যদি তুমি জানতে পর্ব-২৮+২৯

0
356

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_28
লম্বা ঘুম শেষে বিকালের দিকে কে উঠে তুরান । এক ঘুমে যেন সকল ক্লান্তি- বিষাদ দূর হয়ে গেছে। ঘুম ঘুম চোখে দরজা, জানালা গুলো খুলে তুরান। জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো আশেপাশে রুপা আছে কিনা! রুপার সকালের ব্যবহারে খুব বেশি রাগ হয়েছে তুরানের। আবার মিথ্যা বলে ডিপ্রেশনে রেখেছে। মেয়ে টার বুদ্ধি বোধ হয় হাঁটুর নিচে। মিনিমাম সেন্স নেই, একটা মানুষ যে চিন্তায় মরে যাচ্ছে আর সে মিথ্যা বলে ব্লাকমেইল করছে। তুরান গোসল সেরে সকালের অবশিষ্ট নাস্তা খেয়ে নিলো! ওয়াক্ত মতো রান্না করাও হয়ে উঠে না তুরানের! ব্যাচেলর লাইফ কোন রকম খেয়ে পেট ঠান্ডা রাখতে পারলেই এনাফ। রুপা বোধ হয় অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। থাকুক দাঁড়িয়ে! খানিকটা চাপা অভিমান জমে তুরানের মনে।
রুপার তুরানের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এমন কেন তুরান? রুপার রাগ ভাঙালোই না উল্টো নিজেই এখন ভাব ধরে বসে ছিলো। রুপা মনে মনে ভেবে নিয়েছিলো অনেক দিন কথা বলবে না তুরানের সাথে কিন্তু রুপা কেন জানি কথা না বলে পারছে না। আগে কখনো এমন হয়নি রুপার। রুপা রাগ যত ইচ্ছা তত করবে তাই বলে তুরান রাগ ভাঙাবে না? এমন আচরণ করবে? ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে রুপার। সব মেয়েরাই বোধ হয় চায়, তাঁর ভালোবাসার মানুষটা ধৈর্য সহকারে রাগ ভাঙাক।
রুপার তুরানের সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। রুপা তুরানের রুমের কাছে গেলো। রুমের দরজায় বাইরে থেকে ছিটকানি লাগানো। এর মানে তুরান কোথায়ও গেছে। কোথায় গেছে ছাদে নাকি অন্য কোথায়ও? বিকাল টাইমটা তুরান বেশিরভাগ ছাদেই থাকে। রুপা ছাদে গিয়ে দেখে ছাদের এক কোনায় চেয়ারে বসে বই পড়ছে তুরান। চোখে সেই মোটা ফ্রেমের চশমাটা। কেমন হাবা হাবা‌ দেখাচ্ছে তুরান কে। রুপা তুরানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটু কেশে শব্দ করলো। তুরান মনোযোগ সহকারে বইয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে। রুপা এবার গিয়ে তুরানের চেয়ারের পাশে দাঁড়ালো। তুরান বই থেকে মুখ না তুলেই বললো,
-‘ পড়ছি ডিস্টার্ব করো না। কিছু বলার থাকলে বলে চলে যাও।’
খানিকটা অভিমান দোল খায় রুপার মনে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
-‘ আমি আপনায় ডিস্টার্ব করি?’
উত্তর দেয় না তুরান। তুরানের এমন আচরণে অবাক না হয়ে পারে না রুপা। রুপা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ‌। কোন কথা বলছে না। তুরান অনেকক্ষণ পরে বললো,
-‘ আমার আচরনে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
তুরান একটু থেমে আবার বলে,
-‘ যে মানুষের বিন্দু মাত্র রেসপনসিবিলিটি নেই তাঁর সাথে এর থেকে ভালো ব্যবহার করতে পারি না আমি। মিথ্যা বলার একটা সীমা আছে রুপা। আচ্ছা মানলাম আমার ভুল হয়েছে। আমি তোমার রাগ ভাঙিয়ে নিতাম। তুমি কি আচরণ টা করলে ? এমন সব মিথ্যা বললে আমার পাগল হওয়ার অবস্থা। একটুর জন্য ধরা খায়নি। সামান্য একটা বিষয় তুমি টেনেটুনে কত বড় করেছো বুঝতে পারছো?‌‌‌‌আরে মেয়েটা আমার ফ্রেন্ড, আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসছে। এটা যাস্ট একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাটার।’
এই টুকু বলে রুপার দিকে তাকায় তুরান।টপটপ করে জল গড়াচ্ছে রুপার চোখ থেকে।
রুপা কান্না চেপে বললো,
-‘ আমার তো কোন ফ্রেন্ড-ট্রেন্ড নেই। আর আমি তো আর লেখাপড়াও করি নি। তাই ওসব ম্যাটারও বুঝি না। মেয়েটা কে চড় দিয়েছে বলে আপনার লেগেছে খুব সেটা ডিরেক্টলি বললেই পারেন এত ভনিতার দরকার নেই।’
তুরান‌ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে রুপার দিকে তাকায়। চেয়ার থেকে উঠে রুপার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
-‘ এসব চিন্তা ভাবনা কোথায় পেয়েছো? ওই মেয়ের জন্য আমার লাগবে তাই না?’
