#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৫০ (অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
টানা তিনদিন বৃষ্টির পর আজ গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের রশ্মি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। গাছের পাতায় পাতায় এখনো কিঞ্চিৎ জলের ফোটা বিদ্যমান। ফুপা, ফুপি, নেহা, নিহিত দেশে ফেরার পর থেকে বৃষ্টির কারণে ঘরবন্দি হয়ে আছে। সবার সাথে শপিং-এ যাবে বলে মুখিয়ে ছিল নেহা। বৃষ্টি সেই ইচ্ছে পূরণে ব্যাঘাত ঘটালেও আজ সে-ই সুযোগ করে দিয়েছে। তাই এক চিলতে হাসি তার চোখেমুখেও কিরণ ছড়াচ্ছে।
ইফতারের পরপর সবাই মিলে যাবে শপিং করতে। অর্ষা রেণুর সাথে বিকেলে ইফতার বানাচ্ছিল। সঙ্গে আমেনা বেগম এবং ফুপিও ছিল। নেহা কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে রান্নাঘরে ছুটে আসে। দাঁড়ায় অর্ষার গা ঘেঁষে।
ঘামে ভেজা অর্ষা আড়দৃষ্টিতে একবার নেহার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,’কী ব্যাপার?’
নেহা অবুঝের মতো বলে বসে,’কাজ করছ?’
ফুপি এবার গম্ভীর হয়ে নেহাকে শুধালেন,’মতলবটা কী তোর?’
নেহার একটু রাগ হলো। গাল ফুলিয়ে দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায় সে। অভিমানী কণ্ঠে বলে,
‘মতলব আবার কী হবে? তুমি তো আমার সব কাজেই দোষ খুঁজে বেড়াও।’
‘আসছে! তুই কাজটা করিস কী যে তোর দোষ খুঁজব? তুই কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই রান্নাঘরে আসিসনি।’
আমেনা বেগম তার ননোদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,’আহা! থামো তো তুমি। সবসময় মেয়েটাকে এমন ধমকের ওপর রাখো কেন?’
নেহা যেন একটু আশ্রয়স্থল খুঁজে পেল। ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
‘মা সবসময়ই এমন করে মামী।’
‘তোর কিছু লাগবে?’
‘হু। ভাবিকে।’
সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। নেহা থতমত খেয়ে বলে,’না মানে, গল্প করার মতো তো কেউ নেই। ভাবিকে নিয়ে যাই?’
আমেনা বেগম হেসে বললেন,’যা।’
তার বলতে বাকি অর্ষার হাতে টান পড়তে আর দেরি হয় না। এজন্য অবশ্য নেহার মা পেছন থেকে কিছুটা বকাবকিও করেছেন। কিন্তু তাতেই বা কী আসে যায়? নেহাকে আর পায় কে!
অর্ষার রুমে গিয়ে বসল দুজন। নেহাকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছে ভীষণ। অর্ষা বলল,’শুরু করো তোমার গল্প।’
‘গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং ভাবি।’
‘তাই? শুনি সেই ইন্টারেস্টিং গল্পটা?’
‘তার আগে প্রমিস করো তুমি কাউকে কিছু বলবে না?’
‘আচ্ছা যাও প্রমিস।’
‘আমার একটা ফ্রেন্ড আছে বাংলাদেশের। ফেসবুকেই পরিচয় হয়েছিল। ও জানে যে, আমি বাংলাদেশে আছি এখন। তাই খুব করে চাচ্ছে দেখা করতে।’
‘ছেলে ফ্রেন্ড নাকি মেয়ে ফ্রেন্ড?’
‘ছেলে ফ্রেন্ড।’
‘ওহ্! বয়ফ্রেন্ড বুঝি?’
