শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-১১+১২

0
536

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

শুক্রবার সকালেই মামার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে পালকেরা।তবে বাসায় তারা আর ওই বিষয়ে কোন আলোচনা করেনি।আজ শনিবার,অন্যদিন পালক হেঁটেই অফিসে যায় তবে আজ দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে তাড়াতাড়ি ট্যাম্পুতে উঠে পড়লো।তবে এই ট্যাম্পুতে উঠার কারণেই তার স্মৃতির পাতায় যে আরো ওটা বিষাদময় এবং ঘৃ’ণিত স্মৃতি যুক্ত হবে সেটা হয়তো পালক জানতো না।

পালকের বাম পাশে বসেছে একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ,ডান পাশে একজন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এবং সামনে একজন ছেলে।কিছুসময় পর পালক অনুভব করলো মধ্যবয়স্ক পুরুষটি তার গায়ের সাথে একদম লাগিয়ে বসেছে।পালক ভাবলো হয়তো জায়গায় কম তাই ভুল করে লেগে গিয়েছে।কোন কথা না বলে পালক ডান দিকে আরেকটু ছেঁপে বসলো কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরও একই ঘটনা ঘটলো।এবারো পালক কিছু না বলে ডান দিকে আরেকটু সরে গেলো।কয়েক মিনিট পর পালক অনুভব করলো তার পায়ের সাথে কেউ নিজের পা একদম লাগিয়ে দিয়েছে।পালক নিজের পা দুটো আরো গুটিয়ে নিলো তবে কিছু সময় পর লোকটি আবারো নিজের পা পালকের সাথে লাগিয়ে দিলো।এবার পালকের বুঝতে অসুবিধা হলো না লোকটা ইচ্ছে করে অ’সভ্য’তামি করছে।পালক অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করলো।মা তাদের শিখিয়েছে এইধরনের পরিস্থিতিতে রেগে গেলে কিছুই হবে না বরং সবাই বাঁকা চোখে থাকাবে,হাসাহাসি করবে।তাই ঠান্ডা মাথায় যা করার নিজেকে করতে হবে।কিছুক্ষণ চুপ করে পালক ভাবলো কি করা যায়।তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা বড় সাইজের সেফটিপিন বের করে হাতটা এমনভাবে রাখলো যেন কেউ দেখলে মনে করবে সে নরমালি হাত ভাঁজ করে রেখেছে।কিছুসময় পর লোকটি যখন আবারো পালকের গা ঘেঁষতে চেষ্টা করে তখন আচমকা পিনের গুঁতো খেয়ে দূরে সিটকে সড়ে গেলো।তবে পালক কোন রিয়েক্ট করলো না একদম স্বাভাবিক ভাবেই রইলো যেন কিছুই হয়নি।দেখতে দেখতে পালকের অফিসের কাছে ট্যাম্পু চলে এলো।গাড়ি থামাতে বলে পালক নেমে গেলো।লোকটি তখন গাড়িতেই ছিলো।টাকা দিয়ে পালক লোকটিকে উদ্দেশ্য করে হালকা হাসলো যা দেখে লোকটি নিজের নজর লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

অফিসে এসে পালক একদফা অবাক হলো।কারণ তার ডেস্ক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।আগের ডেস্ক থেকে সরিয়ে এখন তাকে পাঁচ নম্বর ডেস্ক দেওয়া হয়েছে সেটা একদম রাদের কেবিনের সামনাসামনি।ব্যাগটা নতুন ডেস্কে রেখে পালক রাদের কেবিন এলো।

” নতুন ডেস্ক কেমন লেগেছে পালকসাহেবা?”

” হঠাৎ আমার ডেস্ক কেন পরিবর্তন করলেন স্যার?”

