#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৪
_________________
শীতে হাত-পা জমে যাওয়ার উপক্রম। তবুও ইরতিজা নড়ছে না জায়গাটা থেকে। ঠায় শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে থেকে ভাবছে। ভাবনা কেবল রং বদল করছে তার। একেকটা ভাবনা একেক রকম যন্ত্রণা দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে প্রেমে পড়ার বিষয়টি। এটা কখন কীভাবে ঘটলো? নিমেষেই ঘটে গেল! মানুষের মন এমন এক কেন্দ্রস্থল যেখানে নিমেষেই এমন কঠিন বিষয়ের সূচনা ঘটতে পারে! আর এটার সূচনাতেই যত জ্বালা!
প্রেমে পড়ার অনুভূতি মারাত্মক হয়। এই অনুভূতি কেমন এর বর্ণনা দেওয়া যায় না ঠিক। বুক দুরুদুরু করে। জাগতিক সবকিছু দুর্বোধ্য লাগে তখন!
প্রতিবেশী কিশোর ছেলেটা চোখের সামনে সাইকেল নিয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। দু চোখের অবলোকন দৃশ্যপট কেঁপে উঠলো ইরতিজার। নড়েচড়ে উঠলো পাথরের ন্যায় স্তম্ভিত তনুখানিও। পিছনের লন থেকে সে রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছে। পড়ে যাওয়া ছেলেটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে আবারও ছুট দিলো সাইকেল নিয়ে। মানুষের জীবনও ঠিক এই ঘটনাটার মতোই যেন। জীবনে কত কী ঘটে যায়, অথচ মানুষ কিছুই ঘটেনি এমন ভাণ করে থাকে! থাকতে হয়। একবার নিজের জীবনের দিকে দৃষ্টি দিলেই সে দেখতে পায়, তার জীবন কেমন অগোছালো উদ্যানের মতো। তার জন্মগ্রহণটাই যেন ভারি অগোছালো একটি বিষয়! জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই এখন অবিন্যস্ত সুর ছেপে গেছে তার। কলের রিনরিনে শব্দটা চিন্তা-ভাবনায় কালো হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কে প্রথমে ধূসর, এবং পরে পুরো শ্বেত রূপ এনে দিলো। পকেট হাতড়ে বের করে আনলো মোবাইলটা। জোনাসের নামটা দেখে ভ্রু মাঝে ঈষৎ ভাঁজ ভেসে উঠলো খানিকটা সময়ের জন্য। পরে তা মিলিয়ে গেল। কল রিসিভ করে কানে ধরলো সে।
“আজ উইকেন্ড ছিল, ভেবেছিলাম তোমায় নিয়ে এই শহরটা ঘুরে দেখবো। কিন্তু তুমি অন্য কারো সাথে অন্য কোনো শহর ঘুরতে গিয়েছিলে! কাজটা ঠিক করোনি টিজা।”
ইরতিজা বিস্মিত হলো। জোনাস কী করে জানে সে অন্য শহর ঘুরতে গিয়েছিল?
“তোমার ওই অসভ্য নিউ ফ্রেন্ডের সাথে কেন ঘুরতে গিয়েছিলে? আমি নিউ ইয়র্ক থেকে এমনি এমনি আসিনি রেডমন্ড। তোমার জন্য এসেছি। তাই তোমার উচিত আমাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দেওয়া। এটা তোমার কর্তব্য। অথচ তুমি নিজের কর্তব্যপরায়ণে অস্বীকৃতি জানিয়ে অন্য কারো সঙ্গ দিয়েছো। ভুল করেছো, অন্যায় করেছো টিজা।”
“ভুল-সঠিক আমি নির্ধারণ করতে পারি। ভুল তো তুমি। এর আগেও তুমি ভুল করেছো, এমনকি এখনও ভুলের উপরই অটুট তুমি।”
“আমি কোনো ভুল করিনি, আর না তো এখন করছি।”
“তুমি অবশ্যই ভুল। তোমার করা কাজগুলো ভুল, তোমার ভাবনাগুলোও ভুল। নিউ ইয়র্ক ফিরে যাও জন। তোমাকে দেখলেই কষ্ট অনুভব হয় আমার। মনে পড়ে যায় একজন ভালো বন্ধু কীভাবে আমার শত্রু হয়ে গেছে। আমার চোখের সামনে পড়ো না আর কখনও!”
“আমি সামনে এলেই বন্ধ রেখো তোমার চোখের পাতা। দেখবে তোমার বন্ধ চোখের তারাতেও আমি আছি।”
ইরতিজা শক্ত মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরলো গায়ে জড়ানো কম্বল। সকল বাধা বিচ্যুতি পেরিয়ে একটা হৃদয় মোচড়ানো শান্ত অথচ তিক্ত অনুভূতির কান্না গলা পর্যন্ত এসে আটকে গেল। বললো,
“তুমি এমন কেন হয়ে গেলে জন? বন্ধুত্বটাকে খুব মিস করি। মিস করি সেই হাস্যউজ্জ্বল চঞ্চল জনকে। যে সব সময় তার দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতো আমাদের। এই এক রোখা সিরিয়াস কঠিন জনকে দেখতে ভালো লাগে না। ভালো লাগে না তার কষ্টমাখা পাগলামি গুলো। কষ্টমাখা পাগলামি গুলো আমাকেও কষ্ট দেয়!”
কথাটা বলার সময় জল চিকচিক করছিল ইরতিজার চোখে।
জোনাস বললো,
“আমিও এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না তোমার করা সেই অভিশপ্ত প্রত্যাখ্যানকে! ওটা একটা অভিশপ্ত প্রত্যাখ্যান ছিল। যে অভিশাপ পুরো আমাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে!”
“তুমি ওই প্রত্যাখ্যানকে আঁকড়ে ধরে বসে ছিলে, এখনও আছো। বন্ধুত্বের দিকটা বিবেচনা করোনি। কোনো কিছুই বিবেচনা করো না তুমি। আর এই কারণেই তুমি ঘৃণার! আমি যাদের ঘৃণা করি এবং যারা আমাকে ঘৃণা করে তাদের নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার, ভাবতে চাই না আমি!”
ইরতিজা এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে লাইনটা কেটে দিলো সঙ্গে সঙ্গে। হৃদস্পন্দন অতি দ্রুততর হচ্ছে তার। মনে মনে নিজেকে বোঝাতে লাগলো, সত্যিই তার ওই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। কিন্তু মানুষের মন যে আজব কীর্তিকলাপের সংস্থান। দেখা যায় আমরা ওই মানুষগুলোকে নিয়েই বেশি ভাবছি, যাদের ঘৃণা করি বা যারা আমাদের ঘৃণা করে!