‘না, না ভাবি। সত্যিই সে শুধুমাত্র আমার ফ্রেন্ড হয়। খুব ভালো বন্ধু বলতে পারো।’
‘আচ্ছা তো বেশ! বাড়িতে আসতে বলো।’
নেহা বিছানায় দু’পা তুলে বসতে বসতে বলল,’পাগল হয়ে গেছ তুমি? আব্বু আম্মু জানতে পারলে জানে মে’রে ফেলবে।’
‘আজব! কেন? ফ্রেন্ড থাকতে পারে না নাকি?’
‘পারে। কিন্তু বিশ্বাস করবে না। ভাববে মিথ্যা বলছি।’
‘এখন তাহলে কী করা যায়?’
‘ও বলেছে সাথে যেন কাউকে নিয়ে আসি। তুমি চলো না ভাবি প্লিজ!’
অর্ষা অবাক হয়ে বলল,’আমি? কী করে সম্ভব?’
‘অসম্ভবের কী হলো? বাসায় বলবে আমরা ঘুরতে যাব।’
অর্ষা কিছু সময় ভেবে বলল,’ঠিক আছে। তবে এখন নয়। ঈদের দিন। আমরা সবাই মিলে সেদিন ঘুরতে বের হব। তোমার ঐ ফ্রেন্ডের সাথে আশিক কিংবা দিদারের আগেই পরিচয় করিয়ে দেবো। আর তোমার ভাইয়ার কাছে বলব যে, সে কাজিন হয় ওদের।’
নেহা খুশি হয়ে বলল,’গুড আইডিয়া।’
‘তার আগে আমায় সত্যি করে বলো সে সত্যিই ফ্রেন্ড নাকি বয়ফ্রেন্ড?’
‘কসম ভাবি! সে শুধুমাত্রই ফ্রেন্ড। বয়ফ্রেন্ড হলে আমি তোমার থেকে লুকাতাম না।’
অর্ষা নেহার গাল টেনে দিয়ে বলল,’তাহলে সেই কথাই রইল। ইফতারের পর আজ শপিংমলে যাবে সবাই। মনে আছে?’
‘তা আর বলতে? আমরা কিন্তু তোমাদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছি। কিন্তু দেখাব না এখনই। সারপ্রাইজ।’
অর্ষা হেসে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
.
.
আহনাফ, আহিল কেউই শপিং-এ যেতে রাজি নয়। জহির চৌধুরী তো আগেই শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে ইফতারের পর থেকে বিছানায় শুয়ে আছেন।
আমেনা বেগম বিক্ষিপ্তকণ্ঠে দুই ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,’সমস্যা কী তোদের? কেন যাবি না?’
আহিলের কোলের ওপর মাথা রেখে সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে আছে আহনাফ। আহিল ভাবলেশহীনভাবে সোফায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। ভাবখানা এমন যেন, রাজ্যের সমস্ত ক্লান্তি এখন তার ঐটুকুন মাথায় এসে ভর করেছে।
আহনাফ ক্লান্তস্বরে বলল,’শরীরটা ভালো লাগছে না মা। ক্লান্ত লাগছে।’
‘আমারও মা। আমিও তো আজ ভাইয়ার সাথে অফিসে কাজ করেছি।’ বলল আহিল।
ফুপি রাশভারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন নিহিতের দিকে। নিহিত এই দৃষ্টির ভাষা বোঝে। সে ফাঁকা ঢোক গিলে বলে,
‘আমার দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছো মামনী?’
‘তোর এক্সকিউজ শোনার অপেক্ষায় আছি। বল শুনি।’
আহিল তখন নিহিতের সাপোর্ট নিয়ে বলল,’ফুপি নিহিত ভাইয়ারও শরীরটা নাকি ভালো না। আমাকে দুপুরে বলেছিল।’
কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটল নেহা। সে কোমরে দু’হাত রেখে বলল,’মিথ্যা বলবা না একদম। ভাইয়া দিব্যি সুস্থ ছিল। আর এখনো আছে।’
আহিল মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’চুপ করো। সবসময় এত পাকা পাকা কথা বলবে না। ছেলেদের কত রকম সমস্যা থাকে সেসব তুমি জানো নাকি?’
