#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ১৪ ও ১৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
মুখের আদলে বিষাদ আর বেদনার্ত ছাপ তুলে তূবার পানে চেয়ে রইলো অপলক, অনিমেষ। তৃষ্ণার্ত, পিপাসার্ত চক্ষের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে ফয়সাল। এতোদিন পরে তূবাকে চক্ষের সম্মুখে দেখে বুক কাঁপছে তার। চক্ষুর চেয়েও তার প্রশস্ত বুকটা আরো পিপাসাকাতর হয়ে উঠলো। স্থির, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ফয়সাল।
নিজের প্রিয় মানুষটার এমন বিধ্বস্ত, বিষন্ন, শ্রান্ত, জরাজীর্ণ চেহেরা দৃষ্টি গোচরীভূত হতেই অন্তর্দেশ মোচড় দিয়ে উঠে তূবার। বার কয়েক পলক ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। দৈবাৎ হৃদগহীনে সূচিত হওয়া প্রকান্ড ঝড়ের রেশ, আভাস মুখে টানলেই সম্মুখের মানুষটা সেই ঝড়ের অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে।
আর্তনাদের স্বর স্ফুরিত হলো ফয়সালের কন্ঠনালী দিয়ে,
‘তুমি কি সত্যি আমার থেকে দূরে চলে যাবে?’
সম্বিত ফিরে পেলো তূবা। ফয়সালের দিকে স্থবির, স্তিমিত, নিমিষহারা চাহনি নিক্ষেপ করলো।
‘এক কথা বার বার বলতে ইচ্ছে করে না আমার। আমি আমার সিদ্ধান্ত বহু আগেই জানিয়েছি তোমাকে।যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সেই সম্পর্কের বাঁধনে থাকার মানেই হয় না।’
র’ক্তশূন্য হয়ে এলো ফয়সালের চেহেরা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিও না। তোমার শূন্যতা আমাকে এই কয়দিনে একেবারে শেষ করে দিয়েছে।’
কিন্তু বলতে পারলো না কিছুই। অসহায় নেত্রে চেয়ে রইলো। জড়িয়ে যাওয়া গলায় বলল,
‘একটু ফারিয়া কে এখানে নিয়ে আসবে? আমার মেয়েটাকে কতদিন দেখি না।’
ভাবান্তর হলো না তূবার। কঠিন মুখে বলল,
‘ফারিয়াকে দেখে কি করবে? ওর সাথে তো তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
একরাশ অসহায়ত্ব ভর করলো ফয়সালের মুখশ্রীতে। মলিন হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে লকেটযুক্ত একটা চিকন সরু চেইন বের করে টি-টেবিলের ওপর রাখলো।
‘পছন্দ হয়েছে বলে ফারিয়ার জন্য নিয়ে এসেছি। ওর গলায় এটা পড়িয়ে দিও।’
ভাবলেশহীন তূবা পুনশ্চ বলল,
‘নিয়ে যাও ওটা। আমার মেয়ে অপরিচিত কারো দেওয়া জিনিস ব্যবহার করে না।’
ফয়সাল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনে দন্ডায়মান কঠিন, শক্ত মনের মানবীর দিকে।
‘ফেলে দিও।’ বলেই পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে। দু’কদম এগিয়ে গিয়েও আবার পিছু ফিরে তাকালো।
‘আমি এক পরাজিত সৈনিক। তবে আমিও আমার সিদ্ধান্তে অনড়।মাথায় রেখো কথাটা।’
আর দাঁড়ালো না ফয়সাল।বড় বড় কদম ফেলে চলে গেলো। ফয়সালের যাওয়ার পানে ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো তূবা।
_______________________
‘হে গো নাযীফাহ কে কি বাড়ি তে আসতে বলবে?’
