দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-২২+২৩

0
414

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ২২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

দুপুরের কাঠফাটা রোদের প্রখরতা কমে গিয়ে পরিবেশ শান্ত হতে শুরু করেছে। তারপরও গরম কমছে না। নাযীফাহ তার চুলগুলো উঁচু করে ব্যান্ড দিয়ে আঁটকে নিলো। বাহিরে শুকাতে দেয়া আচারের বয়াম গুলো ঘরে এনে রাখলো এক এক করে। ফাহমিদা বেগম ঘুমোচ্ছেন। দুপুর বেলা একটু না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মাঝারি সাইজের একটা বয়াম নিয়ে নাযীফাহ মায়ের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।

ফাহমিদা বেগম পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছেন। উনার শিয়রের কাছে গিয়ে নাযীফাহ ধীরস্থির স্বরে ডাকল। দুইবার ডাকতেই ফাহমিদা বেগম পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালেন। আস্তেধীরে উঠে বসলেন তিনি। নাযীফাহ’র দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

‘আচারের বয়াম নিয়ে আমি বকুল ফুফুর বাড়ি যাচ্ছি৷ সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।’

চমকিত হন তিনি। ঘুম জড়ানো চক্ষুদ্বয় বৃহৎ আকার ধারন করে মুহুর্তে। আতঙ্কগ্রস্ত, ভয়ার্ত স্বরে বললেন,

‘না, না ওখানে শিহাব আছে। ও যদি তোকে কোনো ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে তো?’

মাকে একহাতে জড়িয়ে আশস্ত করে বলল,

‘আহ! মা এসব নিয়ে ভয় পাচ্ছো কেন? এতগুলো দিন পাড় করার পর বুঝতে পারছি মানুষের কটু কথার ভয়ে তোমাদের থেকে আমার দূরে মোটেও উচিৎ হয়নি। তাদের কথা গায়ে মেখে আমি এতগুলো দিন ক’ষ্ট পেয়েছি আর তোমাদেরও কষ্ট দিয়েছি। আমার উচিত ছিলো তাদের কথার মুখোমুখি হওয়া। তাদের স্পষ্ট জবাব দেওয়া। ওই যে একটা কথা আছে না, ‘ মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের জম।’ ভদ্রতা আর পড়াশোনা করেছি সেজন্য তাদের সম্মান করতাম। তাই তারা পেয়ে বসেছিল। আসলে মানুষের উপর জবাব দিতে হয়। তাহলে পরবর্তী কিছু বলার আগে দশবার ভাববে। মানুষের কথার থেকে পালিয়ে নয় রুখে দাঁড়াতে হয়। আর শিহাব ভাইয়ের কথা বলছো? বকুল ফুফু শুধু উনার মনের ইচ্ছে পোষণ করেছিল। বেশি কিছু না মা। না উনার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো আর না হয়েছে বিয়ে। তাহলে কেন অতীতের সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমি ও বাড়ি যাওয়া বন্ধ করবো? আমি উনার মুখোমুখি না হলেই তো হয়?’

‘সালাম ভাই তো ওখানে যাওয়া পছন্দ করেন না।’

‘কে বলেছে মা একথা? উনি আমাদের সন্তানের মতো স্নেহ করেন। তবে তা ব্যবহারে ফুটিয়ে তুলেন না। উনি বাহির থেকে নিজেকে যতটা কঠোর দেখান আসলে ততটা কঠোর তিনি নন।’

‘ততটা কঠোর না হলে হালিমা ভাবিকে কেন মানসিক অ’ত্যা’চা’র করেন? কয়েকদিন আগে উনার সাথে তোর বাবার দেখা হয়েছিল। কথাও হয়েছিল টুকটাক। পরে জানতে পেরেছি তিনি নাকি ভাবির গা’য়ে হা’ত তু’লে’ছেন। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। এখন এসব মানা যায়? সেকারণে আজকাল উনাকে দেখলে এরিয়ে যাই। ওই সহজ সরল মানুষটার কষ্টের কারণ হতে চাই না।’

‘বাবার সাথে কিসের এতো রা’গ বলেছে কিছু?’

