বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
137

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৬]
প্রভা আফরিন
_

শরতের শেষে দীর্ঘদিন পর একটা স্বস্তির বৃষ্টি নেমে এলো ধরনীর বুকে। শুকনো মাটি যেন শুষে নিতে চাইলো মেঘের নিবেদিত স্পর্শ। একসময় উগড়ে এসে কাদাময়, ঘোলাটে স্রোতের ধারা বইতে লাগল মাটির গা বেয়ে। সেই স্রোতে পালির কাগজের নৌকা ভাসাতে ইচ্ছে করল। সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা স্মৃতি এসে হানা দিল।
আষাঢ়ের ঘন বর্ষায় তখনো খিলানচরে বন্যার ঢল আসেনি। এক অলস বৃষ্টিমুখর বিকেলের ওপর পালির ভীষণ অভিমান জন্মেছে। এই সময়টা তার খেলার। ঘরে বসে বৃষ্টি দেখতে ছুটন্ত হাত-পায়ের একদমই ইচ্ছে করে না। করবী মেঝেতে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলো। মহসিন যখন বাড়ি ফিরত সাথে অনেকগুলো পুরোনো খবরের কাগজ নিয়ে আসত। করবী সেগুলো খুব মন দিয়ে পড়ত। সে বলত পত্রিকা পড়া ভালো অভ্যাসগুলোর একটি। নিজের দেশ ও দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়। পালিকেও সেই অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। পালি অবশ্য পত্রিকায় ছাপা ছবিগুলো ছাড়া ছোটো ছোটো পিঁপড়ের মতো লেখায় আকর্ষণের আর কিছুই পেত না। তার মা পত্রিকাগুলো পড়া হয়ে গেলে ঠোঙা বানিয়ে ফেলত। আব্বা পরের বার এলে নিয়ে যেত। বিষন্ন বৃষ্টিমুখর বিকেলে মেয়েকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখে কাছে ডাকল করবী। পত্রিকা কেটে খুব যত্ন করে করে তাকে কাগজের নৌকা বানানো শেখালো। এরপর মা-মেয়ে মিলে কাদাজলে পালহীন নৌকা ভাসালো। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা হয়, কারো নৌকা আগে যাচ্ছে তো কারোটা আটকা পড়ে পেছনে থেকে যাচ্ছে। এমন করেই ছোটো ছোটো কিছু আবেগের মাধ্যমে মা মেয়ের একাকি সময়টুকু চমৎকারভাবে কেটে যেত।

সেই স্মৃতি মনে পড়তেই পালির কাগজের নৌকা ভাসাতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে খাতা থেকে কতক পাতা ছিড়ে নৌকা বানানোর চেষ্টাও করল। হলো না। সে ভুলে গেছে মা কীভাবে ভাজের পর ভাজ দিয়ে একটি সাধারণ চৌকো কাগজকে নৌকা সদৃশ রূপ দেওয়া শিখিয়েছিল! হয়তো এভাবেই তার মস্তিষ্ক অনেক প্রিয় স্মৃতিই ভুলিয়ে দিচ্ছে। নতুনকে জানার কৌতুহলে ভাসা মেয়েটা টেরই পাচ্ছে না।

পালি হাল ছেড়ে কাগজগুলো ছুড়ে ফেলতেই নিলয় পাশ থেকে বলল,
“চল আজকে ভিজতে ভিজতে বাড়ি যাই।”

“নানি বকবে।”

“তো আমার মা কী কোলে বসায় রাখবে বলেছি? গিয়ে বলব পথের মাঝে বৃষ্টি নেমেছে, দাঁড়ানোর জায়গা পাইনি তাই ভিজেই ফিরেছি।”

“তুই সোনির সঙ্গে থেকে থেকে মিথ্যা কথা বলা শুরু করে দিয়েছিস।” পালি হেসে বলল।

নিলয় কপাল কুচকে বলল, “তুই তো খুব সত্যবাদী! না গেলে থাক। আমি একাই যাবো।”

নিলয় বৃষ্টি মাথায় সাইকেল নিয়ে স্কুলের বারান্দা থেকে বেরিয়ে পড়তেই পালি ছুটে পিছু নিলো। আজ সোনি স্কুলে আসেনি৷ ফলে দুজনের দুষ্টুমিও কিছুটা কম। বৃষ্টির তেজ কমে গেছে। ঝিরিঝিরি বর্ষণে ভেজা পথে সামলে চলা খুবই মুশকিল। পথিমধ্যে একটি দোকান থেকে এক টাকায় চারটে লজেন্স কিনল পালি। নিলয়কে দুটো দিয়ে বলল,

“দুটো তোর, দুটো আমার।”

নিলয় কচকচে মোড়কের প্যাচ খুলে লজেন্সটা মুখে পুড়ে বলল,
“বিকালে বড়ো মাঠে আসিস। সবাই মিলে খেলব।”

“নানি যেতে দেবে না।”

“তুই একদিনও আসিস না। আমরা কত মজা করি! তোর নানি তোকে এমন বন্দী করে রাখে কেন?”

“কী জানি!” পালি ঠোঁট উল্টায়।

নিলয় দাত বের করে হেসে বলল,
“তুই হলি ব্রয়লার মুরগী। কুকুরুক্কু…”

পালি ক্ষেপে গেল। আঙুল উচিয়ে বলল,
“তুই আবার আমাকে এই নামে ডাকলি?”

