তুমিময় আসক্তি পর্ব-২৩

0
1162

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“২৩”

–“” দোলা আর তানিয়া রেডি হচ্ছে সজলের বাড়ি যাওয়ার জন্য। তানিয়া জাহির চৌধুরীকে বলেছে তার ফ্রেন্ডের বাড়ি ইনভাইটে যাবে৷ দোলাকেও নিয়ে যেতে বলেছে। জাহির চৌধুরী সরল মনে তানিয়ার কথা বিশ্বাস করে নিয়েছেন। কিন্তু রুদ্র যেনো না জানে এটা জাহির চৌধুরীই সতর্ক করে দেন ওদের৷

–” দোলা আর তানিয়া সজলের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি নিয়ে থামে। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে তাকাতেই দুজন হা হয়ে যায়।

–” বউমনি এত বড় বাড়ি উজবুকটার। দেখে তো মনে হয় খুব সাধারণ ঘরের ছেলে কিন্তু এতো দেখি আমাদের চেয়েও বড় বাড়ি অবাক হয়ে বলে তানিয়া। দোলা মুচকি একটা হাসি দেয় শুধু। তবে সেও অবাক সজলের বাড়ি দেখে।

— সজলের বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট। কিন্তু অনেক বড় আর অনেক সুন্দর। অফ হোয়াইট কালার করা সম্পুর্ণ বাড়ি। সামনে ফুলের বাগান করা আর সেখানে অনেক ধরনের ফুল গাছ আছে৷

–” দোলা আর তানিয়া তাদের কৌতুহলটা দমিয়ে ভেতরে যায়।

— সজল তার ঘরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। মুলত দোলারে জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কারণ তানিয়া তো বলেছে তারা দুপুরে আসবে। দোলা আর তানিয়াকে দেখে সজল মুচকি হেসে নিচে নেমে আসে।

–“” সদর দরজার সামনে আসতেই সজলের সাথে দেখা হয় তাদের৷ সজল ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলে ওরাও তার পরিবর্তে একটা হাসি উপহার দেয়। তানিয়ার হাতে একটা গিফটের প্যাকেট।

–” ভেতরে আসুন আপনারা। সে কখন থেকে অপেক্ষা করছি আপনাদের জন্য। এতখনে আসার সময় হলো আপনাদের হাস্যমুখে বলে সজল।

— জ্বি রেডি হয়ে আসতে দেরি হয়ে গেলো একটু বিনয়ী হয়ে বলে দোলা। সজল তানিয়ার দিকে এবার পূর্ণ দৃষ্টি রাখে। তানিয়াকে অনেক সুন্দর লাগছে আজ।
–” দোলা একটা কালো থ্রিপিস পড়েছে সাথে হিজাব করা। দোলা থ্রি পিস পড়ে সচারাচর বের হয়না৷ যেখানে যায় বোরকা পড়ে যায় সে। আজ তানিয়ার জোরাজোরিতে থ্রি পিস পড়েছে৷ কিন্তু দোলাকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে কালো রঙে।
–” তানিয়া হোয়াইট ড্রেস পড়েছে। সম্পুর্ণ হোয়াট ড্রেস হওয়াতে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে তানিয়াকে। তানিয়ার চুল গুলো বেশ লম্বা আছে দোলার মতোই। খোলা চুল লং ড্রেস গালে টোল সব কিছু মিলিয়ে অনেক সুন্দর লাগছে তাকে।

–‘ তানিয়া সজলের তাকানো দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মুচকি হাসি দেয় একটা। দোলা এদের কান্ড দেখে মুচকি হাসে আড়ালে৷
–” আরে দাঁড়িয়ে কেনো আপনারা বসুন বলে সজল দোলারে বসতে বলে। দোলা একটা সোফায় বসলে তানিয়া গিফট হাত দাঁড়িয়ে আছে। সজল তানিয়ার থেকে গিফটের প্যাকেট টা নিয়ে অন্য জায়গায় রাখে। এরপর তানিয়াও দোলার পাশে গিয়ে বসে।

