তুমিময় আসক্তি পর্ব-২৬+২৭

0
1156

#তুমিময়_আসক্তি
কলমে_আলো_ইসলাম

“২৬”

–” দোলা রুদ্রর কথায় শকড। রুদ্র দোলার সাথে কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ভাবা যায়।
— হ্যাঁ আমি মানছি আমি ভুল করেছি। আমার তখন এমন বিহেভ করা উচিত হয়নি। তোমার কথা গুলো শোনা উচিত ছিলো। কিন্তু তুমি তো জানো আমার রাগটা বেশি তাই আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি দোলার ভাবনার মাঝে রুদ্র ঠোঁট উল্টিয়ে বলে কথা গুলো। আর দোলার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম এমন শকড হয়ে তাকিয়ে আছে।

–” তুমি কথা না বললে আমার এখন ভালো লাগে না। এর আগে কত বলতাম চুপ থাকতে কিন্তু তুমি বকবক বকবক করে আমার মাথা শেষ করতে আর এখন যদি চাচ্ছি তোমার কথা শুনতে আর তুমি চুপ করে আছো। দিস ইজ নট ডান দোলা পাখি কথাটা বলে রুদ্র হেসে উঠে। ওই হাসিতে দোলা আসক্ত হয়ে যায়। রুদ্রকে এইভাবে হাসতে আজ প্রথম দেখলো দোলা। আঁটকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে আছে দোলা। রুদ্রর হাসি মুখে উপচে পড়া মায়ার আনাগোনা। কি সুন্দর সে হাসি। আর এই সুন্দর হাসিটা কি না এই মানুষ টা লুকিয়ে রাখে।

–” রুদ্র ঢুলছে আর কথা গুলো বলছে। দোলার হাত ধরে আছে শক্ত করে। দোলা চুপচাপ রুদ্রর কথা শুনছে৷ আসলে এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না৷ দোলার মুখ দিয়ে কোনো কথা আসতেও চাচ্ছে না এই মুহূর্তে। রুদ্রর আবেগময় কথা গুলো দোলার সব কথা কেড়ে নিয়েছে।
–” জানো দুদিন ছটফট করেছি তোমার সাথে কথা বলার জন্য আর তুমি আমাকে ততবারই এড়িয়ে গেছো৷ আমি জানি ওইটা তুমি ইচ্ছে করে করেছো। আমাকে কষ্ট দিতে করেছো। ঠিক বলছি না? প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে বলে রুদ্র। দোলা এখনো চুপ আছে। করুণ চাহনি নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে।

–” কি হলো কথা বলবে না? এখনো অভিমান করে থাকবে? সরি বললাম তো। এই যে কান ধরছি ওকে তাহলে তো হবে। এরপর রুদ্র দোলার থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে দুই হাতে কান ধরে বলে সরি। রুদ্র সরিটা এত সুন্দর করে বলে যে দোলা না হেসে পারে না৷ খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সে৷ আর রুদ্র দোলার উন্মাদ করা হাসি দিকের এক ধেয়ে চেয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণেও অজান্তে হাসি চলে আসে দোলার হাসি দেখে। রুদ্র আবার দোলার দিকে এগিয়ে আসলে দোলার হাসি থেমে যায়। রুদ্র দোলার কোলে মাথা রাখে এসে। হঠাৎ এমন হওয়ায় দোলা ঘাবড়ে যায়। কিন্তু রুদ্রকে সরায় না। দোলার মধ্যে ভালো লাগা, অন্য রকম অনুভূতি মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে।

–” আমার কি মনে হয় জানো দোলা পাখি? রুদ্রর আস্তে বলা কথাটা দোলার সম্পুর্ন কর্নপাত হয়না৷ তাই দোলা মাথাটা রুদ্রর কাছে একটু এগিয়ে নিয়ে যায় শোনার জন্য। রুদ্র দোলার কোলে মাথা রেখে আবার বলে, আমার মনে হয় তুমি আমার নেশা হয়ে গেছো। তোমার মায়ার খাঁচায় আমি বন্দি হয়ে গিয়েছি। #তুমিময়_আসক্তি আমাকে গ্রাস করেছে। আই থিংক আই লাভ… বাকিটা বলার আগেই রুদ্র চুপ হয়ে যায়। দোলা আগ্রহ পূর্ণ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুদ্রর দিকে৷ কিন্তু রুদ্র বাকি কথা আর বলে না৷ একটু পর দোলা বুঝতে পারে রুদ্র ঘুমিয়ে গেছে। দোলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রুদ্রর বলা প্রতিটি কথা দোলাকে ভাবাচ্ছে৷ ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে৷ দোলার ভালো লাগছে রুদ্রর কথা গুলো নিয়ে ভাবতে।

–‘ আচ্ছা শুনেছি মানুষ নেশার ঘোরে সব সত্যি কথা বলে। তাহলে কি উনি যা বললেন সব সত্যি। উনি কি সত্যি আমার মায়ায় আবদ্ধ হয়েছেন৷ উনার মনে আমি জায়গা করেছি। আচ্ছা উনি শেষে কি বলতে গেলেন। উফফ কেনো শেষ করলেন না উনি। কথা অসমাপ্ত রেখেই ঘুমাতে হলো উনাকে আফসোস নিয়ে বলে দোলা একা একা।
– দোলা রুদ্রকে ধরে শুয়ে দেয় খাটে। এরপর জুতা টাই কোট খুলে রেখে দেয় এক পাশে। দোলা বেশ কিছুখন রুদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–” ঘুমন্ত চেহারাটা কত নিষ্পাপ কিন্তু জাগ্রত মানুষটা হিংস্র। আসলে পরিস্থিতি মানুষকে সব রকম হতে বাধ্য করে। রুদ্রর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। দোলা সব ভাবনা চিন্তা ছেড়ে রুদ্র পাশে ঘুমিয়ে যায়।

