#তোমার_মাদকতায়_আচ্ছন্ন
#তানজিলা_খাতুন_তানু
(পর্ব_৩০)
মনিকা ঘামতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। ফারাবির মুখের কোনো তাচ্ছিল্যের হাসি।
– মনি আবার কি করেছে (ফারাবির মা)
– সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করো। আমি ভাবতে পারছি না একটা মেয়ে এতটা নীচে কিভাবে নামতে পারে। আর মনিকা তুই তো জানতিস ভালো করেই তুহা আমার জন্য ঠিক কতটা দামী তুই কিভাবে পারলি আমার প্রানভোমরাকে মৃ/ত্যু/র দিকে ঠেলে দিতে। তোকে আমি বন্ধু ভাবতাম এটা ভাবতেই আমার ঘৃনা লাগছে।
মনিকা মাথা নীচু করে আছে। সকলেই প্রশ্ন করছে মনিকা কি করেছে।
– সেদিন তুহাকে কেউ ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরে দিয়েছিলো। আর সেটা আর কেউ নয় মনিকা।
সকলেই চমকে উঠলো এইরকম কথা শুনে।
– মনিকা এটা তুই করেছিস ছিঃ (ফারাবির মা)
– আন্টি আমাকে মাফ করে দাও,আমি ফারাবিকে ভালোবাসি আর সেইজন্যই।
– মনিকা ভালোবাসা মানেই তাকে পেতে হবে এরকম কোনো মানে নেয়। ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষটিকে ভালো থাকতে দেখা বুঝলি।(ফারাবি)
মনিকা মাথা নীচু করে আছে।
– মনিকা তুই একটা জঘন্য কাজ করেছিস। তোর জন্য আমি আর তুহা সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম তোকে তো এর শাস্তি দিতেই হবে,আমি তোকে পুলিশে দেবো। (ফারাবি)
ফারাবির কাছে মনিকা রিকুয়েস্ট করছে। ফারাবি নাছোড়বান্দা।
– ওনাকে পুলিশে দেবেন না প্লিজ(তুহা)
তুহার কথা শুনে সকলেই চমকে উঠলো।
– এইসব কি বলছো তুহা।(ফারাবি)
– হ্যা ঠিক বলছি, মনিকা দিকে পুলিশের কাছে দেওয়া মানে ওনার পরিবার সাথে আমাদের পরিবারেরই অসম্মান হবে। সকলের নিজের মানুষদের প্রতি বিশ্বাস উঠে যাবে এটা আমাদের কারোর পক্ষেই ভালো হবে না আর তাছাড়া মনিকা দি ওনার মা বাবার একমাত্র সন্তান তাই আমি চাই না কোনো পরিবার সন্তান হারা হোক।আর আমাদের তো এটা নিয়তি ছিলো তাই হয়েছে এতে কারোর কোনো হাত নেয়।
তুহার শিক্ষা আবারো সবাইকে মুগ্ধ করলো। ফারাবী মুগ্ধ নয়নে তার তাহু পাখিকে দেখতে লাগলো। মনিকা তুহার কাছে মাফ চাইলো,তুহা মাফ করে দিয়েছে হয়তো মন থেকে নয়,মুখেই মাফ করেছে,আঘাতটা কখনোই ভোলার নয় আর তুহা কখনোই ভুলতে পারবে না। কিন্তু প্রতিহিংসা মনে রাখলে পৃথিবীতে আর কোনো ভালো কিছু থাকবে না।
মনিকাকে কেউ ক্ষমা করেনি, মনিকার সাথে এই পরিবারের সদস্যদের সব সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে।কালকে কুহু আর কাব্যের হলুদের অনুষ্ঠান তাই সকলেই সেইদিকে মনোযোগ দেয়।
তুহা বারান্দায় বসে আছে,ফারাবি ওর পাশে বসে বললো…
– সত্যি কি তুমি মনিকাকে মাফ করে দিয়েছো।
– না।
তুহার সোজাসুজি উত্তর শুনে ফারাবি চমকালো না। ফারাবি তুহাকে ভালো করেই চেনে, তাই তুহার প্রতিটা কাজের কারন সহজেই বুঝতে পারে। তবুও বললো…