‘সুপ্ত রাগ কি নিয়ে সেটা বলে দিলেই তো মিটমাট করার চেষ্টা করতাম। তোর বাবা মাঝে মাঝে মন খারাপ করে উনার জন্য।’

বক্ষঃস্থল থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিঃসৃত হয় নাযীফাহ’র। মায়ের গালে একটা হাত রাখে।

‘চাচিকেও একটা নজর দেখে আসবো। অনেকদিন হলো উনাকে দেখি না। উনি তো তোমার হাতের আচার পছন্দ করেন। তাই এটা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।’

দেরি না করে ঘরের বাহিরে পা দিলো নাযীফাহ। সেইদিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন ফাহমিদা বেগম। নাযীফাহ বুঝ দিয়ে গেলেও উনি মনকে বুঝ দিতে পারছেন না। মা তো সন্তানের ক’ষ্টের কথা চিন্তা করে যে উনারও মন কাঁদে।

______________________

চুলোর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তূবা। আজ সারাদিনেও গ্যাস আসেনি। দুপুরে তাহমিদ বাহির থেকে খাবার কিনে দিয়ে গিয়েছিল। এখন তার ঝাল ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। গ্যাস না থাকায় কিছুই করতে পারছে না। মনে মনে কয়েকটা কঠিন কথা শুনালো দায়িত্বে থাকা লোকদের। রাত নাগাদ গ্যাস লাইন ঠিক হবে। কিন্তু তার এখনই খেতে ইচ্ছে করছে খুব।

ফারিয়া দৌড়ে মোবাইল নিয়ে এসে তূবার হাতে দিল। ‘বাবাই’ বলে আবারও চলে গেলো। ফারিয়া চলে যেতেই কানে মোবাইল ধরলো। নিঃশ্বাসের আধ্বান ফয়সালের কর্ণগোচর হতেই বলল,

‘আপনার মনের আশাই পূরণ হয়েছে মিসেস। আজ রাতে চট্টগ্রাম যেতে হবে। আগামী পাঁচদিন আর আপনার সাথে দেখা হবে না। এখান বসুন্ধরা ব্রাঞ্চে যেতে হবে।তারপর বাসায় গিয়ে রেডি হয়ে সোজা চট্টগ্রাম।’

আহ্লাদী স্বর টানে তূবা। ন্যাকি গলায় বলল,

‘ওগো, শুনো না?’

এমন কথায় বিষম খায় ফয়সাল।চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একের পর এক বিরতিহীন প্রশ্ন করে গেলো।

‘এই তুমি ঠিক আছো তো? তোমার শরীর খারাপ করেনি তো? তুমি কি ভুলে ডেট এক্সপায়ার্ড কিছু খেয়েছো?’

‘ ওগো, ফারিয়ার বাপ আমার না ঝাল কিছু খেতে খুব ইচ্ছে করছে।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফয়সাল। সে ভেবেছিল তূবা নে’শা’ভা’ন কিছু করেছে।

‘কি খাবে বলো আমি অর্ডার করছি।’

‘একেবারে ঝাল ঝাল কিছু। লাইক রামেন, নাগা বার্গার।’

‘এগুলো বাদে অন্যকিছু বলো। আপাতত এসব খাওয়া ঠিক হবে না।’

কাঁদো কাঁদো গলায় তূবা বলল,

‘খাওয়া ঠিক হবে না ছাই। বলো যে কিনে দিলে তোমার টাকা খরচ হয়ে যাবে।’

ঠাস করে কল কে’টে দিলো। টুট টুট শব্দে কান মোবাইল নামায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে পুনর্বার ফোন করে। কল কে’টে দিলো তূবা।

কল কে’টে চোখ মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে তূবা। তার ইচ্ছে করছে চুলোটাকে মাথার উপর তুলে জোরে একটা আ’ছা’ড় দিতে। দাঁতে দাঁত পিষে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

‘এই ভাপসা গরমে রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

রাশেদা খাতুনের প্রশ্নে মাথা উঁচিয়ে তাকায় তূবা। কোনো উত্তর দিলো না। বিরক্তিতে ছেয়ে গিয়েছে তার পুরো শরীর। ফয়সাল নিষেধ কেন করল।

রাশেদা খাতুন পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে ছেলে বউয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে।

‘মা ফ্রিজে কাঁচা মরিচ আছে না?’

