#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫
“সাইকোর বাচ্চা! সর বলছি। ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করছে। অভি, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
অভিরূপকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল নোমান। তবে কে শোনে কার কথা। অভিরূপের বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটেই গেছে। আবারও নাদিম সাহেব কল করছেন। অভিরূপ জোর গলায় বলল,
“তুই যদি না চাস তোর বউয়ের আগে আমিই সব দফারফা করে ফেলি তাহলে আমাকে হেল্প কর। হেল্প মি অ্যান্ড টেক ইউর ইজ্জত ফর ইউর ফিউচার বউ।”
নোমান ক্লান্ত প্রায়। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকে। অভিরূপ তার এমন আচরণ দেখে টাওয়াল আরেকটু টেনে বলে,
“কী হলো? কী চাচ্ছিস?”
নোমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত উঠিয়ে বলে,
“দে। তোর ফোনটা দে আমাকে।”
বিশ্ব জয়ের হাসি ফোটে অভিরূপের মুখে। কী ঝলক তার হাসির! ফোনটা সেভাবেই হাত থেকে নোমানের হাতে তুলে দেয়। নোমান ফোনটা কোনোরকমে রিসিভ করতে যাবে সেই সময় এক চিৎকারে দুজনেই ঘাবড়ে দরজার কাছে তাকায়। দরজায় ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। সম্ভবত হোটেলের সার্ভেন্ট হবে। মেয়েটির রসগোল্লার মতো চোখ বলেই দিচ্ছে অভিরূপ আর নোমানের এই ভঙ্গি সে অন্য কিছুই ভেবে নিয়েছে। নোমান আর অভিরূপ দুজন দুজনের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকায়। তখনি মেয়েটির হাতে থেকে হুড়মুড় করে ট্রে সহ কাঁচের চায়ের কাপ ফ্লোরে পড়ে খন্ড খন্ড হয়ে যায়। বিকট শব্দ হয়। দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে মেয়েটি। কাঁপা এবং উত্তেজিত সুরে বলে,
“আই এম সরি, আই এম সরি। আমি বোধহয় ভুল সময় এসে পড়েছি। ক্ষমা করবেন।”
মেয়েটিকে আর পায় কে? ধড়ফড় করে বেরিয়ে যায় মেয়েটি। নোমান এবার এক পা আর দুটো হাত দিয়ে অভিরূপকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলে,
“হলো তো? মেয়েটা কি না কি ভেবে নিয়েছে গড নোজ! ছি! অভি, তোর জন্য কোনো আজব খবরে ফেঁসে যাই তাহলে কিন্তু সব মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থুথু মারবে, সাথে তোকেও!”
অভিরূপ তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে আটকাতে যায়। বাহিরে বেরিয়েই দেখে মেয়েটা করিডোরের শেষ মাথায়। একটু জোরেই অভিরূপ ডেকে ওঠে,
“ওহ হ্যালো!”
অভিরূপের ডাকে হাঁটা থামে মেয়েটার। পেছন ফিরে তাকিয়ে অভিরূপকে দেখে আরো জোরে হাঁটা ধরতেই অভিরূপ এবার আরো জোর সুরে ডেকে ওঠে,
“আই সেইড স্টপ!”
অভিরূপ চৌধুরী! তার জনপ্রিয়তা যে কত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই হোটেলে তার কথা অগ্রাহ্য করা মানে চরম সাজাও পেতে হতে পারে। তাই হয়ত মেয়েটা থামে। কাঁপতে কাঁপতে অভিরূপের দিকে ফিরে। অভিরূপ দূর থেকেই বলে,
“আপনি কিছু দেখেন নি ওকে? উই আর বেস্টফ্রেন্ড! জাস্ট কিডিং! সো প্লিজ আজগুবি কিছু ভেবে নিজের মাথা খারাপ করবেন না।”
মেয়েটা জোরে জোরে মাথা নাড়াতেই অভিরূপ আবারও বলে,
“আর যেসব ফেলে দিয়েছেন তা পরিষ্কার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। ডোন্ট প্যানিক! আই উইল পে। যা ভেঙেছে তার জন্য চিন্তা করবেন না।”
মেয়েটি এবারও মুখে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা ঝাঁকিয়েই তড়িঘড়ি করে চলে গেল। অভিরূপ হাঁপ ছেড়ে রুমে ফিরে আসে। নোমানের দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল করে নোমান টাওজার পড়ে নিয়েছে। অভিরূপকে দেখে বাঁকা হাসি দিল নোমান। তার হাসির অর্থ, অভিরূপ আর তার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করতে পারবে না। কিন্তু অভিরূপ কি কম যায়? দুজনেই যেন আবারও ধস্তাধস্তি লেগে যায়। যে জিতবে সে ঠিক করবে নিজের দেশে ফিরবে কি না!
উপুড় হয়ে পেট ধরে মুখটা বালিশের সঙ্গে চেপে শুয়ে আছে কোহিনূর। নড়াচড়া করাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পেটে পাথর রেখে দিয়েছে কেউ। মাঝে মাঝে হালকা করে ‘উহ’ করে শব্দ করে উঠছে সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একবার মাথা এদিক আর একবার ওদিক করছে। সামনেই ঠোঁট চেপে হেঁসে দাঁড়িয়ে আছে রাগিনী। একটু একটু করে পেটে সব খাবার ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সে। এবার কোহিনূরের অবস্থা দেখে হাসিটা এসে যাচ্ছে বার বার। গত আধঘন্টা ধরে সে এভাবেই শুয়ে রয়েছে। আর মাঝে মাঝে পেট ধরে মোচড়াচ্ছে। রাগিনী মিটমিটিয়ে হেঁসে জিজ্ঞেস করল,
“আর ইউ ওকে?”