– তাহলে কেন সবার সামনে ক্ষমা করে দিয়েছে বললে ।
– আমি চাই মনিকা দি শুধরে যাক। নতুন করে শুরু করুক জীবনটা আর তার জন্য আমার ক্ষমাটা ওনার প্রয়োজন ছিলো। আমি জানি মনিকা খারাপ নয় ওহ তোমাকে ভালোবাসতো আর তুমি আমাকে তাই প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে আমাকে আঘাত করেছে।
– সবাই তোমার মতো ভাবলে এত হিংসা, মারামারি থাকতো না।
– হুম।
পরেরদিন, কুহুকে হলুদ শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। মিহা,মেধা,তুহা সবাই খুব খুশি। তুহাকে হাসতে দেখে ফারাবি মুচকি হাসলো।
– দাদাই।
– আরে কাব্য বল।
– দাভাই আমার খুব ভয় লাগছে আমি কি তোমার মতো করে খুশিকে আগলে রাখতে পারবো।
– ভাই ভয় করিস না। সকল পুরুষের মাঝেই একটা দায়িত্ব বোধ থাকে সেটা সময়ের সাথে সাথে ঠিক প্রকাশিত হয়।
– তবূও হয়তো তোমার মতো পারবো না।
– ভালোবাসতে জানলে সবকিছুই হয়, আমরা মানুষরা সবাই এক নয় ঠিক তেমনি আমাদের প্রকাশ ভঙ্গিও এক হয় না। সবাই সবার অনুভূতি অন্য ভাবে প্রকাশ করি। তুই ও পারবি নিজের উপরে আর খুশির উপরে সবসময় ভরসা আর বিশ্বাস রাখবি তাহলেই সবকিছুর সমাধান পেয়ে যাবি।
সমস্ত অনুষ্ঠান ভালো ভাবেই শেষ হয়ে যায়। আজকে কাব্য+খুশি, কুহু+আতিফের বিয়ে। সকলেই হইচই করছে। বিয়েটা একসাথেই ভেন্যুতে হচ্ছে।
মেধা একা দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে,তখনি আশিক ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো…
– কী ম্যাম একা একাই সেলফি তুলছেন আমাকেও একটু নিন।
আচমকা এইরকম কথা শুনে মেধা চমকে উঠলো। মেধা প্রথমে ভেবেছিলো কোনো ফালতূ ছেলে পেছনে ঘুরে আশিককে দেখে চমকে উঠলো।
– আপনি কথাটা বললেন।
– কেন বলতে পারি না বুঝি।
– না সেরকম কিছুই না।
– আচ্ছা আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি। আসলে কি বলো তো আমার দুই বন্ধুর বিয়ে আমি একাই আছি তাই।
– আপনার বোনের ওহ তো বিয়ে।
– হুম।
– দাদা না গাধা কে জানে (বিরবির করে মেধা)
– কিছু বললে।
– না তো।
– ওহ।
– জ্বি।
– তা কবে বিয়ে করবে।
– বিয়ে দেখি কবে ভাগ্যে আছে,ছোটগুলোর তো বিয়ে হয়েই গেলো।
– আমাকে করবে।
– কি বললেন(একটু জোরেই)
– আরে ফান করলাম এতটা রিয়াক্ট করার কি আছে।
– যতসব।
মেধা রাগ দেখিয়ে চলে যায়। আশিক বেচারা কিছুই বুঝতে পারলো না কি থেকে কি হলো।
বিয়ে পড়ানো শেষে,বিদায় পর্বে কুহু প্রচন্ড রকমের কান্নাকাটি করতে থাকে। কাব্য তো বোনকে ধরে কেঁদেই চলেছে আর ফারাবি এককোনো দাঁড়িয়ে ভাই বোনের ভালোবাসা দেখছে।
– দাদাই।
কুহু কাব্যকে ছেড়ে ফারাবিকে জড়িয়ে ধরলো।
-দাদাই একবারো আমার কাছে আসলে না আমি কি তোমার এতটাই পর হয়ে গেছি।
-নারে বোন,তুই তো আমার আদরের ছোট কুহু তোকে কিভাবে পর করে দেবো বল।
-তাহলে আসলে না কেন?
