#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩
নীল আকাশের মাঝে ঘন কালো মেঘ জানান দিচ্ছে বৃষ্টির আগমন। কখন যেন শান্তিময় বৃষ্টি নিজ ইচ্ছায় পতিত হয়ে এই সম্পূর্ণ ভুবনটাকে শীতলতায় মাখিয়ে দেবে। শুষ্ক গাছপালা, যারা পানির জন্য ব্যাকুল তাদের খুশি হয়ে নামবে। অবশেষে কালো মেঘগুলো একসাথে হয়। আকাশ থেকে গুঁড়গুঁড় আওয়াজ পাওয়া যায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির বিন্দুগুলো পিচ ঢালা রাস্তা আধভেজা করে দেয়। সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর মাঝে নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর প্রবণতা দেখা দেয়। সকলেই ছুটোছুটি করতে থাকে। এই প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমের মাঝে হুটহাট বৃষ্টি হওয়া এবং সেটা গায়ে লাগা মানে অসুখ করা। তাই সকলে এতটা ব্যতিব্যস্ত। এই ছুটোছুটির মাঝে ছিল নয়নতাঁরাও। দ্রুত পা চালিয়ে এক বন্ধ চা স্টলের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয় সে। তার ছোট চুলের মাথায় পড়া পানি একহাতে ঝাড়তে থাকে। গোলাপি স্কার্ফ দিয়ে মুখটা ভালোভাবে মুছে আশেপাশে তাকায়। যদি কোনো গাড়ি পাওয়া যায়? একবার রাস্তার এদিকে আরেকবার ওদিকে চায় মলিন চাহনিতে। বৃষ্টিতে যানবাহনের সংখ্যা আরো কমেছে। ফাঁকা গাড়ি না পেয়ে বিরক্তির সুর করে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে সে। অতঃপর আফসোসের সাথে বলে,
“আজকেও উনার সাথে দেখা হলো না। মাই ব্যাড লাক। আমি দেখতে আসার আগেই হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দিল উনাকে। এখন কোন বাহানায় উনার সাথে দেখা করব? ওহ গড, একটা মিরাকল ঘটিয়ে দাও।”
কথার ভান্ডার শেষ হওয়ার মাত্র নয়নের অনেকটা পাশ কাটিয়ে ফুল স্পিডে একটা বাইক চলে যায়। হকচকিয়ে উঠে নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই নিজের শরীরে ভেজা কিছু অনুভব করে নয়নতাঁরা। মাথা নিচু করে নিজের পোশাকের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে তার পুরো পোশাকে কাঁদা ভরে গিয়েছে। চোখটা কপালে উঠে যায় তার। কালো রঙের এই পছন্দের জামা তাকে তার ভাই নির্জন জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। গতকালও বৃষ্টি হওয়ায় পানি বা কাঁদা কোনোটাই ভালোভাবে শুকিয়ে যায় নি। কান্না এবং রাগ একসাথে অনুভূত করে ওঠে। পুরুষালী কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। একটা বাইকে তিনজন ছেলে। সামনে যে ছেলেটি বসে ছিল সে বেশ হেসে বলে ওঠে,
“সরি গার্ল। তোমার এখানে দাঁড়ানো উচিত ছিল না। সো স্যাড!”
ছেলেটির এই কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। নয়নতাঁরার রাগটা এবার দাবানল স্বরূপ হয়ে উঠল। ছাউনির নিচ থেকে বেরিয়ে পায়ের নিচে থাকা বড় পাথর হাতে তুলে কোনো কিছু না ভেবেই নিক্ষেপ করল বাইকের দিকে। চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“স্টুপিডের দল। বাইক যে রাস্তায় কীভাবে চালাতে হয় সেটাও জানে না।”
পাথরের আ’ঘাতে বাইকের পেছনের লাইট ভেঙে গেল। ছেলেগুলো এমনিও ভালো ছিল না। হতে পারে বড়লোকের বাপের বখে যাওয়া ছেলে! সঙ্গে সঙ্গেই বাইক থেকে নেমে তেড়েফুঁড়ে এলো তারা। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়েছে নয়নতাঁরা। কোঁকড়ানো এবং ফোলা চুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে। চুল দিয়ে টপটপ করে বেয়ে পড়ছে পানি। সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছে। তিনজন ছেলেই তার সামনে ঘিরে দাঁড়িয়ে বাইকের মালিক চেঁচিয়ে বলল,
“হাউ ডেয়ার ইউ, ইডিয়ট! আমার গাড়ি ভাঙার সাহস তুমি পাও কই থেকে?”
“যেখান থেকে আপনারা আমাকে হেনস্তা সাহস পান। লজ্জা করে না এসব কাজকর্ম করতে?”
“না করে না। ইভেন এখন সবার সামনে তোমায় ধরে…”
বলেই ঠোঁট কামড়ে বিশ্রী হাসে ছেলেগুলো। তারপর একে অপরের দিকে তাকায় তারা। অতঃপর সবাই মিলে নিজের দৃষ্টি দ্বারাই যেন তীক্ষ্ণ নজর দিতে থাকে নয়নতাঁরার দিকে। যেন তাদের চিলের ন্যায় দৃষ্টি এক খাবারের দিকে লক্ষ্য করছে। নয়নতাঁরার ভেতরটা ঢিপঢিপ করে। এমন দৃষ্টিতে সেঁটে যায়। পায়ের আঙ্গুল দ্বারা বৃথা চেষ্টা করে জুতো খিঁচে ধরার। চোয়াল শক্ত হলো। দৃষ্টি নিচে পরে তখন। আগপাছ না ভেবে রাস্তার পাশে জমে থাকা কাঁদা দুহাতে তুলে ইচ্ছেমতো ছুঁড়ে মা’রতে থাকে ছেলেগুলোর দিকে। ছেলেগুলোর চোখেমুখে কাঁদা লেগে যাওয়ায় রীতিমতো সব অস্পষ্ট হলো। রাস্তার আশেপাশে ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সরগম বাড়ল। সবাই আশ্চর্যের সাথে দৃশ্য দেখতে থাকল আর মজা লুটতে থাকল। এছাড়া পাব্লিকের কাজ কী?
নয়নতাঁরা কিছুটা ক্ষ্যান্ত হতেই রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ছেলেগুলো। একজন ক্ষিপ্র বেগে এসে দাঁত কটমট করে বলে,
“দিন বলেই এতো সাহস পাচ্ছিস রাত হলে বুঝিয়ে দিতাম! নাকি পাব্লিকের সামনে নিজেকে অসম্মানিত করতে চাস?”
