মন পিঞ্জর পর্ব-১৯

0
811

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_১৯

আয়ান তৎক্ষনাৎ আয়েশার গাল বরাবর নিজের হাতে একটা তেজি প্রহার করলো যাতে আয়েশা ছিটকে গিয়ে ফ্লোরে পড়লো,মিরা রাহমান ছুটে গিয়ে ওকে ধরলেন।

তারপর আয়ান গর্জিয়ে বলতে লাগলো।

তুই এতোটা নিচে নেমে যাবি আমি কখনো ভাবি নি আয়েশা,তোকে তো আমার বোন বলতেও লজ্জা হচ্ছে আমার।

ভাইয়া বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করি নি,ঐ লোকটা মিথ্যে বলছে,ওসব কিছু মাহির কারসাজি।

আয়েশা উঠে এসে অসহায় ভঙ্গিতে আয়ানকে এসব কথা বললে আয়ান আবারও ওর অন্য গালে প্রহার করে ওকে ঠিক আগের ন্যায় ফ্লোরে ফেলে দেয়,তারপর এগিয়ে গিয়ে ওর চুল মুঠো করে ওকে উঠিয়ে টানতে টানতে ওকে ওর রুমের দিকে নিয়ে যায় আর আঁছড়ে ফেলে ওকে রুমের ভিতর।

আজ থেকে তুই এখানে বন্ধি থাকবি,দুই দিনের মধ্যে আমি তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি,কথাটা বলে আয়ান দরজা বন্ধ করে দেয়,এদিকে আয়েশা দরজা খোলার প্রাণপন চেষ্টায় নিয়োজিত অবস্থায় চিৎকার করে করে বলছে।

আমি কিছু করি নি ভাইয়া,তুমি এমন করো না,আমি পড়ালেখা করতে চাই, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না,তুমি আমায় বিনা দোষে এতোবড় শাস্তি দিয়ো না ভাইয়া।

এদিকে কে শুনে কার কথা,মিরা খানও ছেলের কাছে আর্তনাদের উপর আর্তনাদে ফেঁটে পড়ছেন তবে সেসব কথা পুরোই অযুক্তিকর মনে হচ্ছে আয়ানের কাছে,আয়ান চিৎকার করে মিরা রাহমানকে উদ্দেশ্য করে বললো,আয়েশা এ রুম থেকে বেরুবে না,দুদিনের মধ্যে ওর বিয়ে,এই সমাজে আমার একটা সম্মান আছে আর আমি চাই না আমার সম্মান তোমাদের জন্য ধুলোয় মিশে যাক,তাই ওকে ওই রুম থেকে বের করার কথা ভেবো না মা,নইলে আমাকে অনেক বড় কোনো স্টেপ নিতে হবে যেটা হয়তো তোমাদের দুজনের জন্য ভালো হবে না।
এদিকে ওই ছেলেটাকে আর কিছু না বলেই ছেঁড়ে দিলো আয়ান এই ভাবনায় যে দোষটা তো ওর বোনের নিজের,এটা টেনে বের করতে গেলে নিজে অসম্মানিত হতে পারে তাই।এদিকে আয়ানের বুকে ল্যাপ্টে থেকে এখনও ন্যাকা কান্না করছে মাহি,আর আয়ানের অগোচরে ঠোঁট বাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে।

মিরা রাহমান আর কোনো উপায় না পেয়ে আয়েশার দরজার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন,উনার কি আর করার আছে ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে দরজা খুলে দেওয়ার ক্ষমতাও যে উনার নেই,আজকাল বাচ্চারা বড় হয়ে গেলে যে মা-বাবাকেও তাদের মতে চলতে হয় উক্ত অনুভুতি অনেক পীড়া দান করছে উনাকে।

বেশ খনিক্ষন পর কলিংবেলের শব্দ কানে ভেসে এলো আয়ানের,আয়ান উঠে গেলো দরজা খুলতে, কিন্তু দরজা খোলে এমন কাউকে দেখতে পাবে তা কখনো অনুমানেই আনে নি সে, সয়ং আঁখি দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।উক্ত দৃশ্য মেনে নেবার সুবাদে আয়ান অবাকত্ব নিয়ে এবার আঁখির পানে প্রশ্ন ছুঁড়লো।

আঁখি তুমি?