তুরানের কথা না শুনেই চলে যায় রুপা। তুরানও আটকায় নি রুপা কে। রুপা চলে যাওয়ার পর ঠাস করে চেয়ারে বসে পড়ে তুরান। নিজের মাথার উপর বারি দিতে ইচ্ছে করছে তুরানের। রুপা কে এমন কঠিন কথা শুনানোর কি দরকার ছিলো? ও তো এমনই,সব কিছু উল্টো বুঝবে। বিষয়টা এ পর্যন্তই তো শেষ হয়ে যেত আবার রাগ শুরু হয়েছে। তুরান হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইল। রুপার রাগ যত দ্রুত সম্ভব ভাঙানো দরকার।
তুরান ছাদে বসে রইলো। বিকেল পেরিয়ে গোধূলি লগ্ন, সূর্য টা অস্ত যাচ্ছে । রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে পুরোটা। তুরান উদাস মনে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। সারা সন্ধ্যায় রুপা কে একবারও দেখেনি তুরান। খুব বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে কি? এই রাগ ভাঙাতে ছোট খাটো ঘূর্ণিঝড়ও হয়ে যেতে পারে।
রুপা যদি রাতে ছাদে আসে তাহলে রাগটা ভাঙানো যাবে। যার সাথে কথা না বলে থাকা যায় না তাঁর সকল রাগ , অভিমান মেনে নেওয়াই বোধ হয় শ্রেয়। তুরান ছোট একটা কাগজের টুকরায় রুপা কে ছাদে আসার জন্য লিখলো। রুপার রুমের জানালার ফাঁক দিয়ে কাগজ টা ছুঁড়ে মারে। রুপাকে কাগজ টা হাতে নিতে দেখে ঠোঁটের কোনে চিলতে হাসি ফুটে তুরানের। সেদিনের পর থেকে রুপার রুমের কাছে যেতে ভয় লাগে তুরানের। তুরানের শঙ্কা কাজ করছে রুপা আসবে তো?
তুরান টাইমও বলে দিয়েছে। তুরান ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করলো, রুপা আসলো না।তুরান ছাদে থেকে নেমে রুপার রুমের দিকে উঁকি দেয়। জানালাও বন্ধ,লাইট অফ। তার মানে ঘুমিয়ে পড়েছে রুপা , আসবে না ছাদে।
তুরান এক রাশ হতাশা নিয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো। কালকে দিনে যে করেই হোক রুপার রাগ ভাঙাতেই হবে।
সকাল বেলা ঘুম এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। মাঝে মাঝে রুপা এসে সকালে ঘুম ভাঙাতো তুরানের। খুব মিস করছে রুপা কে । তুরান ফ্রেশ হয়ে খেয়ে টিউশনির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয় । বাসায় ফেরার সময় রুপার পছন্দের সব কিছু নিয়ে আসবে, তাহলে রুপা আর রাগ করে থাকতে পারবে না। তুরান মনে মনে ভাবলো আজও ভার্সিটি তে যাবে না। কারন টিউশনি করিয়ে বাসায় এসে দেখবে সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী কেউই বাসায় নেই। এটাই রুপার রাগ ভাঙানোর সুযোগ।
তুরান টিউশনি শেষে রুপার জন্য দুই মুঠো চুড়ি কিনলো, রুপার পছন্দের ফ্লেভারের আইসক্রিম আর কতগুলো কদম আর রজনীগন্ধা ফুল নিলো।
রুপা এবার আর রাগ করে থাকতে পারবে না। এগুলো দেখে রুপার রিয়্যাক্ট কেমন হবে তা নিয়ে ভাবছে আর মিটিমিটি হাসছে তুরান। তুরান বাসায় এসে দেখলো আজিজ চৌধুরী বাসার মেইন ডোরে বড়োসড়ো একটা তালা ঝুলানো। এর মানে বাসায় কেউ নেই।‌‌‌‌আর রুপা কে তো বাসার ভিতরে বন্দি করে রেখেছে যাবে না । তুরান পুনরায় হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাসার আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলো বাসায় কেউ আছে কিনা। কেউ নেই বাসায়।
তুরানের এখন কি যে ইচ্ছা করছে নিজেও জানে না। পাশের ফ্ল্যাটের কারো কাছে জিজ্ঞেস করে জানা যাবে। কোথায় যেতে পারে রুপা? তুরান হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলো।