কাহিনি কি না বুঝে মাথা দুলান তিনি। তূবা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলে,

‘এখন কাঁচা মরিচ চিবিয়ে চিবিয়ে খাবো।’ হনহন করে গেলো ফ্রিজের কাছে। ছেলে বউয়ের মতিগতি অর্থোদ্ধার করেই তিনিও গেলেন পিছু পিছু। না হলে অনর্থক হয়ে যাবে।

তূবা ফ্রিজের দরজায় হাত রাখতেই টুং করে মেসেজ টিউন বেজে উঠলো।

‘ আপনার কথায় রামেন অর্ডার করেছি ফুডপান্ডায়। দয়া করে আধঘন্টা পরে নিচে গিয়ে সেটা ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে রিসিভ করে আমাকে ধন্য করুন মহারানী। তবে অল্প একটু খাবেন। আমার মেয়ের ধারেকাছেও যেন এসব না যায়। আমি ওয়ার্ন করলাম।’

মেসেজের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কা’টে তূবা।

‘এ্যাহ্! আসছে কোথা থেকে। উনার ওয়ার্ন শোনার জন্য আমি বসে আছি।’

___________________

আচারের বয়াম হাতে বাড়ির ভেতরের সরু গলি দিয়ে যাচ্ছে নাযীফাহ।দুপাশে চৌচালা টিনের ঘর। মাঝে মাঝে কয়েকটা পাকা বাড়ি। ঘুঁটের গন্ধ এসে নাযীফাহ’র নাকে ঠেকল। কিঞ্চিৎ হেসে মনে মনে আওড়াল, ‘গ্রামবাংলা।’ কয়েকজন মহিলা গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে চলল সামনের দিকে । দু’একজন মহিলার ফিসফিসানি শুনে পা থেমে যায় তার।

‘আরে ওইডা খালেদ ভাইয়ের মাইয়া না? আহারে এই মাইয়া খালেদ ভাইয়ের মান সম্মান এক্কেবারে শেষ কইরা দিলো। মাইয়ার বাপটা কি ভালা মানুষ। আর মাইয়ার চ’রি’ত্রে সমস্যা।’

‘আরে মাইয়া মানুষরে শহরে পড়ালেহার লিগা পাডাইলে পোলাপান নিয়া ফষ্টিনষ্টি করবো। আমার নামে এত বড় কথা র’ট’লে গ’লা’য় দ’ড়ি দিতাম।’

‘আরে এরা ম’রে না। অ’স’তে’র আবার ক”ল”ঙ্কের ভয় আছে নাকি।’

প্রতিটা ধারালো কথার নিস্বন শ্রবণ গ্রন্থিতে ধা’ক্কা দিতেই দুচোখ বেয়ে নিদারুণ য’ন্ত্র’ণাময় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল নাযীফাহ’র। ঢুক গিলে নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালালো। নিজেই নিজের মস্তিষ্কও বুঝালো, ‘পঁচা শামুকে পা দিয়ে পা কা’টা’র মানেই হয় না।’

কথাগুলো কে পাত্তা না দিয়ে আবারও সামনে পা বাড়ায় সে। তখনও ফিসফিসানি বন্ধ হয়নি। আচমকা থমকে দাঁড়ায় সে।

কিছু মুহূর্ত আগেই মাকে বলা কথা গুলো কড়া নাড়ল তার মস্তিষ্কে। সে কেন কথা গুলো থেকে পালিয়ে যাবে? আজ মুখোমুখি হবে এসব ক’টু কথার। অশ্রুকণায় লেপ্টে থাকা গাল বাম হাত দিয়ে মুছে নিল।

সেই মহিলা গুলোর কাছে আসতেই সবাই থতমত খেয়ে গেলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

___________________

ব্লে’ ড দিয়ে ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করা ফাহিমের হাত দুটির দিকে তাকিয়ে আছে যুবক। দৃষ্টি তার সূঁচালো আর তীক্ষ্ণ। মাথা নু্ইয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাহিম। হাত দুটি ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে তার।

‘এজন্য বুঝি ফুলহাতা শার্ট গায়ে?’

সম্মতিতে মাথা দুলায় ফাহিম।

‘নিজের ভালো বুঝিস না? আগের তুই আর এখনের তুই এর মাঝে বিস্তর ফারাক। এটা কি এখনো তোর চোখে পড়েনি?’

‘অভ্যাসটা তুমিই তৈরি করে এখন ভালো ম’ন্দের পার্থক্য করার কথা বলছো? ব্যপারটা জুতো মে’রে গরু দানের মতো হয়ে গেলো না?’

