ভালোবাসার অনেক রং ( ছোট গল্প)

0
471

,,ছোটগল্প
,,ভালোবাসার অনেক রং
,,জিনাত আফরোজ

আমি যখন ইন্টারে সেকেন্ড ইয়ারে উঠি তখনি আমার বাড়িতে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসে। আগে যে আসতো না এমন নয়, তবে এবারটা সিরিয়াস।
বাসার সবাই আমার মতামত না নিয়ে ইতিমধ্যেই বিয়ের কথাবার্তা শুরু করে দিছে। আমি যখন জানতে পারছি পাত্র কে, তখন আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। পাত্র আর কেউ না আমি যে স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আসছি সে স্কুলের শিক্ষক।

যাকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। আমার আর উনার বয়সের অনেক ব্যাবধান। গম্ভীর আর রাশভারী একটা মানুষ। সব সময় উনার বিষয়ে ছাত্র ছাত্রীরা নাম্বার কম পেতো। উনি কাউকে বেশি নাম্বার দিতো না। এ নিয়ে সব ছাত্র ছাত্রীরা উনার উপর খেপে থাকতো।

সবসময় ছাত্রছাত্রীদের সাথে ধমকে ধমকে কথা বলতো। তখন আমরা উনার আড়ালে বলতাম উনি নিচ্ছোই ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছে এ কারণে এত বছরও বিয়ে করতেছে না। সবার সাথে এরকম করে কথা বলে।

আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম তখন ক্লাস টেনের আপুদেরকে বলতে শুনতাম উনি না-কি উনাদের ক্রাশ ছিলো। কিন্তু কেউ সাহস করে উনার সাথে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু আমার কখনো ক্রাশ ছিল না আমার সাথে উনার বয়সের অনেক ব্যবধান ছিলো।

বিয়ের কথা শুনে আমি তো রাগে দুঃখে কান্না করতে করতে বলে দিসি আমি এ বিয়ে কখনোই করব না। ভাবছিলাম নানাকে গিয়ে বলবো পরে শুনি এ বিয়েতে নানারেই বেশি মত।আমাদের পরিবারের কিছু হলেই আমার দাদা পযর্ন্ত নানার মতামতে কাজ করেন। আমি আরও ভাবলাম নানার কাছে কান্নাকাটি করলে, নানা হয়তো সবাইকে মানা করবে। কিন্তু এখন দেখছি আমার নানা এখানে বিয়ে দিতে এক কথায় রাজি। যেটুকু আশা ছিল সেটুকুও চলে গেলো।

বান্ধবীদের নিয়েও অনেক চেষ্টা করলাম বিয়েটা ভাঙার। কিন্তু কোন মতেই সফল হতে পারেনি।
বান্ধবীদের ধারণা স্যার আমাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করেন। তাইতো কলেজে উঠার পর বিয়ের প্রস্তাব দিছে।
তারপর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেলো, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছি স্যারকে আমি কখনোই স্বামী হিসেবে মেনে নেবো না, জ্বা*লিয়ে মা*র*বো।

রাতে আমি ওনার সাথে খুব খারাপ ভাবে কথা বলছি, যে স্যারের সাথে কখনো কথা বলতাম না।
সে স্যারের সাথে চোখ চোখ রেখে তর্ক করছি। কিন্তু মানুষটা একটু কথা বলেই সে যে চুপ হইছে আর কথা বলাতে পারিনি। আমি ভাবলাম আমার এতো বাজে ব্যাবহারে রাগ করে আমাকে কিছু একটা বলে ফেললে। আমি সেটা ধরে ফ্যামিলি সবাইকে বলবো তারপর কান্নাকাটি করে ডিভোর্স নিয়ে নিবো।