জোনাসের তরফ থেকে আর কোনো কল অথবা ম্যাসেজ এলো না। কেটে গেল কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ অদ্ভুত একটা বিষয় উপলব্ধি হলো ইরতিজার। যাতে তার প্রতিটা লোম সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠলো। সচকিত দৃষ্টি এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলো তার। খুব খারাপ একটা আশঙ্কা বুকের মাঝে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন চুপি চুপি তার উপর নজর রাখছে। ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে এলো। হঠাৎ এত ভয় পাচ্ছে কেন নিজেই বুঝতে পারছে না। কে রাখছে তার উপর নজর? এদিক-ওদিক ভালো করে তাকিয়ে আরেকবার দেখার সাহস হলো না। সে দ্রুত ঘরে চলে এলো।
ঘরে এসে জানালা দিয়ে আশপাশটা দেখেছে। কিন্তু কাউকে চোখে পড়লো না। তবে কেউ একজন ছিল। আশেপাশেই ছিল।
খাবার খেয়েই শুয়ে পড়লো ইরতিজা। কয়েকটা ঘণ্টা পার হওয়ার পরও ঘুম আসছিল না। ধীরে ধীরে ঘুমের আবেশ যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো তখনই হঠাৎ কলের শব্দটা ডেকে উঠলো তাকে। ক্যানিয়লের নাম দেখতে পেয়েই ধড়ফড় করে উঠে বসলো। এখন মধ্যরাত। পুরো এরিয়ার মানুষ ইতোমধ্যে ঘুমে আচ্ছাদিত। এমন সময় ক্যানিয়ল তাকে কেন কল দিয়েছে? ইরতিজার সংশয় হচ্ছিল এত রাতে কল রিসিভ করবে কি করবে না। করে ফেললো শেষমেশ। তাৎক্ষণিক ক্যানিয়ল বলে উঠলো,
“তোমার উচিত ছিল পাঁচ সেকেন্ডের সময় কল রিসিভ করার, কিন্তু তুমি উনত্রিশ সেকেন্ডের সময় কল রিসিভ করেছো। মোট চব্বিশ সেকেন্ড সময় অহেতুক ব্যয় করিয়েছো আমার জীবন থেকে। এখন এর কী শাস্তি হতে পারে তোমার?”
ইরতিজা বিস্মিত হলো। সামান্য অমূল্যবান একটা বিষয় নিয়ে শাস্তির কথা বলছে?
“আমি ঘুমাচ্ছিলাম।” বললো ইরতিজা।
“ঘুম? এদিকে আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে বসে আছো, অথচ তুমি ঘুমাচ্ছ?”
“আমি কীভাবে তোমার ঘুম কেড়েছি?” অবাক কণ্ঠের প্রশ্ন ইরতিজার।
“কাড়োনি? চোখ বন্ধ করলেই তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। বলো এসব কী? তোমাকে কে সাহস দেয় আমি চোখ বন্ধ করা সত্ত্বেও আমার সামনে আসার? চোখ বন্ধ করার পর আবারও যদি তোমাকে দেখি তাহলে এর যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবো আমি। দয়া করে আর চোখে ভেসে উঠে ডিস্টার্ব করো না আমায়। ঘুমাতে দাও।”
রাজ্যের বিরক্তি গলায় ঝরিয়ে কল কাটলো ক্যানিয়ল।
এদিকে তার কথা শুনে শিথিল হয়ে গেল ইরতিজা। হৃদকক্ষে ঝুমঝুম শব্দে ভালোলাগার নৃত্য পরিচালিত হতে আরম্ভ করেছে। অসহ্যরকম এক ভালো লাগার অনুভূতি হচ্ছে তার। সে ক্যানিয়লের ঘুম কেড়ে নিয়েছে? এভাবে? মনে মনে হাসে ইরতিজা। ক্যানিয়ল বলেছিল, ইরতিজা তার প্রেমে পড়লে তার মান-সম্মান নষ্ট হবে। অথচ এখন যে সে ইরতিজার প্রেমে পড়েছে? তাও আবার কঠিন প্রেম! এর কী হবে? ক্যানিয়লের মান-সম্মান কি বিন্দু পরিমাণও অবশিষ্ট আছে এখন? কথাটা ভাবতেই হাসে ইরতিজা। এটা ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় কিছু সময়।
আবারও হুট করে কল আসে ক্যানিয়লের। এবার সে আরও বিরক্ত নিয়ে বললো,
“তুমি মেয়েটা এত কেন অবাধ্য? এত বার বললাম যে এসো না আমার চোখের সামনে, তাও তুমি বেহায়ার মতো কেন আসছো? কেন ঘুমাতে দিচ্ছ না আমাকে?”
ক্যানিয়লের বিরক্তমাখা কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছে ইরতিজার। মানুষের বিরক্তমাখা কথাও এত সুন্দর হয় না কি? সে কিছু না বলে নীরব থাকে। ওপাশে ক্যানিয়লও নীরব। কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। বিরতির পর ক্যানিয়ল বললো,
“আমি বুঝতে পেরেছি আজ রাতে আর ঘুম হবে না আমার। তুমি এক অবাধ্য মেয়ে!”
কিছুক্ষণের জন্য আবারও নীরবতা দেখা দেয়। নীরবতা দিয়েই কলের যবনিকা টানতে চাইছিল ক্যানিয়ল। কিন্তু তার আগে ইরতিজা হঠাৎ বললো,
“তোমার মান-সম্মানের কী অবস্থা ক্যানিয়ল?”
“হোয়াট ডু ইউ মিন?” বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট ক্যানিয়লের কণ্ঠে।
ইরতিজা মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমি কি তোমার প্রেমে পড়েছি ক্যানিয়ল? না কি তুমি পড়েছো? না কি আমরা দুজনই পড়েছি?”
কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই স্তম্ভিত হয়ে গেল ক্যানিয়ল। হৃদস্পন্দন থমকে গেল। এই মাত্র কী বললো মেয়েটা?
_________________
পুরো তিনদিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হলো। এর কারণ তুষারপাত! প্রবল তুষারপাতের কারণে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সব কিছু। বৃষ্টিটাও যেন আড়ি করে দেরিতে ঝরলো। না হলে আরও আগেই গলে যেত বরফ। বরফ যে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে তা নয়। প্রকৃতিপানে তাকালে এখনও দেখা যায় তুষারপাতের চিহ্ন। গোলাপি আভার আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ইরতিজা। সামনে লেকের টলমলে পানি। আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুঁটে আছে তাতে। পাহাড়ের চূড়ায় বরফ জমে সাদা হয়ে আছে। সামনে লেক আর লেকের পিছনে পাহাড়। অপরূপ এক দৃশ্য বলে মনে হলো ইরতিজার। আকাশি রঙের শাড়ির সাথে একটা আকাশি রঙের কোট পরেছে সে। মাথায় শাড়ির সাথে ম্যাচ করে হিজাব পরেছে। সাজিদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ইরতিজাকে। এক সময় বললো,
“তুমি ভালো শাড়ি পরতে জানো না ইরতিজা!”
