বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৩]
প্রভা আফরিন
_
আশ্বিন মাসের ভ্যাপসা দুপুরে মাটির অসমান, সরল পথে ছুট লাগিয়েছে পালি। তবে সাইকেল ধরে এগোতে হচ্ছে বলে দৌড়াতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। পালির সঙ্গে ছুটেছে নিলয়। কিছুটা দূরের বনের কাছাকাছি এসে থামল দুজনে। সাইকেল গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে হাটুতে ভর করে শ্বাস নিল পালি। নিলয় বলল,
“বে’ক্কল মেয়ে, সাইকেল থাকতে এভাবে দৌড় দিলি ক্যান?”
“যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! তোকে ফেলে আসব না বলেই তো পায়ে ছুটলাম।”
“তো আমাকে সাইকেলে চাপিয়ে আনতে পারতি না?”
“আমি অন্য কাউকে নিয়ে সাইকেল চালাতে পারি না।”
“আমাকে বলতি, আমিই চালিয়ে আনতাম।”
পালি ঠোঁট উল্টালো। আসল কথা হলো ভয়ে তার মাথাই কাজ করেনি। তাই সাইকেল চালিয়ে আসার বদলে কোনোমতে পায়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছে স্কুল থেকে। নিলয়ের মুখটা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“ওই মেয়ে কই গেল? আমার সাইকেল চুরি করল নাতো!”
সঙ্গে সঙ্গে নিলয়ের পিঠে শুকনো মাটির ঢেলা এসে লাগল। লাফিয়ে উঠে পিঠ ডলতেই নজর গেল সামনের ছোটো, অগভীর জলাশয়ের দিকে। হেলে পড়া হিজল গাছের ওপর পা দুলিয়ে বসে আছে সোনি। মুখে দুষ্টু হাসি। অথচ একটু আগে তার করা অন্যায়ের জন্য প্রাণপণে ছুটতে হয়েছে দুজনের। সোনিকে দেখে ওরা জলাশয়ের কাছে ছুটে গেল। পালি বলল,
“এটা কী করে আসলি সোনি? ওই ছেলে যদি স্যারের কাছে বিচার দেয়?”
সোনি বাতাসে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“দিলেও কী? ছেড়ায় কী আমারে চিনে নাকি নাম জানে?”
“মুখ তো চেনে।”
“আগামী একমাস স্কুলমুখী হমু না। আমারে পাইবোও না।”
সোনি দাত বের করে হাসে। এই দুজন পালির দুজন নতুন বন্ধু। নিলয় পালির সহপাঠী। দুজনের পরিচয় স্কুলেই হয়েছে। নিলয় স্থানীয় চেয়ারম্যান বদরুল আলমের ছোট ছেলে। আর সোনি চামেলির বোনের মেয়ে। শুক্রবারে টিভি দেখতে এসে দুজনের ভাব হয়ে গেল। তিনজন সমবয়সী হলেও সোনি গতবছর ফেল করায় এখন তৃতীয় শ্রেণিতেই পড়ছে। সে নিয়ে সোনির মাথাব্যাথা নেই। মাসে এক-দুইদিন নামমাত্র স্কুলের মুখ দেখে। বাকিদিন পাড়াতে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, বাড়ির কাজে সাহায্য করে, ঝগড়াতেও পটু। আজ স্কুল ছুটির সময় ধাক্কা লেগে এক ছেলের সঙ্গে ধুন্ধু’মার ঝগ’ড়া বাধে তার। এক পর্যায়ে চুলো’চুলি করে ছেলেটার পিঠে দুম দুম করে কি’ল বসিয়ে নিলয়ের সাইকেল কেড়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছে সে। সোনিকে না পেলেও তার সঙ্গী হওয়ায় পালি ও নিলয়কে চিনে ফেলে সেই মার খাওয়া ছেলেটা। বিচার দিতে ছুটেছিল মাস্টারের কাছে। আতঙ্কে পালিরাও ছুটে পালিয়ে এসেছে। পালি এখন ভয়ে আছে পরেরদিন স্কুলে গিয়ে মাস্টারের বেতের বারি খেতে হবে কিনা। মনে মনে ঠিক করল কাল এনাম মামাকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলে পা দেবে।
নিলয় চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে বলল,
“আমার সাইকেল কইরে সোনি?”
“পানিত ফালায় দিছি।”
নিলয় এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পালি হেসে ওর মাথায় টোকা মে’রে বলল,
“ধুর! সোনি মজা করেছে। ওই যে তোর সাইকেল, গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা।”
নিলয় দূরে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কান্না চেপে ধরল। যেন দুটি মেয়ের সামনে ভুল করে কেঁদে ফেলেছে। ওর মুখভঙ্গি দেখে পালি ও সোনি হা হা করে হেসে ফেলল। সোনি নেমে এসে বলল,
“তোর সাইকেলের চেইন পইড়া গেছে। আইজ কেউ সাইকেল চালাইয়া যাবি না। আমার লগে পায়ে হাইট্টা যাবি। নইলে টায়ার নষ্ট কইরা দিমু।”
নিলয় ও পালি মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এই মেয়ে তাও পারবে। নিলয় রাগে মাটিতে পা আছড়ে বলল,
“ধুর, এর জন্যই তোর সাথে যাই না। এতখানি পথ পায়ে হাটলে এক সপ্তাহ আর স্কুলে আসতে পারব না।”
“এহ! আদরের দুলালে কয় কী? আমি কেমনে হাইট্টা যাই?”