কোহিনূর ব্যথিত সুরে বলে,
“মানুষ কাউকে বি’ষ দিয়ে মা’রে। কাউকে রি’ভলবার দিয়ে মা’রে আবার কাউকে ছু’রি দিয়েও মারে। কিন্তু ভালো ভালো খাবার খাইয়ে কী করে কাউকে মা’রতে হয় সেটা তোমার থেকে শেখা উচিত।”
রাগিনী এবার হাসতে গিয়েও থামে। এখন হাসা মোটেও ঠিক হবে না। ঠোঁট কামড়ে হাসি নিবারণ করার চেষ্টা করে। কোহিনূরের চোখে এই দৃশ্য আঁটকায়। সে আগ বাড়িয়ে বলে,
“হাসো হাসো। আরো হাসো। এবার হাসির মাধ্যমেও খু’ন করে দাও। এটাই বাকি রেখেছিলে।”
এবার আশ্চর্য হয়ে হাসি থামায় রাগিনী। উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“হাসিতে আবার কে খু’ন হয়? এবার বলবেন না আমার হাসিতে বি’ষ মিশিয়ে রেখেছি।”
কোহিনূর আধশোয়া হয়ে ধীরে মাথা ঝাঁকায়। উত্তরে বলে,
“এটার বি’ষের মারাত্মক কিছু। এটা হতে পারে আসক্তি। যেখানে আমি বাঁধা পড়েছি।”
“আপনার মনে কী এমন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতির আগমন ঘটেছে আমার জন্য?”
বাঁধাবিহীন বলে ফেলা কথাগুলো এবার কোহিনূরকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয় যেন। ঢক গিলে চোখ বন্ধ করে আবারও পেট চেপে ধরে ‘উহু’ বলে ওঠে। রাগিনীর বুঝতে সময় লাগে না যে এই ব্যক্তি হতে পারে তার কথার কিছুই বোঝেনি আবার হতে পারে বুঝতে চেয়েও সেটা এড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সেও আর না ঘাঁটিয়ে নিজেকে সংবরণ করে বলে,
“আরো খাবেন না খাবার?”
“প্রশ্নই ওঠে না। পেট ব্যথা করা শুরু করে দিয়েছে। আমি এবার থেকে পারলে না খেয়ে থাকব তাও তোমার মতো বিপদজনক নারীকে খাবার আনতে বলব না।”
“আচ্ছা শুনুন। চলুন একটু সিটি হসপিটাল থেকে ঘুরে আসি। এই বাহানায় আপনাকে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার জন্য চেক আপও করিয়ে নেওয়া যাবে!”
“তোমার সাথে গিয়ে আরো রিস্ক বাড়াতে পারব না সরি। বলা যায় না আবার গাড়ির ব্রেকফেল করিয়ে আমাকে মা’রার পরিকল্পনা করতে পারো!”
রাগিনী চোখমুখ জড়িয়ে বিরক্তির সুরে বলে,
“ধুর। আমি সিরিয়াস। আমাকে ওই বাচ্চা ছেলেকে দেখতে যেতে হবে। আমি ওকে কাল রেসকিউ করেছিলাম। আজকে দেখতে না গেলেই নয়। আপনিও যাবেন আমার সঙ্গে।”
কোহিনূর পেট ধরেই উঠে বসে। বাধ্য ছেলের মতো বলে,
“আপনি যখন বলেছেন তখন কোহিনূর যেতে বাধ্য। এখন সেটা হসপিটাল হক বা এভারেস্ট! রাগিনী তাজরীনের আদেশ শিরোধার্য!”
কোহিনূর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যখন হাতে একটা টিশার্ট নিতে যায় তখন তার হাতের ব্যান্ডেজ এবার নজর এড়ায় না রাগিনীর। হুট করেই এমন ব্যান্ডেজে কিছুটা অস্থির ভঙ্গিতেই ছুটে এসে কোহিনূরের ব্যান্ডেজ করা স্থান আলতো স্পর্শ করে সে। অস্থিরতার সাথে বলে,
“কী করে এমন হলো?”
“তেমন কিছু না। হুট করেই কাঁচ লেগে কে’টে গেছে।”
রাগিনীর মুখটা নিমিষে বিষিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে কোহিনূর। মেয়েটা এতো নরম মনের কেন? সামান্য আ’ঘাতের কারণে বুঝি এতো ব্যাকুল হতে হয়? রাগিনী বলে,
“নিজের একটুও খেয়াল রাখেন না তাই না?”
ব্যাকুলতায় ভরা সেই কন্ঠ। মেয়েটা বুঝি জানে না তার এমন কন্ঠ কোহিনূরের অন্তর কাঁপিয়ে তোলে? কোহিনূর একটু মাথা ঝুকিয়ে ধীর গলায় বলে,
“খেয়াল রাখার জন্য যখন এতো সুন্দর একটা মানবী থাকে তখন আর নিজের খেয়াল রাখতে ইচ্ছে করে না।”
মুখটা ভেঙ্গিয়ে কোহিনূরের বাহুতে হালকা ধাক্কা মারে রাগিনী। বিষণ্ণ হয়ে বলে,
“সবসময় মজা করেন আপনি।”
“আর করব না। তাহলে কি আমরা যেতে পারি?”
