অবেলায় বসন্ত পর্ব-০৫

0
287

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৫)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রার কয়েকটা দিন অফিসে ব্যস্ততা গেল। নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছে সেটা নিয়ে দৌড় ঝাপ করতে হচ্ছে, দম ফেলবারও সুযোগ হচ্ছে না। এই ক্লায়েন্টটা বড্ড তিরিক্ষি মেজাজের। মেজাজ যেন নাকের ডগায় বসে থাকে। সাধারণ কথাও ঝাঁজের সাথে বলে। টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে তাই ঝাড়ি দেয়াটা তার কাছে হালাল পর্যায়ে পড়ে! ওয়ার্কারদের সাথে চিৎকার ছাড়া কথা বলতে পারেন না। তাই চিত্রাকে আলাদা করে সময় দিতে হচ্ছে এখানে। তবে ভদ্রলোকের কিছু ব্যাপার খুব চমৎকার। ওয়ার্কারদের সাথে যতই চিৎকার চেচামেচি করুক না কেন এদের খুব ভালো মানের নাশতা দুবেলা দেয়। এতদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় চিত্রা এতটা করতে কোথাও দেখেনি। আর নাশতা চলাকালীন সময়টায় ভদ্রলোক এদের সাথে তার জীবনের সেরা সময়গুলো নিয়ে গল্প করেন। তখন একে পুরো অন্যরকম মানুষ মনেহয়। বাগান করতে ভালোবাসেন। তার বাগানে বেশ কিছু এক্সপেন্সিভ এবং দুর্লভ প্রজাতির গাছ আছে। দেখে বোঝা যায় খুব সৌখিন টাইপ লোক। চিত্রা একে ঠিক বুঝতে পারে না। একবার জিজ্ঞেস করেছিল ওয়ার্কারদের সাথে তার আচরণ এমন কেন? তিনি গম্ভীর গলায় বলেছিলেন “এদের বকাঝকা না করলে কখনোই ঠিক মত কাজ করে না। বানর যেমন পিটিয়ে ভদ্র রাখতে হয় এরাও তাই। আর যারা পরিশ্রমের কাজ করে তাদের পেট ঠান্ডা রাখতে হয়। এদের ভালো খাবার খাওয়ার তেমন সুযোগ হয় না তাই একটু চেষ্টা করি। এতে দিন শেষে আমার বকার চেয়ে এদের কাছে কাজটাই তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।” চিত্রার কাছে কথাগুলো ভালো লেগেছে। মানুষ আসলে ভেতর আর বাইরে থেকে অনেক আলাদা! চিত্রার তখন মনে হল এখানেও কিছু কাজ তাকে এক্সট্রা করে দিতে হবে। ভদ্রলোকের এটা প্রাপ্য। কাজ করতে গেলে এভাবে প্রতিনিয়তই কত অদ্ভুত মানুষের দেখা মেলে। তখন ফাইজের কথা মনে পড়ল। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিল তারও কিছু পাওনা রয়ে গেছে।

