শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-৩০

0
590

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ৩০
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” ফুফা তুমি কি আমার সাথে রাগ করেছো?” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো রাদ।আদিব সাহেব কোন উওর দিলেন না,থমথমে মুখ করে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন।রাদ এসে ওনার পাশে চেয়ার টেনে বসলো।

” খুব বেশি রাগ করেছো বুঝি?”

” আমি কে যে তোমার উপর রাগ করবো?” গম্ভীরভাবে বললেন তিনি।রাদ মাথা হালকা নুয়ে মুচকি হাসলো।আদিব সাহেবের একটা হাত নিজের দু’হাতের মুঠোই নিলো সে।

” ফুফা দেখো আমি এরকম কিছুই করতাম না যদিনা আয়নার অমত থাকতো।আয়নাকে আমি নিজের আরেকটা বোন হিসেবে বড়ই স্নেহ করি।মণি চলে যাওয়ার পর আয়নাই আমাকে বড় বোনের মতো যত্ন করেছে।আমি যখন অসুস্থ ছিলাম,সারাদিন ক্লান্তি নিয়েও দিনশেষে সে আমার সেবা করতে দ্বিধা করেনি।নিজের হাতে রান্না করে,যত্ন করে খাইয়ে দিয়েছে।সেখানে এই বোনটার চোখের পানি আমি কি করে সহ্য করতে পারি বলো।আর তাদের দু’বছর থেকেও বেশি সময় ধরে সম্পর্ক ছিলো।আমি এতোটাও পা’ষ’ণ হৃদয়ের নয় যে সব জেনেও চুপচাপ থাকবো।হ্যাঁ তোমার পছন্দ করা ছেলেটা ভালো কিন্তু বিয়েটা হলে যে আয়না সুখী হতোনা।যদি উল্টাপাল্টা কিছু করতো তখন তো সারাজীবন আফসোস করতে হতো ফুফা।থাক না যে যেভাবে সুখী থাকে তাকে তার সাথে থাকতে দেখা।”

আদিব সাহেব কিছু বললেন না।রাদও আর কিছু বললোনা।উনার হাতটা ছেড়ে উঠে গেলো।
.
.

পড়ন্ত বিকেলে,সূর্য মামা তৈরি হচ্ছে বিশ্রামের জন্য।হাতে দু’কাপ গরম চা নিয়ে বারান্দায় এলো প্রিসা।একটা কাপ বাড়িয়ে দিলো শাশুড়ী মুনতাহা বেগমের দিকে।তিনি কাপটা নেওয়ার পর পাশের চেয়ারে বসে পড়লো প্রিসা।বাড়িতে এখন তারা দু’জন ছাড়া কেউ নেই।চায়ে চুমুক দিয়ে মুনতাহা বেগম প্রিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

” তোমাদের মাঝে সব ঠিক চলছে তো?” চোখ ঘুরিয়ে প্রিসার দিকে তাকালেন তিনি।প্রিসা নিচু স্বরে হ্যাঁবোধক জবাব দিলো।মুনতাহা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন।কেন নিলেন তা প্রিসার অজানা।

” আজ তোমাকে একটা কথা বলবো।আমি জানি নিহাদ তোমাকে বলেনি কিংবা কখনোই বলবে না।”
কথাটা শোনার জন্য প্রিসা আগ্রহ নিয়ে উনার দিকে তাকালেন।

