#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|এগারো তম পর্ব|
অতিবাহিত হয়েছে কয়েক রজনী।
আজকাল আজাদ সাহেবের পেটের অবস্থা তেমন একটা ভালো যায় না। ভ্যাপসা গরমে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে পেটের ভেতর গুরমুর শব্দ করে শুধু। ফলে যে কোন স্থানে বায়ু দূষণ করে বসে আজাদ সাহেব। ইহা খুবই লজ্জা জনক প্রতিস্থিতি। আজ তো সকল কিছুর সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। হাম্মামখানা যেন আজাদ সাহেবের শয়নকক্ষ হয়ে গিয়েছে। হাম্মামখানা থেকে বের হতে না হতেই আবারও চলে যেতে হয় সেখানেই। আজাদ সাহেব নিজেকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। পড়শু ছোট ছেলের জন্মদিন আর এখন আজাদ সাহেবের ডায়েরিয়া হতে হলো! এই নিয়ে সাতবার হাম্মামখানায় আসা যাওয়া হলো। চেয়ারে বসে পেটে চাপ দিয়ে বসে আছে আজাদ সাহেব। বলাবহুল্য হাম্মামখানার দরজার সামনে চেয়ার পাতা।
আয়েশা আজাদ হাতে ইয়া বড়ো পানির জগ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। প্রিয়তম স্বামীর এমন মর্মান্ত অবস্থা থেকে ব্যথিত হলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বললেন না। কেননা আয়েশা আজাদ জানেন উনার স্বামী এক নাম্বার মুখোশধারী। যেকোন সময় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মুখোশ পড়ে বসে থাকে। আয়েশা আজাদ মুখে কাঠিন্যতা ভাব এনে বললেন,
” সত্যি করে বলো, কি খেয়েছিলে?”
আজাদ সাহেব চেয়ারে বসে পেটে হাত দিয়ে নুয়ে পড়েছেন। স্ত্রীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
” তোমার হাতে পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা।”
আয়েশা আজাদ তেতে গেলেন। আবারও স্বামী যে মিথ্যা বলছেন তা দেখে।
” সত্যি করে বলো। নয়তো এবার কাঁচা পাট শাক আর রান্না ছাড়া কাঁচা শুঁটকি খাওয়াবো।”
এমনিতেই আজাদ সাহেবের পেটে সমস্যা তাঁর উপর স্ত্রীর কু-খাদ্যের কথা শোনা। চেয়ার থেকে উঠে আবারও দৌঁড় লাগালেন হাম্মামখানায়।
এদিকে ফাহিমা আজ দৌঁড়ে দৌঁড়ে কাজ করছে। শাশুড়ি নেই যে তাই। ফাহিমার শাশুড়ি আজ আর রান্না ঘরে পা দিবেন না শ্বশুরের অসুখ হয়েছে যে তাই। দুই চুলায় বড়ো বড়ো দুইটা পাতিল বসিয়েছে ফাহিমা। যার একটার মধ্যে চাল সিদ্ধ হচ্ছে আর অপরটার মধ্যে আলু,কাঁচ কলা সিদ্ধ হচ্ছে। এটা নতুন কিছু না প্রেম নীড়ে কয়েকদিন পর পর’ই এই মেন্যু থাকে তিনদিনের জন্য। ফাহিমা চুলার আঁচ কিছুটা কমিয়ে আরেক কাজে মন দেয়।
দূর থেকে ফাহিমার কার্যকলাপ এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিলো রুপ। আজ প্রায় এক মাস হয়েছে রুপ প্রেম নীড়ে। প্রেম নীড়ের সকলের সাথে রুপ এবং রাইসার সখ্যতা হয়েছে একমাত্র নাদিফ ছাড়া। রুপ নাদিফের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে।
” দৌঁড়াচ্ছেন কেন ভাবি?”
আজাদ সাহেবের অসুখ সম্পর্কে রুপ অজ্ঞাত। হাতে মাঝারি আকারের স্টিলের বোলে ফাহিমাকে একবার রান্না ঘরে তো একবার খাবারের টেবিলে আসতে দেখে প্রশ্ন করলো রুপ।
রূপকে দেখে ফাহিমার কলিজায় পানি এসে গেলো। এতক্ষণ ফাহিমার নিজেকে মনে হচ্ছিল এতিম এতিম। প্রতিদিন আয়েশা আজাদের সাথে কথা বলতে বলতে কাজকর্ম শেষ করতো ফাহিমা কিন্তু আজ আয়েশা আজাদ নেই। রুপকে দেখে ফাহিমা তোড়জোড় করে করে উত্তর দেয়,
” একি সর্বনাশ এর কথাবার্তা রুপ! তুমি জানো না আজ বাসায় কি হয়েছে?”
