যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (১০)
~মিহি
১০.
‘বাহ!আমার রিলেশনের খবর ঠিকই ম্যামের কানে তুললি আর মাহিদ স্যার আর সন্ধির মধ্যে কী চলে সেটা বলবিনা নেহা ম্যামকে?’ তূর্ণার কথায় আঁতকে উঠে সন্ধি। এমনিতেই নেহা ম্যাম মাহিদ স্যারকে পছন্দ করে তার উপর তার সামনে এমন একটা কথা বলে ফেলল মেয়েটা! না জানি এখন কোন শাস্তি পেতে হবে সন্ধিকে। ম্যামের হাতে থাকা শক্ত বেতটা এই বুঝি তার হাতটাতে ক্ষত সৃষ্টি করতে উদ্যত হবে। নেহা ম্যামের রাগান্বিত চেহারাটা দেখে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে লাগলো সন্ধি, ‘মাহিদ স্যার, কেন আমাকে একা রেখে চলে গেলেন? আপনার পিচ্চিটা যে মহাসঙ্কটে পড়লো।’
মাহিদ ঢাকা গেছে গতকাল আর আজই এ বিপদ এসে সন্ধির ঘাড়ে জুটলো। নেহা ম্যামকে কেউ তূর্ণার রিলেশনের ব্যাপারে জানিয়েছে। ম্যাম তাকে টি.সি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন। এতেই তূর্ণা রেগে মাহিদ আর সন্ধির কথাটাও বলে ফেলে। এখন নেহা ম্যামের অগ্নিদৃষ্টি সন্ধির দিকে। সন্ধিকে বসতে বললেন তিনি। অতঃপর তূর্ণাকে বললেন ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে।
– ‘সন্ধি, তূর্ণা যা বলল তা কি সত্যি?’
– ‘না ম্যাম।’
– ‘আচ্ছা যাও।’
সন্ধি যাওয়ার পর তূর্ণাকে ডাকলেন তিনি। তূর্ণা বিস্তারিত বললো সেযা যা দেখেছে। তূর্ণার কথা শেষ হওয়ার পর তূর্ণাকেও বিদায় করলেন তিনি। নেহার মাথায় অন্যরকম রাগ চেপে বসেছে। ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতিটা সামলাতে হবে। মাহিদকে এসবের কিছুই জানতে দেওয়া যাবে না। দেড় মাস পর যখন সে ফিরবে তখন কেবল নেহাই হবে তার জীবনসঙ্গী, অন্য কারো মোহে মাহিদকে পড়তে দেবে না নেহা।
সন্ধির প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। তূর্ণা তার সাথে এমনটা করবে সে কখনো ভাবেনি। একটা সময়ের বন্ধুত্বের এই প্রতিদানই কী পাওনা ছিল? দিনশেষে এমনভাবে কেন ভেঙে যায় বন্ধুত্বগুলো? বাড়িতে ঢুকেই সোজা বাথরুমে যায় সন্ধি। ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ গলা ছেড়ে কাঁদে। চোখজোড়া ফুলে লাল হয়ে আছে। মা দেখলে দিব্যি সন্দেহ করবে। গলার স্বরও ভারি ভারি হয়ে এসেছে। কোনরকম বাথরুম থেকে বেরোতেই বাবার মুখোমুখি হয় সন্ধি। অবেলায় বাবার উপস্থিতি তাকে আরো ভীত করে তোলে। বাবা আলতো করে সন্ধির মাথায় হাত রাখেন।
– ‘কী রে মা, চোখ লাল কেন?’
– ‘চোখে পোকা গেছিল বাবা। তুমি এ অবেলায়?’