রাগিনী কোহিনূরের দিকে একটু তাকায়। তারপর পায়ের গোড়ালি উঁচু করে একটু উঁচু হয়ে কোহিনূরের চুলে হাত দিয়ে চুলগুলো একপাশ করে দিয়ে বলে,
“এবার চলুন।”
অন্ধকার ঘর। ঠিক ঘর নয়। একটা গুমোট জায়গা। অদ্ভুত একটা গন্ধ। জায়গাটির চারিপাশে বস্তা সাজিয়ে রাখা। আলো বলতে শুধুমাত্র উপরে থাকা এক ফাঁকা জায়গা থেকে আলো প্রবেশ করছে। যা দিয়ে একটু ঝাপ্সা দেখাচ্ছে সবটা। মাঝখানে রাখা দুটো কাঠের চেয়ার। আর পাশে একটা টেবিল। দুটো চেয়ারই দখল করে বসে আছে এক কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি। প্রসারিত তার দেহ। ঘাড় বাঁকিয়ে রাখা। পা দুটো অন্য চেয়ারে রেখে দিয়ে এক হাতে গ্লাস আর অন্যহাতে সিগারেট ধরিয়ে বসে আছে সে। চোখ দুটো বন্ধ। ঘাড় কাঁত করেই বসে থাকা সেই অজানা মানব চোখ বুঁজেই একবার সিগারেটে মুখ লাগাচ্ছে আর একবার হুইস্কি ভরা গ্লাসে। দরজায় একটু শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল নেত্রপল্লব। কড়া এবং ধারালো দৃষ্টি চলে গেল দরজার কাছে। ধীর পায়ে প্রবেশ ঘটল এক নারীর। স্বভাবতই মুখে মাস্ক আর মাথাটা স্কার্ফ দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা। চোখে আজ সানগ্লাসও রয়েছে। সেখানে প্রবেশ করার সাথে সাথে সানগ্লাস খুলে হাত নিল সে। মাস্ক খুলল। দৃশ্যমান হলো তার ফ্যাকাশে, চুপসে যাওয়া মুখ। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো সেই ধারালো দৃষ্টির দিকে চাইতেই। নিজের চোখ নামিয়ে নিল সে। না চাইতেও সেই মানবের সামনে এসে দাঁড়াতে হলো। লোকটির নিরবতা দেখে সে নিজেই বলে উঠল,
“আ…আসলে আমরা বু…বুঝতে পারিনি আমাদের প্ল্যানিং এভাবে ফেল করবে। স…সরি ডার্ক…”
অসম্পূর্ণ থেকে যায় মানবীর কথা। ডার্ক ম্যাক্স তার পা রাখা চেয়ারটা পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“বস, লেডি বস।”
দাঁড়িয়েই রইল লেডি বস নামক নারী। আসলে তার বসতেও ভয় করছে। সে জানে এখানে ভালো কোনো কিছুর জন্যই ডাকা হয়নি। তার কোনোরকম হেলদোল না দেখে ডার্ক এবার কিছুটা চিৎকার করেই বলল,
“বস বলছি।”
এবার চমকে উঠল সে। চেয়ার টেনে নিয়ে আস্তে করে বসল। তার বসা দেখে সোজা হলো ডার্ক ম্যাক্স। সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে আবারও টান দিতেই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হলো আশপাশ। মেয়েটি মাথা নত করে বসে রইল। এবার তাকে শান্তভাবে প্রশ্ন করা হলো,
“এবার বল। কেন প্ল্যানিং ফেল হলো?”
“আমাদের আ’ক্রমণের আশঙ্কা ধরতে পেরে হয়ত ইন্সপেক্টর রায়ান আগে থেকেই আমাদের বোকা বানানো শুরু করে। অভিরূপের যেই গাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল সেটা হাইড রাখা হয়। অন্য একটা গাড়িকে এতোটাই প্রায়োরিটি দেওয়া হয় আর বলা হয় সেই গাড়িতেই অভিরূপ যাবে। তাই আমি কথা অনুযায়ী সেই গাড়ির নিচে বো’ম ভর্তি ব্যাগ রেখে দিই। কিন্তু লাভ হয় না। অভিরূপের একটুও ক্ষতি হলো না। আমরা হা’মলা করি। অভিরূপের গাড়িটাকে আঁটকায়। ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি আমাদের হাতেই আসবে। কারণ পসিবিলিটি আমাদেরই ছিল। কিন্তু হুট করে আরেক টিম এলো। পুলিশ টিম শক্ত হলো। আমরা পেরে উঠলাম না। আর আমাদের টিমের অনেকজনের মৃ’ত্যু হলো। কেউ কেউ এখন কাস্টারিতে।”
উঠে দাঁড়ালো ডার্ক ম্যাক্স। তা দেখে ধড়ফড়িয়ে মেয়েটিও উঠতে লাগল তবে তার কাঁধে হাত রেখে জোর করে বসিয়ে রাখা হলো। চমকে উঠল সে। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। ডার্ক তার চেয়ারের চারিপাশে হাঁটতে লাগল। সবশেষে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে তার চিবুক চেপে ধরে ডার্ক বলতে লাগল,
“এজন্যই তোকে আমি একটা আলাদা কাজ দিয়েছিলাম! ওই রায়ানকে শেষ না করতে পারিস। অন্তত একটু হসপিটালে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দিতে পারতিস। সেটাও তুই পারিস নি।”
তার চিবুক জোরে চেপে ধরা হয়েছে। চোখমুখ খিঁচে রেখেছে সে। কথাটির উত্তর দিতে সে উদ্যত হচ্ছে তবে তার আগেই গলায় চলে গেল ডার্কের বলিষ্ঠ হাত। চেপে ধরা হলো গলা। শ্বাসরোধ হতে লাগল স্কার্ফ পরিহিতা মেয়েটির। ছটফটিয়ে উঠল। হাত-পা চারিদিকে ছুটতে শুরু করল। ছটফটানিতে মাথা থেকে পড়ে গেল স্কার্ফ। বেরিয়ে এলো তার ছোট সিল্কি চুল। খুব একটা বড় নয় তার চুল। স্ট্রেইট কাঁধ অবধি। একটা সময় ছিল যখন ডার্ক তার চুলও কেটে দিয়েছিল। তবে আজ সে বাঁচার আশা দেখতে পাচ্ছে না। চিৎকার করার চেষ্টা করছে তবে ব্যর্থ হচ্ছে। যখন তার সবটা অন্ধকার তখন তার গলা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ডার্ক। একটা হাত নিজের প্যান্টের পকেটে গুঁজে পিছন ফিরে হাতে কাঁচের