হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-১৭+১৮

0
237

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-১৭+১৮
#Nishi_khatun

এদিকে চেয়ারম্যান বাড়িতে থমথমে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। বদুরুদ্দিন সাহেব আজ রাতে খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করে বসার ঘরে সবাইকে ডেকে পাঠান।

কিছু সময়পর সেখানে সবাই উপস্থিত হয়। তখন বদুরুদ্দিন সাহেব তার কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে তাকিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করে- আমি বহুবছর পূর্বে আমার বড় ছেলের জন্য রাইসা কে পছন্দ করে আমার বড় পুত্রবধূ করে এনেছিলাম। আমার বড় ছেলে আর রাইসা মা’র দাম্পত্যজীবন আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালোই যাচ্ছে। সেই হিসাবে আমি আমার কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য একটা ভালো গুণবতী মেয়েকে পছন্দ করেছি। এখন তোমাকে সেই কন্যাকে বিয়ে করতে হবে।”

দাইয়ান এবার খেঁকিয়ে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে,” আমি দিরহাম ভাই না! যে আমার উপর তোমার সিদ্ধান্ত চাঁপিয়ে দিলেই আমি তা মেনে নিতে বাধ্য হবো।”

বদুরুদ্দিন সাহেব বলল- আমি জানিত তুমি আমার বাধ্য সন্তান না। তুমি স্বাধীন চিন্তাধারার একজন সুপুরুষ। জানো আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল কি ছিলো? তোমাকে জোড় করে ব্যারিস্টারি পড়ানো। ওটা পড়াতে যেয়ে আমি আমার নম্র-ভদ্র স্বভাবের ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলেছি। তবে তোমাকে লেখাপড়া করিয়ে কোন ভুল কাজ করি নাই আমি। প্রতিটা বাবা- মা’র স্বপ্ন থাকে তার সন্তানদের নিয়ে। আমারো কিছু স্বপ্ন ছিলো যা তোমার বড় ভাই পূরণের ব্যর্থ হয়েছিল। সেই স্বপ্ন আমি তোমাকে দিয়ে পূরণ করেছি। তাতে একটু স্বার্থপর হয়েছি এতে কি এমন করেছি? রাজনীতি করতে হলে একটু ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হয়। এছাড়া তোমাকে ব্যারিস্টার রুপে দেখার ইচ্ছা ছিলো আমার বাবার।”

দাইয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল- ওটা তোমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। আমি আমার স্বপ্নের গলাটা তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য হত্যা করেছিলাম। তার মানে এই না যে, তোমার কথামত যে কোন মেয়েকে বিবাহ করে সারাজীবনের জন্য আমার ঘাঁড়ে চাপাতে যাব। মেয়েটা আমার কোয়ালিটির নাও হতে পারে বুঝতে পারলে বাবা।”

বদুরুদ্দিন সাহেব আহত কন্ঠে বলে,”বাবা মেয়েটা শিক্ষিত। শহরে থেকে লেখাপড়া করেছে। তাছাড়া অনেক নম্রস্বভাবের। ছোট থেকে মেয়েটা অনেক সাহসী, কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না।”

দাইয়ান এবার কাঠকাঠ গলায় বলল,” আমার পক্ষে কোন মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব না। আমি সারাজীবন সিঙ্গেল থাকতে চাই। তাছাড়া কোন মেয়েকে আমি জীবনেও স্বামীর সুখ দিতে পারবোনা। কারণ আমার জীবনে মনেও কোন নারীর স্থান হবে না।”

বদুরুদ্দিন সাহেব চিৎকার দিয়ে বলে,”এ বিয়ে করতে তুমি বাধ্য। তুমি যদি এই বিয়েটা না করো তাহলে আমি আত্মহত্যা করতে বাধ্যহবো। তুমি যদি তোমার মায়ের বৃদ্ধ বয়সে কান্নার কারণ হতে চাও এতে আমার কোন আপত্তি কেন থাকবে বলো?”