হ্যাঁ আমি,আসতে তো কখনো চাই নি তবে আসতে বাধ্য করলেন আপনি।

আঁখি কথাটা বলার পর ওর সাইড কাটিয়ে ভিতরে চলে গেলো,তারপর সোজা গিয়া মিরা রাহমানকে বসা থেকে উঠালো উনার চোখের জল মুছে দিয়ে উনাকে স্বাভাবিক করলো তারপর আয়েশাকে বের করলো,আয়েশার গালে যে আয়ানের আঙ্গুলের দাঁগগুলো স্পষ্ট ফুঁটে আছে যা এতোক্ষণে কালো বর্ণ ধারন করেছে,উক্ত হিংস্রতা আঁখির মন কিছুতেই মেনে নিতে বাধ্য হতে পারলো না,বরং নিমিষেই রাগ চড়ে বসলো ওর মাথায়,এদিকে আয়ান ওকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।

এসব তুমি কি করছো আঁখি?তুমি জানো ও কি করেছে?

এবার আঁখি বজ্র কন্ঠে ফেঁটে পড়লো আয়ানের উপর।

আমি সব শুনেছি,ও কি করেছে আর আপনি ওর সাথে কি করেছেন।আপনি অপরিচিত একটা ছেলের কথায় এসে কোনো প্রমাণ ছাড়াই আয়েশার উপর হাত উঠালেন, কোন সাহসে?

ও আমার বোন আর ওর সাথে আমি যাই করি এতে তোমার বলা মানায় না আঁখি।

হুম রাইট মি.আয়ান রাহমান,আপনি চাইলে সবার জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন কিন্তু কেউ আপনার জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না,তাই না?শুনে রাখেন ড.আয়ান,একটা প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের উপর আপনি কোনো উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া হাত উঠাতে পারেন না ওর সাথে কোনো কিছু নিয়ে জোরজবরদস্তি করতে পারেন না,অনেক কিছু ভেবে আমি আজকে আপনার বিরুদ্ধে আইনি স্টেপ নিলাম না,তবে এটা ভাববেন না ভবিষ্যতে ছেঁড়ে দেবো।

দেখছো বেবি ওই আঁখি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে হুমকি দিচ্ছে, আমার তো মনে হয় ওই আঁখিই আয়েশাকে এসব কুপথে যাওয়ার শিক্ষাটা দিয়েছে।

কথাটা শুনেই আঁখি আর দুবার ভাবলো না,এগিয়ে গিয়েই ঠাস করে একটা বসিয়ে দিলো মাহির গালে,যাতে মাহি মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো এবার আঁখি ওর চুল ধরে উঠিয়ে বলতে লাগলো।

কে কাকে কি শিক্ষা দিচ্ছে,কে কি করাচ্ছে তা আমি চাইলে ক্ষনিকে প্রামাণ করে দিতে পারি,তবে তা আমি করবো না কারন আল্লাহর খেলা যে বড়ই অদ্ভুত হয়,আর তোর আর তোর ওই বেবির ভাগের সাজাটা না হয় উনিই দেবেন।

আয়ান এবার এগিয়ে গিয়ে আঁখিকে প্রায় একরকম ধাক্কা দিয়ে মাহির কাছ থেকে ছাড়ালো,এদিকে মাহি রানি আর কি, ন্যাকা কান্না করতে ব্যাস্ত।

