প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
265

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৮

হালকা গোলাপি ছাপ পড়েছে ঐশ্বর্যের গালে। টকটকে হয়ে ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে। প্রেম নামক ব্যক্তিটির কাছে থাকলে লজ্জায় ডুবে যেতে হবে হয়ত তাকে। হাত উঠিয়ে বিছানায় ভর দিয়ে উঠে যেতে চায় সে। প্রেম উঠতে দেয় না তাকে। হাত চেপে ধরে বলে,
“আমার কাজ শেষ হয়নি।”

“আমার লাগবেনা বরফ লাগানো। এমনি ঠিক হয়ে যায়।”

প্রেম কন্ঠ ভার করে জবাব দেয়,
“তোমার লাগবেনা। আমার লাগবে। লজ্জা পাচ্ছো বুঝি? আচ্ছা আর লজ্জা দেব না। আমার কাজ আমায় করতে দাও।”

ঐশ্বর্যও জোড়াজুড়ি করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বলে ওঠে,
“উঁহু, ছাড়ুন। আপনার এতো সাহায্যের দরকার নেই আমার। ঐশ্বর্য সিনহা একাই চলতে পারে।”

ঐশ্বর্যের হাত আরো জোরে চেপে ধরে নিজের কাছে উল্টোভাবে বসিয়ে নিজের দুটো হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে জোড়ালো কন্ঠে বলে ওঠে,
“উহ…রং! ঐশ্বর্য সিনহা নয়। মিসেস. ঐশ্বর্য শেখ। আর শেখ আনন প্রেমের স্ত্রী বলে কথা! তার এই যোগ্যতা তো থাকবেই।”

“কিন্তু আমাকে আপনার সামনে ছোট তো আপনিই করেছেন তাই না মি. শেখ?”

কথাগুলো মস্তিষ্কে নাড়া দেওয়া মাত্র দেরি না করেই ফট করে উচ্চারণ করে দিল ঐশ্বর্য। প্রেম নিরব রইল এবার। ঐশ্বর্য জানে প্রেম আর কিছু বলতে পারবে না। তার কথা শুধুমাত্র ততোদূরই! প্রেম নিজেও জানে প্রেম তাকে ছোট করেছে। নিজের সাথে খানিকটা আলগা করে নিয়ে শার্টের কলার ধরে হালকা নামাতেই শার্ট চেপে ধরল ঐশ্বর্য। প্রেম আস্তে করে চেপে তার ঘাড়ে বরফ ছুঁইয়ে দিতে থাকে। ঠোঁট চেপে ঠান্ডা সহ্য করতে থাকে ঐশ্বর্য। বেশ কিছুক্ষণ চলে নিরবতা। হঠাৎ ঐশ্বর্যকে চমকে দিয়ে সে বলে,
“বিষয়টাকে তুমি দয়া না ভেবে অন্যকিছু ভাবতে পারতে না?”

ঐশ্বর্য যান্ত্রিকভাবে উত্তর দেয়,
“না পারতাম না। কারণ আপনার মনে আমার জন্য কোনো অনুভূতি ছিলই না।”

“কে বলল এটা তোমায়?”

ঐশ্বর্য ঘাড় ঘুরিয়ে প্রেমকে দেখার চেষ্টা করল। ঐশ্বর্য এতোদিন তাই জানতো। সে জানতো প্রেম কখনো কারোর খারাপ দেখতে পারে না। এই মানুষ, এই ব্যক্তিত্ব এতোটাই স্বচ্ছ যে নিজের কোনো শত্রুকেও আঘাত করতে তার হাত কাঁপবে। আসল প্রেমকে চেনার উপায় এটাই। সে স্বচ্ছ পানির ন্যায়! তার ব্যক্তিত্ব ভয়ানক প্রেম নামক সাগরে ফে’লে দেওয়ার মতো। ঐশ্বর্যও পড়েছে। নিজেকে আর বাঁচাতে পারছে না।

প্রেম ঐশ্বর্যের ঘাড়ের কাছ থেকে বরফ সরিয়ে ঐশ্বর্যের সেই নীল বর্ণের টানা সেই নয়নের দিকে। পলকহীন নজরে তাকিয়ে থেকে নিরবতা ভেঙে বলল,
“তোমায় কিছু বলার আছে আমার।”

একটু থামে প্রেম। বড় শ্বাস নিয়ে নেয়। ঐশ্বর্য ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। উত্তরে কিছু বলতে নিলে তার আগেই প্রেম তাড়াহুড়ো করে বলে ফেলে,
“কিছু না। অনেক কিছু বলার আছে আমার। অনেক কথা!”

“কি কথা বলুন?”

প্রেম দম নেয় একটু। আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“না কিছুনা। ব্রেকফাস্ট করে নিতে হবে চলো। বলতে চাইছিলাম মালদ্বীপ ফার্স্ট এলাম। অনেক জায়গা ঘোরা বাকি। তোমার সাথে এই সুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করা বাকি। তুমি পাশে থাকলে এই সৌন্দর্য দ্বিগুন মুগ্ধকর হয়ে উঠবে।”

ঐশ্বর্য কিছুক্ষণ চুপ থাকে। অতঃপর নিজের নেত্রপল্লব ছোট ছোট করে ফেলল। চিকন সুরে বলে উঠল,
“এক্সকিউজ মি! আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন আমার সাথে আমার কোনো ড্রেস আনা হয়নি। আপনার কি মনে হয়? আমি একবার শার্ট আর টাওজার পড়েই আপনার হাত ধরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব?”

“কেন পারবে না? তোমার আগের ড্রেসআপ তো এমনই ছিল। শার্ট, জ্যাকেট এসবই তো পড়তে পছন্দ করতে। এখন কেন পারবে না?”

“অবশ্যই পারব মি.! বাট এটা জেন্টস্ শার্ট। এটা আমায় পড়ে মনে হচ্ছে হাঁটু ছুঁইছুঁই। শর্ট টপস লাগছে একদম। এটা পড়ে আমি বাইরে বের হবো? নো ওয়ে!”

মুখ ফুলিয়ে কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে ঐশ্বর্য। প্রেম স্মিত হেঁসে বলে,
“ওয়েট অ্যা মিনিট।”

বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোফার কাছে দাঁড় করিয়ে রাখা লাগেজের কাছে গিয়ে সেটা তুলে লক খুলে নেয় প্রেম। ঐশ্বর্য মনোযোগের সাথে প্রেমের কর্ম দেখতে থাকে। যদিও প্রেম নিজের লাগেজ খুলে এমন কি জিনিস বের করতে চলেছে তা ঐশ্বর্যের অজানা। প্রেম তাকে হতবাক করে দিয়েই নিজের কয়েকটা কাপড় ঘেঁটে নিচ থেকে ঐশ্বর্যের একটা লং টপস্ বের করল। হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ঐশ্বর্য। তারপর নিজেকে সামলে তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে গিয়ে নিজের ড্রেসটা হাতে নিয়ে বলল,
“আরে এটা তো আমার ড্রেস! এটা কোত্থেকে এলো?”

প্রেম কনফিডেন্টলি জবাব দিল,
“অভিয়েসলি লাগেজ থেকেই!”

“ওহ হো! সেটা তো আমিও দেখলাম। বাট…”

কথার মাঝে থামে ঐশ্বর্য। কিছু একটা ভেবে সরু চোখে তাকায় সে। সন্দিহার হয়ে বলে,
“ওয়েট ওয়েট, আপনি আমার ড্রেস সাথে করে এনেছেন। অথচ আমাকে নিজের ড্রেস পড়তে দিলেন। লায়ার! চিটার!”

ক্ষুব্ধ হয়ে বলল ঐশ্বর্য। সাথে করে প্রেমের বুকেও কিল মেরে দিল। প্রেম শব্দ করে হেঁসে দিল। বুকের কাছে হাত রেখে বলল,
“আহা! এভাবে মারে নাকি কেউ? এখানে সযত্নে রাখা সেইসব অনুভূতি ভয় পাবে তো!”

ঐশ্বর্য থামলো। স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলো। কিসের অনুভূতি জানতে মন আনচান করল তার।
“মানে? কিসের অনুভূতি?”

“সিক্রেট! বলা যাবেনা।”

ঐশ্বর্য মুখ ভেটকাতেই প্রেম আবারও লাগেজের নিচ থেকে ঐশ্বর্যের কয়েকটা ড্রেস বের করে দিয়ে বলল,
“দেখো, কোনটা পড়ে বের হবে। অনেক সকাল হয়েছে। ব্রেকফাস্ট করতে হবে। তারপর বাকিসব!”

ঐশ্বর্য বেছে বেছে হাতে একটা কালো রঙের টপ আর সাদা রঙের ব্লেজার আর লেডিস জিন্স হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে। প্রেম ঠাঁই দাঁড়িয়ে হঠাৎ পিছু ডাকে ঐশ্বর্যকে। ঐশ্বর্য তাকায়। ইশারায় জিজ্ঞেস করে ‘কি?’
প্রেম আনমনা হয়ে বলে,
“”তুমি যদি একবার বুঝতে আমার মনের সেই করুণ অবস্থা! যদি বুঝতে আমার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! যদি অনুভব করতে আমার মনের মাঝে সযত্নে বেড়ে ওঠা এক নতুন অপরিচিত অনুভূতি! আমি পাল্টে যাচ্ছি কেন ঐশ্বর্য? তুমি নামক এক মিশ্রিত অনুভূতি পাল্টে দিতে সক্ষম হচ্ছে অবশেষে?”