—”’ আপনারা যে আমার কথা রেখেছেন এর জন্য সত্যি অনেক খুশি হয়েছি আমি। পরিচয় টা দুদিনের হলেও আপনাদের অনেক আপন ভেবে নিয়েছি। তাই না আসলে খারাপ লাগতো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে সজল।

–”দোলা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে আচ্ছ এত বড় বাড়িতে কি আপনি আর আপনার মনিমায় থাকেন? আর কাউকে তো দেখছি না কৌতুহলী হয়ে বলে দোলা।।
–‘ আবার বাবা থাকতেন আমাদের সাথে তিনি মারা গিয়েছেন গত তিন বছর। এরপর আমি মনিমাই থাকি আপাতত। আর সার্ভেন্ট আছেন মনিমার দেখাশোনা করার জন্য। আমি তো সব সময় বাসায় থাকতে পারিনা। অফিস সামলিয়ে যতটা পারি মনিমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। একমাত্র সে ছাড়া আর তো কেউ নেই আমার দুনিয়াতে। মনটা খারাপ করে বলে সজল শেষের কথাটা।

–‘ দোলা আর তানিয়াও খারাপ লাগে সজলের কথায়।

–‘ আচ্ছা যার জন্য এখানে আসা কোথায় সে? ডাকুন আপনার মণিমাকে। প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলে তানিয়া।

–“” জ্বি আসছে মনিমা আপনারা ততখনে নাস্তা করুন প্লিজ বলে রুদ্র নাস্তার ট্রে’টা এগিয়ে দেয় ওদের দিকে।

–” দোলার কেনো জানি খুব অস্থির অস্থির লাগছে ভেতরে। মনে হচ্ছে তার পরিচিত কেউ তার আশেপাশে আছে৷ হঠাৎ এমন অনুভব হওয়ার কারণ দোলা বুঝতে পারছে না। দোলার কেনো জানি সজলের মনিমাকে দেখতে খুবই ইচ্ছে করছে। দোলা বারবার উপরে তাকাচ্ছে। কখন আসবে তিনি সেই অপেক্ষায় সময় পার করছে।

-”’ সজল আড়চোখে তানিয়ার দিকে তাকায়। তানিয়াও লাজুক চোখে তাকিয়ে বারবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷ কিন্তু এদিকে দোলার ভেতরে ছটফট করছে মনিমা দেখার জন্য।

–”’ একজন সার্ভেন্ট একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে আসে৷ দোলা কৌতুহলী চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

–” বয়সের ছাপ বিদ্যমান কিন্তু এখনো চেহারায় উজ্জ্বলতা কমেনি তার৷ অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। কিশোরী কালে যে অনেক সুন্দরের অধিকারী ছিলেন সেটা এখনো বহমান আছে৷ চোখে চিকন ফেমের চশমা একটা। সাদা শাড়ি কালো পাড়৷ মাঝখান দিয়ে সিঁথি। অনেক গোছানো পরিপাটি একজন মানুষ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷

–‘ সজল রত্না চৌধুরীকে দেখে হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে এসো মনিমা। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই বলে সজল হুইলচেয়ার ধরে নিয়ে আসে। রত্না চৌধুরী হাসি মুখে তাকায় দোলা আর তানিয়ার দিকে। কিন্তু তানিয়া অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ মুখে বিষ্ময়ের ছাপ বিদ্যমান। চমকানো চোখে তাকিয়ে বলে মামি। তানিয়ার কথায় দোলা আঁতকে উঠে বলে কি বলছো তানিয়া৷ উনি সজলের মনিমা।

–‘ তানিয়া করুণ চাহনি নিয়ে তাকায় দোলার দিকে। আর দোলা এখনো কৌতুহলী পূর্ণ চোখে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

–‘ তানিয়া দোলার হাত চেপে ধরে। দোলা অবাক হয় তানিয়ার কাজে।

— কি হয়েছে তানিয়া? তোমার কি শরীর খারাপ করছে। তানিয়া সোফায় বসে পড়ে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে।
তানিয়া এখনো শকড কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সে কি সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন।
–‘ তানিয়া কি হয়েছে৷ কোনো সমস্যা? ঘাবড়ানো কন্ঠে বলে দোলা ফিসফিস করে তানিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ।

–‘ তানিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলা বউমনি এটা আমার মামি। ব্রোর মা। তানিয়ার এতটুকু কথায় যথেষ্ট ছিলো দোলাকে শকড দেওয়ার জন্য। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রত্না চৌধুরীর দিকে।

–‘ তুমি কি শিওর উনি তোমার ভাইয়া মানে ছোট সাহবের মা?