নিলয়কে তাড়া করল পালি৷ বেশিদূর যাওয়া হলো না। তার আগেই কাদায় ধপাস করে শব্দ হলো। নিলয় পা পিছলে পড়েছে। পালি খিলখিল করে হেসে তাকে ধরে ওঠালো। যদিও বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাট মানব শূন্য, কিন্তু কাদায় মেখে লজ্জা পেয়ে নিলয়ের মুখটা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেছে। পালি বলল,
“কাঁদবি না কিন্তু! পুকুরে নেমে একটা ডুব দে। সব ধুয়ে যাবে।”

নিলয়কে পথে বিদায় দিয়ে পালি বাড়ির পথ ধরল। সিকান্দার ভেজা গায়ে, লুঙ্গী কোঁচা দিয়ে সে পথেই যাচ্ছিলো। পালিকে দেখতেই হাক ছাড়ে,
“ওই খন্দকারের ভাগ্নী, খাড়া!”

সিকান্দার কাছে আসতেই পালি বলল,
“আমার নাম আম্রপালি।”

“আম রুপালি…রুপালি আম হউকগা কিছু একটা। তা তুই এহন ইস্কুলের তন আইলি?”

“হ্যাঁ।”

“আগেও কী ইস্কুলে পড়তি? তর বাপে পড়াইতো?”

পালি মাথা দোলালো। সিকান্দার আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি মেলে এরপর মাথা ঝুকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“নিগম ব্যাটায় কী তগো বাইত যাইতো? তর মায়ের লগে যোগাযোগ আছিলো?”

“নিগম? নিগম কে?” পালি কপাল কুচকে প্রশ্নাতুর চোখে তাকালো।

“নাম হুনোছ নাই? তর বাপ-মায় হেই বেডারে নিয়া কাইজ্জা করে নাই?”

“আমার আব্বা মায়ের সঙ্গে কখনও ঝগড়া করেনি।”

সিকান্দার হতাশ গলায় উচ্চারণ করল,
“জগতের সবাই দেহি ভালা। খালি আমার মনডাই কালা।”

সিকান্দার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এমন ভাবভঙ্গি করে চলে যায়। পালি তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না। সে বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি থেমে সূর্যটিও উঁকি দিয়েছে। ঘরে পা দিতেই সে নানির সামনে পড়ল। মেহেরুন বানু ওকে দেখতেই ক্ষে’পে গেলেন। পালিকে এই মুহূর্তে দেখাচ্ছে ভেজা কাকের মতো। ঠান্ডায় মৃদু কাঁপছে। জামাকাপড় বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরে ঘরের মেঝে ভিজে গেছে। তিনি কিছু বলার আগেই পালি কৌতুহলে বলে উঠল,
“নিগম কে নানি?”

মেহেরুন বানু চমকে উঠলেন। “তরে এই নাম কেডা কইছে?”

পালি সিকান্দারের মুখ চিনলেও নাম জানে না। বলল,
“ওইযে টিভি দেখতে আসে এক লোক বলল।”

“আর কী কইছে?”

“বলল ওই লোকটার সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ হতো নাকি, আমার আব্বার সাথে মায়ের ঝগড়া হতো কিনা।”

“কাপড় পালডা, ঠান্ডা লাইগ্যা যাইব। মাথা মুইছা খাইতে আয়।”

নানির শীতল চক্ষুর বিপরীতে পালির বাধ্যের মতো মাথা দুলিয়ে ভেতরে চলে গেল। আসলেই ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। জামা বদলে আসার পর ভেজা মাথাটা গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে মেহেরুন বানু বললেন,
“নিগম এই গেরামের মাস্টার আছিলো। অনেক বড়ো বড়ো ডিগ্রি পাওনের স্বপ্ন দেহাইতো পোলাপাইনগো। তর মায়েরেও পড়াইতো। হের লইগ্যাই জিগাইছে তর মায়ের লগে যোগাযোগ আছে কিনা। বুঝলি?”
“তিনি এখন পড়ায় না?”
“না।”
“কেন?”
মেহেরুন বানুর বিরক্ত হলেন,
“এতকিছু জানি না। জ্বা’লাইস না তো। খাইতে যা।”
____________

দিনের পিঠে দিন হারিয়ে সপ্তাহ দুই কে’টে গেছে।
চরম বিষাদের দিন, নাম না জানা হা’হাকারে পি’ষ্ট হওয়ার রাত। চিত্রার কাছে এক একটা মিনিটও ভীষণ ভার লাগে। সে নিজেকে ঘরবন্দী করেছে দুসপ্তাহ যাবত। সেই স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হওয়া রাতের পর সূর্যের আলো তার অসহ্য লাগে। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। বেলা বয়ে গেলেও গোসল করতে যায় না। চুল আঁচড়ায় না। সাজগোজ করতে পছন্দ করা মেয়েটা ছন্নছাড়া রূপ ধারণ করেছে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তার এমন রূপ দেখে মেহেরুন বানু সেদিন ছেলেকে জোর দিয়ে জানালেন অনেক তো হলো পড়াশোনা, এবার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। মেহেরুন বানুর কথায় অবশ্য কেউ দ্বিমত করল না। সকলেই মনে মনে তেমন কিছুই হয়তো ভাবছিলো। চিত্রার মতামতেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যে মেয়ে আবেগের বশে কোনোরূপ বিচার-বিবেচনা ছাড়াই নিজের জন্মস্থান, আদরে বড়ো করা পরিবার ছাড়তে পারে তার মতামত কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চিত্রা সব শোনে। কিন্তু বিয়ের কথা ভাবলেই দমবন্ধ লাগে। একজনকে মনের দখল দিয়ে কী করে আরেকজনের সংসার করবে সে? রনি যদি ফিরে আসে? হয়তো সেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে লুকিয়ে আছে। একদিন এসে সামনে দাঁড়াবে। শক্ত করে দুহাত ধরে বলবে,
‘আমাদের পথচলা শুরু হলো। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত অক্লান্ত হৃদয়ে পথ পাড়ি দিয়ে যাব।”