দাইয়ান প্রচুর পরিমাণে রেগে বলে,”তুমি আমাকে বিয়ের জন্য থ্রেড দিচ্ছ? জানো আমার বিয়ে ছাড়া জীবনে অন্যকোন লক্ষ আছে। যা পূরণের জন্য আমি সংসার করতে চাইছি না।”

বদুরুদ্দিন সাহেব বলে,” বিয়ে করে বাড়িতে বউ আনবার পর তোমার যে লক্ষ ইচ্ছা পূরণ করিও সমস্যা হবে না।”

দাইয়ান এবার রেগে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। বদুরুদ্দিন সাহেব জানে আজ সারারাত আর তার ছেলে বাড়িতে আসবে না। দাইয়ান কোথায় যেয়ে বসে থাকবে তা সকলের খুব ভালে করে জানা আছে। তা-ই কেউ তাকে নিয়ে কোনরকম আগ্রহ প্রকাশ না করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেদের রুমের দিকে প্রস্থান করে।
*
*
পরেরদিন শাওন শেখ রিমশা আর ইফা কে সঙ্গে করে শহরে নিয়ে যায়। শহরে এসে বড় একটা সোনার দোকানে তারা প্রবেশ করে। এটা শাওন শেখের পূর্ব পরিচিত একটা দোকান। ছেলের বউয়ের সকল গহনাদি এখানে থেকে তারা বানিয়েছে।

সামনে কন্যার বিবাহ! তা-ই মেয়েকে সাথে করে এনেছে তার পছন্দমত ডিজাইনের গলার হার বানাবে বলে।

এদিকে দোকানি এতোশত হারের ডিজাইন দেখাচ্ছে রিমশা’র কোন কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। তার তো বিয়ে করার কোন ইচ্ছা নেই। শুধুমাত্র বাবা- মা’র খুশির জন্য বিয়েতে রাজি হয়েছে। এখন এসব সোনার গহনা কার জন্য পরবে সে? আসলে আহীদ ছাড়া অন্যকারো জন্য সাজার ইচ্ছা তার মধ্যে জীবিত নেই।

এদিকে ইফার চোখে লোখ চকচক করছে। আল্লাহ এতো কিছু তার মেয়ের জন্য করছে আমার জন্য তারা কিছু করবে না? এতো না কি ভালোবাসে আমাকে? এখানে আসার পর থেকে তার মেয়ের জন্য গহনাগাঁটি দেখছে। কই আমাকে তো কিছু জিজ্ঞাস করছে না? হুহ! এসব কিছু এদের ঢং। লোকদের সামনে বড় বড় বুলি আওড়াতে জানে। কাজের বেলায় ঠংঠং।

শাওন শেখ যখন দেখলেন তার মেয়ের এসব কিছুতে আগ্রহ হচ্ছে না তখন তিনি নিজের পছন্দমত গহনা বানিয়ে দেওয়ার জন্য অর্ডার দিলেন। আর সিম্পল ডিজাইন করা সোনার চেইন ইফার জন্য ক্রয় করে। রিমশা’র হাতে সোনার চেইন টা দিয়ে বলে,”এটা তুমি নিজের হাতে ইফার গলাতে পড়িয়ে দাও। ইফা তোমার ছোট বোনের মত। ইফার বিয়ের সময় আমি মোটা সোনার হার গড়িয়ে দিবো। এখন রিমশা’র বিয়েতে পড়ার জন্য সিম্পল সোনার চেইন উপহার দিলাম।”

রিমশা খুশি মনে ইফার গলাতে সোনার চেইন পড়িয়ে দিলো। ইফার মুখটা হাসিখুশিতে ভরপুর থাকলেও মনে ছিলো বিষ।
“নিজের মেয়ের জন্য কতো দামী জিনিশ কিনেছে আর আমার জন্য এই ফকিন্নি মার্কা চেইন! এটা দিয়েছে বলে এমন ভাব করছে আমার মাথায় চড়ে বসবে। থামো তোমাদের মজা আমি দেখাচ্ছি। ”

এদিকের সকল কেনাকাটার পাঠ চুকিয়ে গ্রামে ফিরতে আসরের আজান দিয়েছে। ইফা তখন আহ্লাদিত কন্ঠে বলল- মামাজান আমি রিমশাপু কে সাথে করে একটু আমার বান্ধবীর বাড়িতে যাব?’