গ্লাসটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে বাড়ি দিয়ে ভাঙতেই গ্লাসটা টুকরো হয়। তার অর্ধেকটা ভেঙে যায় আর অর্ধেকটা থেকে যায় ডার্কের হাতে। বিকট শব্দে চমকে গিয়েও মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করতে পারে না লেডি বস। চোখ বুঁজে বড় বড় শ্বাস নিতেই সে ব্যতিব্যস্ত। সেই সুযোগে গ্লাসের ভাঙা এবং ধারালো অংশ হুট করেই চেপে ধরা হয় লেডি বসের হাতে। প্রাণ ফিরে পেতেই যেন আবারও প্রাণ হারা’তে বসেছে সে। নিজের মুখ চেপে ধরেছে সে অন্যহাত দিয়ে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে অশ্রু। চিৎকার করলে আরো ভয়াবহ কিছু দাঁড় করাবে ডার্ক তার সামনে। চলছে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু ডার্ক ম্যাক্স হয়ে উঠেছে হিংস্র। চোখে স্পষ্ট নিষ্ঠুরতার ছাপ। পাগল হয়ে উঠেছে একপ্রকার।
মিনিট দুয়েক এভাবে চলে। লেডি বসের হাত থেকে গলগল করে র’ক্ত পড়তে থাকে। ডার্ক তাকে ছেড়ে দিয়ে গ্লাসের বাকি অংশও ছুঁড়ে মে’রে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিজের হাতটা দেখে নিজেই আঁতকে ওঠে লেডি বস। তার চাপা আর্তনাদ শোনার মতো কেউ নেই। সে স্বেচ্ছায় এই দলে যুক্ত হয়েছে। তার মৃ’ত্যুও হবে এই ভয়ানক মানুষটির হাতেই। হাত দিয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে সে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মুখে দেখা যায় লাল আভা। ব্যথিত দৃষ্টি! ডার্ক তার দিকে ফিরে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,
“অভিরূপের মৃ’ত্যু না দেখে আমার শান্তি নেই। তোরও রেহাই নেই। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ। অভিরূপ চৌধুরীর মৃ’তদেহ যাবে এই দেশ থেকে। ভয় দেখতে চাই আমি। মানুষের চোখে ভয় আমার খুবই প্রিয়। কখন কীভাবে অভিরূপকে মারবি আমি জানি না। শুধু চাই র’ক্ত আর ভয়!”
গাড়ি থেকে নামল রাগিনী আর কোহিনূর। চোখমুখটা দেখার মতো হয়েছে কোহিনূরের। এতো খাবার পেটে রয়েছে যেন নড়তেও কষ্ট হচ্ছে। হাঁটতে গেলেই আগে বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। তা দেখে ক্ষণে ক্ষণে হাসছে রাগিনী। কোহিনূর আঁড়চোখে তাকাতেই হাসি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এভাবেই দুজন হসপিটালের ভেতরে চলে আসে। রিসেপশন পার হয়ে লিফটের কাছে আসতেই তাদের পাশেই তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়ায় একটা মেয়ে। হাইটে রাগিনীর চেয়েও একটু ছোট। কোঁকড়া চুলগুলো সুন্দর করে ঘাড়ে পড়ে আছে। পরনে কিছুটা আধুনিক পোশাক। তাকে খেয়াল করে না রাগিনী এবং কোহিনূর। লিফট খুলতেই যখন দুজনেই প্রবেশ করতে যায় তখনি তাড়াহুড়ো করে তাদের ঠেলে মেয়েটিও প্রবেশ করতে চাইলেই রাগিনীর একটু ধাক্কা লাগায় কোহিনূর ফট করেই রাগিনীর হাতটা ধরে নেয় নিজের মুঠোয়। এবার বিরক্ত হয়ে তাকায় কোহিনূর। মেয়েটির দৃষ্টিও যখন কোহিনূরের দিকে পড়ে তখন যেন দুজনেই থ হয়ে যায়। মেয়েটির মুখ আপনাআপনি হা হয়ে যায়। কোহিনূরের কপাল কুঁচকে যায়। আশ্চর্য হয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি বিস্ময় নিয়ে এক চিৎকার করে বলে ওঠে,
“বিগ ব্রাদার!”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬
হাত মুঠো করে ফেলে কোহিনূর। সারা শরীরে যেন তরঙ্গ বয়ে যায়। এ যেন ভয়ের তরঙ্গ। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। মুখের ফ্যাকাশে বর্ণ ফুটে ওঠে। অন্যদিকে রাগিনী বিষয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে একবার কোহিনূরের পানে চাইছে আর একবার সেই মেয়েটির পানে চাইছে। লিফটে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। এবার রাগিনী বিস্ময়ের সাথে কোহিনূরের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
“এক্সকিউজ মি! আপনি কি উনাকে বিগ ব্রাদার বলে ডাকলেন?”
আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকা নয়নতাঁরা এবার ভ্যাবাচেকা খেয়ে রাগিনির দিকে পলক ফেলে তাকালো। রাগিনীর আপাতমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কি সুন্দর মেয়েটা! ডাগরডাগর হরিণীর চোখ তার। সেই টানা টানা চোখে অনেক বিস্ময়। কথা বলার সময় যখন ঠোঁটজোড়া নড়তে থাকে তখন তার হালকা ফোলা গাল দুটোও নড়তে থাকে। নয়ন বিমোহিত হলো। কিছু বলতে গিয়েও লক্ষ্য করল কোহিনূরের কঠিন দুটো চোখ। নয়নতাঁরা ঢক গিললো। বুঝতে সময় লাগলো না তার খবর খারাপ আছে। রাগিনী নয়নতাঁরার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল,
“কি হলো বলুন আপনি কি উনাকে চেনেন?”
নয়নতাঁরা কিছু বলার আগেই কোহিনূর হুড়মুড়িয়ে বলে উঠলো,
“প্রশ্নই আসে না। হেই গার্ল, হু আর ইউ? ডু ইউ নো মি?”
