ভালোবাসার সন্ধিক্ষণ পর্ব-০১

0
496

#ভালোবাসার_সন্ধিক্ষণ
#পর্ব_০১
#Jannatul_Ferdous_Mahi

আম্মু বুঝার চেষ্টা করো,আমার পক্ষে বিয়ে করা কিছুতেই সম্ভব নয়,আমাকে যে বিয়ে করবে শুধু শুধু তার জীবনটা নষ্ট হবে,তুমিতো জানোই সর্বচ্চ ৩০বছরের বেশি আমি বাঁচবো না।আমার ব্লাড গ্রুপ খুবই রেয়ার,সহজে পাওয়া যায়না,ব্লাডের অভাবে সময়ের আগেই মৃত্যু হতে পারে আমার।

মেয়ের কথা শুনে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন মিসেসঃফাতেমা বেগম।

–মারে,তুই আমার একটা মাত্র মেয়ে,তোকে বাঁচাতে নিজের সবটা উজার করে দিতেও দু’বার ভাবিনি,ভাববোনা।
আমারওতো ইচ্ছে হয় মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দেব,মেয়ে সংসার করবে,জামাই আপ্যায়ন করব।

–প্লিজ আম্মু,কান্না করোনা।তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমারও যে কষ্ট হয় আম্মু,আমি মনোবল হারিয়ে ফেলি।তুমিকি চাও তোমার মেয়ে মনোবল হারিয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ুক??

–নাহ্,আমি চাই আমার মেয়ে সারাজীবন মাথা উচু করে বাচুক,কখনও মনোবল হারানো চলবেনা।

–তাহলে কপালে চুমু দাও,আমি আর্ট স্কুলে যাই (মুচকি হেসে)

ফাতেমা বেগম নিজের মেয়ের কপালে হাত ছুইয়ে মুখে চুমু দিলেন,

–সাবধানে দেখে শুনে যাস,আর আসার সময় ১কেজি পটল নিয়াসিস,ভাজবো আজকে

এতক্ষণ কথা হচ্ছিলো আমাদের গল্পের নায়িকা প্রতিভা আর তার মা মিসেসঃফাতেমা বেগমের মধ্যে।প্রতিভা দেখতে মাশাল্লাহ,সুন্দরী,নামের মতো কাজেও তার জুরি মেলা ভার।ছবি অঙ্কনে পারদর্শী সে,বাচ্চাদেরর জন্য ছোট একটা আর্ট স্কুল রয়েছে ওর,এখানে বিনামূল্যে বাচ্চাদের আর্ট করা শেখায় প্রতিভা,এটা প্রতিভার একটা সখ বলা যায়,তাই বাচ্চাদের ছবি আঁকা শিখিয়ে কোনোরকম টাকাপয়সা নেয়না সে।এছাড়াও প্রতিভা রান্নাবান্না থেকে সেলাই,হাতের কাজ সবকিছুতেই পারদর্শী,কতশত ডিজাইনের কাথা সেলাই সে করেছে হিসেব ছাড়া,প্রতিভার বাবা থ্যালাসেমিয়া রুগি ছিলেন,প্রতিভার বয়স যখন ১০বছর,তখন প্রতিভার বাবা মৃত্যুবরন করেন।প্রতিভার মা ফাতেমা বেগম দরজির কাজ করে যে উপার্জন করেন সেটা দিয়েই সংসার চালান,মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছেন।প্রতিভা বড় হওয়ার সাথে সাথে নিজের প্রতিভার জোরে তার হাতের কাজের জন্য সংসারের আয়-উপার্জন আরও বেড়ে যায়।সে জামা কাপড়েও ডিজাইন করে ফুল তোলে,যার জন্য পোশাকের দাম আরও বেড়ে যায়।
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে প্রতিভার এতএত প্রতিভা থাকা স্বত্বেও আত্মীয়স্বজনদের থেকে বিতাড়িত সে,কারন মরণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত প্রতিভা।
থ্যালাসেমিয়া এমন একটি রোগ,যে রোগটি বংসগত ভাবে ছড়ায়,বাবা-মা দুজনে বা দুজনের একজন যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হয়,বা থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হলে বংশানুক্রমে তাদের সন্তানের মাঝেও থ্যালাসেমিয়া জিন প্রবেশ করে,যার ফলে সন্তানরাও এই রোগে আক্রান্ত হয়,আবার ব্যাতিক্রমও রয়েছে,কখনো কখনো বাবামায়ের মধ্যে একজন সুস্থ থাকলে অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া জিন বহন না করলে ২৫% সুস্থ বাচ্চাও জন্মাতে পারে।
প্রতিভার মা ফাতেমা বেগম সুস্থ থাকলেও প্রতিভার বাবা থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন,ফলাফল প্রতিভাও থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েই জন্মগ্রহণ করেছে।
ব্লাড কেনার খরচ দেওয়ার ভয়ে দাদির বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো প্রতিভা আর ওর মা ফাতেমা বেগম কে,সম্পত্তি থেকেও বহিষ্কার করেছে ওদের,প্রতিভার চাচা ও কাকারা মিলে সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নিয়েছে।
প্রতিভার মা নিজের বাবার বাড়ির যে অল্প একটু সম্পত্তি পেয়েছিলেন,বর্তমানে সেখানেই টিনসেট বাড়ি করে মেয়েকে নিয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছে ওরা,মা ছারা পৃথিবীতে প্রতিভার কেউ নেই বললেই চলে।গোল্ডেন A+ পেয়ে এসএসসি পাশ করার পরেও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে প্রতিভা,কারণ সে বাঁচবে মাত্র ৩০বছর,এত খরচ করে পড়ালেখা করে কোনো লাভ হবেনা।তার চেয়ে হাতের কাজ আর বাচ্চাদের আর্ট শেখানো নিয়ে সে দিব্যি ভালো থাকবে,যতদিন বাঁচবে।তার মা ছাড়া কোনো পিছুটান নেই,প্রতিভাকে আসেপাশের সবাই খুব ভালোবাসে,কারণ প্রতিভা একজন উপকারী মিষ্টভাষী মেয়ে,আর সবার সঙ্গেই মিশে যেতে পারে।
প্রতিভার বর্তমান বয়স ১৯বছর,৩বছর আগে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখন নিজের মা,হাতের কাজ,আর্ট স্কুল আর বাচ্চাদের নিয়েই আছে ও,এইযে হাতের কাজগুলো শেষ করে এখন আর্ট স্কুলে গেলো সে।