মুখ খুললেন এবার ফুপা। তিনি দু’হাত বগলদাবা করে পাশের সোফায় বসে আছেন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়ে না জানলেও আমি তো জানি। আমিও ছেলে। বল তো শুনি, এত কীসের সমস্যা তোদের?’
‘অনেক সমস্যা ফুপা। এক কাজ করেন। আপনিই বরং সাথে যান।’ বলল আহনাফ।
ফুপা থতমত খেয়ে বলেন,’কী যা তা বলিস! আমার ডায়াবেটিস না? আমার শপিং-এ যাওয়া বারণ।’
ফুপি রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,’তুমি যাবে কেনাকাটা করতে। মিষ্টি খেতে নয়। নাটক কম করো।’
আহনাফ এবার সোজা হয়ে বসে। দু’হাতে চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে বলল,’শোনো মা জননী, আর ফুপিমনি আমরা আসলে চাচ্ছিই না তোমাদের সাথে শপিংমলে যেতে। তোমরা তোমাদের কেনাকাটা করে ফেলো। আমরা ছেলেরা পরে গিয়ে আমাদের কেনাকাটা করে নেব। তোমাদের সাথে সারা শপিংমল ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করা আমাদের ধৈর্যে কুলাবে না। তোমাদের চয়েস করতে করতেই দশ ঘণ্টা চলে যাবে। এই কালার না, ঐ কালার। এই ডিজাইন না, ঐ ডিজাইন; কতশত ডিমান্ড! বাপরে বাপ!’
কথাগুলো বলে বড়ো করে দম নিলো আহনাফ। অর্ষা এতক্ষণ নেহার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। এবার সে আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,
‘থাক মা। বাদ দেন। ওদের কারো যাওয়া লাগবে না। আমি, আফরিন আপু আর নেহা গিয়েই শপিং করতে পারব। ভিডিয়ো কল দেবো আপনাদের। আপনি, ফুপি আর রেণু আপা ড্রেস চয়েজ করে দিয়েন।’
‘সে কী কথা! তোমরা এত মানুষের শপিং একা করবে কীভাবে? তোমাদের বাড়ির, আফরিনের শ্বশুরবাড়ির সবার জন্যও তো শপিং করতে হবে। তোমরা বাচ্চা মানুষ এতকিছু একা পারবে না।’
‘যা পারব তাই কিনব মা। তবুও কাউকে এত সাধার প্রয়োজন নেই।’
নিহিত বিড়বিড় করে আহনাফকে বলল,’কথাটা মনে হয় তোমাকে খোঁচা মেরেই বলল ভাইয়া।’
আমেনা বেগম বললেন,’ঠিক আছে। তাহলে সাথে আমিও যাচ্ছি। যাও তোমরা তৈরি হয়ে নাও।’
সবাই সবার রুমে চলে যাওয়ার পর পিছু পিছু আহনাফও যায়। অর্ষা কোনো কথা না বলে চুপচাপ বোরকা পরে হিজাব বাঁধায় মনোযোগ দেয়।
আহনাফ নিঃশব্দে খাটের ওপর বসে। খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বলে,’বোরকাটা সুন্দর। কে কিনে দিয়েছে?’
অর্ষা নিরুত্তর। আহনাফ ফের বলল,’হিজাবটাও সুন্দর। কে কিনে দিয়েছে? বললে খুশি হতাম। আফরিনের জন্যও কিনতাম।’
অর্ষা এবারও নিরুত্তর রইল। আহনাফ হাল ছাড়ল না। সে দু’বার মেকি কাঁশি দিয়ে বলল,’হাতের ঘড়িটাও সুন্দর। কে কিনে দিয়েছে?’
‘বাবা।’
আহনাফ বিড়বিড় করে বলল,’যাক! মুখ খুলেছে তাহলে।’
মুখে বলল,’ওহহ। বাবার পছন্দ অনেক সুন্দর। তাই না?’