–‘ হ্যাঁ বউমনি আমি একদম শিওর। আমি মামার আলমারিতে একটা ছবি দেখেছিলাম অনেক দিন আগে। আর ইনি ছিলেন সেই ছবিতে। তুমি বিশ্বাস না হলে দেখো মামুর আলমারিতে গিয়ে।

–‘ দোলা ঘামতে শুরু করে দেয়। এখানে উনি কি করে আসলো? সজলের সাথে উনার কি সম্পর্ক দোলা বুঝতে পারছে। তাছাড়া উনার এমন অবস্থা কেনো? চলতে পারেন না৷ কি হয়েছিলো? তানিয়াও এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে৷ এখানে এসে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ভাবিনি তারা।

–‘ সজল আর রত্না চৌধুরী হাসি মুখে এগিয়ে আসে।

–” দোলা আর তানিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে মুখে জোরপুর্বক হাসি নিয়ে আসে৷ রত্না চৌধুরী মুগ্ধ নয়নে দোলার দিকে তাকিয়ে আছে৷

–” মনিমা পরিচয় করিয়ে দিই৷ এনি দোলা চৌধুরী দোলাকে দেখিয়ে বলে সজল। দোলা একটা হাসি দিয়ে সালাম দেয়। এরপর তানিয়াকে দেখিয়ে বলে ইনি তানিয়া আহমেদ৷ তানিয়াও কাঁপা গলায় সালাম দেয়।

–“” কি ব্যাপার তোমরা এত ঘামছো কেনো? শরীর খারাপ করছে কি? রত্না চৌধুরী বলেন ওদের দেখে।

-‘ না না আন্টি আমরা ঠিক আছি৷ ওই একটু গরম লাগছে আর কি। দোলা হাসি মুখে বলে। কিন্তু ভেতরে তার তোলপাড় করা অবস্থা। হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে দোলার৷ আনন্দ আবার কৌতুহল অনেক। দোলা এত সহজে রুদ্রর মায়ের দেখা পেয়ে যাবে ভাবিনি৷

–‘ আমাকে বাবার ঘরে গিয়ে মায়ের ছবি দেখতেই হবে। এনি যদি রুদ্রর মা হয় তাহলে আমাকে সব কিছু জানতে হবে। এখানে কি করে আসকেন উনি?। কি হয়েছিলো? সব কিছু জানতে হবে। মনে মনে বলে দোলা।

–‘” সজল এসির পাওয়ার টা বাড়িয়ে দে বাবা, রত্না চৌধুরী বলেন।
“” না না থাক তার আর দরকার হবে না৷ আসলে এসেছি জার্নি করে তাই হয়তো গরমটা বেশি লাগছে৷ একটু বসলে ঠিক হয়ে যাবে নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে দোলা।

–“” তোমরা দুজন ভারী মিষ্টি দেখতে। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি আমি সজলের থেকে। তোমাদের সাথে আলাপ হওয়ার পর থেকে ওতো শুধু তোমাদের গল্পই করে। সজল লজ্জায় মাথা নিচু করে চুল হাত দিয়ে নাড়তে থাকে। আর দোলা একটা মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে তার সামনে।

–“” তা তোমাদের সাথে পরিচিত হওয়ার অনেক ইচ্ছে ছিলো আমার। তোমার মনে হচ্ছে অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছে। দোলাকে উদ্দেশ্য করে বলে রত্না চৌধুরী। দোলা মুখে লাজুক ভাব এনে বলে জ্বি। তবে আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই অনেক ভালো। এটা আমার ননদ তানিয়াকে দেখিয়ে বলে।