নির্লিপ্ত, উদাসীন চাহনি নিক্ষেপ করে যুবক ফাহিমের অভিমুখে।

‘রাতে যখন নে’শা টা চাপে হাতের কাছে না পেলে নিজেকে পা গ ল পা গ ল লাগে।কি করছি না করছি কিছুই মস্তিষ্কে বোধগম্য হয় না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাই। সম্বিত ফিরলে অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এই মানসিক আর শারীরিক য’ন্ত্র’ণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কেউ ভালো কথা বললে বড্ড তিক্ত লাগে আমার কাছে। মা, বাবা, আপু সবাইকে শ’ত্রু মনে হয়। আমার এতো বড় ক্ষ’তি করলে ভাই? এভাবে চলতে থাকলে আমি বাঁ’চ’বো না। আমাকে বাঁ’চা’ও ভাই।’

যুবকের দৃষ্টি তখনও স্থির আর আবেগশূন্য। নির্জন, নিরিবিলি, নির্মক্ষিক পরিবেশে চারপাশে চোখ বুলালো যুবক। কেউ নেই এখানে। পরিত্যাক্ত এই জায়গায় সহজে কেউ আসে না। কাগজে মোড়ানো কিছু একটা ফাহিমের হাতে দিলো সে।

‘যদি সং’শ’য়ে থাকে আপনজনের প্রাণ,
তখন লোপ পেয়ে যায় জ্ঞান।
বাধ্য হয়ে বিপদে ফেলতে হয় আরেকজনের জান।’

একটা শব্দও কানে পৌঁছাল না ফাহিমের। এতক্ষণে অন্যকিছুর নে’শা’য় সে বুদ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও করা আত্মোপলব্ধি সবকিছু যেন মিছে হয়ে গেল। কাগজে মোড়ানো সেই বস্তু নাকের সামনে নিয়ে লম্বা নিঃশ্বাসের সাথে তার গন্ধ টেনে ভেতরে নিতে লাগল। আশেপাশের কি হচ্ছে না হচ্ছে কোনোকিছু তার মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। এ যেন এক অন্যরকম সুখ। যেই সুখে ডুব দিলে ভুলে থাকা যায় দুনিয়ার সকল কষ্ট।

যুবক চেয়ে রইলো ফাহিমের অভিমুখে। চক্ষু জোড়ায় তার কল্মষ আর অপরাধিত্ব।

#চলবে

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ২৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

নাযীফাহ সবার দিকে এক পলক তাকালো। আঁখি পল্লব কিঞ্চিৎ ভেজা। এই ব্য’থা’তুর আননে সবার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের স্বর টানল।

‘চাচি মনে আছে? কাক ডাকা ভোরে আজাদ চাচাদের মুরগির খোয়ার থেকে মুরগি চু’রি করার সময় হাতে নাতে ধরা পড়ছিলেন? আমার কিন্তু মনে আছে। আপনার মেয়েটাকে আপনারই কুকীর্তির জন্য মানুষ কথা শোনাতো। তাও তো থেমে থাকেন নি। এলাকার মেম্বার সাহেবের মেয়ের বিয়ের সময়ও তো আটটা শাড়ি চু’রি করার সময় ধরা পড়েছিলেন। আরেকজনের চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেওয়া কি আদৌও আপনার মানায়?’

‘ওই মাইয়া,,,,

‘গলার আওয়াজ নিচে চাচি। আমি কিন্তু একটা কথাও মিথ্যে বলি নাই। অনেক সম্মান করতাম। কারণ মা বাবা মানুষকে সম্মান করাটা শিখিয়েছে। আজ যে আর সম্মান দিতে পারলাম না। আমার সম্মান করাটা নির্ভর করবে আপনার ব্যবহারের উপর। নিজের সম্মান নিজেকে ধরে রাখতে হয়। আপনি বাধ্য করেছেন আপনাকে অসম্মান করতে। সম্মানের স্থানে থেকে সেই সম্মান ধরে রাখা অনেক কষ্ট। যা আপনি পারেন নাই।’

আরো কয়েকটা কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল নাযীফাহ। এবার তাকাল দ্বিতীয় জনের দিকে। উপহাসের সুরে বলে,