বলেই নয়নতাঁরার দিকে হালকা ঝুঁকে পড়লো কোহিনুর। তার কঠোর দৃষ্টি নয়নতাঁরাকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিল। সেই মুহূর্তেই লিফটের দরজা খুলে গেল। ব্যাস… নয়নতাঁরাকে আর পায় কে! সে হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে যেতেই পিছু ডেকে উঠলো রাগিনী। রাগিনী মেয়েটা নাছোড়বান্দা। রাগিনী ওর লিফটের বাইরে বেরিয়ে আসে সেই সঙ্গে কোহিনূরও। কোহিনূর আবারো তড়িঘড়ি করে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“তোমার বিগ ব্রাদারের নাম কি?”
“উমম…পেন্সিল!”
এবার রাগিনী ও কোহিনূর উভয়েই বিস্ময়ের সাথে একই সঙ্গে বলে উঠল,
“হোয়াট?”
নয়নতাঁরা সঙ্গে সঙ্গে চমকে বলে উঠল,
“না! সরি। জায়ান্ট। মানে দৈত্য।”
বাকহীন হয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে কোহিনূর। তার দৃষ্টি যেন নয়নকে বলছে, ‘অন্তত নামটা তো ঠিক বল! দফারফা আর করিস না।’
রাগিনী বা কোহিনূরের কিছু বলার আগে নয়নতাঁরা আবারও যেচে বলে উঠল,
“আরে না! ডেভিল। নাউ ইট ইজ পারফেক্ট!”
রাগিনী বেশ ভাবলেশহীন হয়ে রইল। আদেও বুঝলো না আসলে মেয়েটা কী বলছে? তার মাথায় আবার সমস্যা নেই তো? তাহলে তো মহা বিপদ! কিছু বলার মতো পাচ্ছেই না সে। আসলে কী বলা উচিত? তৎক্ষনাৎ কোহিনূর দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“আমি আপনার বিগ ব্রাদার আসল নাম জানতে চেয়েছি মিস.!”
“নির্জন… নির্জন আহমেদ…”
কোহিনুর তার কথার মাঝখানেই বলে ওঠে,
“ইটস ক্লিয়ার। আমি কোহিনূর। নাউ ইউ ক্যান গো।”
বললেই আর তীব্র করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কহিনুর নয়ন তারার দিকে। নয়ন তারার মাথায় যেন বাজ পড়েছে। তবে কহিনুরের ইঙ্গিত বুঝতে পারল সে। মুখটা কোনরকমে চোরের মত ঢেকে ছুট লাগালো। রাগিনী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো সেই মেয়েটার দিকে। আশ্চর্যিত হয়ে বলল,
“মেয়েটা এমন করল কেন?”
“আমার মনে হয় মেয়েটা বুঝে গিয়েছে তুমি বিপদজনক একটা মেয়ে। মানুষের খাইতে শহীদ করে ফেলতে পারো। তাই রিস্ক নিতে চায়নি।”
বেশ উদ্বেলিত হয়ে রাগিনীর প্রশ্নের উত্তর দেয় কোহিনূর। চোখ রাঙিয়ে তাকায় রাগিনী। তবে সে কথার প্রতিত্তোর না করে রাগে গজগজ করে বলল,
“লিফট থেকে তো বেরিয়েই এসেছি। বাকিটা সিঁড়ি দিয়ে যাই। আর একটা ফ্লোর উপরে যেতে হবে।”
“এজ ইউর উইশ!”
রাগিনী রাগে কটমট করে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সিঁড়ির দিকে। কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির নিকট যায়। কোহিনূরের হৃদয়ে যেন প্রাণ আসে। একবার ফিরে করিডোরের কিনারায় তাকায়। বিরবির করে কিছু একটা বলে। অতঃপর দ্রুত হেঁটে নিজেও সিঁড়ির দিকে যায়।
কেবিনে প্রবেশ করা মাত্রই সেখানকার বেডে বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটি মাথা উঠিয়ে তাকায় উৎকন্ঠা হয়ে। যেন সেও রাগিনীর অপেক্ষাতেই ছিল। রাগিনী তাকে বসে থাকা অবস্থার দেখেই কিছুটা আগ্রহের সাথে বলে উঠল,
“এখন কেমন আছো? শরীর ভালো?”
“আমি তো এখন ভালাই আছি। এখানের ভালা ভালা খাবার, কত যত্ন নিতাছে। ঠান্ডা ঘর। আমি এমনিতেই ভালা হইয়া গেছি ম্যাডাম।”
বলেই সুন্দর করে হাসে ছেলেটি। তারপর রাগিনীর সঙ্গে থাকা কোহিনূরকে দেখেই ফট করে বলে ওঠে,
“কাল তো অন্য স্যাররে দেখছিলাম। এইডা আপনার সোয়ামি বুঝি?”
সঙ্গে সঙ্গেই কোহিনূর রাগিনীর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে কেশে উঠল। রাগিনীর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। কেমন যেন লজ্জা লাগলো। অস্বস্তি লাগলো। ‘সোয়ামি’ শব্দটাই তার গায়ের লোম শিউরে ওঠার কারণ হয়ে দাঁড়াল। কান গরম হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত রেখে কিছু একটা বলার জন্য উদ্যত হতেই কোহিনূর তার আগেই আগ বাড়িয়ে বলে ফেলল,
“নো লিটল বয়। আমিও তোমার মতোই এক অসহায় মানব। পার্থক্য একটাই। এই ম্যাডাম তোমার সেবা করে আর আমাকে সেবা করার নামে অত্যা’চার চালায়।”
“চুপ করুন তো আপনি। একবার মুখ খুললে যা-তা বলে বসেন।”
রাগ ঝেড়ে বলল রাগিনী। তারপর গিয়ে ছেলেটির পাশে বসল। ছেলেটিও দুজনের চাপা ঝগড়া দেখে নিজের হাসি প্রসারিত করেছে। রাগিনী ছেলেটির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার মা কোথায়? কাল উনার সাথে ভালো করে কথা বলা হয়নি।”
“এখনি এখানেই আছিল। বাইরে গেছে মনে হয়। আপনে একটু বসেন আম্মা আইসা পড়বে।”
কোহিনূর দরজার কাছেই বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে একভাবে। তার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। দূর থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে সামনে থাকা সেই মুগ্ধময়ীকে। সেই কোমলিনীকে দূর থেকে অনুভব করতে মনটা টানছে। দূর থেকে তার কোমলতা অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা কীভাবে যেন সকলের প্রিয় হয়ে ওঠে! তবে কোহিনূর কি মারাত্মক ভুল করে বসল? এখন এই ভুলের সমাধানের উপায় কী?
