অনুভবে তুমি পর্ব-১১

0
737

#অনুভবে তুমি
#পর্ব_১১
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

পুরো শহর জুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।একের পর এক খুন রাহাজানি, কে করছে এই খুন?বা কারা জড়িত,এখন পর্যন্ত তাদের কেউ ধরতে পারছে না।কারন খুনিরা এমন নিঁখুতভাবে সব খুন করছে যার কোনো প্রমাণই নেই।তবে যারা যারা এই খুনি কে দেখেছে তাদের বর্ণনার সাথে অতশীর দেখা সেই সন্ত্রাসীর পুরো মিল আছে। পুলিশের ধারণা এর সাথে কোন গ্যাং জড়িত আছে।তা না হলে একা কারো পক্ষে এতো খুন করা সম্ভব না।পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সেজন্য সেই সন্ত্রাসীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু অতশী সেই ছেলেকে কোনোভাবেই সন্ত্রাসী বলতে পারছে না।সে গণমাধ্যমের সামনে স্পষ্ট বলে দিয়েছে,আজ আমি বেঁচে আছি শুধুমাত্র সেই মানুষ টার জন্য,তা না হলে আজ আমার নগ্ন মৃত্যুদেহ সবাই দেখতে পারতো।সেজন্য আমার চোখে সে কখনোই খুনী হতে পারে না।

শুধু শহর জুড়েই আতঙ্ক সৃষ্টি হয় নি।আতঙ্ক এখন ভার্সিটিতেও ছড়িয়ে পড়েছে।ভার্সিটিতেও এখন একের পর এক খুন হচ্ছে।বিশেষ করে ভার্সিটির নির্বাচনের আগে অগনিত লাশ পাওয়া যাচ্ছে।ছাত্র নেতা আহসান কে কেউ কিছুই বলছে না,অথচ তার দিকেই সবার আগে আংগুল তোলা উচিত।পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট একদম হাত পা গুঁটিয়ে বসে আছে।কারন তাদের কে মোটা অংকের টাকা দিয়ে থামিয়ে রেখেছে আহসান বাহিনী।তমাল ছিলো আহসানের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী,তবুও আহসানকে ধরা হলো না।বিনা অপরাধে শাস্তি ভোগ করছে অয়ন। তমাল মারা যাওয়ায় আহসান এবার ফাঁকা মাঠে গোল দিবে।কারন আহসানের বিপক্ষে কেউ ভোটে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না।তবুও নিয়ম বলে একটা কথা আছে।সেজন্য আজ সকল স্টুডেন্ট দের কে ভার্সিটির মাঠে ডাকা হয়েছে।আজ ফাইনাল ডিসিশন নেওয়া হবে।কে হবে এবার আহসানের প্রতিদ্বন্দ্বী?

ভার্সিটির সকল ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট মাঠে চলে গেলো।অতশী আর তার বান্ধুবীরাও চলে গেলো।কারন সবাই বেশ এক্সসাইটেড।কে হবে এবার আহসানের প্রতিদ্বন্দ্বী? হঠাৎ অতশী খেয়াল করলো ইভান আর তার বন্ধুরা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।হয় তো আলোচনা শুরু হলে তারপর আসবে ওনারা।হ্যাঁ তাই হলো।আহসান আর তার সহচরী রা মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই ইভান আর তার বন্ধুরাও সভায় যোগ দিলো।
ছাত্রনেতারা নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে লাগলো।এক পর্যায়ে সহ সভাপতি বললো,এখন পর্যন্ত কেউ এপ্লিকেশন জমা দেয় নি। আজ কেই শেষ দিন।যে বা যারা আহসানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী তা করতে চাও তারা তারা এপ্লিকেশন জমা দাও।এর পর আর এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে না।
কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না।সবাইকে এভাবে চুপচাপ থাকা দেখে আহসানের সহচরী রা জোরে করে চিল্লিয়ে উঠলো,জয় আহসান ভাইয়ের জয়।জয় আহসানের ভাইয়ের জয়।আহসান ভাই যেখানে আমরা আছি সেখানে।

অতশী হঠাৎ তার বান্ধুবীদের বললো,আচ্ছা ইভান ভাইয়া তো বেশ পরিচিত।কম বেশি সবাই ওনাকে চেনে।উনি কিন্তু আহসানের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারেন।আমি নিশ্চিত উনি জিতবেন।কিন্তু দাঁড়ালেন না কেনো?