-তোদের দুই ভাই বোনের ভালোবাসা দেখছিলাম।
-আর আমি বুঝি তোমার বোন নয়।
-হুম বোন তো।
কুহু সকলকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় শশুর বাড়িতে। চৌধুরী বাড়ির সকলের মনের অবস্থা ভালো নয় কিন্তু কিছু করার নেয় নতুন বউকে তো বাড়িতে নিয়ে যেতেই হবে। খুশিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
খুশিকে তুহা বসিয়ে দিয়ে চলে গেছে,কারোরই মনের অবস্থা ভালো নেয় তাই কেউ আর রাত জাগছে না। খুশি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে কাব্যের সাথে বিয়ের পর থেকেই অনেকটা ক্লোজ হয়ে গেছে। কথাবার্তা হতো ওদের মাঝে।
কাব্য ভেতরে ঢুকে খুশিকে ফ্রেশ হতে বললো,তারপরে দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করলো।
– কেমন লাগছে আমার পরিবার।
– ভালো না লাগার কোনো কারন নেয় তো।
– আর আমাকে।
– জানি না আমি।
– তাই ।
– হুম।
কাব্য খুশির দিকে আগাতে থাকে। খুশি পেছাতে শুরু করলো।
– আপনি আগাচ্ছেন কেন?
– তুমি পেছাচ্ছো কেন?
খুশি দেয়ালের সাথে ঠেসে যায়। কাব্য খুশির কানের কাছে ফিসফিস করে বললো…
– ভালোবাসি খুশি। তোমার মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি আমি। তোমার সাথে নিজেকে মিশিয়ে পূরন হতে চাই।তুমি কি রাজি।
খুশি কাব্যকে জড়িয়ে ধরলো। কাব্য মুচকি হেসে খুশিকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে চলে গেলো। পূর্নতা পেলো আরো একটা মিষ্টি প্রেমের সম্পর্ক।
ওইদিকে..
কুহু মাথায় এতো বড়ো একটা ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে আছে। আতিফের সাথে আগে ফোনে কথা হলেও মনের কোনো একটা ভয় জমা হয়েছে। দরজা খোলার শব্দে ভয়টা আরো তীব্রতর হলো,কুহু বিছানার চাদরটা শক্ত করে চেপে ধরলো।
– কুহু।
– জ্বি বলুন।
– বর ঘরে আসলে সালাম দিতে হয় এটা জানো না।
কুহু জিভ কাটলো, ভয়ের চোটে ভুলেই গিয়েছিলো কথাটা।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম বউ।
আতিফের বলা বউ কথাটা কুহুর মনের ভিতরে আলাদা একটি কম্পন শুরু করলো।
– যাও এখন ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপরে দুজনে নামাজ পড়বো।
আতিফ আর কুহু ও দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলো।
– কী চাইলে আল্লাহ তায়ালার কাছে।
– বলবো কেন?
– ঠিকাছে বলতে হবে না। আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথার উত্তর দাও তুমি কিভাবে জানলে আমি তোমাকে আগে থেকেই পছন্দ করি।
– সেদিন যখন দিভাইকে দাদাভাই আপনার বিষয়ে বলছিলো তখন আমি শুনেছিলাম সবটা।
– তো মিসেস আপনি যখন সবটাই জানেন তখন আর কি বলবো।
– প্রোপজ করুন আমাকে।
– কী?
– হুম কথা না বাড়িয়ে চালু করুন তাড়াতাড়ি।
– আচ্ছা।
আতিফ নিজের মনেই বিরবির করে বললো…
– এ কাকে ভালোবেসেছি আমি।
– কি হলো কি বিরবির করছেন প্রোপজ করুন।
– করছি।
আতিফ কুহুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের হাতটাকে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো…
– ভালোবাসি কোকিল কন্ঠী। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার গোটা পৃথিবীটাই থমকে গিয়েছিলো মনে হয়েছিলো আমি অন্য জগতে আছি। তোমার প্রতি দূর্বলতা থেকে তোমার মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পরি আমি। আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে আজ তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমাকে আমার সাথে জুড়ে দিতে চাই দুজন মিলে একাকার হতে চাই তুমি কি রাজি আছো।
কুহু আতিফের দিকে নিজের হাত এগিয়ে দিলো। আতিফ তার কোকিল কন্ঠী কে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিলো।
১ মাস পর…
তুহা নিজের বাপের বাড়ি ঘুরতে এসেছে। মিহা ওর সাথে ভালো করে কথা বললেও মনটা কিরকম ভার হয়ে আছে তুহা সবটাই খেয়াল করলো কিন্তু সবার সামনে কিছুই বললো আ সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলো। ওর মা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেই তুহা মিহাকে চেপে ধরলো…
– কি হয়েছে তোর।
– কিছুই হয়নি।
– মিহা আমাকে বলবি না তো বোন।
মিহার কথা শুনে তুহা চমকে উঠলো।
#চলবে…
#তোমার_মাদকতায়_আচ্ছন্ন
#তানজিলা_খাতুন_তানু
(পর্ব_৩১)
তুহা চমকে উঠে অবাক দৃষ্টিতে মিহার দিকে তাকিয়ে আছে। মিহা ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে।
– মিহা তুই এতটা শান্ত কীভাবে?
