বৃষ্টি_এবং_মায়াবতী (৩য় পর্ব)

0
1564

বৃষ্টি_এবং_মায়াবতী
(৩য় পর্ব)

৪.
আসিফ যে সত্যি সত্যিই এতো তাড়াতাড়ি তার কথা রাখবে নীলু ভাবেনি। মাত্র কয়েকমাস পর আসিফের ইন্টার্নি শেষ হতেই বড়মামী যেদিন ওর আম্মাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে আসবেন জানালো নীলু সত্যিই খুব অবাক হলো । আসিফ আগে থেকে তাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি ।

আসিফের মা শায়লা ভীষণ স্মার্ট, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চটপটে মহিলা। তাকে দেখেও ভীষণ ভাল লাগলো নীলুর।
ভদ্রমহিলা বেশ হাসিখুশিও । কী সুন্দর করে হেসেহেসে সবার সাথে কথা বলছেন তিনি । নীলুর মনে হলো শহরের মানুষ হলেও অহংকার নেই উনার মনে । আসিফ তাদের সাথে আসেনি বলে নীলুর অবশ্য একটু মন খারাপ লাগছিল। যাওয়ার আগে শায়লা একটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেলেন নীলুর আঙুলে। আংটির মাঝখানে খুব সুন্দর সবুজ রঙের একটা পাথর বসানো।

এটা নাকি আসিফের উপহার। তার উপার্জনের পয়সায় কেনা।
নীলুর চোখ ভিঁজে উঠলো।

তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হলো দুইমাস পর বৈশাখের তিন তারিখ।

মেহমান চলে যাবার পর নীলু জামাকাপড় পাল্টে শুতে যাচ্ছিল বিছানায় । সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে ।

দিলু এসে তার পাশে বিছানায় বসল।
— আপা, আজ শিরিন আপারা তিন বোন কেমন উঁকি দিয়া দিয়া আসিফ ভাইয়ের আম্মারে দেখতে আছিল.. দেখছ?

— মেহমান আসছে তাই দেখতেছিল হয়তো..।
— না আপা, এরা বারবার মেহমানের ঠিকানা, পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেছিল। ওই তিন বোন আন্টির সাথে খুব ভাব জমাইতে চাইতেছিল দেখলাম। আর ঐ মদখোর জামালের মতলবও ভালো ঠেকতেছে না আমার । খুব দুশ্চিন্তা হইতেছে।

নীলু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চম্পা, শিরিন, লতা তিন বোন তার দূর সম্পর্কের এক চাচার মেয়ে । একই পাড়ায় তাদের বাড়ি। এলাকায় ঝগড়া, কূটনামি, ফ্যাসাদ তৈরিতে নাম আছে এই তিন বোনের। আর তার আপন চাচাতো ভাই নেশা, ভাং করা জামালের স্বভাব তো বরাবরই খারাপ। নির্মম সত্য হলো, কাছের মানুষেরাই অনেক সময় খুব বড় ক্ষতি করে থাকে।

রাতে ঘুমের মধ্যে নীলু বার বার চমকে উঠতে লাগলো।
মধ্য রাতের পর সে ধরফর করে উঠে বসল বিছানায়। আগের সেই অস্থিরতা আবার ফিরে এসেছে তার মধ্যে। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই সেরাতের ঘটনাগুলো সব তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।

প্রায় বছর তিনেক আগের ঘটনা,

সেদিন প্রাকৃতিক কাজ সারতে গভীর রাতে সে একা একা বের হয়েছিল । তাদের টয়লেটটা ছিল বাড়ি থেকে একটু দুরে । ঘর হতে বেরুতেই একজন মানুষ তার নোংরা লালসা পূরণ করতে আচমকা মুখ চেপে ধরেছিল অন্ধকারে । তীব্র ভয়ে জ্ঞান হারানোর আগ মুহুর্তে সেই লোকটার চেহারা সে স্পষ্টই দেখতে পেয়েছিল । কিন্তু সাহস আর প্রমানের অভাবে তার নামটা সেদিন সবার সামনে বলতে পারেনি। আর তার এই বলতে না পারার ব্যর্থতার দায় পড়েছিল অন্য একজন হতভাগ্য নিষ্পাপ মানুষের উপর। যাকে সহ্য করতে হয়েছিল অমানসিক নির্যাতন।

দিলুর ঘুম ভাঙলো কান্নার শব্দে। নীলু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। দিলুকে তাঁকাতে দেখে নীলু ফিসফিস করে বললো,
— আলম স্যারের জীবনটা আমার জন্যই শেষ হয়ে গেল। সেদিন আমি আসল সত্যটা সবার সামনে বলতে পারি নাই। আমি পাপ করছি দিলু….আমি মহাপাপী।

নীলু ঠকঠক করে কাঁপছে। নীলুর এই আচরনের সাথে দিলু পরিচিত। সেরাতের কাহিনীর পুরোটাই সে জানে । দিলু কথা না বলে সারারাত নীলুকে জড়িয়ে ধরে জেগে বসে রইলো।