ফাহমিদা বেগমের কথায় শুনে সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকায় খালেদ মোশাররফ। আসলেও মেয়েকে বললে কি বাড়িতে আসবে? চিন্তিত স্বরে বললেন,
‘বলেই দেখি না কি বলে ও। এভাবে কি আর জীবন পার করা যায়? মেয়েটাকে ভালো পাত্রস্থ করতে পারলে ম’রেও শান্তি পেতাম।’
তপ্ত শ্বাস ফেলে ফাহমিদা বেগম বলেন,
‘ফোন করো একটা।’
মাথা দুলিয়ে মেয়ের নাম্বারে ফোন লাগায় খালেদ মোশাররফ।
বহুদিন পরে গায়ে শাড়ি জড়ানোর শখ হয় নাযীফাহ’র। দু’প্যাঁচ দিয়ে শাড়ির টেনে বসে অসহায় হয়ে বসে রইলো সে। শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক করতে গেলে এবড়োখেবড়ো হয়ে যাচ্ছে। অকস্মাৎ নাযীফাহ’র মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে থাকা বাবার নামটা দেখে মুখের বিরক্তির রেখা সরে গিয়ে অধর কোণে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। শাড়ি প্যাঁচানো অবস্থায় উঠে দাঁড়াল। মোবাইল রিসিভ করে কানে ধরে রুমের জানালা খুলে দিলো। এক দলা স্নিগ্ধ শীতল পবন গাঁ ছুঁয়ে দিলো নিবিড়ভাবে।
‘কি করছো বাবা?’
বাবা মেয়ের ভালোমন্দ খোঁজ খবর নেওয়া চলল কিছুক্ষণ। আচমকা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন খালেদ মোশাররফ। বাবার একেবারে নীরব হয়ে যাওয়ায় কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র।
‘কি হয়েছে বাবা একেবারে চুপ হয়ে গেলে কেন?’
আমতা আমতা করতে লাগলেন খালেদ মোশাররফ। পাশে বসে থাকা ফাহমিদা বেগম তাগাদা দিতে লাগলেন কিছু একটা বলার জন্য।
‘বাবার একটা শেষ কথা রাখবি, মা? এটাই শেষবার আর কখনো এই বিষয়ে তোকে কোনো কথা বলবো না?’
কুঁজিত হওয়া কপাল যেন আরো কুঁজিত হলো নাযীফাহ’র।
‘কি কথা বাবা?’
ঢুক গিলে নিজের শুষ্ক কণ্ঠনালী ভিজিয়ে নিলেন খালেদ মোশাররফ।
‘তুহিন একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। ছেলেটা ওর পরিচিত। কলেজের প্রভাষক। তুই কি একবার বাড়ি আসবি? ওরা তোকে একবার দেখবে।’
আনমনে বলল, ‘তুহিন ভাই?’
‘হ্যা, তুহিন নিয়ে এসেছে। আসবি মা একবার?’
পূর্বে বাবার অপমানিত হওয়া মুখ চক্ষে ভাসতেই আঁতকে উঠল নাযীফাহ। বাবার জন্য বুক ফেটে যায় তার।
‘কি দরকার বাবা? এসবের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানে আবারও যেচে অপমানিত হওয়া। বাবা, আমাকে কেউ কথা শুনাক তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাকে কেউ কিছু বললে আমার কলিজা ফেটে যায়। এভাবেই তো ভালো আছি। শুকিয়ে যাওয়া ঘা কেন আবারও নতুন করে জ’খ’ম করছো? তোমাকে কেউ কিছু বললে আমার সহ্য হয় না বাবা। অপদার্থ মনে হয় নিজেকে।’
চোখদুটো ছলছল করে উঠলো খালেদ মোশাররফের। উনার মেয়েটার এতো দুঃখ কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি আজও খুঁজে পাননি। ধরা গলায় বললেন,
‘এটাই শেষবার মা। আসলে আমি বাবা তো। সন্তানের সুখটাই আমার কাছে মুখ্য। কে কি বলল বাবারা এসব তোয়াক্কা করে না। আজ যদি আমি চোখ বুঁজি তোকে দেখার কেউ থাকবে না। আমি থাকতেই তো তোকে,,,,,, ‘
আর কিছু বলতে পারলেন না খালেদ মোশাররফ। কথাগুলো দলা পাকিয়ে আটকে গেলো গলায়। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ব্যর্থতার অশ্রু। মুখে আঁচল চেপে নৈঃশব্দ্যে কাদঁছেন ফাহমিদা বেগম। হুট করেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো। জীবনতরী যে তীর খুঁজে পাচ্ছে না। মাঝ নদীতে ভাসছে তো ভাসছেই।
_____________________
‘কেমন আছেন, মা?’