‘হু।’
‘তুমি কি রাগ করেছ?’
‘না।’
‘কেন করোনি?’
‘কেন করব?’
‘তাই তো! আমি তো রাগ করার মতো কিছু করিনি। আমি তো খুবই ইনোসেন্ট।’
অর্ষা আবার চুপ হয়ে যায়। আহনাফ উঠে দাঁড়ায়। রুমের মাঝে কিছুক্ষণ পায়চারী করে জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার রেডি হওয়া শেষ?’
‘হু।’
‘পাঁচটা মিনিট সময় দেবে? ইয়ে মানে! রেডি হতাম আরকি।’
‘কেন?’
‘আমিও যাব।’
‘লাগবে না। আমরাই পারব।’
‘আরে রাগ করে না পাখি! আমি তখন সবার সামনে কেন বারণ করেছি জানো?’
‘কেন?’
‘কারণ আমি একাই যেন তোমাদের সাথে যেতে পারি। তাহলে একটু সময় কাটাতে পারব বুঝো না?’
‘আমি খুব বোকা না?’
আহনাফ ধরা খেয়ে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অর্ষা বলল,’যান রেডি হয়ে আসুন।’
আহনাফ খুশিতে গমগম করে ওঠে। খুশি আটকে রাখতে না পেরে অর্ষার গালে চুমু খেয়ে ফেলে। মনে মনে হাসলেও বাইরে প্রকাশ করল না অর্ষা।
আহনাফকে রেখে ড্রয়িংরুমে আসে সে। জহির চৌধুরী আর আমেনা বেগম তৈরি হয়ে বসে আছেন। অর্ষাকে দেখতে পেয়ে জহির চৌধুরী বললেন,
‘রেডি হয়েছিস রে মা? নেহা আর আফরিন কোথায়?’
‘রেডি হচ্ছে। আপনি উঠেছেন কেন? রেস্ট করুন গিয়ে।’
‘রেস্ট পরে করলেও হবে। আগে মেয়েদের নিয়ে শপিং করে আসি।’
‘কী গো অর্ষা? মামনী কই তুমি? দেখো তোমার ফুপাও রেডি। কেউ না যাক। তোমার ফুপা থাকতে কোনো টেনশন নাই।’ কথাগুলো বলতে বলতে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে আসছেন ফুপা। পেছন পেছন ফুপিও আসছে।
অর্ষা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ফুপা জহির চৌধুরীকে দেখে বললেন,
‘একি! আপনি এসেছেন কেন?’
এবার নিহিত আর আহিলও অর্ষাকে ডাকতে ডাকতে ড্রয়িংরুমে আসে। ওদের পরপরই আসে আহনাফ। অর্ষা,আফরিন আর নেহা হা করিয়ে তাকিয়ে আছে। একবার নিজেদের দিকে তাকায় তো আরেকবার উপস্থিত বাকিদের দিকে। এতক্ষণ একেকজনের বাহানার শেষ ছিল না। আর এখন প্রত্যেকে সেজেগুজে রেডি হয়ে সাহেব হয়ে এসেছে!
রেণু মুখটিপে হাসছে ওদের কাণ্ড দেখে। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে দেখে সারপ্রাইজড্। আমেনা বেগম বিরক্তমুখে বলেন,
‘একেকটা ড্রামাবাজ!’