শাওন শেখ বলে,”সারাদিন শহর থেকে সবাই ক্লান্ত। বাড়িতে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে আজ বিশ্রাম নিও। কাল সকালে না হয় তুমি তোমার আপুকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।”

ইফা বলে,”আসলে মামাজান আমার বান্ধবীর বিয়ে হয়েগেছে। কয়েকদিন হলো সে বাবার বাড়িতে এসেছে আজ রাতে-ই হয়তো ফিরে যাবে। আমি তাকে বলেছিলাম সে যাবার আগে আমি তার সাথে দেখা করতে যাবো। কিন্তু কাল সকালে তার বাবা- মা’র সাথে দেখা করে আমি কি করবো?”

রিমশা তখন তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আচ্ছা বাবা আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না। মেয়েটা যখন যেতে চাইছে তখন আমি না হয় ওর সাথে ঘুরে আসি। নয়তো মেয়েটার মন খারাপ হবে।”

শাওন শেখ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আচ্ছা যেতে চাইছো যাও। তবে সন্ধ্যা লাগার আগে ফিরে এসো কিন্তু। ”

অনুমিত দেওয়ার সাথে সাথে ইফা রিমশা’র হাত ধরে গ্রামের উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। শাওন শেখ প্রচুর ক্লান্ত ছিলো বিধায় তাদের যাওয়া পথে দৃষ্টিপাত করতে ভুলে গেছে।

রিমশা গ্রামের কোন রাস্তা ঠিকমতো চেনে না। তা-ই ইফা তাকে যে পথ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে পথ দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। গ্রামের পথ ছেড়ে লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে তারা চলে এসেছে। হঠাৎ করে রিমশা ইফাকে প্রশ্ন করে,”এই ইফা আর কতদূরে তোমার বান্ধবীর বাড়ি?”

ইফা বিরক্তির সাথে বলে,”এই জনশূন্য মাঠঘাট পেরিয়ে আর কিছুটা দূরে গেলেই আরেকটা গ্রাম। সে গ্রামের প্রথম বাড়ি তাদের।”

রিমশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”ওহ আচ্ছা! তাদের বাড়িতে যেতেই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। বাড়িতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে তো?”

ইফা বলে,”রাত হবে না। বেশি কথা না বলে তুমি দ্রুত পা চালিত করো।”

রিমশা বাধ্য মেয়ের মতো ইফার পেছনের ছুটতে থাকে। তাদের পথ চলতে চলতে মাঠের মধ্যে সন্ধ্যা হয়েগেছে। এদিকে রিমশা তার মোবাইল ফোনটা শপিং ব্যাগে রেখেছিল যা বাবা বাড়িতে নিয়ে গেছে। এই অন্ধকার পথে সে কীভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হবে?

হঠাৎ করে ইফা রিমশা’র হাত ধরে বলে,”আমার সাথে চলো তাহলে সমস্যা হবে না। আমার অন্ধকারে পথচলার অভ্যাস আছে।”

রিমশা কিছু বলবে তার পূর্বে দেখে কিছুটা দূরে হয়তো ওটা বাড়ি। সে বাড়িতে আলো জ্বলছে। ইফা আলোটা কে উদ্দেশ্য করে বলে,” ঐ যে ঘরে আলো জ্বলছে ওটা আমার বান্ধবীদের বাড়ি বুঝলে।”

বাড়ির কিছুটা কাছে এসে ইফা রিমশা কে বলে,”আপু তুমি বাড়ির ভেতরে যাও আমি তোমার পেছনে পেছনে আসছি। আসলে আমি একটু বাথরুমে যাবো। তাছাড়া তুমি তো জানো গ্রামের টয়লেট গুলো বাড়ি থেকে দূরে হয়। তুমি যাও আমি ওদের টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

রিমশা সরল মনে আলোয় উজ্জ্বল ঘরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায়। দরজা খোলার সাথে সাথে রুমের আলোটা নিভে গেলো। অন্ধকারে ভেতরে অগ্রসর হতে যেয়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে রিমশা ঘরের ভেতরে পড়ে যায়।

হুট করে ভেতর থেকে কেউ দরজা বন্ধ করে দিলো।
দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনে রিমশা’র কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে।

রুমের আলো জ্বলতেই রিমশা তার সামনে যা দেখলো তাতে তার চোখ কোঠর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-১৮
#Nishi_khatun

আমার সামনে কয়েকটা অপরিচিত ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের মুখটা কালো কাপড়ে ঢেকে রাখা। শুধু মাত্র তাদের চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। আমি তাদের এভাবে দেখে একটু ভয় পেয়েছি।

