শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০৬

0
564

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” স্যার প্লিজ এবারের মতো ছেড়ে দিন।আর কোনোদিনও এধরণের ভুল করবো না।” কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো ইয়াসিন।

” পরের কথা পরে।আজ ভুল করেছো তার শাস্তি তো পেতেই হবো।দেখি তাড়াতাড়ি উঠবস শেষ করো।আমার অনেক কাজ আছে।” ভাব নিয়ে বললো রাদ।রাদের কথা শুনে ইয়াসিন গোমরো মুখ করে আবারো উঠবস শুরু করলো।

দরজা খুলেই এরকম একটা দৃশ্য দেখে পালক থ হয়ে গেলো।তার কাছে মনে হচ্ছে রাদ একজন টিচার আর ইয়াসিন হচ্ছে প্রাইমারি স্কুলের স্টুডেন্ট।যে কিনা বাড়িকাজ করে আনেনি।

পালক দরজায় টোকা দিলো।আচমকা শব্দ শুনে দু’জনেই চমকে দরজার দিকে তাকালো।তাদের এভাবে তাকানো দেখে পালক অস্বস্তি বোধ করলো।পালককে দেখে রাদের চমকে যাওয়া ভাবটা চলে গেলো তবে ইয়াসিন লজ্জায় পড়ে গেলো।অপ্রস্তত হাসি দিয়ে পালক বললো,

” আসতে পারি?”

” অবশ্যই পালকসাহেবা।আপনাকে আমার অফিসে এবং আমার কেবিনে স্বাগতম।”

” দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি।আমার নক করে আসা উচিত ছিলো।”

পালকের কথার প্রেক্ষিতে রাদ ব্যস্তভঙ্গিতে বললো,

” আরে না না কোন সমস্যা নেই।আমরা আমরাই তো।কি বলো মুলা?”

” কিন্তু স্যার আপনি তো……..” ইয়াসিনের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রাদ ইশারায় থাকে চুপ করতে বললো।এতে ইয়াসিন কিছুটা অসন্তোষ হলো বটে।কারণ একটু আগে রাদ তাকে নক করে না আসার কারণে কান ধরে উঠবস করার শা’স্তি দিয়েছিলো অথচ পালককে বলছে কোন সম’স্যা নেই।

” আপনি বলেছিলেন অফিসে এসে যেন দেখা করি।তাই এসেছি।এবার আমি তাহলে কাজে যায়।”

” আচ্ছা যান।মন দিয়ে কাজ করবেন পালকসাহেবা।কোন সমস্যা হলে র্নিদ্বিধায় আমার কাছে চলে আসবেন।অল দ্যা বেস্ট।”

” ধন্যবাদ।আমি আমার বেস্টটা দিয়ে কাজ করবো।”

পালক বেরিয়ে যেতেই ইয়াসিন তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করলো,

” স্যার এটা কি হলো?নক না করার কারণে আমাকে শা’স্তি দিলেন অথচ ওই পিচ্চি মেয়েটাকে ছেড়ে দিলেন!এটা কিন্তু অন্যায় স্যার।আপনি শাস্তির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে ব্যবধান করতে পারেন না।শাস্তি সবার জন্য একই হওয়া উচিত।তাহলে ওই মেয়ে অন্যায় করেও কেন কোন শাস্তি পেলো না?” প্রতিবাদী কন্ঠে বললো ইয়াসিন।

” সেটা তুমি বুঝবে না মুলা।তুমি হচ্ছো সিঙ্গেল কমিউনিটির সদস্য।তাই তোমাকে বলেও কোন লাভ নেই।এবার তাড়াতাড়ি কাজে যাও,নয়তো আবারো শা’স্তির ব্যবস্থা করবো।” গম্ভীরভাবে বললো রাদ।শা’স্তির কথা শুনে ইয়াসিন একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।ফাইলের দিকে তাকিয়ে রাদ মুচকি হাসলো।

অফিস ছুটির সময় হলে সবাই আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগলো।পালকও নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো।যাওয়ার আগে আরেকবার ভদ্রতার খাতিরে রাদের সাথে দেখা করে গেলো।পুরোটা সময় রাদ নিজে আসতে না পারলেও ইয়াসিনকে অনেকবার পাঠিয়ে ছিলো পালকের খোঁজ নেওয়ার জন্য।এ রুম ও রুম করতে করতে ইয়াসিন পায়ের অবস্থা খা’রা’প।

অফিস থেকে পালক টিউশনে চলে গিয়েছিলো।ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তার।গলির সামনে আসতেই পালক দেখলো ছোট একটা দোকানের সামনে কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে আছে,কারো কারো হাতে সিগা’রেট জ্বলছে।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পালক আবারো হাঁটতে শুরু করলো।ছেলেগুলো পালকে দেখা মাত্র উঠে দাঁড়ালো এবং যাদের হাতে সিগা’রেট ছিলো তারা ফেলে দিলো।তাদের কাজে পালক আড়ালে হাসলো।পালক তাদের সামনে আসতেই একজন ছেলে বললো,

” ভালো আছেন ছোট আপু?”