নতুন একটা গেমঅ্যাপ্স মার্কেটে ভালো profit পাওয়ায় “খান সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট” এক বড় পার্টি থ্রো করেছে।এই গেম অ্যাপস তৈরিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার ইয়ামিন চৌধুরী,অ্যাপসটি তৈরিতে শতকরা ৮০% ক্রেডিটই তার।বিভিন্ন ইন্জিনিয়ার হেড,বিভিন্ন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং কম্পানি থেকে ইয়ামিন চৌধুরী কে সন্মাধোনা পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে।সবাই ইয়ামিনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে কংগ্রাস করছে,এটা লাইফের ১ম সাকসেস,ইয়ামিন আজ অনেক খুশি।
অনেক স্ট্রাগেল আর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আজ সে একজন সাকসেসফুল সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার,প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে আজ ওর ক্রিয়েট করা অ্যাপসের নিউজ দেখাবে।
পার্টি শেষ করে অফিস থেকে বের হলো ইয়ামিন,এখন তার গন্তব্য পদ্মানদীর পাড়ে যাওয়া,মন মানসিকতা ভালো থাকলে,বা মনের ভেতরে অশান্তি থাকলে ইয়ামিন এইখানে আসে,নিরিবিলি পরিবেশে বয়ে চলার নদীর পানির দিকে চেয়ে থেকে নদীর বাতাশ উপভোগ করে সে,নদীর বাতাসে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে তার।গা থেকে ব্লেজার খুলে বাম হাতে নিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ফুরফুরে করছে ইয়ামিন।ইয়ামিনের পরিচয়টা দি..
ইনি আমাদের গল্পের নায়ক ইয়ামিন চৌধুরী,৫ফুট ৯ইঞ্চি লম্বা,সুঠাম দেহি শ্যাম বর্ণের এক সুদর্শন যুবক।বয়স ২৯,পেশায় ইয়ামিন একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার,।রাজশাহী শহরের বড় এক প্রাইভেট সফটওয়্যার কম্পানিতে জব করে সে,কম্পানির নাম ❝খান সফটওয়ার ইনস্টিটিউট❞

ইয়ামিনের বাবা-মা এক বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে ২বছর হলো,এখন একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে ইয়ামিন একাই থাকে এই রাজশাহী শহরে।ইয়ামিনের শখ বলতে সে একজন ব্লাড ডোনার,বিনামূল্যে রক্তদান করে মানুষের পাশে দাড়াতে তার ভালোলাগে,প্রতি তিনমাস পরপর সে রাজশাহী ম্যাডিকেলে গিয়ে ব্লাড দিয়ে আসে।ইয়ামিনের ব্লাড গ্রুপ O-,অনেকটা রেয়ার ব্লাড,সহজে পাওয়া যায়না।


