মনের গহিনে পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
585

#মনের_গহিনে (২০)
Sarika Islam(mim)

ইয়াদ সকাল সকালেই বাড়ি চলে গেলেন।ফারাহর সাথে দেখা করাটাও প্রয়োজন মনে করলেন না।ফারাহ তার বোনের চরিত্রের উপর কথা তুলেছে সে কিভাবে ফারাহর মুখ দর্শন করতে পারে!!

আম্মুর ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম।বরাবর দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ পরলো সকাল দশটা বাজে।কাল সারারাত কান্না করার ফলে চোখ জ্বালা করছে এখন।বিছানা থেকে উঠে ওয়াশ্রুমে গেলাম ফ্রেশ হতে।চোখে মুখে ইচ্ছেমতো পানি দিতে লাগলাম।আয়নার নিজের চেহারা দেখে কাল রাতের ইয়াদের নিজের উপর লাগালো দোষ মনে পরে গেল।যেই দোষ নিজে করিনি সেই দোষ বহন করা অনেক কষ্টদায়ক হয়ে যায়।
বাহির হয়ে ডাইনিং এ গেলাম তুর্য দাদী বসে নাস্তা করছেন আমাকে দেখে ভাইয়া চেয়ার সরিয়ে বসতে বললেন।আমি বসে বারেবারে নিজের রুমের দিকে তাকাচ্ছি।আম্মু ব্রেডের মধ্যে জ্যাম দিয়ে বললেন,
-ইয়াদ সকাল সকালেই চলে গিয়েছে।

আমি ব্রেডে এক কামড় দিয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম।ছোট্ট করে ওহ বললাম।তুর্য ভাইয়া কেমন তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকাচ্ছেন।আমি ভ্রু কুচকে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে?এইভাবে দেখছো কেন?
-তোদের মধ্যে কিছু কি হয়েছে?

ভাইয়ার করা প্রশ্নে ইয়াদের কাল রাত করে যাওয়া বিহেভিয়ারের কথা মনে পরে গেল।পরক্ষনেই মাথা দুলিয়ে না করলাম কিছুই হয়নি।ছোট খাটো মনমালিন্য তো হয়েই যায় একটা সম্পর্কে তার মানেতো এই নয় বলে তাদের টেনশন দিব।
সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করলো দাদী নিজের রুমে গেল রেস্ট নিতে।তুর্য ভাই ভার্সিটি গেল আমি একাই রয়ে গেলাম বাড়িতে।সেই বাড়িতে কিভাবে যাবো?ইয়াদ তো আমাকে রেখেই চলে গেলেন আমি কোন মুখ নিয়ে যাবো সেই বাড়িতে?সিদ্ধান্ত নিলাম সেই বাড়িতে যাবো না।আম্মু রান্না ঘর থেকে আওয়াজ দিল আমায়।আমি উঠে গেলাম।
-তোদের মধ্যে কি আসলেই কিছু হয়নি?

চিন্তিত স্বরে আম্মু বললেন।এইভাবেই তো নীলাপুকে নিয়ে সারাদিন টেনশনে থাকেন আমি আমার সমস্যা বলে আর টেনশন দিতে চাইনা।তাই আম্মুর গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে হাসি মুখে বললাম,
-আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি কিছু হলে তো বলতাম।আর এত্ত এত্ত টেনশন করো নাতো।

আম্মু আমার এক গালে হাত রাখলো।একখানা হাসি দিয়ে বলল,
-তোরা খুশি থাকলেই আমি খুশি।তো যাবি না?
-আমাকে বিদায় করার জন্য এইসব বলা হচ্ছিল বুঝি?

মুখ গোমড়া করে বললাম।আম্মু আমাকে সামনে নিয়ে হাসিমুখে মাথায় হাল্কাভাবে চাপর মারলো।
-ধুর বোকা।এইটাতো তোদেরই বাড়ি যতদিন ইচ্ছে থাকবি।

আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম।মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল।

————-

ইয়াদ নিজের রুমে বসে আছেন।কোনভাবেই নিজেকে বুঝাতে পারছে না যে ফারাহর বলা সব কথাগুলো সত্যি।আর কিভাবেই বা বুঝাবে নিজেকে বোনের সম্পর্কে বলা হয়েছে তাকি বিশ্বাস করার মতো কথা হয়?