চিত্রার মন যে সামান্যতম আশাও ছাড়তে পারে না। সে পরদিন সকালে আব্বার ঘরে গেল। কান্নাকাটি করে, পায়ে পড়ে অনুরোধ করল তাকে যেন পড়তে দেওয়া হয়। রবিউল খন্দকার অবশ্য কোনো কথা বললেন না। মাসখানিক কেটে যাওয়ার পর চিত্রা স্কুলে যাওয়ার অনুমতি পেল। তবে একা নয়। এনাম তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। এরমাঝে ঘটকের আসা-যাওয়া লেগে রইল। কিন্তু চিত্রার মন সেই নদীর পাড়েই পড়ে থাকে। একদিন হয়তো রনির নৌকাটি এসে নোঙর করবে ঘাটে। গাঙ পাড়ি দেওয়ার বিনিময়ে হৃদয়টা চেয়ে বসবে। কল্পনায় হাজারো স্বপ্ন ডাল মেলে। বাস্তবে তাদের ডানা মেলা হয় না। হেমন্ত পেরিয়ে হাড় কাঁপানো শীত আসে। কিন্তু রনি আসে না। চিত্রাও হাসে না। সে কী ওই পুরুষটির চোখের ভাষা পড়তে ভুল করেছিলো? রনির কী তার প্রতি সামান্য টানও তৈরি হয়নি? একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশায় মেয়েটা কত পাগলামিই না করেছে। রনি ধৈর্যের সাথে সেসব হজম করেছে। সব মিথ্যা? সে কী আসলেই নিষ্ঠুর মানব? নাকি অনুভূতিহীন জড়মানব? সে কী ভাবেনি তাকে ছাড়া সুন্দর হাসির মেয়েটাকে আর সুন্দর লাগবে না? ভাবেনি হয়তো। চিত্রা পড়াশোনায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে নির্বাচনী পরীক্ষায় সে তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। এরমাঝেও পাত্রদেখা চলতে থাকে। চিত্রাও ধীরে ধীরে আশায় লাগাম টেনে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে।

পালি তার এই বুবুকে ঠিক মানতে পারে না। বুবুর হাসির মাঝে মায়ের ছায়া দেখতে পায় সে। অথচ তার বুবু আজ কতদিন হাসে না। তার সঙ্গে খেলে না, পড়ায় না। সে জানে বুবু কারো পথচেয়ে থাকে। সেই ব্যক্তিটাকে পেলে পালি সবার আগে নালিশ করবে কেন তার বুবুর সুন্দর হাসিটা কেড়ে নিলো? সে যেন হাসি ফিরিয়ে দেয়। বিনিময় পালি তার প্রিয় সাইকেলটাও দিয়ে দিতে রাজি।

রাতে পড়া শেষে পালি বইপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সময় মেহেরুন বানু বললেন,
“কাইল স্কুলে যাওনের দরকার নাই।”
“আচ্ছা, কিন্তু কেন?” পালি খুশি হলো।
“হিমাদ ভাই আইবো শহর থেইকা।”
পালির স্মরণে সেই চ’ড় খাওয়া সন্ধ্যার স্মৃতি ভেসে ওঠে। সে জোর গলায় বলল,
“কাল তো আমায় স্কুলে যেতেই হবে, নানি।”

চলবে…
ভবিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৭]
প্রভা আফরিন
_

সেতারা বিবি বসে আছেন খন্দকার বাড়ির বিস্তীর্ণ উঠানের মাঝে পাতা চৌকিতে। শীতল হাওয়ায় ওনার মলিন আচলে জড়ানো জীর্ণ দেহ কুকড়ে উঠছে প্রতিক্ষণে। লালচে প্রলেপ পড়া ঠোঁট পান চিবানোর ফলে অনবরত নড়ে চলেছে৷ কোচকানো চামড়ার ভাজে অসন্তুষ্ট দৃষ্টি নিবদ্ধ রান্নাঘরের দরজায়। পাটায় শুটকি মাছের ভর্তা বানাচ্ছেন মেহেরুন বানু। শুকনো মরিচ শুটকির সঙ্গে পিষে লালবর্ণ ধারণ করেছে। তিনি ভর্তা বানানো শেষে চামেলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“দুই চামচ গরম ভাত দে তো।”

চামেলি সদ্য মাড় গালানো ধোঁয়া ওঠা ভাত বেড়ে দিল ভর্তামাখা পাটায়। মেহেরুন বানু পাটাতেই ভাত মাখলেন। দলা পাকিয়ে হাক ছাড়লেন,
“পালিরে, নলা খাইলে আয়।”