আরেকবার ঝগড়ার আভাস পাওয়া গেল। সোনি অল্প বয়সেই ঝগড়াটা ভালো রপ্ত করেছে। চ্যা’টাং চ্যা’টাং কথা জানে বেশ। চেয়ারম্যান এর ছেলে হলেও নিলয় খুব ভীতু প্রকৃতির তা জানে বলেই সোনি আরো বেশি চড়াও হয়। তার কাছে পালি ও নিলয় দুজনেই খানিক অসহায়। পালি দুজনকে থামিয়ে বলল,
“চল, আজকে হেটেই যাবো।”
দীর্ঘপথ টুকু তারা যতটা কষ্টের ভেবেছিল ততটা হলো না। পথের মাঝে থেমে থেমে গাছে ওঠা, ফল পাড়া, কখনো কথা কা’টাকাটি, কখনো হাসাহাসিতে ডুবে গেল। তিনটি উচ্ছল প্রাণ প্রকৃতির সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে রইল। ছোট বাজারের মধ্যে ঢুকতেই রবিউল খন্দকারের মুখোমুখি হলো তারা। নিলয় ও সোনি বিদায় নিয়ে চলে গেলে পালি ছুটে এল মামার কাছে। তার উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে রবিউল খন্দকারের ঠোঁটেও হাসি ফুটে ওঠে। তিন মাসে মেয়েটা একেবারে মানিয়ে নিয়েছে শালুগঞ্জে। তিনি পালির বইপত্রসহ সাইকেলটা আগলে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। পালির একহাতে একটা দ্রোণ ফুলের চিকন ডাল। সে একটা একটা করে ফুল ছিড়ে তার গোড়া চুষে মধু আহরণ করছে। জিভে হালকা একটু মিষ্টতা ছুঁয়ে যায়, তাই ভীষণ উপভোগ্য।
হিমাদ সপ্তাহখানেক আগে গ্রাম ছেড়েছে। তার শহরের কলেজে ভর্তিসহ হোস্টেল ঠিক হয়ে গেছিলো আরো মাসখানেক আগেই। রবিউল খন্দকার শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। হিমাদ নতুন জীবনের জন্য শঙ্কা ও বাবার প্রতি অভিমান নিয়ে গ্রাম ছেড়েছে। ছেলের বাড়ি ছাড়ার জন্য জুলেখার রাগ আবারো পড়েছে পালির ওপর। হিমাদ একবার বলেছিলো পালিই এনাম চাচাকে সিগারেট খাওয়ার বিষয়টা জানিয়েছে। তাই হিমাদের এমন পরিনতি। জুলেখাও তা বিশ্বাস করে নিয়েছে। ফলে আড়ালে একবার মেয়েটার গায়ে হাতও তুলেছে সে। চামেলির থেকে জানতে পেরে রবিউল খন্দকারও পাল্টা আঘাত করতে ছাড়েননি। এ যেন প্রকাশ্যে এক গোপন রেষারেষি চলছে সকলের মাঝে। যার কেন্দ্রটা পালি। পালি অবশ্য বোঝে মামী কোনো কারণে তাকে সহ্য করতে পারে না। এবং সেটা সকলের সামনে প্রকাশও করতে পারে না। তাই সে মামীকে একপ্রকার এড়িয়েই চলে।
_____________
চিত্রা কয়েকদিন যাবত একটি বোরকার বায়না ধরেছে। বোরকা ছাড়া সে স্কুলেই যাবে না। অগত্যা রবিউল খন্দকার কাজ ফেলে আগে মেয়ের বোরকা আনিয়ে দিলেন। দুদিন ধরে চিত্রা সেই বোরকা পড়েই স্কুলে আসা-যাওয়া করছে। ব্যাপারটা মেহেরুন বানুর খুবই পছন্দ হলো। তবে চিত্রার ভাবনা কিছু আলাদাই ছিল। পরদিন সকালে সে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলো ঠিকই কিন্তু স্কুলে গেল না। ছুটে গেল নদীর তীরে। বোরকা পরিহিত নেয়েটাকে কেউ চিনলও না।সকালের সূর্যটা ধীরে ধীরে তার তীক্ষ্ণ নখ, দাত বের করছে। তেজে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা দায়। চিত্রা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নদীর জলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। বিস্তৃত জলরাশি থেকে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া উড়ে আসছে। চিত্রার দেহের ঘাম শুকায় না। হৃদয়ে অনিশ্চিত অস্থিরতা চেপে ধরেছে। সে আসবে তো? সে এল আরো কিছুটা সময় পর। দূর থেকে একটা ছইওয়ালা ছোট ডিঙি নৌকা ভেসে এল বালুতীরে। চিত্রার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মাঝিকে অবলোকন করে প্রসন্ন হলো। সে বোরকা আগলে দুরন্ত পায়ে নেমে এল তীরে। রনি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ঠেকাতেই চিত্রা লাফিয়ে উঠে পড়ল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে সতর্কতার সঙ্গে রনিও উঠে গেল। নদীর স্রোতে ও বৈঠার দিকনির্দেশনায় নৌকা চলে গেল শালুগঞ্জ থেকে দূরে।
চিত্রা ছইয়ের ভেতর বোরকা খুলে ফেলেছে। কাচের চুড়ির টুংটাং আওয়াজ কানে পৌঁছাতে রনি তাকালো। চোখের সামনে আসলেই রঙিন এক ফুল। এটা আশ্বিনের চিত্রা ফুল। রনির মনে হয় এই ফুলটা আসলে কোনো নির্দিষ্ট মাসের নয়। এই ফুলে সমগ্র ঋতুর অধিকার আছে। তাকে হা করে তাকাতে দেখে চিত্রা ঠোঁট টিপে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রনি বিব্রত হয়ে চোখ সরায়। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। চিত্রা যা করছে তা ঠিক নয়। রনি তা বোঝেও। কিন্তু মেয়েটাকে কঠিন ভাষায় ফেরাতেও পারে না। চিত্রা সরাসরি হুমকি দেয় আব্বার কাছে বলবে রনি তাকে ছুটির পর উত্যক্ত করে। ব্যাস তাতেই রনি চুপসে যায়। সে হোক হুমকির ভয়ে বা হৃদয়ে লুকানো কোনো গোপন টানে, রনি মেয়েটাকে আশকারা দিয়ে ফেলেছে। এখন আর কোনো কূলই পায় না সে। ভাবনার মাঝে চিত্রার কল্লোলিত মিষ্টি স্বর ভেসে এল,
“নৌকা এত ধীরে চলে কেন মাঝি? আমি কি আসব বৈঠার হাল ধরতে?”