অন্যজন তো ক্ষিপ্ত বেগে ধেয়েই আসে। মনে যেন অসৎ উদ্দেশ্য। কাঁদা মাখা চোখমুখটায় ফুটে উঠেছে অসম্ভব রাগ আর কুদৃষ্টি। নয়নতাঁরার ভিজে যাওয়া শরীরকে খুঁটিয়ে দেখার একটা সুযোগও ছাড়ে না তারা। নয়নতাঁরা বুঝতে পেরেছে ছেলেগুলো খুব একটা সুবিধার নয়। কিন্তু সে পিছপাও হবে না। ফট করে ছেলেটির হাত স্কার্ফে পড়তেই দূরে থাকা সমস্ত পাব্লিক এবার ক্ষেপে ওঠে। নয়নতাঁরার মুখে নীল বর্ণ ধারণ করে। তীব্র শব্দ কানে আসে গাড়ি এসে থামার। পাওয়া গেল এক কন্ঠের উগ্র সুর। অতি চেনা এবং আপন লাগল সেই কন্ঠ। নয়নের মনে হলো তার ভ্রম। যেই ভ্রম সে প্রতিদিন নিয়ম করে দেখে।
“কী হচ্ছে এখানে? কী করছেন আপনারা মেয়েটার সাথে?”
নয়নতাঁরা চোখ উঠিয়ে দেখে ছেলেগুলো যেন হাওয়ার বেগে কতটা দূরত্বে সরিয়ে দাঁড়িয়েছে! এই উগ্র সুরের এতো জোর? এতো ক্ষমতা? তার মানে নিশ্চয় ভ্রম নয়! এটা দৃঢ় সত্যি! নয়নের ইচ্ছে করছিল না পিছু ফিরে দেখতে। যদি আবার কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায় সেই কন্ঠের মালিক? কিছুটা নিজের উপর জোর খাটিয়ে পিছু ফিরতেই যখন পুলিশের ফর্মাল ইউনিফর্ম পরা সেই সুপুরুষ সত্য সত্যই দৃশ্যমান হয় নয়নের ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে মানুষটার আলিঙ্গনে দাঁড়াতে। এটা তো সত্যিই মিরাকল!
নয়নতাঁরা ভাবনায় অন্ত ঘটে ছেলেগুলোর উচ্চস্বরে। বাইকের মালিক তড়তড় করে বলে,
“স্যার, মেয়েটা আমার বাইকের ক্ষতি করেছে। পেছনের দিকটা ভেঙে দিয়েছে তাও বড় পাথর দিয়ে। আমাদের রাগাটা কি অস্বাভাবিক নয়? আমরা তবুও ওকে সাবধান করছিলাম। কিন্তু সে আমাদের গায়ে কাঁদা ছুঁড়তে থাকে। মাথায় মনে হয় সমস্যা আছে তার।”
রায়ানের মাথায় ছাতা ধরে আছে শেখর। আঁড়চোখে তাকিয়ে রায়ানের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টায় আছে সে। রায়ান এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। তবে কাজ পিছু ছাড়ে না। কাজের জন্য অফিসে যাচ্ছিল সে। রাস্তার মাঝেই এমন কান্ড দেখে বিষয়টা বুঝতে গাড়ি থামানো হয়। নয়নতাঁরার দিলে একপলক তাকালো সে। বোঝার চেষ্টা করল তার চোখের ভাষা। গোল গোল চোখে তখন একটা সূক্ষ্ম আশা দেখা গিয়েছিল। রায়ানকে পেয়ে এক সূক্ষ্ম আলোর মতো আশা! রায়ান সেই আশাকে বৃথা যেতে দিল না। নারীকে অসম্মান তার বড়ই অপছন্দ। নারী মায়ের জাত। সেখানে সে নিজ চোখে দেখেছে মেয়েটার স্কার্ফে রূঢ় ভাবে স্পর্শ করতে। তবুও রায়ান শান্ত থেকেই বলল,
“তোমাদের সাবধান করার ধরণ বুঝি কোনো মেয়ের স্কার্ফ ধরে টানাটানি করা?”
ছেলেগুলো থতমত খেল এবার। বুঝতে পারল নিজের বলা ক্ষীণ মিথ্যেগুলো ইন্সপেক্টর রায়ান ধরে ফেলেছে। রায়ান আরো একবার তাকালো নয়নের দিকে। মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে মেয়েটির। যা স্বাভাবিক। ছেলেগুলোর ক্ষিপ্র আচরণে সে নির্জীব হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। একটু পর পর কেঁপে উঠছে তার সমস্ত শরীর। রায়ান এবার এগিয়ে গেল নয়নের দিকে। শেখরের হাত থেকে ছাতাটা নিল। নয়নতাঁরার মাথার উপরে ধরতেই নিষ্পলক দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রায়ানের দিকে। মানুষটা আশেপাশে থাকলে নিজের মাঝে সজীবতা নতুন করে খুঁজে পেতে সহজ হয় নয়নের। আস্তে আস্তে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলে পরমূহুর্তেই। রায়ান জিজ্ঞেস করে,
“ওরা যা বলছে সেটা কি ঠিক? ফুল স্টোরি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি।”
নয়নতাঁরা এক আলাদা আশ্বস্ত খুঁজে পায় রায়ানের কন্ঠে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সাবলীল ভাবে বলতে শুরু করে,
“পুরোপুরি সঠিক নয়। ওরা আগে অন্যায় করেছে। ইচ্ছে করে আমার পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে গিয়েছে যাতে আমার গায়ে কাঁদা পড়ে। আমি রাগ সামলাতে পারিনি তাই…”
রায়ানের শান্ত নেত্রপল্লবের দৃষ্টি এবার পড়ে ছেলেগুলোর উপর। পোশাক-আশাকে স্পষ্ট ছেলেগুলো ভালো ঘরের। সমস্যা একাই! মানুষ করতে পারেন নি তাদের মা-বাবা। রায়ানের শান্ত দৃষ্টিতে মিশে থাকা চাপা ক্রোধের আগুন ছেলেগুলোর চোখে ঠিকই ধরা পড়ল। থমথমে সুরে রায়ান বলল,
“সাবধানে চলাফেরা করো তোমরা। ফের আমার নজরে এলে তোমাদের ক্ষমতাশালী কারোর কিছু মানব না। সোজা থানায়। ইটস্ মাই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং বয়েজ্! আর ইন্সপেক্টর রায়ান নিজের কথা মাটিতে পড়তে দেয় না।”
নয়নতাঁরার বিস্ময়ে পরিপূর্ণ আঁখি দুটো যেন সদ্য জন্মানো গোলাপের ভেতরের রেণু। যাকে আবৃত করে রেখেছে গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঘন চোখের পাপড়ি। ফোঁটা ফোঁটা পানির বিন্দু তার সেই আঁখিতে পড়লেও পলক ফেলার নামও নেয় না সে। তার নিকটে থাকা এক শান্ত পুরুষকে দেখার কোনো মূহুর্তে বাদ দেওয়া যাবেই না। এক শান্ত পুরুষ যার শান্ত রাগ দ্বারা শত শত্রু পরাজিত হতে পারে! নয়নের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় চোখের পলক অবশেষে পড়েই যায় রায়ানের কথায়।
“আপনাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি। কাইন্ডলি আমার সাথে আসুন।”
ভদ্রতার সহিত নয়নকে গাড়ির দিকে যেতে ইশারা করে রায়ান। নয়নতাঁরার কাছে তো এটা মেঘ না চাইতেই জল! নেচে নেচে গাড়িতে বসার ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠলেও সেই প্রবণতাকে চাপা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। পাশাপাশি ছাতা নয়নের উপরে ধরে হাঁটতে থাকল রায়ান। মেয়েটার গায়ের জামা লেগে গিয়ে শরীরের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট। লোকজনের নজর এড়াতে কিছু একটা ব্যবস্থা অন্তত করা দরকার!