পালি ব্যস্ত পায়ে ছুটে এল বাইরে। নানির দিকে হাত বাড়াতেই তিনি চোখ গরম করে বললেন,
“হাত ধোয়া?”
পালি মেকি হেসে জামার পশ্চাতে হাত ঘষে পুনরায় পেতে দিয়ে বলল,
“দাও, এবার পরিষ্কার।”
মেহেরুন বানু শুনলেন না। তিনি ধমকে হাত ধোয়ালেন। এরপর গরম ভাতের দলা তুলে দিলেন তার হাতে।
“চিত্রারে ডাক। একলগে খাইয়া উঠব।”
“বুবু ঘুমায়।”
“ছেড়িডার কী খারাপ স্বভাব হইলো! বেলা পর্যন্ত ঘুমায়।”

সেতারা বিবি এতক্ষণ চুপচাপ ওদের দেখে যাচ্ছিলেন। এবার নিজের গড়গড় কন্ঠের নিরবতা ভাঙলেন,
“নাতিনরে একবার কবিরাজ দিয়া ঝাড়ফুঁক দেও, বুঝলা। কুনজর বইল্যাও একটা জিনিস আছে। সুন্দর-মুন্দর ছেড়িগো ঋতু হইলেই বিয়ার তোরজোর শুরু হইয়া যায়। হেই জায়গায় তোমার নাতিনের লইগ্যা আমারে এই বয়সে ছুডাছুডি করন লাগতাছে!”

পালি ঝালে হু হা করতে করতে আচমকা প্রশ্ন করল,
“ও নানি, ঋতু কী?”

মেহেরুন বানু ধমকে বললেন,
“বড়োগো কথার মাঝে তরে কেউ কথা কইতে কইছে? যা এনতে, চিত্রারে ডাইকা তোল।”

পালি চলে যেতে মেহেরুন বানু সেতারা বিবির দিকে ফিরলেন। বললেন,
“মাত্র তো ম্যাট্রিক দিল। আমগো ছেড়ির বয়স এতও হয় নাই।”

“সেতারা বিবি কুনুদিন খারাপ বিয়ার ঘর আনে নাই। তোমার ছেড়ার বিয়াডাও আমার মারফতে হইছে। চুল পাকাইলাম ঘটকালী কইরা। এই বয়সে তোমার দুয়ারে আইয়া হোচ’ট খাইতাছি। এত বাছ-বিচার করলে নাতিন বিয়া দিতে পারবা?”

“সব মানুষেরই কোনো না কোনো খুঁত আছে। কারো শইল্যে তো কারো স্বভাবে। শইল্যের খুঁত দেহে সমাজ, আর স্বভাবের খুঁত ভোগে পরিবার। আমরা নিখুঁত চাই না। তয় বংশ, স্বভাব-চরিত্র সবদিক দিয়া খন্দকার বাড়ির ছেড়ির লগে যে মানাইবো তারেই তো চামু।”

সেতারা বিবি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মেহেরুন বানু হাত ধুয়ে এসে চৌকির এককোণে বসতেই তিনি গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে নিলেন। যেন মনে মনে কিছু গুছিয়ে নিতে চাইছেন। এরপর মৃদু গলায় বললেন,
“আমি তোমাগো খারাপ চাই না। ভুল না বুঝলে একখান কথা কইতাম।”
“কও, কইতেই তো আইছো।”
“বড়ো মোক্তারের দুই মাইয়ার পরে একটামাত্র ছেড়া, জানো তো?”
“নিবাসপুরের মোক্তার?”
সেতারা বিবি মাথা নাড়তেই মেহেরুন বানুর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।
“তাতে কী?”
“মোক্তার গিন্নী ছেড়া বিয়া দিতে পাগল হইছে। অল্পবয়সী যুবক, চরিত্র বিগড়ানের আগে তারে বউ দিয়া ঘরে বানতে চাইতাছে।”

“তাদের বাড়িতে দড়ি নেই? বউ দিয়ে বাধতে হবে কেন?”

চিত্রা আড়মোড়া ভেঙে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। ফোলা, তেল চকচকে মুখ জানান দিচ্ছে ঘুমটা পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মেয়েটা কী রাতে ঘুমায় না? এমন কথা মাথায় আসতে মেহেরুন বানু নিজেকে সামলে নিলেন। হয়তো পরীক্ষার ক্লান্তি এখনো ছাড়েনি। চিত্রার প্রশ্নের বিপরীতে সেতারা বিবি বললেন,

“আহা! এই বান্ধা হেই বান্ধা না। চরিত্র বান্ধনের কথা কই।”

“যে চরিত্র বাপ-মা বাধতে পারবে না সে চরিত্রের ভার অন্য মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেবে কেন? এ তো ঘোর অ’ন্যায়!”

