গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব-৪১+৪২

0
311

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪১

চেয়ারে সোজা হয়ে বসে থাকা নির্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সাহানার দিকে। মাথার উপরে ঝুলতে থাকা লাইট কমলা রঙের আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোয় দৃশ্যমান হচ্ছে সাহানার হালকা চামড়া জড়িয়ে যাওয়া মুখ। বয়সটা এই মহিলার কম নয়। তবুও এতো বড় ক্রা’ইমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে তার বাঁধেনি। সাহানার ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা র’ক্ত থুঁতনিতে এসে থামে। কপালটা ফোলা। গুছিয়ে করা খোঁপা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। পুরোটাই বি’ধ্বস্ত অবস্থা। হবে না-ই বা কেন? সরাসরি রি’মান্ডে নেওয়া হয়েছে তাকে। লেডি পুলিশ তাকে উত্তম’মধ্যম ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে। এখনো লা’ঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্জনের পাশেই। ব্যস…নির্জনের শুধু একটা ইশারা চাই আর আবারও শুরু হবে ধো’লাই। নির্জন অন্য কোনোরকম কথা না বলে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“রাগিনী কোথায়?”

সাহানা জবাব দিল না। টলমল চোখে চেয়ে রইল। নির্জনের ধৈর্য ভাঙ্গছে এবার। তবুও নিজেকে দমিয়ে চুপ রইল। সাহানা আগের মতোই নির্বিকার রইল। মাথা ঘুরছে তার। এটা কি এই ধোলা’ইয়ের সাইড ইফেক্ট? নাকি অন্যকিছু? নির্জন প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,
“কার জন্য কাজ করছেন? কেন করছেন? কে আপনাকে রাগিনীর বাড়িতে পাঠিয়েছে? আপনাদের বস কে?”

“ব…বলব না।”

বেশ কিছুক্ষণ পর মহিলাটি জবান খুললেও এমন উত্তর শুনে মনে হলো যেন নীরবতায় ভালো ছিল। রাগ চাপাতে না পেরে চেয়ারের হাতলে নিজেই আ’ঘাত করে বসল নির্জন। তার পাশে থাকা লেডি পুলিশ রাগি চোখে সাহানার দিকে এগোতেই সাহানা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে যখন পিছিয়ে গেল তখনই নির্জন অদ্ভুত কিছু একটা লক্ষ্য করে সেই লেডি পুলিশকে ইশারায় থামিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। মহিলাটি কেমন যেন কাঁপছে। সময়ের সাথে কাঁপুনি বাড়ছে তার। উঠে দাঁড়াল নির্জন। ভ্রু কুঁচকে ভারাক্রান্ত হয়ে বলল,
“এটা কী হচ্ছে উনার? কোনো থেরাপি দেওয়া হয়েছিল নাকি?”

“এখনো অবধি না। বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে।”

লেডি পুলিশের মুখ থেকে কথা শেষ হতে না হতে গড়গড় করে ব’মি করে দিলেন সাহানা। চমকে উঠল নির্জন সঙ্গে লেডি পুলিশ। অস্থিরতা সামলাতে না পেরে নির্জন চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“হোয়াট দ্যা…! হোয়াট হ্যাপেন টু হার?”

আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ল সাহানার পুরো দেহ। কেমন যেন শেষ বারের মতো ঝাঁকুনি দিলেন। অতঃপর দৃষ্টি স্থির হলো তার। আর নড়াচড়া করল না। নির্জন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে কোনোভাবে দ্রুত এগিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে নিচু হয়ে মহিলার নাকের সামনে নিজের আঙ্গুল ধরল। গরম নিঃশ্বাস পড়ছে না। নির্জনের মনের মাঝে হওয়া ছটফটানি বাড়ল। দ্রুত সাহানার বাম হাত চেপে ধরে পার্লস পরীক্ষা করতেই হতবিহ্বল হয়ে থেমে থেমে বলল,
“সী ইজ ডে’ড!”

মাথায় আপনা-আপনি হাত চলে গেল নির্জনের। শক্ত করে চেপে ধরল নিজের চুলগুলো। অসহ্য লাগছে এবার। মনে যে ঝড় উঠেছে সেটা থামানোর উপায়টাও হাতছাড়া হলো তার। কানে এলো রায়ানের কণ্ঠ।
“কী হয়েছে, অফিসার নির্জন?”

এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকাল নির্জন। হার হিম করা সুরে বলল,
“ডোন্ট নো। তাকে জিজ্ঞেসাবাদ করা হচ্ছিল হঠাৎ তার অদ্ভুত সিম্পটম চোখে পড়ল। আর কিছু বুঝে উঠার আগেই…”

“বাট হাউ ইজ ইট পসিবল?”

নির্জন এবার চুপ রইল। রায়ান তাকাল একবার সাহানার দিকে। বমি দেখে বোঝা গেল সমস্যাটা বি’ষক্রিয়া ধরনের হবেই। তবে সিউর বলা যাচ্ছে না। সে একটা কনস্টেবলকে ডেকে বলল,
“ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করো বডিটাকে। দ্রুত আইডেন্টিটিফাই করতে হবে।”

কনস্টেবল মাথা ঝাঁকাতেই একটা কথা মাথায় এলো রায়ানের। ফট করে বলে বসল,
“অফিসার নির্জন, একটা কথা খেয়াল করেছেন? আমি বলেছিলাম অভিরূপ চৌধুরী দেশে আসার পর যেই টেরো’রিস্টি অ্যা’টাক হয় সেখানে যাকে যাকে আট’ক করা হয় তারাও ঠিক এভাবেই মা’রা যায়? আর তাদের পো’স্টম’র্টেম রিপোর্টে এসেছিল তাদের মৃ’ত্যু রা’ইসিন নামক একটা কেমিক্যালের জন্য। যেটা তাদের শরীরে খুবই অল্প পরিমাণে ছিল।”