লিশা সেই কথা শুনে বললো, সবাই এসব রাজনীতি পছন্দ করে না।তাছাড়া আহসান সন্ত্রাস টাইপের।শুনেছি ও নাকি মানুষ খুন করে।তমাল কে খুন তো ওই করেছে।শুধু তমাল না যে ওর বিপক্ষে দাঁড়াতে চাইবে সেই খুন হবে।ইভান ভাইয়া হয় তো ভয়েই দাঁড়াচ্ছে না।

অতশী তখন বললো,আমার কিন্তু তেমন টা মনে হচ্ছে না।ইভান ভাইয়া মোটেও আহসান কে ভয় পায় না।এর পিছনে অন্য কোনো রহস্য আছে।

–কি রহস্য?

–তা আমি কি করে জানবো?আমার যেটা সন্দেহ হচ্ছে সেটাই বললাম।

আলোচনা সভা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইভান আর তার বন্ধুরা চলে গেলো।হঠাৎ অতশী তার বান্ধুবীদের বললো,তোরা একটু দাঁড়া।আমি যাবো আর আসবো।
এই বলে অতশী ইভানের কাছে চলে গেলো।

–আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।কেমন আছেন?

ইভান অতশীকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো।এ মেয়ে কেনো এভাবে তার পিছু পড়ে আছে?ইভান কোনো উত্তর দিলো না।
কিন্তু ইভানের বন্ধু দিশান বললো,তুমি আবার এসেছো?

–জ্বি ভাইয়া।আসতে হলো।আর আমি এভাবে আসতেই থাকবো।যতদিন উনি আমাকে খাতা কলমে লিখে না দেবেন।
অতশীর কথা শুনে নীলয় বললো,দোস্ত দে তো লিখে।তাহলেই তো মেয়েটা আর পিছু নেয় না।সবসময় ভালো লাগে না এসব।

ইভান সেই কথা শুনে অতশীর হাত থেকে খাতা আর কলম টা নিলো।

–ওমা!আপনি দেখি বামহাতি!আপনি কি সবকাজ বাম হাত দিয়েই করেন?

ইভান এতোক্ষনে কথা বলে উঠলো।বেশি বকবক না করে তাড়াতাড়ি করে কেটে পড়ো।কি সিরিয়াস মেয়ে তুমি।শেষমেষ আমার কাছে লেখে নিলে তো ছাড়লে?খবরদার!এমন ভুলভাল আবদার আর কখনোই করবে না।ভুলে যেওয়া না আমি এই ভার্সিটির বড় ভাই।

–হ্যাঁ তা তো দেখতেই পারছি।আপনারা কেমন বড় ভাই।আহসান ভাইয়া ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে দিলো।আর আপনারা কেউ ওনার বিপক্ষে দাঁড়ানোর সাহস পর্যন্ত পেলেন না।কি ভীতু আপনারা?

ইভান সেই কথা শুনে রাগে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে গেছে সে।শুভ্র,নিলয়,দিশান ও রেগে গেলো।কিন্তু তারা অযথা কোনো কথা না বলে ইভানের হাত ধরে সেখান থেকে চলে গেলো।

অতশীর ভীষণ খটকা লাগলো।এভাবে অপমান করাতেও এরা কোনো কিছুই বললো না।অন্তত ইভানের তো কিছু বলা উচিত ছিলো।অতশী তখন তার হাতের খাতাটা উপর করে ধরলো আর জোরে জোরে করে বললো,ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভার্সিটির বড় ভাইয়ের লেখা এমন বাজে কেনো?ভেবেছিলাম হাতের লেখা অনেক সুন্দর হবে!কিন্তু একি?
কথাগুলো বলেই অতশী সেখান থেকে চলে গেলো।