থমকে যায় ঐশ্বর্য। থমকে যায় যেন সে সময়। স্থির হয় চোখজোড়া। সামনে থাকা মানুষটি কেন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। তার এমন কথাবার্তা ঐশ্বর্যকে বাকরুদ্ধ করে তুলছে। মনে ঝড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিহরণ জাগাচ্ছে। বারংবার মনে হচ্ছে লোকটার মধ্যে সে সেই অনুভূতি তৈরি করতে পেরেছে যেই অনুভূতি সে এতোদিন দেখতে চেয়েছিল। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে ঐশ্বর্যের। সামনে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমও যেন উসখুস করে উঠল। অস্থির হয়ে বলল,
“এই কথাটুকু বললাম। তার কোনো প্রশ্ন করো না প্লিজ! যাও আর চেঞ্জ করে নাও। আমরা বের হবো।”

ঐশ্বর্যও কোনোরকম প্রশ্ন করেনা। সেই মূহুর্তে কোনোরূপ কথা তো মুখ থেকে বেরই হবার নয়। শুধু হৃৎস্পন্দন বাড়বে। বাড়তেই থাকবে। ঐশ্বর্যের কথা শুনবে না। ওয়াশরুমে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করে নিজের শক্তি দিয়ে ঠাস করে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয় ঐশ্বর্য। নিশ্বাস ওঠানামা করছে তার। অবিশ্বাস্য লাগছে চারপাশ! তার মাথা ঘুরছে। একবার সে হাসছে। আবার মূহুর্তেই হতবাক হচ্ছে। মিশ্রিত অনুভূতি! সব মিলিয়ে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজের দিকে তাকায়। আজ ওকে এতো সুন্দর লাগছে কেন? নিজেই নিজেকে দেখে স্তম্ভিত হয়। এইসব পাগলামি তাকে বুঝি সুন্দর করে তুলছে?

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। স্বচ্ছ কাঁচের পানি ঢেউ খেলছে সমুদ্রে। সন্ধ্যার এই আধো আলো এই প্রকৃতিকে আরো মোহময় করে তুলছে। মোহময়ী লাগছে ঢেউয়ের প্রতিধ্বনি। একদিকে নারিকেল, সুপারি সহ নানান গাছগাছালিতে সাজানো একটা দিক। তার থেকে কিছুটা দূরে বালিতে পরিপূর্ণ জায়গা। তারপরেই সমুদ্র। আইল্যান্ডের পূর্ব দিকে গিয়ে ভারুনুলা রালহুগান্ধু নামক জায়গায় ফেরিতে গিয়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করে সবেমাত্র সমুদ্রের ধার দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছে ঐশ্বর্য আর প্রেম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই শুধু পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। সমুদ্রের দমকা হাওয়া দুজনের নিস্তব্ধতা গাঢ় করছে। তীব্রভাবে যখন বাতাস আ’ক্র’মণ করছে তৎক্ষনাৎ ঐশ্বর্যের বেঁধে রাখা চুলোগুলোও বাধাহীনভাবে উড়ে এসে তার চোখেমুখে পড়ছে। বড়ই অসহ্য লাগছে ঐশ্বর্যের। চোখমুখ কুঁচকে ফেলছে সে। প্রেম আচানক আবদার করা সুরে বলে বসল,
“চুলগুলো খুলে রাখো!”

চকিতে তাকালো ঐশ্বর্য। লোকটার সাথে সারাদিন সেভাবে কথা হয়নি। দুজন রোবটের মতো চলেছে, ঘুরেছে ফিরেছে। মাঝে মাঝে দরকার ছাড়া দুজনের একজনও কথা বলেনি। তাদের মাঝে কেউই সকালের ঘটনাগুলোর লেশ কাটাতে পারেনি। ফলস্বরূপ দুজনেই জড়তা নিয়ে হেঁটে চলেছে। ঐশ্বর্য বিরক্তবোধ করে বলল,
“বেঁধে রেখেই তো যন্ত্রণা দিচ্ছে চুল। খুললে তো ঝড় বয়ে নিয়ে যাবে আমার ওপর দিয়ে।”

“সেই ঝড় সামলাতে আমি আছি তো। আমাকে না হয় সেই দায়িত্ব দাও!”

স্নিগ্ধতার সাথে কথাগুলো বলামাত্র কন্ঠস্বর কাঁপতে থাকে ঐশ্বর্যের। এসব কথা না বললেই নয়? তার মাঝে উন্মাদনা সৃষ্টি করে সেটা থামাবে কে? তবে কথা না বাড়িয়ে চুলটা খুলে দিল ঐশ্বর্য। সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদ বাতাস এসে তার কোঁকড়ানো ঢেউ খেলানো চুলগুলো ছুঁয়ে যায়। কালো রেশমী চুল উড়তে আরম্ভ করে। প্রেমের চোখে সেই দৃশ্য হয়ে ওঠে এক অপরূপ দৃশ্য। ঐশ্বর্য তার কাছে অপরূপা। এমন অপরূপা নারী সে নিজের জীবনে দুটো দেখেনি। তবে এই কথা সে আগে খেয়াল করেনি। এই অপরূপাকে সে আগে দেখেনি। কেন দেখেনি? দেখলে হয়ত তার জীবন আরো সুন্দর হতো! তার পৃথিবী আরো সুন্দর হতো!

খেয়ালে আসতে প্রেমের নজরে আসে ঐশ্বর্য বিরক্ত হচ্ছে চুলের দ্বারা। ফট করে হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে দিল প্রেম। ঐশ্বর্য বিস্ময়ের চোখে তাকালো তবে কিছু বলল না। তবে মুখে হাসি ফুটলো আপনাআপনি। কিছুটা হাঁটতে গিয়ে সামনে দাঁড়ানো এক চেনা পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায় তাদের। কিছুটা চমকে ওঠে তারা। সামনের মানুষটাকে এখানে আশা করা যায় না। তারাও করেনি। প্রেম হতভম্বতা কাটিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“আরে ইফান, তুই? তাও এখানে?আনএক্সপেক্টেড!”

ইফান সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিল। প্রেমকে দেখে স্বভাবত হাসি দিয়ে প্রেমকে জড়িয়ে ধরে সে।
“প্রেম ভাই! তুমি। আমিও এক্সপেক্ট করিনি অবশ্য তোমার আর ভাবির সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হবে।”

“কেন তুই কি জানতিস না বুঝি আমরা এখানে এসেছি।”

“জানতাম বাট সেই ভাবে তো ডিটেইলে জানতাম না।”

প্রেম ইফানকে ছেড়ে দূরে এসে দাঁড়ায়। আর জিজ্ঞেস করে,
“হোয়াটস দ্যা ম্যাটার? কি এমন দরকার পড়ল না জানিয়ে সোজা মালদ্বীপ! জানাস নি তো!”

“বাবার কাজের জন্য। লেট ইট গো! কেমন চলছে হানিমুন?”

হেঁসে মজা করে প্রশ্ন করে ইফান। প্রেম শ্বাস নিয়ে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“এসব কি প্রশ্ন? তাও বড় ভাইকে? বাই দ্যা ওয়ে কোন হোটেলে উঠেছিস তুই?”

“আমি বোধহয় তোমাদের পাশের হোটেলে উঠেছি। আমার পাশে যেই রিসোর্ট আছে সেটাই তো আঙ্কেল বুক করে দিয়েছিল তোমাদের জন্য। কেবল মনে পড়ছে আমার। হোয়াট অ্যা কোয়েনসিডেন্স! বাট আগে জানলে না তোমাদের রুমের সামনে গিয়ে ডিস্টার্ব করে হানিমুন স্পয়েল করে আসতাম।”

বলেই হু হা করে হেঁসে দেয় ইফান। ঐশ্বর্য চুপচাপ শুনছে তার আর প্রেমের কথা। তার উদ্ভট লাগছে। শ্বাস নিতেও অস্থির লাগছে। তাও হঠাৎ করেই এসব হচ্ছে। তাই এদিক সেদিক তাকাচ্ছে বার বার। হঠাৎ তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে ইফানের নজর আর মনোযোগ শুধু ঐশ্বর্যের বাম হাতের দিকে। বাম হাতের দিকে তাকায় ঐশ্বর্য। তেমন তো কিছুই নেই একটা রিং আর সেই বিশেষ চিহ্ন ছাড়া। কিন্তু চিহ্নটাও কেমন যেন মুছে মুছে যাচ্ছে। কিন্তু ইফানকে দেখে তার এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? তৎক্ষনাৎ ঐশ্বর্যের মনে পড়ে গত রাতে তার খেয়ালে তাদের রিসোর্টের পাশের হোটেলের দৃশ্য এসেছিল। কেন সেটা এখনো উদ্ঘাটন করতে পারেনি ঐশ্বর্য। ইফানকে দেখে তার কৌতুহল আরো বাড়লো। ইফান এবার বলল,
“ওকে। আমি আমার কাজ করি। তোমরা তোমাদের হানিমুন করো। ডিস্টার্ব করলে আবার বাড়িতে গিয়ে মার খেতে হবে।”

হেঁসে বিদায় নেয় ইফান। ঐশ্বর্য তখনও সন্দিহান নজরে তার দিকে তাকিয়ে। যাবার সময় না চাইতেও আশাতীত ভাবে ইফানের হাতের সামান্য স্পর্শ লাগে ঐশ্বর্যের হাতে। সারা শরীর কেঁপে ওঠে তার। জ্বলে ওঠে তার হাতের চিহ্ন। অনুভব করে অদ্ভুত কিছু। যা অনুভূত হওয়া উচিত নয়।

আনমনে প্রেমের পাশে হাঁটছে ঐশ্বর্য। এলোমেলো তার পায়ের ধাপ। প্রেম তা খেয়াল করেও কিছু বলল না। সামনে কয়েকজন লোকজনের সরগম। প্রেম তা দেখে বলল,
“কি হচ্ছে সামনে?”

ঐশ্বর্য কৌতুহল নয়নে তাকায়। হাসাহাসি চলছে। দেশি বিদেশি লোকজন। সামনে এগোতেই একটা লোক বলে ওঠে,
“নিউ কাপল!”

প্রেম ও ঐশ্বর্য দুজনেই বিস্ময়ের সাথে একে ওপরের দিকে তাকায়। এর বেশ কিছুক্ষণ পর তাদের সাথে যোগ দিয়ে জানতে পারে তারা এখানে যারা যারা আছে সবাই কাপল। সবাই গেম খেলছ। গেমের নাম ‘লাভ গেম’। বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল তাদের কাছে। হঠাৎ একজন প্রেমকে প্রশ্ন করে উঠল,
“হোয়াট ইজ লাভ? আপনার স্ত্রীকে দেখার পরই আপনার মনে ভালোবাসার উদয় হয়েছে? নাকি সময় লেগেছে?”