“পারো কী করে কারোর জন্য এতো কিছু করতে?”
আনমনেই প্রশ্নটা করে ফেলল কোহিনূর। রাগিনী ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল তখনি তার ব্যস্ততা ভেঙে দিল সেই প্রশ্নটি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ছোট্ট করে জবাব দিল,
“বিশ্বাস! বিশ্বাস থাকলে সবকিছুই করা যায়।”
“আমাকে বিশ্বাস করো?”
বেশ উৎসুক হয়ে রইল এবার কোহিনূর জবাব শুনতে। রাগিনী ফিচেল হেঁসে বলল,
“কী মনে হয়?”
কোহিনূর কোনো কথা বলা ছাড়া শুধু মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, সে মনে করে রাগিনী তাকে বিশ্বাস করে না। তা দেখে রাগিনী স্পষ্ট জবাব দিলো,
“মি. কোহিনূর! বিশ্বাস একটা স্বচ্ছ, সূক্ষ্ম কাঁচের মতো। যেটা অতি দৃঢ় হলেও একটু অবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগলেই তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর আপনি আমার কাছে একটা স্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ মানুষ। আপনাকে বিশ্বাস করি বলেই আপনার সঙ্গে থাকলে নিজেকে নিরাপদ লাগে আমার। আপনার সংলগ্নে এলে কোনো অস্বস্তি লাগে না। আপনার ছোঁয়ায় কখনো আমি খারাপ উদ্দেশ্য অনুভব করিনি। তবুও বলবেন আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না?”
বাকরুদ্ধ কোহিনূর। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনে থাকা রাগিনী নামক মেয়েটির দিকে। চোখের পলক ফেলতেও আর ইচ্ছে না কোহিনূরের। রাগিনী ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। কোহিনূরের সংলগ্নে এসেছে। শান্ত গলায় বলল,
“পৃথিবীতে দুটো পুরুষের কাছে নিজেকে সবথেকে নিরাপদ মনে করি আমি। প্রথমজন আমার বাবা। দ্বিতীয়জন কোহিনূর সাহেব।”
কথার মাঝে নিঃশ্বাস নিয়ে থামে সে। থেমে থেমে আবারও বলে,
“আমি চাই না এই বিশ্বাসে কখনো অবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগুক। দয়া করে কখনো এটা হতে দেবেন না।”
কোহিনূর কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। কেন যেন নিজেকে দিশেহারা লাগছে এবার। হারিয়ে যেতে মন চাইছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। তখন রাগিনী অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন?”
শুঁকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল কোহিনূর। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বাঁচতে চতুর্পাশ তাকালো। তারপর বেডে মাথা ব্যান্ডেজ লাগানো নিয়ে বসে থাকা ছেলেটির দিকে চোখ পড়তেই ফট করে বলল,
“বাচ্চা ছেলেটাকে এখনি পাকিয়ে দিও না। আমাদের দিকেই চেয়ে আছে।”
প্রসঙ্গ পাল্টাতেই ইতস্তত বোধ করে পিছু ফিরে তাকায় রাগিনী। কোহিনূর এমন কেন? তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে অন্য কোনো দিক থেকে তার খেয়াল হারায় কেন এভাবে? এটা একদমই ঠিক না। নিরবতার মাঝে এবার ভেসে এলো অন্য মহিলার গলা। মহিলাটি দরজার কাছ থেকে বলে উঠলেন,
“ম্যাডাম, আপনে আসছেন!”
উচ্ছ্বাস নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে দরজার দিকে চোখ পড়ল রাগিনীর। মহিলাটিকে দেখে সে এক গাল হেঁসে জবাব দিল,
“না এসে পারি? আপনার ছেলে তো মায়ায় বেঁধে রাখতে জানে।”
“কী যে বলেন! আমাগো গরীবের প্রতি আবার মায়া!”
“কেন আপনারা মানুষ নন বুঝি?”
“সবাই তো মনে করে না। করলে তো আমার পোলাডার উপরে একটু মায়া করতো।”
শেষ কথা গুলো হতাশা নিয়ে বললেন মহিলাটি। তবে রাগিনী শক্ত কন্ঠে বলল,
“সবার কথা বাদ দিন। আগে নিজে মনে করবেন আপনি মানুষ। শ্রেষ্ঠ জীব! যারা আপনাদের মানুষ মনে করে না তারা নিজেরাই কোনো মানুষের কাতারে পড়ে না।”
রাগিনীর কথায় মহিলাটি আশ্বস্ত হয়ে একটু হাসেন। নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার চিন্তিত হয়ে বলেন,
“কিন্তু ম্যাডাম, আমার পোলাডারে এতো ভালা হসপিটালে ভর্তি করছেন। এখানে তো অনেক বিল উঠবো। এতো টাকা…”
কথার মাঝখানে থামায় রাগিনী। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবেন না। আমি ম্যাডাম নই। আপনার ছোট বোনের মতো। তাই ছোট বোন হয়ে না হয় এতটুকু করলাম। আর ছেলেকে না খাটিয়ে ভালো স্কুলে লেখাপড়া শেখান। অনেক বড় হবে সে।”
“তাইলে আমাগো পেটের ভাত কেমনে ঘরে আসবে?”
