শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-২৭

0
510

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ২৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

চার তারকা একটা রেস্তোরাঁয় সামনাসামনি বসে আছে অয়ন এবং নিহাদ।নিহাদই অয়নকে ফোন করে আসতে বলেছে।নিহাদের সামনে বসে থাকতে অয়নের খুব অস্বস্তি হচ্ছে,সময়ের সাথে সাথে তার অস্বস্তি আরো বেড়ে যাচ্ছে কারণ নিহাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

” তুই কি আমাকে কিছু বলবি?কিছু বলার থাকলে বল না হলে আমি যায়।আমার অনেক কাজ আছে।” আমতো আমতো করে বললো অয়ন।অধরজোড়া প্রসারিত করে হাসলো নিহাদ।

” আরে শা’লাবাবু এতো তাড়া কিসের?বসুন,একটু নতুন জামাইয়ের সাথে গল্প করুন তা নয় আপনি তো পালিয়ে বাড়াচ্ছেন যেন কোন অ’প’রা’ধ করেছেন।কি আমি ঠিক বলছি নাকি?”

নিহাদের হাসিমাখা কথা শুনে অয়ন থতমতো খেয়ে গেলো।

” কি বলছিস এসব?মজা করার জন্য ডেকেছিস নাকি?”

” আমাকে তুই ফোন করে প্রিসার নামে বা’জে কথা বলেছিস তাই না?”

” কি বলছিস এসব?” আমতো আমতো বললো সে।

” শোন অয়ন লুকো’চুরি আমার কাছে পছন্দ হয়,আমি সাদাসিধে মানুষ।তাই যা বলার সরাসরি বলছি,শোন প্রিসাকে বি’র’ক্ত করা ছেড়ে দে।আগের কথা আমি জানিনা তবে এখন সে আমার স্ত্রী।তাই তাকে কোনরকম বিরক্ত করলে সে কি করবে তা আমি জানিনা তবে আমি ভুলে যাবো তুই আমার বন্ধু,সেইসাথে আমার স্ত্রীর ভাই।এখন এসব মেয়েদের মতো কু’টনী’তি ছাড়।নে গরম গরম কফি খা তারপর বাসায় গিয়ে দীপ্তির সাথে বসে কু’টনী’তি ভারা রোমান্স কর।বাই বাই।”

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিহাদ।অয়নের ল’জ্জা’য় মাথা’কা’টা যাওয়ার মতো অবস্থা কারণ সে জানতোনা নিহাদ আগে থেকেই সব জানতো।
.
.

নিহাদ বাড়িতে ফিরেছে সন্ধ্যার পরে।বাড়ি ফিরে সে চুপচাপ জামাকাপড় বদলে নিলো,কারো সাথেই কথা বলেনি।

” সকালে যে আমার বানানো চা খেলেন।কই একবারো তো বললেন না কেমন হয়েছে।”

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিলো নিহাদ,প্রিসার কথা শুনে হালকা তোয়ালে সরিয়ে তাকে দেখে নিলো কিন্তু কিছু বললোনা।

” কি হলো কথা বলছেন না কেন?মুখে কি ক্যাকটাস লাগিয়ে রেখেছেন?”

” ভালো ছিলো।” সংক্ষেপে জবাব দিলো নিহাদ।নিহাদের উওর শুনে প্রিসা ঝাঁ’ঝা’লো কণ্ঠে বললো,

” কি সমস্যা আপনার?মুখে কুলে এঁটে রেখেছেন কেন?নাকি কাউকে কথা দিয়েছেন কারো সাথে কথা বলবেন না?মানছি সকালে আমি একটু আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম কিন্তু আপনি কি?আপনি তো আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গিয়েছেন।সব নিজেই করেছে আবার রাগও তিনিই দেখাচ্ছেন।আরে বাবা আমাকেও তো কিছু করার সুযোগ দিতে হবে নাকি।”

” বাবা রাণীজিকে তো একেবারে লাল মরিচ লাগছে।”

” তো কি করবো?আমাকে তো কিছু বলার সুযোগটাই দেননি আপনি।সেই যে সকালে নিরাকে নিয়ে গিয়েছেন এখন ফিরেছেন বাড়িতে।” খানিকটা মন খারাপ নিয়ে বললো প্রিসা।তোয়ালেটা বিছানায় রেখে নিজের একটা হাত প্রিসার মাথায় এবং অন্যটা প্রিসার হাতের উপর রাখলো নিহাদ।

” রাগ করোনা রাণী।নতুন বিয়ে হয়েছে তাই বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছি।এখন তো আর সিঙ্গেল নেই,ডাবল হয়ে গিয়েছি।এখন তো একজন মানুষের দায়িত্ব আমার উপর,কাজ বেড়ে গিয়েছে।এতো সব কিছুর মাঝে তাদের সাথে আবার কখন দেখা হবে তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই,তাই দেখা করে এসেছি।”

” সেটা ভালো করেছেন কিন্তু একবার ফোন করে জানে তো পারতেন।আমি ভেবেছি আপনি রাগ করেছেন।”