“ভালোবাসা একটা অনুভূতি। এই অনুভূতি প্রকাশের ধরণ একেকজনের একেকরকম হয়। কেউ পাগলের মতো প্রকাশ করে। উন্মাদ হয়ে যায়। আবার কেউ ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যায়। তবে প্রকাশ করার সময় একদম বোকা সেজে যায়। কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সামনে বলতেই পারে না। আর কাউকে দেখার সাথে সাথে ভালোবাসার উদ্ভব হতেই পারে। এই সম্পর্কে জানি না।”

প্রেমের এমন সোজা উত্তর শুনে ঐশ্বর্য হকচকিয়ে ওঠে। পলকহীন নজরে তাকিয়ে থাকে। লোকটা প্রেম তো? প্রেম নামক ব্যক্তির মুখে যেন প্রেমের বাণী শুনে মাথা ঘুরছে ঐশ্বর্যের। তবে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা এমনই হবে ঐশ্বর্যের জানা ছিল। এবার ঐশ্বর্যকেও একই প্রশ্ন করা হলো। ঐশ্বর্য প্রেমের দিকে চাইলো। আর বলে উঠল,
“ভালোবাসা একটা পাগলামি। আমার কাছে ভালোবাসা মানে উন্মাদনা। যেই উন্মাদনায় ভেসে গিয়ে অন্যরকম সুখ উপলব্ধি করা যায়। সেই উন্মাদনা মানুষকে পাল্টে দেয়। শুধু মানুষ না। যেই হৃদয়ে ভালোবাসা দখল করে। সেই হৃদয় পাথরের তৈরি হলেও সেটার আস্তরণ ভেঙে গুঁড়িয়ে একটা নমনীয় মন সৃষ্টি করতে পারে।”

দুজনের উত্তরে সকলেই বিমোহিত হয়ে ছিল যেন। হাততালি দিল সকলেই। অনেকে সেই ভাষা বুঝল না। তবে দুজনের কথার মাঝে গভীরতা যেন ঠিকই বুঝেছে তারা। এরপর বলা হলো পুরুষদের তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বেশি নয় শুধু মাত্র একটা লাইন গাইতে। ঐশ্বর্য দায়সারা ভাব নিয়ে বসে থাকল। আর মনোযোগ দিল বাকিদের গানের দিকে। গানের গভীরতার দিকে। কারণ সে জানে প্রেমের দ্বারা এসব সম্ভব নয়। মানুষটা তো ভালোবাসার গভীরতা বোঝেই না। সেই মানুষ কি করে ঐশ্বর্যের উদ্দেশ্যে একটা লাইন গাইবে?

একে একে সব শেষে পালা এলো প্রেমের। উঠে দাঁড়ালো প্রেম। ঐশ্বর্য বসে ছিল একটা বড় ভাঙা নৌকার মতো কিছু একটা ওপরে। মেয়েরা সবাই সেখানেই ছিল। একটু একটু করে এগিয়ে আসে প্রেম। ঐশ্বর্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়েই থাকে। তার নিকটে এসে বালিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে ঐশ্বর্যের বাম হাত নিজের হাতের ভাঁজে নেয় প্রেম। ঐশ্বর্যের সেই রহস্যে ঘেরা চোখে চোখ রাখে। ঐশ্বর্য ঢক গিলে। প্রেম নিজ মনে গেয়ে ওঠে,
“Yeh dil pagal bana baitha
Ise ab tu hi samjha de…”

ঐশ্বর্যের অন্তর সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। সে ভুল শুনছে না তো? বার বার তার কানে আসতে থাকে সেই লাইন। সেই গানের গভীরতা। প্রেম হাঁসে। হাসিতেই যেন আঁটকে যায় ঐশ্বর্যের শ্বাস। প্রেম বলে,
“হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি ভেতরে ভেতরে। এই পাগলকে তুমিই বুঝিয়ে দাও। তুমি আমার। প্রচন্ড ভয়া’বহ আকারে বেড়ে উঠেছে আমার মনের মধ্যে সেই অনুভূতি। আঁটকে রাখতে পারছি না নিজেকে। ভালোবাসি তোমায়।”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৯

হাত-পা অসার হয়ে এসেছে ঐশ্বর্য। নিজেকে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে নিজের কান দুটোকে। সে কল্পনায় নাকি বাস্তবে ভাসছে সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না। নেত্রপল্লব স্থির সামনে থাকা হাঁটু গেঁড়ে থাকা মানুষটার দিকে। এই কি সেই পুরুষ? যাকে ঐশ্বর্য প্রথম দেখেছিল সেদিন রুক্ষতা আর মানবিকতা ছাড়া কিছুই ছিল না? দৃষ্টি বেশ কিছুক্ষণ স্থির রেখে চোখ বন্ধ করল ঐশ্বর্য। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো। বিরবির করতে লাগল,
“স্বপ্ন হলে তা এখনি ভেঙে যাক। এই স্বপ্ন আমি নিতে পারব না। ভেঙে যাক সেইসব কল্পনা। আমি বাস্তবে ফিরতে চাই।”

কথাগুলোর হয়ত সকলের কানে গেল না। তবে প্রেমের কানে ঠিকই এসে পৌঁছালো। প্রেমে কন্ঠস্বরও অসম্ভব কাঁপছে। সে কি বলছে তার নিজেরও ধারণা নেই। শুধু জানে কথাগুলো তাকে যে করে হক বলতেই হবে। কাঁপা গলায় সে বলল,
“দ্যাটস নট ইউর ড্রিম ঐশ্বর্য। দ্যাটস ট্রু। আই লাভ মাই এ্যাংরি বার্ড। তোমাকে কখন থেকে এই কথাগুলো বলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মুখে আসছিল না। বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি যেভাবে আমায় বুকের এই পাশটা দখল করে ফেলেছো তোমায় বলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় পেলাম না।”

নিস্তেজ কন্ঠে নিজের বুকের বা পাশে হাত রেখে শেষ কথাগুলো বলতেই ঐশ্বর্যের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। স্বপ্ন কি সত্যি হচ্ছে নাকি স্বপ্ন আবারও স্বপ্ন দেখছে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথা ঘুরছে। চোখ বুঁজে আসছে। তিরতির করে কাঁপছে ওষ্ঠযুগল। বুক ধড়ফড় করছে এই ভয়ে যে কখন যেন ঘুম ভাঙবে সেই সাথে ভাঙবে স্বপ্ন। নাহ, সামনে থাকা ব্যক্তিটির সামনে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠছে। কোনোরকমে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। শুঁকনো ঢক গিলে নিলো কয়েকবার। হাফ ছেড়ে দৌড়ে চলে এলো সেই সমাগম থেকে। এসে দাঁড়াল সমুদ্র কিনারায়। ঢেউয়ের শেষ প্রান্ত এসে ছুঁয়ে দিল ঐশ্বর্যের পা। একদিকে মস্তিষ্ক মনে করাচ্ছে সেদিনকার সেই প্রেম আর তার মায়ের কথপোকথন! অন্যদিকে আজকে প্রেমের স্বীকারোক্তি! সব মিলিয়ে কিছু ভেবে উঠতে পারছে না। মন ছুটছে শুধু প্রেমের দিকে!

প্রেম কিছুটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ঐশ্বর্যের পানে। মেয়েটার মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। হয়ত একটু রয়েসয়ে বলা উচিত ছিল তার কথাগুলো। তবে তার কথাগুলো ঐশ্বর্যের বিশ্বাস হয়েছে কিনা তা নিয়ে খানিকটা সন্দেহ রয়েছে প্রেমের। কারণ মেয়েটা এখনো সেই রাতের কথাগুলো থেকে বের হতেই পারেনি। বলা বাহুল্য, বের হতেই চায়নি।

আশেপাশের সকলেই হতবিহ্বল হয়েছে। দৃষ্টি প্রেমের দিকে। কোথা থেকে কি হলো কেউই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। প্রেম উঠে দাঁড়ায়। দ্রুততার সাথে বলে,
“এক্সকিউজ মি!”

সেখান থেকে বেরিয়ে আসে প্রেম। ঐশ্বর্যের খোঁজে আশেপাশে তাকায় আর পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে বালুময় স্থানে সমুদ্রের ধারে। আকাশে তাঁরা টিমটিম করে জ্বলছে। চিকন একটা চাঁদ টলমলে সমুদ্রের পানিতে পড়ে চিকচিক করছে। মনোরম পরিবেশে প্রেমের দুচোখ খুঁজছে ঐশ্বর্যকে। কোথায় যে যায় মেয়েটা!

হাঁটুতে দুহাত রেখে থুঁতনি রেখে বসে আছে ঐশ্বর্য। পরনে থাকা টপ আধভেজা প্রায়। ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাকে। জোয়ারভাটার কারণে বড় বড় ঢেউ গুলো ঐশ্বর্যের চোখেমুখে ছিটে পড়ছে পানি। চোখমুখ বন্ধ করে আবারও খুলছে। সমুদ্রের টলটলে পানির দিকে চোখ স্থির। স্থির চোখের সামনে আচমকায় কেন যেন তার সামনে পানির মাঝে বসে পড়ল। ঐশ্বর্য বিস্ময় নিয়ে বড় শ্বাস নিয়ে পিছু সরে যেতেই তার বাহু আঁটকে ধরল ব্যক্তিটি। গাম্ভীর্যের সাথে সে ধমক দিয়ে উঠল,
“এই মেয়ে এই! কি সমস্যা? যখন কাছে টানতে চাই দূরে সরে যাও কেন?”

ঐশ্বর্য কাঁপুনি দিয়ে প্রেমের দিকে তাকালো। থেমে থেমে বলল,
“আপনি প্রেম তো? মি. আনস্মাইলিং আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারে না। সে তো শুধু আমাকে দয়া করেন। উনি কখনো আমায় ভালোবাসতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।”

“কেন করো না? করতে হবে বিশ্বাস তোমায়। আমার মনে কি তোমার জন্য অনুভূতি মিথ্যে? তোমার কি মনে হয়? আমি তোমায় মিথ্যে বলছি? আমার এইসব স্বীকারোক্তি মিথ্যে?”