– ‘আর বলিস না, অফিসে একটু ঝামেলা হয়েছে। কুড়িগ্রামের শাখায় যেতে হবে সাতদিনের জন্য, তাই সব গুছিয়ে সন্ধ্যের মধ্যে বের হবো। তুই আর তোর মা সাবধানে থাকিস।’
– ‘আচ্ছা বাবা।’
সন্ধির মন আরো খারাপ হয়ে যায়। মাহিদের অনুপস্থিতি এমনিতেই তাকে পীড়া দিচ্ছে, যাওয়ার পর থেকে একটাবারও কল দিল না লোকটা তাকে! কী নিষ্ঠুর! সন্ধি নিজেই মাহিদের নম্বর ডায়াল করলো। দুবার রিং হতেই কল কেটে ব্যাক করলো মাহিদ। তড়িৎ গতিতে আশপাশ দেখে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো সন্ধি।
– ‘কী অবস্থা ছাত্রীসাহেবা? মিস করছিলেন বুঝি?’
– ‘আমার বয়েই গেছে আপনাকে মিস করতে।’
– ‘তাহলে কল রাখি। নেহাকে কল দিই বরং।’
– ‘তাই তো দিবেন। আমাকে কেন কল দিবেন? আমি কে?’
– ‘সেটাই তো প্রশ্ন করেছিলাম। বলো আগে আমি তোমার কে?’
– ‘জানিনা।’
– ‘যখন বলতে পারবে তুমি আমার কে, তখন কল দিবে তার আগে না।’
খট করে কলটা কেটে দেয় মাহিদ। সন্ধি বেশ মন খারাপ করে এতে। মাহিদ এভাবে তার মুখের উপর কল কাটতে পারলো? ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মন খারাপ করে বসে রইল সন্ধি।
________________
স্বামীকে বিদায় দিয়ে সায়েরা জামান সন্ধির কাছে এসে বসলেন। বললেন, ‘কাল সকাল সকাল তৈরি থাকবি।’ মায়ের মুখের উপর প্রশ্ন করার সাহস হলো না সন্ধির। এ মুহূর্তে তার মন বড্ড খারাপ। একে তো মাহিদের উপর অভিমান তার উপর তূর্ণার প্রতিদান- উভয়ে তাকে ভেঙেচুরে ফেলেছে।
সকালবেলা ড্রয়িংরুমে হাসাহাসির শব্দ শুনে ঘুম ভাঙে সন্ধির। আড়মোড়া ভেঙে বসতেই নয়নের কণ্ঠস্বরটাও কানে আসে স্পষ্ট। একটু পর সায়েরা জামান এসে তাকে বলেন শাড়ি পড়ে রেডি হতে। বিস্মিত হওয়ার পালা তখনো বাকি সন্ধির।
– ‘মা, এসব কী হচ্ছে? শাড়ি কেন পড়বো তাও এ সকালবেলা?’
– ‘আজ তোর বিয়ে নয়নের সাথে।’
– ‘মাআ…কী বলছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো? বিয়ে কি ছেলেখেলা?’
– ‘স্কুলের টিচারের সাথে রঙঢঙ করার আগে ভাবতি সেটা। তোর তো আবার চরিত্রের দোষের অভাব নেই। চিঠিটাও কি ঐ মাস্টার দিয়েছিল? ছিঃ ছিঃ! লাজলজ্জার ছিটেফোঁটাও যদি বেঁচে থাকে, শাড়ি পড়ে আয়।’
– ‘মা প্লিজ, আমার কথাটা শোনো। বাবা আসুক, বাবার সাথে…’
– ‘হয় তুই আজ বিয়ে করবি না হয় আমার মরা মুখ দেখবি। তোর জন্য ঐ ম্যাডাম আমাকে এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে কথা শুনিয়েছে কাল। এরপরও তোকে আমি এ বাড়িতে রাখবো? পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হ।’