বহুদিন পরে তূবার কন্ঠস্বর শুনে বুকের মাঝে শূন্যতা অনুভব করলেন রাশেদা খাতুন। এই মেয়েটাই বাসা মাতিয়ে রাখতো। মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করতে থাকা বাসাটায় একবার চোখ বুলালেন তিনি।
‘যেমন থাকার কথা ছিলো তেমনই আছি।’
মনটা খারাপ হয়ে গেলো তূবার। শোনা গেল তার বিষন্ন স্বর।
‘আপনি ঠিকমতো ঔষধ খান তো? ইনসুলিন কে দিয়ে দেয়?’
কোনো উত্তর দিলেন না রাশেদা খাতুন। সদুষ্ণ শ্বাস ফেলে তূবা।
‘মা,ফারিয়ার জন্মদিনে আসবেন তো?’
‘তোরা তোরাই কর আনন্দ। আমার মতো বুড়ো মানুষকে আর টানিস না।’
‘আসতে যে হবেই মা।সমাপ্তিটা যে সেদিনই ঘটবে।’
কন্ঠনালী কাঁপছে রাশেদা খাতুনের।
‘সিদ্ধান্ত আমি তোর উপর ছেড়ে দিয়েছি। তারপর এই বুড়ো মানুষটা জানতে চায়, তুই কি সত্যি এই সংসারে ফিরবি না?’
রহস্যময় হাসলো তূবা।
‘সময় আমার উপর কি সিদ্ধান্ত চাপায় দেখা যাক। আপনি কিন্তু আপনার ছেলেকে নিয়ে আসবেন। কি করে, কিভাবে নিয়ে আসবেন আমি কিছুই জানি না। তবে আপনাদের উপস্থিতি আমার চাই চাই।’
_________________
একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে তূবা আর মিলন। মিলনের হাত তূবার হাত স্পর্শ করতেই তূখর শব্দে বেজে উঠলো তূবার মোবাইল। মেকি হেসে তূবা মিলন বলল,
‘দুই মিনিট কথা বলি?’
মোবাইল কানে ধরে ফিসফিস করে বলল,
‘হুমায়রা, আমি মিলন ভাইয়ের সাথে ডেটে আসছি। তোকে সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে কল করবো।’
চমকৃত, বিস্মিত হুমায়রা। তূবার কথা ঠিক হজম করতে পারছে না সে। এটা কি আদৌও সম্ভব?
‘আর ইউ ক্রেজি তূবা? আমি তো সেদিন ভেবেছি তুই জাস্ট তামান্নাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এসব বলেছিস।’
‘তামান্নাকে শুনিয়ে বলিনি।আমি আমার মনের কথাই বলেছি। রাখছি এখন।’
মোবাইল হাত থেকে রেখে মিলনের চোখে চোখ রাখে তূবা। মিলন কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘পাশেই আবাসিক হোটেল আছে একটা যাবেন?’
কফির কাপে চুমুক দিয়েছিল সে। খুঁকখুঁক করে কাশতে শুরু করে।
‘তুমি সিউর?’
মাথা দুলায় তূবা। অতঃপর বিল মিটিয়ে সেখান থেকে বের হলো তারা। একটা রিক্সা ডেকে সেখানে চড়ে বসল তারা। মিলন রিক্সার হুড তুলে দিলো। মুচকি হাসলো তূবা।
‘ভয় পাচ্ছেন বুঝি?’