“আমি জানি না, আমি জানি না, জানি না। শুধু এতটুকু জানি যে আপনি আমায় দয়া করে বিয়ে করেছিলেন। আপনি আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছিলেন।”

জোর কন্ঠে তেতে উঠে জবাব দিল ঐশ্বর্য। প্রেমও দমলো না। এতটুকু বুঝতে পারল এই মেয়েকে চুপ না করালে কথায় কথায় তর্ক করতেই থাকবে। কোনোরকম কথা শুনতে চাইবে না। প্রেমের ভেজা হাত দুটো দিয়ে ডান হাত ঐশ্বর্যের মুখে আর বাম হাত দিয়ে তার কোমড় আঁকড়ে ধরে বলল,
“শাট আপ! অপমান আর তোমায়? তার আগে শেখ আনন প্রেমের মৃ’ত্যু হক। তোমার কি মনে হয় আমি এতোটাই ভালো মানুষ যে আমি আমার লাইফ স্পয়েল করে আমি তোমায় দয়া করে বিয়ে করব?”

প্রেম থামে। ঐশ্বর্য চোখজোড়া কপালেই তুলে ফেলেছে প্রায়। আবার মুখ খুলে বলতে শুরু করে প্রেম,
“সরি টু সে, আমি এতোটাও ভালো মানুষ নয়। আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকেই চেয়েছি যাকে আমি বিয়ে করেছি। তোমার মায়ের কথায় বিয়ে এটা তো শুধুমাত্র একটা বিষয় ছিল, একটা পথ ছিল। আমি কখনো মা-বাবার কথার অমান্য করিনি। তাই রোজের সাথে বিয়ের কথাতেও আমি অমান্য করিনি। তবেও মাকে অনেকবার বলেছিলাম বিয়েটা করব না আমি। কিন্তু মা আমাকে যেভাবে এক কথায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছিল যার কারণে আমি মানা করতে পারিনি। অন্যদিকে তোমার প্রতি সেই অপরিচিত অনুভূতি বীজ তুমি আমার মনে পুঁতে দিয়েছিলে। সেটা যে একটু একটু করে বড় হচ্ছিল তীব্রভাবে বেড়ে উঠছিল আমি উপলব্ধি করতেই পারিনি। সব মিলিয়ে আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসহায় ব্যক্তি হয়ে পড়েছিলাম। শেষমেশ নিজের মনের সাথে যখন যুদ্ধ করেও পেরে উঠছিলাম না তখন তোমার মা এলো। সেই সাথে হানা দিল সেইসব অনুভূতিরা যারা শুধু তোমার নামে ছিল।”

এতোক্ষণ ছটফট করছিল ঐশ্বর্য। মূহুর্তেই যেন তব্দা লেগে গিয়ে প্রেমের নয়ন দুটোর দিকে তাকালো। তার চোখে সত্যি ভাসছে। মিথ্যা নেই। ভালোবাসা নামক কোনো মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেই। আস্তে করে ঐশ্বর্যের মুখটা ছেড়ে দেয় প্রেম। ঐশ্বর্যের ভেতরে তোলপাড় চলছে। কি করবে, কি বলবে সেই কোনোকিছু মাথায় আসছে না। মনের মাঝে যে আনন্দের বন্যা বইছে সেটা কি করে প্রকাশ করবে সেটা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে হুট করেই চোখ টলমল করে উঠল ঐশ্বর্যের। প্রেমের অস্থির চাহনি তাকে আরো খানিকটা পাগল করে দেওয়ার জন্য ছিল যথেষ্ট। প্রেমের গালে হাত রাখলো ঐশ্বর্য। হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পরিপূর্ণ তার গাল। তা হালকা ভিজে গেছে। ঐশ্বর্য অবিশ্বাস্য কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“সত্যি? আপনি আমাকে ভা…ভালোবাসেন?”

“সত্যিই ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

এবার প্রেমের গাল থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে ঐশ্বর্য। সবটা অবিশ্বাস্য লাগছে। মাথা ঘুরছে তার। এইতো সেদিনই তো এই লোকটার পেছন পেছন পাগলের মতো ভালোবাসা পেতে ঘুরেছে। আজ সত্যিই লোকটা তাকে ভালোবাসে! এর থেকে সুন্দর হয়ত আর কিছু হতে পারে না। এর থেকে বড় খুশি হয়ত আর কিছুই হতে পারে না। চোখে পানি পরিপূর্ণ হলো ঐশ্বর্যের। অনুভূতিরা বেরিয়ে আসতে লাগল। টপটপ করে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে আরম্ভ করল। হাত ভিজলো সেই অশ্রুতে। ঐশ্বর্যের এমতাবস্থা দেখে তার মুখ থেকে হাত সরাতেই প্রেম দেখে ঐশ্বর্য কাঁদছে। মুখ থেকে হাত সরে যেতেই বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে দিল ঐশ্বর্য। পাগলের মতো কাঁদতে থাকলো। চোখ থেকে ক্রমাগত অশ্রু ঝরতে থাকল। প্রেম হতবিহ্বল নয়নে চেয়ে রইল। কি হলো মেয়েটার? এভাবে কাঁদছে কেন সে? তার চিবুকে সযত্নে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে প্রেম প্রশ্ন করল,
“এই মেয়ে, এভাবে কাঁদছো কেন? আমি কি তোমায় কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? হ্যাঁ, হয়ত এসব কথা আমার আগে বলে দেওয়া উচিত ছিল। আমি পারিনি। আমি বুঝিনি আমার ভেতরে কি হচ্ছে আমি বুঝতেই পারিনি। শুধু তোমার সংস্পর্শে নিজেকে উন্মাদ মনে করেছি। আই এম সরি!”

কাঁদতে কাঁদতেই ঐশ্বর্য প্রতিত্তোরে বলে,
“আই এম অলসো সরি। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমায় অপমান করে বিয়ে করেছেন। তাই সবসময় আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে গেছি। আই এম সরি মি. আনস্মাইলিং!”

প্রেম ঐশ্বর্যের হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে হাতের পিঠে তার ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরে। শব্দ করে চুমু খেয়ে স্নিগ্ধ আবেশের সাথে বলে,
“তুমি কি আমার সেই ছোট্ট পৃথিবী হবে? যেখানে শুধু তুমি নামক সুখ থাকবে?”

ঐশ্বর্য এখনো অনবরত কাঁদছে। তবে তার কাঁদার কারণ অজানা নয় প্রেমের। মেয়েটা নিজেকে বাহিরে বাহিরে কাঠিন্যের সাথে যতই আচরণ করুক না কেন! সেই তো একটুতেই গলে পড়ে সে। চোখমুখ জড়িয়ে খিঁচে কাঁদতে কাঁদতেই বড় শ্বাস নিয়ে মাথা ঝাঁকায় ঐশ্বর্য। অতঃপর প্রেমের সাথে তার হাত রাখা সেই হাতটা নিজের ঠোঁটের কাছে এনে বেশ কয়েকটা ঠোঁটের পরশ দিয়ে নিল সে। অতঃপর থামলো হঠাৎ করে। কান্নাও থামলো সেই সাথে। কিছু কথা মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“কিন্তু…”

এতটুকু বলেই থেমে গেল সে। আর কোনো কথা বের হলো না। অজানা আশঙ্কায় অন্তর কেঁপে উঠল। প্রেমের কপালে ভাঁজ পড়ল। সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করল,
“কিন্তু কি?”

“আমি…”

আবারও এতটুকু বলে থামলো সে। সম্পূর্ণ কথা বলতে পারছে না আঁটকে যাচ্ছে। সে খুব করে চাইছে এই মূহুর্তে নিজের আসল পরিচয় প্রেমকে জানাতে। সে যে মানুষ নয়। তার জগৎ আর প্রেমের জগৎ যে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা আলাদা জাতি! প্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি ঐশ্বর্য? বলো!”

কোনো রকম জবাব না দিয়ে প্রেমের বুকে ঢলে পড়ল ঐশ্বর্য। যেন অনেক সাধনার পর এই মানুষটার বুকে স্থান পেয়েছে সে। সে যে হারাতে চায় না সেই স্থান। সেসব অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শোনার পর যদি এই পরম শান্তির স্থান হারিয়ে ফেলে? অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে ঐশ্বর্যের হাত দিয়ে প্রেমকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। প্রেমও গভীর আবেশে তাকে নিজের নিকটে নিয়ে আসে। ঐশ্বর্যের ক্লান্ত ভঙ্গি। সে নিজের অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করে প্রেম নামক এই পুরুষটির গভীর আবেশে হারিয়ে যেতে চাইছে। ঐশ্বর্য নিচু সুরে বলে,
“আপনার মুখে ভালোবাসি শব্দটা আমার কাছে অমৃতের মতো লাগছে। এই অমৃত আমার প্রাণ নতুনভাবে সঞ্চার করছে মি. আনস্মাইলিং!”

প্রেম হাসে। হুট করে দুজনের ওপর ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে নিজমনে চলে যায়। সমুদ্রের প্রগাঢ় শব্দ। আর তাদের বড় বড় নিশ্বাসের শব্দ দুজনকেই মাতাল করে তুলছে। প্রেম বলে,
“তোমাকে এবার হাজারবার ভালোবাসি বললেও তৃষ্ণা মিটবে না।”

এরপর নিস্তব্ধতা। শুধু একটা চাঁদের আধো আলো। আর শুধুমাত্র প্রণয়!

বারংবার হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে ঐশ্বর্য। টিস্যুতে নাক মুছে নিচ্ছে। গায়ে আর মাথায় ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে নাক টানছে ফের হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে। সেই মূহুর্তে ওয়াশরুম থেকে প্রেম বেরিয়ে এলো। গায়ে ওফ হোয়াইট গেঞ্জি। ভেজা মাথার চুল নেতিয়ে কপালে পড়েছে। সেটা টাওয়াল দিয়ে মুছতে ব্যস্ত সে। ঐশ্বর্যের হাঁচি শুনে সে ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“শান্তি পেয়েছো? কি দরকার ছিল সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেবদাসের মতো বসে থাকার?”