— তা আমি জানি৷ তোমাদের ননদ ভাবির সম্পর্ক বোনের মত এটাও জানি৷ সজল সব বলেছে৷ এই মেয়ে তুমি নাকি অনেক ঝগড়া করতে পারো? তানিয়াকে বলেন তিনি। তানিয়া অবাক হয়ে তাকায় এরপর গরম চোখে সজলের দিকে তাকালে সজল এদিক ওদিক তাকায়। এমন ভাব করেছে সে কিছুই জানে না।

–‘ তানিয়া মুখটা মলিন করে তাকিয়ে থাকে রত্না চৌধুরীর দিকে। রত্না চৌধুরী উচ্চ স্বরে হেসে বলে আরে পাগলী আমি মজা করছিলাম। আমার কথায় কিছু মনে করো না।।

–‘ ইটস ওকে আন্টি৷ আমি কিছু মনে করিনি। সাবলীল ভাবে জবাব দেয় তানিয়া৷
— তবে আপনি অনেক ভালো আর অনেক হাসিখুশি একজন মানুষ দেখে মনে হচ্ছে।

–‘ তানিয়ার কথায় রত্না চৌধুরীর মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়৷ মুখে একটা গম্ভীরতার ভাব এনে বলে হ্যাঁ আমি অনেক হাসতে ভালোবাসি৷ আমাকে হাসতে হয় অনেক কিছু আড়াল করার জন্য আনমনে হয়ে বলেন তিনি কথাটা।।

–‘ মানে? সাথে সাথে প্রশ্ন করে উঠে দোলা।

–‘ রত্না চৌধুরী চমকে উঠে বলে হ্যাঁ। ও কিছু না৷ বাদ দাও৷ আমারো কিন্তু তোমার মতো ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছিলো। রত্না চৌধুরীর কথায় দোলা সুযোগ পায়৷ তাই আগ্রহ নিয়ে বলে এটা বুঝি আপনার শ্বশুর বাড়ি?.
–” রত্না চৌধুরী হেসে বলে না৷ এটা আমার ভাইয়ের বাড়ি৷ যদিও সম্পর্ক টা রক্তের না তবুও এরাই আমার আপন। সজল আমার নিজের ছেলের মতোই। ও আমাকে কখনো আলাদা ভাবে দেখিনি ওর মায়ের চোখে ছাড়া। আর আমিও ছেলে ছাড়া ওকে কখনো আলাদা দেখিনি।

— উফফ মনিমা কি শুরু করলে অনেক হয়েছে ইমোশনাল কথা আর নয়। তুমি আমার মা তুমি আমার বাবা৷ আর এটাই এখন সত্য৷ আচ্ছা আমরা খাওয়া দাওয়া করি এবার আসুন৷ সজলের কথায় দোলা আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পায়না৷ কিন্তু একের পর এক কৌতুহল জমা হচ্ছে তার মধ্যে। এরপর তারা খেতে চলে যায়।
— সবাই খেতে বসেছে। তানিয়া আর দোলার গলা দিয়ে যেনো খাবার নামছে না৷ দোলা অনেকখন ধরে উসখুস করছে একটা কথা বলার জন্য। রত্না চৌধুরী দোলাকে অনেকখন ধরে লক্ষ্য করছে।

–” তুমি কি কিছু বলবে দোলা? রত্না চৌধুরীর কথায় দোলা চমকে উঠে বলে এএ হ্যাঁ না না। দোলার কাজে রত্না চৌধুরী মুচকি হাসে৷ সজলও হেসে উঠে ।

— মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলবে। বলো না কি বলবে। সংকোচ ছাড়া বলতে পারো৷ রত্না চৌধুরীর কথায় দোলা বলে আসলে আন্টি একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম যদি কিছু মনে না করতেন?
– হুম বলো কি বলবে?.