গাড়িতে বসতেই পেছনের সিটে নয়নতাঁরা পাশে রাখা কালো কোটটা নয়নের হাতে ধরিয়ে দিল রায়ান। আর বলল,
“এটা রাখুন আপনার কাছে। আর পড়ে নিলে ভালো হয়।”
নয়নতাঁরা দেরি করল না। নিজের এমন বিশ্রী অবস্থা দেখে লাজুক ভঙ্গিতেই জড়িয়ে নিল কোট গায়ে। মনে মনে একটা কথার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল, ‘বিপদে পড়ে যদি এই মুগ্ধকর মানুষটার সঙ্গে বারংবার দেখা পাওয়া যায় তবে হাজারবার সে আনন্দের সহিত বিপদে পড়তে রাজি!”
ভুবনে নেমে আসা তীব্র বেগের বর্ষণ দুচোখ ভরে দেখছে কোহিনূর। ছোট্ট জানালার জমা হয়েছে সেই বষর্ণের ক্ষুদ্র জলবিন্দু। এই বষর্ণের তীব্র শীতল হাওয়া কোহিনূরের গা ছুঁইয়ে গেলেও মনটাকে ছুঁতে পারল না। প্রকৃতিতে তো কিছুক্ষণ আগে এই বষর্ণের সৃষ্টি হলো! তবে তার মনে যে টানা কয়েকদিন বর্ষণ চলছে? তার কী হবে? সেই বর্ষণে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে মনের প্রতিটা কোণ। মনের অভ্যন্তরে থাকা সমস্ত কথা উগলে দিতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। তবে এই ইচ্ছের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা সেই জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়টা বার বার জিতে যাচ্ছে। কোহিনূরের নিজের উপরেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ফেলে। আপনমনে আওড়ায় কিছু কথা!
“নির্জন আহমেদ কোহিনূর! যার জীবনের ডিকশনারিতে ভয় নামক শব্দ ছিল না। কোনো মৃ’ত্যুভয় অবধি ছুঁতে পারে নি তাকে। কিন্তু আজকে এমন দিন এলো যে একটা নারীকে তার সংলগ্নে রাখার জন্য, তাকে হারাবার ভয়ে শতশত মিথ্যে বলে যাচ্ছে। অনেক কথা লুকিয়ে যাচ্ছে। সেই নারীকে অদূরে হারিয়ে ফেলার ভয়টা রাতের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে। ভয় বুঝি এভাবে হৃদয়টাকে আঁকড়ে ধরে?”
নিজের বলা কথাগুলো বুঝে উঠে নিজেই হয়রান হয় কোহিনূর। মেঘলা সেই আকাশের গুড়গুড় শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো তার। তৎক্ষনাৎ আকাশের ভয়ানক গর্জন ভুবনকে কাঁপিয়ে তুলল। কোথাও বাজ পড়ল। কোহিনূরের মনের কোণে একটা ক্ষুদ্র প্রশ্ন জমা হলো! কোহিনূরের আসল পরিচয় যদি রাগিনী জেনে ফেলে তাহলে বুঝি এই আকাশের গর্জনের মতোই অবিশ্বাস নামক ছোট্ট শব্দটি তাদের নামহীন এই মিষ্টি সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে? না চাইতেও অবাধ্য দুটো চোখ গিয়ে আবারও পড়ল দরজায়। দরজার কাছে সেই চেনা চেহারা যদি ভেসে ওঠে? যদি সেই প্রগাঢ় মায়াবী চোখের দেখা পাওয়া যায়? সে তো চোখ নয় যেন আস্ত কাজলদিঘী! চিকন করে কাজল লাগায় রাগিনী মেয়েটা। তবুও যেন মনে হয় সেই আঁখিতে ভাসে স্বচ্ছ এক গোপনীয় সমুদ্র। যাকে কাজল দিয়ে ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে। দরজায় কারোর উপস্থিতি না পেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল কোহিনূর। নিজে নিজেকে সামলাতে বিরবির করে বলল,
“এতো বিচলিত কীসের তাড়নায়? এতো ব্যাকুলতা কেন? কোহিনূর তো আগে এমন ছিল না। সে এভাবে কারোর জন্য ব্যাকুল হয়নি। আজকাল কী হয় তার? এই উচাটন সামলে উঠতে পারছি না কেন আমি?”
করিডোরের কাছে এসে বিভিন্ন ছাতা মেলিয়ে রাখা দেখল রাগিনী। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ধরে রাখা ছাতাটাও রেখে দিল সে বৃষ্টির পানি ঝরতে। আজ আসতে তার দেরি হয়েছে বটেই। দেরি হবে না কেন? বাড়িতে যা কান্ড ঘটল! উর্মিলা জ্ঞান আসার পরপরই সেখানে আর থাকেনি সে। জেদ ধরে বসেছিল নোমান যেখানে আছে সেখানে আর এক মূহুর্ত থাকবে না। তাই রাগিনীও তড়িঘড়ি করে খাবার রেডি করে উর্মিলার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল। উর্মিলাকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের গন্তব্যে এসেছে। এরমাঝে অভিরূপের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ করার সময় আর হয়ে ওঠেনি। তবে ছেলেটাকে বেশ অদ্ভুত লেগেছে তার। যতক্ষণই চোখের সামনে থেকেছে গোল গোল করে চোখ পাকিয়ে থেকেছিল নয়ত নোমানের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছিল যেন উচ্ছ্বাসের সাথে। রাগিনীর কিছুটা হাসি পেলেও তা দমিয়ে রেখে নিজের কাজ করে গিয়েছিল।
এসব আগপাছ ভাবতে ভাবতেই আনমনেই কোহিনূরের ঘরের ভিড়িয়ে দেওয়া দরজাটা ঠেলে দিয়ে শান্তভাবে একপা রাখল সে। তৎক্ষনাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যেতে হলো তাকে। আরেকটু হলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতো রাগিনী। দরজার একদম কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল কোহিনূর। রাগিনীর এমন প্রতিক্রিয়ায় তার স্বভাবসুলভ হাসিটা আরো বাড়ল। বড় একটা শ্বাস নিল রাগিনী। তেত উঠে বলল,
“এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে? ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?”