নাক মুছে আবারও হাঁচি দিয়ে ঐশ্বর্য ঝাঁঝালো গলায় জবাব দেয়,
“আপনার কি দরকার ছিল ওখানে ওইভাবে কনফেস করার? রুমে করতে পারতেন। অন্তত শক পেয়ে সমুদ্রের ধারে দৌড়ে গিয়ে বসতাম না।”

“সকালে চেষ্টা করেছিলাম। আপনি তো পুরোটা না শুনেই দৌড় ওয়াশরুমে। এতো লজ্জা কোথা থেকে উদ্ভব হয়েছে আপনার? আগে তো কিড’ন্যাপ করে আই লাভ ইউ বলতে বাঁধতো না।”

ঐশ্বর্য গালে হাত দিয়ে বলে,
“ধুর, আগে আর এখন এক নাকি?”

“কেন কি চেঞ্জ হয়েছে?”

ফিচেল হেঁসে জিজ্ঞেস করে প্রেম। ঐশ্বর্য আবারও হাঁচি দিয়ে বলে,
“জানি না।”
প্রেম কথা বাড়ায় না আর। রুমের টেলিফোনের কাছে বসে। রাতের খাবার ঘরেই খেয়ে নেবে। সাথে বেশ ঠান্ডা লেগেছে তাদের। তার জন্য মেডিসিনের প্রয়োজন।

নিশুতিরাতে চাঁদের দেখা নেই। মেঘের আড়ালে নিজের সুবিধেমত লুকিয়ে পড়েছে। ঘনঘন বজ্রপাত ঘটছে। আকাশ চমকাচ্ছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে প্রকৃতি আরো মেতে উঠেছে। চারদিক বিমোহিত হয়ে উঠেছে। ঐশ্বর্যকে নিজের বাহুডোরে রেখে নিজের আরেক হাত দিয়ে তার বুকের সাথে চেপে ধরে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়িয়ে ঘুমোচ্ছে প্রেম। গভীর ঘুমে মগ্ন অথচ ঐশ্বর্যকে নিজের হাত দিয়ে বাঁধনে বেঁধে রাখা। ঐশ্বর্যের ঘাড়ে পড়ছে প্রেমের গরম নিশ্বাস। দুজনের মনেই নেই কোনো দ্বিধা দুজনের নিকটে থাকতে। তবে ঐশ্বর্যের মনের কোণে তবুও দ্বন্দ্ব।

বজ্রপাতের শব্দে চোখ মেলে তাকালো ঐশ্বর্য। সে ঘুমায় নি। শুধুমাত্র ঘুমের ভান ধরেছিল। নয়ত প্রেম যে ঘুমোচ্ছিল না। চেয়ে চেয়ে দেখছিল ঐশ্বর্যের বিমোহিত মুখশ্রী। সেই হরিণী চোখে তাকিয়ে নিজে হারিয়ে ফেলছিল যে বার বার। তাই ঐশ্বর্য চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান করছিল। ঐশ্বর্য উঠতে চায়। তবে পারে না। যদি প্রেমের ঘুম ভাঙে? তা তো হতে দেওয়া যাবে না। খুব আস্তে করে প্রেমের হাত সরিয়ে নেয় ঐশ্বর্য। অতঃপর নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে কৌশলে হাওয়ায় বেগে নিজে সরে এসে প্রেমের বাহুডোরে বালিশ রেখে দেয় ঐশ্বর্য।

বেডের নিচে নেমে স্বস্তির শ্বাস ফেলে নেয় ঐশ্বর্য। তাকায় ঘুমন্ত প্রেমের দিকে। মানুষটার বাহুডোর থেকে এখনি উঠতে তার ইচ্ছে করছিল না। তবে উপায় নেই। খানিকটা প্রেমের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে ঐশ্বর্য বলে,
“আই ইউল বি ব্যাক সুন, মি. আনস্মাইলিং!”

হোটেলের নাম লাইটিং হচ্ছে। ভালোই লাগছে দেখতে। সেই হোটেল টার ছয় নম্বর ফ্লোরের ৬১০ নম্বর রুম। আগুন জ্বলছে ঘরের মধ্যে। সেই আগুনের তাপ নিচ্ছে ইফান। বড় দুটো শ্বাস নিয়ে বেলকনি দিয়ে বাহিরে তাকায় সে। বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। ঠান্ডায় তার শরীর অসার হয়ে আসছে। শক্তি কমে যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ বেলকনির দরজা লাগিয়ে দেয় সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“কালকে অমাবস্যা। প্রায় শতশত বছর ধরে সেই অমাবস্যার অপেক্ষা। কাল একটা বিশেষ দিন। আর কালকেই হবে কার্য হাসিল।”

বাঁকা হাসি দেয় ইফান। হঠাৎ অনুভূত হয় এই হোটেলের ভীত কেঁপে উঠছে। ইফানের পায়ের তলা কাঁপছে। ইফান দ্রুত ফোন হাতে নেয়। কাউকে কল লাগায়। দুইতিন বার কল লাগানোর পর রিসিভ হয় কল। পাগলের মতো কিছু প্রলাপ বকে। তৎক্ষনাৎ তার রুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে দরজার দিকে তাকায় ইফান। ফোনটা কেটে দেয়। দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খোলে। সামনের মানুষটাকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না। সে আগেই টের পেয়েছিল সামনে থাকা ব্যক্তিটির আগমন। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে ইফান বলে,
“ভাবি, এতো রাতে তাও এই হোটেলে? তোমরা না পাশের রিসোর্টে উঠেছিলে। এনি প্রবলেম? প্রেম ভাই ঠিক আছে তো?”

ঐশ্বর্যও হাসে। মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
“সবাই ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি। তোমার প্রেম ভাইও ঠিক আছে। কোনো প্রবলেম হয়নি।”

“তাহলে হঠাৎ এতো রাতে? ভাবলাম কোনো সমস্যা!”

ঐশ্বর্য কথার জবাব দিতে দিতে তড়তড় করে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। সরাসরি চেয়ারে বসে পড়ে পায়ে পা তুলে।
“সমস্যা থাকলেই বুঝি তোমার কাছে আসতে হবে? এমনি আসতে পারি না?”

“না ঠিক তা নয়।”

ঐশ্বর্য আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। ইফান কৌতুহলের সাথে প্রশ্ন করে,
“তাহলে এতো রাতে না ঘুমিয়ে আমার ঘরে? কোনো বিশেষ কারণ আছে?”

ঐশ্বর্য এবার র’ক্তলাল দৃষ্টিতে তাকায় ইফানের দিকে। তাকে কটাক্ষ করে বলে,
“প্রশ্নটা আমারও! নিজের রাজ্য, নিজের আস্তানা ছেড়ে হঠাৎ বিদেশের মাটিতে কি করছো? কোনো বিশেষ কারণ আছে?”

থতমত খেয়ে তাকায় ইফান। কিছু বলতে যাওয়ার আগে উঠে দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। চোখের রঙ পাল্টাতে শুরু করে তার।
“হুঁশশ, নো মোর এক্সকিউজ! হোয়াট ডিড ইউ থিংক? আমি চিনব না তোমায়? তুমি ইফান নও। ইউ আর অ্যা ডেভিল।”

ইফান পিছু সরে যেতে শুরু করে। ঐশ্বর্য আগায়। হাতের নখ তীক্ষ্ণ আকারে বাড়তে শুরু করে। চোখের রঙ ইতিমধ্যে সবুজ রঙ ধারণ করেছে। ইফানের চক্ষু চড়কগাছ। কেননা, ঐশ্বর্যের চোখের বর্ণ তো লাল হবার কথা। তবে কি সে ডেভিল কুইন হবার আশঙ্কা হারিয়ে পূর্ণাঙ্গ ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হচ্ছে?

ঐশ্বর্যের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত। শরীরের সমস্ত রগ সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। সে নিজের আসল রূপে এসেছে। তৎক্ষনাৎ ইফানকে নিজের হাত দিয়ে আঘাত করে ঐশ্বর্য। ছিটকে পড়ে ইফান। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় তার ইফানের রূপ। বেরিয়ে পড়ে তার আসল রূপ। এরিকের চেহারা। তার চোখজোড়া লাল হয়ে ওঠে। শরীরের রগ আর শিরা কালো হয়ে ফুটে ওঠে। এরিক উঠে দাঁড়ায়। ঐশ্বর্য চোখের পলকেই এরিকের কাছে আসে। এরিকের গলা চেপে ধরে।
“বলো, ইফান কোথায়? কোথায় ইফান? তার মানে তুমিই এতোদিন ইফানের রূপে ওই বাড়িতে ছিলে? তাহলে ইফান কোথায়?”

এরিক কথা বলতে পারছে না ছটফট করছে। এমতাবস্থায় সে জবাব দিল,
“ওর যেখানে থাকার সেখানেই চলে গেছে।”

ঐশ্বর্য থমকায়। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। হতভম্ব হয়ে বলে,
“ওয়েট, তোমরা ডেভিলরা তো একটা মানুষ ম’রে না যাওয়া অবধি তার রূপ ধারণ করতে পারো না। এর মানে ইফান…”

এতোটুকু বলে থামলো ঐশ্বর্য। এরিকের গলা ধরে ওপরে তুলে ছিটকে ফেলে দিল সে। সোফার সাথে আঘাত থেকে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো সোফা। হুংকার দিয়ে উঠল ঐশ্বর্য। তেড়ে আসে এরিকের দিকে। চিৎকার করে বলে,
“তোকে আমি তখনই চিনেছিলাম যখন ইফানের রূপে এখানে প্রথমবার দেখি। যদিও বাড়িতে চিনতে পারিনি। সেই পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম না। আমি নিশ্চিত হই তখন যখন তোর স্পর্শ আমার হাতে লাগে। বোকা ডেভিল!”

আহ’ত অবস্থায় এরিক হাসে। তার হাসিতে রাগের মাত্রা বাড়ে ঐশ্বর্যের। হাসতে হাসতে এরিক বলে,
“আপনি নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা দিয়েছেন।”

ঐশ্বর্য চোখমুখ জড়ায়। তৎক্ষনাৎ বলে,
“মানে? কি উদ্দেশ্য তোর? কেন তোরা আমাদের পেছনে পড়ে আছিস?”

