# পরিবর্তন : দুই পর্বের গল্প #
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের সুন্দর মুখের, দামী সব ক্রিম লোশন দিয়ে সযত্নে পরিচর্যা করছিলো ফাল্গুনী। রোজ রাতে ঘুমাবার আগে এটা ওর প্রধান ও জরুরী কাজ, একদিনও ভুল হয় না…. দারুণ সচেতন সে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে সুতরাং সতেজ, সজীব নিঁখুত ত্বক ও নিটোল কোমল দেহের অধিকারিনী সে।
মুখে ক্রিম ঘসতে ঘসতে শিল্পপতি স্বামী আবীরের দিকে চেয়ে মধুর হেসে বললো ফাল্গুনী — ওগো শুনছো?
ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত আবীর অবশ্য স্ত্রীর ভুবন ভুলানো হাসি দেখতে পেলো না, তার সমস্ত মনোযোগ তখন ল্যাপটপে, জটিল হিসাব নিকাশে ডুবে আছে, সেই অবস্থায় উত্তর দিলো…. হ্যাঁ গো শুনছি, বলো।
স্বামীর ব্যস্ততায় ভ্রুক্ষেপ না করে ফাল্গুনী বলে চললো…. এবার ঈদের বাজেট কিন্তু বাড়বে, সিংগাপুর থেকে বড় আপারা আসছেন সবাই, দেশে ঈদ করতে, আজ তো তিন রোজা হয়ে গেলো আমার শপিং এখনো কিছুই হয়নি, তাছাড়া বড় আপারা যে আসবেন, জানতাম না হঠাৎই ঠিক হয়েছে আসা, আপাদের সবার জন্য সেরা জিনিস কিনতে হবে, ছোট ভাইটা বায়না ধরেছে এবার ঈদী নেবে নামী ব্র্যান্ডের হোন্ডা……
ওর সব কথা কানে যায় না আবীরের — অন্যমনস্ক ভাবে হ্যাঁ… হু করে গেলো।
আজ নতুন নয়, রোজা আসার আগেই ফাল্গুনী নব উদ্যমে গা ঝাড়া দিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে…. অথচ সারা বছরই তার কেনার কোনো বিরাম নেই…. স্বামীর আছে অঢেল তাই মনের সুখে সেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকে। ফাল্গনী যাতে অসন্তষ্ট না হয় সেজন্য বেশ মোটা টাকা ওর কাছে আগেই দিয়ে রাখে আবীর — আর ফাল্গনীর নিজস্ব ব্যাঙ্ক একাউন্ট তো আছেই… সেখানেও প্রায় সারা বছর টাকা জমা পড়তে থাকে এছাড়াও রোজা শুরু হতেই হিসাব করে যাকাতের টাকাও আবীর স্ত্রীর হাতেই দিয়ে দেয়….. ফাল্গনী মোটেও কার্পণ্য করে না, টাকার সিংহভাগ বাপ ভাইয়ের কাছে দিয়ে দেশের বাড়ি চাঁদপুরে পাঠিয়ে দেয়, গরীব আত্মীয় স্বজন আছে, বছরে দু’একবার ফাল্গুনী যায় দেশে — থাকে না, সকালে যেয়ে বিকেলেই ফিরে আসে….. তার দানের কল্যাণে সে যে রাজকীয় আপ্যায়ন পায় দেশের মানুষের কাছে সেটা ফাল্গুনী খুব উপভোগ করে।
বাড়ির কাজের মানুষদের হিসাব আলাদা…. ড্রাইভার, দারোয়ান, মালী… এরা সব সাহেবের কাছে থেকে তাদের প্রাপ্য টাকা পায়, ম্যাডাম — বার্বুচি, বুয়াদের দেয়। মোট কথা ঈদ এলে ফাল্গুনীর রাজ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যায়।
ফাল্গুনীদের বিশাল বাড়ি এলিফ্যান্ট রোডে… চারপাশে বিভিন্ন সব মার্কেট… গাউসিয়া, নিউমার্কেট, ইষ্টার্ন মল্লিকা, হকার্স মার্কেট —- ফাল্গুনীর তো পোয়াবারো, কিছু না কিছু শপিং প্রাণ ভরে করতে থাকে, দিনের থেকে রাতেই কেনাকাটা করা সুবিধা, দিনে ফকিরগুলো ভীষণ বিরক্ত করে, বাসা থেকে বের হলেই ছেঁকে ধরে হাত পেতে দাঁড়ায়…. রাবিশ — রাগে চোখ মুখ কুঁচকে কোনো মতে পাশ কাটিয়ে চলে যায় সে।