” জানো নিহাদ যখন প্রথমবার তোমার কথা বলেছিলো তখন আমি এবং ওর বাবা না করে দিয়েছিলাম।অনেক ঝা’মে’লা,রা’গারা’গি হয়েছিলো আমাদের মধ্যে।নিহাদ তো মাঝেমধ্যে রা’গ করে খেতোনা,দরজা বন্ধ থাকতো,ঠিকমতো কথা বলতোনা।কয়েকদিনে আমার গোছালো ছেলেটা অগোছালো হয়ে গিয়েছিলো।এসব দেখে ওর বাবা রাজি হয়ে যায় কিন্তু আমি তখনো আমার কথায় অনড় থাকি।মি’থ্যা বলবো না,তোমার সবদিক একদম পারফেক্ট ছিলো কিন্তু তোমার বয়সটা বেশি ছিলো।যেখানে আমি চেয়েছিলাম সদ্য আঠারো-উনিশে পা রাখা মেয়েকে বউ করে আনবো সেখানে তোমার বয়স ছিলো চব্বিশ থেকেও বেশি।ভেবেছিলাম হয়তো তোমার কোন সমস্যা আছে যার কারণে তোমার এখনো বিয়ে হয়নি।মূলত এইকারণেই আমি রাজি হচ্ছিলাম না।একদিন সদর দরজার কাছে মাথা ঘুরে পড়ে গিলো আমার ছেলেটা।খাওয়া-দাওয়া না করার কারণে এরকমটা হয়েছে।হাসিখুশি ছেলে না আর হাসতোনা,চুপচাপ বসে থাকতো।আমি মা হয়ে এসব মেনে নিতে পারছিলাম না।তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।যখন শুনেছে আমরা তোমাকে দেখে যাবো তখন আবারো আমার ছেলেটা স্বাভাবিক হয়েছে।আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রেখো মা,খুবই নরম মনের মানুষ সে।তার অভিমান খুব বেশি।তোমাদের মধ্যে কোন ঝামেলা হলে রা’গারা’গি করোনা,মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করো।”

প্রিসার মনে পড়ে গেলো বিয়ের পরেরদিন নিহাদের বলা একটি কথা,

” তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কতটা পথ যে পাড়ি দিয়েছি সেটা হয়তো তুমি জানোনা রাণী।”
.
.

” শুনলাম আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করার জন্য সাময়িক সময়ের জন্য দে’বদা’সের রুপ ধারণ করেছিলেন?”

বাইরে থেকে বাড়ি ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই।গায়ে জড়ানো শার্টের বোতাম খুলছিলো নিহাদ কিন্তু প্রিসার কথা শুনে সেখানেই হাত জোড়া থমকে গেলো।বোকা বোকা হাসি দিয়ে প্রিসার দিকে তাকালো সে।

” তোমাকে কে বলেছে রাণী?যেই বলুক,তুমি ভুল শুনেছো।এমনকিছুই না।”

” ও আচ্ছা।তার মানে শাশুড়ী মা মি’থ্যা কথা বলেছে?ডাকবো নাকি উনাকে?” কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো প্রিসা।

” হ্যাঁ হয়েছিলাম সাময়িক সময়ের জন্য জন্য দে’বদা’স।তো কি করতাম কেউ রাজী হচ্ছিলো না।তাই একটু ইমোশনাল ব্যা’কমে’ইল করেছি।”

” তাই বলে না খেয়ে,অযত্নে থেকে নিজেকে ক’ষ্ট দেবেন!”

নিহাদ প্রিসাকে ঘুরিয়ে তাকে পেছন থেকে আলতো করে জরিয়ে ধরলো।

” দীর্ঘক্ষণের সুখের জন্য যদি সাময়িক সময় কষ্ট পেতে হয় তাহলে সেটা খারাপ না।তোমাকে হারিয়ে ফেলার কষ্টের কাছে সেই ক্ষাণিকের কষ্ট কিছুই না রাণী।”

” বুঝতে পেরেছি,এবার ছাড়ুন।ছিঃ বাইরে থেকে এসে জামাকাপড় না বদলেই আমাকে জরিয়ে ধরেছেন আপনি।তাও এই গরমের মধ্যে,ঘামে ভেজা শরীরে এখনো আমাকে জরিয়ে ধরে আছেন।ছাড়ুন,ছাড়ুন।” নিহাদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দূরে সরে এলো প্রিসা।