“আপনাকে সঠিক স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

ঐশ্বর্যের বিশ্বাস হয় না সব আজগুবি কথা। এরিকের দিকে এসে ঝুঁকে তার গলা চেপে ধরে টেনে সে। আস্তে আস্তে দেয়ালের সাথে ওপরে তুলে বলে,
“আজকে ম’রবি তুই। বিনা অপরাধে যাকে তুই মৃ’ত্যু দিয়েছিস সেই সাজা তোকেও ভোগ করতে হবে। আমি কিন্তু পরিচয় আর নিজের শক্তি কোনোটাই ভুলিনি। আমি ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য।”

এরিক কিছু বলতে পারছে না। সে নিজের শক্তি কমিয়ে ইফানের রূপ পুনরায় ধারণ করেছে। তার শ্বাস রো’ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে প্রা’ণ বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখ উল্টে ফেলেছে। ঠিক সেই মূহুর্তে ঐশ্বর্যকে ধাক্কা দিয়ে কেউ ফেলে দেয়। ছিটকে পড়ে যায় ঐশ্বর্য। চোখমুখ খিঁচে ফেলে। চেনা কণ্ঠস্বরে চোখ খুলে ফেলে সে। মাথা থেকে পা অবধি কাঁপুনি ধরে।
“ইফান আমার ভাই ঐশ্বর্য। ওকে মা’রতে পারো না তুমি ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস!”

চলবে….

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪০

ঐশ্বর্য মাথা নিচু করে ফ্লোরে পড়ে রয়েছে। মুখে কোনোরকম কথা নেই। চোখমুখ ফ্যাকাশে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে চলেছে। তার আসল রূপ এখনো অবধি জ্বলজ্বল করছে। তীক্ষ্ণ নখ মুড়িয়ে রাখার চেষ্টা করেও হচ্ছে না। তার সবুজ বর্ণের নয়নে চেয়ে রয়েছে সামনে ক্রোধে ফেটে পড়া প্রেমের দিকে। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছে ইফান রূপি এরিক। জোরে জোরে কাশছে। কাশতে কাশতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল ফ্লোরে। আধশোয়া হয়ে পড়ল। নিজেকে দুর্বল উপস্থাপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রেমের সামনে। ঐশ্বর্য নড়েচড়ে না উঠে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে রইল। গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগলো প্রেমের এখানে আগমন কি করে হলো? সে তো ঘুমোচ্ছিল! তবে?

একে একে সমস্ত পরিকল্পনা বুঝতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হলো ঐশ্বর্যের। প্রেমও একটু নিচু হলো। তা দেখে ঐশ্বর্যের বোধ হলো যে প্রেম তাকে ধরে দাঁড় করাবে। তবে তার ভাবনা ভুল। সে মুখোশধারী ইফানকে টেনে তুলল। অস্থির হয়ে পড়ল প্রেম।
“ইফান, তুই ঠিক আছিস? কষ্ট হচ্ছে না তো তোর? তোর গলাতে তো গভীর ক্ষ’তের সৃষ্টি হয়েছে। ইমিডিয়েট ডক্টরের কাছে যেতে হবে।”

ইফান ভয় পাওয়ার ভান করে প্রেমের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাই, ঐশ্বর্য মানুষ না ভাই। ভাবি মানুষ না। ও ভ্যাম্পায়ার। সবাইকে মে’রে ফেলবে। সবার র’ক্ত শুষে নিতে এসেছে। আমার উপর আজ আ’ক্র’মণ করেছে। কাল তোমার উপরেও করতে পারে।”

প্রেম কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো। তার আগেই ঝড়ের বেগে উঠে দাঁড়িয়ে ইফানকে ছিটকে দিয়ে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল ঐশ্বর্য। চিৎকার দিয়ে প্রেমের বলল,
“প্লিজ, এর কথা বিশ্বাস করবেন না। ও ইফান নয়। ও শুধু ইফানের রূপ ধরে রয়েছে। আসল ইফান…”

ইফানের হাসি মুখ দেখে থামল ঐশ্বর্য। তাদের থেকে প্রেমের দূরত্ব বেশ দূরেই। ঐশ্বর্য তাকে ঠেলে ঘরের শেষ মাথায় নিয়ে এসেছে। ইফান হিসহিসিয়ে বলল,
“আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। কিন্তু একটা ছোট্ট চালাকির পেছনে আমি ফিকে পড়ে গেছেন। আমি চেয়েছিলাম সেকারণেই আমার হাতের স্পর্শ আপনার হাতের সাথে লেগেছিল। আমি চেয়েছিলাম আপনি আমার উপস্থিতি বুঝুন। আপনি যখন হোটেলে প্রবেশ করেছেন তখন আপনার আগমন টের পেয়েছিলাম আমি। তৎক্ষণাৎ প্রেমকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছি। বলেছিলাম, আমি খুব বড় বিপদে পড়েছি। ব্যাস…আমার কাজ এখানেই শেষ।”

আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল ঐশ্বর্য। ইফানকে আঁচড়ে ফেলে দিক ফ্লোরে। তার বুকের ওপর পা তুলে দিল সে। আর্তনাদ করে উঠল ইফান। ছুটে এলো প্রেম। ঐশ্বর্যের হাত ধরল। মিনতির কন্ঠে বলে উঠল,
“আমার ভাইয়ের প্রা’ণ তুমি নিও না। ফর গড সেক, ওকে ছেড়ে দাও। তোমার কি র’ক্ত চাই? আমার র’ক্ত শুষে নাও। আমার সামনে ইফানের প্রা’ণ যাক আমি চাই না। ও আমার ভাই হয় ঐশ্বর্য!”

ঐশ্বর্য ক্রোধে একাকার হয়ে পড়েছে। প্রেমের কথা ওর কানে পৌঁছাচ্ছে না। ও একইভাবে ইফানের ওপর পা রেখে পা দিয়েই তাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে প্রেমের নিজেরও প্রা’ণ যায় যায় অবস্থা। নিজের ভাইয়ের এই দশা দেখার নয়। ঐশ্বর্যের হাত জোরে চেপে ধরে প্রেম। তাকে টেনে সরিয়ে আনতে চায়। তাতে ব্যর্থ হয় সে। উল্টে ঐশ্বর্যের হাতের নখের আঁচড়ে তার হাতের অনেকটা কেটে যায়। ছু’রির মতো ধারালো তার নখ। প্রেম মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে। সাথে সাথে ঐশ্বর্যের হুঁশ আসে। ইফানের থেকে সরে এসে নিজের মনুষ্য রূপ ধারণ করে সে। গায়েব হয় তার নখ। প্রেমের নিকটে এসে তার হাত থেকে র’ক্ত ঝরতে দেখে ঐশ্বর্য। ব্যাকুল হয়ে পড়ে। প্রেমের হাতখানি ধরে। র’ক্ত তাকে আর্কষণ করছে। গলা শুঁকিয়ে আসছে। তবুও নিজেকে সামলে নেয় ঐশ্বর্য। ঢক গিলে নেয়। আকুলতার সাথে বলে ওঠে,
“আই এম সরি, মি. আনস্মাইলিং! আবারও আমি আপনার কষ্টের কারণ হলাম। ব্যাথা করছে? আমার নখে তো বি’ষও আছে। আপনার তো জ্বালা করবে।”

বলেই দেরি না করে নিজের মুখ দিয়ে প্রেমের হাতের ক্ষত স্থান চেপে ধরল ঐশ্বর্য। শুষে নিল প্রেমের র’ক্ত। ঐশ্বর্য বেসামাল হয়ে পড়ছে। র’ক্তের ঘ্রাণ ও স্বাদ তাকে মাতাল করে তুলছে। তবে প্রেমের বি’ষ শুষে নেওয়া আবশ্যক। কোনোমতে নিজের উদ্দেশ্য স্থির রেখে ঠোঁট সরিয়ে নেয় ঐশ্বর্য। প্রেমের দিকে চোখ যেতেই দেখল লোকটার দৃষ্টি স্থির। সে যেন জীবন্ত মূর্তি। সযত্নে নিজের হাত সরিয়ে নিল প্রেম। নির্জীবভাবে বলল,
“আমার প্রতি এতো সংযত হচ্ছো কেন? তোমরা তো ভ্যাম্পায়ার না? কাউকে ছাড় দাও না। আমার প্রতি এতো দরদ? তাহলে আমার ভাইকেও ছেড়ে দেবে প্লিজ?”

ঐশ্বর্য অসহায় পানে তাকালো। লোকটা এভাবে কেন কথা বলছে? আগে তো বলতো না! কেমন যেন নিষ্ঠুর লাগছে তাকে। ঐশ্বর্য মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিল,
“আপনার মধ্যে আমার প্রাণভোমরা লুকায়িত মি. আনস্মাইলিং!”

একটু থামলো ঐশ্বর্য। ইফানের দিকে তাকালো অতঃপর আবার বলতে শুরু করল,
“আপনি আমার স্বামী! আমরা ভ্যাম্পায়ার মানছি! কিন্তু আমাদের জগতেরও কিছু নিয়ম থাকে। সেই নিয়ম অনুযায়ী আমরা যাকে তাকে মা’রতে পারি না।”

“তাহলে আমার ভাইটাকে কেন মারছো? হি ইজ ইনোসেন্ট? ও কি ক্ষতি করেছে তোমার? আর আমাদের পেছনেই বা কেন পড়েছো কি উদ্দেশ্য তোমার?”