নির্জন চুপ থেকে কিছুটা পরে উত্তর দিল,
“ইয়াপ! বাট আই হ্যাভ নো টাইম। এই মহিলার মৃ’ত্যুর রহস্য খুঁজে বের করার সময় নেই আমার হাতে। রাগিনীকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন ইন্সপেক্টর রায়ান। ইটস অলরেডি লেট।”

নির্জনের কণ্ঠে এক অন্য ব্যাকুলতা ধরা দিল। রায়ানের বুঝতে সময় লাগল না এই পুরুষের এক অন্য দুর্বলতা সেই ঝামে’লায় জড়ানো নারীর প্রতি। মেহরাজের আগমন ঘটে তৎক্ষনাৎ।
“স্যার, রাগিনী ম্যাডামের ফোনের লাস্ট লোকেশন উনার বাড়িতেই। লোকেশন ট্র্যাক করে প্রথমে মাওয়া ঘাটে গিয়েছিল পুলিশ ফোর্স। বাট লোকেশনটা স্থির ছিল না। শেষমেশ শেষমেশ রাগিনী ম্যাডামের বাড়িতে লোকেশন ট্র্যাক করা হয়েছে। অভিরূপ চৌধুরীর ফোনের লোকেশনও এক।”

নির্জন একটু চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সাহানার মেলে রাখা চোখের দিলে। প্রা’ণ চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তবে চোখটা খোলা এখনো অবধি। নির্জন গমগমে সুরে বলল,
“ওয়েট আ মিনিট! আই থিংক রাগিনীকে তার বাড়িতেই রাখা হয়েছিল। কারণ ওটাই একমাত্র জায়গা যেখানে কোনো প্রবলেম হলেও কেউ ধরতে পারবে না। ওখানে রাগিনী থাকবে সেটা কারোর মাথাতে আসবে না। সবাই সবখানে খুঁজবে শুধু তার বাড়ি ছাড়া। উই হ্যাভ টু সার্চ দেয়ার। মেহরাজ, গাড়ি বের করো। আমি যাব সেখানে।”

“বাট স্যার, কেউ জানে না আপনি কে! মি. শাহ্ রাশেদ আপনাকে এখনো মেন্টাল পেশেন্ট হিসেবে চেনে। ওখানে সার্চ করতে গেলে আপনার পরিচয়টা জানাতে হবে যে!”

মেহরাজের কথার প্রতিত্তোরে রায়ান গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল,
“আমি যাচ্ছি। নো প্রবলেম।”

নির্জন বাধ সাধে। নিজের কোটের কলার ঠিকঠাক করতে করতে বলে,
“নো নিড। বাড়ি সার্চ করতে গেলে যা করতে হয় আমি করব। যদি প্রয়োজন পড়ে নিজেকে সামনে নিয়ে আসব। চোর পুলিশ অনেক খেলেছি। এই সমস্ত প্রবলেম ক্রিয়েট আমার দ্বারা হয়েছে। আমি যদি আরো কিছুদিন আগে রাগিনীকে সমস্তটা জানাতাম সে কেয়ারফুল থাকত। মেহরাজ দেরি করো না।”
মেহরাজ আগে বেরিয়ে যায়। পিছু পিছু রায়ানের পাশ কাটিয়ে যায় নির্জন।

কাঠগোলাপের গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে নির্জন। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশে জ্বলছে মিটমিটিয়ে তাঁরা। সুন্দর ব্যাপার হলো জোনাকিরাও যেন এই গাছে ভীড় করে। লাইট জ্বালানো হলো। মৃদু বাতাস স্পর্শ করল নির্জনের সর্বাঙ্গ। লাইট জ্বালাতে বিরক্ত হলো কিছুটা নির্জন। অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় সেই জোনাকির খেলাতে অন্যরকম মুগ্ধতা ছিল। শুধুমাত্র পাশে প্রয়োজনবোধ করছিল সেই রাগিনী নামক নারীর। মনে মনে নির্জন আওড়ালো, ‘একসময় তোমায় আমার প্রয়োজন ছিল রাগিনী তাজরীন! কেইসের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিলে তুমি। কিন্তু আজ আমি বুঝি, তুমি আমার সারাজীবনের জন্য প্রয়োজন। আমার প্রতিটা মূহুর্ত সুন্দর করে তুলতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

“স্যার, এখানে তো তেমন কিছুই নেই।”

ধ্যান ভাঙল নির্জনের। মেহরাজের কথায় আশেপাশে তাকাল। আসলেই কিছু নেই। সে সোজা উত্তর দিল এবার।
“অবশ্যই এখানে ফেলে রাখবে না রাগিনীকে। ওই লোকটা কোথায়? কী যেন নাম! বাড়ি পাহাড়া দেয়। মি. সায়েদুল?”

সায়েদুল ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল। গোলগোল আঁখিদুটিতে ধরা পড়ল নির্জনের ফর্মাল লুক। তবে মুখভঙ্গিটা বেশ অস্থির। এখনো তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যাকে একদিন পাগল বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই পাগলটা সাহেব রূপে তার সামনে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে। যখন নির্জনের গাড়িটা এসে থেমেছিল তখন তাকে দেখেই প্রথমে বিশ্বাসই করতে চান নি সে একজন পুলিশ টিমের কেউ। অতঃপর নির্জন না পেরে নিজের আইডি কার্ড দেখায় তাকে। তারপর নিজেই নিজের কপাল চাপড়ানোর অবস্থা হয় তার।

“বাড়িতে কেউ নেই?”

নির্জনের শান্ত প্রশ্নে সায়েদুল হকচকিয়ে উত্তর দিলেন,
“না। সৈয়দ ছাড়া বাড়িতে কেউ নাই। রাশেদ স্যার তো চেম্বারে। আর যারে নিয়ে এতো মাতামাতি সে গেছে কনসার্টে। আমি তো রাগিনী মারে সচক্ষে দেখলাম। রিকশা থেকে নামলো। আমার সামনে দিয়া গেট দিয়া ঢুকলো। কিন্তু তারপর কই উধাও হইলো বাড়ি থেকে?”