“কী করব বলো? তোমার মতো একজন যুবতী, কুমারী মেয়ে এভাবে রুমে নক না করেই ঢুকে আসে। তোমরা মেয়েদের রুমে হুটহাট করে কোনো ছেলে নিশ্চিত মানহানির মামলা করে দেবে। আর আমাদের ছেলেদের রুমে তোমরা দেখি যখন ইচ্ছে তখন ঢুকে পড়ো। আমাদের ছেলেদের আইন নেই বলে এমন শান্ত নির্যা’তন করবে?”
রাগিনী এখনো অবধি কোহিনূরের ঘরে ঢুকতেও পারেনি। সবেমাত্র মানুষটার চেহারা দেখল। তাতেই শুরু! মাথায় এলো একটা সূক্ষ্ম প্রশ্ন। শান্ত নি’র্যাতন আবার কোন ধরণের নির্যা’তন? এটা আদেও কোনো বাংলা ডিকশিনারিতে আছে? অতঃপর সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“আমাকে জ্বালিয়ে কী পান আপনি?”
এবার দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায় কোহিনূর। রাগিনী হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে। আগের মতোই টিফিনবক্স টেবিলে রাখতেই কোহিনূরের কথায় পিছু ফিরে তাকায় সে।
“এইযে তোমার ঝাঁঝালো দৃষ্টি যা আমার অস্থির মনকে শান্ত প্রতিষেধক। তোমার রাগভরা কন্ঠ আমার কাছে এক মাধুরী মেশানো রূপকথার কোনো সুর। যেই সুরে মনটা তাল মিলিয়ে যায়। আমাকে এতো কিছুর থেকে এতক্ষণ মিস করানোর জন্যই তোমাকে রাগিয়ে দেওয়া।”
কথার মাঝে দম নেয় কোহিনূর। নিকটে আসে রাগিনীর। রাগিনী খুব করে চায় সামনে থাকা এই মুখোশধারী ব্যক্তিকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে জোরপূর্বক জিজ্ঞেস করতে, কে সে? জানে, এর কোনোরকম উত্তর পাবে না তাই চুপ করেই থাকল সে। ভেতরে থাকা অবিশ্বাসের এক তীব্র আগুন এই কোহিনূর রত্নের সংলগ্নে আপনা-আপনি বুঝি নিভে যায়? কেন মনটা এমন ইঙ্গিত দেয় যে এই মানুষটিই তার নিরাপত্তা? অথচ তাকে সন্দেহ করার হাজার হাজার কারণ খুঁজে বের করেছে রাগিনী। আবারও কোহিনূরের জবান খুললে চকিতে তাকায় সে।
“তাছাড়া রাগিনী নামটাকে তো সার্থক করতে হবে!”
রাগিনী এবার পাশ কাটিয়ে সরে যায়। গ্লাসে পানি ঢেলে বিছানায় ধপ করে বসে বলে,
“আপনার মুণ্ড! দ্রুত খেয়ে নিন। আমরা এক জায়গায় যাব।”
“আবার একটা জায়গা? কোথায়?”
“সারপ্রাইজ!”
একটা উদ্ভট হাসির সাথে বলল রাগিনী। কোহিনূরের কিছুটা অদ্ভুত লাগল তবুও কিছু বলল না। এসে বসল খেতে। বেশ খিদে পেয়েছিল। কাল কাজের যা চাপ ছিল! খাওয়ার সুযোগটাই হয়নি ঠিকমতো।
ঢাকা শহর একপ্রকার বিখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে। যেখানে সেখানে যানবাহনের ভীড়। ঘন্টার পর ঘন্টা যে হারে জ্যাম লেগে থাকে সেটুকু সময়ে একটা দম্পতির বিয়ে থেকে শুরু করে সংসার পাতা অবধি হয়ে যাবে। ঠিক সেরকম জ্যামে আটকা পড়েছে রাগিনীর গাড়ি। হুটহাট করে একটু একটু এগোচ্ছে আবারও থেমে যাচ্ছে গাড়ির চোটে। রাগিনী বিষয়টাতে বিরক্ত! চট্টগ্রামেও এমন হয় তবে এতোটা সমস্যা হয় না। সিটে ঠেস দিয়ে বসে রাগিনী। কন্ঠে বিরক্তি টেনে বলে,
“উফফ… জ্যাম কখন ছাড়বে কে জানে! একে তো দূরের রাস্তা তার উপর এই অবস্থা। পৌঁছাতে পৌঁছাতেই তো সন্ধ্যা।”
“বৃষ্টি থামছে তো তাই সবাই তাড়াই আছে। মনে হয় তাড়াতাড়ি ছাড়বে।”
ড্রাইভারের কথায় তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে রাগিনী। সঙ্গে সঙ্গে নীরব কোহিনূর বলে,
“হ্যালো, মিস! আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?”
“উঁহু, সারপ্রাইজ।”
কোহিনূর সরু চোখে তাকায়। আলতো ধাক্কা দিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে,
“এবার আমার সন্দেহ হচ্ছে।”
“কীসের?”
“উহুম! আমাকে একা পেয়ে আবার এডভান্টেজ নিতে চাইছো না তো?”
সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসে রাগিনী। কোহিনূরকে আঁড়চোখে দেখে নেয় সে। কড়া সুরে এবার ঠোঁট সরু করে বলে,
“আপনার মতো দানব টাইপ লোকদের থেকে এডভান্টেজ?”
“করলে তো ইনসাল্ট?”