হুংকার ছেড়ে বলল প্রেম। ঐশ্বর্য তার হুংকারে কেঁপে উঠল। প্রেম অচেনা হয়ে উঠছে তার কাছে। ঐশ্বর্য নিচু সুরে বলে,
“বিলিভ মি! ও ইফান নয়। ও ইফান রূপি ডেভিল। ও আমাদের ভ্যাম্পায়াদের চিরশত্রু। ওর উদ্দেশ্য ভালো নয়। প্লিজ একটু আমাকে বিশ্বাস করুন।”

আচমকা প্রেম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সেই সঙ্গে উত্তরে বলে,
“বিশ্বাস? অনেস্টলি, তোমার প্রতি বিশ্বাস আসছে না কেন যেন! ও ডেভিল? ইউ মিন শয়’তান? তাহলে ও দেখতে আমার ভাইয়ের মতো কেন? বোকা বানাচ্ছো? অবশ্য এতোদিন তো তাই বানিয়ে এসেছো। বোকা বানিয়ে এসেছো শেখ আনন প্রেমকে। আর বানাতে পারবে না।”

ঐশ্বর্যের কান্না পায় ভীষণ। হেঁচকি ওঠে। কষ্ট হচ্ছে। প্রেমের কথাগুলো তার বুকে তীরের মতো বেধে গিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ঠিক এই ভয় পেয়েছিল সে। সে চায়নি তার পরিচয় প্রেম জানুক! তাদের মাঝে দূরত্ব আসুক। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে ঐশ্বর্য। নজর পরে বাহিরের দিকে। বৃষ্টির বেগ জোরে হয়েছে। মালদ্বীপে বৃষ্টি মানে প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া! হোটেলের নিচেই রয়েছে ঠান্ডা পানির সুইমিংপুল। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ঐশ্বর্যের। ফট করে বলল,
“আপনাকে যদি প্রমাণ করে দিই ও একটা ডেভিল! তবে?”

প্রেম সন্দিহান চোখে তাকায়। মেয়েটাকে এখন ভয় করছে তার। উত্তরে কিছু বলে না। ঐশ্বর্য পিছু ফিরে এগোয় ইফানের দিকে। ইফান ওঠার চেষ্টা করছে। সে বেশ আ’হত হয়েছে বটে। সেও পারবে পাল্টা আঘাত করতে। তবে প্রেমের সামনে বর্তমানে ইফান সেজেই থাকতে চাইছে সে। আর ডেভিল কুইনকে আঘাত করবার মতো সাধ্য বা সাহস কোনোটাই তার নেই। ঐশ্বর্য তার দিকে হেলে হঠাৎ করে তার গেঞ্জির কলার ধরে দাঁড় করালো। চোখের পলকে টেনে নিয়ে দাঁড় হলো বেলকনির কিনারায়। ইফান ছটফট করে। তার ঠান্ডা সহ্য হয় না। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি গায়ে লাগে। শরীর কেঁপে ওঠে। প্রেম হতভম্ব হয়ে শুধু চেয়ে থাকে। আচানক ওপর থেকে সুইমিংপুলের দিকে বেলকনি ছাড়িয়ে ইফানকে ধাক্কা দেয় ঐশ্বর্য। ইফান তাল হারায়। হাওয়ায় ভেসে পড়ে যায় সোজা সুইমিংপুলে।

দূর থেকে এসব দেখে ছুটে বেলকনিতে আসে প্রেম। চিৎকার হয়ে ওঠে ভয়ে।
“ইফান!”

ঐশ্বর্যের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। প্রেমের নিজেকে পাগল পাগল লাগে! কি হচ্ছে এসব? কি করে আটকাবে ঐশ্বর্যকে তা বোধগম্য হয়ে ওঠে না। চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ঐশ্বর্যের বাহু চেপে ধরে প্রেম। নিজের সমস্ত রাগ ঢেলে বলে ওঠে,
“তুমি এতোটা নিষ্ঠুর! ওকে ফেলে দিলে? ওর কিছু হয়ে গেলে আমি তোমায় ছাড়ব না ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। তোমার মাঝে যতই শক্তি থাক। তোমার যতই ক্ষমতা থাক। আর আমি যতই মানুষ হই না কেন! তোমাকে আমি ছাড় দেব না।”

ঐশ্বর্য পাগলের ন্যায় হাসে। প্রেমের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে বলে,
“আমি এমনিতেও ছাড় পেতে চাই না আপনার থেকে। আমার বাহুডোর থেকে। আমি হতে পারি ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু এই লোকটার কাছে আমি নিষ্ক্রিয়।”

প্রেমের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে ওঠে সেইসব কথা। কিন্তু সে পাত্তা দিতে চায় না। মাথায় একটাই কথা ঘুরতে থাকে, সামনের মেয়েটি নিষ্ঠুর! সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। সব করতে পারে। ঐশ্বর্যের বাহু ছেড়ে প্রেম একপ্রকার দৌড় লাগায় বাহিরের দিকে। ঐশ্বর্য ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে।

সুইমিংপুলের কাছে যেতে যেতেই দৃশ্যমান হয় ঐশ্বর্যের মুখশ্রী! সে নিরব হয়ে সুইমিংপুলের পানিতে তাকিয়ে আছে। প্রেম আসতে আসতে আশ্চর্য হয়ে দেখল ঐশ্বর্যকে। মেয়েটা তো তার পেছনে ছিল সেই রুমে। এখনি এখানে তার আগে কি করে পৌঁছালো? তারপর তার স্মরণে এলো, মেয়েটা তো তার মতো সাধারণ মানুষ নয়। তার কি ক্ষমতার শেষ আছে? এসব মাথা থেকে বের করে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে সুইমিংপুলের কাছে এলো প্রেম। চিৎকার করে ডাকলো,
“ইফান! আমার ভাই!”

প্রেমের উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু ফিরে তাকায় ঐশ্বর্য। তারই অপেক্ষায় ছিল ঐশ্বর্য। দ্রুত এসে পানির দিকে তাকিয়ে ইফানকে খোঁজে প্রেম। তাকে না পেয়ে পানিতে ঝাপ দিতে প্রস্তুত হয়। সেই মূহুর্তে ঐশ্বর্য তাকে আঁটকায়। প্রেম তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে তিক্ততার সাথে বলে ওঠে,
“ডোন্ট টাচ মি। তুমি খু’নি। আর কোনো খু’নিকে ভালোবাসা যায় না।”

ঐশ্বর্যের ভেতরটা ভাঙতে থাকে। চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। বহু কষ্টে কান্না চেপে রেখে বলে,
“পানিতে ঝাপ দেওয়ার আগে দেখে তো নিন যে কাকে বাঁচাতে ছুটছেন আপনি!”

পানির নিচ থেকে ধড়ফড়িয়ে বেরিয়ে আসে ইফান রূপি এরিক। তার আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে। নিজের চেহারা ধারণ করেছে। বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে যায় প্রেম। নেত্রপল্লবের পলক পড়তেই থাকে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“আ…আমার ভাই? ইফান কোথায়?”

“ও ইফান নয়। ও ডেভিল। ওর আসল চেহারা আপনি নিজেই তো দেখতে পাচ্ছেন। এতোদিন ও ইফানের রূপ নিয়ে ঘুরেছে। ওর উদ্দেশ্য আমার জানা নেই। কেন এই ডেভিল আমাদের পিছু নিয়েছে তাও জানি না। আর ডেভিলরা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। কারো রূপ ধারণ করলে তার আসল চেহারায় আনতে অতিরিক্ত ঠান্ডায় যথেষ্ট! এখন তো আমায় বিশ্বাস করছেন তাই না মি. আনস্মাইলিং?”

প্রেম বাকরুদ্ধ। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসেছে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। ঐশ্বর্যের কথা শুনেও চুপ রইল সে। তাকিয়ে রইল এরিকের দিকে। ঐশ্বর্য চোখ বুঁজে নিল। তার আগের রূপে ফিরলো। সেই চোখ ঝলসানো রূপ! ভয়াবহ সুন্দর রূপ। যেই রূপে যেমন মোহ রয়েছে তেমনই ভয়াবহতা! তার ঠোঁটের দুই ধার দিয়ে বেরিয়ে এলো চিকন আর ধারালো দাঁত। ভার কন্ঠে বলল,
“এখন নিশ্চয় ওকে মারতে আপনি বাঁধা দেবেন না?”

প্রেম নিরব রইল। কথা বলার শক্তি সে হারিয়েছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে সেটা গুলিয়ে ফেলেছে। ঐশ্বর্য আর উত্তরের অপেক্ষা না করে লাফ দিয়ে হাওয়ায় ভেসে পানিতে গিয়ে পড়ল। পানিতে যেন ঝড় সৃষ্টি হলো। পানি কেঁপে উঠল। বড় ঢেউ দিয়ে উঠলো। এরিক সহ ঐশ্বর্য পানির নিচে ডুবল। প্রেম তবুও নিরব। আজ অনেক বড় সত্যির মুখোমুখি সে। যা আর নিতে পারছে না। ক্রমাগত শরীর কাঁপছে।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে তাজা লাল র’ক্ত ভেসে ওঠে। টলটলে পানিতে মিশে র’ক্ত যেন রঙ হয়ে গেল। পানি যেন হয়ে উঠেছে র’ক্তের এক জলাশয়। ভয়া’বহ সেই দৃশ্য। শিউরে উঠল প্রেম। না চাইতেও দৃষ্টি যেন সেই নিষ্ঠুরতম মেয়েটিকেই খুঁজতে লাগল। মনটা প্রশ্ন করে উঠল, ‘মেয়েটার কিছু হলো না তো আবার?’ মনের কোথাও এখনো তার জন্য চিন্তা প্রেমকেই ভাবিয়ে তুলল। ইতিমধ্যে পানির নিচ থেকে উপরে উঠে এলো ঐশ্বর্য। ভিজে চুপসে যাওয়া সেই মুখটাকে দেখে প্রেমের মন মস্তিষ্ক যেন আপনাআপনি স্বস্তি পেল।

পানি থেকে উঠল ঐশ্বর্য। প্রেমের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই হুইসিল বাজল। সিকিউরিটি গার্ড হুইসিল বাজাচ্ছে। হয়তবা এতো পানিতে শোরগোল পেয়ে এদিকেই আসছে। ঐশ্বর্য দ্রুততার সাথে বলল,
“তাড়াতাড়ি চলুন এখান থেকে।”

“কেন? ভয় হচ্ছে? তোমাদের ভয়ও হয়?”