–‘ আপনার পায়ে কি হয়েছে? বেশ বিষ্ময় ভরা গলায় বলে দোলা।

— একটা এক্সিডেন্টে আমার পা দুটো হারিয়ে গেছে৷ এরপর থেকে এই চেয়ারই আমার আস্থা আমার ভরসা থমথমে গলায় বলা রত্না চৌধুরী।

— ওহ। সরি এমন একটা প্রশ্ন করার জন্য। আপনার মনটা খারাপ করে দিলাম মনে হয় আমি।

– না দোলা আপনি নিজেকে কেনো দোষ দিচ্ছেন। এটা নরমাল। ইটস ওকে। খাওয়া শেষ করেন সজল বলে। দোলা আর কিছু না বলে খেতে শুরু করে।

–“”” তানিয়া আর দোলা সজলের বাড়ি থেকে চলে এসেছে কিছুখন আগে। দোলার মধ্যে অস্থিরতা, কৌতুহল কমার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে। তানিয়ারও একই অবস্থা। এতদিন পর এই পরিচিত মুখ দেখবে কল্পনাও করিনি৷ যদিও তানিয়া রত্না চৌধুরীকে সামনে থেকে দেখিনি কখনো। কারণ রত্না চৌধুরী যখন চলে আসেন তখন তানিয়া দুই মাসের বাচ্চা ছিলো।

–” আমার মাথায় কাজ করছে না বউমনি৷ এটা কি করে সম্ভব। মামি ওইখানে। সজলের সাথে সম্পর্ক কিভাবে? কিছুই বুঝতে পারছি না৷ নিজের প্রতি বিরক্ত নিয়ে বলে তানিয়া।

–‘ আমাদের সব কিছু জানতে হবে তানিয়া৷ এইভাবে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমাকে বাবার সাথে কথা বলতে৷ তার আগে মায়ের ছবিটা দেখতে হবে আমাকে।

–” কিন্তু কি করে দেখবে তুমি৷ মামা তো ওই একটা ছবি রেখেছে এই বাড়িতে মামির৷ তাও তার কাছে আলমারিতে। কাউকে হাত দিতে দেয়না সেটাই। মামির কোনো চিহ্ন নেই এই বাড়িতে তাছাড়া ৷

–” কিছু তো একটা উপায় আছে। তাছাড়া আমি এইভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না৷ আমাকে সব জানতে হবে। উনার মুখে হাসি আমি ফিরিয়ে দেবো। উনার মাকে উনার কাছে ফিরিয়ে দেবো আমি৷ এটা যে আমার নিজের কাছে নিজের করা প্রমিস তানিয়া।

–” তুমি সফল হবে বউমনি। আমি জানি তুমি পারবে৷ আমি আছি তোমার সাথে। যখন যা দরকার হয় আমাকে বলবে। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি। দোলা মুচকি হাসি দেয় তানিয়ার কথায়।

—“”” সময়টা সন্ধ্যা। দোলা সবার জন্য নাস্তা করে ঘরে এসে ফ্রেস হয়। জাহির চৌধুরী বাইরে গেছেন হাঁটতে। তিনি এই সময়টা হাঁটতে বের হোন। দোলা এই সুযোগে জাহির চৌধুরীর ঘরে যায়। দোলাকে রত্না চৌধুরীর সব খবর নিতে হবে তার আগে ছবিটা দেখতে হবে তাকে।

–‘ দোলা জাহির চৌধুরীর ঘরে যেতেই দেখে আলমারির সাথে চাবি ঝুলছে। জাহির চৌধুরী হয়তো আজ ভুলে রেখে গেছেন। চাবি দেখে দোলার মধ্যে আনন্দে নেচে উঠে। এত সহজে সবটা হয়ে যাবে ভাবিনি সে।
— দোলা দেরি না করে আলমারিটা খুলতেই জামা কাপড় তার গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সব অগোছালো হয়ে আছে। দোলা সব জামা কাপড় সরিয়ে ছবিটা খুঁজতে থাকে। দোলার ভীষণ ভয় করছে৷ যদি জাহির চৌধুরী চলে আসে তাহলে কি হবে তখন?

–‘দোলা প্রথম তাক খুজতেই ছবিটা হাতে পেয়ে যায়।ছবিটা বের করে দেখতেই চমকে উঠে। এটা রত্না চৌধুরীরই ছবি। তার মানে তানিয়া ঠিকই বলেছিলো। ইনি রুদ্রর মা।
–“” কিন্তু ভাগ্য দোলার সাথে বেশিখন সহায় ছিলো না। ইতি মধ্যে জাহির চৌধুরী এসে হাজির হয় ঘরে। দোলাকে তার ঘরে দেখে অবাক হয়ে বলে তুই এখানে কি করছিস দোলা?.