ইয়াদ নিচে গেল আম্মা রান্নাঘরে রান্না করছিলেন।ইয়াদ ডাইনিং টেবিলে বসে গলা উচু করে বললেন,
-আম্মু এক কাপ কড়া করে কফি দিও প্লিজ!!

কিছুক্ষন পর সুহান বেগম ছেলের জন্য কফি টেবিলে রাখলো।ইয়াদের পাশের চেয়ারেই বসলো।ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-কিছু কি হয়েছে?সকাল থেকে কেমন ডিস্টার্ব দেখছি?

ইয়াদ কফির মগে চুমুক দিয়ে মলিন হেসে বলল,
-নাহ কিছু হয়নি।তুমি চিন্তা করো না।
-ফারাহকে দেখিনি?ও আসেনি?

ইয়াদের দিকে পুর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল।ইয়াদ কফির দিকে তাকিয়েই বললেন,
-জানি নাহ।

বলে উঠে গেলেন নিজের রুমে।সুহানা বেগম ছেলের ভাবভঙ্গি বুঝতে পারলেন না।সেই প্রথম দিন থেকে ফারাহর প্রোটেক্ট করে আসছে আর হঠাৎ করে কি হয়ে গেল?সুহানা বেগম ছেলের আচরনে চিন্তিত হয়ে পরলেন।

————-

রাতে,
সোনিয়া ভায়ের কামরায় আসলো ইয়াদ কেমন একখেয়ালী হয়ে বসে আছেন।সোনিয়া ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাড়ালো।ইয়াদ সোনিয়াকে দেখে হাল্কা হেসে তার দিকে তাকালো।
-কিরে কি হয়েছে?

সোনিয়া ইয়াদের পাশে বসলো।ইয়াদের কাধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলল,
-ভাই কিছু কি হয়েছে তোমার?আজ সারাদিন রুম থেকে বের হও নি কেন?আর ভাবী আসেনি কেন?

ইয়াদ বোনের কথায় তার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার মুখ নিচে নামালো।এখন কি বলবে সে?ফারাহ কেন আসেনি?কি করে বলবে সে?ইয়াদ মলিন কন্ঠে বলল,
-আরে নাহ কিছুই হয়নি চিন্তা করিস না।
-দেখ ভাই আমি তোমার ছোট বোন কিন্তু সব বুঝি।তোমার কি কারনে মন খারাপ?

ইয়াদ উঠে দাড়ালো।কি বলে বুঝাবে এখন বোনকে?ইয়াদ না হচকচিয়ে সোজাসাপ্টা ভাবে বোনকে বলল,
-ফারাহ তার এক্স এর সাথে এখনো কথা বলে।এক্স বললে ভুল হবে প্রেজেন্ট।

সোনিয়া ভাইয়ের এহেন কথা অবাক হলেন।ফারাহ ভাবী এইসব করতে পারেই না সে কখনোই দেখেনি।সম্পুর্ন তার ধারনার বাইরে এইসব।সোনিয়া উঠে দাড়ালো ভাইয়ের সামনে গিয়ে বলল,
-এইসব কি আবল তাবল বকে যাচ্ছো ভাই?ভাবী এইসব কিছুই করেনি।

ইয়াদ সোনিয়াকে কিভাবে বুঝাবে তার পবিত্র ভাবী আসলে পবিত্র নয়।সে যেটা ভাবছে আসলে সেইটা নয়।ইয়াদ সোনিয়ার কাছে এসে বলল,
-আমি নিজে দেখেছি ওর ফোনে R দিয়ে নাম্বার সেভ করা আর কি সব মেসেজ।বলতেও মুখে বাজছে।

মুখ ছিটকে বলল ইয়াদ।সোনিয়া ইয়াদের কথা শুনে বুক ধক করে উঠলো।ভাইয়া সব জেনে গিয়েছেন?এখন কি বকবে আমায়?নাকি মারবে?এইসব ঘুরে যাচ্ছে সোনিয়ার মাথায়।ভীত কন্ঠে বলল,
-সত্যি বলছো?
-হুম।

ইয়াদ বসে পরলো বিছানায়।সারাদিন এইসব কথা মাথায় ঘুরছিল এখন শেয়ার করে জেন একটু শান্তি লাগছে তার।হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
-ফারাহ আমার সবকিছু শেষ করে দিল।আমি ওকে প্রচুর বিশ্বাস করেছিলাম ও সব ভেংগে দিল।