–“” সকালে রুদ্র উঠার আগে দোলা উঠে যায়। নামাজ পড়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে সবার জন্য নাস্তা করতে যায় সে। সকাল ৮টা নাগাদ রুদ্রর ঘুম ভাঙে৷ আড়মোড়া দিয়ে উঠতেই সে চমকে উঠে নিজেকে ঘরে দেখে। রুদ্রর ড্রিংক করলে হুস থাকে না। তাই কখন কিভাবে বাড়ি এসেছে কিছু মনে করতে পারছে না। রুদ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে দোলাকে খুঁজে। কিন্তু কোথাও দেখতে না পেয়ে একটা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে ওয়াসরুমে যায়৷ দোলা সবার জন্য নাস্তা তৈরি রুদ্রর জন্য কফি নিয়ে আসে রুমে।

–” কফি নিয়ে এসে দেখে রুদ্র উঠে পড়েছে৷ দোলা রুমে প্রবেশ করতেই রুদ্র বের হয় ওয়াসরুম থেকে। দোলা দেখে রুদ্র খুশি হয়। তার থেকে বেশি অবাক হয় দোলার বিহেভ দেখে।

–‘ এই নিন আপনার কফি বলে দোলা টেবিলে রেখে বিসানা গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। দোলা তার সাথে কথা বলছে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে এটা দেখে রুদ্র যেমন খুশি তেমন শকড৷ রুদ্র সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে৷ দোলা বিসানা ঠিক করতে করতে দেখে রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ চোখের পলক যেনো আঁটকে আছে তার।
-‘ রুদ্রকে এমন ভাবে তাকাতে দেখে দোলা ভ্রু কুচকে বলে এইভাবে কি দেখছেন? সাথে সাথে রুদ্র চোখ সরিয়ে নেয়। দোলার কথায় বেশ লজ্জা পায় সে৷।
–‘ তোমার শরীর কেমন আছে? গম্ভীর কন্ঠে বলে রুদ্র৷ দোলা সাবলীল ভাবে জবাব দেয় তাতে। রুদ্র কফি নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। আর দোলা রুদ্রর পিছু থেকে হেসে উঠে কারণ দোলা জানে রুদ্র অবাক হয়েছে তাকে কথা বলতে দেখে৷ রুদ্রর তো গতরাতের কথা কিছুই মনে নেই এটাও দোলা জানে৷

–“” মাঝে কেটে যায় আরো দুদিন৷ রুদ্র আর দোলার সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক। যদিও রুদ্রর একঘেয়েমি মেজাজ কখনো যাওয়ার নয়৷ কিন্তু দোলা আগের মতোই রুদ্রকে জ্বালানো শুরু করেছে। এখন এতে রুদ্র বিরক্ত হয়না৷ বরং তার ভালোই লাগে দোলার জ্বালানোতে।

–“” দোলা দাঁড়িয়ে আছে জাহির চৌধুরীর সামনে তার ঘরে। দোলা জাহির চৌধুরীর কাছে রত্না চৌধুরীর লেখা চিঠিটা চাই। জাহির চৌধুরী দোলাকে সেটা দিতে নারাজ কিন্তু দোলাও নাছড়বান্দা হয়ে লেগে আছে।
–‘ কেনো এমন পাগলামি শুরু করেছিস দোলা মা। রুদ্র এইসব জানলে আবার ঝামেলা করবে কিন্তু। বাদ দে মা। দেখ যা হওয়ার তো হয়ে গেছে। আমার জীবন থেকে ২২ টা বছর চলে গেছে৷ সেটা আমি কখনো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না৷ রুদ্রর ছেলেবেলা আর মায়ের ভালবাসা কোনো কিছু আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না৷ তবে মন থেকে চেয়েছি রত্না যেখানে থাক যার সাথে থাক সুখে থাক ভালো থাক। ওর জীবনে আমাদের ছায়া কখনো না পড়ুক। কথাগুলো বলতে জাহির চৌধুরী নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। গলা ধরে আসে কান্নায়৷ রত্না চৌধুরীকে সে ভীষণ ভালোবাসে৷ এবং সে ভালোবাসা আজও একই ভাবে রয়ে গেছে৷ দোলা নিরব চাহনি নিয়ে মুগ্ধ নয়নে জাহির চৌধুরীর লোকানো ভালোবাসাটা অনুভব করার চেষ্টা করছে।

— আসলে ভালবাসা এমনই হয়তো৷ দুরত্ব বাড়লেও ভালবাসাটা কখনো কমে না৷ বরং আরো বেড়ে যায়।যেখানে ভালোবাসার জায়গা থাকে সেখানে কখনো ঘৃণা বাস করতে পারে না৷ ভালবাসার বিপরীত ভালোবাসায় হয় কখনো সেটা ঘৃণা দিয়ে পূর্ণ হতে পারে না।

–‘ বাবা আমার উপর ভরসা রাখুন দয়া করে। আমি আমার স্বামীর মুখে হাসি দেখতে চাই। তার মধ্যেকার দুঃখ গুলো সরিয়ে আমি সুখের সাথে সন্ধি করাতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দিন অন্তত। আপনি তো বলেছেন মা অনেক সরল আর অনেক ভালো ছিলো। তাহলে বাবা আপনার মনে কি একবারের জন্য আসেনি মা হঠাৎ কেনো এমন করলো? তাছাড়া যদি কারো সাথে সম্পর্ক হয়ে থাকতো অবশ্যই জানতেন৷ কিন্তু কোনো কিছু তো শিওর না আপনারা। শুধু ওই চিঠিটার ভিত্তিতে সব কিছু ধরে নিয়ে বসে আছেন৷ মা কোথায় আছে একবার খোঁজার চেষ্টাও করেননি।