_____________

আদৃত ঘরে ঢুকছিলো তখনি ওর ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো,ফোনটা হাতে নিয়েই স্ক্রিনে চোখ বুলালে চিরচেনা একটা নাম্বার চোখে ভেসে উঠলো আদৃতের, আদৃত অল্প সময়ের জন্য হতবম্ভ হয়ে রইলো,তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো,কিছু বলার যেনো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না আদৃত তখন,মুখের সকল ভাষা যেনো ওর বিলুপ্তি পেয়েছিলো সে ক্ষনে,মন পিঞ্জরে একরাশ আশা নিয়ে ফোনটা কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো অপর পাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত কন্ঠটার কিছু মধুর বানী শ্রবনের আশায় ,কিন্তু সে আশাটা আর পূর্ণ হলো না আদৃতের হয়তো ওপর পাশে উপস্থিত থাকা সে জনও কোনো উপযুক্ত ভাষা পাচ্ছিলো না আদৃতকে বলার জন্য,হয়তোবা যথেষ্ট সাহসও ছিলো না বুকে,তাই ফোনটা কেটে দিলো,আদৃত যেনো উক্ত বিষয় মেনে নিতে ব্যার্থ হলো,ফোনটা কেটে গেছে বোধগম্য হওয়ার পর হ্যালো হ্যালো বলছে বার বার,হয়তো মনের সান্ত্বনায়, কোনো জবাব না পেয়ে পাগলপ্রায় হয়ে আবার ফোন করলো কিন্তু ফোনটা এখন অফ যাচ্ছে,এবার বার বার ফোন করতে লাগলো আদৃত কিন্তু সব বারই একই ফলাফল আসতে লাগলো,আদৃতের মস্তিষ্ক যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো সেই ক্ষনে,বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না যে এটা সত্য না শুধুই আদৃতের কল্পনা,তবে জেগে থাকা সত্ত্বেও কল্পনা কি করে দেখতে পারে আদৃত, কিন্তু এই সত্যটাও যে আদৃতের ব্যাকুল মন পিঞ্জর মানতে বরই নারাজ হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে আদৃতের নিজেকে স্বাভাবিক করতে, কোনোরকম নিজেকে স্বাভাবিক করে আদৃত ঘরের পানে অগ্রসর হয়,রুমে গিয়ে দেখতে পায় আঁখি নেই,ভাবে হয়তো দিদুর রুমে আছে কিন্তু একটা কাজবশত আদৃত নিচে নামলে কোনো দিকেই আঁখির কোনো সারা পায় না কেনো যেনো আদৃতের মনে অনেকটা খটকা লাগে কাজ করে,সায়েদা তখন আদৃতের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তখনই ওকে দাঁড় করায় আদৃত।

সায়েদা।

জি ভাইয়া বলো?

আঁখি কোথায়?

কি জানি ভাইয়া,দুজন মিলে পড়ছিলাম তখনি কারো ফোন আসলো,সে ফোনটা রিসিভ করে কথা বলার পর আঁখি কেমন জানি ছটফট করতে লাগলো,তারপর আমাকে বললো ওকে এখনই কোথাও যেতে হবে দিদু ঘুমিয়ে আছে উনি উঠলে উনাকে সামালতে তাই বলে ছুটে কোথাও চলে গেলো।

ওকে তুমি যাও।

চলে গেলো…….কোথায় গেলো?
উক্ত চিন্তা খনিক ভাজ সৃষ্টি হলো আদৃতের ললাটের কোনে।
__________________

মাহি আয়ানের পিছন লুকিয়ে বলতে লাগলো,দেখো বেবি ওই আঁখি আমাকে কিভাবে মারলো,তুমি কোনো প্রতিবাদ করবে না বুঝি?