” জ্বি আমি ভালো আছি।আপনাদের সব ঠিকঠাক আছে তো।আবার কোন…..”

” না না আপু সব একদম সেট।কোন তেড়া বেঁকা কোন কিছু নেই।”

” তাহলে তো ভালোই।”

” আপনি কোথা থেকে আসছেন আপু?”

” নতুন অফিস জয়েন করেছি আজ।আচ্ছা তাহলে আমি আসি।তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেও কিন্তু।”

” জ্বি জ্বি আপু।সাবধানে যাবেন,কোন ধরণের সমস্যা হলে আমাদের বলবেন।আমরা আপনাকে সাহায্য করতে হাজির হয়ে যাবো।”

” আপনাকে কি একটু এগিয়ে দেবো ছোট আপু?”

” না না তার দরকার নেই।সামনেই তো বাসা।”

” বড় আপু কোথায়?”

” আপু বাসায় আছে।কেন লাগব নাকি?”

” না না লাগবে না,লাগবে না।আমাদের পক্ষ থেকে বড় আপুকে সালাম,নমস্কার দুটোই জানবেন।”

” আচ্ছা বলবো।এবার তাহলে আমি আসি।”

ছেলেগুলো পালককে যাওয়ার জায়গায় করে দিলো।ছেলেগুলোকে ক্রস করে আসার পর পালক আবারো হাসলো।আগে এই ছেলেগুলোই কোন মেয়েকে দেখলে নম্রভাবে কথা বলা তো দূর উল্টো বাজে ব্যবহার করতো।তবে কয়েক সপ্তাহ আগে একটা ঘটনায় তাদের আচরণ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো।

কয়েক সপ্তাহ আগে পালক এই প্রায় সময়টাতেই বাসায় ফিরছিলো।তার দু’হাতে ছিলো বাজারের থলে।রিকশা ভাড়া মিটিংয়ে প্রিসাও আসছিলো পেছনে।দু’বোন আজ ঘরের জন্য বাজার করতে গিয়েছিলো।আজকের মতো সেইদিনও ছেলেগুলো বসে ছিলো আর সিগা’রেট খাচ্ছিলো।পালককে দেখে তারা খারাপ উদ্দেশ্য এগিয়ে আসতে লাগলো।তবে খারাপ কিছু করবে তার আগেই প্রিসা একটা বড় ধরণের পাথর ছুঁ’ড়ে মারলো,যার কারণে একজনের মাথা ফে’টে র’ক্ত পড়তে লাগলো।তারপর দু’বোন মিলে তাদেরকে ইট,লাউ,শসা সহ হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দিয়ে ইচ্ছে মতো মে’রে’ছে।অবস্থা বেগতিক দেখে কয়েকজন মানুষ এসে তাদের দু’জনকে থামালো।এরকম থেকেই ছেলেগুলো দু’বোনকে দেখলে ভ’য়ে সিটিয়ে থাকে।এসব ভাবতে ভাবতেই পালক বাড়িতে পৌঁছে গেলো।
____________________________________________

শহরের নামি-দামি একটা বেসরকারি হসপিটালের আইসিও বেডে শুয়ে আছে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি।মুখে তার অক্সিজেন মাস্ক,মুখে বড় একটা কাঁটা দাগ,বাম পা এবং হাত দুটো ব্যান্ডেজ করে ঝোঁলানো।

শাকিল হোসেন চোখ খুলে নিজের এই ধরণের অবস্থা দেখে বেশ অবাক হলেন।ব্যথার কারণে নাড়তে পারছেন না তিনি।যথাসম্ভব চোখ ঘুরিয়ে রুমটাকে দেখলেন তিনি।বুঝতে বেগ পেতে হলো না যে বর্তমানে তিনি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছেন।কিন্তু এটা বুঝতে পেরে তিনি আরো বেশি অবাক হলেন কারণ তিনি তো “ব্লু বেরি” রিসোর্টে একটা মেয়ের সাথে ছিলো।কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করার পর ওনার আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে লাগলো।