“করলাম! ইনসাল্ট হওয়ার জন্য নিজেই এগিয়ে এসেছেন।”
কোহিনূর এবার রাগার বদলে মুখ টিপে হাসে। তার হাসির রহস্য উদ্ধার করতে পারে না রাগিনী। কোহিনূর হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে হাসিটা আরো প্রগাঢ় করে বলে,
“শুনেছিলাম সুন্দরীদের কাছ থেকে ইনসাল্ট হওয়ার টেস্ট দারুণ। টক, ঝাল, মিষ্টি! আজকে ফিল করলাম। আসলেই সুন্দরীদের কাছে ইনসাল্ট হতে খারাপ লাগে না। আর যদি সেটা হয় রাগিনী তাজরীন তাহলে তার শত ইনসাল্ট, তার শত আ’ঘাত, তার শত শা’স্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।”
রাগিনীর আঁখি স্থির হলো কোহিনূরের আঁখিতে। গভীরভাবে মনোনিবেশ করল সেই আঁখিতে। লোকটার কন্ঠে কিছু আছে যা প্রতিটা সাধারণ অক্ষরও আকর্ষণীয় করে তোলে। তার চোখে কিছু অব্যক্ত ভাষা রয়েছে যা যেন রাগিনীকে খোঁজার নির্দেশ দেয়। এ যেন কোনো মানুষ নয় আস্ত এক গুপ্ত রহস্যের ভান্ডার। যা উদ্ঘাটন করতে পারলে আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার হবে! যেটা রাগিনীর কাছে অভাবনীয়।
আজকে রিলিজ দেওয়া হবে হামিমকে। হামিম হচ্ছে সেই ছোট ছেলে যাকে রাগিনী রেসকিউ করেছিল। তাকে বিদায় দিতেই এসেছে ফাহমিদ নিজে। অবশ্য রাগিনী তাকে বলেছিল আসতে। কারণ রাগিনী নাকি আজ ব্যস্ত থাকবে। অন্যদিকে ছেলেটার কাছে রিলিজের দিন না এলেই নয়। তাই ফাহমিদ এলো হসপিটালে। ফাহমিদকে একা দেখে হামিমের মা প্রশ্ন করে উঠলেন,
“ম্যাডাম আজ আসেন নাই?”
ফাহমিদ মৃদু হেঁসে নিচু সুরে জবাব দিল,
“না। আসলে ও নাকি একটু ব্যস্ত আজ। তাই আমি এলাম। কেন? আমি থাকলে হবে না বুঝি?”
“না, না। সেটা বলি নাই। আপনেও তো আমার পোলাডার জন্য কম করেন নাই। শুনলাম আপনে র’ক্ত দিছেন ওরে। এইডাই বা কয়জন করে? আপনে সত্যিই ভালা মানুষ।”
“এসব বলে লজ্জা দিচ্ছেন কিন্তু। আর ছেলেকে এভাবে রাস্তায় ইন’কাম করতে পাঠাবেন না। ভালো করে পড়াশোনা করান। ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে।”
হামিমের মায়ের মুখ মলিন হলো। হাসোজ্জল মুখটায় নেমে এলো একটা আঁধার। কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তাছাড়া কী আর করমু? পোলাডার বাপের ক্যান্সার আছিল। এই ম’রণব্যাধি উনারে বাঁচতে দেয় নাই। সে থাকলে কি আর এতো কাম করতে দিতো? কলিজার মধ্যে রাইখা দিতো হামিম রে। ছোডুবেলায় অনেক ভালা পাইতো হামিমরে। বাপ নাই তো কিছুই নাই। সর্বহারা।”
ফাহমিদের মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গেল পরক্ষণেই। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজের রাগে ভরা দৃষ্টি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতেও বেরিয়ে এলো এক ক্রোধে ভরা চোখ। চোখ নামিয়ে নিলো সে। ঢক গিলে হিসহিসিয়ে বলল,
“সব বাবা ভালো হয় না। কিছু বাবা থাকার থেকে না থাকাই ভালো। কিছু বাবা সন্তানকে কলিজায় ঢুকিয়ে আগলে রাখে না। কিছু বাবা সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করে নিজহাতে। সব বাবা বটগাছের মতো সন্তানকে আগলায় না। বরং ঠেলে দেয় বিপদের দিকে।”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪
রায়ানের গাড়িটা এসে থামল ঠিক ‘আহমেদ মেনশন’ নামক সাধারণভাবে সুসজ্জিত বাড়ির সামনে। গাড়িটা স্থির হওয়ায় সামনের সিটে সোজা হয়ে বসে থাকা রায়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। বাম জানালার কাঁচে গুটিশুটি মে’রে বসে আছে নয়নতাঁরা। চোখ দুটো বন্ধ। ভেজা ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে গিয়েছে। তবে কাঁপুনি কমেনি বিন্দুমাত্র। মাথার চুলে এখনো পানিতে নেতিয়ে আছে। যত পানি বসবে আরো ঠান্ডা লাগবে। তাই রায়ান ডাক দিয়ে ওঠে।
“মিস. নয়নতাঁরা!”
নয়ন নড়েচড়ে ওঠে। তবে চোখ মেলে তাকায় না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে জানালার পাশ ঘেঁষে মাথা রেখে দুহাতে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মত কাঁচুমাচু মে’রে বসে থাকে। রায়ান তাকে কীভাবে ডাকবে ভেবে উঠতে পারছে না। সে নিজে উসখুস করে আবারও ডাকল,
“হ্যালো! মিস নয়নতাঁরা। আমরা আপনার বাড়ির সামনে এসে গিয়েছি।”
এবার কথাটা নয়নের কান অবধি পৌঁছালো। রায়ান নয়নের বাড়ি চিনলো কীভাবে? নয়ন তো রায়ানকে বলেনি। প্রশ্নটা মস্তিষ্কে খেলে যেতেই নয়নতাঁরা এক ঝটকায় উঠে বসল। হুড়মুড়িয়ে জানলার বাহিরের দিকে নিজের বাড়িটার দিকে তাকাল। আরে হ্যাঁ, এটা তো তারই বাড়ি। এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে রায়ানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রায়ান বুঝে গেল নয়নের এই চাহনিতে লুকিয়ে থাকা প্রশ্ন। তাই সে সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
“আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। আপনি ভাবছেন আমি আপনার বাড়ি চিনলাম কীভাবে। উত্তরটা খুব সহজ মিস. নয়নতাঁরা। সেদিন এয়ারপোর্টে যখন আপনাকে দেখেছিলাম এবং আপনি আপনার নাম বলেছিলেন তখন আপনাকে আমার চেনা চেনা লেগেছিল। আপনার নামের সঙ্গে আহমেদ টাইটেলটা আমার সন্দেহ প্রগাঢ় করেছিল। পরে জানতে পারি আপনি অফিসার নির্জন আহমেদের একমাত্র বোন। অফিসার নির্জনের সাথে আপনাকে আমি একটা ইভেন্টেও দেখেছিলাম অনেক আগে। আমার স্মরণ শক্তি এতটাও দুর্বল নয়।”
নয়নতাঁরার চোখ এবার কপালে। রায়ান নামক ব্যক্তিটিকে সে যতই ভোলাভালা ভাবুক, আসলে লোকটা সাংঘাতিক সেই সাথে বুদ্ধিমান। এখন কি তার ভাইয়ের মতো এই লোকটাও সব সময় খবরদারি করবে? সব খবরদারি করা লোকজন কেন তার কপালেই জোটে। অবশ্য রায়ানকে তো সে ইচ্ছে করে জুটিয়েছে। কী আর করার সত্যিকার অর্থেই যে মানুষটা এতটাই মনোমুগ্ধকর। নয়ন নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দেয়,