আমি মনে মনে ভাবছি,” আজকে ইফাকে বিশ্বাস করে এমন পরিস্থিতিতেপড়বো কখনো কল্পনা করি নাই। তবে এখন আফসোস হচ্ছে! তখন কেনো যে বাবার কথায় সম্মতি জানায়নি। এখন এতো গুলো পুরুষেরা কি আমাকে ছেড়ে দিবে? উঁহু কখনোই না! এরা আমাকে খুবলে খাবে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে খারাপ কোন কাজ হয়।
আল্লাহ আজ বুঝি আমার মানসম্মানের শেষ রক্ষা হবে না।”

তখন আমার সামনে উপস্থিত থাকা ছেলেদের মধ্যে একজন কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,

-“এই মেয়ে কে তুমি? আর এখানে কার সাথে এসেছো? ”

রিমশা কান্না মাখা কন্ঠে বলে,
-“আমি রিমশা! ইফার সাথে ওর বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। তবে সে আমাকে ভেতরে আসতে বলে বাড়ির অনেকটা দূরে অবস্থান করে। কিন্তু আমি ভেতরে প্রবেশ করে বুঝতে পারছি আমি খুব বড় ভুল করেছি।”

তখন ঐপাশের রুম থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলল- আমি আগেই বলেছিলাম ঐ ইফা চালাক মেয়ে। ডায়নী সহজে অন্যের জালে আটকা পড়বে না। তবে অন্যদের ঠিকি তার পাতা ফাঁদে আটক করতে জানে। ”

ঐ লোকটাকে আশ্বস্ত করতে আরেকজন নমনী কন্ঠে বলে,

“চিন্তা করতে হবে না। আজ না হয় কাল ইফা কে একদিন ওর মরণ ফাঁদে আটকা পড়তেই হবে। আমি দরকার হলে ওর জন্য মরণফাঁদ তৈরি করবো।”

তখন প্রথম ব্যক্তি বলে,
“ইফা যে আমাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে ঐ মেয়েটাকে পাঠিয়ে তার কি হবে?”

দ্বিতীয় জন বলল-,” তোমাদের খবর কেউ জানে না আমি ব্যতীত। এখানে মাঝেমধ্যে আমার আসা হয়। তা-ই তোমরা সবাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করো। আমি দেখছি ঐ মেয়েটার সাথে কি করা যায়।”

প্রথম ব্যক্তি বলে,” যা ইচ্ছা হয় করো! তবে খারাপ কিছু করবে না। কারণ আমরা এখানে খারাপ উদ্দেশ্যে কেউ একত্রিত হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য সৎ এবং সঠিক।”

তখন আমার সামনে থাকা একটা ছেলে বলে ওঠে,”আরে ভাই এই মেয়েটাকে আগে কখনো গ্রামে দেখি নাই। তবে কিছুদিন যাবৎ মেয়েটাকে শাওন শেখের বাড়িতে দেখা যাচ্ছে। ”

রিমশা নিজ থেকে বলে ওঠে,”আমি শাওন শেখের কন্যা।”

তখন ছেলেটার পেছনে থেকে একজন মহিলা বলে,
“ওহ তুমি সেই মেয়ে যে রতন স্যারের মাথা ফাঁটিয়ে গ্রাম ছাড়া হয়েছিলে?”

রিমশা প্রতিবাদী কন্ঠো বলে,” আমি একজন দুশ্চরিত্র লোককে তার পাপের শাস্তি দিয়েছিলাম। যদি যে ভালো চরিত্রের লোক হতো তাহলে কখনোই তাকে আঘাত করার দরকার হতো না। তাছাড়া প্রতিটা নারীর কাছে তার সম্মান খুব মূল্যবান। আর আমি কেনো এই মূল্যবান সম্পদ ঐ লম্পট লোকের কাছে বিষর্জন দিতাম? আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কোন ভুল কিছু করি নাই। যতবার দরকার হবে আমি ততবার নিজের সম্মান বাঁচাতে লড়াই করবো।”

মেয়েটা বলে,”আজকে এরা যদি তোমার সাথে খারাপ কিছু করে তখন তুমি কি করবে? ”

রিমশা বলে,”নিজের সর্বচ্চ শক্তি দিয়ে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করবো। তবুও ওদের সামনে সহজেই মাথা নত করবো না।”

তখন পাশের রুম থেকে দুজন পুরুষ বেড়িয়ে এসে বলল-, “সবাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করো। ঐ ইফাকে বিশ্বাস নেই।”

মহিলা বলে ওঠে,”এই মেয়ের কি হবে?”