“শিক্ষিত মাইনষের লগে তর্ক করা ঝামেলা। হেরা খালি কথা প্যাঁচায়। আমি এত জ্ঞানের কথা জানি না। আমি জানি সমাজ, সংসারের কথা। পুরুষ-পোলার পায়ের নিচে শইষ্যা থাহে। ঘরে মন টিকে না। নিজের সংসার হইলে হেরা এট্টু ঘরমুখী হয়। মায়েরও ডর কমে। তাই বিগড়ানের আগে বউ দিয়া থিতু করতে হয়। মাইয়াগো বেলাতেও তাই।”

চিত্রা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো। মেহেরুন বানু তারআগে বললেন,
“হাত-মুখ ধুইয়া আয়। আব্বার লগে বইয়া ভাত খাবি।”
চোখে স্পষ্ট বেয়াদবি না করার সতর্কতা দিলেন তিনি। চিত্রার সে ভাষা আত্মস্থ। সে অমায়িক একটি হাসি উপহার দিল। নির্জীব ঠোঁটের মলিন হাসি। সে দিকে তাকিয়ে মেহেরুন বানুর বুকটা ধক করে ওঠে৷ সেই রাতের পর আজ কতদিন কতমাস পেরোলো অথচ মেয়েটা ভ্যাপসা দুপুরের মতো থমকে আছে। না শীতল হয় আর না উত্তপ্ত। যেন সে ইচ্ছে করেই নিজেকে এমনরূপে উপস্থাপন করছে যে সকলে তাকে নিয়ে মনে মনে শঙ্কিত। এবং সে সেটা উপভোগ করছে। চিত্রা বিদায় নিলে মেহেরুন বানু আগের কথায় মনোযোগী হলেন,

“মোক্তারের ছেড়ার কথা তুললা যে?”

“দেহো, অতীতে কিছু কারণে তোমাগো দুই পরিবারের সম্পর্ক ঠিক হইতে গিয়া বিগড়াইছে। এইহানে তো মোক্তারগো দোষ নাই। হেরা নিজের থাইকা সব জাইনা তোমগো কাছে আত্মীয়তার হাত বাড়াইছিলো। করবীরে বিয়া নিতে চাইছিলো। যাইহোক ভাগ্যে আছিলো না। এইবার কিন্তু তোমরা চাইলেই হয়।”

মেহেরুন বানুকে আর কিছু ভেঙে বোঝাতে হলো না। সেতারা বিবি তার প্রতিক্রিয়া পড়তে ব্যর্থ হলেন। তবে থেমে থাকলেন না। নিবাসপুরে নাজমুল মোক্তারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন পরেরদিন। একইভাবে মোক্তার গিন্নী রাজিয়ার কানে তুললেন চিত্রার কথা। তবে উভয়পক্ষের অন্দরমহলের স্ত্রীগণ থেকেই সে প্রস্তাব নাকচ ঘোষিত হলো। কর্তাদের কান অবধি আর পৌছালো না। পৌছালো শুধু রাজিয়ার একমাত্র ছেলে সাম্যের কানে।
___________

জুলেখা মামী আর হিমাদ ভাই এই দুইজন মানুষের সামনে যেতে পালির একদমই ইচ্ছে করে না। সেবার হিমাদ যখন প্রথম বাড়িতে এল, পালির সংকুচিত ভাব মেহেরুন বানুর নজর এড়ায়নি। তিনি চেপে ধরতেই পালি চ’ড় খাওয়ার পর থেকে তার তটস্থতার কথা স্বীকার করে নেয়। মেহেরুন বানুই হিমাদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফলই হয়নি। এ বাড়িতে হিমাদের সবচেয়ে বেশি সখ্যতা মায়ের সঙ্গেই। জুলেখা ছেলের কাছে প্রাণখুলে নিজের দুঃখের কথা বলে। বলে পালিকে নিয়েও। হিমাদের মনে চাপা ক্ষো’ভে জুলেখা যেন জ্বা’লানি দেয়। ফলে মেয়েটাকে দেখলেই সে বিরক্ত হয়। রবিউল খন্দকার নিজের পাতের ভালো মাংসটা বা মাছটা তুলে পালির পাতে দেন বলে সেদিন হিমাদ তাচ্ছিল্য করে বলেছিল,
“উড়ে এসে জুড়ে বসা কাক। জীবনে পায়নি এখন গিলুক।”

ছোটো থেকেই আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হওয়া পালির তখন ইচ্ছে করেছিলো বমি করে খাবার ফেলে দিতে। সে এখন নিজের খাওয়া নিয়েও সতর্ক হওয়া শিখছে। বুঝতে শিখছে মামাবাড়ি ও নিজের বাড়ির তফাৎ। এখানে স্বাধীনতা ব্যয় করতে হয় বুঝেশুনে। অন্যেরা যতই ভালোবাসুক, মায়ের মতো ভালোমন্দ সবটুকু গ্রহণ করে ভালোবাসতে পারে না। তারা ভালোবাসে শুধু ভালোটুকুকেই। মন্দটুকু তার একার। মন্দের ভাগ কেউ নিতে চায় না। মাতৃহীন সন্তানেরা খুব জলদিই বড়ো হয়ে যায়। প্রকৃতি তাদের বড়ো হতে বাধ্য করে।