-“” জাহির চৌধুরীর কথায় দোলার হাত থেকে ছবির ফেম টা পড়ে যায়। দোলা ভয়ার্ত চেহারায় তাকায় জাহির চৌধুরীর দিকে। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে সে বারবার।

— রত্না চৌধুরীর ছবিটা নিচে পড়তেই জাহির চৌধুরী তাকায়। রত্না চৌধুরীর ছবি দেখে জাহির চৌধুরী রেগে বলে তোর কাছে এই ছবিটা কেনো? তুই আমার ঘরে কি করছিস?৷ আমার আলমারিতে হাত কেনো দিয়েছিস তুই?
— দোলা ঘাবড়ে যায় অনেক। কি বলবে বুঝতে পারছে না৷ ভয়ে রীতিমতো ঘামছে সে৷

— আসলে বাবা.. দোলা কি বলবে বুঝতে পারছে না। আর জাহির চৌধুরী এখনো রাগী লুকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।

— দোলা রত্না চৌধুরীর ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে বলে এটা কে বাবা? এই মহিলার ছবি আপনার আলমারিতে কেনো? কে হোন উনি আপনার?

–‘ দোলার প্রশ্নে জাহির চৌধুরী চমকে উঠে ঘাবড়ানো গলায় বলা ছবিটা রেখে তুই এই ঘর থেকে যা দোলা।

–“” আমি যাব না বাবা৷ আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি যাব না৷ প্লিজ বাবা বলুন না কে এই মহিলা। কি সম্পর্ক আপনার তার সাথে। তাহলে কি ধরে নেবো ইনি ছোট সাহেবের মা। আমার শ্বাশুড়িমা?

–‘ দোলা তোকে যেতে বলেছি আমি কঠোর গলায় বলে জাহির চৌধুরী।
— আমি আজ সব কিছু না শুনে এক পাও নড়বো না বাবা। প্লিজ আমাকে বলুন হাত জোড় করে বলে দোলা।

–‘ হ্যাঁ এটাই রুদ্রর মা৷ আমার ওয়াইফ৷ তোর শ্বাশুড়ি! রত্না চৌধুরী এটা। শুনে নিয়েছিস৷ এবার যা প্লিজ। হতাশ সুরে বলে তিনি।

–” এইদিকে দোলার ঠোঁটের কোণে অটোমেটিক হাসি ফুটে উঠে। উত্তেজিত কন্ঠে বলে এনি আমার শ্বাশুড়ি। কিন্তু উনি কোথায় বাবা?

— জাহির চৌধুরী করুণ চাহনি নিয়ে তাকায় এবার৷ দোলা কৌতুহল ভরা চোখে তাকিয়ে আছে জাহির চৌধুরীর কথার।
— দোলা তুই কিন্তু বড্ড বেশি প্রশ্ন করিস আজকাল। তোকে ভালোবাসি মানে এই না তোর সব কিছু মেনে নেবো৷ তুই আর কখনো আমার ঘরে আসবি না আমার অনুমতি ছাড়া। এখন যা আমার ঘর থেকে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলে জাহির চৌধুরী।

–” আজ তো আমি কোনো কথা শুনব না বাবা। আজ আমি সব সত্যি জেনে তবেই যাব এই ঘর থেকে। জাহির চৌধুরী অবাক হয়ে তাকায় দোলার দিকে। আর দোলা আগ্রহ পূর্ণ চাহনি নিয়ে আছে।
.–“” দেখুন বাবা আমার স্বামীর কঠোর হয়ে ওঠার পেছনে ইনি আছেন আমি জানি। তাই আমাকে সব কিছু জানতে হবে। কোথায় উনি? কি হয়েছিলো। কেনো চলে গেছেন সব কিছু জানার অধিকার আমার আছে৷ আপনি আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না বাবা। দোলা কাঠগলায় বলে। জাহির চৌধুরীর থেকে সব কথা জানতে হলে তাকে কঠিন হতে হবে। তাই দোলা জাহির চৌধুরীর কথায় ভয় না পেয়ে সাহস নিয়ে বলে কথা গুলো।