কিন্তু আমি যত কিছুই বলি উনি কিছুই বলেন না।
স্কুলে সবাইকে ধমক দেয় কিন্তু এখানে
এতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকবে কখনোই ভাবতে পারেনি।
রাগ,অভিমানে মাস চলে যায়, কিন্তু আমি কখনোই উনার সাথে ঝগড়া বাধাতে পারিনি। আমি যখনি গরম হয়ে কিছু বলি তখনি উনি গম্ভীর হয়ে বসে থাকেন, না হয় রুম থেকে চলে যান।

বিয়ের কয়েক মাস পরে আমাদের বাড়িতে,
একদিন উনার সাথে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলতে আমার বড়ো চাচাতো বোনে শুনে ফেলে।
আপু আমাকে আড়ালে নিয়ে একটু রেগে বলে,
– তোর সমস্যা কী রুহি? তুই স্যারের সাথে এভাবে কথা বলছিস কেনো? (আপুও উনার ছাত্রী ছিল) তুই কী এখনো স্যারকে মেনে নিতে পারিসনি?

আমি আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলি,
– আপু আমি উনাকে কোন মতেই মেনে নিতে পারছি না,একতো উনি আমার থেকে কত বড়ো, তার উপর উনি সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে। এরকম মানুষতো আমার পছন্দের ছিলো না। তাহলে কী করে আমি উনাকে মেনে নিবো বলো?

আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,
– বয়স বেশি এটাই তোর সমস্যা? আমার ননদ মিহুর কথা তোর মনে আছে?
আমি মাথা নাড়তে আপু আবার বলে,
– ওর স্বামীকে তোর কেমন লাগে?
আমি বেশ উৎসাহর সাথে বলি,,
– মিহুর হাসবেন্ড তো অনেক স্মার্ট, হাসি,খুশি, তার চেয়ে বড়ো কথা হলো মিহু আর ওর হাসবেন্ডের বয়স প্রায় সমান, যাকে বলে পারফেক্ট ম্যাচ।

আপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,
– হুম আমরা শুধু মানুষের উপরের দিকটাই দেখি, কিন্তু মনটা কেমন তা দেখি না। তুই জানিস মিহুর মতো মিষ্টি মেয়েটাকে ওই পারফেক্ট অমানুষটা কথায় কথায় মা*রে, গা*লা-গা*লি করে। এ পযর্ন্ত মিহুর নামে আমাদের কাছে কতবার যে বিচার নিয়ে আসছে। তোর দুলাভাইতো মিহুকে বলছে চলে আসতে কিন্তু মেয়েটা আসছে না, ও না-কি ওই অমানুষটাকে অনেক ভালোবেসে ফেলছে। তাই ছেড়ে আসার কথা ভাবতেই পারে না। মেয়েটা কতো বোকা বল ভালোবাসায় ওর জীবনটা শেষ করে দিলো।
শুন রুহি আমি বলছি না যে সব পারফেক্ট মানুষ খারাপ এবং আনপারফেক্ট মানুষগুলো ভালো। ভালো খারাপ নিয়ে আমাদের জীবন, হইতো স্যারের বয়স বেশি কিন্তু স্যার কখনো তোকে অসম্মান করেনি। তুই এতো বাজে ব্যাবহার করছিস তাও স্যার এ পযর্ন্ত কাউকে বলেনি। উনি হইতো কথা কম বলে তাই বলে যে তোর মনের মতো হবে না তা তো নয়। আর কখনো স্যারের সাথে বাজে ব্যাবহার করবি না, এগুলো যদি দুই পরিবারের মানুষে জানে, তোকে ছেড়ে কথা বলবে উনারা?। সময় নিয়ে স্যারকে বুঝ দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

আপু বলছে বলে নয় ইদানীং দেখি উনি আমার পছন্দের জিনিস নিয়ে আসেন, যেমন আমি বই পড়তে ভালোবাসি উনি দুইদিন পরপর বই নিয়ে আসেন, চুড়ি নিয়ে আসেন। প্রতিদিন একটা না একটা ফুল আনবেন, তাও লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সাজের বক্সের ভেতর রেখে দেন, হইতো আমি রাগারাগি করবো ভেবে।