সপ্তাহ দুই আগে চিত্রার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। খুব একটা ভালো হয়েছে বলা যায় না। চিত্রার মনে দ্বিধা আছে সে আদৌ পাশ করবে কিনা। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে যে মেয়েটা ক্লাসে সেরা পাঁচে থাকত, শেষে তাকে পঞ্চাশেও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে গেছিলো। এ নিয়ে অবশ্য চিত্রা নিজেকেই দোষারোপ করে। কেন সে বেহা’য়া হতে গিয়েছিল? একজন দিনের পর দিন উপেক্ষা করা সত্ত্বেও তার প্রতি অবাদ্ধ আকর্ষণকে বাড়তে দিয়েছিল? দোষটা কী তার একার? রনি কী তাকে আশকারা দেয়নি? তাহলে এভাবে কী করে ফেলে চলে যেতে পারল? নাহয় গিয়েছেই প্রাণের ভয়ে। এরপরে কী একবারও খোঁজ নিতে পারত না? না, লোকটা ফেরেনি। কোনো সন্ধানও দেয়নি। অবাদ্ধ অনুভূতিরা গুমরে ম’রেছে বালিসের ভাজে, অন্ধকার রাতে, গুমোট বাতাসে ভরে গেছে মনের আঙিনা। চিত্রা শুধু তার অপেক্ষায় একের পর এক সম্বন্ধ নাকচ করেছে। কিন্তু পরিনতি এখন স্পষ্ট। সে আসবে না। কে জানে! এতদিনে হয়তো ভুলেও গেছে চিত্রা ফুলের কথা। ফুলটাও সেই কবে ঝরে গেছে! রয়ে গেছে নির্জীব দেহের গাছটি।

তবে চিত্রা এখন দুঃখ লুকিয়ে হাসতে শিখেছে। শুধু ফড়িংয়ের মতো চঞ্চলতাটুকু নেই। নেই উচ্ছাস। অলস বিকেলে সে পালিকে নিয়ে হাটতে বের হয়েছিল। ইদানীং তার একা বাইরে যাওয়া নিয়ে আর কারো কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। দুজন পা মিলিয়ে বিজন পথে হেটে বেড়াচ্ছিলো। পালির মুখে নানান গল্প।

“বুবু, তুমি সত্যিই বিয়ে করে চলে যাবে? তুমি চলে গেলে আমি খুব কাঁদব।”

“রেখে দে, আমিও যেতে চাই না।”

“জানো, সোনির বড়ো বোনকে নাকি তার দুলাভাই অনেক মা’রে। সোনি আমাকে বলেছে ও কোনোদিন বিয়ে করবে না। তোমাকেও যদি বিয়ের পর মা’রে!”

“এত সুন্দর মানুষকে কেউ মা’রতে পারে নাকি? পারলে সে ভালোবাসতেই জানে না।”

অচেনা কন্ঠে চিত্রা ও পালি দুজনেই থমকে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘোরাতেই একজন অচেনা, অদেখা ব্যক্তিকে নজরে এল। চিত্রাদের তাকাতে দেখে যেন লোকটা কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠল। এক পা এগিয়ে এসে আবার বলল,
“তার গায়ে হাত উঠবে শুধু ভালোবাসতে। প্র’হার করতে নয়।”
চিত্রা ভ্রু কুচকে বলল,
“আপনি কে?”
“আমি সাম্য।”

চলবে…

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [১৮]
প্রভা আফরিন
_

‘সাম্য’ নামটা শুনে চিত্রা একটু ভাবল, তার স্মৃতিতে কোথাও উক্ত নামের কোনো ব্যক্তির ঠাই নেই। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিদ্বয় মেলে ধরল। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মুখটায় প্রাণবন্ত হাসি খেলা করছে। অচেনা কারো সঙ্গে কথা বলছে বলে মনেই হচ্ছে না। চিত্রা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আমরা কী পরিচিত?”
“উহু।”
“আপনি এ গ্রামের কেউ?”
“তা ও নয়।”
“তাহলে আমাদের কথার মাঝে এলেন কেন?”
“রাগ করলেন?”
“করার কথা নয় কী?”

সাম্য একটু অপ্রস্তুত হলো। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল ক্ষণেই। অপ্রতিভ হয়ে বলল,
“আমাকে বখা’টে ভেবে বসবেন না যেন। আসলে আমরা পরিচিত নই তবে আপনার পরিচয় জানি। আপনি তো খন্দকার চাচার মেয়ে। তাই এগিয়ে এসেছিলাম। স্বীকার করছি এমন রসিকতা করা ঠিক হয়নি।”

চিত্রা মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলো। পালির হাত ধরে চলে যেতে নিলে সাম্যের কন্ঠ চঞ্চল হয়।
“আমার পরিচয় না নিয়েই চলে যাচ্ছেন?”
“জেনে কী করব?”
“হয়তো কাজে আসতে পারে।”
অপরিচিত একজন মানুষের এমন ছাড়াছাড়া কথা চিত্রাকে বিরক্ত করছে। তারচেয়েও বড়ো কথা বাড়ির কেউ তাকে অচেনা পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে যেটুকু বিশ্বাস সে ফিরে পেয়েছে তাও হারাবে। চারিদিকে সন্ধ্যা নামা ম্লান আলো। পশ্চিম আকাশের নিরুত্তাপ লালচে সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে কোমলভাবে৷ ঠান্ডা হাওয়ায় পালির গায়ে কা’টা দিয়ে ওঠে। সে চিত্রার হাতটা শক্ত করে ধরল। চিত্রা কিছু বলার আগেই সাম্য আবার বলল,
“আমি নাজমুল মোক্তারের ছেলে। নিবাসপুর থাকি। ঘটকের মাধ্যমে আপনার পরিচয় জানতে পেরেছি।”