–” কেনো এমন করছিস আমার সাথে? কেনো পুরোনো ক্ষত গুলো আবার খুঁচিয়ে তুলছিস? আমি তো সব কিছু ভুলে থাকতে চাই৷ সব পুরোনো স্মৃতি থেকে দূরে থাকতে চাই কথাটা বলতেই গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে জাহির চৌধুরী। দোলার অনেক খারাপ লাগছে জাহির চৌধুরী চোখে পানি দেখে।

— আমাকে মাফ করে দিন বাবা। কিন্তু আমার এছাড়া যে উপায় নাই৷ আমাকে যে সবটা জানতেই হবে। প্লিজ বাবা আপনি আমাকে সব কিছু বলুন প্লিজ জাহির চৌধুরী হাত ধরে বলে দোলা।
— জাহির চৌধুরী দোলার দিকে তাকিয়ে কিছুখন চুপ থেকে বলে…

–“” আমি আর রত্না দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। রত্না ছিলো খুবই গরিব ঘরের মেয়ে। গ্রামে থাকতো ওরা৷ আমি অফিসে কাজের জন্য ওদের গ্রামে গিয়েছিলাম। আর সেখানে আমাদের আলাপ হয়। এরপর আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলি। একদিন হুট করে বিয়ে করে নিয়ে আসি রত্নাকে এই বাড়িতে। কিন্তু আমাদের কেউ মেনে নেয়না৷ বাবা মা সবাই রত্নার সাথে দুর্ব্যবহার করতে থাকে৷ এমনকি জেসু ও মানতে পারে না রত্নাকে৷ আমি রত্নাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। সবার থেকে দূরে গিয়ে আমরা আলাদা সংসার শুরু করেছিলাম।

—-“‘” এক বছরের মাথায় রুদ্র রত্নার গর্ভে আসে৷ রত্না মা হবে শুনে বাবা মা আমাদের মেনে নেয় এবং আমাদের ওই বাড়িতে নিয়ে যায়। রুদ্র হওয়ার দুইমাস আগে মা বাবা কার এক্সিডেন্টে মারা যান। এরপর রুদ্র জন্ম নিলে আমাদের সংসার বেশ সুখের কাটে৷

–‘ জেসমিন তানভীর নামে একজন ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে আনে। তানভীর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলো আর আমাদের চেয়েও বড়লোক ছিলো তারা। তারাও জেসুকে মেনে নেয় না। জেসমিন তানভীরকে নিয়ে আমাদের এখানে থাকতে শুরু করে। এইভাবে কাটে আমাদের দিন..

–‘ রুদ্রর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। রত্না আমাদের সবাইকে ধোকা দিয়ে চলে যায় আরেকজনের হাত ধরে। কথাটা বলেই থেমে যায় জাহির চৌধুরী। তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে৷ দোলাও কান্না করছেন জাহির চৌধুরীর কথা শুনে৷ কিন্তু দোলা আজ যে রত্না চৌধুরীকে দেখে এসেছে তার সাথে এমন বাজে একটা কাজ যায় বলে মনে হচ্ছে না।

–‘ জাহির চৌধুরী আবারও বলতে শুরু করে …. রুদ্র ছিলো ওর মা ভক্ত। ওর মাকে ভীষণ ভালোবাসতো৷ রত্নাকে ছাড়া ও কখনো একা থাকিনি কোথাও আর রত্নাও রুদ্রকে অনেক ভালোবাসতো৷ রুদ্র ছিলো ওর প্রাণ। রত্না ছিলো অনেক লাজুক আর সল্পভাষী। খুব কম কথা বলতো কিন্তু মুখে হাসি থাকতো সব সময় ওর৷ দেখতে সুন্দর থাকায় হাসিটা ওর মুখে বেশ মানাতো। দোলা মুগ্ধ হয়ে শুনছে জাহির চৌধুরীর কথা। এখনো কতটা ভালোবাসে তিনি রত্না চৌধুরীকে সেটা তার কথায় বুঝতে পারে দোলা।