“যে রাগিনী নয় সে তো উধাও হবেই। যাকে দেখেছেন সে রাগিনী নয়। পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই মাথায় আসলো না যে ওই মেয়েটা অভিরূপের ক্ষ’তি করতে পারল না কেন? এত সময় পেয়েছে সে। তাও অভিরূপকে আ’ক্রমণ করার চেষ্টা করল না?”

সায়েদুল চকিতে তাকাল। উনার মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকছে না। হুবহু রাগিনীকে দেখেছেন তিনি এটা নিশ্চিত। রাগিনীর মুখ চিনতে সে ভুল করবেই না তাও কেন এই কথা?
“আচ্ছা, এই বাড়িতে গ্যারেজ, স্টোররুম বাদে কোনো রুম নেই যেখানে মানুষের যাওয়াআসা কম থাকে? বা তালাবদ্ধ থাকে?”

সায়েদুল খানিকটা ভাবলো। তার চুপ থাকা বাড়িয়ে দিল নির্জনের মনের চাঞ্চল্যতা। একে তো শান্ত থাকা সম্ভব হচ্ছে না তার উপর এত সময় নিলে কী চলে? এভাবে করে যেন দম বন্ধ হয়ে কখন যেন মাটিতে লু’টিয়ে পড়বে সে! রাত বাড়ার সঙ্গে বোধহয় জ্বরের মাত্রা বেড়েছে। দাঁড়িয়ে থাকতে প্রয়োজন হচ্ছে শক্তি। সারা শরীরে যেন ধরেছে ভঙ্গুর। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠলে কাঠগোলাপের গাছটায় হাত রাখে সে। চোখটা বন্ধ করে নেয়। মেহরাজ সঙ্গে সঙ্গে এসে তাকে ধরে। আর চিন্তিত হয়ে বলে,
“স্যার, আপনার হাতটাই তো ভীষণ গরম। টেম্পারেচার অনেক হবে। শরীর তো খারাপ হচ্ছে আপনার।”

“হক। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি শুধু রাগিনীর খোঁজ চাই। হোয়ার ইজ সী?”

গলার কণ্ঠস্বর ভেঙে এলেও তেজ এখনো স্পষ্ট। ইতিমধ্যে নির্জনের কর্ণকুহরে আসে সায়েদুলের মিনমিন করে বলা কথাগুলো।
“একটু সামনে গিয়ে ঘুরে গ্যারেজের পাশে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার মতো ঘর আছে বাহিরের সিঁড়ির সাথে লাগানো। ওখানে বাড়ির পুরোনো নষ্ট গাড়ি অনেকদিন ধরে পড়ে আছে। কেউ যায় না ওইদিক।”

নির্জনের টনক নড়ে। হাতটা গাছ থেকে সরিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে,
“নিয়ে চলো।”

চিলেকোঠার তালাটা বেশ পুরোনো। তালাটার চাবি খুলতে গিয়ে সায়েদুল দেখল তালাটা আগের থেকেই খোলা। অর্থাৎ ভাঙা। ভড়কে গিয়ে নির্জন আর তার টিমের দিকে তাকাল সায়েদুল। ভ্রু কুঁচকে তালায় হাত দিয়ে সেটা দ্রুত ফে’লে দিল মাটিতে। কারোর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার সময় নেই তার। তালা ভাঙা দেখেই সে বুঝে নিয়েছে কোনো গন্ডগোল তো আছেই। হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই ধুলোবালির রেশ এসে নাকে সরাসরি নাকে। ভেতরটা অন্ধকার পুরোটাই। চোখ দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নির্জন দ্রুত পকেট হাতিয়ে ফোনটা বের করে ফ্লাশ জ্বালায়। পেছনে মেহরাজও একই কাজ করে নির্জনের পিছু পিছু হাঁটে। সামনে দেখা যায় একটা গাড়ি। বেশ পুরোনো মডেল। গাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল নির্জন। লাভ হলো না। হতাশ মনে এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলতেই মাথাটা টলমল করতে থাকল তার। কয়েকবার কাশি দিয়ে উঠল। গাড়ির পেছনে আলো ধরতেই চকচক করে উঠল কিছু একটা। ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝল ওটা একটা সাদা রঙের ঘড়ি। একটা মেয়েলি চিকন হাতটা দেখেই বুকটা ধক করে উঠল নির্জনের। অস্থিরতা, অসুস্থতায় ঠিক রাখতে পারল না নিজেকে। সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। ব্যস্ত পায়ে ছুটল গাড়ির পেছনটা। কাঙ্ক্ষিত স্থানে দাঁড়িয়ে আলো ধরতেই চোখ বুঁজে রাখা ঘর্মাক্ত সেই মুখশ্রীর দেখা পেয়ে যেন অনেকক্ষণ পর দম নিতে পারল নির্জন। গলা কা’টা মুরগীর ন্যায় ছটফট করতে থাকা প্রা’ণটা যেন স্বস্তি পেল। খুঁজে পেল প্রশান্তি। তবে মেয়েটার চোখ বন্ধ কেন? হুড়মুড়িয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে সবার আগে নাকের কাছে নিজের আঙ্গুল রাখতেই নির্জন অনুভব করল গরম শ্বাস। তার শ্বাসে মিলল শান্তি। সর্বপ্রথমেই বড় শ্বাস নিয়ে নিজের শান্তিটা ভালোমতো অনুভব করল নির্জন। তবে রাগিনীর এমন করুণ অবস্থা দেখে মস্তিষ্কে যেন উঠে গেল র’ক্ত। মুখটা কী শক্ত করেই না বেঁধে দিয়েছে! সেই সঙ্গে হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফোন হাত থেকে নামিয়ে দ্রুততার সাথে প্রথমে হাত তারপর পায়ের দড়ি খুলে জ্ঞান হারা রাগিনীকে তুলে কোনো কিছু না ভেবেই নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল নির্জন। যতটুকু তৃষ্ণা বাকি ছিল তা পুরোটাই যেন পরিপূর্ণ হলো তার। সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল উষ্ণতা! একহাতে রাগিনীর মাথা চেপে ধরে অন্যহাতে মুখে বাঁধা রুমালটা খুলে ছুঁড়ে মা’রল সে। এরপর দেরি করল না আর। সামলে উঠতে পারল না নিজেকে। মাথা এবং কপালে নিজের শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ লাগালো লাগামহীনভাবে। কিছুটা দূরেই যে মেহরাজ দাঁড়িয়ে তার কোনো হুঁশ নেই নির্জনের। তবে মেহরাজের চোখে পড়েনি এখনো কিছু। নির্জনকে চুপ দেখে এবার দুইধাপ এগিয়ে দেখতেই যেতে যেতে বলল,
“স্যার, রাগিনী ম্যাডামকে পেয়েছেন নাকি?”