” ধুর তুমি একটুও রোমান্টিক নও।অন্যের বউরা স্বামী বাড়িতে এলেই জরিয়ে ধরে,অনেকে তো চু’মুও দেয় আর তুমি কিনা ছিঃ ছিঃ করে দূরে সরে গিয়েছো!” ভাঙা মন নিয়ে বললো নিহাদ।নিহাদের কথা শুনে প্রিসার হাসি পেলো তবে সে হাসলোনা।সিরিয়াস ভাবে বললো, ” তাহলে যান না ওরকম রোমান্টিক আরেকটা বউ নিয়ে আসুন।শুনুন এতো রোমান্টিক না আমি নয়,হতে পারবোনা।এখন তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড় পরিবর্তন করে আসুন।নয়তো টেবিলে যে স্কে’ল আছেনা,ওটা দিয়ে দেবো কয়েকটা।”

প্রিসার কথা বিছানা থেকে কাপড় তুলে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো নিহাদ।নিহাদের বাচ্চামো স্বভাব দেখে প্রিসা আবারো হাসলো।
.
.

বিয়ের প্রায় বেশ অনেকদিন পর আয়না ইয়াসিনকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসেছে।কোন এক কারণে ইয়াসিন আসতে চাইছিলো না,আয়না ভাবলো তার বাবার সাথে দেখা হবে সেই ভ’য়েই সে আসতে চাইছেনা।আয়নাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়,জোড় করে তাকে নিয়ে এসেছে।মেয়ে আর নতুন জামাই আসবে এটা জেনে নূরজাহান বেগম তো ভোরবেলা থেকেই বন্দবস্ত করতে লেগে পড়েছেন।পালকও ওনাকে কাজে সাহায্য করছে।তবে রাদ নেই,সে অফিসে চলে গিয়েছে।তা মতে প্রতিদিনই তো তাদের সাথে দেখা হয়,তাই এতো ফর্মালিটি সে করতে পারবেনা।

ভয়ে ভয়ে আদিব সাহেবের কাছে এলো আয়না,সেইসাথে ইয়াসিনকেও টানতে টানতে নিয়ে এসেছে।

” এই ভাঙা আয়না আমার হাত ছাড়ো।তোমার যেতে হলে যাও,আমি যাবোনা।” কানে কানে বললো আয়নাকে।

” চুপ করুন।বেশি কথা বলবেন না,না হলে যে মজার মজার রান্না হচ্ছে তা আর পেটে যাবেনা।”

পা টিপে টিপে রুমের মধ্যে ঢুকলো আয়না।মিনমিন করে আদিব সাহেবকে ডাকলো।আদিব সাহেব তাকাতেই আয়না ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো।

” আরে মা তুই এসেছিস।আয় বস।কতদিন তোকে দেখিনা।” হাসিমুখে বললেন তিনি।বাবাকে আবারো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখে আয়না স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।

” বাবা তুমি কি এখনো রাগ করে আছো?”

আদিব শাহরিয়া মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

” মোটেও না।আমার উচিত ছিলো তোর উপর জোড় না করা।ক্ষমা করে দিস আমাকে মা।”

বাবার কথা শুনে আবেগি হয়ে ওনাকে জরিয়ে ধরলো আয়না।বাবা-মেয়ে বেশ অনেকটা সময় কথা বললো।ইয়াসিন কিছুক্ষণ দাড়িয়ে চলে যাবে কিন্তু আদিব সাহেব তাকে থাকতে বললেন।খানিক সময় পর তাদের দু’জনকে একা রেখে চলে গেলো আয়না।আদিব সাহেব গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিলেন।

চা-বিস্কুট এনে আয়নার পাশে বসলো পালক।

” তো ননদজী কেমন চলছে দিনকাল?এতোদিন পর তাহলে আমাদের কথা মনে পড়লো।”

” আরে আপু আর বলোনা।আমার জুতো চো’র স্বামী না এলে আমি কি আসতে পারি।”

” তোমরা এতোদিন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করলে অথচ আমি যখনই দেখতাম তোমরা ইঁদুর বিড়ালের মতো ঝগড়া করছো।”

” হাহাহা…..আমরা ইচ্ছে করেই করতাম।শোন আপু তোমাকে একটা কথা বলি।অন্যের কাছে শোন তার আগেই আমি বলেদি।খারাপ ভাবে নিও না।” আয়নার দিয়ে ভ্রু-কুচকে তাকালো পালক।