সোনিয়ার বুক কাপছে।ইয়াদ ফারাহকে ভুল বুঝেছে এর জন্য ওর খারাপ লাগছে।নিজেকে সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি মনে হচ্ছে।একজনের সংসার এইভাবে সে উজার করতে পারেনা।এইভেবে কাপাকাপা পায়ে ভাইয়ের মুখ বরাবর দাড়ালো।কাপাকাপা কন্ঠে বলল,
— R,,R দিয়ে সেভ করা ব্যক্তি ভাবীর কিছুই হয়না।

ইয়াদ সোনিয়ার মুখ থেকে কথা শুনে মুখ তুলে তাকালো।
-তুই বেশি বকিস না।
-ওইটা আমার বয়ফ্রেন্ড রাহুল।

ইয়াদ আশ্চর্য নজরে বোনের দিকে তাকালো।সোনিয়া পুরো কাপতে লাগলো ভাইয়ের নজরে।হাত মলতে মলতে বলল,
-আমি রাহুলকে ভালোবাসি।আম্মা আমার ফোন ভেংগে ফেলায় ভাবীর টা দিয়ে মেসেজ করেছিলাম আর সেভ করেছিলাম R দিয়ে।

মাথা নিচু করে বলল।ইয়াদ অবাক হয়ে উঠে দাড়ালো।বোনের কথা শুনে রেগে গেল।ফারাহ সত্যিই বলেছিল সেই তাকে ভুল বুঝেছে!!এখন নিজেকেই নিজের মারতে ইচ্ছে করছে।ইয়াদ সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে উচু গলা বললেন,
-আমাকে আগে বলবি না?একটা বার তো বলতেও পারতি?

সোনিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।ইয়াদ জোরে চিৎকার করে বলল,
-যাহ এখন এইখান থেকে।

ইয়াদ বিছানায় বসে পরলেন।ফারাহকে সে ভুল বুজেছে তাই তো তার মন মানছিল না।সে কেন ভুল বুঝলো?সে একটু তো বিশ্বাস করতে পারতো নাকি?নিজের প্রতি প্রচুর রাগ হচ্ছে ইয়াদের।

———–

সকালে,
ইয়াদ ফারাহকে ফোন করলো কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো।অপর পাশ থেকে কোন কথা না শুনে ইয়াদ নিজেই সালাম দিল।সালামের উত্তর ও করলো না।ইয়াদ হাল্কা হাসলো খুব বেশিই রেগে আছে।কড়া গলায় বলল,
-দশ মিনিটের মধ্যে যেন বাসায় দেখি তোমায়।

অপর পাশ থেকে ফারাহ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন কাট করে দিল।ফারাহ বেচারি কিছু বলতেও পারলো না।ইয়াদ অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।

এগারোটার মধ্যে ফারাহ বাড়ি ফিরলো।সোফায় সুহানা বেগম আর সোনিয়া বসে আছে।ফারাহ সুহানা বেগমকে সালাম দিলেন।সুহানা বেগম কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-আজ আসতে ইচ্ছে হলো?আরো দুদিন থেকে আসতে?

আমি কিছু বললাম না।মন চাইছিল বলতে আপনার ছেলেই ডেকেছে নাহয় আসতামি না।এই বাড়িতে সবাই শুধু আমার সাথে কড়া গলায়ই কথা বলে ধুর জীবনটাই বেদনার।সিড়ি বেয়ে যেতে নিলেই সোনিয়ার ডাক পরলো।একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।সোনিয়া হুট করেই আমার হাত ধরে ফেলল।আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।কি হলো?কাদোকাদো কন্ঠে বলল,
-ভাবী আমাকে ক্ষমা করে দাও!!আমার জন্য তোমাদের মধ্যে ঝামেলা পেকেছে।

আমি প্রথমে ওর ক্ষমার কারন না বুঝতে পারলেও এখন ঠিকি বুঝতে পেরেছি।ইয়াদ তাহলে সোনিয়াকে ব্যাপারটা বলেছে আসলে বলেই ভালো করেছে সত্যিটা এখন সে জানতে পারলো।নাহয় সারাজীবন তো দোষি আমিই থেকে যেতাম।মলিন একটা হাসি দিয়ে সোনিয়াকে বললাম,
-আরে ক্ষমা চাচ্ছো কেন সমস্যা নেই।