রিমশা’র দিকে না তাকিয়ে বাহিরে বেড়িয়ে যাবার সময় বলে,

“এই মেয়ের চিন্তা তোমাদের না করলেও চলবে। আশাকরি মেয়েটা আমাদের জন্য সমস্যা হবে না। তবুও বাকিটা না হয় সে এসে সমাধান করবে।”

এরপর সবাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। আমাকে রুমের ভেতরে রেখে বাহিরে থেকে লক করে তারা চলে যায়। আমি অনেকটা সময় ধরে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি শুরু করি তবে সাহায্যের জন্য আশেপাশে কেউ এগিয়ে সে না।

এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর কেউ একজন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে জোড়ে চিৎকার করে বললাম -,”আমার সাথে খারাপ কিছু করার চিন্তা যদি করেন তাহলে ভালো হবে না। ভালোই ভালোই আমাকে এখানে থেকে যেতে দিন বলছি।”

-আপনার হাতে পায়ে কেউ শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে? তাহলে এইভাবে কথা বলার মানেটা কি?

এই শীতল কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই আমি তার দিকে ফিরতেই চমকে উঠি। আমার অতি পরিচিত আপন মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে। এটা কী আমার দেখার ভুল? না কি বিপদে পড়েছি বলেই তাকে কল্পনা করছি? আমি কোন কিছু বলার পূর্বে সামনের ব্যক্তি বলল- “রিমশা তুমি এখানে আসলে কি করে?”

আমি আর কোন কথা না বলে সোজা তার বুকের উপর কিল দিতে শুরু করি। তারপর বলি,’ আপনি না মারা গেছেন?
তাহলে এখানে জীবন্ত আমার সামনে কীভাবে?’

আহীদ আমার হাত দুটো তার বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল- “আমি মারা গেছি একথা কে বলেছে? এই জলজ্যান্ত মানুষটা কে মৃত বানিয়ে দিলে? ”

রিমশা বলে,”আমি নিজের কানে শুনেছি! মামা বলেছে পাশের বাড়ির ছেলেটা মারা গেছে। এরপরে মামা আমাকে একা যাতায়াত করতেও বলেছেন।”

আহীদ বলে,”আমি কি কোনদিন বলেছি ঐ বাড়ির ছেলে আমি? ঐ বাড়িটা আমার বন্ধুর বাড়ি ছিলো। দুজনে একসাথে লেখাপড়া করতাম। আমি ব্যারিস্টারি পড়ছিলাম আর ও ইঞ্জিনিয়ারিং। দুজনের যাত্রা পথও আলাদা হয়ে যায়। তবুও ওর পরিবার আমাকে ভালোবেসে তাদের বাড়ির ঐ রুমটা আমার জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছিল। তবে তুমি যেদিন চলে যাও সেদিন রাতে আমার বন্ধু এক্সিডেন্টে মারা যায়। ওহ মারা যাবার পর আর আমার পক্ষে ওর বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না।
আমি একটা ভালো কোর্টে জবের পাশাপাশি প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়ে যাই। তাই দ্রুত সেখানে সেটেল হই। এরপর তোমার সাথে যোগাযোগ করার বহুত চেষ্টা করেছি। ”

রিমশা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে,”আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছিলো। তা-ই ভাইয়া নতুন ফোন আর সিম কিনে দিয়েছিল। আপনি মারা গেছেন দেখে আপনার নাম্বারে কখনো ট্রাই করি নাই।”

আহীদ বলে,”খুব ভালো কাজ করেছ। আমি তো মারা গেছি, এখন আমার আত্মা তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ”

রিমশা আহীদ কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে,
“আমি দুঃখীত। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এখন আর আপনাকে ছাড়া কোথাও যেতে চাই না।”

আহীদ হঠাৎ করে বলে,”তা তুমি এখানে আসলে কি করে?”