” আসলে রাদ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার ভাবনা ছিলো কিন্তু মাঝে তোমাদের হুট করে বিয়ে হয়ে যায়।এটা আমি আগে জানতাম না।আমার বিয়ের দিন জানতে পারি।আমাকে খারাপ ভেবোনা আপু।রাদ ভাইকে আমি ছোট থেকেই নিজের ভাই ভেবে এসেছি,আমি তাকে কোনদিনও অন্য দৃষ্টিতে দেখিনি।ভুল বুঝোনা আমাদের আর রাদ ভাইকেও বলোনা।যদি সে জানতে পারে আমি এবং তুমি এটা জানি তাহলে অনেক অস্তিত্বকর পরিবেশ তৈরি হবে।”

আয়নার কথা শুনে পালক থম মেরে বসে রইলো।
.
.

” আমার মেয়ের ঠিকঠাক যত্ন নিচ্ছো তো?আমার মেয়ের কোন ধরণের অযত্ন হলে কিন্তু তোমার থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনতে আমার বেশি সময় লাগবেনা।খরচের সমস্যা হলে আমাকে বলবে,আমি টাকা পাঠিয়ে দেবো।কিছুদিন অপেক্ষা করো আমি একটা বড় বাড়ি উপহার হিসেবে দেবো।আমি চায়না আমার মেয়ে ছোট একটা ফ্ল্যাটে থাকুক।”

মাথাটা হালকা নুয়ে হাসলো ইয়াসিন।মাথা তুলে আদিব সাহেবের চোখে চোখ রেখে বললো,

” আমার হয়তো মাসে লক্ষ টাকা আয় নেই কিন্তু যা আছে তাতে আমাদের চারজনের খু্ব ভালো করেই চলে যায়।হয়তো প্রতিদিন আমি তাদের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার খাওয়াতে পারবোনা তবে মাসে একবার বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবো।আমার কাছে হয়তো অনেক বড় বাড়ি নেই কিন্তু যেই ফ্ল্যাটটা আছে ওটাও বেশ ভালো।সবচেয়ে প্রশান্তির কথা সেটা আমার নিজের কষ্টের টাকায় কেনা।আমার বিশ্বাস আয়না কখনোই আমাদের সামর্থের বাইরে কিছু করবে।তার থেকেও বড় কথা সেই ফ্ল্যাটে আয়না দু’জন ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে।আমি কিংবা আমার মা-বাবা কখনোই আয়নাকে কষ্ট দেবোনা,ভালোবাসা চাদরে মুড়ে রাখবো তাকে।চিন্তা করবেন না,আপনার কাছে যতটুকু ভালো ছিলো তার থেকে কোন অংশে কম ভালো থাকবেনা সে।আর ধন্যবাদ তবে আমি আর যাইহোক আপনার থেকে কিছু চায়না।

কয়েক সেকেন্ড আদিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো ইয়াসিন।আদিব শাহরিয়া বিছানা বসলেন এবং কিছু ভাবতে লাগলেন।
.
.

ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে অয়ন।কয়েকমাস হচ্ছে একটা চাকরিতে ঢুকেছে সে,যদিও বা নিজের যোগ্যতা থেকেও বেশি বাবার সাহায্যে।রুমে ঢুকতেই অয়ন দেখলো দীপ্তি আলমারিতে কিছু করছে।

” আলমারিতে কি খুজঁছো তুমি?আর চাবি কোথায় পেলে?”

” ও তুমি এসে পড়েছো।যাও ফ্রেশ হয়ে এসো,ব্যাগটা আমাকে দাও।” দীপ্তি ব্যাগ নেওয়া উদ্দেশ্য হাত বাড়ালো তবে অয়ন ব্যাগ সরিয়ে নিলো।দীপ্তির হাত থেকে চাবি নিয়ে আলমারি বন্ধ করে দিলো।ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে মেড়ে বললো,

” আমি না থাকলে আর কখনো আলমারি খুলবে না।যা দরকার আমি বাড়িতে এলে নেবে।”

আলমারির চাবি সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো অয়ন।থমথমে মুখ দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তি।অয়নের কথা শুনে রা’গে গা জ্ব’লে যাচ্ছে তার।

চলবে…….