৫.
শায়লা স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাওয়া শেষ করেন দুইটা, আড়াইটার মধ্যে। তারপর লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠে বিকালে চা খান। আজও ঘুমানোর আয়োজন করছিলেন। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুললেন। দরজার সামনে অপরিচিত তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। তিনি নিজের বিস্ময় আঁড়াল করে বললেন,
—- তোমরা কি আমার কাছে এসেছ ?
মেয়ে তিনটি মাথা নাড়লো। তাদের থেকে একজন বললো,
— আপনার সাথে আমাদের খুব জরুরি একটা কথা আছে।
— কিন্তু আমি তো তোমাদের ঠিক চিনতে পারছি না।
–মুক্তাগাছায় ইদ্রিস মোল্লার বাড়িতে আপনে আমাদের দেখছেন। হয়তো খেয়াল নাই।

প্রায় মাসখানেক আগে ছেলের অনুরোধে শায়লা মুক্তাগাছা গিয়েছিলেন ঠিক। তার একটাই ছেলে বিয়ের ব্যাপারে তার পছন্দই প্রধান। তবে সেখানেই এই মেয়ে তিনটিকে দেখেছিলেন কিনা তার ভালো মনে পড়লো না।
— আমরা নীলুর বোন। নীলু সম্পর্কে আমাদের চাচতো চাচার মেয়ে হয়। আমাদের বাড়ি একই পাড়ায় । ওর সম্পর্কেই একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার মনে করলাম। না হলে ঠকানো হয়।
শায়লা এখন কৌতুহলবোধ করছেন। তিঁনি দরজা ছেড়ে দাড়ালেন।
—- এসো, তোমরা ভেতরে এসে বসো।

****
মেয়েগুলো চলে গেছে প্রায় আধ ঘন্টা হলো। শায়লা বজ্রাহতের মতো চেয়ারে বসে আছেন। মেয়েগুলো যা যা বলে গেছে তা যদি সত্যি হয় নীলুর সাথে আসিফের বিয়ে হবার প্রশ্নই উঠে না। তিনি আসিফকে বুদ্ধিমান ছেলে বলে জানতেন। নিজের ছেলের বুদ্ধির উপর ভরসা ছিল তার। এখন মনে হচ্ছে ভরসা রাখা ভুল হয়েছে। তিনি দ্রুত আসিফকে ফোন করলেন। তাকে পুরো ঘটনা জানানো দরকার।
তার বড় বোনের মেয়ে শ্যামা শহরের এক কলেজে অনার্স পড়ছে। বড় আপার খুব ইচ্ছে ছিল তিনি যেন শ্যামাকে পুত্রবধূ করেন। দুলাভাই স্ট্রোক করে বিছানায় শয্যাশায়ী আছেন কয়েক বছর ধরে। ছেলের পছন্দের কথা ভেবে শায়লা এতো দিন পাত্তা দেননি। এখন ঠিক করেছেন ঘটনা যদি সত্য হয় তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসিফের সাথে শ্যামার বিয়েটা দিয়ে দিবেন। সম্ভব হলে এই সপ্তাহের মধ্যেই ।

৬.
ভর দুপুরে আসিফ নেমেছে মুক্তাগাছা বাস স্ট্যান্ড। সে এসেছে নীলুর সাথে দেখা করতে । নীলুর মুখ থেকেই সে সত্যিটা জানতে চায়। তার দৃঢ় বিশ্বাস সে যা কিছু শুনেছে পুরোপুরি ভুল। ফোনে নীলুকে এসব জিজ্ঞেস করা যেত কিন্তু তার ইচ্ছা সামনাসামনি সব ফয়সালা করা। ইচ্ছে করেই সে কাউকে আগেভাগে তার আসবার খবর জানায়নি।

জামাল স্টেশনের কাছেই চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছিল। প্রায়দিন নেশা-ভাং করে তার বাড়ি ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত হয়। সে লেখাপড়া তেমন করেনি, কাজেকর্মেও মন নেই তার । কাল রাতে নেশা করে ঘরে ফিরেছে প্রায় শেষ রাতে । ঘুম থেকে উঠেছে এই দুপুরবেলা তারপর এইখানে এসে বসেছে।
দুর থেকে সে দেখলো আসিফ বাস থেকে নেমে অন্যমনস্কভাবে হেঁটে হেঁটে নীলুদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে।
ঘটনা কী..? দুইদিন পর বিয়ে… এখন তো ডাক্তার সাহেবের এখানে আসবার কথা নয় ! সে বড় বড় পা ফেলে দ্রুত হেঁটে আসিফকে ধরে ফেললো। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে খুঁক খুঁক করে কাশতে লাগলো ।
আসিফ ঘুরে তাকালো।

জামাল হাসি হাসি মুখ করে বললো,
—ভাইসাব কেমন আছেন ? আমারে চিনছেন? আমি জামাল।
আসিফ চিনতে পারলো। নীলুর বড় চাচার ছেলে। সে মৃদুস্বরে বললো,
— কেমন আছেন জামাল ভাই ?