রুপ ঘাবড়ে গেলো ফাহিমার কথা শুনে। ফাহিমার পিছু পিছু একপ্রকার দৌঁড়াতে শুরু করলো রুপ।
” কি হয়েছে ভাবি! আমি তো কিছুই জানিনা। কিছু চুরি হয়েছে কি! নাকি কেউ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে? আর বলুন তো ভাবি কি হয়েছে?”
ফাহিমা এবার হাতের কাজ শেষ করে স্টিলের বোল হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ফাহিমার পিছু পিছু রুপও উঠে যাচ্ছে। রুপের একের পর এক প্রশ্নে ফাহিমা আহত হয়।আগের ন্যায় হন্তদন্ত হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে রুপ যেন দম ফেলবার পাত্রী নয় ফাহিমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
“কি হয়েছে ভাবি বলেন না?”
ফাহিমা সবে শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়ালো। এতক্ষণ তাড়াহুড়ায় রুপের কথার উত্তর দিতে পারছিলো না। কিন্তু এখন যেহেতু কাঙ্খিত জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাই পিছনে ফিরে রুপের কথার উত্তর দিল,
” তুমি কি জানো না, শ্বশুর আব্বা ডাইরেক হয়েছে?”
আজাদ সাহেব হাম্মামখানা থেকে বের হলেন মাত্র। বাহির থেকে ডাইরেক কথা শুনে আজাদ সাহেবের পেটে আবার মোচড় দিয়ে উঠলো। আজাদ সাহেব পেটে চেপে ধরে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” এই মেয়েটার কবে আক্কেল জ্ঞান হবে বলো তো! ডাইরেক না বলে পাতলা পায়খানা বললেও তো পারতো অথবা ডায়রিয়া বলতো। একেবারে ডাইরেক বলা কি ঠিক? তাও আবার হবু বউমার সামনে! আমার আর ইজ্জত থাকলো না।”
আয়েশা আজাদ কটমট চোখের স্বামীর পানে তাকালেন। আয়েশা আজাদ এর নিকট এখনো পরিষ্কার না যে কিভাবে আজাদ সাহেবের এই অবস্থা হয়েছে।
রুপ ফাহিমা একসাথে ঘরে প্রবেশ করে। ফাহিমার হাতে স্টিলের বাটিতে চিড়া মুড়ি ভেজানো খাবার। যা শ্বশুর বাবার জন্য নিয়ে এসেছে ফাহিমা। চিড়া মুড়ি ভিজিয়ে হালকা চিনি দিয়ে খেলে পেট টাইড হয়।
“আঙ্কেল এখন ঠিক আছেন?”
রুপের ব্যাথাতুর কণ্ঠস্বর।
” আর ঠিক রে মা! হাম্মামখানায় যেতে যেতে জীবন অর্ধেক শেষ। আমার তো এখনো ইচ্ছে করছে বালিশ কাঁথা নিয়ে হাম্মামখানায় শুয়ে থাকতে। যেন কষ্ট করে এই টুকু পথ আর হাঁটতে না হয়।”
আজাদ সাহেবের কথা শেষ হতেই ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে নাদিফ। নাদিফের চেহারায় স্পষ্ট চিন্তার রেখা বিদ্যমান। নাদিফ বিচলিত হয়ে আজাদ সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালো। আজাদ সাহেবকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কখন থেকে হচ্ছে? আমাকে খবর দিলে না কেন? ডাক্তার ডাকবো? না ডাক্তার দেখার প্রয়োজন নেই। চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সেলাইন দিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে।”
ছেলের কথা শুনে আয়েশা আজাদ তেতে উঠেন। একপ্রকার চিৎকার করে বলেন,
” আগে তোর বাবাকে স্বীকার করতে বল কি এমন খেয়েছিল যার কারণে এই অবস্থা হয়েছে। নয়তো এক পাও ঘর থেকে বের হতে দিবো না বলে দিলাম। আগে জিজ্ঞেস কর?”
নাদিফ এবার শান্তস্বরে বাবা কে প্রশ্ন করে,
” সত্যি করে বলো বাবা কি খেয়েছিলে?”