আফরিন বলল,’এভাবে বোলো না মা। ভালোই তো হলো। আমরা সবাই একসাথে যাব। অনেক মজা হবে।’
জহির চৌধুরী রেণুর উদ্দেশ্যে বললেন,’যাও তুমিও তৈরি হয়ে আসো।’
রেণু প্রথমে বিস্মিত হয়। পরক্ষণে লজ্জা পেয়ে বলে,’না, না খালু। আমি যামু না।’
রেণুর নাকচ অবশ্য বেশিক্ষণ টিকল না। সেও রেডি হয়ে আসার পর সবাই মিলে এক সাথে রওনা হয়। আহনাফ হাঁটতে হাঁটতে অর্ষার হাত চেপে ধরে। মুখপানে না তাকিয়েই ফিসফিস করে বলে,
‘আজকের রাতটা সুন্দর।’
______
মাহিত আর সকাল মিলে রেশমির জন্য শাড়ি দেখছে। কিন্তু কোনো শাড়িই একসাথে দুজনের মনঃপুত হচ্ছে না। সকালের পছন্দ হলে মাহিতের পছন্দ হচ্ছে না। আবার মাহিতের পছন্দ হলে সকালের পছন্দ হচ্ছে না। মুসিবতের শেষ নেই।
শেষমেশ সকাল বিরক্ত হয়ে বলল,’তোমার হবু বউ। শাড়ি তোমার পছন্দ মতোই কেনো।’
‘আমার পছন্দমতো কিনলে আমি একাই আসতে পারতাম। তোদের সাথে আসতাম নাকি?’
‘তাহলে মাকে বলো। মা তো শাড়ি ভালো চেনে।’
‘ধুর না! এটা না জানিয়ে দেবো। বলতে পারিস সারপ্রাইজ। চল অন্য দোকানে যাই।’
সকাল বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলল,’চলো।’
অন্য দোকানে গিয়ে সকাল শকড্। মাহিতও কিছুটা অবাক হয়েছে অর্ষাদের সবাইকে একসাথে দেখে। মাহিত এগিয়ে গিয়ে আহিল আর আহনাফের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল,
‘কী অবস্থা ভাই? আপনারাও দেখি এখানে।’
আহনাফ হেসে বলল,’ঈদ আসলে যা হয় আরকি!’
এরপর সে বাকিদের সাথেও মাহিতের পরিচয় করিয়ে দিয়ে কেনাকাটা শুরু করে।
আহিলকে ডেকে এক পাশে নিয়ে যায় মাহিত। সকাল দাঁড়িয়ে আছে নেহার সাথে। দুজনে সমবয়সী হওয়াতে ভাব জমে গেছে। আহিলকে ডেকে নিয়ে যাওয়ায় সকাল মনে মনে একটু ভয়ও পাচ্ছে। আহিলও যে ঘাবড়ে যায়নি তা নয়! সে নিজেও কিছুটা নার্ভাস ফিল করছে।
মাহিত আহিলের কাঁধের ওপর হাত রেখে বলল,’একটা হেল্প লাগবে তোমার। রেশমি কেমন শাড়ি পরে জানো? ও তো তোমার ফ্রেন্ড। ওর পছন্দ, অপছন্দ তো তোমারও জানার কথা।’
হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল আহিল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,’ড্রেস, অর্নামেন্টসের ব্যাপারে মেয়েরাই ভালো বলতে পারবে ভাইয়া। আমার তো আইডি নেই কোনো।’
মাহিত কিছুটা হতাশ হলো। দাঁড়ি চুলকিয়ে বলল,’তাহলে উপায়?’
‘আপনি এত হতাশ হচ্ছেন কেন? উপায় তো আছেই। অর্ষাকে ডাকেন আপনি।’
‘তোমার ভাইয়া যদি আবার মাইন্ড করে?’
‘কখনোই না। আমার ভাইয়া এমন মানুষই নয়। আচ্ছা আমি অর্ষাকে নিয়ে আসছি।’
আহিল গিয়ে অর্ষাকে নিয়ে এলো। অর্ষা শাড়ি চ্যুজ করতে খুব একটা সময় নিলো না। বান্ধবীদের সবার পছন্দ সম্পর্কে সে খুব ভালোমতোই জানে। অর্ষার পছন্দ করা শাড়ি মাহিত আর সকাল দুজনেরই পছন্দ হয়েছে।
মাহিত ইনিয়ে-বিনিয়ে বলল,’ইয়ে মানে চুড়িটুড়ি কিছু যদি দেখে দিতে!’