” কারণ তোমার ডেস্ক থেকে আমার কেবিন অনেক দূরে ছিলো।মুলার এতোটা পথ আসতে-যেতে অনেক কষ্ট হয়।আমার কেবিন তো আর সরাতে পারবো না তাই তোমার ডেস্কই পরিবর্তন করে দিলাম।এখন আর মুলার কষ্ট করতে হবেনা।একটা শিষ বাজালেই তুমি শুনতে পাবে।”

রাদের কথা পালকের মোটেও বিশ্বাস হয়নি তবে সে কিছু বললো না।মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।

” স্যার আপনি আমার এতো কেয়ার করেন?আমার কষ্টের জন্য আপনি ওর ডেস্ক পর্যন্ত চেঞ্জ দিলেন।” কাঁদো কাঁদো হয়ে ইমোশনাল ভাবে বললো ইয়াসিন।

” মুলা এতোটাও সিরিয়াসলি নিও না।তোমার পা ফুলে ঢোল হয়ে গেলেও আমার কোন সমস্যা নেই।আমি তো জাস্ট একটা শ’কু’ন থেকে পালকসাহেবাকে বাঁচানোর জন্য আমার চোখের সামনে রেখেছি।উনি খুবই নিষ্পাপ,কারো মনের প্যাঁচ বুঝবেন না।তাই ওনার সেফটির জন্য এই ব্যবস্থা।” ফাইলের দিকে তাকিয়ে বললো রাদ।

” তার মানে স্যার আপনি আমার কষ্ট নিয়ে একটুও চিন্তা করেন না?” কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো ইয়াসিন।

” মোটেও না।”

” মানুষ ঠিকই বলে ভালো মানুষির দাম নেই এখন আর।আমি আপনার কত কেয়ার করি আর আপনি।আপনার সাথে আড়ি।আর আসবো না আপনার কেবিনে।আমি চললাম।” মিছে মিছে চোখ মুছে ইয়াসিন দরজার কাছে চলে এলো।

” আপনি আমাকে আটকাবেন না স্যার?”

” আমি কি যেতে বলেছিলাম?তোমার যেতে হলে যাও।”

” ঠিক আছে চলে যাচ্ছি।আর আসবো না,বিদায়।” মিছে মিছে কান্না করতে করতে বেরিয়ে গেলো ইয়াসিন।ইয়াসিনের পাগলামি দেখে হাসলো রাদ।

মিটিং রুমে বসে আছে অফিসের সব স্টাফ।রাদ আজ নিজে তাদের সাথে কথা বলবে তবে রাদ এখনো আসেনি দেখে অনেকেই বিরক্ত।কিছুসময় পর হুইলচেয়ার করে মিটিং রুমে এলো রাদ,তার সাথে এলো ইয়াসিন।তবে নতুনদের মধ্যে তিনজন রাদকে হুইলচেয়ারে দেখে চমকে গেলো।

” স্যার হুইলচেয়ারে কেন?হাঁটতে পারে না নাকি?” খানিকটা শব্দ করেই বললো নোরা।তার পাশে থাকা একজন পুরোনো স্টাফ তাকে বললো রাদ হাঁটতে পারে না,তার পায়ে সমস্যা আছে।রাদ হাঁটতে পারে না শুনে নোরা খানিকটা বিরক্ত হলো।

” ধুর এতোদিন শুধু শুধু এতো সময় নষ্ট করলাম।আগে যদি জানতাম এই ছেলে ল্যাং’ড়া তবে এতো সময় এটার পেছনে নষ্ট করতাম না।”

হুইলচেয়ারে বসেই রাদ সকলের উদ্দেশ্য বললো,

” তাজ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রি যে প্রজেন্টটা ছিলো ওটা আমরা পেয়ে গিয়েছি।মিটিং কাল হওয়ার কথা থাকলেও সেটা আমরা আজকেই শেষ করে ফেলেছি।আপনাদের পরিশ্রম এর জন্য আমরা ডিলটা পেয়েছি তবে এখন থেকে আরো বেশি কাজ করতে হবে যেন আরো প্রজেক্ট আমরা পেতে পারি।আপনাদের যার যার কাজ ইয়াসমিন এবং ম্যানেজার সাহেব আপনাদের টিম হেড করে বুঝিয়ে দেবেন,তাদের থেকে আপনারা কাজ বুঝে নেবেন।আজকের মিটিং এই পর্যন্ত,ভালো থাকবেন সবাই।”