মার্কেটের এত কাছে গাড়ি নেওয়া যায় না, ভীড় এবং পার্কিংয়ের সমস্যা, তাই ওকে বাধ্য হয়ে হেঁটেই যেতে হয়…. অবশ্য এসব মার্কেটে ফাল্গুনী কমই আসে…. তার পছন্দের জায়গা হচ্ছে — বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, আড়ং ইত্যাদি , তবে শপিং করা যাদের নেশা, তারা কি আর গাউসিয়ায় একবার ঢু না মেরে পারে?…. এই হলো সুখী ফাল্গুনীর জীবন চিত্র।
আজ ইফতারে কি মেনু হবে, ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বার্বুচিকে বলে দিচ্ছিলো ফাল্গুনী, ছুটা বুয়া ময়না এসে সামনে দাঁড়ালো, বিরক্ত মুখে তাকায় সে ময়নার দিকে, খুব সংকোচের সাথে কাঁচুমাচু মুখে ময়না বলে — ম্যাডাম ( কাজের মানুষের মুখে… আপা, খালা, ভাবী ইত্যাদি শুনতে পছন্দ করে না সে, এদের সবাইকে ঢালাও হুকুম দেওয়া আছে, তাকে ম্যাডাম বলার ) একটা কতা কইতাম
ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফাল্গুনী বলে…. তোমার কাজ শেষ?….. আরো জড়সড় হয়ে যায় ময়না…. না ম্যাডাম, ঘর মুছা অয় নাই,
— হয়নি তো এখানে কি? যাও কাজ শেষ করো,
বিশ হাজার টাকা বেতনের বার্বুচিও ধমকে উঠলো… ম্যাডামের সময় নাই , যাও এখন…
কিন্তু ময়নার তো এখন গেলে চলবে না, মরিয়া হয়ে বলে উঠলো — না, কইছিলাম কি… দ্যাশ থন আমার লগে ঈদ করতে বাপ ভাইরা আইবো, যুদি যাকাতের টাকা একটু বেশী দ্যান…..
এর বেশী আর বলতে পারলো না বেচারী, চটে উঠলো ফাল্গুনী…. ব্যস শুরু হয়ে গেলো চাওয়া? রোজা মাত্র আরম্ভ হলো…. যত্তসব ননসেন্স, আরো তিনজন বুয়া আছে, ওদেরকে দিতে হবে না, তোমাকে একলা দিলেই হবে? যাও এখন…..
লজ্জিত করুণ মুখে মাথা নত করে চলে গেলো ময়না, এটুকু বলতেই সে দুদিন ধরে সাহস সঞ্চয় করেছিলো…. ভয়ে লজ্জায় বলতে পারলো না যে… যাকাতের টাকায় গরীবের হক বেশী, সেই টাকা থেকেই সে কিছু বাড়তি চেয়েছিলো।
হকার্স মার্কেটের এদিকে বাটার দোকানের সামনে আধ বয়সী এক মহিলা ভিখারী বসে থাকে, ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরা, মুখ ও শরীরে জরার ছাপ…. কথা বলে না বিশেষ শুধু লোকজনের পানে বোবা অসহায় দৃষ্টি মেলে হাত পাতে, কেউ দয়া করে, কেউ মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।
ফাল্গুনী যখনই এদিকে আসে, দেখে এই মহিলা উস্কখুস্ক চুলে, নোংরা শরীরে বসে আছে — একদিন দেখলো, শুধু একটা পলিথিন মাটিতে বিছিয়ে তার ওপর খাবার রেখে খাচ্ছে, ঘৃণায় রি রি করে উঠলো ফাল্গুনীর শরীর, মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো গজগজ করতে করতে —- এই সব আপদগুলোর জন্য ফুটপাতে হাঁটা দায়, কোথা থেকে যে আসে সব…..