আজাদ সাহেব চোরা চোখে সকালের পানে তাকালেন। নিচের দিকে তাকিয়ে নীচুস্বরে বলা শুরু করলেন,
” মোড়ের ধারে টাকলু মামার দোকান। দোকানের সামনে দিয়ে রোজ তিনবেলা আসা-যাওয়া করি। মামার হাতের বানানো পুরি সিঙ্গারার ঘ্রাণ নাকে আসে প্রতিবেলা। একটা বিষয় কি জানিস? জীবনের সবকিছু সংযত করা যায় কিন্তু রুচিকে সংযত করা যায় না। ব্যস ইচ্ছে হলো সেখান থেকে কিছু খাবো তাই খেয়ে নিলাম। তোর মায়ের জন্য তো কিছুই খেতে পারি না বাহিরের খাবার। তাই দারোয়ানকে দিয়ে লুকিয়ে আনিয়েছিলাম পুরি সিঙ্গারা। পেট ভরে, মন ভরে খেয়েছিলাম ইচ্ছামত। তারপর এই অবস্থা।”
আয়েশা আজাদ স্বামীর দিকে এক প্রকার তেড়ে আসছেন। আজ সত্যি সত্যি আয়েশা আজাদের ইচ্ছে হচ্ছে কাঁচা পাট শাক আর কাঁচা শুঁটকি খাওয়াতে স্বামীকে। আয়েশা আজাদকে অনেক কষ্টে রুপ আটকে রাখে এবং বিছানায় বসিয়ে দেয়।
” আন্টি হয়েছে তো! আর অস্থির হবেন না। আংকেল এখন অসুস্থ। আঙ্কেলকে সুস্থ করে তুলতে হবে। এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না! ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
নাদিফ এতক্ষণ রুপকে খেয়াল করেনি। রূপের কণ্ঠস্বর শুনে নাদিফ রুপির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আজ পনেরো দিন পর নাদিফ রুপকে দেখছে। মেয়েটা রুপের কাছ থেকে শুধু পালিয়ে বেড়ায়। রুপকে দেখে এতদিন অন্তরে পুষে রাখা রাগ প্রকাশ করল নাদিফ। রুপের উদ্দেশ্যে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” তা নিয়ে যাবে তুমি! এক কাজ করি আমি বসে থাকি হাত দুটো গুটিয়ে আর তুমি বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। তা এতো যেহেতু বুঝো বসে ছিলে কেন? আঙ্কেলের প্রতি একটা দায়িত্ব কর্তব্য আছে না তোমার! ছেলেদের কাজ তুমি মেয়ে হয়ে করে নিতে।”
রুপ বুঝতে পারছে এই পনেরো দিনের হিসাব নিকাশ আজ এক দিনে উসুল করবে নাদিফ। রুপ কিছু বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুপ ভাবছে যদি রুপ এখন আরো কিছু বলে তো এই ঘাড়ত্যাঁড়া আর ঠোঁট কাঁটা লোকটা দেখা যাবে এখন সবার সামনে রুপকে অপমান করা শুরু করছে।
রুপের চুপ থাকা দেখে নাদিফ আরো রেগে যায়। নাদিফের এখন ইচ্ছে করছে রুপকে আস্তো গিলে ফেলতে।
এদিকে রুপের প্রতি নাদিফের এরূপ আচরণে সকলেই স্তব্ধ বনে যায়। আয়েশা আজাদ ছেলেকে ধমকে উঠে,
” নাদিফ এটা কেমন ব্যবহার! মেয়েটাকে বকছিস কেন?”
নাদিফ কিছু বলল না। কটমট চোখে রুপের পানে তাকিয়ে রইলো। এদিকে আজাদ সাহেব বসে বসে ফাহিমার নিয়ে আসা চিড়া মুড়ি খাচ্ছে। আয়েশা আজাদ মায়া ভরা চোখে স্বামীকে দেখছেন। আয়েশা আজাদ যতোই স্বামীকে বকুক না কেন! ভালোবাসে প্রচুর।
” চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
আয়েশা আজাদ স্বামীর পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন। আজাদ সাহেব মুখে শেষ চামচ চিড়া মুড়ি ঢুকিয়ে চুপ করে রইলেন। স্ত্রীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
” আর কখনও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাবো না।”
আয়েশা আজাদ এবার হাসিমুখে বললেন,
” যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে। বাসায় বানিয়ে খাওয়াবো।”
নাদিফ বাবা-মার মিষ্টি প্রেমালাপে ব্যাঘাত ঘটায়।
” চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
আজাদ সাহেব এবার হাসিমুখে বললেন,
” তা আর যেতে হবে না। বউয়ের সেবা পেয়ে আজকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবো।”
নাদিফ আর কিছু বলল না। এখন নাদিফের বাবার মনে প্রেম জেগেছে। নাদিফ কোন পাত্তা পাবে না এখানে। ফাহিমা অনেক আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছে চুলার উপর পাতিলের কথা মনে পড়ায়।
রুপ হা করে আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের প্রেমময় আলাপ শুনছে। এদিকে রুপের কান্ডে নাদিফ হাসে। রুপের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। রুপ অবাক, এই রাগী লোকটা রুপের হাত ধরেছে! কত বড়ো সাহস?
” ছাড়ুন হাত!”
” আজ কোন ছাড়াছাড়ি নাই। তৈরি হয়ে আসো। পনেরো দিন অনেক লুকোচুরি খেলেছো। আজ তোমাকে বুঝাবো লুকোচুরি করার প্রতিফল কতটা ভয়াবহ।”
আজাদ সাহেবের জন্য দোয়া করেন সবাই। যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। রুপের জন্যও করবেন।
চলবে…….