কথাটা শুনে ইরতিজা লেক থেকে দৃষ্টি এনে সাজিদের দিকে তাকালো। আজ সে তাড়াহুড়ো করে শাড়ি পরেছে সেটা ঠিক, কিন্তু শাড়ি পরা যে খারাপ হয়েছে এটা মানতে নারাজ। কিন্তু সাজিদের কথাটায় সে সায় মিলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, ভালো শাড়ি পরতে জানি না আমি। আর যে মেয়ে ভালো শাড়ি পরতে জানে না তাকে বিয়ে করা মানে গুণহীন কাউকে জীবনসঙ্গী করা। আপনি তো একজন বহু গুণসম্পন্ন ব্যক্তি। আপনার এমন কাউকে বিয়ে করা উচিত যার মাঝে হাজার হাজার গুণ আছে।”
ইরতিজার কথাটায় হাসলো সাজিদ। বললো,
“আপনি সব সময় এই বিয়েটা ভাঙার চেষ্টায় থাকেন কেন?”
“কারণ চাই না এই বিয়েটা হোক। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না এটা তো সেই পুরোনো কথা। এবার বিয়েটা ভেঙে গেলেই নতুন একটা কাহিনীর সূচনা হবে। আপনি কি চান না পুরোনো কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে একটা নতুন কাহিনীর সূচনা হোক?”
“চাই। তবে বিয়ে ভেঙে নয়, বিয়ে হয়ে গিয়ে নতুন কাহিনীর সূচনা হোক এটা চাই।”
ইরতিজা বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করলো।
“আপনি শুধু শুধু নিজের জীবনের সময় অপচয় করছেন। এতদিনে খোঁজ করলে খুব ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন।”
“ভালো মেয়েতে এলার্জি আমার, খারাপ মেয়েই আমার জন্য পারফেক্ট।”
কথাটায় ইরতিজার বিরক্ত তো লাগলোই সাথে রাগের একটা সুতোয়ও টান পড়ে ঝিরঝির করে কেঁপে উঠলো। ইচ্ছা করলো র’শি দিয়ে বেঁ/ধে এই ঘাড়ত্যারা লোকটার ঘাড় সোজা করে। কিন্তু পিছিয়ে যেতে হলো ইচ্ছাটা থেকে। বললো,
“এত ঘাড় ত্যাড়ামি আমি সহ্য করতে পারি না।”
“কথায় কথায় আপনার এই ‘বিয়ে করবেন না’ কথাটাও আমি সহ্য করতে পারি না।”
ইরতিজা দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। কিছু বলে আর কথা বাড়ানোটাই অনুচিত মনে হলো তার। সে তাৎক্ষণিক সাজিদকে নির্দেশ দিলো তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সাজিদ নির্দেশ পালন করলো। গাড়িতে উঠে বসে ইরতিজা অনুভব করলো শাড়ি পরাটা ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। পরতে তো একদমই চায়নি। কিন্তু সাজিদ যখন শাড়ি পরার কথা বলেছিল তখন সেখানে নওরিন এবং মা উপস্থিত ছিল। শাড়ি পরতে না চাইলে নওরিন তাকে অনেক কিছু বলেছে। বাধ্য হয়ে তাই শাড়িটা পরে নিয়েছে। সাজিদ ইরতিজাকে এরিয়ার ভিতরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। জরুরি কল এসেছিল বসের থেকে। এখনই দেখা করতে বলেছে।
আকাশের গোলাপি আভা এখনও বিরাজমান। বাতাসে শীতলতার অনুভব। চলতে চলতে ক্যানিয়লকে ভাবছিল ইরতিজা। সেদিনের পর ক্যানিয়লের সাথে আর কথা কিংবা দেখা হয়নি। এমনটা কেন হচ্ছে? শূন্যতা উপলব্ধি হচ্ছে তার! একটা পাজি ছেলে হঠাৎ চুপচাপ ভদ্র হয়ে গেলে সেটা মেনে নিতে হিমশিম খেতে হয় আসলেই।
এক পা, দুই পা, তিন পা করে এগিয়ে আসছিল ইরতিজা। কিন্তু তার পিছন পিছন যে আরও এক জোড়া সাবধানী পা শব্দহীনভাবে এগিয়ে আসছিল সেটা টের পায়নি। টের পাওয়া মাত্রই দাঁড়িয়ে গেল। মস্তিষ্ক সচকিত হয়ে উঠলো। দাঁড়িয়ে গেল শরীরের প্রতিটি লোম। পিছনের ব্যক্তিটাও ইরতিজার এমন দাঁড়িয়ে যাওয়াতে সচকিত হয়ে উঠলো। সে প্রস্তুত ছিল। ইরতিজাকে পিছনে ফিরতে দিলো না। ইরতিজা ফেরার আগেই একটা রুমাল জাতীয় কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরলো ওর। ইরতিজার মনে হলো তার প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে এখনই।
(চলবে)
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৫
_________________
কতক্ষণ অবচেতন ছিল জানে না, যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলো বৃহৎ এক কক্ষ মাঝে। সুবিশাল কক্ষটির চারপাশ অন্ধকার দ্বারা বেষ্টিত। কক্ষটির মাঝ বরাবর মাথার উপর জ্বলছে একটা আলোর উৎস। যা কক্ষটির মধ্যভাগকে আলোকিত করলেও পুরো কক্ষটি থেকে অন্ধকারের ঘাপটি মেরে থাকাকে দূর করতে পারেনি। কক্ষে উপস্থিত মানুষদের উপর চোখ বুলাতেই দেখা গেল দুটো মেয়ে এবং তিনটি ছেলেকে। এদের ভিতর একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে, বাকিরা শ্বেতাঙ্গ। বুকের ভিতর ‘ভয়’ নামক জিনিসটি ঝনঝন করে উঠলো ইরতিজার। নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর। নড়তে গিয়ে লক্ষ করলো সে একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় আছে। এমনকি তার হাত দুটো পিছন দিকে নিয়ে বাঁ’ধা হয়েছে। এতক্ষণ ব্যথা অনুভব না হলেও ধীরে ধীরে ব্যথাটা শরীরে জেগে উঠলো। হাত দুটোতে বেশি ব্যথা অনুভব করছে। যন্ত্রণায় ইরতিজার মুখটা মুহূর্তেই করুণ ছাপ এঁকে নিলো। সে বুঝতে পারছে না কী ঘটছে! এখানে কেন সে? এই ছেলে-মেয়েগুলো কি তাকে এখানে এনেছে? কিন্তু কেন? প্রশ্নগুলো মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারলো না ইরতিজা। ভয় করছিল, সাথে দুর্বলতাও অনুভব হচ্ছিল।
ছেলে-মেয়েগুলো ইরতিজার থেকে কিছুটা দূরে অবস্থানরত। একটা মেয়ে টুলে বসে ছিল, ইরতিজা জাগ্রত হওয়ায় উঠে দাঁড়ালো সে। মেয়েটার উচ্চতা অনেকখানি। মাথার চুলগুলো দীঘল কালো। চোখ দুটো স্বচ্ছ নীল। মুখের ভিতরে থাকা চুইংগাম অনবরত চিবিয়ে যাচ্ছে সে। শীতের মাঝেও মেয়েটার গায়ে শুধু সামান্য একটা স্লিভলেস টপ পরিধান করা। সাথে নীল জিন্স। মেয়েটা এসে ঝুঁকে পড়লো ইরতিজার দিকে। ইরতিজা ভয় পেয়ে গেল। ওর ভয়ে মিইয়ে যাওয়া চেহারাটা সহজেই প্রকাশ পেল।
মেয়েটা নিজের নীল চক্ষু বুলিয়ে ক্ষণ সময় ধরে দেখে চললো ইরতিজাকে। তারপর বললো,
“ইউ লুকিং সো গুড…বাট ইওর বয়ফ্রেন্ডস বিহেভিয়ার আর সো ব্যাড এন্ড ডার্টি!”