বেবি, আজ তোর বেবি কেনো তোর বাবাও তোকে বাঁচাতে পারবে না শাঁকচুন্নি।

আঁখি…….এনাফ এটা কোন ধরনের ব্যবহার,তোমার সাহস কি করে হয় মাহির গায়ে হাত তোলার।

আওয়াজ নিচে আয়ান,আমাকে নিজের ফর্মে আসতে বাধ্য করো না,অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করেছি নয়তো একবার আমার মাথা ঘুড়ে গেলে আমি কি করতে পারি তা সম্পর্কে ভালো আইডিয়া তোমাদের দুজনেরই আছে,ভালোয় ভালোয় বলে দিও তোমার ওই বেবিকে শুধরে যেতে নইলে ওকে টেনে বেবি থেকে বড় বানাতে সময় লাগবে না এই আঁখির।
আয়েশা তুই ভয় পাস না যখনি এরা কেউ তোর সাথে আর মায়ের সাথে কিছু করতে আসবে তখনই আমায় ফোন করবি দেখবো কে কি করতে পারে।

তার আর দরকার পড়বে না রে আঁখি,যেখানে আমার সম্মান নেই সেখানে আমি থাকতেও বাধ্য নই,যে ভাই কখনো আমার গায়ে ফোলের টোকাও দেয় নি সে ভাই আজ অন্যের কথায় এসে আমাকে এভাবে প্রহার করলো আমার কথা দ্বিতীয় বার ভাবলো না,সে আর যাই হোক আমার ভাই রয়ে যায় নি, চল এখান থেকে।

আয়েশা নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে যাবার জন্য পুরো তৈরী হয়ে বেড়িয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বললো।
এবার আয়েশা মিরা রাহমানের কাছে গিয়ে বললো।

চলো মা আমি তোমার কাপড়চোপড়ও প্যাক করে নিয়ে এসেছি,আমার সাথে চলো,আমরা নিজেদের একটা জগত গড়ে নিবো যেখানে আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা থাকবে,যেখানে না খেয়ে মরলেও সম্মানের সহিত মৃত্যুটা নসিব হবে।

মা কোথাও যাবে না,তোর যাওয়ার হলে তুই চলে যেতে পারিস,তাছাড়া আর কোথায় যাবি আঁখির মতো কাউকে খোঁজে তার গলায় ঝুলে পড়বি।

কথাটা শুনে আঁখি অতিরাগে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়,বর্তমানে আর আয়ানের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে চায় না ও।
এদিকে মিরা রাহমান আঁচলের কোন দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে এবার ব্যাথা ভরা কন্ঠে বললেন।

না রে বাবা,এই বুড়ির যে তোর মতো সম্মানিত আর বিত্তবান ব্যক্তির ঘরে থাকার তৈফিক নেই,তুই সুখে থাক দূর থেকে চাইবো।

তারপর মিরা রাহমানও ওদের সাথে চলে যেতে নিলে আয়ান পিছন থেকে বলে উঠলো।

যাবার আগে একবার ভেবে নাও মা,এই অর্থ বিত্ত আভিজাত্য আর কোথাও পাবে না,মিছে অভিমানে অবুজের মতো চলে যেও না পরে না আবার পস্তাতে হয়,কারন আর যাই হোক অতি আত্মসম্মান কিন্তু পেটে খাবার জোটাবে না।

এবার এগিয়ে এসে আয়েশা বলে উঠলো।

জানিস ভাইয়া আল্লাহ ধন দিয়ে মন দেখেন,একটা কথা শুনে রাখ ভাইয়া,দিয়ে ধন দেখে মন কেড়ে নিতে কতোক্ষণ, আমরা কখনো তোকে অভিশাপ দেবো না ভাইয়া,তবে উপরওয়ালা যে সবাইকে তার প্রাপ্য সাজাটা দিয়ে থাকেন।তোর ভাগের টাও কতো করুণ হবে সেটা ভেবে এখন থেকেই আমার ভিতর টা মোচড় দিয়ে উঠছে,কোনো দিন প্রয়োজন মনে করলে আসিস,আমরা কখনোই তোকে ফিরিয়ে দিবো না।চলি।

কথাটা বলে চলে গেলো ওরা আঁখির সাথে।

আয়ান আর কিছু না বলে রুমের দিকে প্রস্থান করলো হনহনিয়ে,যেনো এসবে ওর কোনো আসে যায় না,এদিকে ওরা চলে যাবার পর মাহি রাজ্য জয় করা ঠোঁট বাঁকানো হাসিতে মেতে উঠলো।

চলবে…….