পাশের ফ্ল্যাটের ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলো রুপা সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর সাথে কক্সবাজার গেছে। তুরানের মাথায় যেন বাজ পড়লো। কক্সবাজার কি ঘুরতে গেছে উনারা? তুরান ফ্লোর ঘেঁষে বসে পড়লো।
এমন কেন রুপা টা? একবার বললো না! ও কি বুঝে না ওর জন্য কারো খুব বেশি টেনশন হয়। কবে ফিরবে রুপা? অনিশ্চিয়তার হতাশ হয়ে যাচ্ছে রুপা।
চলবে…

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_29

দুই দিন পর কক্সবাজার থেকে ফিরলো রুপা’রা। এই দুই দিনে তুরানের পাগল প্রায় অবস্থা। তুরান না গেছে ভার্সিটি তে,না টিউশনি তে। রুপাকে ছাড়া সব কিছু বিষাদ লাগে তুরানের। রুপা কক্সবাজার থেকে ফিরে এসেই সোজা চলে গেলো তুরানের রুমে। তুরান একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে । রুপার উপস্থিতি টের পেয়েও না এমন ভাবে বসে আছে যেন কেউ আসে নি রুমে। তুরানের চেহারায় রাগের ছাপ। রুপা নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও পারছে না। রুপা আস্তে আস্তে খাটের এক কোনায় বসলো। সাহেলা বেগমের হঠাৎ জরুরি কাজ পড়লো কক্সবাজারে,সে জন্য আজিজ চৌধুরীও গেলো। রুপা কে তো আর একা বাসায় রেখে যাওয়া যায় না!
-‘ বিশ্বাস করুন আপনার সাথে রাগ করে যাই নি আমি। আম্মু-আব্বু দুই জনই যাবে তাই আমায়ও নিয়ে গেছে। আমি কেঁদেছি খুব, তাও জোর করে নিয়ে গেলো। আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট পাবেন।’
এই পর্যায়ে তুরান রুপার দিকে অগ্নিবর্ন দৃষ্টিতে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-‘ এত কৈফিয়ত আমি কারো কাছে শুনতে চাই নি। ভালোয় ভালোয় রুম থেকে বের হয়ে যাও।’
রুপার মন অভিমানে ছেয়ে যায়। ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। তুরান রুপার দিকে তাকাচ্ছেই না। অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রুপা। চাপা স্বরে বলল,
-‘ সরি আমি। বিশ্বাস করুন কিছু করার ছিলো না আমি।’
এই টুকু বলে আচমকা তুরানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো রুপা। রুপার চোখে আষাঢ় ধারা নামতে থাকলো। প্রিয় মানুষের ছোঁয়ার রাগ মোমের মত গলে যায়, আরও যদি হয় কান্না মিশ্রিত ছোঁয়া। রুপা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তুরান কে জড়িয়ে ধরলো। তুরানের ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে নিলো। তুরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষ টার ছোঁয়ার কি যে অদ্ভুত শিহরণ! অব্যক্ত অনুভূতি! তুরানও আলতো করে চুমু খায় রুপার ঠোঁটে। রুপা মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো। অনেকক্ষণ পরে তুরান বললো,
-‘ পাগলি ছাড়ো! দরজা খোলা কেউ আসতে পারে।’
রুপা দ্রুত তুরানের বুক থেকে সরে গিয়ে দূরত্ব রেখে বসলো। রুপা লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। তুরান মুখ টিপে হাসছে। দুই দিনের কষ্ট,রাগ কয়েক মুহূর্তেই শেষ।
-‘ আচ্ছা তুমি একটা বার ও ভাবলে না কিভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া?’
-‘ আমার তো কিছু করার ছিলো না।’
তুরান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুপার শরীর ঘেঁষে বসে বললো,
-‘ তাঁরা যদি আরো কয়েক দিন থাকতো কক্সবাজার? কি অবস্থা হতো আমার?’
-‘ আমার বুঝি কষ্ট হয় নি?’