“না না, আপনে ভিতরেই বহেন। কেউ দেখলে জান নিয়া আর পাড়ে পৌঁছাইতে পারমু না।”
“কে দেখবে? কেউ চিনবে না। আপনি ভেতরে আসেন।”
“স্রোত বেশি। হাল না ধইরা রাখলে নৌকা পথ হারাইবো।”
চিত্রা চোখ পাকিয়ে তাকায়, “খালি বাহানা।”
রনি জবাব দিল না। গত একমাস তাদের তেমন একটা সাক্ষাৎ হয়নি। কাজের জন্য রনি সময় বের করতে পারেনি। চিত্রা রেগে গিয়ে আবারো রনির শার্ট ছিড়েছে। বলেছে একটা দিন শুধুই তাকে দিতে হবে। শালুগঞ্জের বাইরে, যেখানে কেউ দেখে ফেলার ভয় থাকবে না। চিৎকার করে করে ভালোবাসা প্রকাশ করলেও কেউ শুনবে না। আজকেই সেই দিনটা। কিন্তু রনি স্বাভাবিক হতে পারছে না। সে বারবার জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাচ্ছে। তৃষ্ণায় হাহাকার করছে বুকের ভেতরটা। নৌকা থামলো শালুগঞ্জের বাইরে বিরান এক বালুচরে। ধু ধু প্রান্তরে চোখ ধাধানো রোদ খেলে বেড়াচ্ছে। রনি নৌকা ভিড়িয়ে বলল,
“নামবেন?”
“নাহ, আপনি আসেন।”
রনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চিত্রা ব্যঙ্গ করে বলল,
“আপনার মেয়ে হওয়া দরকার ছিল, আর আমার ছেলে। তাহলে আশাকরি এত সমস্যা থাকত না। আসবেন নাকি হাত ধরব?”
হাত ধরার কথায় কাজ হলো। রনি নৌকা দুলিয়ে তড়িঘড়ি করে ছইয়ের ভেতরে এসে বসে। তবে দূরত্ব রেখে। সূর্যের উত্তাপ ছই মাড়িয়ে গায়ে লাগছে। চিত্রার মুখ-গলা ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। সে হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হঠাৎ বলল,
“আমরা যদি আর গ্রামে না ফিরি!”
“মানে?” রনি ভড়কালো।
“চলেন পালাই।”
“আমি মনে হয় জ্ঞান হারাইতাছি।”
চিত্রা শব্দ করে শ্বাস ফেলল। হতাশ গলায় বলল,
“এবার আমি নিশ্চিত আপনার ভেতর তেলাপোকার কলিজা। তাইতো সেখানে আমার জায়গা হয় না। মানুষের হলে এতক্ষণে সেখানে আমি সংসার পেতে ফেলতাম। একটু মিষ্টি করে ভাবেন না, আপনি আর আমি দূরে গিয়ে মিষ্টি একটা সংসার পাতবো। আপনার আর আমার আলাদা এক পৃথিবী সাজাবো।”
“মানুষ পৃথিবীর প্রয়োজনে বদলায়। পৃথিবী মানুষের প্রয়োজনে না।”
“কিন্তু এই পৃথিবীর প্রয়োজনটা তো আসলে মানবজাতির জন্যই। মানুষই নিজেদের প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত নিয়ম বদলায়। প্রেমের ক্ষেত্রেই কেন তাদের মনে নিয়ম বদলানোর প্রয়োজনীয়তা আসে না?”
“তাইলে জগতে প্রেম বড়ই সস্তা হইয়া যাইতো। এত বাধা, বিপত্তি আছে বইলাই না যুগে যুগে ভালোবাসার উর্ধ্বে কোনো অনুভুতি জায়গা করতে পারে না।”
“তাহলে আপনার হৃদয়ে আমার ভালোবাসা ঠাই পায় না কেন?”
রনি চুপ রইল। চুপ হয়ে গেল চিত্রাও। সময় আপন খেয়ালে বয়ে গেল দুজনের মাঝে। দমকা হাওয়া আবেশ নিয়ে মনের রুদ্ধদ্বারে ছুঁয়ে গেল। দিয়ে গেল হৃদয় বিবশ হওয়া অনুভুতি। চিত্রা আকুল কন্ঠে বলে,
“আপনাকে একটু ছুঁই?”
রনি নড়ল না, সামান্যতম শব্দটিও করল না। চিত্রা হুট করে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়ায় অবহেলায়। রনি সেদিকে তাকিয়ে আলতো করে কনিষ্ঠা আঙুল ছুঁয়ে দেয় তার চোখের কার্নিশে। চিত্রা ঝাপসা চোখ তুলে তাকায়। দৃষ্টি একে অপরে নিবদ্ধ হয়। চিত্রা স্বগোতক্তি করে বলে,
“ভালোবাসার চেয়ে মহৎ কোনো টান পৃথিবীতে নেই। সেই টান যখন আপনার মনেও আসবে চারিদিকে শুধু আমাকেই খুঁজবেন।”
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৪]
প্রভা আফরিন
_
সিকান্দার অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে বা গল্প বলে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পছন্দ করে। মানুষ ভড়কে যায় কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত হয় এমন কাজ প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে ঘটিয়ে ফলাফল উপভোগ করাই তার লক্ষ্য। এই স্বভাব তার ছোটোবেলা থেকেই। সেবার জৈষ্ঠ্যমাসের নাভিশ্বাস ওঠা গরমে নবু মাঝির ঘরে সিঁধ কে’টে চু’রি করার কান্ডটা সিকান্দারই ঘটিয়েছিল। রাতের বেলা নদীর ঘাট থেকে ফেরার পথে নবুদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় যখন দেখল নবুরা দরজার খিল খোলা রেখেই বেহুশ হয়ে ঘুমাচ্ছে তখনই তার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। যদিও দামী কোনো বস্তু কিংবা জানমালের ভয় নেই বলেই তাদের দরজা খোলা বন্ধ নিয়ে চিন্তা নেই। দিন আনা দিন খাওয়া নবুর বাড়িতে চুরি করে কিছু পাবে না সে বিষয়ে সিকান্দারও নিশ্চিত ছিল। তবুও সে খুঁজে খুঁজে আধ কিলোগ্রাম মুড়ি কেনার টাকা পেয়েছিল। এরপর ঘটনাটি আরো রোমাঞ্চকর করতে সতর্কতার সাথে সিঁধ কেটে রেখেছিল যেন গ্রামে সিঁধেল চোরের উপদ্রব দেখে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এবং সে সফল হয়েছিল। সিঁধেল চোরের ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ঘুরেছে। জানমালের ভয়ে রাত জেগে গৃহস্থরা বাড়ি পাহারা দিয়েছে। এমন বিচিত্র কান্ড ঘটিয়ে মানুষের অভিব্যক্তিকে উত্তেজিত করার মাঝে সিকান্দার আনন্দ খুঁজে পায়। তবে এবার সে বেশ বড়োসড়ো একটা পদক্ষেপ নিতে চলেছে।
সে এসেছে রবিউল খন্দকারের রাইস মিলে। তেজস্বী সূর্যটি এখনো মধ্যগগনে এসে পৌঁছায়নি। রোদ ভেঙে আসায় গরমে হাপিয়ে উঠে সে মিলের সামনের টিউবওয়েল চেপে মুখ-গলা ভিজিয়ে নিল। আজলায় ভরে পানি খেয়ে তারপর রবিউল খন্দকারের কাছে গেল। রবিউল খন্দকার গদিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। ওকে দেখে বললেন,
“কি হে সিকান্দার, তোমারে তো এই মিলে আইতে দেহি নাই। আইজ হঠাৎ?”