প্রতিত্তোরে মুচকি হাসলো মিলনও। ‘তা তো একটু পাচ্ছিই।’ বলে মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিলো। মিনিট পনেরো বাদে রিক্সা এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে হোটেলে ঢুকে বসে রইল তারা কিছুক্ষণ। তূবা মোবাইল স্ক্রল করছে। আর মিলন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আচমকা ঠোঁটের কোণে ক্রূর হাসি ফুটে উঠলো তূবার। মোবাইল পার্সে রেখে নেত্রপাত করল মিলনের দিকে।
‘পাঁচ দিনের ফলাফল আজ পাবো সত্যিই ভাবিনি।’
‘ লুকোচুরি শেষ হলো তবে।’
মিলনের কথা শুনে দুর্বোধ্য হাসলো তূবা। এই হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে পাঁচ ছয় বছরের পাওয়া অপমান, হাজার অবহেলা আর কষ্ট।
দু’ঘন্টা পরে সেখান থেকে বের হয়ে এলো দু’জন। তূবার ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য হাসি।
___________________
ফারিয়ার জন্মদিন আজ।পুরোদমে ব্যস্ত তূবা। সেভাবে কাউকে বলেনি। ঘরোয়া আয়োজন করা হয়েছে। হুমায়রা, তামান্না, তামান্নার বর আর মেয়ে এসেছে। এখনো এসে উপস্থিত হয়নি রাশেদা খাতুন আর ফয়সাল।
গরুর মাং’স ম্যারিনেট করছে তূবা।আজ সব আয়োজন সে নিজের হাতে করবে। হুমায়রা আর তামান্না পাশে দাঁড়ানো।
‘আজই কি সবকিছুর ইতি টানবি?’
তামান্নার কথায় নির্জীব চাহনি নিক্ষেপ করে তূূবা।
‘অগোচরে থাকা সবকিছু এবার সম্মুখে আসা খুব প্রয়োজন। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে কেন থাকবো?’
‘ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নে তূবা।ফারিয়ার জীবন এতে জড়িয়ে।’
হুমায়রার পানে নেত্রপাত করল তূবা। চেয়ে রইলো অপলক।
‘আমার মেয়ের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। তোর ভাই কি আসবে না তামু? আজকের দিনে তার উপস্থিতি বড্ড প্রয়োজন।’
‘মে’রে ফেলবি আমার ভাইকে?
‘বাঁ’চা আর ম’রা আল্লাহর হাতে। তবে তোকে আর ভাইকে আমার ধন্যবাদ দেওয়া বাকি।’
বাঁকা হাসলো তামান্না। হুমায়রা কিছু না বুঝে আহাম্মকের ন্যায় তাকিয়ে রইলো।
রান্নাবান্নার পর্ব শেষ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। দিনের আলো ধীরে ধীরে ক্ষীন হয়ে আসছে। রৌদ্রের প্রখরতা কমে গিয়ে শীতলতা বিরাজ করছে চারপাশে। তাহমিদের রুমে নিজেদের নিয়ে আলাপচারিতা চালাচ্ছে সোহেন আর তাহমিদ। ঘেমে নেয়ে একাকার তূবা। শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন। বসার ঘরে বসে আছে তামান্না আর হুমায়রা। নিজের রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলো না তূবা। ভাবলো একটা বার ফয়সাল কে কল দেওয়া দরকার। যদি না আসে? কিছু না ভেবে ফোন লাগাল ফয়সালের নাম্বারে।
মোবাইল বেজে চলেছে ফয়সালের। তূবার নাম দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না । ঠিক কিসের জন্য ফোন দিয়েছে জানা আছে ফয়সালের। রিং হতে হতে কে’টে গেলো। আবারও বাজতে শুরু করলো মোবাইল। অনিচ্ছা সত্বেও রিসিভ করলো সে। মোবাইল কানে ধরে একেবারে নিশ্চুপ, নীরব রইলো।
‘সন্ধ্যা হয়ে এলো আর কখন আসবে?’