” একটা কাজ হয়না তোমার দ্বারা।তোমাকে না বলেছিলাম ফাইলটা বদলে দিতে তাহলে কি করে এটা ওরা পেলো?এখন আমি ওনাকে কি জবাব দেবো?জানো এই ডিলটার দাম কত?ইডিয়েট।”

” স্যার আমি তো বদলানোর সুযোগই পাইনি।মিটিং তো কাল হওয়ার কথা ছিলো তাই আমি আজ রাতেই ফাইল বদলে দেবো ভেবেছিলাম কিন্তু তারা তো কাউকে না বলেই আজকেই মিটিং করে ফেলেছে।”

” ঠিক আছে।এবারে মতো ছেড়ে দিলাম।বাকি কাজগুলো ঠিক মতো করো অন্তত না হলে তোমাকে আর কেউ খুঁ’জে পাবো না।”
____________________________________________

স্কুল থেকে এসে খাবার গরম করে মা-মেয়ে দু’জনে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুসময় হয়েছে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।তবে সেসময়ই ঘরের বেল বেজে উঠলো।বিছানা থেকে উঠে প্রিসা ঘড়ির দিয়ে তাকিয়ে দেখলো তিনটে বেজে গিয়েছে।প্রিসা যাওয়ার আগেই তার মা দরজা খুলে দিলো।অপর পাশের মানুষটিকে দেখে প্রিসার চোখমুখ কুঁচকে গেলো।দরজার ওপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে লামিয়া মুনতাহা সম্পর্কে তিনি প্রিসার ফুপি।

” কি হলো ভাবী ভিতরে আসতে দেবে না নাকি?”

” না সেরকম কিছু না এসো।” অনিলা বেগম দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালে লামিয়া বেগম এবং তার মেয়ে লিসা হনহন করে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

” হুম…..যতটা খারাপ ভেবেছিলাম তোমাদের অবস্থা দেখি ততটাও খারাপ নয়।” সোফায় বসতে বসতে বললেন লামিয়া বেগম।অনিলা বেগম রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে প্রিসা উনাকে বসতে বলে নিজে চলে গেলো।কি দেওয়া যায় চিন্তা করতে করতে প্রিসা ভাবলো নুডলস,কফি আর বিস্কুট দেবে।প্রিসা দেরি না করে নুডলস আর কফি তৈরিতে লেগে পড়লো।

অফিস শেষে হেঁটেই বাড়ি ফিরছে পালক।আসতে আসতে ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার করছে সে।সবজি কিনে ফিরে আসার সময় সে খেয়াল করলো একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা যার বয়স অনেকটা তার মায়ের মতো তিনি বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।পালক মহিলাটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

” কোন সমস্যা আন্টি?”

” না না কোন সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি।”

” কোন সমস্যা হলে বলতে পারেন আন্টি।আমি তো আপনার মেয়ের মতো।সমস্যা হলে বলুন দেখি আমি সাহায্য করতে পারি কিনা।”

” আসলে মা আমার ব্যাগ চু’রি হয়ে গিয়েছে।তাই ফোন বা টাকা কোনটাই নেই যে বাড়িতে ফিরে যাবো বা কাউকে ফোন করবো।আমি যে এখন কি করে বাড়ি যাই।বাড়িও প্রায় অনেকটা দূরে।” চিন্তিত স্বরে বললের মহিলাটি।

পালক চুপ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো যে কি করা যায়।
.
.

খাবার নিয়ে এসে প্রিসা টেবিলে রাখলো।সোফায় চোখ যেতেই সে লক্ষ্য করলো লিসা নেই।প্রিসা চারিদিকে তাকিয়ে যখন লিসাকে দেখতে পেলো না তখন সে দ্রুত তার রুমের দিকে গেলো।

” তুমি আমাদের রুমে কি করছো লিসা?”

চলবে……..

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” তুমি আমাদের রুমে কি করছো লিসা?”