— জাহির চৌধুরী অসহায় চোখে তাকায় দোলার দিকে। ওই সময়টা এমন ছিলো কোনো কিছু মাথায় আসছিলো না। আমি রত্নার এমন কিছু মেনে নিতে পারিনি৷ অনেক ভালবাসতাম ওকে৷ কিন্তু ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। রুদ্রকে নিয়ে আমি নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলাম৷ রুদ্রর কান্নামুখ আমাকে সব সময় তাড়া করতো৷ যার জন্য আমি আর রত্নাকে নিয়ে ভাবিনি। রুদ্রকে ভালো রাখায় ছিলো আমার একমাত্র কাজ তখন৷
– দোলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে বুঝতে পারছি বাবা সব৷ কিন্তু এখন আমাকে চেষ্টা করতে দিন। যদি মা এমন কিছু করেও থাকে তাহলে তাকে তার জবাব দিতে হবে কেনো করেছে এমন। ছোট সাহেবের কথা কেনো একবার ভাবলেন না তিনি। যে সন্তান মা ছাড়া কখনো কিছু বুঝতো না৷ তাকে ফেলে আসলেন কি করে? এর সব উত্তর আমার তার কাছ থেকে চাই৷ আমাকে চিঠিটা দিন বাবা প্লিজ। দোলার অনুরোধে জাহির চৌধুরী আর না করতে পারে না। যত্ন করে তুলে রাখা চিঠিটা আলমারি থেকে বের করে দেয়।

–দোলা চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ে একবার। এরপর সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে আচ্ছা বাবা এটা কি মায়ের হাতে লেখা? মানে মায়ের হাতে লেখা তো আপনি নিশ্চয় চিনেন বা জানেন?
-‘ জাহির চৌধুরী কিছুখন চুপ থেকে বলে আসলে আমি রত্নার হাতে লেখা ঠিক সেভাবে দেখিনি। কারণ রত্না গ্রামের মেয়ে ছিলো তো। তাই লেখাপড়া আগেই ছেড়ে দিয়েছিলো। আর্থিক সমস্যার জন্য তার বাবা পড়াশোনা করাতে পারে না৷ আমি বিয়ের পরও রত্নাকে কোনো লেখালেখি করতে দেখিনি। কিন্তু রত্নার থেকে শুনেছিলাম ওর হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিলো। রত্না তো সংসারটা খুব মন দিয়ে করতো। সংসার ছিলো ওর প্রিয়।

–‘ জাহির চৌধুরীর কথায় দোলা যা বোঝার বুঝে যায়। এখানে অনেক বড় ষড়যন্ত্র আছে দোলা উপলব্ধি করতে৷ সব কিছু তাকে খুঁজে সমাধান করতে হবে। এর জন্য দরকার রত্না চৌধুরীর আসল হাতের লেখা৷ দোলা আর কিছু না বেরিয়ে আসে জাহির চৌধুরীর ঘর থেকে। দোলার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নরা ভীড় করেছে৷ দোলা আনমনে হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই জেসমিন চৌধুরীর সাথে ধাক্কা খায়। ধাক্কা লাগায় হাত থেকে চিঠিটা পড়ে যায়। জেসমিন চৌধুরী বিরক্ত নিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে দোলা চিঠিটা তাড়াতাড়ি করে তুলে লুকিয়ে ফেলে৷ দোলার কাজে জেসমিন চৌধুরী সন্দেহের চোখে তাকায়৷

–‘ দোলা একটা শুকনো ঢোক গিলে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে জেসমিন চৌধুরীর দিকে।
— কি লুকালে তুমি? দেখাও তাড়াতাড়ি ধমক দিয়ে বলে জেসমিন চৌধুরী। দোলা চমকে উঠে জেসমিন চৌধুরীর কথায়। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলে কই কি কিছু না৷ ওই একটা কাগজ আমার দরকারী আমি আসছি বলে দোলা চলে যেতে যায়। কিন্তু জেসমিন চৌধুরী দোলার হাতের কব্জির একটু উপরে চেপে ধরে থামিয়ে দেয়৷ দোলা ভয়ে বড় বড় চোখ করে তাকায়।

-” আমাকে দেখিয়ে তবে যাবে। কি এমন দরকারী কাগজ যে তোমাকে লুকিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে আমার থেকে। দোলা মনে মনে ভাবে কি করবে এখন সে৷ জেসমিন চৌধুরী তো সহজে ছাড়বে না তাকে৷ যদি চিঠিটা দেখে তিনি সতর্ক হয়ে যায়। দোলার পূর্ণ বিশ্বাস এর মধ্যে জেসমিন চৌধুরী আছে৷

— আমার হাত ছাড়ুন ফুপিমা শক্ত কন্ঠে বলে উঠে দোলা। এখন ভয় পেলে হবে না। শক্ত হতে হবে তাকে। তাই দোলা কন্ঠে কঠোরতা এনে বলে। দোলার কথায় জেসমিন চৌধুরী অবাক হয়।
–‘ এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না তুমি আমাকে চোখ রাঙ্গাচ্ছো। তোমাকে তো আমি বলে জেসমিন চৌধুরী হাত তুলতে যায় তখনই জাহির চৌধুরী হুংকার ছেড়ে জেসু বলে উঠে। জাহির চৌধুরীকে দেখে জেসমিন চৌধুরী ঘাবড়ে যায়। দোলা ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে আসে ।

–‘ এইসব কি হচ্ছে এখানে৷ তুই দোলার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলি রাগী কন্ঠে বলে তিনি।
— আসলে ভাইজান, এই দোলা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে ছিলো। আমি শুধু বলেছি হাতে কি আছে দেখানোর জন্য, আর তাতে আমাকে অনেক কথা শুনিয়ে দিলো৷ তাই আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে ওকে… বলেই থেমে যায় সে। আর দোলা তো অবাক হয়ে শুনছে জেসমিন চৌধুরীর সাঁজানো গল্প। মানুষ এত খারাপ হতে পারে দোলা জেসমিন চৌধুরীকে দেখে বুঝে গেছে৷