“এতটুকুও আমাকে ভাবতে দিন।”
এবার মহিলাটি কঠোর হয়ে বলল,
“না ম্যাডাম। এগুলা অনেক খরচের ব্যাপার। আমি আপনের থেকে এতো খরচ কেমনে নিমু? পারমু না।”
রাগিনী আর কোহিনূর অবাক হলো কিছুটা। গরীব, নিম্নবিত্ত হলেও তারা কি সুন্দর নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখেছে। এখন কোহিনূর ভাবছে যে রাগিনী কী জবাব দেবে। সে বেশ আগ্রহের সঙ্গে কথাগুলো শুনছে। তৎক্ষনাৎ রাগিনী কিছুটা ভেবে বলল,
“মোটেও না। আপনাকে এমনি এমনি খরচ তো দেবোই না। আপনাকেও কিছু করতে হবে এর বদলে। শুনুন, আমার বাড়ির পেছনে একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে। গাছটার যত্ন নেওয়ার জন্য বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আপনার দায়িত্ব আপনি কাল থেকেই আমার বাড়িতে গিয়ে সেই গাছটার যত্ন নেওয়া।”
এবার ভ্যাবাচেকা খেলেন মহিলাটি। কোহিনূর মিটমিটিয়ে হাসছে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। কীভাবে কৌশলে কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মহিলাটি বিস্ময়ের সুরে বললেন,
“এতটুকু কাম?”
“এতটুকু মানে? এটা অনেক বড় কাজ। আমার সবথেকে প্রিয় গাছটা। কত নজরে রাখতে হবে বুঝতে পারছেন? আমার নম্বর লিখে নিন তো। কাল ঠিক সময়ে এসে পড়বেন।”
মহিলাটি না চাইতেও নম্বর দেওয়া নেওয়া করল। আরো কথাবার্তা হলো। একটু গল্প হলো। সবশেষে রাগিনী ও কোহিনূর বিদায় জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। হাঁটার মাঝে হঠাৎ কোহিনূর বলে ওঠে,
“তোমাকে যতটা ভেবেছিলাম ততটাও বোকা নও তুমি!”
হাঁটার মাঝে দাঁড়িয়ে যায় রাগিনী। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মানে?”
“মানে একটু আধটু চালাক আছো। কীভাবে উনাকে তাক লাগিয়ে দিলে।”
“এটা প্রশংসা করছেন নাকি ইনসাল্ট করছেন?”
“অবশ্যই প্রশংসা। তোমার মতো মেয়ের প্রশংসা না করে ইনসাল্ট করা যায়?”
রাগিনী এবার কোহিনূরের কথায় পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। দুজনই লিফটের কাছে এসে দাঁড়াল। কোহিনূর মুচকি হেঁসে রাগিনীর বাঁধা চুল টান দিয়ে আবারও চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাগিনী কটমট করে তাকিয়ে লিফট খোলার বাটনে চাপ দিল। কোহিনূর বিরবিরিয়ে বলল,
“চলো! উনি কাঠগোলাপের গাছ সামলাতে থাকুক আর আমি আমার জীবন্ত কাঠগোলাপকে সামলাই!”
বড়সড় সাদা রঙ করা বাড়ি। বাড়ির আশেপাশের পাঁচিলও সাদা রঙের। বাড়ির সদর দরজার পাশে সুন্দর করে নেম প্লেট লাগানো। বাড়ির নাম ‘আহমেদ মেনশন’। কেমন যেন উঁচু উঁচু লাগছে পাঁচিলগুলো নয়নতাঁরার কাছে। মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে পাঁচিল দিয়ে ওপাশ দেখার চেষ্টা করছে সে। উদ্দেশ্য পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকা। যেই ভাবা সেই কাজ। কোনোরকমে পাঁচিলে হাত রেখে পা দিয়ে নিজেকে ঠেলে উপরে ওঠার চেষ্টা করল সে। ধড়ফড় করে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। বড় একটা দম ফেলে পাঁচিলের গায়ে একটা লা’ত্থি মে’রে বলল,
“কী কপাল আমার! নিজের বাড়িতে চোরের মতো ঢুকতে হচ্ছে।”
নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এবার নয়নতাঁরার। আবার পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে ওঠার চেষ্টা করল সে। এবার সফল হলো। পাঁচিল টপকে পেছনের দিকে লাফ নামতেই একটা শব্দ হলো। এবার পায়ের শব্দ কানে এলো। চোখ বড় বড় করে সামনের দিকে চাইলো নয়নতাঁরা। দুটো লোক ফট করেই এগিয়ে এসে তার দিকে রি’ভলবার তাক করতেই হকচকিয়ে উঠল নয়নতাঁরা। হাত দিয়ে নিজেকে দ্রুত আড়াল করে বলল,
“আরে আরে কী হচ্ছে! আমি এ বাড়ির মেয়ে। কোনো চোর নই।”
রি’ভলবার তাক করে থাকা দুজন লোক দুজনের দিকে তাকাতাকি করল। তারপর কঠোর সুরে বলল,
“মেয়েই যদি হন তাহলে চোরের মতো আসলেন কেন বাড়িতে? কে আপনি সত্যি করে বলুন। নয়তো…”
নয়নতাঁরা চুপসানো মুখে হাত দুটো উঁচু করে। জোর দিয়ে বলে,
“আমি নয়ন। নয়নতাঁরা আহমেদ। নির্জন আহমেদের একমাত্র আদরের, ভোলাভালা, সাধাসিধা, সরল, প্যাঁচবিহীন ছোট বোন।”
এক নিঃশ্বাসে বলা নয়নতাঁরার কথাগুলো যেন বিশ্বাসযোগ্য লাগলো না দুজনের কাছে। তারা নয়নের নিকটে গিয়ে জোর করে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দিল। চেঁচামেচি করে উঠল নয়ন। কিন্তু তাদের কানে কথা গেলে তো!