” না রাগ নয় তবে অভিমান করেছিলাম কিন্তু এখন সেটা আর নেই।আচ্ছা তুমি মায়ের কাছে যাও,একটা জিনিস এনেছি।মায়ের কাছে আছে,দেখো তুমি।আমি আসছি।”

একটা কোমল হাসি দিয়ে প্রিসা বেরিয়ে গেলো।সে চলে যেতেই নিহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো।অয়নের সাথে দেখা হওয়ার কথাটা নিহাদ ইচ্ছে করে লুকিয়ে গিয়েছে।প্রিসা তো এই ব্যপারে আগ্রহী নয় তাহলে কি দরকার তার কথা বলে মানুষটা কষ্টটা বাড়ানোর।কিছু কথা থাকে যেগুলো না বলাই শ্রেয়,তাতে মানুষটা কষ্ট থেকে দূরে থাকে।
.
.

কিছুদিন পর গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে রাদের অফিসে।সবাই এখন তা নিয়েই ব্যস্ত।রাদেও নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে ল্যাপটপে।যেহেতু পালক বিয়ের জন্য অফিসে যাইনি তাই তার এখন কোন কাজ নেই।

” রাদসাহেব।”

” হুম বলো পালকসাহেবা।” স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো রাদ।

” আমার দিকে তাকাও।কিছু কথা আছে।”

রাদ বুঝতে পারলো পালক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে তাই ল্যাপটপ বন্ধ করে পালকের দিকে তাকালো।
হাতের ইশারায় পালককে নিজের কাছে ডাকলো সে।পালকের দু’হাত দু’টো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রাদ প্রশ্ন করলো,

” কি হয়েছে?তোমার কন্ঠ এরকম শোনাচ্ছে কেন?”

” শোন এই মিটিংটা হয়ে গেলে তুমি আর অফিসে যাবেনা,আমিও যাবোনা।ঘরে থাকবে,ডাক্তারের সব নিয়ম মেনে চলবে।”

” কি বলছো তুমি এসব?অফিসে না গেলে কাজ করবে কে?”

” ফুফা,আয়না,ইয়াসিন ভাই ওনারা দেখে নেবে।না হলে আমিও যাবো কিন্তু তোমার যাওয়ার দরকার নেই।আমার কাছে কাজ থেকেও তুমি আগে।তোমাকে কখনো আমি নিজের পায়ে হাঁটতে দেখিনি।আমি প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি আমি কোন এক শরতের তোমার হাতটি ধরো একটি শুভ্র মাঠ পাড়ি দিচ্ছি।তোমার পায়ের সাথে পা মিলিয়ে আমি শরতের কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করছি।আমি তোমাকে এভাবে আর দেখতে পারছিনা রাদসাহেব।”

পালকে নিজের বুকের সাথে জরিয়ে ধরলো রাদ।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পালক।আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রাদ বললো,

” আমি তাড়াতাড়িই নিজের পা হাঁটবো পালকসাহেবা।খুব তাড়াতাড়ি তোমার ইচ্ছেগুলো আমি পূরণ করবো।শীঘ্রই আমরা কাশফুলের শুভ্ররাজ্যের হাতে হাত রেখে পায়ে পা মিলিয়ে একিসাথে হাঁটবো।”

” কবে সত্যি হবে?আমি কি আমার আ’য়ু থাকতে তোমাকে নিজের চোখে হাঁটতে দেখতে পারবো?” ফুঁপিয়ে বললো পালক।

” অবশ্যই দেখবে তুমি।শুধু একটু অপেক্ষা করো,তোমার ইচ্ছে তোমার রাদসাহেব পূরণ করবে।”

রাদের বুকে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো পালক।রাদ তার মাথায় এখনো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তবে সে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছে।
.
.

প্রিসার সামনে বর্তমানে দু’টো মিষ্টির বক্স।একটাতে লাল গোল মিষ্টি,অন্যটাকে সাদা রঙের গোল মিষ্টিগুলো রাখা আছে।পরিবারের বাকি সবাই সাদা মিষ্টিটা নিয়েছে কিন্তু প্রিসা মিষ্টি নিচ্ছেনা কারণ সে সাদা মিষ্টি পছন্দ করেনা।এখন অন্যদের দেখে আলাদা মিষ্টিটাতে নিতে তার সংকোচ কাজ করছে।

” আরে ভাবী তুমি বসে আছো কেন?নাও,আমাদের এখানের মিষ্টিগুলো অনেক ভালো।ও মা ভাবীকে দাও না।”

” আরে বউমা তুমি না নিয়ে বসে আছো কেন?আর নিহাদ তুইও বলিহারি নিজেদেরটা খেতে শুরু করে দিয়েছিস অথচ মেয়েটাকে দিলিনা।”

মুনতাহা বেগম প্রিসাকে একটা বাটিতে দুটো লাল রঙের মিষ্টি তুলে দিলেন।

” আমার ছেলেটা না শুধু শরীরের দিক দিয়ে বড় হয়েছে,মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই।মানুষ চাখোর হয় কিন্তু আমার এই ছেলে মিষ্টিখোর।মিষ্টি দেখলে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।”