আর্টস্কুলে প্রতিভা বাচ্চাদের আর্ট শিখাচ্ছে,এই স্কুলে ছোটবড় দিয়ে মিনিমাম ১৫০+ বাচ্চা হবে,সবাই প্রতিভা কে আপ্পি বলে ডাকে,তারা প্রতিভা কে খুবই ভালোবাসে।আজকের মতো আর্টক্লাস শেষ করে প্রতিভা ব্যাগ গোছাচ্ছে বাড়ি যাওয়ার জন্য,তখনই ৬বছরের এক বাচ্চা মেয়ে এসে প্রতিভার সামনে দাঁড়ালো।

–আপ্পিই,আপ্পি

–বলো মিষ্টি সোনা,তুমিকি জানো তোমার নামের মতো তুমিও খুবই মিষ্টি (গালে কিস করে)

–থেঙ্কু আপ্পি,তোমাকে না একটা কথা বলার ছিলো

–হুম বলো শুনি

–মাম্মাক তোমাকে ইনবাইট করেছে,কালকে আমার বাথডে,তোমাকে আসতেই হবে

–তাই নাকি,কাল তাহলে মিষ্টি সোনার বার্থডে বুঝি,তাহলে তো যেতেই হয়

–তুমি আসবেতো আপ্পি??আমি তোমার জন্য ওয়েট করব কিন্তু

–অবশ্যই যাব,কেন যাবোনা হুম মিষ্টি সোনার জন্মদিন বলে কথা।

–তোমাকে এত্তগুলা লাভ ইউ,উম্মাহ

মিষ্টি নামের মেয়েটা প্রতিভার গালে চুমু দিয়ে ছুটে বেড়িয়ে গেলো,প্রতিভা ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে এসে দেখে মিষ্টির মা মিষ্টি কে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

–আসসালামু আলাইকুম আন্টি,কেমন আছেন??

–আলহামদুলিল্লাহ ভালো,তুমি কেমন আছো প্রতিভা

–এইতো আলহামদুলিল্লাহ

–এ মাসের ব্লাড নিয়েছো??

–না আন্টি,হসপিটালের নার্সের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি,O- ব্লাডগ্রুপের কোনো ডোনার আসলে তার নম্বরটা রেখে দিতে,জানেনই তো এই ব্লাডগ্রুপ অনেকটা রেয়ার,সহজে পাওয়া যায়না,কাল পরশু ম্যাডিকেলে যাব,দেখা যাক ব্লাড পাই কিনা,দোয়া করবেন আন্টি

–অবশ্যই,তোমার মতো এতো মিষ্টি একটা মেয়ের এতবড় রোগ যে কেন দিলো আল্লাহ

–আন্টি আল্লাহ যা করেন,ভালোর জন্যই করেন

–হুম,সেটা ঠিক
শোনো প্রতিভা,কাল সন্ধান মিষ্টির জন্মদিনের জন্য ছোট্ট করে একটু আয়োজন করেছি,তোমার ইনভাইট রইলো,মাকে সাথে করে আসবে কেমন?

–ভেবে দেখবো আন্টি,সময় পেলে অবশ্যই আসবো (মুচকি হেসে)

–অপেক্ষা করবো তোমার,এসো কিন্তু,না আসলে রাগ করব

–ঠিক আছে আন্টি,আসব।
আসি,আসসালামু আলাইকুম

বাড়ি যাওয়ার সময় প্রতিভা বাজার থেকে ১কেজি পটল,আর হাফ কেজি চিনি কিনে নিলো।এতটুকু রাস্তা হেঁটে এসে হাফিয়ে গেছে মেয়েটা,বাড়িতে এসে দরজায় টোকা দিলে ওর মা এসে দরজা খুলে দিলো।
মেয়ের হাত থেকে পটল,চিনির প্যাকেট নিয়ে তিনি বললেন..

–হাঁপিয়ে গেছিস মা,হেঁটে আসতে গেলি কেন,একটা রিকশা নিতে পারতি,যা ফ্রেশ হয়ে নে

–রিকশাওয়ালা মামাগুলো ভীষণ অসৎ,সবসময় ভাড়া বেশি নেয়।এতটুকুই তো রাস্তা,তাই হেঁটে আসলাম।
আম্মু,পরশুদিন যে ড্রেস গুলো বানিয়েছো,ওগুলো আমার ঘরে রেখো,আমি ফ্রেশ হয়ে ফুল তুলবো,ম্যাচিং সুতা কিনে এনেছি।

–এখনই এসব নিয়ে বসতো হবেনা মা,ফ্রেশ হয়ে একটু জিড়িয়ে নে আগে।

মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে প্রতিভা কলের পার থেকে হাতমুখ ধুয়ে গামছা দিয়ে মুখচোখ মুছে বিছানায় এসে সুয়ে পড়লো।পুরো শরীরে কিটকিটে চিনচিনে যন্ত্রণা হচ্ছে,প্রতিটি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগিদের এই এক সমস্যা,ব্লাড নেওয়ার সময় এগিয়ে আসলে শরীরে এধরণের অসহ্যকর যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়……

To be continue….