প্রেম তরঙ্গ পর্ব-০১

0
493

#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#উষা_পর্ব

খুব ভয়ে থাকি তাকে দেখে। খুব দ্বিধায় থাকি আজকাল। তার অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারি না। জোর গলায় আমি তাকে শুধাতে পারি না,

” কেন আমার তিতাসকে আপনি আমার থেকে আলাদা করে দিলেন? কেন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আপনি আমায় ছোট করলেন ওর চোখে। আপনি একটা নিচু মনের মানুষ। শুধুমাত্র বোনের ভালোবাসাটাই দেখলেন? আর তার ভালোবাসার মূল্য দিতে গিয়ে আজ আমার ভালোবাসা কেড়ে নিলেন। আই হেইট হউ আনলিমিটেড।”

অনেক গুলো এমন কথা মুখে এসে জড়ো হয়। হুটোপুটি খায় বুকের মাঝে। কিন্তু বলা হয় না। এক বদ্ধ ঘরে বোবার মতো শুধু দিনপাত করে যাচ্ছি আজ সাত দিত হলো। সে জাতে আমেরিকান। বাংলা বাবার সন্তান। আর আমেরিকান মায়ের পুত্র। নাম তার ক্যারেন জাহিদ। তার বোন কণা ইসলাম। ক্যারেনের মা গত দুই সপ্তাহ আগে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। তিনি আমেরিকাতেই থাকতেন পুত্রসহ। শুধু কণার জন্ম আমেরিকাতে হলেও বাসস্থান বাংলাদেশে। আমার শশুর, আলোম ইসলাম ক্যারেনের মা ছাড়াও আরো একজন নারীকে স্ত্রী করেছিলেন। তিনি বন্ধ্যা। নিসন্তান। পরবর্তীতে শুনেছি ক্যারেনের বাবা কণাকে বাংলাদেশে আনেন। তার পূর্বে আমার ক্যারেনের মায়ের সম্পর্কে কেউ অবগত ছিল না। বলা চলে ক্যারেনের বাবা ক্যারেনের মা’কে লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। সকলের অগোচরে, অমতে। অতঃপর এক বিদেশি নারী সাথে ক্রিশ্চান থেকে ধর্ম পরিবর্তন করা ক্যারেনের মায়ের কথা পরিবারের কাছে তুলে ধরতে পারেননি। ফলস্বরূপ শাশুড়ি মা বিদেশেই পরে ছিলেন। তবুও তার নাকি ছিল না কোনো অভিযোগ, ছিল না কোনো রাগ ক্ষোভ স্বামীর প্রতি। হাসি মুখে কণাকে তুলে দিয়েছিল ক্যারেনের বাবার হাতে। সতীন নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা হয়তো ছিল না। ছিল না বাঙালী নারীদের মতো তেজ। তবে ভালোবাসাটা ছিল অপরিসীম।

–টিটি? হেই…. টিটি?

ভাবনার মাঝে হঠাৎ হাঁক। চমকে উঠলাম আমি। হাঁটু মুড়ে বসে ছিলাম ফ্লোরে। চকিতে উঠে দাড়িয়ে গেলাম। ক্যারেন ভ্রু কুঁচকে দাঁড়ানো আমার সামনে। আমি একপলক দেখে চোখ সরিয়ে নিলাম। তাকে দেখলেই বুকে কেউ যেন এসিড ছুড়ে মারে। পুড়তে পুড়তে যেন কুঁচকে যায় হৃদয়।

— টিটি, হট হ্যাপেন? এখানে এভাবে বসে আছো কেন?

স্পষ্ট আর অস্পষ্ট বাংলা ভাষা তার। তালগোল পাকানো। আমার তিথি নাম গুলিয়ে মিলিয়ে ডাকে টিটি! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মুরগির বাচ্চা। আঁধার দেওয়ার জন্য আমায় ডাকা হচ্ছে, “টিটি আয় আয় পানি খেয়ে যা!”