সিকান্দার নত মুখে হাসল। বিনয়ী গলায় বলল,
“কামের বাজারে মন্দা চলতাছে খন্দকার সাব। কোনোহানে কাম পাই না। ভাবলাম ইট্টু আপনের লগে দেহা কইরা যাই।”
“তুমি তো কোনো কামেই টিকতে পারো না। সাতদিন কাম কইরাই তোমার মন উইঠ্যা যায়। মন্দা আসলে কামে না, তোমার মর্জিতে চলে। মর্জি ঠিক করো সব ঠিক হইয়া যাইব।”
সিকান্দার লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাকায়।
“কথা মিছা না। তয় সইত্য হইল খন্দকার সাব, আমার কোনোদিকে মন টানে না।”
“মন টানব কেমনে? তিনকূলে তো কেউ নাই। কারো লইগ্যা টানও নাই। হের লইগ্যাই কই বিয়া-শাদী করো। ঘর-সংসার, বউ-পোলাপাইন হইলে হেই টানেই গেরাম ছাড়তে পারবা না।”
“আপাতত গেরামেই আছি। ঘরখানি ভাইঙ্গা পড়ছে। ছনের বেড়া খইয়া পড়ছে। বৃষ্টি নামলে ফুটা চাল বাইয়া পানি পইড়া বিছনা-তোষক ভিজ্জা যায়। থাকনের যায়গা লইয়াও মসিবতে আছি। আমারে কেউ মাইয়া দিবো? আগে একখান কামের বন্দোবস্ত করি। আপনে কত মাইনষেরেই কাম দেন। রনি ছেড়াডা তো আপনের ধারেই কাম করে। আইলো জিরজিরা শইল নিয়া আর এহন চিনাই যায় না।”
রবিউল খন্দকার হেসে বললেন,
“ছেড়াডা আসলেই ভালো। মান্য করে খুব।”
সিকান্দার যেন মনে মনে কিছু গুছিয়ে নিল। এরপর উৎসাহ নিয়ে বলল,
“হ, হেয় দেহি সব কামই করে। চিত্রারে ইশকুলেরতন বাড়িত পৌঁছায় দেয়। এমনিতেও দিনকাল যা পড়ছে, মাইয়া-বেডি একলা বাইরে ছাড়ন ডরের। হের উপরে আমগো চিত্রা মাশাল্লাহ চান্দের টুকরা। ভালা করছেন হেরে এই কাম দিয়া।”
প্রসঙ্গের বাইরে সম্পূর্ণ বেখাপ্পা একটি কথা। রবিউল খন্দকারের কানে বিঁ’ধল। রনি চিত্রাকে স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় মানে! তিনি সহসাই কথাটা ধরতে পারলেন না। ওনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে সিকান্দার চুপসে গেল। মিনমিন করে বলল,
“আমি যাই খন্দকার সাব। আপনে ইট্টু চোখ, কান খোলা রাইখা আমার দিকটা ভাইবেন।”
সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। রবিউল খন্দকার এক দৃষ্টিতে সিকান্দারের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন। ওনার কেন জানি মনে হচ্ছে সিকান্দার আসলে কাজের কথা বলতে নয়, অন্যকিছু ইঙ্গিত দিতে এসেছিল। রবিউল খন্দকার হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। সেই গম্ভীরতা ওনার মুখে ক্রমশই গভীরতা পেতে শুরু করল। কয়েকদিন তিনি নিরবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলেন। তাতেই যা বোঝার বুঝে গেলেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন অত্যান্ত ঠান্ডা মেজাজ নিয়ে। কিন্তু মুখটা থমথমেই রইল। ওনাকে হঠাৎ থমথমে রূপে দেখলে বাড়ির সবাই একটু সমঝে চলে। আজও তাই হল। পালিও মামার কাছে এসে ঘুরঘুর করার সাহস পেল না। রাতে খেতে বসে নিজের পাতের বড়ো মাছটা চিত্রার পাতে তুলে দিয়ে তিনি বললেন,
“তোর পড়ালেখা কেমন চলে?”
“ভালো আব্বা।”
“রাস্তাঘাটে কোনো ঝামেলা হয় না তো?”