গাড়ির পেছনটাই চোখ যেতেই রোবটের মতো স্থির হলো মেহরাজ। বারংবার চোখের পলক ফেলে ঢক গিলতেই কাশি বেরিয়ে এলো ভুলক্রমে। এতক্ষণ নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিতে ব্যতিব্যস্ত থাকা নির্জন চোখ গরম করে তাকাল। ফ্লাশ লাইটে মেহরাজের মনে হলো যেন স্বয়ং বাঘমামা তাকিয়ে। নির্জন যান্ত্রিক গলায় বলল,
“কী হয়েছে? ডিস্টার্ব করছো কেন? আশ্চর্য!”

মেহরাজ কী বলবে ভেবে পায় না। বেতাল হয়ে বলল,
“স…স্যরি স্যার।”

নিজের চোখে হাত রাখে মেহরাজ। পেছনদিকে হাঁটা শুরু করে। নিজের টিমের কাছে এসে শুকনো মুখে তাকাতেই তার টিমের একজন জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো? ভেতরে কেউ নেই? আমরা সার্চ করি? কিছু পেলেও পেতে পারি।”

বলে সামনে এগিয়ে হাঁটতে উদ্যত হতেই মেহরাজ ধমক দিয়ে বলল,
“ওতো গভীরে যাওয়ার দরকার নেই। সার্চ করতে গেলে এখন কেউটে বেরিয়ে পড়বে জানো তো?”

“কেউটে? কী বলছেন আপনি?”

মেহরাজ বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,
“আরে ধুর! কাবাবে এত হাড্ডি হলে কাবাব খাবে কেমনে? তোমরা তো সবগুলা হাড্ডি। তার থেকে মাংস আর মাংস একত্রে থাক। আমরা বিদায় নিই। চলো তো!”

কারোর কিছুই বোধগম্য হলো না। তার আগেই মেহরাজ তাদেরকে ঠেলে বের করল সেখান থেকে। পারলে যেন দরজাটাও লাগিয়ে দিতো। কিন্তু আবার যদি নির্জন রেগে যায়? তার থেকে থাক সেভাবে।

“রাগিনী! এই রাগিনী!”

অবচেতন রাগিনীকে বারংবার নিচু সুরে ডেকে চলেছে নির্জন। কিন্তু রাগিনীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটার গালে দাগ পড়ে গিয়েছে শক্ত করে রুমাল বাঁধায়। গালের দুপাশটা বসে গিয়েছে। ঘর্মাক্ত কপাল বৃদ্ধা আঙ্গুলি দিয়ে সুন্দর মতো মুছে দিল নির্জন। চুলে আলতো করে হাত বুলালো। তারপর হাতটা এলো গালে। মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না কেন? কী করেছে তারা ওর সাথে? সেন্সলেস রাগিনীর সাথে নির্জন আনমনেই কথা বলা শুরু করল।
“আমার জ্বর, আমার অসুস্থতার, আমার দুর্বলতার একটাই প্রতিষেধক তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে। সে হলো রাগিনী তাজরীন।”

নির্জন থামে ভাঙা গলায় কেঁপে কেঁপে বলে,
“একবার বিরক্ত হয়ে আমার তাকাও। সেই চাহনি কতক্ষণ ধরে দেখি না। তোমার নিস্তব্ধতা আমায় জ্বালিয়ে মা’রছে এবার রাগের রানী। প্লিজ ওপেন ইউর আইস।”

নির্জন সযত্নে হাত বুলায় রাগিনীর দাগ পড়ে যাওয়া হাতে। আস্তে করে চুমু খায় সেই জায়গায়। ঠোঁটের কাছেই ধরে বিড়বিড়িয়ে পাগলের মতো বকে,
“জানি, কোনো নারীকে অবচেতন অবস্থায় চুমু খাওয়া ভয়াবহ অপ’রাধ। কিন্তু কেন জানি না আজ সেই অ’পরাধে অপ’রাধী হতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। করেই ফেলি অপ’রাধ? রাগ করবে? ঠিক আছে! রাগ করলে না হয় আমার নামে কে’ইস করে দিও। তবুও আমি মানছি না কোনো রুলস।”