বলতে বলতে মেয়েটার চোখ-মুখ রোষমদপূর্ণ হয়ে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খুব জোরে একটা চ/ড় মারলো সে ইরতিজাকে। ইরতিজার মুখবিবর দিয়ে ব্যথার আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। মুখ সরে গেল অন্যদিকে। ব্যথায় টনটন করে উঠলো গাল। চোখ দিয়েও পানি ছিটকে বেরিয়ে এসেছে।
মেয়েটা নিজের দলের দিকে এগোতে এগোতে বললো,
“কল করো ক্যানিকে। ওকে আসতে বলো এখানে।”
ইরতিজার গালে আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে। ভীষণ কষ্টে ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে আসছে তার। কেন হচ্ছে এসব? ক্যানিয়ল? ক্যানিয়ল কি তাকে এখানে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছে? ইরতিজার দু চোখ বেয়ে জলের দুটি অবিগলত ধারা নেমে গেল। ক্যানিয়ল এমনটা কেন করবে? উহুঁ ক্যানিয়ল করছে না। কিন্তু তার উপর হঠাৎ এমন তান্ডব ঝড় কেন শুরু হলো?
কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটা বললো,
“শুধু কল করবো? তোমার কি মনে হয় না সাথে একটা ফটো পাঠালেও সুন্দর হয়?”
“ফটো?”
মেয়েটা ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে ইরতিজার দিকে তাকালো। তারপর আবার ঘাড় সোজা করে বললো,
“কিন্তু এমনভাবে ছবি তুলে পাঠালে ক্যানি আমাদের দুর্বল ভাববে।”
এই বলে মেয়েটা আবারও ইরতিজার কাছে এলো। খুব জোরে আবারও একটা চ’ড় বসিয়ে দিলো ইরতিজা8র গালে। এবার চ’ড়টার আঘাত ছিল আগের চেয়েও মারাত্মক। ইরতিজার ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত দেখা গেল। শরীরে এবার ভয়ের কাঁপন শুরু হলো তার। ভয়, ব্যথার যন্ত্রণায় মুখ হয়ে আছে একেবারে বিবর্ণ। ক্ষণকাল পার হতেই কেটে যাওয়া স্থান থেকে রক্তের ক্ষুদ্র ধারা গড়িয়ে পড়লো। মেয়েটা বললো,
“এবার ছবি তোলো।”
ছবি তুলে সেটা পাঠানো হলো ক্যানিয়লের কাছে। সাথে কলও দেওয়া হলো। প্রথম বার কল হলেও রিসিভ করলো না ক্যানিয়ল। ছেলেটা তাই চিন্তিত মুখে শুধালো,
“রিসিভ হচ্ছে না।”
“আবার দাও।” নীল চোখের মেয়েটা হুকুম করলো। ছেলেটা তার কথা মতো আবারও কল দিলো।
প্রথমবারই কলটা দেখেছিল ক্যানিয়ল। সে সময় ড্যাড তাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছিলেন। তাই অপরিচিত নাম্বারের কল রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন কলটা এলো তখন সে আলোচনা সভা থেকে উঠে চলে এলো।
“হু স্পিকিং?” প্রশ্ন করলো ক্যানিয়ল।
ওপাশে ছেলেটা হাসলো। ক্যানিয়ল নিজ প্রশ্নের উত্তর পেল না। ছেলেটা বললো,
“তোমার গার্লফ্রেন্ড ক্যানি…”
ক্যানিয়লের কপালে বিস্ময়ের খাঁজ পড়লো,
“গার্লফ্রেন্ড?”
মাত্র দুই মিনিটের মাথাতেই ক্যানিয়ল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এত ব্যস্ত ভঙ্গিতে সে বের হলো যে সকলের দৃষ্টিতে খুব করে লাগলো বিষয়টা। হঠাৎ কী ঘটেছে যার জন্য ক্যানিয়ল এমন ছটফটে ভাবে বেরিয়ে গেছে?
বেলিক নামের ছেলেটা খুব নিবিড়ভাবে ইরতিজাকে লক্ষ করে চলছিল। সবাই যখন ক্যানিয়লের এখানে আসার অপেক্ষা করছে চুপচাপ, তখন ছেলেটা এগিয়ে গেল ইরতিজার দিকে। হালে, অর্থাৎ নীল চোখের মেয়েটা চোখের ইশারায় ইরতিজার কাছে যেতে নিষেধ করেছিল বেলিককে। কিন্তু বেলিক তার নিষেধাজ্ঞাকে এক টুকরো বাঁকা হাসি দিয়ে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেল।
ক্রমশ ভয়ে ভিতরটা জড়োসড়ো হয়ে আসছিল ইরতিজার। এত ভয় শেষ কবে পেয়েছিল মনে করতে পারছে না! হৃদয়ে ঢুমঢুম করে ভয় শব্দ করছিল।
বেলিকও এসে হালের মতো ঝুঁকে পড়লো ইরতিজার দিকে। তবে বেলিক একটু বেশিই ঝুঁকেছে। ইরতিজা আর তার দূরত্ব মাত্র কিছুটা। বেলিকের এমনভাবে ঝুঁকে পড়ায় ভীষণ চমকে উঠেছে ইরতিজা। আতঙ্কগ্রস্ত হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার মাঝ বরাবর আটকে রয়েছে।
বেলিক খুব মনোযোগ সহকারে দেখলো ইরতিজার ভীত সন্ত্রস্ত মুখখানি। চোখ, ঠোঁট, নাক, কপোল সবকিছুতেই খুব নিবিড়ভাবে দৃষ্টি বুলিয়ে গেল সে।
ছেলেটার অধরে বিদ্যমান বাঁকা হাসিটাকে ইরতিজার কাছে কাঁটার ন্যায় মনে হলো। ছেলেটা বললো,
“তুমি দেখতে ভীষণ সুন্দর প্রিন্সেস। প্রথম দেখায় তোমাকে যার ভালো না লাগবে, ধরে নিতে হবে তার মস্তিষ্কে কিছু বিষয়ের অনুপস্থিতি রয়েছে।”
বেলিক ইরতিজার মাথায় দৃষ্টি দিলো। একরাশ অসন্তুষ্টি এসে ঘিরে ধরলো তাকে। গাম্ভীর্য কণ্ঠে বললো,
“নিজের সুন্দর চুলগুলোকে কেন ঢেকে রেখেছো? জানো মেয়েদের কোন বিষয়টা আমার হৃদয়ে বেশি দোলা দেয়? মেয়েদের চুলের ঘ্রাণ!”