তুরান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘ আচ্ছা রুপা তুমি মোবাইল চালাতে পারো না? ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার এসব? মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে তোমার খোঁজ নেওয়ার উপায় ই থাকে না?’
রুপা খানিকটা চমকে গিয়ে বললো,
-‘ না,না আমার মোবাইল চালানো নিষেধ। আম্মু মারবে।’
-‘ মোবাইল চালানো নিষেধ কেন? এই যুগে মানুষ মোবাইল ছাড়া চলে কিভাবে? আর মোবাইল চালালে প্রবলেম কোথায়?
-‘ জানি না ওসব।’
তুরান কথা না বাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে রুপার দিকে তাকিয়ে রইল। দুই দিন পর সেই চেনা মুখ টা দেখলো! মনে হচ্ছে কত শত বছর ধরে দেখে নি। রুপার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে রুপা। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়।
তুরান একটু হেসে বললো,
-‘ মুখটা এদিকে ঘুরালে কেন? দেখি না একটু! দুই দিন ধরে দেখিনি।’
-‘ ইস! এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার লজ্জা লাগে।’
তুরান উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। রুপার আরও কাছে গিয়ে বসে রুপার থুতনি ধরে মুখটা উঁচিয়ে রুপার সৌন্দর্যবর্ধক কুচকুচে কালো তিলটায় চুমো খায়। রুপা চোখ বুজে ফেলে। সময়টা কে থামিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে রুপার । তুরানেয় ছোঁয়ার এত শান্তি কেন।
হঠাৎ তড়িঘড়ি ভাব নিয়ে রুপা বললো,
-‘ সেই কখন আসছি আমি! আম্মু চেঁচামেচি করবে । যেতে হবে!’
রুপা এই টুকু বলে তুরানের দিকে তাকায়। তুরানের চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ইস কি হাল হয়েছে চেহারার! মনে হচ্ছে কতদিন খাননি। গোসল সেরে বেশি করে খেয়ে সুন্দর একটা লুক নিয়ে বিকালে ছাদে আসবেন বুঝলেন?’
-‘ তুমি ছাড়া চেহারার হাল এর থেকে ভালো কিভাবে থাকবে বলো তো?’
-‘ হয়েছে হয়েছে ঢং।’
-‘ কোনটা ঢং কোনটা ভালোবাসা তাও বুঝো না দেখি?’
রুপা হেসে বলে ,
-‘ বুঝি তো! আমার শোকে দেবদাস সাজা হয়েছিল।’
তুরানও হেসে দেয়।
রুপা রুম থেকে চলে গেলো। তুরান মনে শান্তি ফিরে পেলো। রুপা কে ছাড়া থাকতে এতটা কষ্ট হবে তুরান বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষ টার জন্য ভালোবাসা কিংবা মানুষ টার গুরুত্ব বুঝার জন্য হলেও এরকম দূরত্ব তৈরি হওয়া উচিত।
তুরান গোসল সেরে আসলো। এই দুই দিনে কেমন যেন নির্জীব হয়ে গিয়েছিল তুরান। তুরানের খুব ইচ্ছা করলো রুপার হাতে খেতে। তুরান রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি আর চিকেন রোস্ট নিয়ে এলো। রুপার হাতে খেলে মনে হয় সব কিছুর স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ইদানিং রান্না করতে ইচ্ছে করছে না তুরানের। বেশির ভাগ সময়ই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনে খায়।
খাবার নিয়ে এসে রুপার জন্য অপেক্ষা করছে তুরান। রুপা কে রুমের বাইরে দেখছেই না। সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী বাসায় তাই কোন রকম রিস্ক না নেওয়াই ভালো। কিন্তু রুপার হাতের মাখানো খাবার খাওয়ার ইচ্ছা দমাতে পারছে না তুরান। রুপার রুমের দিকে যেতেই দেখে বারান্দায় আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগম বসা। তু্রান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কেন জানি তুরানের মনে হলো সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী তুরান কে লক্ষ্য করছে। তাই তুরান স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলেও অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আজিজ চৌধুরী হাত ইশারায় তুরান কে ডাক দেয়। তুরানের কলিজা কেঁপে উঠে। নিজের এমন ভয় পাওয়া নিয়ে নিজেই বিরক্ত হচ্ছে , এদিকে আসার মানে কি শুধু রুপার রুমের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারা? কত কাজই তো থাকতে পারে। তাই তুরান সাহস জুগিয়ে সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর কাছে গেলো । তুরান কে চেয়ার টেনে বসতে বললো সাহেলা বেগম। তুরানও তাই করলো।
-‘ তা তুরান তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে? ফাইনাল এক্সাম কবে?’