‘আসলেই শহরে গিয়ে মানুষ পড়াশোনা না করে বড়লোক ছেলেপুলেদের সাথে ফ’ষ্টি’ন’ষ্টি করতে যায়। সে যাইহোক আমি তো না ভয় ভার্সিটি ভর্তি হয়ে ফ’ষ্টি’ন’ষ্টি শুরু করেছি। আপনার মেয়েটা কোন বয়সে এসব শুরু করল? ক্লাস টেনেই তো নিজের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেলো। আমি তো তাও ভালো।’

উপস্থিত সবাই নিশ্চুপ। কেউ মাথা নুইয়ে ফেলেছে আবার কেউ রাগে ফুঁসছে। নাযীফাহ এবারে তাকায় তৃতীয় জনের দিকে।

‘আসলেই অ’স’তের কলঙ্কের ভয় নাই। সেটা আপনাকে দেখলেই বুঝা যায়। বাহিরের মানুষের দিকে আবার তাকাতে হয় নাকি। নিজেই তো জলজ্যান্ত প্রমাণ।আপনি কি করছেন সবকিছু ভুলে গেলেন নাকি? আমার তো মুখে নিতেও আটকায়। চাচা ভালো মানুষ বলেই আপনার সাথে এতোগুলা বছর সংসার করেছে।’

একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামল নাযীফাহ। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। এরমধ্যে কেউ একজন বলে উঠলো,

‘এতো বড় বড় কথা কইতাছো তুমি আকাম করো নাই?’

মানুষটার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নাযীফাহ।

‘আমি জানি আর আল্লাহ জানে আমি কতটা শুদ্ধ। আপনারা তো যাই দেখবেন তাই বিশ্বাস করবেন। মাঝে মাঝে চোখের দেখা প্রমাণও ভুল হতে পারে। আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো আমি এমন কিছু করিনি। আমার কাছে আমার বাবার সম্মান মুখ্য ছিলো। আপনার কয়জন বলতে পারবেন আপনারা কতটা শুদ্ধ? আসলে যে যেমন সে মনে করে সবাই তার মতো। আপনারা নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য অন্যদের নিয়ে সমালোচনা করেন আর পৈ শা চিক আনন্দ পান। আপনাদের মাঝে যদি মনুষ্যত্ববোধ থেকে থাকে তাহলে নিজেদের পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন। আর না থাকলে তো,,,,।’

কুৎসিত মনের মানুষদের সামনে আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো।

__________________________

বিকেলে দোকানে মোটামুটি ভিড় কম থাকে খালেদ মোশাররফের। সদাই বেচার ফাঁকে দেখলেন তুহিন এসেছে দোকানে। মিনিট পনেরো বাদে কাস্টমার বিদায় করে তুহিন কে কাছে ডাকলেন।

‘তুই যে বিয়ের কথাটা বলেছিলি উনাদের কাল আসতে বলতে পারবি?’

‘চাচা তুমি আরো আগে বলবা না। তা নাযীফাহ বলেছে তো?’

‘হুম বলেছে। সকাল দশটা এগারোটা বাজে এলে নাযীফাহ কে পছন্দ হলে না হয় ঘটা করে আবার আসবে।’

‘আচ্ছা চাচা আমি কথা বলে দেখছি।’

‘কালকে হলে ভালো হয়।আসলে নাযীফাহ’র ছুটি আর নেই। তাই বলছিলাম আর কি।’

‘তুমি চিন্তা করো না চাচা। আমি ব্যবস্থা করবো।’

বলে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। খালেদ মোশাররফও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে মনে দোয়া করতে লাগলেন, এবার যেন সব ঠিকঠাক হয়।

বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য কাঁচা রাস্তায় পা দিতেই পথিমধ্যে তুহিনের সাথে দেখা হয় একজনের।

‘তোর কথামতো সম্বন্ধ দেখালাম। চাচাও রাজি। নাযীফাহ নাকি রাজি। এখন ছেলে পক্ষের সাথে কথা বল।জিজ্ঞেস কর কাল সকালে আসতে পারবে কিনা।’

তুহিনের কথা শুনে বুকের মাঝে ছ্যাৎ করে উঠে মানুষটার। তার একতরফা ভালোবাসা অজানায় রয়ে গেলো। তুহিনের কথায় বিষন্ন হেসে উদাসীন চাহনি নিক্ষেপ করলো। তুহিন তার কাঁধে হাত রাখে।