ফাইজ তার ঘরের বারান্দায় বসে চা পান করছিল। দিনের অধিকাংশ সময় বারান্দাতেই কাটে তার। চিত্রা এত সুন্দর করে দিয়ে গেছে জায়গাটা যে তার এখানে থাকতে ভালো লাগে। ইদানীং সে এটাও লক্ষ করেছে যে হুট করেই চিত্রার ভাবনা তার মাথায় চলে আসে! সেটা এই বারান্দার কারণে নাকি অন্য কিছু সেটা বুঝতে পারে না। কাজ শেষ করে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল চিত্রা চলে গেছে। এর মধ্যে একটাবার যোগাযোগও করল না। এতদিন ইন্টেরিয়রের কাজ চলছিল একটা ব্যস্ততা ছিল, এখন তেমন কোন কাজ নেই। ভাবছে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়া উচিত। অনেক দিন তো থাকা হল। কিন্তু কেন যেন এবার যেতে মন চাচ্ছে না তার। এখানে সনামধন্য এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক বন্ধু তাকে কয়েকটা দিন স্পেশাল ক্লাস নিতে বলেছে। সে যেহেতু এত বড় একজন প্রফেসর, তার থেকে দেশের কিছু পাওনা আছে, শেখার আছে। সে যেহেতু ফ্রি-ই আছে তাই রাজি হয়ে যায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১দিনের একটা ট্রেনিংও নেবেন শিক্ষকদের, সেই সাথে শিক্ষার্থীদের ৭ দিন ক্লাস নেবেন। দুদিন পর থেকেই সেটা শুরু হবার কথা। এটা শেষ হলে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। তার অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন দেশের বাহিরেই থাকে। তাই দেশে থাকারও কিছু নেই। দেশে আসলে মায়ের জন্যই আসা হয়। দেশে আসার জন্য তার নিজের কোন পিছুটান নেই। এমন সময় তার ভাবনায় ছেদ পড়ল ফোনের শব্দে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে চিত্রা কল করেছে। সে কী একটু আনন্দিত হলো ফোন পেয়ে? ফোন পিক করতেই চিত্রা বলল- কেমন আছেন?

-হুম ভালো। আপনি?

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। একটু ব্যস্ততায় দিন যাচ্ছে।

-ও আচ্ছা…

-আপনিও কী ব্যস্ত?

-না। দেশে আমার তেমন কোন ব্যস্ততা থাকে না।

-আপনি কী একটু আমার অফিসে আসবেন?

-কেন? কোন কিছু বাকি রয়ে গেছে কী?

-হুম, তা তো আছেই। সেজন্যই আসতে বলেছি।

-আমি যতদূর জানি সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে।

-আপনি আসুন, এলেই জানতে পারবেন।

-ঠিক আছে।

বের হয়ে ফাইজের মনে হল চিত্রার জন্য কিছু কী নিয়ে যাবে? ফুল? ব্যাপারটা বেশি হয়ে যাবে না তো? আচ্ছা সে এতটা ফরমাল কী আগে ছিল? এই চিত্রা মেয়েটার ব্যাপারে সব সময় সব কিছু এমন কনফিউজিং হয়ে যায় কেন? শেষমেশ সে কোন কিছু না নেবার সিদ্ধান্ত নিল।

চিত্রার অফিসটা সুন্দর। তার চেয়েও সুন্দর চিত্রার কেবিন। এখানে সে আগেও এসেছে। কেবিনে ঢুকে চিত্রার দিকে তাকাতেই কিছুটা অনুমান করতে পারল চিত্রা তাকে কেন ডেকেছে। চিত্রা তাকে বসতে বলে বলল-

-আপনার একটা ধন্যবাদ পাওনা ছিল তাই আসতে বলা।

-ধন্যবাদটা কিসের জন্য?

-আপনার দেয়া অসাধারণ গিফটের জন্য। ব্যস্ততার কারণে বলতে দেরি হয়ে গেল। শাড়িগুলো চমৎকার। অনেক ধন্যবাদ।

-শুধু এই কারণে আসতে বলেছেন? ওটা তো ফোনেও বলা যেত।

-অবশ্যই বলা যেত তবে সামনাসামনি বলা আর ফোনে বলায় বিস্তর তফাত আছে।

-হুম, বুঝেছি। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। চিত্রা আজ তার দেয়া আসমানী রঙের শাড়িটা পরেছে। চিত্রাকে সুন্দর লাগছে… চিত্রা হয়ত তার সম্মানে শাড়িটা পরেছে বলেই তাকে অফিসে আসতে বলেছে। তার কী বলা উচিত “আপনাকে সুন্দর লাগছে”? কেমন দেখায় না ব্যাপারটা? আবার সেই কনফিউশন! তাই সে কিছু বলল না আর।