–” ওর হাতে যায় থাক এতে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে৷ সব কিছু তোর দেখতে হবে কেনো? ওইটা আমি দিয়েছি ওকে। যা নিজের কাজ কর বলে জাহির চৌধুরী সোফায় গিয়ে বসে৷ জেসমিন চৌধুরী কটমটে চোখে দোলার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। দোলা একটা মুচকি হাসি দেয় শুধু জেসমিন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে তারপর সেও চলে যায়।

—“” তানিয়া আর দোলা ছাদে বসে৷ গবেষণা চলছে চিঠিটা নিয়ে। রত্না চৌধুরীর হাতের লেখা লাগবে তাদের৷ কিভাবে সেটা পাওয়া যায় তাই ভাবছে দুজন মিলে।
— আচ্ছা বউমনি যদি সজলকে বলি তাহলে তো হয়ে যায়৷

— কিন্তু উনি যদি জিজ্ঞেস করেন কি হবে উনার মামনির হাতের লেখা তাহলে কি বলব আমরা। দোলার কথায় তানিয়া আবার চিন্তিত মুখ করে বসে থাকে। আচ্ছা তানিয়া আমরা যদি সজলকে সব বলে দিই তাহলে কেমন হয়। উনিও নিশ্চয় চাই মা তার পরিবারে ফিরে আসুক। মায়ের ভালো তো তিনি চাইবেন।
— কি জানি বউমনি৷ উনি কি করবেন কেমন ভাবে নিবেন বিষয়টা বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু উনার সাহায্য ছাড়া কোনো কিছু সম্ভবও না আমাদের৷

–” আচ্ছা সজল কবে আসছে কিছু বলেছে৷ তানিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে জানায় সে জানে না৷ সজল সঠিক ভাবে কিছু বলেনি। দোলা একটা হতাশ নিশ্বাস ছাড়ে৷ এই সময়টাই বাইরে যেতে হলো তাকে বলে আকাশের দিকে তাকায়।

— বউমনি আনন্দিত গলায় জোরের সাথে বলে উঠে তানিয়া৷ তানিয়ার কান্ডে দোলা চমকে উঠে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলে কি হয়েছে?
– তানিয়া মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি নিয়ে বলে একটা আইডিয়া পেয়েছি৷ শুনো আমরা নিজেরাই গিয়ে তো মামির হাতে লেখা নিয়ে আসতে পারি।
-; কিন্তু কিভাবে সেটা কৌতুহলী হয়ে বলে দোলা।

–” চলো না কাল তবে বুঝবে৷ আমরা কাল সকালে সজলের বাড়ি যাব৷ এরপর মামির সাথে আড্ডা দেবো। দোলা বুঝতে পারে না তানিয়া আসলে কি করতে চাচ্ছে। কিন্তু তানিয়া কিছু একটা ভেবে কাজ করছে এই বিশ্বাস দোলার আছে তানিয়ার প্রতি।

–“” রাত ৯ টা। রুদ্র অফিস থেকে ফিরে দেখে দোলা ফোন নিয়ে বসে আছে৷ কিছু একটা দেখছে ফোনে। রুদ্র হাতের ব্যাগটা শব্দ করে রেখে দোলাকে জানান দেয় সে এসেছে। দোলা শব্দ শুনে পিছু ফিরে রুদ্রকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। এরপর ব্যাগটা জায়গা মতো রেখে বেরিয়ে যাবে তখনই রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে তোমার পড়াশোনা নেই? কখনো বই নিয়ে বসো বলে তো মনে হয় না৷ সামনে না তোমার ফাইনাল এক্সাম। পাশ করার চিন্তা ভাবনা আছে নাকি বিয়ে হয়েছে বলে সব মাফ। অন্য দিকে তাকিয়ে বলে কথা গুলো রুদ্র৷ দোলা রুদ্রর কথায় মুখটা বাংলার পাঁচের ন্যায় করে মলিন চোখে তাকিয়ে থাকে.।

–‘ এই রাক্ষসটার আবার আমার পড়াশোনা নিয়ে ভাবা কবে থেকে শুরু করলো? মনে মনে বলে দোলা৷ রুদ্র দোলার কোনো উত্তর না পেয়ে দোলার দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলে কি বললাম কথা কানে যায়নি। দোলা মৃদু কেঁপে উঠে রুদ্রর ধমকে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷

–‘ রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে এখন পড়তে বসবে আর উঠবে একদম ১১ টা বাজলে যাও৷ রুদ্রর কথায় দোলা অবাক হয়ে তাকায়৷ দোলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখন ৯টা ২০ বাজছে। তার মানে আমাকে এক ঘন্টা ৪০ মিনিট পড়তে হবে মনে মনে বলে দোলা৷ দোলার পড়াশোনা করতে খারাপ লাগে না কখনো। সে সব সময়ই মনোযোগী পড়াশোনার ব্যাপারে৷ কিন্তু বিয়ে হওয়ার পর থেকে দোলার মধ্যে সেউ পড়ুয়া ভাবটা আর যেনো নেই। এখন অল্প পড়তে বসলেই দোলা যেনো হাঁপিয়ে ওঠে ।

— আমি আপনার জন্য ঠান্ডা পানিটা নিয়ে এসে পড়তে বসি নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে দোলা।
— তোমাকে কিছু করা লাগবে না৷ আমি যেটা বলেছি সেটা করো ফাস্ট। আমি যেনো ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে তোমাকে টেবিলে দেখতে পায় বলে রুদ্র ওয়াসরুমে চলে যায়। আর দোলা পেছন থেকে একটা ভেংচি কেটে গোমড়া মুখ নিয়ে পড়তে বসে।

–”’ চলবে…

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“২৭”