‘ছোট থেকেই তোকে দেখছি। কত খেলাধুলা করলাম তোর সাথে। তোর মনের কথাও আমি বুঝতে পারি কিছুটা। নাযীফাহকে ভালোাবাসিস তাহলে বলে কেন দিচ্ছিস না? পারিবারিকভাবে নিজের করে নে। তুই তো আর বেকার না। মনের মানুষের সাথে দুইদিন বেঁচে থাকাও আনন্দের। মনে করবি ওই দুইদিন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সময় থাকতে সময়ের কদর কর। না হলে সারাটা জীবন আফসোস করবি।’

অসহায়, আবেগশূন্য চোখে তুহিনের অনিমেষ তাকিয়ে রইলো সে। বিবশ চোখজোড়া কতকিছু বলতে চায়। কিন্তু সে বলতে পারে না। তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারে না। কারণ সে পুরুষ। তার অসহায়ত্বগুলো কান্না হয়ে ঝরতে চায়। কঠোরতার দেয়াল সেগুলোকে আঁটকে রেখেছে।

‘যাকে ভালোবাসি তাকে দুঃখের সাগরে ভাসাই কেমনে তুহিন ভাই? আমি তাকে পেয়ে গেলে যে রোজ তাকে মৃ’ত্যু সম য’ন্ত্র’ণা ভোগ করতে হবে। চোখের পানি ঝরা যে আর বন্ধ হবে না।’

‘বুঝলাম না।’

‘কিছু না। আমি তোমাকে রাতে জানাচ্ছি।’

এতটুকু বলে গটগটিয়ে প্রস্থান করল সে। নাহলে তুহিন তাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে। যার উত্তর সে কোনো কালে দিতে পারবে না।

____________________________

কাজে মন বসাতে পারছে না তাহমিদ। এই সপ্তাহটা তার কাছে বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছে। দিনগুলো যেন কাটতেই চাইছে না। নাযীফাহকেও দেখছে না কতদিন ধরে। মন আর চোখ দু’টোই তৃষ্ণার্ত। সর্বদা চোখের সামনে দেখতে দেখতে এখন ছবি দেখলে অশান্ত মন শান্ত হয় না। চেয়ারে গা এলিয়ে কপালে হাত রেখে নাযীফাহ’র কথা ভেবে চলেছে তাহমিদ। সিম টা সে আজও খুঁজে পায়নি। কোথায় রেখেছে মনে করতেই পারছে না। কপাল থেকে হাত সরিয়ে মোবাইল হাতে নিল। ইতস্তত করছে এই নাম্বার থেকে ফোন করবে কি করবে না। আর কথা বললেও কি উছিলায় কথা বলবে। দোটানায় আছে সে।

‘স্যার আসবো?’

তনয়ার ডাকে ঘোর কা’টে তাহমিদের। লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

‘আসুন।’

‘ডেকেছিলেন স্যার?’

তাহমিদ কোনো ভণিতা করল না।

‘নাযীফাহ কে একটা কল দিন না?’

শব্দ করে হেসে দিল তনয়া। তনয়ার হাসি দেখে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। তনয়া পেট চেপে বলে,

‘ওহ স্যার! আপনি তো দেখছি মনের কথা আর প্রেম করার আগেই পুরো দেবদাস হয়ে গিয়েছেন। মেয়েটা ছুটিতে গিয়েছে। মা বাবার সাথে সময় কাটাতে। অস্থির হচ্ছেন কেন?’

‘আমার জায়গায় থাকলে বুঝতেন আমার কত টেনশন হচ্ছে। মেয়েটা গ্রামে যাওয়ার পর দুদন্ড শান্তি পাইনি। মনে হচ্ছে খুব দেরি করে ফেলছি। একটা ফোন দিন না। আমি শুধু একটু নাযীফাহ’র গলার স্বর শুনবো।’

‘আচ্ছা আচ্ছা ফোন দিচ্ছি।’

______________________

নাযীফাহকে বাড়িতে দেখে আহ্লাদে আটখানা সালাম সাহেবের স্ত্রী। এতোগুলো বছর পরেও নাযীফাহ আর পছন্দের কথা মনে রেখে আচার নিয়ে এসেছে। এটা দেখে উনি প্রায় কান্নাই করে দিয়েছিল। হাত দু’টো ধরে কান্নামাখা স্বরে বলেন,

‘তোকে বউ করার বড্ড শখ ছিল আমার। যার বউ করবো সেই তো রাজি না। আসলে মানুষ খাঁটি সোনার কদর করতে জানে না।’

‘আহ! চাচি এসব কথা বাদ দাও তো। চাচা কই গো?’