বলেই সন্ধির কাছে থাকা ফোনটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন সায়েরা জামান। সন্ধির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কতই বা বয়স তার? ষোলো পেরোলো তো। এখনি বিয়ে? তাও নয়ন ভাইয়ের সাথে? সন্ধির ইচ্ছে হচ্ছে গলায় দড়ি দিতে কিন্তু সাহসে কুলালো না। শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে আবারো কাঁদতে লাগল সে। বিয়েটা আটকানোর কোনো উপায়ই কি নেই? মাহিদের সাথে যোগাযোগ করার উপায়ও নেই এখন। তূর্ণার উপর অসীম রাগ হচ্ছে সন্ধির, সে রাগের খানিকটা ছিটে নেহা ম্যামের উপরও পড়ছে। এ দুজনের হস্তক্ষেপে আজ তার জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতি এসেছে।
_____________________________
ঢাকায় আসার পর থেকে কাজের চাপে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাচ্ছে না মাহিদ। ভেবেছিল পরিবারের সাথে একটু সময় কাটাবে তাও হচ্ছে না। সন্ধিকে কপট রাগ দেখিয়ে সেই যে ফোন রেখেছে তারপর থেকে মেয়েটাও আর ফোন করছে না। মাহিদ অবশ্য বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল কিন্তু সন্ধির নম্বর সুইচড অফ বলছে। রাগ করে মেয়েটা নিজের নম্বরই বন্ধ করে রেখেছে। এতটুকুন মেয়ের এত রাগ যে কোথা থেকে আসে! ভাবতে ভাবতে সকালের নাস্তা করতে বসলো মাহিদ। মা প্লেটে খাবার সার্ভ করে বসে আছেন অথচ মাহিদ খেয়ালই করেনি।
– ‘খাচ্ছিস না কেন মাহিদ?’
– ‘ওহ..হ্যাঁ ..এই তো..না মানে খাচ্ছি।’
– ‘মাহিদ, বাবা তুই কি প্রেমে পড়লি নাকি? এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করছিস?’
– ‘কী যে বলো আম্মু! খাচ্ছি আমি।’
মাহিদ হালকা হেসে খাওয়া শুরু করে। সন্ধির থেকে দূরে থাকাটা কিছুতেই তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। সব কাজ যেন লণ্ডভণ্ড হচ্ছে আরো। গোছানো জীবনটা অগোছালো করে ফেলছে মাহিদ।
‘ইস্ক নে গালিব নিকাম্মা কার দিয়া,
ওয়ারনা আদমি হাম ভি কাম কে থে।’
কথাগুলো খুব মৃদু স্বরে বললেও মাহিদের মায়ের কানে ঠিকই পৌঁছায়। হেসে উঠেন তিনি। মায়ের হাসিতে অপ্রস্তুত হয়ে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে কোনরকমে চলে যায় মাহিদ।
একদিকে সন্ধির অনুপস্থিতি মাহিদকে বিষণ্ণ করে তুলছে তো অন্যদিকে মাহিদকে ভুলে জীবনের এক আকস্মিক সূচনার পথে সন্ধি। নয়নকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে যেন সন্ধিকে পেলেই তার জীবন সার্থক অথচ একটাবারও সন্ধির মনের খবর জানার চেষ্টা করেনি ছেলেটা। করলে বুঝতো সন্ধির মনে কখনোই তার নাম লেখা ছিল না। সন্ধির মন জুড়ে একজনেরই প্রভাব-প্রতিপত্তি বিরাজমান। সে মাহিদ ব্যতীত অন্য কেউ নয়।
‘বলো মা কবুল,’ কাজী সাহেব তাড়া দিচ্ছেন। সন্ধির গলা দিয়ে আওয়াজ নিঃসৃত হচ্ছে না। সন্ধি মনে মনে চাইছে সে বোবা হয়ে যাক এই মুহূর্তের জন্য তবুও নয়নের নামে কবুল সে বলতে পারবে না। মায়ের রক্তচক্ষু তাকে ভীত করছে না ঠিকই কিন্তু তার দেওয়া অভিশাপ তার মনকে আহত করছে। মা যে পরিমাণ রাগী তাতে সত্যিই নিজের ক্ষতি করে বসতে পারেন। সন্ধির ঠোঁট কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটেই সে বিড়বিড় করে উঠলো,’ ক…কব….কবু….কবুল…’
চলবে…