তখন “আপনি একটু বসুন। আমি ৫ মিনিটের মধ্যে আসছি” বলে চিত্রা চলে গেল।

চিত্রা চলে যাবার পর ফাইজ বসে বসে চিত্রার রুমটা ভালো করে দেখছিল। এমন সময় চিত্রার ফোন বেজে ওঠে। চিত্রা তার ফোন রেখে গেছে ডেস্কের উপর। একসময় কলটা কেটে গেল আর কেটে যেতেই ফাইজ অবাক হয়ে গেল, ফোনের লক স্ক্রিনে যে ছবিটা রয়েছে সেটা বারান্দায় বসে থাকা ফাইজের ছবি!!! তার ছবি চিত্রার ফোনে কেন? কী মানে এর? চিত্রা কী তবে তাকে…? কিন্তু চিত্রার কোন আচরণ তো তেমন কিছু কখনো প্রকাশ করেনি! তাহলে এর মানে কী? এমন সময় চিত্রা চলে এলো। বলল-

-sorry বসিয়ে রাখার জন্য। চিত্রা বসতে বসতেই ওই নাম্বারটা থেকে আবার ফোন এলো। চিত্রা “এক মিনিট” বলে ফোন রিসিভ করে, তখন চা নাশতা এসে গেল। চিত্রা ফাইজকে বলল- আপনি চা খান আমি একটু কথা বলে নেই।

-শিওর, বলে ফাইজ চা নিল। চা পান করতে করতে সে চিত্রাকে দেখছিল। তার মনে তখনো কিছু প্রশ্ন ঘুরছিল।

চিত্রা কথা শেষ করে বলল তার ক্লায়েন্ট ফোন করেছিল। তারপর ভদ্রলোকের গল্প করল। কেমন মেজাজি অথচ ভালো। ফাইজ শুনল তারপর বলল-

-আপনার অফিস চা বেশ ভালো বানায়।

-আপনি আমার বাসায় গিয়ে বলেছিলেন অন্য কোন একদিন খাবেন।

-এই চা কী আপনি বানিয়েছেন তাহলে?

-হুম।

-খুব ভালো। চায়ের জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

-বলুন?

-আপনি কখনো প্রেমে পড়েছেন?

আচমকা এমন প্রশ্নে চিত্রা বিষম খেল যেন। সে থতমত চোখে ফাইজের দিকে তাকাল, ফাইজ তার দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন চিত্রার ভেতরটা সে পড়ে ফেলতে চায়। চিত্রা চোখ নামিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- আমার মত মানুষদের প্রেমে পড়া বারণ। হঠাৎ এ প্রশ্ন?

-প্রশ্নের উত্তরটা হলো না।

-হুম পড়েছি।

-তারপর?

-তার আর কোন পর নেই। কারণ আমি সে অনুভূতি প্রকাশ করিনি। করা হবেও না।

-হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। আজ উঠি?

চিত্রা তখন বড় ভাড়ী একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল- এটা আপনার।

-এটা কেন?

-সব “কেন” র উত্তর নেই।

ফাইজ ধন্যবাদ বলে চলে গেল। ফাইজ চলে গেলেও তার পারফিউমের স্মেলটা রয়ে গেল যেটা তার অনুপস্থিতিকে অস্বীকার করছিল। আর চিত্রার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ফাইজ কেন তাকে প্রেমে পড়ার প্রশ্নটা করল?

ফাইজের মাথা থেকে চিত্রার ভাবনা কিছুতেই নামছিল না। তাই বাসায় এসে চিত্রার দেয়া গিফটের কথা সে ভুলেই গেল। অনেক রাত অব্দি আজ তার ঘুম এলো না। এমনটা তো কখনো হয় না তার! চিত্রা তার জীবনের কিছু কী পালটে দিল? তার মাথায় অনেক প্রশ্ন আসে কিন্তু সঠিক উত্তর আসে না। সে অস্থির অনুভব করে। এমন সময় চিত্রার দেয়া গিফটের কথা মনে পড়ে। বড় একটা পেইন্টিং দিয়েছে। খুলে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘুম আসছিল না তাই উঠে গেল সেটা দেখতে। অনেকগুলো কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে। কাগজগুলো খুলতেই সে বিস্মিত হয়ে গেল। এটা তো তারই ছবি! চিত্রার ফোনের লকস্ক্রিনে যে ছবিটা দেখেছিল সেটাই। পেইন্টিং করা, দেখতে অসাধারণ হয়েছে। একেবারে যেন জীবন্ত! এত ভালো কাজ মানুষ করে কী করে? ফ্রেমের এক পাশে একটা খাম আটকানো, সে খামটা নিয়ে খুলল। ভেতরে একটা চিঠি…