–“” দোলা আর তানিয়া বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। তানিয়া দোলার কলেজে ভর্তি হয়েছে। দোলা আর তানিয়া একই ক্লাসে হওয়ায় ভালোই হয়েছে তাদের। রুদ্র তানিয়ার ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তানিয়া যেহেতু আর দেশের বাইরে যাবে না৷ তাই এখানেই পড়াশোনা শুরু করবে। দুজন একই ক্লাসে হওয়ায় একসাথে বের হতে এখন আর সমস্যা হয়না। কলেজের কথা বলে বেরিয়ে আসে দুজন।

-রিকশা করে যাচ্ছে দুজন। কিন্তু দুজনেই চিন্তিত মুখ করে। কারণ হুট করে একজনের বাড়ি চলে যাওয়া ব্যাপার টা ভালো দেখায় না। তাছাড়া সজল থাকলে ব্যাপার টা অন্য রকম হতো। কিন্তু ওইখানে গিয়ে কি বলবে যদি রত্না চৌধুরী জিজ্ঞেস করে কেনো এসেছে। কিছু একটা তো বলা লাগবে। তানিয়া আর দোলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এটা নিয়ে গবেষণা করছে। কিন্তু কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

-” ভাবনা চিন্তার মাঝেই সজলের বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামে। ভাড়া মিটিয়ে ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুখন দুজন।
-” এসো তো যা হয় পরে দেখা যাবে বলে তানিয়া দোলার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় দোলাকে।
— কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় একজন মেয়ে। মেয়েটা কাজ করে সজলের বাড়িতে৷ মেয়েটা দোলা আর তানিয়াকে দেখেই বলে আপনারা? এর আগে এসেছিলো তখন দেখেছে তাই চেনে মেয়েটা এদের।

–” তানিয়া মুচকি হেসে বলে মামি বলেই মুখ চেপে ধরে। দোলা বড় বড় চোখ করে তাকায় তানিয়ার দিকে। তানিয়া বিশাল মাপের একটা হাসি দিয়ে বলে মনিমা আছেন বাড়িতে। তানিয়ার কথায় মেয়েটি হ্যাঁ বলে। এরপর ওদের ভেতরে বসতে দেয়।

–“” আমার তো ভয় করছে তানিয়া। উনি জিজ্ঞেস করলে কি বলব। কেনো এসেছি আমরা।
— দোলার কথা শেষ করতেই রত্না চৌধুরী হাজির হয়। দোলাদের দেখে উনি খুশি হোন অনেক। মুচকি হেসে বলে তোমরা এসেছো দেখে অনেক ভালো লাগছে আমার।

— আসলে মনিমা সজলই আমাদের বলেছে আসার জন্য। আপনি বাড়িতে একা একা আছেন তাই সময় কাটাতে আসলাম আপনার সাথে। আপনার কোনো সমস্যা নেই তো? এক দমে বলে তানিয়া। আর দোলা তো অবাক হয়ে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তানিয়া দোলাকে একটা চোখ টিপ দেয়।
— কি ধুরন্ধর মেয়েরে বাবা৷ অনায়াসে মিথ্যা বলে দিলো বলে একটা ঢোক গিলে দোলা।

–“” আমি অনেক খুশি হয়েছি তোমাদের দেখে৷ আমি তো ভাবছিলাম সজলকে বলব তোমাদের আসার জন্য। কিন্তু ছেলেটা তার আগেই বলে দিয়েছে তোমাদের৷ কাজে গিয়েছে তারপরও আমার কথা ওর মাথায় সব সময় হেসে বলে রত্না চৌধুরী।

–‘ এমনটা হওয়ায় স্বাভাবিক। উনি তো আপনাকে অনেক ভালোবাসে৷ নিজের মায়ের জায়গা দিয়েছে৷ সেখান থেকে আপনার কেয়ার করবে এটাই স্বাভাবিক দোলা মৃদু হেসে বলে।
— আমার ছেলেটা অনেক ভালো আর সরল মনের মানুষ। নাহলে দেখো না৷ যার সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই তার জন্য এতটা কেউ করে বলেই মুখটা মলিন হয়ে আসে তার।

–‘ আচ্ছা মনিমা আপনার নিজের সংসার নেই? আপনি তো বলেছিলেন আপনার অনেক ছোট থাকতে বিয়ে হয়েছিলো তাহলে আপনার স্বামী কোথায়? আপনার কি সন্তান ছিলো না কোনো? কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বলে দোলা। রত্না চৌধুরী কি বলেন সেটাই জানার অপেক্ষা এখন।

— দোলার কথায় রত্না চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠে। অতীতের কিছু স্মৃতি সামনে এসে হানা দেয়। দোলা গভীর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে রত্না চৌধুরীর দিকে। তানিয়াও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

–“” আচ্ছা তোমরা কি খাবে বলো? কথা ঘুরিয়ে বলে রত্না চৌধুরী। এতে দোলা আর তানিয়া দুজনেই হতাশ হয়। দুজনে এক সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
–”
বেশ কিছুখন কথা বলার পর তানিয়া বলে আচ্ছা মনিমা একটা কথা বলব তোমাকে? দোলা আর তানিয়ার সাথে রত্না চৌধুরীর বেশ ভাব জমে গেছে । রত্না চৌধুরী ওদের তুই করে বলা শুরু করেছে আর দোলারা তুমি করে।
— তানিয়ার কথায় দোলা আর রত্না চৌধুরী দুজনেই পূর্ণ আগ্রহ জ্ঞাপন করে।
— আচ্ছা আমরা একটা খেলা খেলি যদি তোমরা কিছু মনে না করো, সন্দেহ দৃষ্টিতে বলে তানিয়া। দোলা বুঝতে পারছে না তানিয়া আসলে কি করতে চাচ্ছে৷।

–“” সব সময় দুষ্টামি বুদ্ধি মাথায় চলতে থাকে তাই না রত্না চৌধুরী হেসে বলে তানিয়াকে। তানিয়াও বিপরীতে একটা হাসি দেয়। কিন্তু মনে মনে ভয় হচ্ছে যদি রত্না চৌধুরী না বলে তাহলে সব শেষ।