কথাটা বলতে বলতে মুখটা ইরতিজার কানের কাছে নিয়ে গেল। কিছুটা ফিসফিসানি সুরের শোনালো তার শেষের কথা। ইরতিজা আঁতকে উঠলো।
বেলিক হাত বাড়ালো ইরতিজার মাথার দিকে। হিজাবটা হাত দিয়ে স্পর্শ করা মাত্রই ইরতিজা বলে উঠলো,
“কী করছো তুমি?”
বেলিক তার মাথার হিজাবটা খুলতে চাইছে বুঝতে পেরেই ভীষণ রকম ছটফট করে উঠলো ইরতিজা। মৃদু চিৎকারের সুরে বললো,
“ডোন্ট ডু ইট…ডোন্ট প্লিজ!”
ইরতিজা নিজের হাতদুটো ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। শত টানা-হিঁচড়া করেও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। বেলিক ছেলেটা মাথার হিজাবটা খুলে ফেলেছে! ইরতিজা বার বার থামতে বলছিল ছেলেটাকে কিন্তু ছেলেটা শুনলো না। হিজাবটা খোলার পর সে ইরতিজার বাঁধা চুলগুলোও খুলে দিলো। এরপর কুৎসিত ভাবে বুক ভরে টেনে নিলো ইরতিজার চুলের ঘ্রাণ!
হঠাৎই ভীষণ ঘৃণা এসে জাপটে ধরলো ইরতিজাকে। ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো তার! কিছু সামনে থাকা চুল বেলিক হাত দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। এরপর ইরতিজার ঠোঁটের কেটে যাওয়া অংশটা স্পৰ্শ করে মুছে দিলো রক্ত। বললো,
“তোমার বয়ফ্রেন্ডও আমার শরীর থেকে এমন লাল র’ক্ত ঝরিয়েছে। আমিও ওর শরীর র/ক্তা/ক্ত করতে চাই। তবে তোমার শরীরের এই রক্ত আমাকে কষ্ট দিচ্ছে সুইটহার্ট।”
বলে অদ্ভুতভাবে হাসলো বেলিক। তারপর হাতে থাকা চা’কুটা দেখিয়ে বললো,
“এটা দিয়ে আ/ঘা/ত করা হবে ওকে।”
বলে সে ইরতিজার পিছনে এসে চা’কু’টা ইরতিজার গলায় চে’পে ধরলো। হাসতে হাসতে বললো,
“এটা এখন তোমার গলায় টেনে দিলে কী হবে ভেবে দেখেছো সুইটহার্ট?”
ইরতিজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আরও কিছুক্ষণ যদি চা’কুটা এমনভাবে তার গলায় ধরে রাখা হয় তবে সত্যি সত্যি বোধহয় শ্বাস রোধ হবে তার। পিছন থেকে বেলিক আবার বললো,
“ভয় নেই, আমি অবশ্যই চাইবো না তুমি এভাবে আ’হত হও।”
চা’কুটা নামিয়ে নিলো বেলিক। ইরতিজা যেন প্রাণ ফিরে পেল। ফিরে পাওয়া প্রাণটা হঠাৎ আবার খা’মচে ধরলো ঘাড়ের পিছন থেকে বেলিকের নিচু স্বরের কথাটা,
“আগামীকাল তুমি ফ্রি আছো প্রিন্সেস? ফ্রি থাকলে কাল সারাটা দিন আমরা একসাথে কাটাতে পারতাম, এমনকি রাতটাও একসাথে কাটানো যেত।”
ইরতিজার বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কান্নাটা আর কোনোরকম আটকে রাখার চেষ্টা চালালো না সে। কাঁদতে কাঁদতে হালের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এমনটা কেন করছো? অপরাধ কী আমার? কোন দোষে এমন শাস্তি দিচ্ছ? কারা তোমরা?”
কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে এবার আর কোনো ভয় ভীতি অনুভব করলো না ইরতিজা।
ঘটনাগুলো ঘটেছিল আজ থেকে বেশ কিছুদিন পূর্বে। হালেদের ছয়জনের একটা দল আছে। যার মধ্যে পাঁচজনই এখানে উপস্থিত। দলটা মূলত বলতে গেলে দুর্বলদের উপর জু’লু’মকারী দল। সেই সাথে আছে ই’ভটিজিংও। দেখা যায় এরা প্রায়শই দুর্বলদের সাথে অন্যায় করছে। ঠিক এমনটাই দেখে ফেলেছিল ক্যানিয়ল। দুটো ছেলে-মেয়ের সাথে খুব বাজে আচরণ করেছিল এরা। ক্যানিয়লের ওসব সহ্য হয়নি। আর তাই সে হালের দলকে মেরেছিল। যদিও হালে এবং আরেকটি মেয়েকে মারেনি, কারণ তারা মেয়ে সেজন্য। বেলিক এবং রেন্ডি নামের ছেলেটা তো ক্যানিয়লের কাছে মা’র খেয়েছে দুইবার। প্রথমবার মা’র খেয়েছিল একটা মেয়ের সাথে অ’সভ্যতামি করার জন্য।
হালে ইরতিজাকে এসব ব্যাপারে কিছু বললো না। আসলে এসব কথা ইরতিজাকে বলার কোনো প্রয়োজনই নেই। ইরতিজাকে তারা এনেছে ক্যানিয়লকে ক্যাচ করার জন্য। ক্যানিয়লকে এমনি এমনি তারা কোনো কিছু দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না জানে। তাই তো এই পথ অবলম্বন করে ক্যানিয়লকে ডাকতে হলো তাদের। ক্যানিয়ল এখানে আসার পর একটা হা’ঙ্গা’মা হবে। এটা আসলে প্রতিশোধ মূলক একটা বিষয়।
পরিত্যক্ত ম্যানশনের বাইরে গাড়িতে ব্রেক কষার শব্দ শোনা গেল হঠাৎ। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দটা খুব জোরে শোনালো। সবার ধারণাই জানান দিলো ক্যানিয়ল এসেছে। হালে এগিয়ে গেল কক্ষটির কর্ণারে জমে থাকা অন্ধকারের দিকে। সেখান থেকে দুই হাতে করে তিনটা হকিস্টিক নিয়ে ফিরলো। ছেলে দুটোর দিকে দুটো হকিস্টিক বাড়িয়ে দিলো।
সামনে কী ঘটতে চলেছে ধারণা করতে পারছে না ইরতিজা। মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দু চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। এরা কি ক্যানিয়লকে মা’রা’র প্রস্তুতি নিচ্ছে?