“প্রফেসর সাহেব,
পেইন্টিংটা কেমন হয়েছে তা বলতে পারি না। তবে খুব চেষ্টা করেছি তুলির প্রতিটি আঁচড়ে মায়া ঢেলে দিতে। যদিও আঁকায় আমার প্রফেশনাল ট্রেনিং আছে তবু সখে আঁকি। এ পর্যন্ত অনেক এঁকেছি কিন্তু এতটা যত্ন নিয়ে কাজ করতে কখনো ইচ্ছে হয়নি। আপনার জন্য কেন করেছি…? ঠিক জানি না।
আমার জীবনে আসলে একজন বন্ধুর দরকার ছিল… সময়ে অসময়ে আপনি আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। আমার জীবনে অনেকটা আলো এনে দিয়েছেন। আপনাকে ভালো বন্ধু বলাই যায় কিন্তু কেন যেন বলতে পারি না, ভয় হয়। আপনি তো এ দেশের অতিথি বলা চলে। বন্ধু ভেবে যদি আপনার প্রতি নির্ভর করে ফেলি? যদি ভালো থাকার লোভ হয়ে যায়? তাই সামলে চলি। আমার জীবন তো অপ্রাপ্তির জীবন সেটা ভুলে গেলে চলবে? আমাকে ভালো থাকতে হবে নিজের সাথে। ভালো থাকবেন আপনি।

চিত্রা”

ফাইজ আরেক দফা অবাক হলো চিত্রার প্রতিভা দেখে। তার বিশ্বাস হতে চাইছে না। তবে চিঠির বাকি কথাগুলো তার মন খারাপ করে দিল। সেই সাথে তার বাকি রাতটুকুর ঘুমও কেড়ে নিল। ভোর হতে বেশি বাকি নেই আর… সে বারান্দায় গিয়ে শেষ রাতের শীতল হাওয়ায় বসল। তখনও অন্ধকার কাটেনি তবে তার মাথায় ঘুরতে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তরই জবাব হতে লাগল একে একে। সে একসময় বুঝে গেল তার কী করা উচিত। সে ফজরের নামাজ আদায় করে দীর্ঘ মোনাজাত করল তারপর উঠে সোজা চিত্রাকে ফোন দিল।

চিত্রা সবে নামাজ পড়ে উঠেছে এমন সময় ফাইজের ফোন দেখে ভীষণ অবাক হলো। অসময়ে ফোন এলে প্রথমেই যা মনে আসে চিত্রারও তাই মনে হলো, “খারাপ কিছু না তো?” সে ফোন পিক করে হ্যালো বলতেই ফাইজ বলল-

-ঘুম ভাঙালাম না তো?

-না, জেগেই ছিলাম। এত সকালে? সব ঠিক আছে তো? আন্টি ভালো আছে?

-হুম আন্টি ভালো আছে কিন্তু…

চিত্রা অস্থির হয়ে বলল- কিন্তু?

-আমি মনে হচ্ছে ভালো নেই। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি…

– কেন?

-আপনি কী আজকের সকালের চা আমার সাথে বসে খেতে পারেন?

-হ্যাঁ পারি কিন্তু এটা বলার জন্য আপনার সারা রাত ঘুম হয়নি!

-ফাইজ তখন দুম করে বলল- “Chitra, will you marry me?”

চিত্রা প্রথমে বুঝল না কী শুনেছে তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল। ফাইজ ২য় বারও একই কথা বলল। চিত্রা অস্ফুট স্বরে বলল- আমি কী এখনো ঘুমাচ্ছি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি?