ঐশ্বর্য নিরব চাহনি নিয়ে তাকালো। প্রেম হাঁটতে শুরু করল। পিছু পিছু হাঁটতে লাগল ঐশ্বর্য। বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। বৃষ্টিতে ঘোলাটে হয়ে আসছে প্রেমের দৃষ্টি। সবটা আবছা লাগছে।

ঠান্ডায় কাঁপছে ঐশ্বর্য। খেয়ালে এলো তার হাতের চিহ্নটাও জ্বলছে। প্রচন্ডভাবে জ্বলছে। হঠাৎ ঠান্ডা লাগার কারণ বুঝল না ঐশ্বর্য। প্রেম রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। টাওয়াল দিয়ে নিজের মাথা মুছছিল ঐশ্বর্য। প্রেমের আগমনে তার দিকে এগিয়ে এলো ঐশ্বর্য। টাওয়ালটা প্রেমের দিকে বাড়িয়ে বলল,
“নিন। মুছে নিন।”

প্রেম একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। কোনো হেলদোল নেই। আচানক প্রশ্ন করে উঠল,
“তাহলে ইফান কোথায়?”

ঐশ্বর্য চমকালো। এদিক-ওদিক তাকালো। কন্ঠস্বর কাঁপছে তার। প্রেম আবারও বলল,
“মিথ্যে বলবে না। সত্যি যতটাই তিক্ত হক। আমি হজম করে নেব। তোমার আসল পরিচয় যদি জেনে এখনো চুপ থাকতে পারি তবে সব জেনে মেনে নেব।”

ঐশ্বর্য বড় শ্বাস নিতে নিতে থেমে থেমে বলল,
“ইফান মা’রা গেছে। কারণ একটা ডেভিল কোনোদিন একটা মানুষ না ম’রে যাওয়া অবধি তার রূপ ধারণ করতে পারে না।”

প্রেম আবারও চুপ। যেন সত্যিই হজম করছে কথাগুলো। চোখ বুঁজে নিল সে। স্মৃতিচারণ করল। কতশত স্মৃতি ইফানের সাথে। ইফানের বোকা কথাগুলো! ছোট থেকে কতশত সময় কাটিয়েছে তার সাথে। স্বর্ণ দিয়ে যেন মুড়ানো। চোখে আপনাআপনি অশ্রু এলো তার। তবে তা গড়িয়ে পড়ল না। পুরুষদের নাকি অশ্রু ফেলতে নেই! চোখ খুলল প্রেম। সেখান থেকে চলে এসে বেলকনির দরজা খুলে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। ঐশ্বর্য পেছনে দাঁড়িয়ে দেখল লোকটার মতিগতি। লোকটা কষ্ট পেয়েছে। তাকে সামলাবে কি করে? ঐশ্বর্য এগিয়ে তার নিকটে এসে দাঁড়ালো। টাওয়াল দিয়ে একটু উঁচু হয়ে প্রেমের মাথার চুল মুছতে যেতেই ছিটকে সরে এলো প্রেম। ধমকে বলে উঠল,
“ডোন্ট টাচ মি!”

ঐশ্বর্য অবাক হলো। তারপরেই নিজেকে সামলে নিল। তারপর বলল,
“আমি মানুষ নয় আমি মানছি। তাই বলে কি আপনাকে ছোঁয়ার অধিকার, আপনার কাছে যাওয়ার অধিকার আমি হারিয়েছি?”

“আমি কোনো বিশ্বাসঘাতকের স্পর্শ চাই না। আর তোমার মতো চরম বিশ্বাসঘাতকের স্পর্শ তো কোনোদিন না। যে কিনা দিনের পর দিন নিজের পরিচয় লুকিয়ে আমার কাছে আসার চেষ্টা করেছে। সত্যি করে বলো, তোমার উদ্দেশ্য কি?”

“কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই আমি আপনার জীবনে প্রবেশ করেছি। আমি এক ছন্নাছারা এক ভিন্ন জগতের রাজকন্যা। যে আপনার খোঁজে এই মানুষের পৃথিবী আপন করে নিয়েছে। আর কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি আপনাকে শুধু ভালোবেসেছি।”

প্রেম হাসে। চাপা কন্ঠে বলে,
“ভালোবাসলে কোনো লুকোচুরি চলে না ঐশ্বর্য। ওপসস… সরি, ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য।”

ঐশ্বর্যের চোখে পানি টলমল করতে থাকে। ঘোলাটে হয় দৃষ্টি। কান্না চেপে বলে,
“আমি মানুষ নই বলে কি আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়? আমি জানি আমার মতো খারাপ মেয়ে কোনো যোগ্যতাই নেই আপনার মতো একটা ভালো মানুষের ভালোবাসা পাবার। কিন্তু দয়া করে ঘৃণা করবেন না আমাকে। আমি বাঁচতে পারব না।”

“তোমাকে ঘৃণা করার যোগ্যতাও আমার নেই। কিন্তু তোমার আর আমার মধ্যে যে অসীম দূরত্ব সৃষ্টি করেছো সেটা মিটবে না। তুমি ছলনাময়ী। তুমি নিষ্ঠুরতম রাজকন্যা। বলা তো যায় না, যদি তোমার সাথে থেকে আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হয়? ইতিমধ্যে আমার ভাইটার প্রা’ণ শেষ হয়ে গেছে। আমি আর চাই না। আমার থেকে দূরে থাকো তুমি। তোমার আর আমার জগত ভিন্ন। সেই ভিন্নতা থেকে মিলন অসম্ভব! কে বলতে পারে? কাল তুমি আমায় আ’ক্রমণ করে বসলে?”

ঐশ্বর্য অবিশ্বাস্য নয়নে তাকায়। নিরবে বেয়ে পড়ে অশ্রু। অস্ফুটস্বরে বলে,
“এতোটাই অবিশ্বাস?”

প্রেম কিছু বলে না বেরিয়ে যায় ঘর থেকে দ্রুততার সাথে। ঐশ্বর্য ফ্লোরেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। সবটা অন্ধকার লাগে। এই জগতটাকে অসহ্য লাগে। হু হু করে কেঁদে দেয়।
“ওই প্রেম নামক ব্যক্তির ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম আমি। সেটা যখন পেয়ে গেলাম যেন নতুন অস্তিত্ব পেলাম! আবার নিজের আরেক অস্তিত্বের জন্য তা হারিয়ে বসলাম। কি লাভ আমার অস্তিত্ব রেখে। হারিয়ে যাক সেই অস্তিত্ব!”

রাতটা গভীর এবং নিরব। পাশের ল্যাম্পশিটের হালকা আলো মাধুর্যের চোখে পড়েছে। পায়ে জড়ানো ব্ল্যাঙ্কেট। চিন্তাতে পরিপূর্ণ তার মুখশ্রী। বিষণ্ণ তার মন। একটা অস্থির অস্থির ভাব। পাশেই অনুভব ঘুমিয়েছে। যদিও লোকটা বেশ ক্লান্ত ছিল! মাধুর্য অনুভবের দিকে তাকায়। পায়ের ওপর থেকে ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে বেডে পা নামিয়ে বসে। কিছু একটা ভাবতে থাকে। গভীর চিন্তার মাঝপ বাগড়া দিয়ে যখন তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলা হয় চকিতে তাকায় সে। বুঝতে এক মূহুর্তও দেরি হয় না এই কাজটা করার লোকটা কে! ঘাড়ে আলতো ঠোঁটের স্পর্শ পড়তেই নড়েচড়ে ওঠে মাধুর্য। অনুভবের শীতল কন্ঠ কানে এসে বাজে।
“কি হয়েছে? এতো রাতে না ঘুমিয়ে হঠাৎ বসে আছো?”

“ভালো লাগছে না আমার অনুভব। কেমন যেন অস্থির লাগছে। মনটা কেমন করছে!”

অনুভব কিছু একটা বুঝে উত্তর দেয়,
“মেয়ের জন্য মন খারাপ করছে?”

“আচ্ছা, ওকে একটা কল করি?”

“কয়টা বাজে দেখেছো? এসময় হয়ত ঘুমোচ্ছে। তোমার মেয়ে তো খুব ঘুম কাতুরে। দেখবা তোমার ওপর ঘুম ভাঙার রাগ ঝাড়তে না পেরে প্রেমের ওপর ঝাড়ছে!”

মাধুর্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“ঠিকই বলেছো। ও আমার ওপর অনেক রেগে আছে জানো তো? কাল সকাল হলেই প্রেমকে একবার ফোন করব। বলব কাল রাতটা যেন ঐশ্বর্যকে একদম হাতছাড়া না করে। আমার খুব ভয় করছে।”

অনুভবের মুখ ভার হয়। মাধুর্যকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। ভয় তো তার নিজেরও হচ্ছে। আত্মা কাঁপছে! তবুও মাধুর্যকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আমি জানি তোমার ভয় করছে। কিন্তু প্রেম আছে। আর ঐশ্বর্য নিজেকে সামলে নেবে।”

“কাল রাত তো আমাদের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক একটা রাত হতে চলেছে। বিশেষ করে আমাদের মেয়ের জন্য। ও তো জানেও না কাল রাতে কি হতে পারে ওর সাথে। কাল আমাদের শক্তি পুরোপুরি গ্রাস করে নেমে অমাবস্যা! কাল রাতে ডেভিলদের শক্তি দশগুন বেশি হয়ে যাবে। আমরা না হয় আমাদের ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের প্রবেশদ্বারের শক্তি থেকে বাঁচবো। কিন্তু ঐশ্বর্য?”

“ওর কাছে প্রেম আছে। ওর ভালোবাসার মানুষ আছে। ওর পরিপূরক প্রেম। কখনো এমন কিছু হবেনা। আমি জানি কাল ঐশ্বর্যের জন্য একটা অন্যরকম রাত। কাল রাতে ওর পরিচয় বদলে যেতে পারে। কিন্তু ঐশ্বর্য তো এইখানেই নেই। ডেভিলরা ওর ধারের কাছেও যেতে পারবে না। চিন্তা করো না।”

মাধুর্য হাফ ছাড়ে। অনুভবের কথা তার বিশ্বাস হয়। অনুভবের বুকে মাথা রাখে সে। স্বস্তিতে চোখ বুঁজে নেয়।

চলবে…