শূন্য দরজায় হঠাৎ ক্যানিয়লের পদচারণ পড়লো। সে এক পা থামলো না। ধীর পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগলো। এগোতে এগোতে লক্ষ করলো হালে এবং ছেলে দুটোর হাতে থাকা হকি স্টিক। এমনকি তার শান্ত ধারালো চোখ জোড়া থেকে বেলিকের হাতের চা’কুটাও দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারলো না। সবকিছু এক পলক দেখে নিয়ে সব শেষে তাকালো ইরতিজার দিকে। ইরতিজার রক্তিম গাল এবং ঠোঁটের ক্ষতটা চোখে পড়তেই দৃষ্টি ক্রুর হয়ে উঠলো তার। ক্ষণিকেই তা আবার নেমে এলো নমনীয়তায়। ইরতিজার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো সে। কোমল আঁখিতে চেয়ে বললো,
“ঠিক আছো তুমি?”
ক্যানিয়লের এই প্রশ্নটায় ইরতিজার শুষ্ক হৃদয় ভিজে উঠলো প্রশান্তি বর্ষণে। এই প্রশ্নটির মাঝে সে খুঁজে পেল ভরসা, ভালো লাগা। মৃদু মাথা দুলিয়ে বললো,
“ঠিক আছি।”
“সত্যি?”
“হুম।”
কথাটা বলার খানিক পরেই আবার দুই পাশে মাথা নেড়ে কেঁদে বলে উঠলো,
“না, আমি ঠিক নেই।”
ক্যানিয়লের চোখের দৃষ্টি নম্র। ইরতিজার ঠোঁটের কে’টে যাওয়া স্থানটায় অঙ্গুলি স্পর্শ রেখে বললো,
“স্যরি পাকিস্টানি গার্ল! জানতাম না কেউ আমার জন্য এরকম আহত হবে। সত্যিই জনতাম না। স্যরি! এবং থ্যাঙ্ক ইউ এটার জন্য যে, আজ তোমার আহত হওয়ার কারণে বুঝতে পারলাম, কেউ একজন আছে আমার। আমার বিষাদের আকাশে সত্যিই একটা নক্ষত্র আছে। যেটা এখন আর ঝাপসাভাবে নয়, বরং ভীষণ উজ্জ্বলভাবে নিজের দুত্যি ছড়াচ্ছে!”
(চলবে)
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৬
_________________
ক্যানিয়ল হাত থেকে হকিস্টিকটা ফেলে দিলো।
হটিস্টিকের গায়ে র/ক্ত লেগে রয়েছে। কার র’ক্ত সেটা পার্থক্য করা দুষ্কর এখন। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে ব্যথায় কাতরাচ্ছে প্রত্যেকে। ক্যানিয়লও যে আঘাত পায়নি সেটা নয়। ঘাড়ে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করার ফলে তার শুভ্র ঘাড় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
হালে আছে একটা চেয়ারের সাথে আবদ্ধ অবস্থায়। তার ডান গালটা লাল হয়ে আছে র’ক্ত জমাট বেঁধে। ব্যথায় ওপাশটা অবশ এখন। ইরতিজার মতো তার ঠোঁট কে’টে র’ক্ত না পড়লেও নাক দিয়ে র’ক্ত ঠিকই পড়েছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছে, তবুও সে নিশ্চুপ ক্ষুব্ধ চাহনিতে ক্যানিয়লের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। ক্যানিয়ল তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“মেয়েদের গায়ে কখনোই হাত তুলতে চাইনি আমি। এটা আমার পছন্দ না। এই জন্য সেদিন রে’হা’ই দিয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু আজ তোমাকে আঘাত না করে থাকতে পারলাম না। কারণ তুমি অ’স’ভ্য’তা’মি’র সীমা অতিক্রম করেছো। ব্যাপারটা শুধু আমাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকা শ্রেয় ছিল। তোমার উচিত হয়নি আমার মানুষদের এর মাঝে টানা। উচিত হয়নি ওর গালের ওই লাল অবস্থার সৃষ্টি করা! যদি এটা না করতে তাহলে তোমার গালও এখন দ্বিগুণ লাল হতো না।”
হালে দাঁতে দাঁত চেপে গা’লি দিয়ে উঠলো,
“সন অব অ্যা বি…”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই ক্যানিয়ল আরও একটা থা/প্প/ড় বসিয়ে দিলো হালের গালে। হালের মুখ অন্যদিকে সরে গেল। অসহনীয় ব্যথারা চিৎকার করে উঠলো! যদিও হালের মুখ থেকে তেমন কোনো শব্দ নির্গত হলো না।
ক্যানিয়ল চেয়ারের দুই হাতলে ভর দিয়ে কিঞ্চিৎ ঝুঁকলো হালের দিকে। হালের চোখের দৃষ্টি তখনও ক্ষুব্ধতার পরিচয় বহন করছে। ক্যানিয়ল তার হিং’স্র চোখ জোড়া হালের চোখেতে রেখে বললো,
“আর কখনও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করো না। এবারের মতো আঘাতটা সামলে উঠতে পেরেছো, পরবর্তীকালে সেটা নাও পারতে পারো। কারণ আমি যথেষ্ট ভালো আচরণ বজায় রাখবো না। রাখার চেষ্টা করবো না। অবস্থা হবে খুব করুণ!”
ক্যানিয়ল ইরতিজার কাছে এসে ওর একটা হাত ধরে বললো,
“চলো।”
ইরতিজাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ক্যানিয়ল, কিন্তু কয়েক পা সামনে এগিয়েই হঠাৎ থেমে গেল ইরতিজা। ক্যানিয়ল পিছন ফিরে তাকালো। ইরতিজা ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
“ওদের শাস্তি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।”
ক্যানিয়লের নেত্রতে জিজ্ঞাসু ভাব এসে হানা দিলো। ইরতিজা মেঝেতে শায়িত অবস্থায় ব্যথায় কাতরানো বেলিককে দেখিয়ে বললো,
“ও আমার সাথে নোংরা আচরণ করেছে!”
ক্যানিয়লের দৃষ্টি মুহূর্তেই ইরতিজার থেকে ঘুরে গিয়ে শান্ত ক্ষিপ্র রূপ নিয়ে তাকালো বেলিকের দিকে। ওর নিঝুম হিং’স্র চোখ জোড়া দেখে বেলিক আরও জড়োসড়ো হয়ে গেল ভয়ে। ক্যানিয়ল জিজ্ঞেস করলো,
“কী করেছে ও?”
কথাটা বলতেই ঘেন্না বোধ হচ্ছে ইরতিজার। কিন্তু ক্যানিয়লকে বিষয়টা জানানো উচিত বলে মনে করছে। বেলিকের এত কম মার খাওয়া তার কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে। বেলিক যদি আরও আঘাত পেতো তাহলে দৃশ্যটা আরও বেশি দৃষ্টি নন্দন হতো। ইরতিজা রোষপূর্ণ হয়ে বলে উঠলো,
“ও আমার মাথার হিজাব খুলে ফেলেছে! আমার চুল শুঁকেছে! আমার ঠোঁট স্পর্শ করেছে!”