আস্তে বললেও ফাইজ কথাগুলো শুনতে পেল। বলল- আপনি স্বপ্ন দেখছেন না, ভুলও শুনছেন না।

-আপনি চা রেডি করুন আমি আসছি।

ফাইজ ধন্যবাদ বলে ফোন রেখে দিল। চিত্রা ফোন রেখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে কিছুই মেলাতে পারছে না… ফাইজ গতকাল কেন এমন প্রশ্ন করেছিল আর আজ কেন এমন উদ্ভট কথা বলছে তার আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! বুঝতে হলে সরাসরি কথা বলা ছাড়া উপায় নেই তাই সে তৈরি হতে লাগল।

ফাইজের বারান্দাতেই বসে আছে চিত্রা। ফাইজ চা এনে তারপর মুখোমুখি বসেছে দুজন। চিত্রা চাইছে ফাইজ নিজেই বলতে শুরু করুক আর ফাইজ ভাবছে চিত্রা কী ভাবছে বা বলবে? অবশেষে চিত্রাই বলল- আমার অফিস ধরতে হবে।

-আপনি অসাধারণ পেইন্টিং করেন। এটা প্রফেশন হিসেবে নিলে আপনি অনেক ভালো করতেন।

-ধন্যবাদ। এটা আমার সখ আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং আমার নেশা।

-গুড… চিত্রা, আমি ফোনে একটা কথা বলেছিলাম আপনি কিছু বলেননি এখনো।

-আমি আপনাকে বিয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহী, আবেগশূন্য বলে জানতাম হঠাৎ কী এমন ঘটল যে এমন কথা বলছেন তা আমার বুঝে আসছে না, তাও আবার আমার মত কাউকে!

-আমি জানতাম আপনি এভাবেই ভাববেন। আমি আসলে আপনার সাথে পরিচয় হবার পর থেকে অদ্ভুত এক অনুভূতির ভেতর বাস করছি যার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। অনেক প্রশ্ন আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায় কিন্তু আমি তার জবাব পাই না। লাস্ট নাইট আমি এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারিনি। আপনার চিঠি পড়ে আমার প্রশ্নগুলো আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। ভোর হতেই আমি সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। আসলে আপনাকে আমার ভালো লাগে, আপনার সঙ্গ আমার পছন্দ, আমি আপনাকে চাই। আর ফোন করে সেটাই আপনাকে জানিয়েছি। এখন আপনি বলুন।

-চিত্রার চা ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। সে মন দিয়ে ফাইজের কথা শুনছিল। যাকে দেখলে তার সমস্ত দুনিয়া থেমে যেতে চায় সে নিজেই বলছে “চিত্রাকে তার চাই”! তার হার্টবিট বেড়ে গেছে অনেক কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- আপনি আসলে আমাকে করুণা করতে চাইছেন। আমাকে আপনার ভালো লাগলেও সেটার জন্ম করুণা থেকে। এটা আপনাকে বুঝতে হবে।

-ভুল আপনি বুঝছেন। আমি সত্যি আপনাকে…

চিত্রা ফাইজের কথা শেষ করতে দিল না। বলল- আপনি যথেষ্ট ম্যাচিউরড একজন মানুষ আপনি এভাবে বলবেন ভাবতে পারিনি।

-ম্যাচিউরড মানুষের কী কাউকে চাওয়া বারণ?

-আপনি পাগলামো করছেন।

-চিত্রা, আপনার ফোনের লকস্ক্রিনে যে ছবিটা দেয়া আছে কাল সেটা আমি দেখেছি। চিত্রা অবাক এবং অপ্রস্তুত হলো। বলল- আশ্চর্য আপনি আমার ফোন ধরেছেন?

-না, ফোন আসার পর সেটা কেটে যেতেই ছবিটা দেখতে পেয়েছিলাম, টেবিলের উপরই তো ছিল। সে কারণেই গতকাল ওই প্রশ্নটা করেছিলাম। আপনি নিজেও তো আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন তাই না?