-; ওকে বল কি খেলা শুনি। রত্না চৌধুরীর কথায় তানিয়া মুখে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে আসে। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে থাকে।
— আমরা সবাই একটা কাগজ আর কলম নেবো৷ আর তাতে আমাদের দুটি করে ইচ্ছের কথা লিখব যার টা বেশি ইন্টারেস্টিং হবে সে ফাস্ট। তানিয়ার কথায় দোলা ছোট ছোট চোখ করে তাকায়।

— ওহ তার মানে এই ছিলো ওর মনে। কিন্তু মা কি রাজি হবে। কি বাচ্চাদের মতো খেলা শুরু করেছে। মনে মনে বলে দোলা।

— ইচ্ছের কথা, উৎসুক কন্ঠে বলে রত্না চৌধুরী। তানিয়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
– এরপর তিনজন কলম আর একটা করে ফ্রেস কাগজ নিয়ে লিখতে শুরু করে। দোলার মুখে প্রাপ্তির হাসি। তানিয়ার চোখ মুখ জুড়ে জয়ের আনন্দ। সব কিছু এত সহজে হয়ে যাবে ভাবিনি তানিয়া৷
-“‘ সবার লেখা শেষ হলে কাগজ গুলো দোলার হাতে দেয়।
— সত্যি সত্যি যদি আমার এই ইচ্ছে গুলো পূরণ হতো তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি বোধহয় আর কেউ হতো না। আনমনে হয়ে মলিন চেহারায় বলে কথাটা রত্না চৌধুরী। দোলা আর তানিয়া দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে রত্না চৌধুরীর লেখার দিকে তাকায়। দোলা খুব ভালো করে লেখা গুলো দেখে। রত্না চৌধুরীর হাতের লেখা আসলেই সুন্দর কিন্তু খুব ছোট ছোট লেখা। লেখা গুলো একদম স্পষ্ট । আর চিঠির লেখাটা একটু বড় আর যুক্ত করে লেখা।

–” কি রে বল দেখি কার কি ইচ্ছে রত্না চৌধুরী বলে উঠে। তার কথায় দোলা চমকে উঠে বলে এহ হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি। এরপর তানিয়ার কাগজটা হাতে নিয়ে দোলা পড়তে শুরু করে।

— পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকতে চাই। আরেকটা ইচ্ছে হলো সুন্দর একটা মনের মানুষ চাই। দ্বিতীয়টা পড়ে দোলা মুচকি হাসে আর রত্না চৌধুরী শব্দ করে হেসে উঠে। তানিয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।
— চিন্তা করো না মনের মানুষ খুব শীগ্রই পেয়ে যাবে৷ আশেপাশেই আছে একটু মন দিয়ে দেখলে পেয়ে যাবে কথাটা বলে রত্না চৌধুরী মুখ চেপে হেসে উঠে। দোলাও হাসে রত্না চৌধুরীর কথায়। কিন্তু তানিয়া বুঝতে পারে না রত্না চৌধুরীর কথা তাই ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে থাকে।

–“” আচ্ছা দোলা তোমার টা শুনি। কৌতুহল নিয়ে বলে রত্না চৌধুরী৷ দোলা সংগোপনে একটা সুপ্ত হাসি দিয়ে কাগজটা রত্না চৌধুরীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। রত্না চৌধুরী অবাকিত চোখে তাকিয়ে বলে আমাকে কেনো দিচ্ছো?
–এটা আপনি নাহয় বলুন। রত্না চৌধুরী মুচকি হাসি দিয়ে কাগজটা নিয়ে পড়ে দোলার দিকে তাকায়। দোলা মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে শুধু।

–‘ মনিমা বলুন না কি লিখেছে বউমনি। কৌতুহল ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে তানিয়া৷
–” স্বামীর প্রিয় জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিতে চাই৷ আরেকটা লিখেছে একজনের ভালোবাসার মানুষটাকে আবার তার কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই।
*— তানিয়া দোলার লেখা গুলোর অর্থ বুঝলেও রত্না চৌধুরী বুঝে না৷
— আচ্ছা এবার তোমার টা পড়ে দেখি বলে দোলা রত্না চৌধুরীর কাগজ টা খুলে দেখে মুচকি হাসে৷

–” কি আছে লেখা? তানিয়া জিজ্ঞেস করলে দোলা মৃদু হেসে বলে, মৃত্যুর আগে প্রিয় মানুষ গুলোকে দেখে যেতে চাই আরেকবার৷ দোলা আর তানিয়া দুজবে রত্না চৌধুরীর দিকে তাকালে দেখে রত্না চৌধুরী মুখটা গম্ভীর করে আছে৷

–‘ তারপরের টা আগ্রহ নিয়ে বলে তানিয়া। সজলের জন্য মিষ্টি একটা বউ নিয়ে আসতে চাই। এইটা শুনে তানিয়া লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি দেয়।

–‘ কিছুখন গল্পগুজব করে দোলা আর তানিয়া রত্না চৌধুরীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। দোলা খুব খুশি আজ। রত্না চৌধুরীর এত কাছাকাছি যেতে পেরে আর তার কাজটা এত সহজে হয়ে যাওয়ার জন্য। দোলা তানিয়াকে অনেক বার ধন্যবাদ দেয়। কারণ এই সব কিছু তানিয়ার জন্যই হয়েছে।