ক্যানিয়লের চোখে দ্বিগুণ হিং’স্রতা জেগে উঠলো। ক্ষণকাল সে একইভাবে তাকিয়ে রইল বেলিকের দিকে। তারপর হঠাৎ এগিয়ে এলো বেলিকের কাছে।
বেলিক ভয়ে মিইয়ে যাচ্ছে। ক্যানিয়লের চোখে এই মুহূর্তে মানবিকতার ছোঁয়া মিললো না। ওর নিষ্প্রাণ আঁখি জোড়ায় তাকিয়ে বেলিকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ক্যানিয়লের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। বেলিককে বললো,
“অন্যের গার্লফ্রেন্ডের সাথে বেয়াদবিই সহ্য করতে পারি না, সেখানে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে বেয়াদবির সাজা কী হতে পারে সেটা মাথায় রাখা উচিত ছিল তোমার।”
অকস্মাৎ ক্যানিয়ল বেলিকের চুল শক্ত মুষ্টিতে চেপে ধরলো। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো বেলিক। ক্যানিয়ল শুধালো,
“তোমার চুলগুলো আমার শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে।”
এই বলে আরও জোরে চেপে ধরলো। ওদিকে বেলিকের আ’র্ত’না’দও খুব জোরে শোনা গেল। ক্যানিয়ল বেলিককে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে এলো ইরতিজার দিকে। ইরতিজা অবাক! কথাটা জানার পরও ক্যানিয়ল বেলিককে কিছু না বলে, না মে’রে এভাবে ছেড়ে দিয়েছে?
“তুমি ওকে মা’রলে না কেন?” ক্যানিয়ল নিকটে আসা মাত্রই প্রশ্ন ছুঁড়লো ইরতিজা।
ক্যানিয়ল উত্তর না দিয়ে ওর এক হাত ধরে যেতে উদ্যত হলেই ইরতিজা হাত ছাড়িয়ে নিলো। বেলিকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো,
“ওকে তুমি এভাবে ছেড়ে দিতে পারো না। ওর শরীরে আরও আ’ঘা’তের চিহ্ন থাকা প্রয়োজন।”
ক্যানিয়ল কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ, তারপর ইরতিজাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো। গাড়িতে উঠে বসা মাত্রই ইরতিজা বললো,
“তুমি কেন মা’র’লে না ওকে? ওকে আরও মা’র’ধ’র করা প্রয়োজন ছিল। কেন মা’র’লে না তুমি? এমনি সময় তো অন্যদের খুব মা’র’তে পারো, তাহলে আজ কেন নয়?”
ক্যানিয়ল গাড়ি স্টার্ট করে বললো,
“চুপ করো ইজা। এই মুহূর্তে কিছু শুনতে ভালো লাগছে না।”
ইরতিজার ভিতরটা খুব আঘাতপ্রাপ্ত হলো। যা তার দু চোখে জল এনে দিলো। সে ভেবেছিল কথাটা জানার পর ক্যানিয়ল বেলিককে খুব মা’র’ধ’র করবে, কিন্তু ক্যানিয়ল তেমন কিছুই করেনি। হিজাব খুলে ফেলা, চুলের ঘ্রাণ শোঁকা, এই ব্যাপার দুটো জীবনের কুৎসিত মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম! এমন কুৎসিত কাজ এর আগে কেউ করেনি তার সাথে। ক্যানিয়লের কারণে আজ সে আ’ঘা’ত পেয়েছে, এ জন্য কোনো অভিযোগ নেই তার ক্যানিয়লের প্রতি। সব অভিযোগ একটা কারণেই, সেটা হলো ক্যানিয়ল কথাটা জানার পরও কেন মা/র/লো না বেলিককে? তবে কি ক্যানিয়ল তাকে ভালোবাসে না? এ জন্যই কি তার সাথে কে কি করলো না করলো এই নিয়ে যায় আসে ক্যানিয়লের? ইরতিজার নয়ন আরও ভার হয়। ঝরে পড়ে নয়ন নির। সিদ্ধান্ত নিলো ক্যানিয়লের সাথে চলতি পথে আর একটা কথাও বলবে না সে।
গাড়ি এসে থামলো একটা শপের সামনে। ক্যানিয়ল বেরিয়ে গেল, ইরতিজাকে নামতে নিষেধ করলো। হঠাৎ এখানে কেন গাড়ি দাঁড় করানো হলো বুঝতে পারছে না ইরতিজা।
কিছু সময় পরই ফিরে এলো ক্যানিয়ল। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। গাড়িতে উঠে ব্যাগ থেকে বের করলো একটা হিজাব। হিজাবটা পরম যত্নের সাথে জড়িয়ে দিলো ইরতিজার মাথায়।
ক্যানিয়লের এই কাজটায় ইরতিজার মনের সকল অভিমান কেটে গিয়ে এক ফালি রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়লো মন সাম্রাজ্যে। সে পলকহীন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল ক্যানিয়লের দিকে। এর মাঝেই ক্যানিয়ল দুই হাতের আলতো ছোঁয়ায় তার মাথাটা নিজের নিকটে নিয়ে গেল। ওষ্ঠাধর ছোঁয়ালো ইরতিজার মাথায়।
ইরতিজা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। থমকে গেল তার হৃদস্পন্দনও। দু চোখে বিস্ময়ের ঘোর ছায়া নেমে এলো। ক্যানিয়ল বললো,
“বেলিকের করা কাজ চরম ভুল ছিল! আমি নিশ্চয়ই এ ভুল ক্ষমা করবো না।”
ইরতিজা বিস্ময় থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে। ক্যানিয়লের কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও মনে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা দেখাতে পারেনি। একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটায় সে বাকরুদ্ধ, অভিভূত এবং স্তব্ধ!
পথে আর কোনো কথা হলো না দুজনের মাঝে। ইরতিজা বাড়িতে ঢুকলো মুখ ঢাকা অবস্থায়। বাড়ির লোক ভাবছে সে এতক্ষণ সাজিদের সাথে ছিল। কিন্তু এতক্ষণে যে তার জীবনে কত কী ঘটে গেছে তার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল একমাত্র সে। বাড়িতে মুখ ঢেকে প্রবেশ করলেও অসাবধান বশত নওরিনের সামনে তার মুখ প্রকাশ পেয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে গেল ইরতিজা। ইরতিজার ঠোঁট দেখে কেমন চোখ সরু করলো নওরিন। তার মন প্রথমেই ভুল ভেবে নিলো ক্ষতটা দেখে। পর মুহূর্তেই তার খেয়ালে এলো ইরতিজার গাল লালচে হয়ে আছে। সে এবার বিস্মিত হলো। সে ধরে নিলো ইরতিজার ঠোঁটের ক্ষত এবং গালের এমন লালচে বর্ণ, উভয় কারণের পিছনেই সাজিদ আছে। সে ইরতিজাকে জিজ্ঞেস করলো,
“এনিথিং রং?”