– দিভাই আমার বিশ্বাস আমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তো আমার কাছে ঠিক ফিরে আসবে।
তুহা মুগ্ধ হলো মিহার কথাতে নিজের ভালোবাসার প্রতি ঠিক কতটা বিশ্বাস থাকলে কথাটা মানুষ বলতে পারে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না। মিহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। ছোট আদরের বোনটা এতটা কষ্ট পেতে দেখেও কিছু করতে পারছে না এটা ঠিক কতটা পীড়া দিচ্ছে সেটা একমাত্র তুহাই জানে।
মেহতাব দেশের বাইরে চলে গেছে, সবাই জানে মেহতাব কাজের সূত্রে দেশের বাইরে গেছে কিন্তু মিহা জানে মেহতাব কেন গিয়েছে।
– দিভাই তুই ভেঙ্গে পড়লে আমাকে শক্তি দেবে কে?
– হুম।
– দিভাই আমাকে সাহস দে না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই ওনার যোগ্য তৈরি করতে চাই।
– দেখিস বোন মেহতাব দা ঠিক তোকে ভালোবাসবে।
– হুম।
সময় বহমান কেটে যাচ্ছে নিজের গতিতে, মেধা আর আশিকের মাঝে একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। হয়তো কিছুসময়ের অপেক্ষা প্রনয়ের।
মিহা নিজের পড়াশোনাতে ফোকাস শুরু করেছে, কুহু আতিফের সাথে আর কাব্য খুশির সাথে সুখেই আছে। তুহা একটা চাইল্ড কেয়ার হোম চালাচ্ছে,ফারাবির ফুল সার্পোট আছে সবকিছুতেই। তিশা আর অয়ন তাদের ছেলে শাওনকে নিয়ে সুখেই আছে।
ফারাবি অফিসের কাজ করছে, হঠাৎ একটা আননোন নম্বর থেকে ওর কাছে ফোন আসলো…
– হ্যালো।
– হ্যালো আপনি কি ফারাবি চৌধুরী।
– জ্বি।
– আপনি এখুনি … হসপিটালে আসতে পারবেন।
– কিন্তু কেন,, কী হয়েছে?
– ডক্টর .. আপনার সাথে কথা বলতে চাই।
ডক্টরের নাম শুনতেই ফারাবির মনে পড়লো তুহার ট্রিটমেন্ট ওই ডক্টরই করেছে। হয়তো বিশেষ কিছু প্রয়োজন তাই ডেকেছে ফারাবি সময় নষ্ট না করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
হসপিটালে গিয়ে রিসেপশনে ফারাবি জিজ্ঞাসা করলো…
– ডক্টর.. কোথায় আছেন?
– ৩০১ নম্বর কেবিনে আছে।
ফারাবি কথামতো কেবিনে ঢুকে চমকে উঠলো। ডক্টরের হাতে স্যালাইন, মুখে মাক্স দেওয়া,মাথাতে,হাতে ব্যান্ডেজ করা আছে। ফারাবি নিজের মনেই প্রশ্ন করলো, ডক্টরের কী এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে,আর যদি হয়ে থাকে তাহলে আমাকে ডাকলো কেন? নিজ মনে প্রশ্ন করেও উত্তর মিললো না। তাই অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেলো।
– ডক্টর!