“নাহ।”
রবিউল খন্দকার মেয়ের চোখের সামনের ঝুকে পড়া চুলগুলো গুছিয়ে কানের পিঠে গুজে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“মন দিয়া পড়। ভালো ফলাফল নিয়া পাশ করা লাগব। আমার সন্তানেরা জানি আমার বদনামের কারণ নাহয়। তারা জানি গর্বের কারণ হয়।”
চিত্রার হঠাৎ অস্বস্তি হতে শুরু করল। আব্বার কন্ঠ কেমন অনুভুতিহীন। দৃষ্টি বরফশীতল। হঠাৎ বদনাম কিংবা গর্বের কথাই বা কেন উঠল? আব্বা তো এসব নিয়ে কখনোই কথা বলে না। নাকি লুকিয়ে গোপন অনুভুতিকে আশকারা দেওয়ায় আতঙ্কে বেশি ভাবছে সে? অন্তরে পাপবোধ হচ্ছে কী? চিত্রা অস্বস্তিতে পড়ে তেমন একটা খেতেই পারল না। পাতে হাত ধুয়ে ফেলতে জুলেখা বলল,
“কী হইলো? ভাত নষ্ট করলি ক্যা?”
“আর খাব না।”
চিত্রা যেন পালিয়ে বাঁচল সবার দৃষ্টি থেকে। জুলেখা থালা উঠিয়ে নিতে নিতে বলল,
“দুইদিন পর পর কী খেয়াল যে চাপে এই মাইয়ার মনে!”
“কী খেয়াল চাপে তা জানতে তো মাইয়ার দিকে মনোযোগ দেওন লাগব। তুমগো এত সময় আছে?”
“এহন আমি কী করলাম? আপনেরা সবাই নিজের মর্জি মতো চলেন। আমি কিছু কইলেও ভালা না, না কইলেও ভালা না। কোনদিকে যামু?”
রবিউল খন্দকার উত্তর দিলেন না। ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন।
____________
ঘেমে ওঠা তেলতেলে মুখটা আচলে মুছে নিল চিত্রা। শরতের শুভ্ররাঙা আকাশ যেন গনগনে উনুনের মতো আগুন ঢালছে। একফোঁটা বাতাসও নেই। বিকেল হতে চলল অথচ সূর্যের তাপ কমছে না। সে দ্রুত পায়ে নদীর ঘাটে গেল। স্রোতের টানে ধেয়ে আসা বাতাসে দেহ শীতল হয়ে গেল নিমিষেই। তীরে বাধা নৌকাটি দেখে তার ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। চিত্রা লাফিয়ে নৌকায় উঠে গেল। রনিকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখে বলল,
“আমাকে দেখলে আপনার মুখের মানচিত্র এমন থাকে কেন বলুন তো? হাসতে পারেন না? দাতে পোকা আছে? দেখি ইইই করেন।”
চিত্রা ঠোঁট ছড়িয়ে দাত দেখাতে বলল। রনি অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
“মজা করা ছাড়েন। দরকারি কথা কইতে আইছি।”
“কী কথা?”
চিত্রা পা ভাজ করে বসল। নৌকা দুলে উঠে পানিতে গোলাকৃতির তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে তা ক্রমেই ছড়িয়ে মিশে গেল দূরে। রনি গুরুতর ভঙ্গিতে বলল,
“আমার ভালা ঠেকতাছে না। কাইল খন্দকার চাচা আমারে ডাইকা পাঠাইলো। ভালা-মন্দ জিগাইলো। আবার এইডাও জিগাইলো মাঝেমইদ্যে দুপুরের কই যাই আমি। আমার ঘন ঘন বাইর হওয়া তাগো নজরে পড়ছে।”
চিত্রা থমকে গেল। কাল রাতে তো আব্বা তার সাথেও অন্যরকম গলায় কথা বলল। দুটি ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে! চিত্রার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল।
“আব্বা কালকে আমাকেও ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করছিল। এরপর কেন জানি অস্থির লাগছে ভীষণ।”
“সর্বনাশ!” রনি আতকে ওঠে। চিত্রা খপ করে রনির হাত ধরে বলল,
“এটা কী নিছক কোনো ব্যাপার হতে পারে না? আমাদের আশঙ্কা ভুলও তো হতে পারে।”
রনি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। অস্থির গলায় বলল,
“আপনের কথা হোনা আমার ঠিক হয় নাই। আইজ দেখা কইরা আরো বড়ো ভুল করছি। আপনে এক্ষণ বাড়ি ফিরা যান। আমি নাও ঘুরাই। আর দেখা করতে আইবেন না। আমারেও ডাকবেন না।”
চিত্রা কেঁদে ফেলল। রনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার থেকে। সে জোর করে তাকে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে বলল,
“দোহাই লাগে, এমন করবেন না। আপনাকে না দেখে আমি থাকতে পারব না।”
“আবেগ ছাইড়া বাস্তবতা বোঝেন। আমাগো দেখা হওয়া দুইজনের লইগ্যাই বিপদজনক।”
চিত্রা হুট করে রনির বুকে মাথা রেখে তাকে দুহাতে জাপটে ধরে। হৃদয় বিবশ হওয়া প্রথম আলিঙ্গনে কোনো সুখ নেই। আছে শুধু উৎকন্ঠা।
“এত বাধা কেন জীবনে? আমার যে আপনাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমরা কী দূরে গিয়ে সংসার বাধতে পারি না?”