অন্ধকার ঘরে দিনের আলো এসে ঘরটা খানিকটা আলোকিত করেছে। ছিমছাম একটা ঘর। অতিরিক্ত আসবাবপত্র নেই। বড় একটা বেড। বেডের দুপাশে সুন্দর ল্যাম্পশিট। জানালার পর্দা সরিয়ে রাখা। জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসেছে নির্জন। হাতে কফির কাপ। মাঝে মাঝে শব্দবিহীন হালকা করে চুমুক লাগাচ্ছে কফির কাপে আর মুখে বিরাজ করছে অদ্ভুত গাম্ভীর্য। দরজায় টোকা পড়ে তখন। নির্জন গম্ভীর সুরে জবাব দেয়,
“কাম ইন।”
দরজা খুলতেই চেঁচামেচি কানে আসে নির্জনের। মেয়েলি কন্ঠ চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না তার। কফির কাপটা রেখে চেয়ার নিয়ে ঘুরে বসে নির্জন। তাকে দেখে ছটফটাতে থাকা নয়নতাঁরা শান্ত হয়। দাঁত কেলিয়ে হাঁসে আর বলে,
“বিগ ব্রাদার!”
“কেন আমাকে এখানে এক্সপেক্ট করো নি?”
“না। মানে হ্যাঁ। তোমার বাড়ি। তুমিই তো থাকবে।”
পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে ঘাড় কাঁত করে নির্জন জবাব দিল,
“তুমি আমাকে বাহিরে দেখেছো সেকারণেই তো এখানে এসেছো।”
ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় পানে চায় নয়নতাঁরা। তার ভাইটা এতো বুদ্ধিমান কেন? তার মতো একটু বোকাসোকা হলে কি পারতো না? নির্জন ইশারা করে নয়নকে ছেড়ে দিতে বলে। হ্যান্ডকাপ খুলে দিতেই নয়ন ফোঁসফোঁস করে বলে,
“বলেছিলাম না? আমাকে না ধরতে। মিলল তো আমার কথা। যার বাড়ি তাকেই চোর বানিয়ে দিচ্ছে।”
“ওদের উপর চেঁচিয়ে লাভ নেই নয়ন! আমি ওদেরকে বলেছিলাম তোমার ছবি দিয়ে যাতে তোমাকে দেখামাত্র আমার কাছে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে।”
নয়ন এবার কান্না করার ভান ধরে। নির্জনের দিকে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
“তুমি এমনটা করতে পারলে?”
“না করার কী আছে? কম নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছো আমাকে? কোন সাহসে লন্ডন থেকে পালিয়ে এসেছো?”
নয়নের বুঝতে বাকি থাকে না তার ভাইয়ের মেজাজ এবার চড়ে যাচ্ছে। তাকে যে করে হোক ঠান্ডা করতে হবে। ফট করেই নির্জনের কোলে বসে নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে তাকায় সে। আর আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“বিকজ আই মিসড ইউ।”
“হুমম। কত মিস করো সেটা আমার জানা আছে। সেকারণেই তো আগে আমার সাথে দেখা করা বাদ দিয়ে ইন্সপেক্টর রায়ানের সঙ্গে দেখা করতে হসপিটালে ছুটছিলে।”
নয়নতাঁরা এবার শয়তানি হাসে। হাতের কনুই দিয়ে নির্জনের বুকে গুঁতো দিয়ে বলে,
“তুমি কী করছিলে শুনি? আজকে যা দেখলাম দেশে এসে। না আসলে তো মিস করে যেতাম।”
“শাট আপ! যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলবে না।”
নয়নতাঁরা মিটমিটিয়ে হাসে। নির্জনের এক গাল টেনে ধরে বলে,
“কোনটা বুঝি না? একটা মেয়ের কত সুন্দর করে ধরে ছিলে সেটার মানে বুঝি না? নাকি লাজুক চেহারা বুঝি না? ইউ নো হোয়াট বিগ ব্রাদার? এই প্রথম তোমাকে লজ্জা পেতে দেখছি। যাক ওই কিউট মেয়েটা আই মিন হবু ভাবির দৌলতে জীবনে নির্জন আহমেদের ব্লাশিং ফেসও দেখা গেল।”
নির্জন যেন থতমত খেলো নয়নতাঁরার কথায়। আসলেই কি তার লজ্জা লাগছে? ফেস ব্লাশ করছে? তবুও সে না দমে নয়নতাঁরাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আই এম নট জোকিং নয়ন! এটা কেস সংক্রান্ত ব্যাপার।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও বা কোথায় জোক করলাম? কেস সংক্রান্ত ব্যাপার আমিও বুঝলাম। কিন্তু যেমন তেমন কেস নয় এবার লাভ কেসে ফেঁ’সে গিয়েছো।”
“উফফ…আসলে কী বলো তো! তোমাকে বোঝানোর জন্য মুখ নাড়ানোর থেকে একটা গাছের সঙ্গে মুখ নাড়ানো অনেক ভালো। দেখি সরো। অনেক ভারি হয়ে গিয়েছো। পায়ের হাড় ভাঙবে এবার আমার।”
নয়নতাঁরা নাছোড়বান্দা। সে আরো নির্জনের কোলে ভালো করে বসে বলল,
“না উঠব না। তুমি যদি সত্যি না বলো আমি উঠছি না আজকে।”
“তুমি যা ভাবছো তা নয়। ব্যাপারটা অন্যরকম। গল্পটা অন্য। গোধূলি বেলার গল্প। রাগিনী জানেও না আমার পুরো নাম নির্জন আহমেদ কোহিনূর। তার ধারণাও নেই আমার পরিচয় সম্পর্কে। সে যেটা জানে সেটা আমি নই। আর যেটা জানে না সেটাই নির্জন আহমেদ কোহিনূর!”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]