“এই নিয়ে তিনবার আমায় বিপদ থেকে বাঁচালেন আপনি। আপনি মানুষটা এত বিপদের সাথে জড়িত থাকেন কেন? এত বিপদ নিয়ে থাকলে আপনার কাছে কেউ আসবে? আমি নেহাত ভালো মেয়ে তাই আসি।”
রায়ান এবার হতবাক হয়। তার জানামতে সে দুইবার মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে। আরো একবার কখন তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে? নয়নতাঁরা রায়ানের কোট খুলতে শুরু করে। তা দেখে রায়ান তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
“খুলতে হবে না আপনাকে। আপনার কাছে রাখুন।”
কোনোরকম বিলম্ব না করেই কোট পুনরায় নিজের গায়ে জড়িয়ে নেয় নয়ন। যেন সেই কোট পেয়ে সে খুশিতেই আটখানা। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে নয়ন রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আরেকটু সময় দাঁড়াবেন প্লিজ? আমি এক্ষুনি আসছি।”
বলেই মেয়েটা তার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। রায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। হাঁটার মাঝে বিরতি নিয়ে নয়ন ফের পিছু তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে বলে,
“ওয়েট করবেন কিন্তু।”
রায়ান হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল তার কোট পরিহিত মেয়েটির দিকে। তার ভেজা চুলগুলো হাঁটার তালে তালে দুলছে। মেয়েটার মনটা এখনো বাচ্চাদের মতোই। বাচ্চা ভাবটা এখনো কাটেনি। না কাটানোই স্বাভাবিক। নির্জনের একমাত্র বোন সে। নির্জনের এই একটাই দুর্বলতা! নয়নতাঁরা। তাকে যেভাবে আগলে রাখার কথা তাতে বাচ্চা ভাবটা কাটবেই না। এসব মনে মাঝে একটু একটু ভাবতে ভাবতে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় রায়ানের। কতদিন মায়ের সাথে কথা হয় না! মানুষটা কেমন আছে জানা হয় না। চিকিৎসা কতদূর জিজ্ঞেস করা হয় না। ফ্রি হয়ে দ্রুত কথা বলতে হবে।
ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাল সেই চিকন মেয়েলি সুর। চোখ দুটো নিমজ্জিত হওয়া আবারও পিটপিট করে তাকালো ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নয়নের পানে। ফুল দেখে উসখুস করে উঠল রায়ান। গলা খাঁকারি দিয়ে গাম্ভীর্য রূপটা ধারণ করার চেষ্টা করল। নয়নতাঁরা ফুলটা রায়ানের মুখের সামনে ধরে বলল,
“আমাদের গাছের ফুল। এটা নিন।”
“কেন?”
“ফুল কেন দেয় একটা মানুষ আরেকজন মানুষকে? উপহার হিসেবে? পুরষ্কার হিসেবে? আবার ভালোবাসা প্রকাশ্যে। এরমধ্যে যেকোনো একটা ধরে নিলেই পারেন।”
নয়নতাঁরা এমন উত্তরে এবং কন্ঠস্বরে রায়ান বুঝল মেয়েটা তার করা বোকা প্রশ্নে চটে গেছে। ফুলটা নেওয়া উচিত হবে কিনা সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তবে মেয়েটার চোখে স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা দেখে ঢক গিলে দুটো আঙ্গুলে ফুল ধরল রায়ান। নয়নতাঁরার হাসির ঝলকে যেন মুখরিত হয়ে উঠল আশপাশ। মেয়েটা এতো ছোট ব্যাপারে খুশি হয়ে গেল কেন? মেয়েটা আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে পিছু ফিরে হাঁটা দিল। কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“ফুলটা কিন্তু আমি আমার বলা লাস্ট রিজনের জন্যই দিয়েছি মিস্টার!”
সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল রায়ানের। মেয়েটা এক চোখের পলকে কোথাও যেন উধাও হলো। লাস্ট রিজন মানে? ভালোবাসা প্রকাশ্যে? এতটুকু ভাবতেই গলা শুঁকিয়ে এলো রায়ানের। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কান গরম হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। নয়নের দেওয়া ফুলটি গোলাপ। বারোমাসি গোলাপ যাকে বলে। তবে বেশ স্নিগ্ধ ভাবে ফুটে রয়েছে। শেখরের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে তার।
“স্যার, অফিসার নির্জনের বোন কী বলে গেল ওসব?”
রায়ান থতমত খেয়ে গম্ভীর ভাবে জবাব দেয়,
“কিছু না। তুমি গাড়ি স্টার্ট দাও।”
রাস্তার আশেপাশে কিছু গ্রামীণ দৃশ্য দেখে বেশ ভাবনায় পড়ে গেল কোহিনূর। রাগিনীর বিশেষ চমকটা কী সেটা বুঝে উঠতে পারল না। এবার ধৈর্যহারা লাগছে নিজেকে। শেষমেষ রাগিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আপনার সারপ্রাইজটা কি আজকের মধ্যে দেখতে পাব তো ম্যাডাম?”
রাস্তার দুপাশে ধানের ক্ষেত বিমোহিত হয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল রাগিনী। বেশিক্ষণ টিকলো না তার মুগ্ধতা। কোহিনূরের কথায় সোজা হয়ে বসে আঁড়চোখে তাকিয়ে উত্তর দিল,
“অবশ্যই আর বেশিক্ষণ নয়। সামনেই আপনার সারপ্রাইজ ওয়েট করছে।”
রাগিনীর কথাবার্তা আজ ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না কোহিনূরের। মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে কথা বলছে। তার প্রতিটা কথায় যেন সাসপেন্সে ভরা। কীসের দৌলতে ঠিক এত সাসপেন্স সেটা বুঝে উঠতে পারছে না কোহিনূর। গাড়ি থামতেই ভাবলেশহীন হয়ে সামনে তাকায় কোহিনূর। জায়গাটা ঠিক তার চেনা নেই। তবে রাগিনী গাড়ি থেকে নেমে কাউকে কল লাগালো প্রথমেই। কোহিনূরও তার দেখাদেখি নেমে দাঁড়াল বাহিরে। গ্রামের পরিবেশ মানেই এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। শীতল বাতাস মন অবধি ছুঁইয়ে দেয়। খোলা মাঠে ধানগুলো দেখে মনে হয় কোনো সবুজ রঙের দীঘি। রাস্তার দুইপ্রান্ত সারিতে লাগানো বড় ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর পাতা দুলছে। পাখিরা যেন সুর তুলে আওয়াজ করতে পারে এখানে। কোহিনূর প্রাণভরে একটা নিশ্বাস নিল। অতঃপর গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“সারপ্রাইজটা কিন্তু দারুণ। সো ন্যাচরাল। আই এম ইম্প্রেসড, রাগের রানী!”