মাহিতের ইতস্ততা দেখে অর্ষা হেসে ফেলে। বলে,’সমস্যা নেই চলুন।’
সকাল ওদের সাথে গেল না। সে নেহার সাথে নেহার জন্য ড্রেস দেখছে। যদিও তার খুব ইচ্ছে হয়েছিল সঙ্গে গিয়ে সেও চুড়ি কিনবে। পাছে আহিলের বিষয় নিয়ে মাহিত আবার কোনো রকম সন্দেহ করে ফেলে! তাহলে তো আর রক্ষে নেই। সেজন্য ইচ্ছে দমিয়ে সে নেহার সঙ্গে থেকে গেছে।
রেশমির খাঁজকাটা কাচের চুড়ি ভীষণ পছন্দ। ওরা সব বান্ধবীরাই এই চুড়ি অনেক পছন্দ করে। ফুটপাতে যে-ই চুড়ি দেখত সে-ই সবার জন্য এক মুট করে চুড়ি কিনে নিত। শুধুমাত্র অর্ষা ব্যতীত। কেননা তখন তার ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য ছিল না।
মাহিত আর অর্ষা মিলে চুড়ি দেখছে। আহিল অর্ষার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে ফোন ঘাটছিল। সেলসম্যান কতগুলো ব্রেসলেট বের করে বলল,
‘ম্যাম এগুলো নতুন এসেছে। দেখতে পারেন। আপনার হাতে মানাবে।’
অর্ষা বলল,’লাগবে না ভাইয়া।’
মাহিত আপত্তি জানিয়ে বলল,’লাগবে না কেন? লাগবে। আমি তোমাকে কিনে দেবো।’
‘আমার সত্যিই লাগবে না ভাইয়া।’
‘না লাগলেও ভাইয়ার উপহার বোনের নিতে হবে।’
‘বেশ! তবে চুড়িই নিই?’
‘তোমার যা ইচ্ছে তুমি তা-ই নাও। কোনো আপত্তি নেই।’
অর্ষা নিজের জন্য শুধুমাত্র এক মুট চুড়ি নিল মাহিতের থেকে। মাহিত আরো অনেক কিছু কিনে দেওয়ার জন্য প্রচুর জোর করেছে, অর্ষা শোনেনি। রেশমির জন্য কেনাকাটা শেষ হলে অর্ষা আমেনা বেগমের কাছে যায়। আহনাফ বার দুয়েক চোখের ইশারায় ডেকেছে। তবে যাওয়ার ফুরসত হয়নি। রাগ করে আহনাফ ঐ দোকান থেকে বেরিয়েই গেল।
সবার কেনাকাটা শেষ হতে হতে রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে তখন। ওরা এবং সকালের ফ্যামিলি মিলে একই রেস্টুরেন্টে বসেছে। আহনাফ গাল ফুলিয়ে রেখেছে। অর্ষার সাথে কথা বলছে না। অর্ষা টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করলেও আহনাফ পাত্তা দেয়নি একদম।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় সকলের দৃষ্টির আড়ালে সকালের হাত চেপে ধরে আহিল। সকাল হতবিহ্বল হয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। আহিলের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে সকলের দৃষ্টির অগচোরে প্যান্টের পকেট থেকে নীল রঙের ব্রেসলেট বের করে। খুব সন্তর্পণে সকালের হাতে ব্রেসলেট পরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোমার জন্য।’
এরপর আর সে সকালকে কিছু বলতে দিল না। নিহিতের কাছে গিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। সবাই বিদায় নিয়ে এবার বাড়ি ফেরে। আহনাফ আর অর্ষা পাশাপাশি বসে ছিল গাড়িতে। ক্লান্তিতে আহনাফের কাঁধে মাথা রাখে অর্ষা। চোখ দুটো বুজে এসেছে। রাগে, অভিমানে আহনাফ একবার ভেবেছিল কাঁধ থেকে মাথাটি সরিয়ে দেবে। তবে ঐ বিধ্বস্ত, ক্লান্ত মুখশ্রী দেখে মন এত বড়ো স্পর্ধা দেখানোর সাহস করে ওঠেনি। বরঞ্চ এর বদলে মন-জমিনে ভালোবাসার একরাশ ফুল জন্মিয়েছে। প্রতিটা ফুলে যতটা মায়া মিশে আছে ততটাই মায়া কাজ করছে আহনাফের মনে।
বাড়িতে পৌঁছিয়ে অর্ষাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে আহনাফ। রাত অনেক হয়েছে তাই শপিং দেখার মুড নেই কারো। কাল সকালে সবার শপিং দেখা যাবে। আহনাফ আগে আগে রুমে যাচ্ছিল। পেছন থেকে শুনতে পায় নেহা অর্ষার কাছে আবদার করে বলছে,
‘আজকে আমার সাথে ঘুমাও ভাবি প্লিজ!’