” ও কিছু না আপু।আসলে অনেক বছর পর তোমাদের বাসায় এসেছি তো তাই একটু ঘুড়ে দেখছিলাম।”

” ও ঠিক আছে।চলো খেয়ে নেবে।”

লিসাকে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই প্রিসার কানে এলো তার ফুপির কথা।

” তা ভাবি মেয়েদের বিয়ে কবে দেবে?ভাইটাতো অকালেই চ’লে গেলো।এখন তুমি যাওয়ার আগে ওদের কোন গতি করে দাও।” কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন লামিয়া বেগম।লিসা সোফায় বসেই নিজের মতো নুডলস খেতে ব্যস্থ হয়ে পড়লো।

” শুনলাম তোমার বাবার বাড়িতে থেকে নাকি প্রিসার জন্য সম্বোধন ঠিক করেছে কেউ।তো সেটাতে মত দাওনি কেন?”

” এ কথা তুমি কি করে জানলে?” ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো অনিলা বেগম।কারণ ঘরের কথা বাইরের লোক কি করে জানতে পারলো।

” ঘরে বিয়ের বয়সী মেয়ে থাকলে সব কথা হাওয়ায় উড়ে।শুনলাম ছেলে নাকি ভালো,টাকা পয়সারও কমতি নেই।”

” ছেলের বয়স বেশি আর টাকা পয়সায় সব নয় লামিয়া,সুখ টাই আসল।যদি প্রিসা এতে মত দিতো তাহলে আমি কথা এগিয়ে নিতাম কিন্তু মেয়েই যখন মত দেয়নি তখন আমার উচিত না জোড় করা।”

” ওর আবার কিসের মত?ওর কি ওতোসব বুঝ জ্ঞান আছে নাকি?পঁচিশ পার হতে চললো,তো ওনার জন্য কি কুড়ি বছরের ছেলে বসে থাকবে নাকি?”

” লামিয়া আমার মেয়েরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি।যোগ্য পাত্র পেলে আমি নিজেই ওদের কে তাদের হাতে তুলে দেবো।”

” যোগ্য পাত্র খুঁজছো নাকি আরো পয়সাওয়ালা কাউকে খুঁজছো?আর কত মেয়েদের টাকায় খাবে বলো তো?নাকি মেয়েদের টাকায় ভাগ পড়বে বলে বিয়ে দিচ্ছো না?”

” ফুপি আজে বাজে কথা বলা বন্ধ করো।এটা তোমার বাড়ি নয় এটা আমার মায়ের বাড়ি।”

” তুমি চুপ করো মেয়ে।আচার ব্যবহার তো দেখি কিছুই জানো না।এরকম ব্যবহার করলে শাশুড়ী লা’থি দিয়ে বের করে দেবে।”

” আমার ব্যবহার না হয় খা’রা’প কিন্তু আপনি কি ব্যবহার করছেন?নিজের ভাবীকে এসব কথা বলছেন।আমাদের মা আমাদের টাকা খরচ করে,আপনার টাকা তো আর খরচ করছে না তাহলে আপনাদের এতো সমস্যা কেন?আমরা ছেলে হলে কি মাকে টাকা দিতাম না?ছেলেরা বাবা-মাকে খরচ দিতে পারে আর মেয়ে দিলে বলে বাবা-মা মেয়ের টাকায় চোখ দিয়েছে,তাদের লোভ বেশি।কেন?মেয়েদের যে ছোট থেকে বাবা-মা মানুষ করে,পড়াশোনা করাই ভালো চাকরী পাওয়ার পর বেতনের টাকা তাদের হাতে তুলে দিলেই দোষ আর ছেলেরা তুলে না দিলে বলে বউয়ের কথায় চলে,বউয়ের বাপের বাড়ির লোকদের পেছনে খরচ করে।মানে আপনাদের মতো কিছু লোকেদের সব জায়গায় সমস্যা।”

” ভাবি তোমার মেয়ে কিন্তু আমাকে অপমান করছে।নিশ্চয়ই এই উ’গ্র ব্যবহারের জন্য বিয়ে হচ্ছে না।কি দু’কলম পড়াশোনা করে একটা টিচারি করছে মেয়ের দে’মা’গ কতো।