তুরান হাসার চেষ্টা করে বললো,
-‘এই তো আংকেল ভালোই।কয়েক মাস পরে ফাইনাল এক্সাম।’
তুরান একটু থেমে আবার বললো,
-‘ আপনাদের যে কয়েকদিন ধরে দেখিনি। কোথায়ও গিয়েছিলেন নাকি?’
সাহেলা বেগম হেসে বললো,
-‘ কক্সবাজার গিয়েছিলাম। হুট করে একটা কাজ পড়লো। আচ্ছা তুমি নিজে রান্না করেই খাও তাই না?’
সাহেলা বেগমের হেসে কথা বলার ধরনটা ভালোলাগে তুরানের। মানুষ টা অমায়িক! আজিজ চৌধুরী হেসে বললো,
-‘ ব্যাচেলর মানুষ নিজে রান্না করে খাওয়া ছাড়া উপায় কি? আমি ছাত্র জীবনে একটানা কয়েক বছর রান্না করে খেয়েছি।’
আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগম গল্প জুড়ে দিলো। তুরান নিজের অনিচ্ছাকৃত ভাবেও গল্পের প্রধান চরিত্রের ভূমিকা রাখছে। তুরানের পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু কি আর করার?
আজিজ চৌধুরী তুরান কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর দেশে চাকরি করবা নাকি দেশের বাইরে চলে যাবে?’
-‘ যদি সুযোগ হয় দেশের বাইরে যাবো।’
-‘ চেষ্টা করো সুযোগ অবশ্যই হবে। তাছাড়া আর কতো ব্যাচেলর থাকবে? লেখাপড়া প্রায় কমপ্লিট বিয়ে করে নেও। অন্তত রান্না-বান্নার জামেলা থেকে বেঁচে যাবে।’
আড্ডার ভাবমূর্তির রক্ষা করতে ফিকে হাসলো তুরান। সাহেলা বেগম বললো,
-‘ দুপুরে খেয়েছো তো? মাঝে মাঝে রান্না করতে ইচ্ছে না করলে আমাদের বাসায় খেয়ে যাবে বুঝলে?’
-‘ না আন্টি খাই নি , রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনেছি খাবো এখন।’
-‘ সেকি এখনো খাও নি? আমাদের বাসায় খাবে চলো।’
-‘ না,না আন্টি অন্যদিন।’
তুরান এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলো। তাড়াতাড়ি রুমে চলে যায় । রুপা বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। রুপার হাতে খাওয়া হলো না আর আজ। সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর আজাইরা বকবক শুনে তুরানের পেটের ক্ষুধা যেন আরো বেড়ে গেছে। রুপা টা এত বেখেয়ালি কেন তুরান ভেবে পায় না। চোখের সামনে থাকতে পারে না সব সময়? রুমের ভিতর একদম ঘাপটি মেরে থাকে। তুরান খেয়ে নেয়। বিকাল ছাড়া আর রুপার দেখা পাওয়া যাবে না। আর সে পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে ক্ষুধায় মরেই যাবে। তুরান খাওয়া শেষে বই নিয়ে বসলো। অনেকদিন ধরে পড়া হয় না। লেখাপড়া ইদানিং হচ্ছেই না তুরানের। এমন চলতে থাকলে পরীক্ষায় ফেল নিশ্চিত। তুরান কিছুক্ষণ পড়ে, বাজার করতে রওয়ানা হয়।
প্রায় সব বাজারই ফুরায় গেছে। হাতে তেমন টাকা-পয়সাও নেই । এই মাস এভাবে কষ্ট করে টেনেটুনে চলতে হবে। রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কারণে খাবার জন্য যে বাজেট নির্ধারণ করা তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। এভাবে আর খাওয়া যাবে না । বাসায়ই রান্না করে খেতে হবে।
তুরান বাজার করা শেষে রুপার জন্য একটা গোলাপ ফুল কিনে নেয়। ফুল টার দাম পাঁচ- দশ টাকার বেশি না। কিন্তু রুপা অল্পতেই খুশি হয়। রুপা কে পায়ের নুপুর বানিয়ে দেওয়ার পর যেমন খুশি হয়েছে, দশ টাকার ফুল দেওয়ারও একই রকম খুশি হয়েছিল।
যে মানুষ গুলো অল্পতে খুশি হতে পারে তাঁদের জীবনে হতাশা , কষ্ট কম।
চলবে…