” মা তুমি এরকমটা বলতে পারলে?আমি তো শুধু একটু বেশি মিষ্টি খায়,তাই বলে তুমি আমাকে এরকমটা বললে।” ছোট বাচ্চাদের মতোন করে বললো নিহাদ।

” দেখো বউমা,ছোট বাচ্চাদের মতো ঢং করছে।একটু বোঝাও তো বাচ্চামো ছেড়ে দিতে।শোন বাবা মিষ্টি কম খা,নয়তো ডায়বেটিস হয়ে যাবে।”

” হলে হবে কিন্তু আমি মিষ্টি খাবোই,দরকার হলে ভাত খাবোনা তাও আমি মিষ্টি খাবোই।” বলেই আরেকটা মিষ্টি মুখে পুড়ে দিলো নিহাদ।সবাই হাসতে লাগলো।নিহাদের কাজ দেখে প্রিসাও হালকা হাসছে।সে মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

” সবাই বলে পুরুষ মানুষদের নাকি গম্ভীর,রাগী,রগচটা স্বভাবটা মানানসই কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের রগচটা স্বভাব নয় বরং বাচ্চামো,স্নিগ্ধ,কোমল স্বভাবটাই মানায়।কেন পুরুষদের গম্ভীর হতে হবে?কেন তাদের রাগী হতে হবে?বক্ষপিঞ্জরের তাদেরও তো একটা কোমল হৃদয় আছে।ক্ষ’তি কি কিছু কিছু পুরুষ না হয় কোমল,হাসিখুশি হলো।”
.
.

” স্যার মাহাবুব সিনহা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন?”

” উনি এখানে কেন এসেছে মুলা?তুমি জানতে নাকি উনি আসবে?”

” না স্যার।পূর্ববার্তা ছাড়ায় এসেছেন।এখন কি করবো স্যার?”

” কি আর করবে।ফিরিয়ে তো আর দিতে পারিনা।আসতে বলো,দেখি কি বলেন।”

খানিক পরেই গম্ভীরভাব নিয়ে কেবিন প্রবেশ করলো মাহাবুব সিনহা।তার সাথে যে লোকটা ছিলো তাকে এবং ইয়াসিনকে ভেতরে আসতে বারণ করে দিলেননি।রাদের দিকে তাকালো ইয়াসিন।রাদ চোখের ইশারায় কিছু বললো তাকে,দরজা বন্ধ করে ইয়াসিন চলে গেলো।

” আঙ্কেল কেমন আছেন?শরীর ভালো আছে তো?মনে হচ্ছে অনেক টেনশনে আছেন।ব্যবসায় ল’সট’স হয়ে নাকি?নাকি আপনার কোন লোক আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে?”

” একটু বেশিই কথা বলছো না তুমি?”

” আরে কি যে বলেন না আপনি।তা কি খাবেন?চা,কফি,অ্যালকোহল নাকি অন্যকিছু?”

” শোন তোমাকে একটা ভালো পরামর্শ দি।এই লাইনে তুমি নতুন।এখনো তোমার আসল ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা নেই।তাই বলছি যা করবে ধীরেসুস্থে করবে।দেখা গেলো না দেখে দৌড়াতে গিয়ে হোঁ’চ’ট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে।তখন আবার সমস্যা।আসি,সাবধানে থেকো।ঔষধ ঠিকমতো খেও,নিয়মিত ডাক্তার দেখাবে কিন্তু।”

হাসতে হাসতে চলে গেলেন মাহাবুব সিনহা।রাদ পেছন থেকে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
.

ঘন্টাখানিক ধরে অঝোরে কান্না করে যাচ্ছে আয়না।পালক তাকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার কান্না আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।তার কান্না করার মূল কারণ আদিব সাহেব আজকেই ঘরোয়া ভাবে ওনার কোন পার্টনারের ছেলের সাথে আয়নার বিয়ে দেবেন।আয়না শুনেই সরাসরি বারণ করে দিয়েছে কিন্তু তিনি শোনেনি।ধ’ম’ক দিয়ে তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন।সেই থেকে আয়না কান্না করে চলেছে।পালক কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।রাদও নেই যে তার সাথে বসে কিছু সিদ্ধান্ত নেবো।প্রায় একমাস হতে চললো রাদ বাড়িতে নেই,বাইরে গিয়ে।রাদকে খবরটা দিতেও পারছেনা কারণ তার ফোন বন্ধ।এদিকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে।পালকের মাথা ব্যথা করছে এবার।কিছু যে ভেবে করবে তাও পারছেনা।অসহায় দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকালো সে।নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে মেয়েটা।পালকের মনে প্রশ্ন জাগলো,

” আয়নার কি ছেলেটাকে পছন্দ নয় নাকি জো’ড় করে বিয়ে দেওয়াটা?”

চলবে…….