নিজের দামী শাড়ী জুতা ঐসব অশুচির স্পর্শ বাঁচিয়ে সাবধানে সরে যায়।
মাঝে মাঝে ফকির মিসকিনকে যে কিছু দেয় না, তা নয়, ব্যাগ খুলে দু’ পাঁচ টাকা বের করে অবহেলায় ভিখারীর হাতের ছোঁয়া বাঁচিয়ে ফেলে দেয়। যাকাতের টাকা এইসব মানুষের পাওয়া নসীবে হয় না…. এদের বঞ্চিত করে ফাল্গুনী নিজের পছন্দের মানুষদের বিতরণ করে, আবীর এসবের কোনো খোঁজ রাখেনা, সে স্ত্রীর কাছে টাকা দিয়েই খালাস, স্ত্রী স্বাধীনতায় সে ঘোর বিশ্বাসী।
ইফতারের পর বেশ আয়েশ করে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো ফাল্গুনী…. একমাত্র ছেলে তার ঘরে পড়া নিয়ে ব্যস্ত — আবীর আজ অফিসে ইফতার পার্টি দিয়েছে সুতরাং সে ছিলো না, ফাল্গুনী ছেলেকে নিয়ে একাই মুখরোচক সব ইফতার খেয়েছে… এখন বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে পরিতৃপ্ত মুখে কফি সেবন করছে। খুব সন্তষ্ট ও খুশী সে….. ছোট ভাইকে হোন্ডা কেনার টাকা দিয়েছে আজ, মা বাবা ছোট বোনের জন্য মার্কেটের শ্রেষ্ঠ সব পোশাক কিনেছে, মা ও বোনটাকে এক সেট গয়নাও দিয়েছে, বড় আপাদের জন্য শপিং এখনো কিছু বাকি, করে ফেলবে দুচার দিনের মধ্যেই….. এই সময়ে হঠাৎ বেরসিকের মত তাল ভঙ্গ হলো — ময়নার কথা কেন যে মনে পড়লো….. যাকাতের কিছু বাড়তি টাকা চেয়েছিলো পরিবারের ঈদ আনন্দ কেনার জন্য, দেবে কোথা থেকে সে, যাকে যা দেবার দেওয়া হয়ে গেছে…. আচ্ছা ঠিক আছে, রোজা রমজানের দিন কাউকে অখুশি করা উচিত নয়, হ্যান্ড ব্যাগের চিপা চাপায় কিছু টাকা আলাদা করে রেখে দেয় সে, সেখান থেকে শ’পাচেক দিয়ে দেওয়া যাবে — এর বেশী দেবে না, লাই পেলে মাথায় উঠে যাবে তাহলে।
নাঃ বার্বুচিটা রাঁধে ভালো, আজকে চমৎকার হালিম রেঁধেছিলো — খাসির মাংসের, কিছু দিন আগেও কেজি ছিলো আটশো টাকা, রোজার মধ্যে এক হাজার হয়ে গেছে কেজি…. তাতে হালিম রান্না আটকায়নি, দরকার হলে আস্ত খাসি কিনে ফেলবে — অসুবিধা কি, আলুর চপ, পিয়াজী, বেগুনি —- এগুলো তো ছিলই…. হালিমটা বাড়তি আইটেম।
মনে মনে ভাবলো ফাল্গুনী, কালকে ডিম চপ বানাতে বলবে বার্বুচিকে আর আবীরকে বলবে অফিস ফেরত স্পেশাল সুতি কাবাব আনতে…. যার কেজি হচ্ছে পনেরোশো টাকা, সঙ্গে বাটার নান, উঃ দারুণ জমবে খাওয়াটা —- নিজের আত্মসুখে চোখ বুজে মগ্ম ছিলো ফাল্গুনী….. আচমকা শরীরটা কেমন কাঁপতে লাগলো…. ঝিনঝিন করে উঠলো মাথার ভেতর, কোনো মতে কফির মগ সাইড টেবিলে রাখতে না রাখতে চেতনা হারিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লো…. কাউকে ডাকার সময় পেলো না।
# চলবে #