গাড়ির ওপ্রান্ত দাঁড়িয়ে থাকা রাগিনী কানে ফোন ধরে একটা উদ্ভট হাসি দিল। যেন মনে হচ্ছে মেয়েটার এই হাসিতেও লুকিয়ে রয়েছে গভীর রহস্য। সেই রহস্য উদ্ঘাটন করার বহু চেষ্টা করেও সফল হলো না কোহিনূর। রাগিনী হাসিমুখেই বলল,
“এটা তো শুরু। আসল সারপ্রাইজ এখনো বাকি।”
কথাটা শেষ করেই ফোনে মনোযোগ দিল পুরোটাই। ফোনের ওপাশে কে কী বলল তা কোহিনূরের কান অবধি পৌঁছাল না। তবে তার উত্তরে রাগিনী যা বলল কান খাঁড়া করে শুনল সে।
“আপনি ঠিক কোথায়? হ্যাঁ, গাড়িটা আমারই। আপনি কোথায় বলুন? আশেপাশে…”
কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে চেয়েও করতে পারল না রাগিনী। সম্পূর্ণ এক বাক্য হতে আটকালো তার হাঁচি। জোরে একটা হাঁচি দিতেই গোছানো চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়ল তার। আগের মতো একহাত দিয়ে চুল পেছনে দিতে ব্যর্থ হলো সে। বাতাস তাকে সফল হতে দিল না। হুরহুর করে বাতাস চোখেমুখে আরো চুল ছিটিয়ে দিতেই চুলের উপরই যেন রাগল সে। কিছুহাত দূরে দাঁড়িয়ে কোহিনূর তার এমন তুচ্ছ রাগের কারণে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকল। তবে সে খেয়াল করছে রাগিনীও আসার পর থেকে বেশ কিছুবার হাঁচি দিয়েছে। মাঝে মাঝে নাক ঘষছে। চোখটাও কিছুটা ফুলে গিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে তারও কি ঠান্ডা লেগেছে কোহিনূরের মতো? অবশ্য খারাপ কী? কথায় বলে না? হাম জিতে হায় তো একসাথ, মারতে হায় তো একসাথই। তাহলে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে একসাথে ঠান্ডা লাগার লজিকটাও ভুল কিছু নয়। এসব উল্টোপাল্টা ভেবেই মাথা ঝাঁকাল কোহিনূর। তার চোখের উপর অন্য কেউ হাত ঝাঁকাতেই দৃষ্টি স্থির হয় তার। রাগিনী বলে,
“কোথায় হারিয়ে যান?”
কোহিনূর মৃদু হেঁসে সহজ উত্তরে বলে,
“আমার প্রেমিকার সঙ্গে এক ভালোবাসার সাগরে।”
সামান্য বাক্যটা শুনে শিরদাঁড়া ঠান্ডা হলো রাগিনী। এই প্রেমিকা নামক শব্দটি শুনলে মনের মাঝে মিশ্র অনুভূতি কাজ করে শুধু। পৃথিবীর অন্যসব ভাবনা বাদ দিয়ে কোহিনূরের বলা এই প্রেমিকা শব্দটির গবেষণা করতে মন চায়। কী এমন অমৃত লুকায়িত আছে এর মাঝে? নাকি এটা শুধু কোহিনূরের কন্ঠে শোনা বলে এতোটা শ্রুতিমধুর? কিছু নীরব থেকে রাগিনী নিচু সুরে বলে,
“এইযে সামনে ধানের মাঝে এই সরু রাস্তা দেখতে পাচ্ছেন এখান দিয়ে আমাদের কিছুদূর হাঁটতে হবে।”
“কেন? আবার কোথায় যাব?”
“ভয় পাচ্ছেন বুঝি?”
“ভয় শব্দটা আমার ডিকশনারিতে নেই। যদি থেকে থাকে সেই ভয়টার নাম তুমিময় একটা ভয়। সেখানে নিজের ক্ষতি, আ’ঘাত পাবার ভয় নেই কোথাও! শুধু রয়েছে রাগিনী নামক মেয়েটিকে মাঝরাস্তায় হারিয়ে ফেলার ভয়।”
নিজেই তাজ্জব বনে গেল রাগিনী। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। মানুষটা যে মাঝে মাঝে কী বলে সেটা বুঝতে সময় লেগে যায় বেশ। যদিও বুঝে ফেলে তখন উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শব্দ মস্তিষ্কে আসে না। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ে। হৃদয় নিজ তাগিদে সরগম সৃষ্টি করে। কী বিশাল যন্ত্রণা!
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাস্তার নিচে সেই ধানের মাঝে সরু রাস্তায় নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে রাগিনী। বরাবরের মতোই রাগিনী পায়ে মাঝারি সাইজের উঁচু হিল পড়ে। আর বৃষ্টি হওয়ায় পুরো জায়গায়টা যে পিচ্ছিল ছিল সেটা ধারণাতে আসেনি তার। ফলস্বরূপ পা পিছলে যায়। রাগিনী ব্যালেন্স হারায়। এই বুঝি সব শেষ। অঘটন ঘটার অন্তিম পর্যায়ে রাগিনীর কোমড়ে এক প্রশস্ত এবং শক্ত হাতের স্পর্শ অন্যহাত রাগিনী হাতে আবদ্ধ হয়। মৃদু চিৎকার দিয়ে চোখমুখ খিঁচে নেয় পড়ে যাবার ভয়ে। ফিসফিসিয়ে বলা কথা এবার কানে বেজে ওঠে রাগিনীর।
“এই কোমলিনীর হাতটা যতক্ষণ আমার হাতে আবদ্ধ ততক্ষণ সে এই কোমলিনীকে পড়তে দেবে না।”
আস্তে করে তাকাল রাগিনী। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাখা ব্যক্তিটিকে দেখেই কেমন যেন হৃদয়ের তরঙ্গ নিজ ছন্দে মেতে ওঠে। মানুষটার স্পর্শ সে পেতে না চাইলেও পেলে এতোটা উতলা হয় কেন সে?