–” জেসমিন চৌধুরী বসে টিভি দেখছে। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে শফিকের নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি ফোন টা রিসিভ করে জেসমিন চৌধুরী।
— দোলার আর তানিয়া যে সজলের বাড়ি গেছে সে সব কথা জানায় সে জেসমিন চৌধুরীকে। জেসমিন চৌধুরী বুঝতে পারে না ওরা কেনো ওইখানে যায়। কার বাড়ি ছিলো সেটা জিজ্ঞেস করলে শফিক জানায় ওইটা বিশিষ্ট শিল্পপতি হাচান সাহেবের বাড়ি। এটা শুনে জেসমিন চৌধুরী একটু না অনেকটা অবাক হয়। কারণ ওইখানে দোলা বা তানিয়ার কোনো কাজ থাকতে পারে বলে মনে হয়না তার৷ তাছাড়া উনারা অনেক বড়লোক। জেসমিন চৌধুরী ফোন কেটে দিয়ে ভাবছে বসে বসে৷ কি কারণে যেতে পারে৷ দোলা কি করছে বা কি করতে চাচ্ছে সব কিছু চোখে চোখে রাখতে হবে । দোলার কাজকর্ম একদম সুবিধার মনে হচ্ছে না জেসমিন চৌধুরীর কাছে।

–‘” রুদ্র আর রাজ বসে আছে অফিসে৷ রাজ মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে৷ রুদ্র বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে মুখটা এমন করে রাখার কারণ কি। কিন্তু রাজ শুধু দীর্ঘশ্বাসই রেখেছে ততবার কিছু বলে না৷ এতে রুদ্র বিরক্ত রাজের প্রতি। অনেক বিরক্ত সে৷

–” তোর সমস্যা টা কি বলবি৷ মুখটা পেঁচার মতো করে আছিস কেনো। রুদ্রর কথায় রাজ অসহায় ফেস করে বলে এত বড় কথা বলতে পারলি তুই আমাকে।
– এর থেকে নিম্ন মানের কথা আমার মাথায় আসছে না আপাতত তাই বড়টাই বললাম। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে রুদ্র। আর রাজ রুদ্রর কথায় একটা কিউট ফেস উপহার দেয়।

–‘ দেখ রাজ আমার কিন্তু এবার অনেক রাগ হচ্ছে তোর উপর। সমস্যা কি বলনা ইয়ার।
— বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে প্রতিনিয়ত মুখটা ফ্যাকাসে করে বলে রাজ। রাজের কথায় রুদ্র কি রিয়াকশন দেবে বুঝতে পারছে না।
– মানে কি? তুই কি মেয়ে যে তোকে বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে আর তুই ন্যাকা মেয়েদের মতো কান্না করছিস, না আমি বিয়ে করবো না আমাকে বিয়ে দিও না৷ বিয়ে দিতে চাই তো করে নে। বয়স তো কম হলো না। রুদ্রর কথায় রাজ ইয়া বড় বড় চোখ করে তাকায়।

— তুই বলছিস আমাকে এই কথা রুদ্র?
– হ্যাঁ তো। এখানে আমি ছাড়া আমার আত্মা আছে বলে মনে হচ্ছে তোর। রুদ্রর কথায় রাজ আমতাআমতা করে বলে না মানে, এর আগে যতবার বিয়ের কথা বলেছি তুই তো আমার গুস্টি উদ্ধার করে ছেড়েছিস৷ তাই এখন একটু না অনেকটা অবাক হচ্ছি বলে একটা ফোকলা হাসি দেয় রাজ।।

— ভাই সে আমি বললেও তুই বিয়ে করবি না বললেও করতি আমি জানি৷ আমার সামনে ভাব নিস না৷ এখন আসল কাহিনি কি সেটা বল?
— রাজ একটু চুপ থেকে মুচকি একটা হাসি নিয়ে এসে বলে দোস্ত ভাবিকে বলনা আমার বিয়েটা পাকা করে দিতে। রাজের কথার আগামাথা কিছুই বুঝে না রুদ্র। তাই ভ্রু কুচকে কৌতুহল নিয়ে বলে তোর বিয়েতে দোলা কি করবে?
– আমি ভাবির ফ্রেন্ড আশাকে পছন্দ করি৷ ভালবাসি বলতে পারিস৷ আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। দোস্ত প্লিজ সব ঠিকঠাক করে দে ক্ষীণ স্বরে বলে রাজ। আর রুদ্র রাজের দিকে গভীর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।

— আচ্ছা এতখনে বুঝলাম বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো কান্না করার কারণ। বাড়িতে জানিয়েছিস আশার কথায়?
– রাজ মাথা নাড়িয়ে না বলে। যদি আশা রাজি না হয় তখন৷ আমি তো ওকে আমার মনের কথা বলিনি এখনো। রুদ্র রাজের অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারে৷

–“” আচ্ছা চিন্তা করিস না আমি দেখছি। দরকারে আমি আশার সাথে কথা বলব। রুদ্রর কথায় রাজ উঠে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলে থ্যাংকস দোস্ত। তুই সত্যি আমার কলিজার বন্ধু বলে একটা কিস করে বেরিয়ে যায়। আর রুদ্র বেকুব হয়ে রাজের কান্ড দেখে গেছে।

–“” পড়ার টেবিলে বই খুলে বসে আছে দোলা৷ কিন্তু মনোযোগটা বইয়ে নয় আছে অন্য দিকে৷ চিঠি এক হাতে আরেক হাতে রত্না চৌধুরীর লেখা কাগজের টুকরো টা ধরে আছে৷ দুটো লেখা সম্পুর্ণ আলাদা৷ দোলার বুঝতে একটু সমস্যা হয়না এইটা একটা চক্রান্ত। আর এর পেছনে যে জেসমিন চৌধুরীরই হাত আছে এটাও বুঝে গেছে৷ কিন্তু দোলা এটা বুঝতে পারছে না জেসমিন চৌধুরী এতকিছু কেনো করেছে৷ রত্না চৌধুরীকে সরিয়ে দিয়ে তার কি লাভ। দোলা তানিয়াকে কিছু বলতে পারবে না এই ব্যাপারে। কারণ যতই হোক জেসমিন চৌধুরী তানিয়ার মা৷ মায়ের এমন অপরাধের কথা জানলে কোনো সন্তানেরই ভালো লাগবে না৷ দোলা তাই ঠিক করে এখন যা করার সে নিজে করবে৷ জেসমিন চৌধুরীত সাথে কথাও দোলা একা বলবে।