রনি থমকে গেল। কিছুক্ষণ নিরবে চিত্রার ফোঁপানো শুনে কঠিন গলায় বলল,
“না, পারি না। আপনের আবেগ যেইখানে শেষ ওইখান থাইকা আমার ভাবনা শুরু। আর আমার ভাবনা যেইখানে সীমাবদ্ধ ওইখান থাইকা আপনের আব্বার অবাধ বিচরণ। অনেক হইছে, আর কোনো পাগলামি না। আপনে বাড়ি যাইবেন।”
চিত্রা মাথা তুলল। রনির শার্ট খাম’চে ধরে ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করল। রনি বাধা দিল না। হাতে না পেরে দাতে কেটে সে রনির শার্ট ছিড়ল। সমর্পিত কন্ঠের সবটুকু আকুলতা নিয়ে উচ্চারণ করল,
“আপনি নিষ্ঠুর, ভীষণ নিষ্ঠুর। আমাকে একটুও ভালোবাসলেন না।”
রনি নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল চিত্রার মুখে। গরমে, রাগে, আতঙ্কে, কান্নায় তার শুভ্র মুখটা লাল হয়ে গেছে। ঠিক যেমনটা ছিল প্রথম সাক্ষাতের দিন। সে চিত্রার গালে বয়ে যাওয়া সরু স্রোতধারায় আঙুল ছুঁইয়ে বলল,
“এই চিত্রা ফুলটা ঝরে যাক আমি চাই না।”
দুজনের আর কথা হল না। চিত্রা নৌকা ছেড়ে পাড়ে উঠতেই স্থির হয়ে গেল। ভয়ের শীতল ঢল নামল মেরুদণ্ড বেয়ে। রবিউল খন্দকার ও এনাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ওকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে রবিউল খন্দকার কালো ছাতা মেলে এগিয়ে এলেন। চিত্রার মাথায় ছাতা ধরে গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,
“স্কুল ছুটি হইছে না? বাড়ি চল।”
চিত্রা খেয়াল করল তার গলার স্বর হারিয়ে গেছে। চেষ্টা করেও একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। পা দুটিতে যেন পাথর বাধা হয়েছে। নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। তৃষ্ণায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে। চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকাল। একই অবস্থা রনিরও। ওকে পেছনে তাকাতে দেখে রবিউল খন্দকার দরাজ গলায় ডাকলেন,
“এনাম?”
“কন ভাই।”
“রনিরে নিয়া হাটে যা। মেলা কাম পইড়া রইছে। আর সিকান্দাররে একবার আমার লগে দেখা করতে কইছ।”
রবিউল খন্দকার মেয়ের হাত ধরে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেটে বাড়ি চলে এলেন। আব্বার হাতের টানে পুরোটা রাস্তা ঘোরগ্রস্তের মতো হেটে এল চিত্রা। বাড়ির সকলে তাদের মুখ দেখে অবাক হল। মেহেরুন বানু কয়েকবার জিজ্ঞেসও করল কী হয়েছে। রবিউল খন্দকার কোনো উত্তরই দিল না। মেয়ের সঙ্গেও কোনো কথা বলল না। আব্বার এত নিস্পৃহতা চিত্রাকে ভেতরে ভেতরে কুকরে দিচ্ছে। অজানা ভয়ে বুকের ভেতরটা ছটফট করছে।
সিকান্দার কিছুক্ষণের মাঝেই খন্দকার বাড়িতে উপস্থিত হল। রবিউল খন্দকার তাকে দেখে বলল,
“হেদিন কইলা তোমার ঘরখানি নাকি ভাইঙ্গা গেছে?”
“তা তো গেছে খন্দকার সাব। বেড়া-বুড়া সব খইয়া পড়ছে।”
“ঘরামীরে খবর দেও। মজবুত কইরা টিনের একখান দোচালা ঘর তোলো। খরচাপাতির চিন্তা কইরো না। বুঝতে পারছো?”
সিকান্দার মাথা নেড়ে সায় দিল। সে বুঝতে পারছে রবিউল খন্দকার কী কারণে তাকে ঘর করে দিতে চাইছে। সে এমনটাই চাইছিল। আশঙ্কাও ছিল ক্ষতি হওয়ার। তবে তা হল না। রবিউল খন্দকার ঝামেলা না বাড়িয়ে চিত্রার ব্যাপারটা পাঁচকান করা থেকে চেপে যাওয়ার বিনিময়ে সিকান্দারকে বাসস্থানের চিন্তা থেকে মুক্তি দিল। পরিকল্পনা সফল হওয়ায় নিজের ওপর তার গর্ব আরেকদফা বেড়ে গেল। সিকান্দার চলে যাওয়ার খানিক বাদে এনাম বাড়ি ফিরল। তাকে দেখে চিত্রার বাধ ভাঙে। সে ছুটে গিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসে পড়ল। আকুতি করে বলল,
“আব্বা, সব দোষ আমার। ওনার কোনো দোষ নেই আব্বা। আপনি সব শাস্তি আমাকে দিন। ওনার কোনো দোষ নেই।”
রবিউল খন্দকার মেয়ের দিকে ফিরেও তাকালেন না। কোনো কথাও বললেন না। চিত্রা দিশেহারা হয়ে এনামের কাছে ছুটে গিয়ে হাতজোড় করে বলল,
“চাচা, আমি তো আপনার মেয়ের মতো। আপনার কোলে-পিঠে বড়ো হয়েছি। আমার ওপর মায়া করে হলেও কথাটা রাখেন। দয়া করে সম্বলহীন মানুষটার ক্ষতি করবেন না। আমি স্বীকার করে নিলাম সব আমারই দোষ। সে আমার চাপেই দেখা করতে আসছে। আপনি একটু আব্বাকে বুঝিয়ে বলবেন চাচা।”
চিত্রা অঝোরে কাঁদছে। এনাম তার জড়ো করা হাত ছাড়িয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“চিত্রা মা, তুমি ঘরে যাও। তার কোনো ক্ষতি হইবো না। আব্বার সামনে এডি কইয়া তার রাগ বাড়াইয়ো না। ”
চিত্রা এই আশ্বাসে শান্ত হতে পারল না। সন্ধ্যা নাগাদ মেহেরুন বানু এবং জুলেখাও আসল ঘটনা জেনে গেল। জুলেখা রেগে মেয়েকে ঠাটিয়ে দুটি চ’ড় মা’রতেও ভুলল না। চিত্রা মেঝেতে শুয়ে মাঝরাত অবধি কেঁদে গেল। এরপর হুট করেই চরম সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলল। গভীর রাতে সে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ল। প্রিয় মানুষটির হাত ধরেই নাহয় নতুন সূর্য উদয় হোক।
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৫]
প্রভা আফরিন
_