কথা সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র রাগিনীর হাতে পড়ে অগুনতি চুম্বন। হাত ছেড়ে পাগলের ন্যায় তার দুটো গালেও একে দিল গভীর ঠোঁটের পরশ। সর্বশেষ রাগিনীর ঘামে ভেজা ললাটে পড়ল নির্জনের পাগলামির শেষ চিহ্ন। নিশ্চিত রাগিনী জাগ্রত থাকলে গালে কয়েকটা থা’প্পর জুটে যেতো নির্জনের। আর নয়তবা লজ্জামাখা মিইয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরিমাপ করার চেষ্টা করতো সেইসব স্পর্শের গভীরতা! মেয়েটা ঘামছে বেশ। না জানি কতক্ষণ ধরে এখানে রয়েছে। নির্জনও আর সময় পেল না। এখানেই নিজের উন্মাদনা দেখানো শুরু করে দিয়েছে? পরক্ষণেই রাগ উঠল নিজের ওপর। দুর্বল শরীরে কোলে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করল রাগিনীকে। কষ্ট হলো কিছুটা। সে তো নিজেই ঠিকঠাক চলতে পারছে না। তবুও বড় দম নিয়ে সবশেষে কোলে নিয়েই ধীর পায়ে হাঁটা ধরল গেটের দিকে। গেটের কাছে আসতেই চোখে পড়ল মেহরাজ সহ সায়েদুল আর তার টিমকে। সবার এমন উটকো চাহনিতে বিব্রত বোধ করল বেশ নির্জন। সেটাও যেন যথেষ্ট ছিল না। তার টিমের একজন না বুঝেই জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“স্যার, এতক্ষণ সময় লাগল যে!”

থেমে গিয়ে আবারও মেহরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মেহরাজ স্যার তো কীসব কাবাব, হাড্ডি, মাংসের কথা বলছিলেন। আমরা বুঝিনি।”

এবার নির্জন নিজের কর্মকান্ডে মাটিতে মিশে যায় এমন অবস্থা হলো। গলা খাঁকারি দিতে দৃষ্টি মেলানোর চেষ্টা করল। মেহরাজও থতমত খেল। ইচ্ছে করল অতিরিক্ত কথা বলা লোকটাকে রা’মধমক দিতে! কিন্তু পারল না। অপরপাশে ঠোঁট কামড়ে নিশ্চুপই রয়ে গেল নির্জন।

চলবে…

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪২

অবচেতন রাগিনীর হাতের পার্লস চেক করছেন ডক্টর। গুমোট সেই চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরে থেকে করুণ অবস্থা হয়ে গিয়েছে মেয়েটার। শরীরটা ভিজে গিয়েছে ঘামে। এসির বাতাসে সবে তার লাল আভায় মিশ্রিত মুখশ্রীর বর্ণ মিশতে শুরু করেছে। তবে রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখা গালের দাগটা এখনো তেমনই আছে। এতটাই শক্ত করে বাঁধা হয়েছিল তাকে। হাতের দাগটা আরো প্রগাঢ় হয়েছে। কালসিটে পড়ে যাবে বোধহয়। রাগিনীর অন্যপাশে সোজা হয়ে মলিন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন রাশেদ সাহেব। মুখে কোনো কথা নেই। শুধু দেখছেন নিজের মেয়েকে। বারংবার আফসোস করছেন। নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করছেন। কেন উনি বাহিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন? আর কেনই বা সাহানার সেই কাঁদো কাঁদো মুখ এবং মনগড়া কাহিনী শুনে এ বাড়িতে কাজে রাখলেন! সবই উনার ভুল। তার জন্যই বোধহয় তার একমাত্র আদরের মেয়েটার আজ এই হাল। মেয়েটার কিছু হলে তো উনি শূন্য হয়ে যাবেন। মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরেই তো উনার বাঁচা। রাগিনীর কিছু হয়ে গেলে উনি বাঁচবেন কীভাবে? এসব ভেবেই বুকের ভেতরের ব্যথা হচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর।

নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাগিনীর বিছানা থেকে খানিকটা দূরে। মাথাটা করে রেখেছে নত। অপলক নেত্রপল্লব শুধু এবং শুধু রাগিনীর দিকে চেয়েই কাটছে। ডক্টর আরো কিছুক্ষণ চেক করে জবান খুলতেই সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল উনার দিকে।
“আমার মনে হয় না যে শুধু সামান্য ঘুমের ঔষধ বা ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু দিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকা হয়েছে। আরো এমন কিছু রাগিনীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে যে তার জ্ঞান ফিরতে আরো সময় লাগবে। হয়ত কোনো ইনজেকশন বা ড্রা’গ জাতীয় কিছু পুশ করা হয়েছে।”

“রাগিনীর সেন্স সত্যিই ফিরবে তো?”

রাশেদ সাহেবের ভয়ে ভয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে ডক্টর আবারও ভাবুক হয়ে বললেন,
“আই থিংক সো! ওর পার্লস রেট, হার্টবিট রেট সব ঠিকঠাক আছে। শুধু প্রেশারটা ফল করেছে। এখন আপনি যদি ওকে যেকোনো হসপিটালে নিয়ে যানও তবে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। তারা রিজন তো জানতে চাইবে। আর বিষয়টা তো সুবিধার নয়। এতে শুধু সবার প্রেশার বাড়বে। অন্য কোনো লাভ হবে না। তার চেয়ে অপেক্ষা করুন। অন্তত সকাল অবধি দেখুন। আর আমি তো বলছি অল ইজ রাইট। রাতের মধ্যেই জ্ঞান এসে যাবে।”

“আপনি সিউর তো ডক্টর?”

নির্জনের উত্তেজনায় বলা কথাগুলো শুনে এবার নির্জনের দিকে এক পলক তাকালেন রাশেদ সাহেব। তার মুখচোখের বিবর্ণ রঙ! চুপসে যাওয়া মুখ দেখে মনে হলো সেও বেশ চিন্তিত। রাশেদ সাহেবের গম্ভীর দৃষ্টি নিজের দিকে দেখে কিছুটা থতমত খেল নির্জন। তবে কিছু বলল না। ডক্টর তার বলা কথার জবাবে বললেন,
“ইয়েস, ওফকোর্স। বলা যায় সে এখন ঘুমোচ্ছে। তাকে বিরক্ত করতে হবে না। যা ওর শরীরে দেওয়া হয়েছে সেটার প্রভাব কাটলেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“থ্যাংক ইউ, ডক্টর।”

উঠে দাঁড়ালেন রাশেদ সাহেব। ডক্টরও যাওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলেন। তাকে এগিয়ে দিতে রাশেদ সাহেবও যেতে লাগলেন। ঘরে রইল শুধু মেহরাজ, নির্জন, সৈয়দ এবং বিছানায় পড়ে থাকা রাগিনী। ঘর খালি হতেই উসখুস করতে শুরু করল মেহরাজ। ফট করেই কিছু একটা ভেবে নির্জন সৈয়দের উদ্দেশ্যে বলল,
“গলা শুঁকিয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা পানি হবে?”