উপরে গেলাম।এই বাড়িতে সবাই শুধু আমার সাথেই পারে কেউ মিজাজ দেখায় কেউ চিৎকার করে আবার কেউ ক্ষমায় জরজরিত।উফফফফ কোথায় এসে পরলাম।নিজের কপালকে বকতে বকতে রুমের দিকে গেলাম।ইয়াদ পাইচারি করছিলেন আমাকে দেখে এক যায়গায় পা থেমে গেল।সম্ভবত আমার অপেক্ষায় ছিলেন।আমি তাকে ইগ্নোর করে এগিয়ে গেলাম।সে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
-এতক্ষন লেগেছে কেন আসতে?সেই কখন বলেছিলাম?

মিজাজ আমার চংগে উঠে গেল তার এইসব কথা শুনে।একেতো একা এসেছি আবার বলছে দেরি হলো কেন?সেইদিন কত করে বকেছিল আর এখন মুহাব্বাত?সব ছুটাচ্ছি।আমি দাতেদাত চেপে বললাম,
-রিকশা দিয়ে এসেছি প্লেন দিয়ে নয় দেরি তো হবেই।

ইয়াদ ফারাহর কথায় দাত কেলালো ফারাহর আগোচড়ে।ফারাহর সামনে গিয়ে দাড়ালো।ফারাহ ইয়াদকে ইগ্নোর করে ওয়াশ্রুমে গিয়ে দরজা ঠাস করে আটকে দিল।ইয়াদ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো ফারাহর কান্ডতে।আসলে এইটা খুব কমিই করছে যা করছে তার আরো প্রাপ্য সে ভুল কিভাবে বুঝলো?নিজেরই রাগ লাগছে কিন্তু ফারাহকে তো মানাতে হবে।

আমি ওয়াশ্রুম থেকে বের হলাম।আমার জন্য বিছানায় সুন্দর ভাবে টাওয়াল সাজিয়ে রেখেছে।আহহা কতই না কেয়ার উতলায় পরতাসে।বরাবরই তার করা কাজে বিরক্ত হচ্ছি প্রথমে না জেনে মিথ্যে অপবাদ দিল এখন আদ্যিক্ষতা দেখানো হচ্ছে?আমি টাওয়াল টার্চও করলাম না প্রচুর অভিমান করেছি তার সাথে হুহ ভাংবে না।

ইয়াদও কম যায় না৷ ফারাহর অভিমান সে ভেংগেই ছাড়বে।ফারাহর প্রিয় কিটকেট এনে ফারাহর সামনে ধরলো।চুল আচড়াচ্ছিল ইয়াদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো।ইয়াদ মাসুম চেহারা করে ফারাহর দিকে তাকিয়ে আছে কিটকেট নেওয়ার অপেক্ষায়।
-আজ অফিস নেই?যান অফিসে যান।
-বউ রেগে থাকলে ভালোলাগে?

ইশশশশ আসছে এখন বউয়ের কেয়ার করতে?রেগে গেলাম উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,
-বউর রাগ এখন দেখছেন আর সেইদিন যে বকলেন অযথা?সেইটা,,সেইটার কি হবে হ্যা?

ইয়াদ অপরাধী ফেস করে তাকালো ফারাহর দিকে।
-আসলেই আমার ভুল হয়ে গেছে।আমায় ক্ষমা করে দাও তোমায় ভুল বুঝেছি আমি।

ইয়াদের এই চেহারা মোটেও আমি দেখতে পারছি না।ক্ষমা করে দেওয়াটাই শ্রেয় হবে।আমি ইয়াদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,
-আর কখনো অবিশ্বাস করবেন?কখনো সবটা না জেনে বকবেন?

ইয়াদ আমার দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা দুলালো সে আর এই রকম ভুল করবে না।আমি হেসে ফেললাম ইয়াদের এই বেকুব মার্কা চেহারা দেখে।ইয়াদও হেসে ফেলল।আমি ইয়াদের গলা জরিয়ে নাকে নাক ঘষে বললাম,
-ভালোবাসি।

ইয়াদ আমায় জড়িয়ে ধরে বলল,
-ভালোবাসি।

_____________সমাপ্ত___________