প্রিসা আর কিছু বলবে কিন্তু অনিলা বেগম তাকে থামিয়ে দিলো।

” প্রিসা ফুপিকে সরি বলো।ওনার সাথে এরকম ব্যবহার কথা তোমার মোটেও উচিত হয়নি।তিনি তোমার বড়ো।সরি বলো।”

” সরি ফুপি।” মাথানিচু করে বললো প্রিসা।সে মোটেও এধরণের ব্যবহার করতে চাইনি কিন্তু গত কিছুদিন ধরে এতো এতো কথা শুনে সে আর সহ্য করতে পারছিলো না।

” রুমে যাও প্রিসা।” প্রিসা রুমে গিয়ে দরজা ভীড়িয়ে দিলো।

” মেয়ের লাগাম টানো নয়তো দেখবে একদিন দড়ি ছিঁড়ে চলে যাবে।”

” লামিয়া মেয়েটা যেহেতু আমার তাই তাদের নিয়ে আমার থেকে অন্তত তোমাদের বেশি চিন্তা থাকবে না।আমি মা,তোমাদের থেকে আমি ভালো বুঝতে পারি মেয়েদের জন্য কোনটা ভালো হবে।” মুখে হাসি মুখেই জবাব দিলেন অনিলা বেগম।

ছিমছাম একটা ড্রইংরুমে বসে আছে পালক।মহিলাটিকে সে রিকশায় তুলে দিয়ে চলে আসতে চেয়েছিলো তবে মহিলাটি তাকে যেতে দেয়নি জোড় করে নিজের সাথে করে নিয়ে এসেছে।ড্রইংরুমটা একদম সাধারণ তবে গোছানো।উপরে দুটো ঝাড়বাতি ঝোলালো,সাদা-কালো দেয়াল আর তাতে কয়েকটা হাতে আঁকা ছবি টাঙানো।কথায় কথায় জানতে পেরেছে মহিলাটির নাম নূরজাহান রহমান।

” তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম মা।”

” না আন্টি কিসের কষ্ট।আমার মা হলে কি আমি সাহায্য করতাম না,তেমনি আপনাকে করেছি।”

” তুমি বড় ভালো মা।বসে আছো কেন খাও না।”

একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে পালক প্রশ্ন করলো,

” বাসায় কি কেউ নেই আন্টি?”

” না মা।ছেলেটা অফিসে,মেয়েটা নাকি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছে আর তোমার আঙ্কেল জানি কোথায় গিয়েছে বলে যায়নি।”

আরো দু’একটা কথা বলে পালক চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।যাওয়ার আগে নূরজাহান রহমান পালকের নম্বর নিতে ভুললেন না।

” আবার এসো মা।তোমার মা আর বোনকেও নিয়ে এসো।” পালকে জরিয়ে ধরে বললো নূরজাহান রহমান। ” অবশ্যই আন্টি।সাবধানে থাকবেন।আসি তাহলে।”

সন্ধ্যা হয়ে আসছে।লামিয়া বেগম এখন চলে যাবেন।লিসা মেয়েটা ভালো তবে অনেক কম কথা বলে।অনিলা বেগম প্রিসাকে বললেন যেন তাদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে।প্রিসাও কথা না বাড়িয়ে তাদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হলো।তবে দোতালায় এসেই প্রিসা থমকে গেলো।কয়েকবার চোখেন পলক ফেললো না সে ঠিকই দেখছে।

একদম অন্ধকার এটা রুমে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে কাদের আলীকে।আজ দ্বিতীয় দিন তাকে এভাবে বেঁধে থাকা হয়েছে।না খাবার দেওয়া হয়েছে আর না ওয়াশরুমে যেতে দেওয়া হয়েছে।নিস্তব্ধ,শব্দহীন পরিবেশের অবসান ঘটিয়ে শোনা গেলো কয়েকজোড়া পায়ের শব্দ।আস্তে আস্তে শব্দ আরো জোড়ালো হতে লাগলো।আচমকা মিলে গেলো সব শব্দ,আবারো ঘর হয়ে গেলো একদম নিস্তব্ধ,কোন শব্দ নেই।