চকিতে তাকানো সৈয়দ দ্রুত মাথা নাড়িয়ে প্রস্থান করলেন ঠান্ডা পানি আনার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল মেহরাজ। নির্জন কড়া গলায় বলল,
“কী সমস্যা? যক্ষ্মা রোগী হওয়ার ইচ্ছে আছে?”

মেহরাজ দ্রুত মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল না নেই তার ইচ্ছে। অতঃপর আবারও আগের ন্যায় নির্জন বলল,
“তোমাকে কি বাহিরে যাওয়ার জন্য আলাদা করে ইনভাইটেশন কার্ড দিতে হবে?”

এবার না বুঝেই মেহরাজ মাথা নাড়িয়ে হালকা হেসে বলে,
“জি স্যার।”
পরক্ষণেই বুঝে উঠতে পেরে হকচকিয়ে উঠে বলল,
“আই মিন না স্যার।”

বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল মেহরাজ। ঘরে শুধুমাত্র রাগিনী আর নির্জন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত চোখে তাকায় সেই সুদৃঢ় এবং সুদর্শন পুরুষ। আরো একটু একান্তে সময় চাইছিল সে খুব করে। ইচ্ছে ছিল নিজের মনের অনুভূতি উগড়ে দিতে। এজন্যই বোধহয় ঘর ফাঁকা হওয়ার জন্য দুষ্টু পাখির মতো চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার যে সাধ মিটছে না। সে ধীর পায়ে গিয়ে বসল রাগিনীর পাশে। ডান হাতটা নিলো নিজের হাতের মুঠোর। হাতটা এখনো গরম রাগিনীর। নির্জন যত্ন করে বুলিয়ে যেতে লাগল মেয়েটার হাতের দাগ পড়া জায়গাটায়। কোমল হাতের কী অবস্থা! রাগিনীর অন্যহাতটাও ধরল নির্জন। দুটো হাত একত্র করে নিজের দাড়ি যুক্ত গালে আলতো করে লাগিয়ে নিলো সে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আই এম স্যরি! সব আমার ভুল। আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করে উঠতে পারিনি। নির্জন আহমেদ অনেক বড় একটা কার্লপ্রিট। তুমি কখন জাগবে? জেগে আমাকে শা’স্তি দেবে সেই অপেক্ষায় আছি। তবুও যেন আমাকে দূরে ঠেলে দিও না প্লিজ। তোমার ওই ঘৃণাভরা দৃষ্টি আমার কাছে অসহনীয় হয়ে দাঁড়াবে।”

চোখ বুঁজে রাখা রাগিনীর কাছ থেকে এলো না কোনো উত্তর। সে নির্বিকার যেন। তবুও প্রলাপ বকতে থাকল নির্জন।
“বেশি চেয়ে ফেলছি? কী করবে বলো? আমার ডিমান্ড আগে থেকেই বেশি। একটু বেহায়া টাইপ আমি। সেকারণেই হয়ত বলতে পারছি এতকিছুর পরেও যে তোমার বিষা’ক্ত দৃষ্টি আমার কাছে মোটেও সহ্যকর হবে না। এই বেহায়া লোকটাকে মেনে নিও একটু।”

বলেই হালকা মলিন হাসে নির্জন। এলোমেলো হয়ে যাওয়া রাগিনীর চুল হাত দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিতে থাকে সে। আনমনে আবারও নিজের মনের চাওয়া থেকে কপালে আস্তে করে চুমু খেয়ে বসে সে। তারপর ভাবে, দিন দিন বুঝি সে সত্যিই লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে! তবে প্রেয়সীর সামনে লজ্জাহীন হওয়াটা ক্ষতির নয়। এটা তার ব্যক্তিগত মতামত। মনে ঝেঁকে বসা অনুভূতিগুলো খুব করে চায় রাগিনীকে। সবসময় ছুঁয়ে দিতে সুযোগ খুঁজতে থাকে মস্তিষ্ক। আর সুযোগ যেন একটাও হাতছাড়া করতে চায় না সে। আকাশপাতাল চিন্তাভাবনার মাঝে নিজের কপালের সাথে রাগিনীর কপাল লাগিয়ে রাখে সে। রাগিনীর মুখে পড়তে থাকে নির্জনের তপ্ত শ্বাস। আর নির্জনের মুখশ্রীতে চলে আসে মৃদুভাবে রাগিনীর গরম শ্বাস। এমনভাবেই কেটে যায় কিছু মূহুর্ত। নির্জন নিজেই বকবক করে বলে,
“ভাগ্যিস তোমায় খুঁজে পেয়েছি। নয়তবা আর কিছু মূহুর্ত তুমি বিহীন কেটে গেলেই হয়ত আমাকে সত্যি সত্যিই মেন্টাল হসপিটালে জায়গা হতো!”