ইভান এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না।সে দৌঁড়ে এসে বললো,এই মেয়ে দাঁড়াও!কি বললা তুমি!আমার হাতের লেখা বাজে!
অতশী কিছু বলার আগেই শুভ্র এলো সেখানে,সে ইভানের হাত ধরে বললো দোস্ত বাদ দে তো এসব মেয়েদের কথা।আমাদের অনেক কাজ আছে কিন্তু।এই বলে সে ইভান কে পাঠিয়ে দিলো।আর অতশীকে বললো,তোমার কাজ হয়ে গেছে?যাও এখন।আর কোনো সময় যেনো আমাদের কাছে আসতে না দেখি?তখন ব্যাপার টা ভীষণ খারাপ হয়ে যাবে?কারন দুই দিন থেকে আমি তোমার বেয়াদবি দেখতিছি।ইদানীং তোমার অনেক সাহস বেড়ে গেছে।সো বি কেয়ারফুল।

অতশী সেই কথা শুনে আবার হাঁটা শুরু করলো।তবে শুভ্রর কথা শুনে সে আজ ভীষণ লজ্জিত হলো।এইভাবে তাকে অপমান করতে পারলো!আর অপমান তো করারই কথা!নিজের থেকে যেচে যেচে কথা বললে সবাই তাকে সস্তায় ভাবে।সে কেনো এমন করছে?কেনো বার বার ইভানের কাছে ছুটে যাচ্ছে সত্যি সে নিজেও বুঝতে পারছে না।

অতসী কি মনে করে যেনো পিছন ফিরে তাকালো।পিছনে তাকাতেই দেখে ইভান ও তার দিকেই দেখছে।অতশী তা দেখে আর মুখের হাসি আটকাতে পারলো না।মুচকি একটা হাসি দিয়ে উঠলো।ইভান তা দেখে ভীষণ লজ্জা পেলো।সে সাথে সাথে তার চোখ ফিরিয়ে নিলো।কারণ সে কখনোই এটা আশা করে নি যে অতশীও তার দিকেই তাকাবে।

অতশী আর ইভানের এমন চোখাচোখি দেখে তার বন্ধুরা হা করে তাকিয়ে রইলো।তারা একবার ইভানের দিকে দেখছে তো আরেকবার অতশীর দিকে।তারা কিছুই বুঝতে পারছে না।আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এটাই ইভান যে বাম হাত দিয়ে লেখে এটা তারা ফাস্ট দেখলো।
–তোরা এভাবে কি দেখছিস আমার দিকে?
দিশান সেই কথা শুনে বললো দোস্ত তুই কি লুকাচ্ছিস কিছু?
–কি লুকাবো?তোরা একটু বেশি বেশি বুঝিস।চল আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
শুভ্র তখন বললো,আচ্ছা ওসব কিছু বাদ দে তো তোরা?তার আগে ইভান একটা কথা বল,তুই কবে থেকে বাম হাত দিয়ে লিখছিস?না মানে তুই কি আজকাল বাম হাত দিয়ে খাবারও খাচ্ছিস?
–ছিঃ কি বলছিস এসব?বাম হাত দিয়ে খেতে যাবো কেনো?
–তাহলে বাম হাত দিয়ে লিখলি কেনো?তোকে তো কখনো বাম হাত দিয়ে লিখতে দেখি নি।
–ডান হাত কাটা গিয়েছে।সেজন্য বাম হাত দিয়ে লিখলাম।সিম্পল ব্যাপার।
–কই দেখা দেখি?এই বলে ইভানের ফ্রেন্ডরা ডান হাত দেখতে লাগলো
হ্যাঁ আসলেই তো।ইভানের ডান হাত কাটা গিয়েছে।

অতশীর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করলেও অতশীর কিছুতেই মন বসছে না। সে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে দেখছে আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে।তার অয়ন ভাইকে কিভাবে নির্দোষ প্রমান করা যায় আর কিভাবে তার মুখ,,,,,এই কথা টা মনে হতেই অতশী লিশাকে বললো,দোস্ত একটা হেল্প করতে পারবি?
–কি?
–কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে কিন্তু সেটা যদি প্রকাশ না করে তাহলে কিভাবে তার মুখ থেকে কথাটা বের করা যায়?
–আগে বল মানুষ টা কে?কার মুখ থেকে কথা বের করতে হবে?
–পারবি কিনা বল?না পারলে বল?