তৎক্ষণাৎ আহনাফ ফিরে আসে। অর্ষার হাত বগলদাবা করে নেহাকে বলে,’তোরা পেয়েছিসটা কী রে বল তো? আমার বউকে আমিই ভাগে পাই না। যা গিয়ে আফরিনের সাথে ঘুমা। হুশ!’
অর্ষা আর নেহা দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তাকিয়ে থাকাটাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অর্ষাকে হিরহির করে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যায় আহনাফ।
নেহা বিস্মিতকণ্ঠে বলে,’এটা আমি কোন আহনাফ ভাইকে দেখছি!’
আফরিন দূর থেকে এসব দেখছিল। নেহার কাছে এসে মৃদু হেসে বলে,’বিয়ের পরের ভালোবাসাটাই এমন বুঝলি। তাই ভাইয়াও এখন ইউটার্ন মেরেছে। এখন আমরা চল ঘুমাই।’
অর্ষা ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়েছে। ঘুম আসতেও সময় লাগেনি। আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে অর্ষা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। বেড-সাইড টেবিলের ওপর থেকে ওয়ালেট নিয়ে অর্ষার জন্য কিনে রাখা চিকন চেইনটি বের করে। পুরো চেইনটি স্বর্ণের। শুধু ছোট্ট লকেটটা ডায়মন্ডের। আলোতে কেমন ঝকমক করছে। আর ছোট্ট ডায়মন্ডের একটা নাকফুল। ঘুমে কাবু হয়ে থাকা অর্ষা কিছুই টের পায় না। খুব সাবধানে নাকফুল পাল্টে দেয় আহনাফ। গলায় চেইনও পরিয়ে দেয়। নাকের নাকফুলে চুমু খেয়ে কপালে আলতো করে চুমু খায়। ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,
‘আমার ভালোবাসাটা!’
লাইট নিভিয়ে পাশে এসে শুয়েও শান্তি পায় না। অর্ষাকে ভীষণ জ্বালাতে ইচ্ছে করছে তার। আহনাফের গায়ের ওপর হাত রাখে অর্ষা। আহনাফ আরো শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ইচ্ছে করে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখি।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
এই পর্বেই শেষ করে দিতাম। তবে মন বিক্ষিপ্ত। দেশের এমন অবস্থা। মন লিখতে সায় দেয় না। তবুও দিয়েছি কারণ আজ গল্পটা দেওয়ার কথা ছিল। আর আপনারাও অপেক্ষায় আছেন। অর্ধেক লেখা ছিল, বাকি আরো কিছু শব্দ লিখে পোস্ট করেছি। অন্তিম পর্বের বাকি অংশ ইন-শা-আল্লাহ্ পরশু পেয়ে যাবেন। সবাই চট্টগ্রাম, পাবনা ও ঢাকায় বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোর জন্য দোয়া করবেন।]
অন্তিম পর্বের শেষ অংশ এখানে যোগ কররে দেওয়া হবে।