‘কিছুক্ষন আগে গো রুমেই দেখলাম।’

‘আমাকে দেখলে কিছু বলবে না তো?’

‘কি বলবে?’

‘ আচ্ছা বাদ দাও। কতদিন হয়ে গেলো তোমার হাতের ছিটা রুটি খাই না। বানিয়ে দাও না। তুমি তো সবসময় সময় আতপ চাল গুঁড়ো করে রাখো।’

নাযীফাহ’র আবদারের প্রানখুলে হাসলেন তিনি। অতঃপর ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটলেন রান্নাঘরে।

বকুলের কাছে যেতেই উনি বকুলের শ্যাম্পু করা চুল দেখে জোর বসিয়ে দিলেন মাথায় তেল দেওয়ার জন্য। বকুল পরম যত্নে চুলে তেল দিয়ে মাথায় বিলি কে’টে দিচ্ছেন। নাযীফাহ পরম আবেশে অনুভব করছে।

‘আমি বোধ হয় এই বয়সে এসে প্রেমে পড়েছি।’

হাত থেমে গেলো বকুলের। কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

‘তবে মানুষটাকে আমি কখনো দেখিনি। সে দেখতে কেমন তাও জানি না। তার জন্য আমি অন্য কিছু অনুভব করি। তার ছোট কেয়ার আমার মনকে প্রফুল্লিত করে। তবে আমার সেই অনুভূতি হয়তো তাকে কখনো বলা হবে না। হয়তো বা তাকেও কখনো দেখা হবে না। বাবা একটা বিয়ের কথা বলেছে। আমি মত দিয়েছি। তাদের যদি আমাকে পছন্দ হয়। ছেলে যেমনই হউক আমি বিয়ে করে নিবো। মানুষ এই ধা’রা’লো কথা আমার সহ্য হয় না। এবার একটু শান্তি চাই। বাবাকেও একটু শান্তি দিতে চাই। মানুষ টা আমার জন্য চিন্তা করতে করতে শরীরে রোগের বাসা করছে।’

কোনো উত্তর দিলেন না বকুল। থেমে যাওয়া হাত খানা আবারও বিলি কে’টে দিতে লাগল।

দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা গুলো শুনছিল কেউ একজন। কথা শেষ হতেই দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল।

__________________

‘কি হলো ফোন তুলছে না?’

তাহমিদের প্রশ্নে অসহায় চোখে তাকায় তনয়া। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।

‘কতগুলো কল দিলাম ফোন তুলছে না।’

এবারে যেন তাহমিদের চিন্তার মাত্রা তরতর করে কয়েক গুণ বেড়ে। থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো চিন্তাগ্রস্থ আননে।

‘টেনশন করবেন না স্যার। হয়তো ব্যস্ত সেজন্য ফোন তুলছে না।’

‘সেদিন আমার বোনের মোবাইল থেকেও কল দিলাম। ফোন তুলেনি। সেজন্য আমার চিন্তাটা বেশি হচ্ছে।’

‘আচ্ছা আমি একটু পরে আবার কল দিবো।’

_____________________

পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে নাযীফাহ। ফাহমিদা বেগম আড়ালে আছেন। বকুল নাযীফাহ’র পাশে দাঁড়ানো। পাত্র, পাত্রের মা, খালেদ মোশাররফ আর উপস্থিত আছে তুহিন। নাযীফাহকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে পাত্রের মা। টুং করে মেসেজ টিউন বেজে উঠতেই পাত্র মোবাইল হাতে নিল। অতঃপর নাযীফাহ’র দিকে জহুরির চাহনি নিক্ষেপ করে একটা বার পরখ করল।

‘মিসের ঢাকা শহরে ব্যবসা কেমন চলছে?’

নাযীফাহ কথার মানে বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

‘ বড়লোক ছেলেপুলেদের সাথে রাত কাটিয়ে কত টাকা ইনকাম করেন?’

আসমান ভেঙে পড়লো উপস্থিত সবার উপরে। গা হাত পা ছেড়ে দিল নাযীফাহ সহ খালেদ মোশাররফ। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল বেদনার অশ্রু।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।