হঠাৎ অতশীর টিচার বললো,ইউ?স্ট্যান্ড আপ?কথা বলছো কেনো?
অতশী ধীরে ধীরে দাঁড়ালো।আর বললো না স্যার। বলছি না।
–আমি দেখলাম তোমরা দুইজন কথা বলছো।
আর তুমিও দাঁড়াও।
লিশা দাঁড়িয়েই বললো,আসলে স্যার আমরা পড়া নিয়েই আলাপ আলোচনা করছিলাম।অতশী বুঝতে পারছে না তাই আমার কাছে জানতে চাচ্ছে।
অতশী তখন লিশাকে একটা চিমটি কেটে বললো,সবার সামনে কি বললি এটা?
–তো কি বলবো?
স্যার তখন বললো, কি হচ্ছে এসব?তোমরা আবারো কথা বলছো?

হঠাৎ ক্লাসরুমে অতশীদের ডিপার্টমেন্টের দপ্তরি আসলো।তিনি এসেই বললেন,স্যার আসসালামু আলাইকুম।বিজ্ঞপ্তি টা স্টুডেন্ট দের শুনিয়ে দেওয়ার জন্য আসলাম।
–কিসের বিজ্ঞপ্তি?
–ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট দের বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটা প্রোগ্রাম এর আয়োজন করা হয়েছে।প্রোগ্রাম টা তিন দিন পরেই হচ্ছে।
–ওকে জানিয়ে দাও সবাইকে।

দপ্তরি নোটিশ টা পড়ে শুনালো সবাইকে। আর বললো অবশ্যই সবাই এটেন্ড থাকবে।আর তোমরা কেউ যদি প্রোগ্রাম উপলক্ষে নাচ,গান বা অন্য কিছু দিতে চাও তাহলে তার একটা লিস্ট তৈরি করে ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিও।

এদিকে অতশী আর লিশা এই সুযোগে দুইজনই বসে পড়েছে।কারন নোটিশ টা শোনার পর ক্লাসে একদম হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। স্যার তখন বললো আজ ক্লাস এখানেই অফ করলাম, কেউ যদি প্রোগ্রাম এ এটেন্ড করতে চাও অবশ্যই জানিয়ে দেবে।এই বলে স্যার চলে গেলো।

অতশীর বান্ধুবী নেহা আর লিশা ভীষণ এক্সসাইটেড।কারন তারা ঠিক করেছে প্রোগ্রাম এ অংশগ্রহণ করবে।নেহার গানের গলা ভীষণ সুন্দর।আর লিশা নৃত্য পারে।বিশেষ করে হিন্দি গানের তালে তালে তার ডান্স সেই সুন্দর হয়! প্রোগ্রাম নিয়ে অতশীর কোনো মাথাব্যথা নেই।কারন সে নাচ গান কিছুই পারে না।তবুও সেও ভীষণ এক্সসাইটেড।

অতশী আজ ভীষণ উৎফুল্ল মন নিয়েই বাসায় প্রবেশ করলো।কিন্তু বাসায় ঢুকতেই দেখে সবাই একসাথে বসে আছে।অতশীর আম্মু কাঁদছে আর তার দাদী তাকে শান্ত্বনা দিচ্ছে।মুহুর্তের মধ্যে অতশীর সব আনন্দ মাটি হয়ে গেলো।সে তার আম্মুর কাছে গিয়ে বললো,কি হয়েছে আম্মু?কাঁদছো কেনো?
অতশীর আম্মু সেই কথা শুনে অতশীর গলা ধরে বললো,অয়নের সাজা বেরে গেছে।কারন অয়নের পক্ষে কোনো সাক্ষী নাই।
তানিম তখন বললো, আসলে এটা সব ছাত্র নেতা আহসানের হাত।ওর ভয়ে কেউ সাক্ষী দিচ্ছে না।কারন অয়ন নির্দোষ প্রমাণ হলে পুলিশ আবার নতুন করে তদন্ত শুরু করবে।

অতশী তখন বললো আচ্ছা তানিম ভাইয়া আমাকে একটু ভাইয়ার সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবেন?ভাইয়াকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।
তানিম সেই কথা শুনে বললো, আন্টিকেই আজ দেখতে দেয় নি।তোমাকেও হয় তো দেবে না।তবে আমি চেষ্টা করছি।যে করেই হোক দেখা করাবো।

#চলবে,,,,,,,