‘বিরহের দহনে পুড়িয়ে তিলে তিলে না মে’রে একেবারে মেরে ফেললেই তো পারো।’
ফয়সালের কথা শুনে শব্দযোগে হাসতে লাগলো তূবা। সেই হাসির শব্দ বড্ড যন্ত্রণাময় মনে হলো ফয়সালের।
‘আজকে একেবারেই মে’রে ফেলবো।তাই তো ঘটা করে এতো আয়োজন করলাম।’
হৃদগহীনে ভাঙচুর শুরু হলো ফয়সালের। নিজের প্রতি নিজের করুণা হচ্ছে তার। নিজের ভুলের কারনে আজ তার এই অবস্থা।
‘আমি আজ গেলেই তুমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করবে।’
চেঁচিয়ে উঠে তূবা।
‘এই একেবারে মেজাজ খারাপ করবে না।আসতে বলছি সো আসতে হবে। এই বেশি বোঝার কারনে তুমি কষ্ট পাচ্ছো। আজ যদি তুমি এই বাড়িতে না আসো তাহলে এটাই আমাদের শেষ কথা হবে। কখনো আমাদের চোখের দেখাও দেখতে পাবে না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।’
‘এইমাত্র আমার সাথে যেভাবে কথা বললে বহু বছর আগে যদি এভাবে কথা বলতে তাহলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা হতামই না। সেদিন তুমি আমাকে দু’টো থা’প্পড় দিতে তাহলে আর আমাকে গুমরে গুমরে ম’র’তে হতো না।’
এবারে গলার স্বর নরম হয়ে এলো তূবার। শূন্যতায় তো সমানতালে সেও পুড়ছে। তফাৎ সে কাউকে দেখাতে পারছে না।কঠিন হওয়ার মুখোশে আবৃত করে রেখেছে নিজেকে।
‘মাঝে মাঝে আমরা যা ভাবি বা কল্পনা করি তেমনটা নাও হতে পারে। শেষটা হয়তো আমাদের ভাবনার থেকেও সুন্দর হতে পারে। তোমার কাছে আমার রিকুয়েষ্ট থাকবে আসার জন্য।’
______________________
নিজের জামা কাপড় এক-এক করে ভাঁজ করে ব্যাগে রাখছে নাযীফাহ। সকালের ট্রেনে বাড়ি যাবে সে। গ্রামের ভেজা মাটির গন্ধ, সিদ্ধ ধানের ভাপের ঘ্রান, পুকুরে জাল ফেলে ধরে আনা মাছ মায়ের সাথে বসে কা’ট’তে বেশ লাগে তার। কতদিন হলো ভেজা মাটির গন্ধ নেওয়া হয়না। গ্রামের নির্মল বাতাস গায়ে এসে ঠেকে না। আর কয়েক ঘন্টা পরে নিজের গ্রামে পা রাখবে সে। ভাবতেই প্রফুল্ল হলো মন। পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে গেলো। এভাবে তোড়জোড় করে গ্রামে যাওয়ার একটাই কারন খালেদ মোশাররফের ফুপাতো বোন বকুল নাকি অনেক অসুস্থ। নাযীফাহ’র আর একটা মা তিনি। এতো এতো ঘটনার পর সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। একমাত্র এই একটা মানুষ তাকে পরম মমতায় আগলে নিয়েছিল। কারো কথা তিনি বিশ্বাস করতে চাননি। এসব কটু কথা থেকে বাঁচাতে নিজের ভাইয়ের ছেলে শিহাবের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। পোড়া কপাল হলে যা হয়। বেঁকে বসে শিহাব। সে কখনোই নাযীফাহকে বিয়ে করবে না সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। বকুল নামক মানুষটার সংসার হয়নি। বিয়ের পর কোনো অজানা কারনে স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন তিনি। গ্রামের মানুষের কটু কথা কম শুনতে হয়নি তাকে। কেউ শুনিয়ে শুনিয়ে কিছু বললে মুচকি হাসতো আর বলতো,
‘লোকে হাজার কথা বলবে সব কথা গায়ে মাখতে নেই। ভালোবাসা বিহীন মানুষ চলতে পারে না। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার হয়না। তাই চলে এসেছি।’
পুরোনো কথা ভাবতেই মন বিষিয়ে গেলো নাযীফাহ’র। সেই মানুষটার মতোই তার কপালটা। পার্থক্য শুধু ওই মানুষটার বিয়ে হয়েছে তার হয়নি। কিন্তু মানুষের ধারালো কথার বানে জর্জরিত হয়েছে দু’জনেই। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলো সে।
গোছগাছ শেষ করে মোবাইলটা হাতে নিলো নাযীফাহ। সেই নাম্বারে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। আজ অনেকদিন হলো কোনো মেসেজ আসে না। হাজার জল্পনা কল্পনা শেষে ডায়াল করলো সেই নাম্বারে। নাম্বার বন্ধ। মনটা খারাপ হয়ে গেলো নাযীফাহ’র। মেসেজ পাঠালো সেই নাম্বারে।