চিত্রার কপালের ভাজ গভীরতা পেল। সেদিন সেতারা বিবি এই লোকটার কথাই তো বলছিল। সে শক্ত গলায় বলল,
“সেই সম্বন্ধ তো..”
“জানি। তবুও দেখার কৌতুহল সামলাতে পারিনি। গত দুদিন বিকেল করে আপনাদের বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো বেরই হন না। হতাশ হয়ে ফিরে আসার পথে দেখলাম অন্ধকার হয়ে আসা সন্ধ্যায় একটি মেয়ে ছাদে উঠেছে। এক ঝলকেই বুঝে নিলাম নিঃসন্দেহে সে আপনি।”

চিত্রার অভিব্যক্তিতে বিতৃষ্ণা ভর করল। এই লোক তাকে লুকিয়ে দেখেছে! আবার সেই কথা গর্বের সঙ্গে জাহির করছে। সাম্যকে তার মোটেও ভালো লাগল না।
“ঘটক একটু মুখ খুলে প্রশংসা করতেই লুকিয়ে দেখতে চলে এসেছেন? এবার বিদায় হন নয়তো আমাদের যেতে দিন।”
“আপনি কী এভাবেই কথা বলেন?”
“তো কীরকম আশা করেছিলেন?”
সাম্য হেসে ফেলল। “আপনাকে গ্রামের লাজুক, ভীতু মেয়ে কল্পনা করা মোটেও উচিৎ হয়নি। বোঝা উচিৎ ছিল আমার কল্পনায় ঠাই পাওয়া মেয়েটি মোটেও গড়পড়তা মেয়েদের কাতারে পড়ে না। ইশ! প্রথম সাক্ষাতেই কতগুলো ভুল করে ফেলেছি। শাস্তিস্বরূপ সারাজীবন আপনার রাগী মুখটা দেখতে চাই।”
“আপনি কী জানেন আপনি ভীষণ গায়েপড়া?”
“বিশ্বাস করুন, আমি মোটেও এমন নই। কিন্তু এই স্বভাববিরুদ্ধ কাজটা আমার দ্বারা হয়ে যাচ্ছে।”

কথায় কথা বাড়ার আগেই চিত্রা দ্রুত পায়ে পালির হাত ধরে চলে এল। লোকটার কথার উত্তর দেওয়ার সময় নিজের কন্ঠের তেজে চিত্রা নিজেই ভড়কে গেছে। আবেগী মেয়েটাও গম্ভীরমুখে কথা বলতে শুরু করেছে! কোথায় গেল তার অবুঝ, অগোছালো চঞ্চলতা? কোথায় হারালো সেই বিধ্বংসী, হৃদয়ে উচাটন তোলা অনুভুতি? নিষ্ঠুর মানুষটা সব কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। ছয়টা মাস হতে চলল। চিত্রা এখনো মায়া কা’টাতে পারে না। এ মায়া যে কখনোই কা’টবে না। চিত্রা দক্ষিণা বাতাসে উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয়। বাড়িতে ঢোকার আগে পালিকে বারন করে যেন এই ঘটনা কাউকে না জানায়। বলা যায় না, অচেনা ছেলের সঙ্গে কথা বলায় সকলে তাকেই ভুল বুঝতে পারে। তবে ঘটনা এখানেই থেমে থাকল না।

সপ্তাহখানিক বাদে গ্রামের চেয়ারম্যান বদরুল আলম এসে হাজির হলো খন্দকার বাড়িতে। রবিউল খন্দকারের সঙ্গে সবিনয়ে কুশল বিনিময় করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে বসলেন। বদরুল আলম চেয়ারম্যান হয়েছে রবিউল খন্দকারের ছত্রছায়ায়। রবিউল খন্দকার যদি রাজনীতিতে ভিড়ত নিঃসন্দেহে তার চেয়ারম্যান হওয়া হতো না। এ নদী বিধৌত অঞ্চলে খন্দকারদের বংশ ও সম্পত্তিগত বেশ প্রভাব বিদ্যমান। দশ গাঁয়ের মানুষ বদরুল আলমকে না চিনলেও এক নামে খন্দকারদের চেনে। ফলে বদরুল আলম নিজেও তাকে তোয়াজ করে চলে। নানান বৈষয়িক কথার এক পর্যায়ে বদরুল আলম বললেন,
“হিমাদরে ঢাকায় পাঠাইয়া ভালো কাজ করছেন খন্দকার সাব।”
“না দিয়া উপায় কী? আজকাল পোলাপাইনগুলা নষ্ট হইয়া যাইতাছে। গেরামে তো নে’শার মা’ল ছয়লাব করতাছে।”
“গরীবের ছেলে-মেয়ে সারাদিন কাজ কইরা রাইতের বেলা জু*য়া খেলে, ম*দ- গা*ঞ্জা খায়। এইডা তো নতুন না।”
“নতুন না, তয় সংখ্যাডা বাড়তাছে। সঙ্গদোষের খপ্পরে পোলাপাইনগুলা অল্প বয়সেই নষ্ট হইয়া যাইতাছে। হেদিন দেখলাম আজমলের বড়ো ছেড়া গা *ঞ্জার টেকা জোগাইতে মায়ের শইল্যে হাত তুলছে। সূর্যোদয় থাইকা সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাম কইরা সংসার বাঁচাইতে গিয়া বাপ-মায়েরাও ঠিকমতো খেয়ালও দিতে পারে না। তোমারে এই দিকটায় একটু নজর দিতে হইব আলম।”
বদররুল আলম চুকচুক করে আফসোস করে বললেন,
“দিতে হইব দেখতাছি। আমি ভাবতাছি বড়ো ছেলেরে বিদেশ পাঠাইয়া দিমু। সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা পাইতাছিলাম দেইখা ভাবলাম আপনের লগে আলাপ কইরা যাই একবার। এহন নিশ্চিত পাঠামু। তা চিত্রার ব্যাপারে কী ভাবলেন? বিয়া-শাদী দিবেন নাকি ওরেও ঢাকায় পাঠায় দিবেন?”