জ্যোৎস্নারাতের ম্লান আধারে ছুটে চলেছে চিত্রা। তার অস্থির হৃদয়, উৎকন্ঠায় নিমজ্জিত চিন্তাভাবনারাও দ্রুত বেগে ছুটছে। জনমানবহীন এই ছমছমে পরিবেশ তাকে বিচলিত করছে না। চাষহীন, বিস্তীর্ণ জমির ঘাস চেড়া সরু পথ গিয়ে শেষ হয়েছে হাটের বড়ো সড়কের বুকে। চিত্রা এখন সেই জোছনা বিছানো নরম পথটি ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে। একটু আগে আকস্মিক যে সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বাড়িছাড়া হয়েছে তা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। নেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য নূন্যতম ভয়। মাথায় শুধু ঘুরছে আব্বা কিছু করার আগে রনিকে নিয়ে গ্রাম ছাড়তে হবে। কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের এমন সম্পর্ক জানার পর কোনো পিতাই চুপ থাকার কথা না। কিন্তু রবিউল খন্দকার এত বড়ো একটা ঘটনার পর দুজনকে হাতেনাতে ধরেও চুপ আছেন। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। চিত্রার ভয়টা এখানেই। নিশ্চয়ই ওনার পরিকল্পনা ভিন্ন। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই গ্রাম ছাড়বে সে। এমন সিদ্ধান্তে সমাজে তার পরিবারকে কতটা হেয় হতে হবে কিংবা অদূর ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত হবে তা নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। রনি তাকে গ্রহন করবে কিনা সেটাই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন।
চিত্রার নারী চক্ষু পুরুষ চক্ষুর ভাষা বুঝতে শিখেছে। এবং সেই অভিজ্ঞতা বলছে রনি তার প্রতি দুর্বল। হয়তো তার মতোই ভয়ানক রকমভাবে ভালোবাসে। শুধু প্রকাশ ভঙ্গি জানে না অথবা ভয় পায়। চিত্রা শক্ত করে হাতটি ধরলে সে কখনোই ফেরাতে পারবে না। এসব ভেবে চিত্রা মনে মনে নিজেকে সাহস দিচ্ছিল। লোকলজ্জা, সমাজ, সম্মান কোনো চিন্তাই তার হৃদয়ের অনুভুতিময় জমিটুকু টলাতে পারছে না। তবে গন্তব্যের নিকটবর্তী অজানা ভবিষ্যত ঠিকই টলিয়ে দিল। রবিউল খন্দকারের ধান মজুদের আড়তের সঙ্গে রনির বরাদ্দ ঘরে গিয়ে চিত্রা তাকে পেল না। পেল না আশেপাশে কোথাও। চিত্রার মাথা ঘুরে উঠল। কোথায় গেল লোকটা? সে আধারের মাঝে পাগলের মতো পুরো ঘর হাতড়ে বেড়ালো, জোরে জোরে ডাকল। নেই, রনি কোথাও নেই। এই আধার, এই রহস্যময় প্রকৃতি কী তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে? নাকি আব্বা তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছে? এমন ভাবনা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রার চোখে নোনা স্রোত বইতে শুরু করল। ঝাপসা চোখে দেখল দূর থেকে এক চিলতে আলোর বিচ্ছুরণ এগিয়ে আসছে। আলোর উৎস হারিকেন এবং সেই হারিকেন হাতে এনাম এসে দাঁড়ালো তার সামনে। চিত্রা তাকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল। কিন্তু মনটা রনির চিন্তায় আচ্ছন্ন। এনাম অবশ্য বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“আম্মা, বাড়ি চলো। এত রাইতে বাইর হইয়া ঠিক করো নাইকা।”
খুবই স্বাভাবিক বাক্যব্যয়। যেন রোজকার মতোই কথা বলছে।
“সে কই, চাচা? আপনারা কী করেছেন তার সাথে?” চিত্রার ভয়ার্ত কন্ঠ।
“কিছুই করি নাই। সে একলাই চইলা গেছে।”
“মিথ্যা কথা। আপনারা সরিয়ে দিয়েছেন তাকে। কী করেছেন ওনার সঙ্গে?”
“তুমি বেশি বেশি চিন্তা করতাছো। তারে কেউ কিছুই করে নাই। ডরে আগেভাগেই গেরাম ছাড়ছে।”
“কোথায় গেছে?”
“সে কাউরে জানায় যায় নাই। জানাইলেও আটকাইতাম না।”
চিত্রার বিশ্বাস হতে চাইলো না। সে এনামের হাত থেকে হারিকেন কেড়ে রনির বরাদ্দ ঘরটায় ছুটে গেল পুনরায়। এবারও হতাশ হতে হল। রনির ব্যবহৃত তৈজসপত্র থাকলেও জামাকাপড় নেই। চিত্রা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। রনি কি আসলেই ফাঁকি দিল! চলে যাওয়ার আগে তার একবারও চিত্রার কথা মনে পড়েনি? একবারও কী পিছুটান অনুভব করেনি? আরেকটু অপেক্ষা করলে খুব কী ক্ষ’তি হতো? চিত্রার অশ্রুসিক্ত গালে বয়ে যাওয়া বারিধারা থামে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে, সব। এনাম পাশে এসে আবারো আদুরে গলায় ডাকল,
“চিত্রা আম্মা, সব ভুইলা বাড়ি ফিরা চলো। তোমার আব্বা পথ চাইয়া বইয়া আছে।”
আব্বা পথ চেয়ে আছে! চিত্রা কেঁপে উঠল। যেন তখনই বাস্তবতার ধা’ক্কাটা এসে তার আবেগতাড়িত চিন্তাভাবনায় আলোড়ন তুলল। এই প্রথম তার মনে হল কী ভয়ানক কান্ডটা সে ঘটিয়ে ফেলেছে। এবার বাড়ি ফিরবে কী করে? এনাম বোধহয় ওর ভয়টা বুঝতে পারল। আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ডরাইয়ো না। এই বয়সে এইরম ভুল হইয়া যায়। আমিও কম ভুল করি নাই। ভাইজান আছিলো দেইখা বিপথে যাই নাই। তোমার আব্বা কিন্তু এহনো তোমারে কিচ্ছু কয় নাই। তোমার লইগ্যা ভাইজানের মনডা কত নরম তা কী জানো না? গিয়া আগেভাগে মাফ চাইয়া নিবা। তইলে দেখবা রাগ পইড়া গেছে।”
চিত্রা থম মে’রে রইল। এখান থেকে তার যাওয়ার একটাই গন্তব্য, যেখান থেকে ফিরে এসেছে সেখানেই। এমন সময় চিত্রার খেয়াল হল এখন যদি রনি উপস্থিত থাকত এবং দুজনে পালাতে চাইতো তাহলে ধরা পড়ে বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যেত।
“আব্বা তাকে কিছু করবে না তো?”