‘ আমার মনে অনুভূতির জাল বুনে হাওয়া হয়ে গেলেন জনাব? এই অধমকে একটু দেখা দিলে কি হয়? আমি যে মরিয়া হয়ে আছি আপনার সাক্ষাৎ পাবার জন্য।’
______________________
ড্রয়িংরুমে নতজানু হয়ে বসে আছে ফয়সাল। রাশেদা খাতুন এসেই নাতনির কাছে বসে আছেন। ফয়সালরা যখন এই বাড়িতে পা দেয় ফারিয়া ওদের দেখামাত্র বাবা বলে তার কাছে যেতে নিয়েও পিছিয়ে যায়। হয়তো সেদিনের সেই হিং’স্র রূপটার কথা মনে পড়ে গেছে। বাবা আর সন্তানের দূরত্ব যে বাবাকে ঠিক পোড়ায় তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ফয়সাল। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে তার।
রাত বাড়তে লাগল।কেক কা’টা’র সময় হয়ে এলো। বার বার ঘড়ির দিকে আর সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে তূবা।
‘কিরে আর কেক কখন কাটবি? তোর মেয়ে কিন্তু পরে ঘুমিয়ে যাবে।’ হুমায়রার প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিলো তূবা,
‘আরো দু’জন গেস্ট আসার বাকি।’
ঠিক তখনই বেল বাজলো। তূবা ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
‘এই তো আমার গেস্ট এসে গেছে।’
দরজার কপাট খুলতেই প্রবেশ করল মিলন আর তার স্ত্রী। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল হুমায়রার। তূবার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘তুই উনাদেরও ডেকেছিস? উনার সাথে তো তোর সাথে ? কি চলছে তোর মাথায়?’
তূবা ক্রূর আর রহস্যময় হাসলো।
‘সারপ্রাইজ।’
কেক কাটার পর্ব শেষ। ফারিয়া নিজের মাকে কেক খাওয়ানোর পর কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়ের অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে হাঁটু গেঁড়ে বসে মেয়েকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝালো। বিস্তর হেসে বাবার কাছে গেলো সে। কাঁপা কাঁপা বাবার একটা হাত ধরে টানলো। ফয়সাল হাঁটু গেঁড়ে বসল মেয়ের সামনে। ফারিয়ার চোখে মুখে কিঞ্চিৎ আতংক। মেয়ের মুখের দিকে নিমিষহারা তাকিয়ে রইলো ফয়সাল । ফারিয়া বাবার মুখের সামনে কেক ধরলো। চোখেমুখে একরাশ ভয় তারপরও বাবাকে কেক খাওয়ানোর জন্য এতোক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলো ফারিয়া। এটাই হয়তো র’ক্তের টান। কথাটা ভাবতেই অশ্রুতে চিকচিক করতে লাগল ফয়সালের অক্ষি কোণ। বার কয়েক পলক ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো ।মেয়ের হাত থেকে কেক খাওয়ার পর নজর গেলো গলায়। এই তো সেদিনের চেইনটা।এক পলক তাকালো তূবার দিকে। অতঃপর মেয়েকে বুকে টেনে নিলো। তূবা রগড় গলায় বলল,
‘এভাবে মেয়েকে বুকে মিশিয়ে রাখলে তো হবে না। এখনো সবাইকে কেক খাওয়ানো বাকি।’
মুচকি হেসে ছেড়ে দিলো মেয়েকে ফয়সাল।
‘মা তুমি সবাইকে খাবার দাও আমি ফারিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে আসি।’
‘ফারিয়া খাবে না?’
ফয়সালের প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তূবা। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
সবাই খাওয়ার জন্য বসলেও একমাত্র বসলো না ফয়সাল।
‘ফয়সাল ভাই খাবেন না?’
‘তোমার আসুক আগে একসাথে না হয় খাবো।’
তাহমিদ ফিসফিস করে বলল,
‘আপনার জন্য আজ আমার বড্ড মায়া হচ্ছে। আজ আপনার জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যাবে।’
তাহমিদের কথা শুনে র’ক্তশূণ্য হয়ে গেলো ফয়সালের মুখ। চিন্তার মাত্রা তরতর করে বাড়তে লাগলো। সেই চিন্তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো তামান্না,
‘ভাইয়া তোমার জন্য আমার বড্ড টেনশন হচ্ছে। একা একা কিভাবে থাকবে তুমি বাকি জীবন।’
বিষন্ন, অনুভূতিশূন্য চাহনি নিক্ষেপ করলো ফয়সাল।
‘বোন হয়ে তুইও মজা নিচ্ছিস?’