এরকম করতে করতে প্রায় বিয়ের ৫ মাস হয়ে গেছে, অনেক তো হলো এবার না হয় সব রাগ ছেড়ে উনাকে সময় দিই। তাই কলেজ থেকে আসার সময় একটা কেক নিয়ে আসি, ফ্রিজে রেখে দিই।
তারপর যখন রাত হয়, সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। আমি অন্য রুমে গিয়ে সুন্দর করে শাড়ি, চুড়ি, হলকা মেকআপ করে, কেক নিয়ে রুমে আসি। উনি একটা বই পড়ছিলেন, দরজার আওয়াজ শুনে তাকিয়ে, আমাকে এ অবস্থায় দেখে হা করে তাকিয়ে আছেন।
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলি,
– এভাবে তাকিয়ে না থেকে পাঞ্জাবিটা পড়ে তারাতাড়ি তৈরী হয়ে নিন, কেক কাটতে হবে।

উনি পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আবার যখন ধমক দিতে যাবো উনি তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
উনার ভ্যাবেচেকা চেহারা দেখে হাসি আসছিলো, এখন চলে যাওয়াতে হাসতে থাকি।

পাঞ্জাবি পড়ে বের হওয়ার পর আজ প্রথম বার পূর্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি, মানুষটাকে আমি যেমন ভাবতাম তেমন নয়। আসলেই সিনিয়র আপুদের ক্রাশ এমনি এমনি ছিলো না।
শিক্ষক, রাগী, গম্ভীর মানুষ হিসেবে ছাড়া অন্য দৃষ্টিতে তাকাইনি তাই হইতো এমন মনে হতো।
কিন্তু আজ অন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেই লজ্জা পেলাম।

উনাকে আরও একটু অবাক করে দিয়ে প্রথম বারের মতো উনার হাত ধরে কেক কাটতে নিয়ে আসি। কেকের উপর লেখা দেখে উনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকায়,
“Happy Five Months Anniversary ”
তারপর কেক কেটে আমাকে খাইয়ে দেয়,

আলমারি খুলে একটা গিফট বক্স নিয়ে আমার হাতে দেয়। আর বলে,,
– আজকে কিনেছিলাম তোমার জন্য কিন্তু তোমাকে দেওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না।
তারপর ভ্রু নাচিয়ে আবার বলে,,
– আমি তো ভাবছিলাম আমিই শুধু বিয়ের দিনগুলোর কথা মনে রাখি। এখন তো দেখি আমার আরও একটা পার্টনার আছে মনে রাখার জন্য।

উনার কথা শুনে মেকি রাগ দেখিয়ে বলি,,
– তাই না,, বিয়ে যখন করছেন তখন মনে ছিল না? আপনার আরও একটা পার্টনার আছে? তবে শুনে রাখুন আজকে সুন্দর ভাবে কথা বলছি বলে ভাব্বেন না আমি সব মেনে নিয়েছি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার আরও সময় লাগবে।
কথা বলতে বলতে আমি উনার হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিই।

উনি মুচকি হেসে বলে,,
– যতা আজ্ঞা মহারাণী আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে।
তারপর উনি আমার গালে হাত রেখে বলেন,
– শুধু আজকে যেভাবে কথা বলছো সেভাবে কথা বলো, আমি আর কিছু চাই না। তুমি জানো আমি আজকে কতোটা খুশি হইছি। আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলবে। তোমাকে বড্ড ভালোবাসি রুহি,, বিশ্বাস করো অনেক ভালোবাসি। তাইতো তোমার অমতেই বিয়ে করতে বাধ্য হইছি।

“ভালোবাসা এমন কেনো?ভালোবাসার এতো রং কেনো? কেউ ভালোবেসে জীনব শেষ করে দেয়, কেউবা ভালোবেসে পালিয়ে বেড়ায়,কেউ বা ভালোবাসা মানুষটার ভালবাসা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে,,ভালোবাসা বড়োই অদ্ভুত।

~সমাপ্ত~