–” দোলার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফোনটা গগনবিদারী শব্দ করে বেজে উঠে। দোলা মৃদু চমকে উঠে তাতে। বিসানার উপর ফোনটা থাকায় উঠে এসে রিসিভ করতেই রোকনের কান্নামিশ্রিত কন্ঠে আঁতকে উঠে দোলা। এরপর যা শুনে তাতে দোলাও চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়।

–” রাত ১০টা। দোলা জাহির চৌধুরী রোকন তানিয়া হসপিটালের বারান্দায় চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছে। দোলা এসে পর্যন্ত কেঁদেই যাচ্ছে৷ রোকনের চোখ দিয়েও অনবরত পানি পড়ছে। দোলার কান্না দেখে তানিয়ার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে৷ জাহির চৌধুরী ভীষণ টেনশনে আছে৷ ভেতরে ডক্টর রাশেদ মিয়ার অপারেশন করছেন৷ রাশেদ মিয়া গাড়ি নিয়ে আসার সময় একটা ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করেন৷ আর এতে খুব বাজে ভাবে জখম হোন তিনি৷ শরীরে অনেক জায়গায় আঘাত লাগে তার৷ রোকন ফোন দিয়ে দোলাকে জানালে দোলা কান্না করতে করতে বেরিয়ে আসে। তানিয়া জাহির চৌধুরীও দোলার সাথে আসে সব শুনে৷ রুদ্রকে ফোন দেওয়া হয়েছে অনেক বার কিন্তু রুদ্র ফোন উঠায় না। জাহির চৌধুরী এতে ক্ষিপ্ত হয় রুদ্রর উপর। কাজের সময় কখনো ফোন দিয়ে পাওয়া যায়না তাকে।

–“” রুদ্র অফিসে কাজের জন্য ঢাকার বাইরে গিয়েছিলো৷ হঠাৎ করে তাকে ফোন দিয়ে ডাকা হয়। তাই রুদ্র চলে যায় সাথে সাথে। ফিরতে ১১টা বেজে যায় । বাড়িতে কাউকে দেখতে না পেয়ে একজন সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করলে সে সব জানায়। রুদ্র দেরি না করে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়।

–“” দোলা তানিয়ার কাধে মাথা রেখে কান্না করছে৷ এত সময় হয়ে গেছে এখনো ডক্টর বের হয়নি৷ রাশেদ মিয়ার কোনো খবরও তারা দেয়নি৷ রোকন দোলার পাশে চুপ করে বসে আছে মন খারাপ করে।
–“” কিছুখন বাদে রুদ্র দ্রুত পায়ে হসপিটাল প্রবেশ করে দেখে জাহির চৌধুরী একটা চেয়ারে বসে আছে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে। রোকন দৃষ্টিটা মাটির দিকে নিবদ্ধ রেখেছে৷ এরপর চোখ যায় দোলার দিকে৷ দোলা তানিয়ার কাধে মাথা রেখে অনবরত কান্না করে যাচ্ছে৷ দোলাকে এমন ভাবে দেখে রুদ্রর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে৷ দীর্ঘ সময় কান্নার ফলে চোখ ফুলে গেছে। রুদ্র আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে।

–” দোলার সামনে দাঁড়িয়ে আলতো স্বরে দোলা বলে ডাকতেই দোলা করুণ চাহনি নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় এরপর রুদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করতে থাকে৷ রুদ্র পরম যত্নে দোলাকে আগলে নেয় নিজের মধ্যে। দোলার মাথায় হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করছে রুদ্র কিন্তু দোলা কারো কোনো কথায় শুনে না। দোলা তার বাবাকে অনেক ভালোবাসে৷ মা মারা যাওয়ার পর রাশেদ মিয়া দোলাকে মা বাবার ভালোবাসা সমানে দিয়ে গেছেন৷ বাবাই সব দোলার কাছে৷ তার যদি কিছু হয়ে যায় দোলা কখনো মানতে পারবে না আর না সহ্য করতে পারবে।

–‘ মিনিট বিশ পর ডক্টর বেরিয়ে আসেন৷ ডক্টরকে দেখে রুদ্র এগিয়ে যায় দোলাকে সাথে নিয়েই৷ দোলা এখনো রুদ্রকে জাঁপটে ধরে আছে৷ রুদ্রও চাইনা দোলাকে এই মুহূর্ত কাছ ছাড়া করতে৷
–‘ রাশেদ কেমন আছে ডক্টর চিন্তিত কন্ঠে বলেন জাহির চৌধুরী। ডক্টর একটা টানা শ্বাস ছেড়ে বলে দেখ জাহির ওর আঘাত গুলো অনেক মারাত্মক। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি৷ এখন জ্ঞ্যান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না আমি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা বলে চলে যায় ডক্টর। দোলা আবারও শব্দ করে কেঁদে উঠে রুদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দোলার কান্নায় রুদ্রর অনেক খারাপ লাগছে। তানিয়াও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। তানিয়া রোকনের কাধে হাত রাখলে রোকন তানিয়াকে ধরে কেঁদে উঠে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে । সব কিছু ঠিক থেকেও আবার এলোমেলো হয়ে যায়। রুদ্র দোলাকে থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ কিন্তু দোলার মধ্যে কি চলছে এখানে উপস্থিত সবাই উপলব্ধি করতে পারছে৷ রুদ্র অসহায় হয়ে দোলার কান্নামাখা মুখটা সহ্য করে যাচ্ছে।

— চলবে…

-❌- কপি করা নিষেধ ❌ ভুলক্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষে বিবেচনা করবেন।