ফারাবির কন্ঠস্বর শুনে উনি চোখ খুললেন। মুখে একটা হাসির রেখা দেখা গেলো। মুখের মাক্সটা খুলতে যেতেই পাশ থেকে নার্স বললো…
– স্যার ওটা খুলবেন না।
নার্সের কথা না শুনেই উনি মাক্সটা খুলে ফেললেন।
– স্যার আপনি।
– একজন ডক্টর হিসাবে আমার ধারনা আছে আমি কী করছি। তুমি এখন যাও মিষ্টার চৌধুরীর সাথে আমার কিছু কথা আছে। ( মৃদু স্বরে ডক্টর)
নার্স আর কিছুই বলতে পারলো না, নিঃশব্দে কেবিন ত্যাগ করলো। ফারাবি কিছুই বুজতে পারছেনা হতভম্ব হয়ে আছে।
– আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন আমি কেন আপনাকে এখানে আসতে বললাম তাই তো।
– হুম।
– আমার আপনার সাথে কিছু দরকারী কথা ছিলো।
– আমার সাথে কি কথা।
– সেদিন আপনার ওয়াইফের অসুস্থতায় আমি আপনার চোখে যে আকুলতা, অধৈর্য দেখেছিলাম একদিন সেই পরিস্থিতিতে আমিও পড়েছিলাম জানেন।
ডক্টরের কথা শুনে ফারাবির কপালে ভাঁজ পড়লো।ডক্টর ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল…
– একটা সন্তানের জন্য কতকিছুই না হয়। কারোর সংসার ভাঙ্গে,কারোর সংসার জুড়ে যায় আবার কেই সঙ্গীহীন হয়ে পড়ে।
– ডক্টর আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলবেন।
– গল্পটা আমাদের মানে আমি আর আমার স্ত্রী পৃথার। আপনি কী শুনবেন।
ফারাবি ডক্টরের করুন আকুতি ভরা কন্ঠটা উপেক্ষা করতে পারলো না। মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালো,ডক্টরের মুখে হাসি ফুটে উঠল,তিনি মৃদু হেসে বললো…
– মেডিকেল পড়ার সময়ে পৃথার সাথে আমার প্রনয় ঘটে। পৃথা বড়োলোক বাড়ির আদরের মেয়ে আর আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে,বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলে ডক্টর হবে তাই তার সবটা দিয়ে আমাকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছিল, ভালোই চলছিলো পৃথাও সবটা জেনে আমাকে ভালোবাসতো কিন্তু এতটা ভাগ্যবান মনে হয় আমি নয় একটা এ*ক্সি*ডে*ন্টে মা বাবা দুজনেই আমাকে একা করে চলে যায়, ততদিন আমার মেডিকেল পড়া শেষ হয়ে গেছে কিছুদিন পরেই লাইসেন্স পাবো, বাবা মা আমার ডাক্তার হওয়াটা দেখতে পারলো না। খুবই ভেঙে পড়েছিলাম পৃথা আমার সার্পোট করেছিলো আমাকে শক্ত করেছিলো আমি নিজের কাজে ফোকাস করি,একজন ডক্টর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ি। তারপরে সিদ্ধান্ত নিই পৃথা আর আমি বিয়ে করবো,ওর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠালে কেউই না করেনি , পৃথা আর আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাই।
ডক্টর চুপ করে গেলেন। ফারাবি উৎসূক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পরেরটা শোনার জন্য। ডক্টর আবারো বলতে শুরু করলেন…
– একদিন পৃথার বাড়ি থেকে খবর আসে পৃথার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পৃথা আর আমি ওখানে গিয়ে দেখি সবটা শেষ হয়ে গেছে পৃথা ওর বাবাকে খুব ভালোবাসতো বাবার শোকটা কাটাতে না কাটাতে আবারো একটা ধাক্কা আসে ওর জীবনে জীবনের সবথেকে বড়ো সত্যির মুখোমুখি হতে হয় ওকে, বাবার মৃ*ত্যু*র পরেই সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি হয়,পৃথা এইসবে খুব বিরক্ত ছিলো তাই বাড়িতে গিয়ে সবাইকে বোঝাতে চাই…….