কথা বলার মাঝে হুট করেই কানে আসে অন্যরকম এক ডাক। তবে নির্জন নড়চড় করল না। সেভাবেই চোখ বুঁজে থাকল। ফট করেই একটা আকস্মিক কান্ড ঘটে গেল। গালে অনুভব করল ভীষণ জ্বলুনি। হুড়মুড়িয়ে সোজা হয়ে গালে হাত দিয়ে বসল সে। চোখ বড় বড় করে তাকাল রাগিনীর পাশেই থাকা ছোট্ট তুলতুলে রিও এর দিকে। রিও যেন তৎক্ষণাৎ চোখ দ্বারা ধম’কানি দিল। সামনের একটা পা তুলে তেড়ে এসে থেমে গেল। চেঁচিয়ে উঠল নিজ ভাষায়। নির্জনের ভাবনায় বিরাজ করল এ আবার কখন এলো? টের তো পেল না। বিড়াল বাচ্চা হলে কী হবে? এর তো দেখা যায় পেটে পেটে শয়তানি! সৈয়দ ও মেহরাজের আগমনে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় নির্জন। গালে রয়ে যায় হাত। ভেজা কিছু অনুভব করে। বুঝতে সময় লাগে না র’ক্ত নামক জিনিসটা হাতে ভরেছে। রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিও এর দিকে। সৈয়দ তড়িঘড়ি করে পানি এনে এগিয়ে দেয় নির্জনের দিকে। অপরদিকে মেহরাজ কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সরু চোখে তাকিয়ে তার স্যারের গালে হাত দেওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টায় আছে। অতঃপর মেহরাজ রাগিনীর দিকে তাকায়। রাগিনীর জ্ঞান ট্যান ফিরে আবার থাপ্প’র দিয়ে ফেলেছে নাকি? তবে তো মহা সর্ব’নাশ! পরপরই মনে হলো, নাহ। রাগিনী তো এখনো চোখ বন্ধ করেই স্থির হয়ে শুয়ে। তবে ব্যাপার কী?
পানি এগিয়ে দেওয়ার নির্জন এবার কোনোরকমে বলে উঠল,
“লাগবে না, ধন্যবাদ। পানি খাওয়ার শখ আমি মিটে গিয়েছে।”

“দুঃখিত। আসলে ঠান্ডা পানি তো ছিল না। তাই ঠান্ডা পানি তুইলা নিয়ে আসলাম।”

সৈয়দের নিচু সুরে বলা কথাগুলো শুনে নির্জন ফের নম্রভাবে বলার চেষ্টা করল,
“বললাম তো লাগবে না। কষ্ট করে আনার জন্য ধন্যবাদ।”

ব্যস…আর দেরি করে না নির্জন। গালে হাত রেখেই হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে সেখানে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে গালে চেপে ধরে। তীব্রভাবে জ্বলছে। পিচ্চি একটা বিড়াল কিনা আজ তাকে এভাবে খা’মচে দিল তাও আবার শুধুমাত্র রাগিনীর কাছে যাওয়ার জন্য? কী হিংসুটে হয়ে গিয়েছে আজকাল বিড়ালও! ভাবা যায়? রুমালটা জোরে চেপে ধরতেই হাজির হলো মেহরাজ। উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করল,
“স্যার! আপনার কী হয়েছে? গালটা কি খাল হয়ে গিয়েছে?”

“তোমার ননসেন্স কথাবার্তা স্টপ করো। বিড়াল খাম’চে দিয়েছে।”

“সে কী! ওই ছোট্ট ছানার সাহস হলো কী করে আপনাকে খাম’চে দেওয়ার!”

“তার মালকিনের যেমন সাহস হয়েছে আমাকে সার্বক্ষণিক অস্থির রাখার ঠিক তেমন!”

কথাবার্তার মাঝেই ধীর পায়ে এসে উপস্থিত হন রাশেদ সাহেব। উনার গম্ভীর ও বিমূঢ় মুখটা ভেসে ওঠে নির্জনের সামনে। কথোপকথন বন্ধ হলো মেহরাজ ও তার মাঝে। একধ্যানে চেয়ে রইল নির্জন সেই মানুষটির দিকে। রাশেদ সাহেব চশমা ঠিক করে বললেন,
“আপনাদের আর কোনো কাজ আছে এখানে?”

মাথা নাড়ায় নির্জন। অর্থাৎ নেই। রাশেদ সাহেব আবারও আগের কণ্ঠে বললেন,
“তবে আসুন আমার সঙ্গে। আপনাদের সাথে কিছু কথা আছে।”

হাঁটা ধরেন রাশেদ সাহেব। মেহরাজ একবার নির্জনের দিকে চেয়ে নিজেও পিছু পিছু যেতে শুরু করে। রুমালটা গাল থেকে নামিয়ে নেয় নির্জন। সাদা রুমালে খুব একটা বেশি নয় হালকা র’ক্তের ছাপ। খুব একটা বেশি কাটেনি তবে। রুমাল মুড়িয়ে দরজা একটু সরিয়ে জ্ঞানহারা সেই প্রেয়সীর দিকে চেয়ে শেষবারের মতো একবার নিজের দুটো সুদৃঢ় দর্শনেন্দ্রিয়ের তৃষ্ণা ঘুচিয়ে নেয়।

হলরুমে এসে সোফায় বসেন রাশেদ সাহেব। বেশ ভদ্র ভঙ্গিতে ইশারা করে নির্জন ও মেহরাজকেও বসতে বললে তারা বসে যায়। রাশেদ সাহেব দেরি না করে সরাসরি প্রশ্ন করে ওঠেন,
“আমার আমার হসপিটালে এতকিছু হয়ে গেল! অথচ আমাকেই জানানো হলো না কেন? অফিসার নির্জন আপনি রাইট?”

“ইয়েস। কিন্তু কোহিনূরও আমার নামই। সেই নামেই ডাকতে পারেন।”

“তবে বলুন, আমাকে কেন জানানো হলো না? দিনের পর দিন আমার মেয়েটার সঙ্গে এক্টিং করে যাওয়ার কারণটা কি শুধুমাত্র ওই আত’ঙ্কবাদী আমার মেয়ে সেটা সন্দেহ করা?”