-ছবিটা নিয়ে আমি কাজ করছিলাম তাই ওখানে রেখেছি এর বেশি কিছু না।

-চিত্রা, আপনার চোখ কিন্তু অন্য কিছু বলছে। আর চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।

-চিত্রা কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সে পারত পক্ষে ফাইজের দিকে তাকাচ্ছিল না কারণ মানুষ মুখে যাই বলুক চোখ কখনো মিথ্যে বলতে পারে না। ফাইজ বিচক্ষণ মানুষ চিত্রাকে খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারবে, আর হলোও তাই। চিত্রা উঠে দাঁড়িয়ে বলল- চোখের ভাষা চট করেই বুঝে ফেলা যায় না। আপনি ভুল করছেন। আমি আসি, বলে চিত্রা পা বাড়াতেই ফাইজ হাত তুলে তার সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায়। বলল-

-আমি কোন ভুল করছি না। ভুল তো তুমি করছ শুধু শুধু নিজেকে গুটিয়ে রেখে। পৃথিবী কখনো এত নিষ্ঠুর হতে পারে না যে আল্লাহর একটা চমৎকার সৃষ্টিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করবে। কেউ না কেউ তো থাকবেই যার চোখে তুমি অসাধারণ কিছু হবে। সেই মানুষটা যদি আমি হই দোষ কোথায়?

-চিত্রা অবাক হয়ে ফাইজের দিকে তাকাল। ফাইজ কথাগুলো এত দৃঢ়তার সাথে বলছে? তাকে “তুমি” বলছে! ফাইজ কী তবে এতটাই সিরিয়াস? ফাইজ তখনও চিত্রার দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জবাবের আশায়। চিত্রা খানিক অসহায়বোধ করল… সে কোনভাবেই চাইছে না তার ভেতরের ভাংচুর ফাইজ দেখে ফেলুক। সে নিজেকে শক্ত রেখে বলল- ঠিক আছে প্রমাণ দিন আপনি আমায় কতটা চান?

-প্রমাণ?

-হ্যাঁ। একজন টিনএজার ছেলে যেভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেয় সেভাবে প্রপোজ করুন।

ফাইজ চোখ বড় বড় করে বলল- মানে?

-মানে খুব সিম্পল। একজন টিনএজ ছেলে যখন প্রেমে পড়ে তখন সে যা যা করে, যেভাবে প্রপোজ করে তার সব আপনাকে করতে হবে। যদি ইম্প্রেস করতে পারেন তখন প্রপোজাল এক্সেপ্ট করব।

-এই বয়সে এসব কী করে সম্ভব?

-সেটাই তো আপনাকে বোঝাতে চাইছি। আমাদের বয়সটা আর সেই জায়গায় নেই যেখান থেকে আমরা এভাবে কোন কিছু না ভেবে দুম করে প্রেমে পড়ে যেতে পারি। আর আপনি টিনএজ বাচ্চাদের মতই আচরণ করে যাচ্ছেন, কিছু বুঝতেই চাইছেন না।

-তোমার তাহলে তাই মনে হচ্ছে!!! well then I will do what you want.

চিত্রা কিছু না বলে চলে গেল। ফাইজ তখন বসে পড়ে ভাবতে লাগল… বলে তো দিলাম কিন্তু করবটা কী??? চিত্রা ইচ্ছে করে এই শর্ত দিয়েছে যাতে আমি কিছু করতে না পারি। ভালোবাসার মানুষটা নিজে তাকে চাইছে তবু সে মেনে নিচ্ছে না! মেয়েটা এমন কেন? যাক ফাইজের পছন্দের মেয়ে সে একটু এমন না হলে ঠিক মানায় না। তবে চিত্রা ফাইজকে জানে না। জানলে হয়ত এমন শর্ত রাখার চেষ্টা ভুলেও করত না। এখন তাহলে মিশন “চিত্রার মন জয় করা” তার মন এখন অনেকটা ফুরফুরে হয়ে গেল। ফুরফুরে মনে সে নাশতা করতে গেল।

চলবে।