কাজের ফাঁকে একটু বিরতি নিয়েছেন রাশেদ সাহেব। শরীরটা যেন দিন যাচ্ছে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আর আগের মতো একাধারে বসে পেশেন্টের সাথে কথা বলতে পারেন না। ক্লান্ত বোধ করেন। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চশমাটা খুলে চোখ বুঁজে নীরবে বসে রয়েছেন। বুকটা হালকা হালকা ব্যথা করছে। গতকাল ঔষধ নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। হতে পারে এটা তারই ফল। চিনচিন করছে বুকের ভেতরে। এই সময়ে ফোন বেজে ওঠায় খানিকটা বিরক্ত হন তিনি। ফোন ধরবেন না বলে ঠিক করলেও অনিচ্ছায় চোখ মেলে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখেন বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন আসছে। এখান থেকে একমাত্র সৈয়দই ফোন করে। তাই দেরি না করে রিসিভ করলেন তিনি। আর গম্ভীর গলায় বললেন,
“হ্যালো, সৈয়দ! অসময়ে ফোন দিলে যে। কোনো সমস্যা?”
ওপাশ থেকে নরম সুর ভেসে এলো সৈয়দের।
“তেমন কোনো সমস্যা না স্যার। দুঃখিত এই সময় ফোন করার জন্য। কিন্তু কিছু জানার ছিল তাই বাধ্য হয়ে কল দিলাম। বলতেছিলাম, বাড়ির মেহমানদের জন্য কী কী খাবার হবে সেটা যদি বলে দিতেন। এনারা তো আবার সব কিছু খায় না। সকালে অভিরূপ বাবাকে তুলসি দিয়া চা করে দিছিলাম। খাইছে। দুপুরের জন্য কী করব?”
“রাগিনীর থেকে জেনে নিতে। রাগিনী তোমায় বলেনি?”
“রাগিনী মা তো বাড়িতে নাই, স্যার। সেজন্যই তো আপনারে কল দিলাম।”
এবার টনক নড়ে রাশেদ সাহেবের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। সন্দিহান হয়ে জানতে চান,
“মানে? বাড়িতে অভিরূপ আর নোমান আছে। ওদের রেখে রাগিনী কই গিয়েছে? বাড়িতে কেউ না থাকলে তো সমস্যা।”
“টিফিনবক্সে খাবার নিয়া বাকি দিনগুলার মতো ওই পাগলটার কাছে গেছে আজকেও।”
মিনমিন করে জবাব দিলো সৈয়দ। রাশেদ সাহেবের বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। কেমন যেন হতাশ বোধ করছেন। শান্তভাবে বললেন,
“মাটন বিরিয়ানি কর, সাথে কষানো মাংস, ডাল আর আমরা বাঙালিদের যে যে খাবার দ্বারা আপ্যায়ন করি সেসবই করো। তবে মনে রাখবে ঝাল কম দেবে। অভিরূপ ঝাল খেতে পারে না। আর কিছু মিষ্টি জিনিস বানিয়ে রাখো। আমি রাখছি।”
বিলম্ব না করে কল কাটেন রাশেদ সাহেব। আরো একবার বড় শ্বাস ফেলে নিজের টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকান। মেয়েটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। আগে তো এমন ছিল না। রাশেদ সাহেব তো একবার বলেই দিয়েছিলেন কোহিনূরের কাছে কম যাওয়া-আসা করতে। তবুও কি মেয়েটা কথাটাকে সেভাবে নেয়নি? উনার মেয়ে তো উনার কথা কখনো ফেলেন না। আজ শুধুমাত্র একটা পাগল ছেলের জন্য মেয়েটা এমন আচরণ করা শুরু করেছে? রাগিনীর ভরসাতেই তো অফিসে এসেছিলেন রাশেদ সাহেব। তিনি ভেবেছিলেন রাগিনী ওদিকে সব সামলে নিবেন। কিন্তু তার মেয়েটার এভাবে বোধবুদ্ধি লোপ পাবে ভাবতে পারছেন না। তবে কি ওই ছেলের প্রতি রাগিনীর কোনো অনুভূতি…?
আর ভাবতে পারলেন না রাশেদ সাহেব। এর বেশি ভাবতে চান না। বুকের ব্যথা কিছুটা তীব্র হলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন বার বার।
অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে সামনেই একটা লম্বা সিঁড়ি আবিষ্কার করল কোহিনূর। সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে কাঠ দিয়ে বানানো একটা খোলা ঘরের মতো। নিজের হাতটা দিয়ে শক্ত করে রাগিনীর হাতটা ধরে রেখেছে সে। রাগিনী এবার সাবধানে হেঁটে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“এবার তো ছাড়ুন। আমি ঠিকঠাক হাঁটতে পারব।”
রাগিনীর কথা কানেই নিল না কোহিনূর। বরং হাতটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোনো রিস্ক নিতে পারব না। দেখা যাচ্ছে পড়ে টড়ে যাবে তারপর পা বা কোমড় ভাঙবে। আর এতোখানি রাস্তা আমাকে তোমায় মতো একটা সত্তর কেজি ওজনকে নিয়ে পাড়ি দিতে হবে হেঁটে। না না বাবা। আমি ওসবে নেই। সেফটি ফার্স্ট।”
“মোটেও আমি সত্তর কেজি ওজনের না। আপনার মতো মনে করেন নাকি আমাকে? মাত্র পয়তাল্লিশ কেজি ওজন আমার।”
রাগে ফুঁসে উঠে জবাব দেয় রাগিনী। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই কোহিনূর বলে,
“তোমরা যে এই হিল পড়ে কী মজা পাও বুঝিনা।”
রাগিনী এবার কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা ভেংচি কেটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল একমনে। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে কোহিনূরও পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। শেষ সিঁড়িতে পা রেখে সামনে সেই কাঠের ঘরের মাঝে সাইড ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চেনা ব্যক্তিকে দেখেই কম্পন ধরে গেল কোহিনূরের। সে কী ভুলভাল দেখছে? হঠাৎ এই ইডিয়ট কোত্থেকে আসবে? নিজের চোখটা ভালোমতো ডলে আবারও একই ব্যক্তি দেখে মাথাটা ঘুরে ওঠে কোহিনূরের। পা দুটো সেখানেই থেমে যায়। দৃঢ় শক্ত চাহনি দিয়ে যেন চোখ দিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘ইডিয়ট মেহরাজ, এই ছিল তোমার মনে? তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে।’
অন্যদিকে মেহরাজের করুণ দৃষ্টি। সে যেন বলতে চাইছে, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।’
চলবে…