– এইরকম করছো কেন তোমরা মাত্র কিছুদিন হলো বাবা নেয় আর এর মধ্যেই তোমরা অশান্তি করছো।(পৃথা)
– এই পৃথা তুই চুপ কর আমাদের পরিবারের বিষয় আমরা বুঝে নেবো তোকে এইসবে নাক গলাতে হবে না।(পৃথার বড়দাদা)
– বড়দা তোমাদের পরিবার মানে কি এটা তো আমারও পরিবার তাই আমি কথা বলবেই। আর যদি সম্পত্তির ভাগ হয় তাহলে ৫ ভাগে ভাগ হবে।
– ৫ ভাগে ভাগ মানে?( পৃথার ছোটো দাদা)
– হ্যা পাঁচ ভাগেই। বড়দা,ছোটদা, বোনু, মা আর আমার। আমার ভাগটা অনাথ আশ্রমে ডোনেট করবো আমি বলে দিচ্ছি।
– এই পৃথা তোর ভাগ মানে কী তুই তো আমাদের কেউই নয় তোকে আমরা কেন আমাদের বাবার ভাগ দেবো।(বড়দা)
– মানে কি সব বলছো বড়দা।
– মা আমাকে মাফ করো আমি আর সত্যি টা লুকিয়ে রাখতে পারছি না। (বড়দা)
পৃথা ওর মায়ের দিকে তাকালো উনি কাপড়ে মুখ গুঁজে কাঁদছেন।
– কী সত্যি বলো আমাকে।
– সত্যি হলো এটাই তোর সাথে আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেয় তোকে বাবা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিলো।
পৃথা কথাটা শুনে এক পা পিছিয়ে যায়। জীবনের এতবড়ো সত্যি টা কে বা মেনে নিতে পারো, যাদের এতগুলো বছর বাবা,মা দাদা,বোন ভাবতো তারা আসলে ওর নিজের কেউ নয়। ওহ একজন অনাথ।।
– মা বড়দা কি বলছে এসব।
– হ্যা মা। তবে তোকে আমরা কখনোই ওটা ভাবিনি আমি আর তোর বাবা সবসময় তোকে আমাদের নিজের মেয়ে ভেবে এসেছি। তুই তো জানতিস তোর বাবা তোকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।(মা)
– মা তোমার নাটক বন্ধ করো, আমার আর ভাইয়ের সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দাও। (বড় দা)
– সম্পত্তির ভাগ বোঝানোর কোনো কথাই নেয় তোর বাবা সবটা আগে থেকেই ঠিক করে গেছে।
– মানে? (ছোটদা)
– তোর বাবা সম্পত্তি যে যার নামে করে দিয়ে উইল করে দিয়েছেন। তিনি ভালো করেই জানতেন ওনার ছেলেরা কেমন।
– মা(বড়দা)
– গলা তুলে লাভ নেয়।সবটা মানতে পারলে তোরা সম্পত্তি পাবি আর নাহলে কিছুই পাবি না।
– আচ্ছা আমাদের উইলটা দাও।
পৃথার মা উইলটা ওনার ছেলেদের কাছে দিলেন। উইলটা দেখে ওনারা চমকে উঠলো।
– মা এসব কি এখানে তো পৃথার নামে আমাদের সবার থেকে বেশি সম্পত্তি আছে।
– আমি এসবের কিছুই জানি না। যে যার ভাগের জিনিস বুঝে নাও।
পৃথার দুই দাদা রেগে চলে যায় ওখান থেকে। পৃথা আর ছোটবোন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
– মা আমার কিছুই লাগবে না।
– মারে তোর বাবা তোর নামে দিয়েছে এটা না নিলে তোর বাবার অসম্মান হবে।
– মা আমাদের তো কম কিছু নেয় তাই আমি চাই আমার ভাগের সবটা দিয়ে সাধারন মানুষের জন্য কিছু করতে।
– আচ্ছা তাই করিস মা।
– দিভাই আমি এখানে থাকবো না। দাদারা এতটা খারাপ আমি ভাবতেই পারিনি।
– বোন তোদের এখানে থাকতে হবে না। তুই পড়াশোনার জন্য বাইরে যাবি মানুষ হয়ে ফিরে আসবি আর মা আমার কাছে থাকবে।
– না মা সেটা হয়না। আমি বরং আমাদের অনাথ আশ্রমে শিশুদের কাছেই থাকবো।
পৃথা চেষ্টা করেও মাকে আমাদের কাছে আনতে পারেনি উনি অনাথ আশ্রমেই থাকতো। পৃথার বোন পড়াশোনার জন্য বাইরে চলে যায় ওর দাদারা আর কারোর সাথেই যোগাযোগ রাখেনি। পৃথা আর আমার ছোট পরিবারে আনন্দের খবর আসে আমরা মা বাবা হতে চলেছি পৃথা আর আমি খুব খুশি থাকি। কিন্তু…
এটুকু বলেই ডক্টর চুপ করলো। ফারাবি সবটা শুনে থমকে গেছে। সমাজের অবনতি কিভাবে ঘটেছে,বাবার মৃ**ত্যু** হতে না হতেই সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগি এ আমার কোন সমাজে বাস করছি।
– তারপরে কি হয়েছিলো আপনার স্ত্রীই বা কোথায় এখন?
ডক্টর যেটা বললো সেটা শুনে ফারাবি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
#চলবে…