প্রিসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিহাদ।পড়নে তার পারপেল টি-শার্ট,ঢোলাঢালা একটা ট্রাউজার,চোখে বড় ফ্রেমের চশমা,শ্যাম্পু কথা চুলগুলোর একাংশ কপালে অবস্থা করছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন ভার্সিটিকে পড়া একজন ভোলাভালা ছাত্র।

” আপনি এখানে কি করছেন নিহাদ?” বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো প্রিসা।সে মোটেও নিহাদকে এখানে আসা করেনি।

” আমি তিন তালায় নতুন উঠেছি।আপনিও কি এখানে থাকেন?”

” জ্বি,চারতলায়।”

” বাহ্ তাহলে এখন তো আমাদের মাঝে সম্পর্ক আরো মজবুত হলো।প্রথমে কলিগ এখন প্রতিবেশি।” হাসি হাসি ভাব করে বললো নিহাদ।

” আচ্ছা তাহলে আমি এবার আসি।কোন সমস্যা হলে বলবেন।”

” অবশ্যই বলবো।”

প্রিসা যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে নিহাদ সরে তাকে জায়গায় করে দিলো।প্রিসার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আপন মনে হাসলে নিহাদ।

রাতের খাবার খাচ্ছে পালক,প্রিসা আর অনিলা বেগম।বাসায় বিকেলে কি হয়েছে তা এখনো পালক জানেনা।

” মা আমি কি সত্যিই তোমার বোঝা হয়ে গিয়েছি?”

মেয়ের এরকম কথা শুনে অনিলা বেগম এর বুক ধক করে উঠলো।বোনের এরকম কথা শুনে পালকের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে তার অনুপস্থিতে বাসায় কিছু হয়েছে।

” কি হয়েছে মা?আপু তুই হঠাৎ এরকম কথা বলছিস কেন?কি হয়েছে?”

” সন্তানরা কখনোই বাবা-মায়ের বোঝা হয়না।হোক সে ছেলে বা মেয়ে।সন্তানরা হচ্ছে বাবা মায়ের অংশ,তারা কি করে বোঝা হতে পারে।অন্যের কথায় মন খারাপ করো না।মানুষ অনেক কিছু বলবে কিন্তু তুমি যদি তাতে সহজে ভেঙে পড়ো তাহলে কখনোই সামনে এগোতে পারবে না।সবকিছুর একটা সঠিক সময় আছে।সময় হলে আমি তোমাদের দু’বোনকেই যোগ্য কারো হাতে তুলে দিয়ে আমার শে’ষ নিঃশ্বাস ত্যা’গ করবো।”

প্রিসা আলতো করে মায়ের কাঁধে মাথা রাখলো।এই ভরসাযোগ্য কাঁধে মাথা রেখে সে বড়ই স্বস্তি পাই।বোনের মনের অবস্থা বুঝে পালক এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করলোনা,পরে জিজ্ঞেস করে নেবে।

সেই অন্ধকারচ্ছন রুমটাতে কয়েক মিনিট এর জন্য শোনা গিয়েছিলো পায়ের আওয়াজ।ঘন্টাখানেক ধরে সেই রুমটাতে কোন শব্দ নেই তবে এখন আবারো শোনা যাচ্ছে মিহিভাবে কারো পায়ের শব্দ।কাদের আলী মাত্রই চোখ বন্ধ করেছিলো কিন্তু কারো স্বরে চোখ খুলে খেললো।

” কাদের আলী।” নিচু এবং গম্ভীর স্বর লোকটির।এতো ভুতুড়ে শব্দ শুনে কাদের আলী ধরফরিয়ে চোখ খুলে ফেললো।

” কে তুমি?আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছো?টাকা লাগলে বলো আমি এখুনি আমার লোকেদের বলে দিচ্ছি।তাও আমাকে ছেড়ে দাও।”

” ৪ জানুয়ারি,মধুপুর ব্রিজ মধ্যরাত।”

কাদের আলীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।এতো মাস পর আচমকা এই কথাটা শুনবে সেটা কাদের আলী আশা করেননি।

চলবে……