রবিউল খন্দকার একটু চুপ থেকে বললেন,
“মাইয়া বড়ো হইলে বাপের হাজারও চিন্তা। আর সবচেয়ে বড়ো চিন্তা ও দায়িত্ব হইলো পাত্রস্থ করা। যোগ্য মানুষ না পাইলে তো তা করতে পারি না। ম্যাট্রিক দিয়া দিছে। এহন ভালো পাইলে হাতছাড়া করমু না।”
“ভালো ছেলে হাতে আছে আছে একজন। বোধকরি চিত্রা মায়ের লইগ্যা তারচেয়ে যোগ্য কেউ হয় না।”
“কার কথা কও?”
“নাজমুল মোক্তার ছেলের বিয়া করাইতে চায়। আমার লগে সাক্ষাৎ হইল কিছুদিন আগে। আমিও বেখেয়ালে ফট কইরা চিত্রার নামটা কইয়া দিছি। হেদিন কিছু কয় নাই। কিন্তু তার ছেলে নাকি আমাগো চিত্রারে দেখছে। আব্বার কাছে পছন্দের কথা জানাইছে। নাজমুল মোক্তার খবর পাঠাইছে, যদি আপনে রাজি থাকেন তার একমাত্র ছেলের বিয়ার পয়গাম পাঠাইতে চায় আপনের দুয়ারে। আরও একবার পুরান দ্বন্দ্বের ফয়সালা করতে ইচ্ছুক তারা।”

রবিউল খন্দকার চুপ করে গেলেন। এ বিষয় নিয়ে সেদিন আর কথাই হলো না। বিয়ের কথাটা উঠেও কেন জানি বারবার চাপা পড়ে যাচ্ছে।
____________

চৈত্রের হুল ফোটানো গরমে পালি সাইকেল চালিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলো। সে এখন পঞ্চম শ্রেণিতে। সোনি তৃতীয় শ্রেণি থেকে পাশ করে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠলেও এবার পড়াশোনার পাঠ সে প্রায় চুকিয়েই দিচ্ছে। অভাবে দিনাতিপাত করা পরিবার থেকেও কোনো আগ্রহ নেই বলে সোনির পড়াশোনা নিয়ে কোনো শাসন বারনও নেই। বলা ভালো সরকারি বিদ্যালয়ে খরচ নেই বলেই সোনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এগিয়েছে। পালির সাইকেল যখন মোড়ের বাঁকে এসেছে তখনই সোনির দেখা পেল সে। সোনি হাশেম মুদির দোকান থেকে বের হয়ে দৌড়ে যাচ্ছে রাস্তা ধরে। তার মুখটা আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে। চোখদুটি বোবা কান্নায় ডুবে আছে। পালি ছুটে তাকে নাগাল পেয়ে পথ রোধ করে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে সোনি, তুই ওই মুদি দোকানে কী করতে গেছিলি?”
সোনি বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
“যামু না। আর কক্ষনো যামু না।”
“এমন করিস কেন? কী হলো তোর?”
সোনি খপ করে ওর হাত ধরে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“পালিরে, হাশেম দোকানী ভালা না। আমারে শনপাপড়ি দেওনের কথা কইয়া ডাইকা নিয়া অনেক যন্ত্রণা দিছে। কইছে এই কথা কাউরে কইলে আমার বদনাম হইবো। সবাই নাকি আমারে আর আমার আব্বা-আম্মারে সমাজছাড়া কইরা দিব।”

ধুলোমাখা তপ্ত পথের ঘেসো প্রান্তরে বসে সোনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এগারো বছরের মেয়েটির দেহে এখনও কৈশোরের ছোঁয়া লাগেনি। নারী হওয়ার রহস্যই এখনো তার অজানা। সে বোঝেনা কা’মুকতা, বি’কৃত মানসিকতার আগ্রা’সী পরিচয়। অথচ সব না জেনেও বুঝে গেছে তার সঙ্গে হাশেম দোকানী ভালো কিছু করেনি। যা করেছে তা খারাপ কাজ। কাউকে বলা যায় না।

হাশেমের দোকানে গেলেই পালির অদ্ভুত এক অস্বস্তি হতো। কিছু কিনতে গেলে লোকটা কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোনোকিছু দিতে গেলে সে হাত স্পর্শ করবেই। পালি এ ধরনের আচরণে অস্বস্তি বোধ করে বলে দোকানটা এড়িয়ে চলত। আজ সোনির কথা শুনে তার সচেতন মস্তিষ্ক হুট করেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। চোখে সামনে ভেসে ওঠে সোলেমানের নোংরা হাসিমাখা মুখ, চরের একটি ভয়ংকর সন্ধ্যা। সঙ্গে সঙ্গে পালি থরথর করে কেঁপে ওঠে।

চলবে…