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। যার যার হাতে কোকের গ্লাস। সবাই খোশগল্প করছে। শুধু হাসি নেই ফয়সালের মুখে। চিন্তা টেনশনে গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে।হাসফাস লাগছে তার।
অপ্রত্যাশিত ভাবে তূবা বলল,
‘এমনটা কেন করলি হুমায়রা?’
আচমকা তূবার প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে যায় সে। সন্ধিহান গলায় বলে,
‘কি করেছি আমি?’
পাশ থেকে তামান্না বলে,
‘কি করেছিস সেটা তো তুই ভালো বলতে পারবি।’
স্থবির, স্তিমিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘দৃষ্টির অলক্ষ্যে থেকে ফয়সালের মনে আমার জন্য অবিশ্বাসের জাল বুনা, আমার সুন্দর সংসারটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা। উল্টো পাল্টা ছবি পাঠিয়ে আমার চরিত্র সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা। এগুলো কেন করেছিস? আমি তোর কি এমন ক্ষতি করেছি? কিসের জন্য তুই এমন আমার পিছনে, আমার সংসারের পিছনে উঠে পড়ে লেগেছিস?’
শুকনো ঢুক গিলে গলা ভিজানোর চেষ্টা চালায় হুমায়রা। লম্বা শ্বাস ফেলল সে।
‘তোর মাথা ঠিক আছে? এসব আমি কেন করতে যাবো? এসব তো করেছে তা,,’
হুমায়রার কথা শেষ করতে দিলো না তূবা।
‘এসব তামান্না করেছে তাইতো? তুই আমায় তামান্নাকে চিনাতে এসেছিস? সেদিন তোর মুখে তামান্নাকে নিয়ে বানোয়াট কথা বহু কষ্টে হজম করেছি আমি। দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক কতটা নিচে নামতে পারিস তুই। তোর কিসের এতো রাগ আমাদের উপর?’
হুমায়রা নিস্তেজ স্বরে বলল,
‘কি প্রমাণ আছে তোর কাছে?’
‘প্রমাণ না? এই প্রমাণ যোগাড় করার জন্যই তো এতো কষ্ট। অপরাধী যখন কোনো অপরাধ করে না তখন কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যায়।ঠিক সেরকম ভুলও তুই করেছিস। যেই নাম্বার থেকে তুই ছেলে সেজে ফয়সালকে কল করতি তোর মোবাইল হারানোর পর হটকারিতায় সেই নাম্বার থেকেই তামান্নাকে কল করে বসলি।সেটাই ছিলো তোর জীবনের কাল। ভাগ্যিস সাথে সাথে তোর নাম্বারটা সেভ করেছিল তামান্না। না হলে তোর মুখোশের আড়ালের হিং’স্র রূপটা কখনো দেখতেই পেতাম না।’
হুমায়রা দু’কদম এগিয়ে এসে বলল,
‘বিশ্বাস কর তূবা তামান্না নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য আমাকে ফাঁসিয়েছে।’
‘সেটাই, আমার পিছনে লোকও তামান্না লাগিয়েছে, তাই না? তুই কিভাবে আমার সকল খবর রাখিস সেটা জানার জন্যই মিলন ভাইয়ের সাথে ডেটের নাটকটা করি।ধারণা করেছিলাম কেউ না কেউ তো আমাকে ফলো করেই। না হলে দূরে থেকেও আমার সকল খবর রাখা তোর সম্ভব না। তোর উপর যেন কেউ সন্দেহ না করে সেজন্য তো ভয়েস চেঞ্জার দিয়ে কথা বলতি। আমি ঠিক বললাম তো?’
অর্ধেক খালি হওয়া গ্লাসটা মেঝেতে ছুড়ে মা’রে হুমায়রা। চিৎকার করে বলে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
‘হ্যা, এসব আমিই করেছি। উল্টো পাল্টা বলে দিক ভ্রম করার চেষ্টা করেছি যেন আমি অব্দি তুই না পৌঁছাতে পারিস।
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।