এনাম বিরক্ত হল। তাড়া দিয়ে বলল,
“ওই ছেড়ায় আগেভাগে ভাগছে, ভালা করছে। তুমি কিছু না ঘটাইলে তো আর কিছু করার থাহে না। হের কথা ছাইড়া নিজেরে নিয়া ভাবো। কারো চোক্ষে পড়ার আগে বাড়িত যাইতে হইবো। আর বইয়া থাইকো না।”
ভঙ্গুর মন, দুর্বল দেহ নিয়ে চিত্রা ঘোরগ্রস্তের মতো বাড়ি ফিরল। রবিউল খন্দকার বাড়িতে প্রবেশের জং ধরা লোহার ফটকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওনার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা ভীষণ শান্ত। কিন্তু আধারের মাঝে খেয়াল করলে বোঝা যায় ওনার চোয়াল ওঠানামা করছে। দৃষ্টিতে ক্রো’ধের জ্বা’লাময়ী শি’খা। তিনি আবছা দুটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসতে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। চিত্রা ফটকের সামনে আসতেই কাঁপতে শুরু করল। পা থেমে গেছে ততক্ষণে।
রবিউল খন্দকার মুখ না ফিরিয়েই বললেন,
“ওরে ভিতরে যাইতে ক। না যাইতে চাইলে যে রাস্তায় যাইতে চায় বিদায় দিয়া আয়।”
চিত্রা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বিপরীতে কিছু বলার সাহস বা শব্দ কোনোটাই তার নেই। এনাম এগিয়ে এসে আমতা আমতা করে বলল,
“পোলাপাইন মানুষ, ইট্টু ভুল কইরা ফালাইছে৷ মাফ কইরা দেন ভাইজান। চিত্রা নিজের বাড়ি ফালাইয়া কোনোহানে যাইব না।” এরপর চিত্রার দিকে ফিরে ইশারা করে বলল,
“আব্বা কী কইছে হুনছো না? ঘরে যাও।”
চৌকাঠে পা দিতেই জুলেখা চড়াও হলো চিত্রার ওপর। চুলের মুঠি ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। বাদ গেল না অশ্রাব্য গা’লিগা’লাজও। জুলেখা চুলির মুঠি চেপেই বলল,
“ব’দ’মাইশ ছেড়ি, এই দিন দেখতে তরে জন্ম দিছিলাম? অজাত-কুজাতগো লগে ঢলাঢলি করনের শখ হইছে? শইল্যে এত জ্বা’লা থাকলে কইতি, বিয়া দিয়া দিতাম। কামলাগো লগে ভাইগ্যা ব’দনামের ভাগীদার করতে গেছিলি?”
মধ্যরাতে খন্দকার বাড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তবুও যতটা সম্ভব ফিসফাস করেই কথা হচ্ছে। এনাম ব্যতীত পরিবারের বাইরের কেউ বিষয়টা জানুক সেটা কেউই চাইছে না। চিত্রা যেন এক প্রস্তরখন্ড। মায়ের আঘাতের বিনিময়ে মৃদু আর্তনাদ ছাড়া কিছুই করল না। জুলেখা আবারও বলল,
“মাইয়া মাইনষের একবার ব’দনাম হইলে জিন্দেগীতে হেই ব’দনাম ঘোচে না। নিজের ফুপুরে দেইক্ষা শিক্ষা হয় নাই? হইব কেমনে সব তো একই জাতের। নজর যায় ন’র্দমার দিকে।”
চিত্রা হঠাৎ জ্ব’লে উঠল,
“সেই বদনাম করার পেছনে তো তোমারই হাত ছিল তা ভুলে যাও কেন? নিজের মেয়ে বলে আমারটা ঢাকছো। পরের মেয়ের বেলায় তো গোটা গ্রাম জানিয়েছ।”
জুলেখা মেয়েকে এলোপা’তাড়ি চ’ড়-থা’প্পড় মারতে লাগল। মেহেরুন বানু ছুটে এসে সরালেন তাকে।
“থামো, বহুত হইছে। আগে যহন শাসন করতে কইছি একজনেও আমারে দাম দেও নাই। এহন শাসন কইরা কী হইব? খা’চা ছাড়া পাখিরে এক রাইতে পোষ মানাইতে চাও? আর কথায় কথায় আমার মাইয়ারে টানার অভ্যাস যদি বদলাইতে না পারো জুলেখা, পরিনাম কিন্তু ভালো হইব না। কিছুই ভুলি নাই। ভুলমুও না।”
জুলেখার হাত থামলেও মুখ থামল না। সে গা’লাগা’ল করতে করতে ঘর ছাড়ল। মেহেরুন বানু শুধু শীতল চোখে তাকিয়ে রইলেন নাতনির দিকে। চিত্রা গুনগুনিয়ে কাঁদছে। সান্ত্বনা দিতে কেউই এগিয়ে এল না। তবে দুটি কোমল হাত ঠিকই এল তাকে সান্ত্বনা দিতে। রাত তখন শেষভাগে। চারিদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে বাড়ির সকলে নৈঃশব্দে নিকষিত ঘুমে বিভোর। অথচ কারো চোখেই ঘুম নেই। এমনই নৈঃশব্দের মাঝে পালি চুপিচুপি এল চিত্রার ঘরে। তার চোখের জল মুছিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বুবু, তুমি কোথায় গেছিলে?”
“চিত্রা ফুলটা বিসর্জন দিতে।”
চিত্রা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে মুখ চেপে চিৎ’কার করে কাঁদতে লাগল। এই হাহা’কার প্রথম প্রেমের ব্যর্থতার। প্রথম হৃদয় ভঙ্গের যন্ত্র’ণার। পালির গভীর জলরাশির মতো চক্ষুদ্বয় সেই করুণ দৃশ্য বিস্ময়ে দেখে।
চলবে…