রিমশা তখন ইফার সাথে এখানে আসার পুরো কাহিনী ক্লিয়ার করে বলে। তারপর এখানে যারা ছিলো তাদের কথাও বলে।

রিমশা’র কথা শোনার পর আহীদ বলে,”এখানে থাকা যাবে না সমস্যা হতে পারে। চলো তোমাকে তোমার বাড়িরে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

রিমশা বাচ্চাদের মতো জিদ করে আহীদ কে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না।”

আহীদ বলে,”যেতে কে বলছে? তুমি তোমার বাড়িতে যাবে। নয়তো খুব বড় বিপদে পড়তে পারি আমরা।”

ঠিক সে সময় সেখানে গ্রামের অনেক লোকজন এসে উপস্থিত হয়। তারা রিমশা কে পরপুরুষের এতোটা কাছে দেখে নানারকম খারাপ মন্তব্য করতে শুরু করে।

এতো মানুষকে হঠাৎ করে দেখে ভয়ে লজ্জায় আহীদের পেছনে লুকিয়ে পড়ে।

এতো মানুষকে এভাবে এখানে একসাথে দেখে বুঝতে পারে আজ কপালে খুব খারাপ কিছু আছে। তাদের এখন যা বোঝাতে যাব তার বিপরীত কিছু বুঝবে সবাই।”

সেখানে উপস্থিত কিছু লোকজন বলে ওঠে,”ছিঃ ছিঃ ছিঃ চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের চরিত্র এতো খারাপ আগে জানা ছিলো না। গ্রাম থেকে দূরে নির্জন স্থানে এমন ঘরে তৈরি
করেছিল। এসব আকাম কুকাজ করার জন্য।
আমরা ভাবতাম ছেলেটা বুঝি আমাদের ভালোর জন্য এখানে আসতো। এখন দেখছি না নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাতে এখানে আসতো। তোমার থেকে আমরা কেউ এমন কিছু কোনদিন আশা করি নাই।”

একজন বয়স্ক ব্যক্তি বলে,”এতোই যখন মেয়ে মানুষের দরকার পড়ে তোমার। তাহলে বিয়েটা কেন করো না?'”

আরেকজন কটূক্তির সাথে বলে,”আরে বড়লোকি বেপার বোঝনা? বিয়ে শাদী করলে কি রোজ রোজ এমন নতুন
পাখির দেখা পাবে?”

এভাবে বেশ কিছু সময় ধরে মানুষের বাজে মন্তব্য তারা দু জনে শুনছিল। এদের সামনে প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না।

কিছু সময় পর সেখানে মেম্বার কাজী সাহেব কে সাথে নিয়ে আসে। আসার পর বলে,”এতো রাতে এখানে বিয়েটা কার?”

উপস্থিত সকলে রুমের ভেতরে ইশারা করে। মেম্বার সাহেবের তাদের দেখে চিন্তিত কন্ঠে বলে,”আরে এতো আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে দাইয়ান। দাইয়ান বাবা তুমি এমন অপকর্ম করতে যেয়ে হাতে নাতে ধরা পড়বে তা কখনোই ভাবতে পারি নাই।”

মেম্বর সাহেব দ্রুত চেয়ারম্যান সাহবের সাথে যোগাযোগ করে তাকে সবকিছু বলে।

এর কিছুসময় পর চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার বড় ছেলে দিরহাম সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তখন দাইয়ানের পাশে মাথা নিচু করে রিমশা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি চমকে ওঠেন।

চেয়ারম্যান সাহেব একটু নিরব থেকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আপনাদের সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে ঐ মেয়েটার সাথে আমার ছেলের বিয়ে বহুপূর্বে ঠিকঠাক।
হয়তো কিছুদিন পর আপনাদের সবাইকে জানিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করতাম। যেহেতু আপনারা সকলে না জেনে বুঝে একটা খারাপ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। সেই জন্য আমার ছেলের কিছুদিন পর হওয়া বিয়েটা আজকে সম্পন্ন করে দিচ্ছি। ”

এরপর রিমশা আর দাইয়ানের বিবাহের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। তবে বিয়েটা দাইয়ান করতে নারাজ ছিলো। তার বাবা একপ্রকার মানসম্মানের দোহাই দিয়ে বিয়ে করতে রাজী করে।



চলবে…..