নির্জন মাথা দুলিয়ে বলে,
“ইয়েস। আই এম স্যরি ফট দ্যাট। আপনাকে জানানোর কারণ ছিল একটাই। আপনার মেয়ে রাগিনী। আপনি কোনোদিক থেকেই বিশ্বাস করতেন না।”

“হ্যাঁ করতাম না। কারণ আমার মেয়েকে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না। ও র’ক্ত দেখে অবধি ভয় পায়। অতিরিক্ত শ’ব্দে ওর ফোবিয়া আছে। ও কাউকে অসহায় অবস্থায় দেখতেও পারে না। আর সে কিনা টেরো’রিস্ট?”

“আমাদের কাছে আর অন্য কোনো রাস্তাও ছিল না বিশ্বাস স্যার। আপনি নিজে হয়ত নকল রাগিনীকে দেখেছেন। এত নিখুঁত চেহারায় মিল সবার ভুল হবে।”

রাশেদ সাহেব কিছুটা ক্ষ্যান্ত হলেন এবার। আসলেই তো! ভুলটাও কিছু বলেনি নির্জন। সে তো নকল রাগিনী তাজরীনকে দেখে নিজেই প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,
“ঠিক আছে। আপনার কথা যুক্তিযুক্ত অফিসার। বাট আই ওয়ান্ট ফুল সেফটি ওফ মাই ডটার!”

নির্জন উনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“নির্জন আহমেদ নিজে রাগিনী তাজরীনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিল।”

“আপনার কাজটা কি শুধুই আমার মেয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা? আই ডোন্ট থিংক সো!”

রাশেদ সাহেবের কথায় কিছুটা ভ্যাকাচেকা খায় নির্জন। পাশে থাকা শ্রোতা ও নীরব মেহরাজও শূন্য হয়ে চেয়ে রয়েছে। বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছে রাশেদ সাহেবের বলা কথাটির মর্মার্থ। তৎক্ষনাৎ উনি আবার থমথমে গলায় বলেন,
“আপনার কি আমার মেয়ের প্রতি দুর্বলতা আছে?”

দুটো হাত মুঠো করে ফেলে নির্জন। মুখ নিচু হয়। প্রচন্ড গরম লাগতে শুরু করে মূহুর্তেই। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এ কেমন প্রশ্ন? এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে সে বুঝে উঠতে যে পারে না। আর এমন অর্ধবয়স্ক মানুষের সামনে এর জবাব কিই বা দিতে পারে সেটা মস্তিষ্কে খেলে উঠবে না। সে কী করে বলবে, যে সে রাগিনীকে সার্বক্ষণিক নিজের খুব কাছে চায়? হৃদয়ের কপাটে শুধু রাগিনী তাজরীন নামটি লিখে দিয়েছে? এসব বলার আগে বোধহয় এখানেই জ্ঞান হারাতে হবে। রাশেদ সাহেব এতক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে ছিলেন নির্জনের দিকে। কিছু বুঝে উঠে বললেন,
“আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গিয়েছি। জবাবের প্রতিত্তোরে আমি বলব প্লিজ এই বিষয়টার সমাপ্ত এখানেই করুন। বেশি দূর এগোতে যাবেন না। আপনার মনের অনুভূতির ইতি টানুন অফিসার নির্জন।”

নির্জন স্তব্ধ, হতবিহ্বল। কিছু বলার আগেই সরাসরি মানা করাটা যেন বুকে তীরের ন্যায় বিঁ’ধে। কেন রাগিনীর বাবার এই আবদার? কারোর জন্য মনে সুন্দরতম অনুভূতি জন্মানো কি খারাপ?
“এমনিতেই জানি না রাগিনীর সঙ্গে কীসব হচ্ছে। এই একটা কেসেই আমার মেয়েটাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছে। আর ও যদি আপনার মতো জীবনসঙ্গীকে পায় যার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই তবে… ”

কথার মাঝে রাশেদ সাহেব থেমে গেলেন। আর বলতে পারলেন না। উনারও দ্বিধাবোধ হলো বেশ কিছুটা। ইতস্তত বোধ করে আবারও বলা শুরু করলেন,
“হয়তো আপনার কাছে আমার কথাগুলো বোকা বোকা লাগতে পারে। এটা ঠিক যে আপনার মতো মানুষও সংসার করে। তারাও পরিবার গড়ে তোলে। কিন্তু আমি বাবা হিসেবে কিছুটা স্বার্থপর মানুষ। মেয়েটাকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। তাই এখানেই সব কিছুর সমাপ্তি ঘটুক। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবুন। তবে আমার মেয়ে নয়।”

হুট করেই উঠে দাঁড়ায় নির্জন। তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। বাহিরে থাকা গুমোট পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়। মুখ দিয়ে কোনোরূপ কথা না বলে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে। মেহরাজ নিজেও থমকেছে আজ। একবার রাশেদ সাহেবের দিকে কিছুটা অস্বস্তির দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর সে নিজেও প্রস্থান করে।

ঘরের সব জিনিসপত্র এলোমেলো। কোনো জিনিস ঠিক জায়গাতে নেই। কয়েকটা শোপিচ ভেঙেচুরে পড়ে আছে ফ্লোরে। সেই সঙ্গে সেই ভাঙা জিনিসপত্রের মতোই ফ্লোরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে রূপাঞ্জনা। অগোছালো চুলগুলোতে মুখ ঢেকে গিয়েছে অর্ধেকটা। বড় বড় শ্বাস ফেলে চলেছে বারংবার। গালটায় পড়েছে পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ। টনটন করছে ব্যথায়। আচমকা চুলে টান পড়ায় সে কুঁকড়ে ওঠে। চোখমুখ খিঁচে ধরতেই কুর্ণকুহরে ভেসে আসে ডার্ক ম্যাক্সের গলা।
“শা* বে*ন্মা! আমার কথা অমান্য করার সাহস কে দিল তোকে? সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করলি কেন আজ? মনে কি রঙ লেগেছে?”

চলবে…