–”’ অফিসে কাজের জন্য আমাকে ১৫ দিনের জন্য বাইরে যেতে হয়। আমি রত্না আর রুদ্রকে জেসমিন আর তানভীরের ভরসায় রেখে যায়৷ এক সপ্তাহ যেতে জেসমিন আমাকে ফোন দিয়ে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য। কারণ জানতে চাইলে বলে আসলে নাকি বলবে৷ আমি রত্নাকে ফোন দিতে থাকি। কিন্তু ওর ফোন বারবার নট রিচেবল বলে। আমার অনেক চিন্তা হতে থাকে৷ রত্না বা রুদ্রর কিছু হয়েছে ভেবে আমি আর স্থীর থাকতে পারিনা৷ অর্ধেক কাজ রেখে চলে আসি আমি দেশে৷

–”বাড়ি এসে শুনি রত্না নাকি অন্য একজনের হাত ধরে চলে গেছে। এটা শোনার পর আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে বসে পড়েছিলাম নিচে। রুদ্র মাথা নিচু করে বসে ছিলো। আমার ওইটুকু ছেলে যার পাঁচ বছর। যে কখনো মা ছাড়া থাকিনি সে আজ গত তিনদিন মা ছাড়া আছে। আর সেখানে আমিও নেই যে ছেলেকে দেখব। আমি রুদ্রর দিকে তাকালে আমার বুক ফেঁটে যায় কষ্টে৷ আমার ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেছে দুদিনে। চোখের নিচ দিয়ে কালি পড়েছে।

–‘ জাহির চৌধুরী বলতে বলতে থেমে যায়। তার কন্ঠে দৃঢ়তা। তিনি আর কিছু বলতে পারছে না৷ দোলাও কান্না করছে অঝোরে। কান্নারত কন্ঠে বলে তারপর কি হয়েছে বাবা বলুন?

–” রত্না যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখে যায়। আর সে চিঠিতে লেখা ছিলো, সে নাকি আমার সাথে সুখী ছিলো না। আমাকে আর ভালো লাগে না। সে নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে আর আমার থেকে বড় লোক সে। রত্না তার সাথে থাকতে চাই তাই চলে গেছে তার হাত ধরে। আমরা যেনো তাকে খোজার চেষ্টা না করি। বিশ্বাস কর দোলামা সেদিন রুদ্র না থাকলে আমি আমার জীবন টা রাখতাম না৷ নিজেকে শেষ করে দিতাম তখনই। আমি রত্নাকে অনেক ভালোবাসতাম৷ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে বিয়ে করেছিলাম৷ আর ও আমাকে মাঝ পথে রেখে চলে গেলো। আমাদের সন্তানের কথাটাও একবার ভাবলো না ও। রুদ্রকে আমি সামলাতে পারতাম না। দিনরাত কান্না করতো মায়ের জন্য। আমার অনেক কষ্ট হতো রুদ্রর কান্নামাখা মুখটা দেখলে। জেসু ওকে আগলে রাখতো সব সময়। এরপর আমার ছেলেটা একা একা থাকতে শুরু করে। দিন দিন গম্ভীর হয়ে উঠে। কারো সাথে কথা বলে না। ঠিক মতো খাইনা৷ আমি আমার হাসিখুশি রুদ্রটাকে সেদিনই হারিয়ে ফেলেছি রে মা। আমার জীবনের সব সুখ রত্না নিয়ে চলে গেছে বলে শব্দ করে কেঁদে উঠেন তিনি। দোলা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না৷ সেও কান্না করছে জাহির চৌধুরীকে ধরে।

–“” এখানে কি হচ্ছে? ভাইজান তুমি কান্না করছো কেনো? এই মেয়ে তুমি কি করেছো বলো? আমার ভাইজান কান্না করছে কেনো এইভাবে বলো বলে জেসমিন চৌধুরী দোলার হাতে থাকা রত্নার ছবির দিকে তাকায়। দোলার হাতে রত্নার ছবি দেখে জেসমিন চৌধুরী চমকে উঠে। ঘাবড়ানো চোখে তাকায় দোলার দিকে..

— চলবে….