ইরতিজা কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। নওরিন তাকে দেখে কী ভাবছে কে জানে! কিন্তু মিথ্যা একটা গল্প তো বানাতেই হবে। ইরতিজার মন বিচলিত, কিন্তু সে চেহারা যথেষ্ট দৃঢ় রেখে বললো,
“আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে…গাড়ি থেকে নামার সময় পড়ে গিয়েছিলাম। যার কারণে এই…”
ইরতিজা স্পষ্টতরভাবে সব কথা শেষ করলো না।
নওরিনের দৃষ্টি সন্দিহান। বোঝাই যাচ্ছে সে ইরতিজার কথা বিশ্বাস করেনি। দু চোখে সন্দেহের প্রকাশ, মুখে বললো,
“ঠিক আছে, ফ্রেশ হয়ে নাও।”
নওরিন চলে গেল। হাফ ছেড়ে বেঁচেও যেন বাঁচতে পারলো না ইরতিজা।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইরতিজার ক্যানিয়লকে মনে পড়ছিল। গাড়িতে থাকাকালীন দৃশ্যটা বার বার ভেসে উঠছিল চোখে। হিজাবটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল। এই হিজাবে ক্যানিয়লের ওষ্ঠ পরশ লেগে রয়েছে! ভালো লাগার রিম ঝিমঝিম বৃষ্টি হঠাৎই কোথা থেকে এসে যেন ছুঁয়ে দিলো ইরতিজাকে। এর মধ্যেই শুনতে পেল রুমের ভিতর মোবাইলটা বাজছে। ইরতিজা বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। সাজিদের নামটা দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। কল রিসিভ করে কানে লাগাতেই সাজিদ বললো,
“কোথায় কোথায় আ’ঘা’ত পেয়েছেন ইরতিজা?”
“বুঝলাম না। কীসের আ’ঘা’তের কথা বলছেন?”
“কেন? আমার গাড়ি থেকে নামার সময় যে পড়ে গেলেন, সেই আ’ঘা’ত!”
ইরতিজা চমকে উঠলো,
“আপনি জানলেন কীভাবে?”
“আমার গাড়ি থেকে পড়ে গেলেন, আমার সামনে, আর আমি জানবো না?”
সাজিদের কণ্ঠে ব্যাঙ্গাত্মক ভাব। ইরতিজা বুঝতে পারলো নওরিন কথাটা জানিয়েছে সাজিদকে। কারণ কথাগুলো তো সে নওরিনকেই বলেছিল।
“আসলে…”
সাজিদ ইরতিজাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আপনার আসল কথা রাখুন, সত্যি কথা বলুন। মিথ্যা কেন বলেছেন আপনি? আপনি তো গাড়ি থেকে নামার সময় পড়েননি। তাহলে কেন এই মিথ্যা বলা?”
চু’রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া চো’রের মতো ফিল হচ্ছে ইরতিজার। কী বলবে এখন? সে কণ্ঠকে যথেষ্ট সবল রেখে বললো,
“আমি কি আসামি? পুলিশের মতো জেরা করছেন কেন আমাকে?”
“আপনি আসামি নন, কিন্তু আমার হবু স্ত্রী আপনি। আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ তো করতেই পারি।”
“পারেন না। আমার উপর কোনো অধিকার নেই আপনার। আমি আপনাকে অনেক আগেই বলে দিয়েছি আপনাকে আমি বিয়ে করবো না। যেখানে আমাদের বিয়েটাই হবে না, সেখানে এমন জিজ্ঞাসাবাদ করার মাধ্যমে অধিকার দেখানোর চেষ্টা করবেন না।”
“আমি যদি বলি আমাকে আপনার বিয়ে করতেই হবে, তাহলে?”
“আমার এমন কোনো বাধ্য বাধকতা নেই। যখন আমি বলেছি বিয়েটা করবো না, তখন অবশ্যই এটা ওই ‘না’ শব্দতেই আটকে থাকবে।”
ওপাশটা অনেকক্ষণ নিঝুম রইল। এরপর হঠাৎ নীরবতার জাল ছিদ্র করে সাজিদের কথাগুলো ধারালো ফ’লা’র মতো এসে আ’ঘা’ত করলো ইরতিজাকে।
“আপনার ঠোঁটের ওই ক্ষত কি আপনার প্রেমিকের কারণে সৃষ্টি হয়েছে ইরতিজা?”
“মানে?”
“আপনার প্রেমিক চুমু খেয়েছে আপনাকে, এটাই তো?”
ইরতিজা রাগে ফেঁটে পড়ে বললো,
“নিজের মন গড়া মতো যা তা কথা বলা বন্ধ করুন সাজিদ। আপনি লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন!”
সাজিদ ইরতিজার কথায় কর্ণপাত না করে বললো,
“আপনার বাবা চান আমাদের বিয়েটা হোক। আর আপনি আপনার বাবার চাওয়াকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না এটা ভালো করেই জানেন। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আপনার প্রেমিক একজন ক্রিশ্চিয়ান।”
ইরতিজার কাছে সত্যিই অসহ্য লাগছে বিষয়টা। সাজিদ এখনও জোনাসকে তার প্রেমিক ভাবে! ইরতিজা আর এই ভুল বোঝাবুঝিটা নিতে পারছে না। বললো,
“আপনাকে একটা সত্যি কথা বলবো। এটা আসলেই সত্যি। মিথ্যার কোনো অবকাশ নেই এখানে। জোনাস আমার প্রেমিক নয়। না আগে কখনও ছিল। আমরা আগে জাস্ট বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। হ্যাঁ, মাঝখান থেকে ও আমাকে প্রোপোজ করেছিল। আর সেটা করার পর থেকে আমদের বন্ধুত্বের সেই সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে! আমদের সম্পর্কটা এখন বন্ধুতেই নেই, সেখানে আপনি প্রেমিক কী করে ভাবলেন? এটা একান্ত আপনার ভুল ধারণা। এছাড়া কিছু নয়।”
“আমি সহ্য করবো না ইরতিজা। আগে আপনার প্রেমিকের ব্যাপারটা কষ্ট হলেও সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু এখন? এখন পারি না। রাগ হয়, হিংসা হয়, কষ্ট হয়। আপনি দূরে থাকুন জোনাসের থেকে। না হলে আমাকে এগিয়ে আসতে হবে। আমি চাই না আপনি কষ্ট পান। আমি আপনাকে ঠিক তখনই বিয়ে করতে চেয়েছি, যখন আপনি চাইবেন এই বিয়েটা হোক। আমাকে এগিয়ে আসতে বাধ্য করবেন না। একটা অসুখী সম্পর্কের সৃষ্টি হোক আমি চাই না।”
কল কাটলো সাজিদ।
সাজিদের কথাগুলো ইরতিজাকে বিমূঢ় করে রাখলো কিছুক্ষণ। সে অন্যমনস্ক অবস্থায়ই বললো,
“আমি কখনও চাইবো না বিয়েটা হোক। আর একটা অসুখী সম্পর্কের সৃষ্টি হোক সেটা তো কখনোই চাইবো না।”
ইরতিজা হাত থেকে মোবাইলটা বিছানায় ফেললো। হিজাবটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা হৃদয় ছেড়া নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।
(চলবে)