— আর থাকা। চাচী সেদিন বলতেছিল টাংগাইল শহরে নতুন চাকুরীতে নাকি যোগদান করছেন?
—- হুমম। আপাতত সেখানকার এক হাসপাতালে আছি।
— সামনে বিবাহ শুনলাম। তা ভাইসাবের মুখটা এতো শুকনা লাগতাছে ক্যান ? সব ঠিক আছে তো ?

আসিফ অন্যমনস্কভাবে বললো,
— আচ্ছা, নীলুদের বাড়িতে কি কোন মাস্টার সাহেব থাকতেন?
জামাল গাল চুঁলকে বলল,
—- একজন জায়গীর মাস্টার আছিলেন। এতীম ছেলে। বাবা, মা আছিল না। ছাত্র ভালো, কলেজে পড়ত। থাকত নীলুদের সামনের ঐ ছোট ঘরে।
— উনার নাম ছিল আলম তাই না ?
— পুরা নাম আছিল জাহাংগীর আলম। কিন্তু সবাই ডাকত আলম স্যার। সে নীলু, দিলুরে পড়াইতো।

— তিনি এখন কোথায় আছেন জানেন কিছু?

জামালকে হঠাৎ খুব আনন্দিত মনে হলো। সে অতি দ্রুত সেটা গোপন করে মুখটা গম্ভীর, দুখী দুখী করে ফেললো,

— ছেলের লাশ পাওয়া গেছিলো ঐ পশ্চিম দিকের ধান ক্ষেতে। কে মারছে প্রমান হয় নাই। তবে দুক্ষের কথা….. সবাই বলাবলি করে এতে নাকি চাচা মানে নীলুর বাপের হাত আছে।

— নীলুর বাবা..! কেন ?

—- সেটা আপনে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন ভাইসাব। আমি অতশত জানি না। তাছাড়া সবই রটনা সেসব বলতেও চাই না।

আসিফ চিন্তিত মুখে বললো,
— অসুবিধা নাই। রটনাগুলোই আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।
জামাল গলার স্বর আরেক ধাপ নামিয়ে বললো,
—- সবাই বলে ঐ নীলুর সাথে স্যারের ফষ্টিনষ্টি মানে প্রেম আছিল। ঘটনার দুইদিন আগে নীলুরে মধ্য রাতে পাওয়া গেছিলো জায়গীর স্যারের ঘরে। জ্ঞান আছিল না।

আসিফ চুপ করে আছে। জামাল নিজের জিভ কেটে বললো,
— এগুলা খুবই শরমের কথা। আপনারে বলা ঠিক না। কিন্তু একেবারে লুকানোও অনুচিত। আমি আবার সত্য কথা লুকাইতে পারি না।

আসিফের নিজেকে বিরাট বোকা মনে হচ্ছে । এভাবে অচেনা কাউকে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা তার খুবই ভুল ছিল বোঝা যাচ্ছে। মা তাহলে ভুল বলেননি। সবই তো হুবহু মিলে গেল। মেয়েটির স্বভাব তাহলে আসলেই খারাপ। শুধু শুধু সে কষ্ট করে এতোটা পথ এসেছে। নীলু তার অতীত নিয়ে কিছুই তাকে বলেনি।
সে নীলুর প্রতি এখন তীব্র বিতৃষ্ণাবোধ করছে ।

আসিফের মনে হলো নীলুর সাথে দেখা করার আর প্রয়োজন নেই। যা জানার তার জানা হয়ে গেছে ।
সে ঘুরে বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্য আবার হাঁটতে শুরু করলো।

****
জামাল অনেক চেষ্টা করেও নিজের মনের আনন্দ লুকাতে পারছে না। একটু পর পর তার হাসি এসে যাচ্ছে। সে খুশিতে পর পর চার কাপ চা খেয়ে ফেলল। শিকার এতো সহজে এভাবে টোপ গিলবে তার ধারণাতীত ছিল। জামাল আবারও মনে মনে হাসলো। নীলুর খুব অহংকার হইছিল। যাহ, আরও বেশি করে বিয়া কর। জামাল মনে মনে কুৎসিত একটা গাল দিল।

৭.
আসিফের অনত্র বিয়ে করার সংবাদ ইদ্রিস মোল্লার কানে পৌঁছতে বেশী দেরী হলো না। ভয়ংকর অপমানে তার শরীর কাঁপতে লাগলো…..।

চলবে—-
© মাহবুবা আরিফ সুমি

তিন পর্বে গল্পটি শেষ করতে চেয়েছিলাম। লিখতে গিয়ে গল্পটি চার পর্ব হয়ে গেছে।
**** সামনের পর্বে গল্পটি শেষ হবে। সাথে থাকবেন।