🍁🍁🍁🍁

মধ্যবয়স্ক শাকিল হোসেন একটা ফাইভ স্টার হোটেলের একটা সাজানো গোছানো রুমে যুবতী এক মেয়েকে নিয়ে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন।ঘন্টা দু’য়েক পর মেয়েটা চলে গেলে তিনি শাওয়ার নিয়ে ড্রিংক করতে বসলেন।অতিরিক্ত ড্রিংক করার ফলে তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

মধ্যরাত এখন।চারিদিকে ছেঁয়ে আছে নিস্তব্ধতা।শাকিল হোসেনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো কয়েক জোড়া পা।কালো পোষাক পড়ার কারণে স্বল্প আলোতে তাদের শারিরীক গঠন বা মুখ খুব ভালোভাবে বোঝা গেলো না।

নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা গেলো একজন পুরুষের কন্ঠ।

” ওনাকে তোলো স্যাম।আমরা এতো কষ্ট করে ওনার সাথে দেখা করতে এলাম আর উনি ম’রা’র মতো ঘুমাচ্ছে।তোলো তোলো।”

পুরুষটির কথা শুনে অপরজন যাকে সে ‘ স্যাম ‘ নামে সম্বোধন করেছে সে এক বাতিল পানি এনে শাকিল হোসেনের গায়ে ছুঁড়ে মারলো।এতে শাকিল হোসেন তড়িৎগতিতে উঠে বসলেন।শাকিল হোসেন জেগে উঠতেই পুরুষটি ইশারা করলো তার পা-হাত বেঁধে দিতে।কি হচ্ছে তা বুঝে উঠার আগেই লোকগুলো তার হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলো।

” কেমন আছেন বিজনেস ম্যান শাকিল হোসেন?দিনকাল কেমন চলছে?”

” কারা তোরা?এভাবে না বলে আমার রুমে ঢুকলি কি করে?পানি দিয়ে ঘুম ভাঙানো কোন ধরণের আচরণ?” রেগে বললেন তিনি।

” দেখেছো স্যাম।ওনার থেকে আচরণ শিখতে হবে এবার আমাদের।আরে মিস্টার শাকিল কুল কুল।ঘুম ভাঙিয়েছি বলে এতো রা’গ হচ্ছে।ইশ,তবে চিন্তা করবেন না।এখন থেকে সারাদিন ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ করতে হবেনা আপনাকে।”

” মানে?তোরা কারা?আর আমার হাত-পা বেঁধেছিস কেন?”

” আরে আস্তে আস্তে।সব কিছু জানতে পারবেন।তো প্রথম প্রশ্ন আমরা কারা?আমরা ইচ্ছি তোর য’ম।” শাকিল হোসেনের কানের কাছে এসে বললো পুরুষটি। ” মনে আছে ৪ জানুয়ারি,মধুপুর ব্রিজ মধ্যরাত।” এই কথাগুলো শুনে শাকিল হোসেন চমকে গেলেন।ছিঁটকে দূরে সরে আসতে চাইলেও পারলেন না কারণ তার হাত-পা দু’টোই বাঁধা।

” কে তুই?আর এই ব্রিজ আর তারিখ সম্পর্কে জানলি কি করে?ওই দিনের সম্পূর্ণ ঘটনা কি তুই জানিস?” ভয়ে এসি রুমেও ঘামতে লাগলেন শাকিল হোসেন।

শাকিল হোসেনের কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো লোকটি।সে নিজের মতো বললো, ” বলেছিলিনা কেন তোর হাত-পা বেঁধেছি?তোকে মা’র’তে তোর হাত-পা বেঁধেছি।”

” দেখ আমি জানিনা তুই কে।কিন্তু দেখ তুই আমাকে বলে দে তুই কি কি জানিস।তাহলে আমি তোকে অনেক অনেক টাকা দেবো।এতো টাকা যেটা তুই চোখেও দেখিসনি।”

শাকিল হোসেনের কথা শুনে আঁধারেই পুরুষটি সকলের আড়ালে হাসলো।পুরুষটির চুপ থাকা দেখে শাকিল হোসেনের অধর জোড়ায়ও হাসি ফুঁটলো।

” টাকার কথা বলেছি আর চুপ হয়ে গেলো।হাহাহা……আসলেই মানুষ হচ্ছে একধরণের কু’ত্তা।যারা টাকার গন্ধ পেলে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃ’ণ্য কাজটা পর্যন্ত করতে পারে।”

চলবে………