— এমনি।

আমার কথার প্রত্যুত্তরে ক্যারেন তার ফ্যাকাশে ফর্সা মুখটায় টেনে আনলো একঝাঁক চিন্তা। আমি জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। তার পায়ের পাতার আমার দৃষ্টি পরলো। সাদা কাগজের মতো। রক্তের লাল লাল শিরা উপশিরা ভেসে আছে অতি আনন্দে।

— থোমার টিটাস কাল বউ নিটে আসবে। যাবে না? সকাল সকাল যেতে হবে কিন্তু। এওকন তো লাস্ট নাইট। ঘুমাও। কুইক!

ক্যারেনের কন্ঠস্বর আমায় জ্বালিয়ে দিলো যেন। তার এলোমেলো বাংলা শব্দের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা কটাক্ষ বাণী ঝট করে ধরে গেলো আমায় মাথায়। আমি তড়িৎ গতিতে মাথা তুললাম। মুহূর্তেই আকস্মিক ভাবে ঠক করে শব্দ হলো। তার থুতনিতে লেগেছে আমার মাথা। এতো কাছে ছিল নাকি? আমি ঈষৎ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে চাইলাম দুপা। ঠিক তখনই আবার ক্যারেন তার শক্ত পা দিয়ে চেপে ধরলো আমার পায়ের পাতা। তার ডান পায়ের পুরো পাতা জুড়ে বসলো আমার বাম পায়ে। ধ্বক করে যেন শব্দ তুলল আমার হৃদপিণ্ড। শঙ্কিত চোখে চেয়ে দেখি সে বন্ধ করে নিয়েছে চোখ। সাদা চামরার কপাল জুড়ে পরেছে দু তিনটে ভাজ। আমি মিন মিনিয়ে বলে উঠলাম

— স..সরি।

ক্যারেন চোখ মেলে তাকালো এতোক্ষণে। বিরক্তর দৃষ্টিতে যেন আমায় ঝলসে দিয়ে সে সমস্ত ফারাক ঘুচে ফেলে এগিয়ে এলো আমার নিকট। ততক্ষণে তার বাম পাটা আলগোছে রাখা হয়ে গেছে আমার ডান পায়ের পাতার ওপর। আমি বন্ধ করে নিলাম চোখ। ক্যারেন এমন সময় বলল

— জিভ কেটে দিলে। দিস ইজ নট ফেয়ার। টিটাসকে নিয়ে এথো সিরিয়াস?

— আমি.. দেখিনি।

বন্ধ চোখে বলে উঠলাম। ক্যারেনের পক্ষ হতে কোনো বাঁক পেলাম না আর। একটু সময় পর। প্রায় মিনিট দুয়েক। অনুভব করলাম আমার পা জোরা শান্তির ছোঁয়া পেয়েছে। মুক্ত সে ভারি কোনো কিছু থেকে। ক্যারেন বোধ হয় চলে গেছে। আমার বন্ধ চোখের পাপড়ি বেয়ে গাড়িয়ে গেলো এক ফোঁটা জল। মনে উথলে ওঠতে লাগলো সেই মুহূর্ত। আমার আর তিতাসের ভালোবাসার কিভাবে ফাটল ধরিয়েছিল ক্যারেন সে কথা।

সেদিন ছিল ক্যারেনের মায়ের মৃত্যুর তৃতীয় দিন। ক্যারেন সুদুর আমেরিকা থেকে নিজের প্রাণহীন মাকে নিয়ে এসেছিলো বাংলাদেশে। আমি কণাদের বাসার ভাড়াটিয়া। আম্মু আব্বু গ্রামে পরে থাকে। আমি লেখাপড়ার সূত্রে ঢাকায়। বাসাটা ঠিক করে দেয় আমায় তিতাস। ক্যারেনের বাবা সম্পর্কে তিতাসের খালু। তিতাসের ছোট খালার স্বামী। আমি তখন মাত্র তিনদিন হলো উঠেছি কণাদের বাসায়। তিতাস আগে থেকেই সে বাসার বাসিন্দা। ওখান থেকে ওর মেডিকেলের দুরত্ব বড্ড নগণ্য। আমার যে এডমিশন হলো। তখন পুরোদস্তুর গাধার মতো খাটিয়ে খাটিয়ে পড়িয়েছে তিতাস। শুধুমাত্র এই আশায় যেন আমি ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাই। তার পাশাপাশি থাকি। সে পুরোদমে যেন আমার খেয়াল রাখার অবকাশ পায়। রাত তিনটা পর্যন্ত ভিডিও কলে থেকে আমায় পড়িয়েছে। নিজে এপাশে কঙ্কাল নিয়ে সংসার করেছে আর আমাকে বই দিয়ে রেখেছে। কখনোবা ঘুমিয়ে গেছে। ফোন কাটা হয়নি। বড্ড ফাঁকিবাজ আমি। পড়ালেখা একদম ভালো লাগে না এ কথা সে বেশ করে জানে। ঘুমের মাঝে আবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলেছে

” এই, তিথি… পড়ছো তো তুমি? প্লিজ ফাঁকিবাজি কোরো না। ঢাকায় আসার এই একটাই চান্স তোমার। আমাদের প্রেমের পূর্ণতা পাওয়ার পথ এটা। তুমি আসলেই আমি একটা ক্লু নিয়ে তোমার আম্মু আব্বুর কাছে গিয়ে তোমায় চাইতে পারবো।”

— লাইট অফ করবো আমিই

ভাবনার মাঝে আবারও ক্যারেনের ডাক। সে বিছানায় অবস্থানরত। আমি চোখ মুছে গুটি গুটি পা বাড়িয়ে চলে এলাম বিছানার কাছে। ক্যারেন বুকে ভর দিয়ে শুয়ে আছে। তার মাথার এক ঝাঁক সরু, ঈষৎ লালচে চুলগুলো দেখে আমার ইচ্ছে জাগলো টেনে ধরি। টেনে টেনে উঠিয়ে মনের সব আক্রশ মিটিয়ে ফেলি। কিন্তু তা হবার নয়। ধুপ করে বিষাদ মাখা মন নিয়ে শুয়ে পরলাম তার পাশে। সে লাইট নেভালো। অতঃপর কি আধারকে আপন করে বন্ধ করলো চোখ? করেছে হয়তো! একটু পর ঘুমিয়েও যাবে। তার তপ্ত নিশ্বাসের সুর কানে বাজবে আমার। রাত গত হতে থাকবে। আমার ঘুম হবে না। প্রথম দু রাতে ঘুম হয়নি ভয়ে। ক্যারেন নি স্বামীর অধিকার নিয়ে জোরজারি করবে আমার সাথে? এমন দুশ্চিন্তায় গ্রাস হয়ে ছিলাম। অতঃপর দু’টো রাত যখন কাটলো। ক্যারেনের পক্ষ হতে অপ্রত্যাশিত কিছু প্রকাশ পেলো না তখন বুকের ভয় অল্পে অল্পে নেমে গেছে। জানি না সে কি চায়। তাকে তো আমি কোনো এক দ্বিধা, ভয়, অস্বস্তির কারণে কিছু বলতেও পারি না। মা বাবাও জানে না আমার এসব খবর। এক বিদেশি তরুণের সাথে যে আমার আচমকা, বাজে পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে সেখবর আমার আপনজনদের কেউ জানে না। ফোনে কথা হলো এই সাতদিনে মা-বাবার সাথে। কিন্তু কিছু বলার সাহস হয়নি আমার। ক্যারেন কে আমি বুঝি না। আর না বোঝার চেষ্টা করি। আমি শুধুই তার নামে বুকের মাঝে ঘৃণা পুষি। অসংখ্য, পাহাড়সম। তিতাসকেও ঘৃণা করি আমি। কিভাবে পারলো সে আমায় অবিশ্বাস করতে? কিভাবে? তারউপর কণাকে বিয়ে করলো এক নিশ্বাসে। তিনবার কবুল উচ্চারণ করে। একবারও ওর কষ্ট হয়নি? বুক কাঁপে নি?

চলবে……
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন )