সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-১৯+২০

0
235

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ১৯
সকালবেলায় সান্যাল বাড়িতে বরাবরই তাড়া থাকে, একই সঙ্গে প্রতাপ বাবু এবং সুকান্ত দুজনেই কোর্টে বেরোন। প্রতিদিনের মতোই আজও যখন সুকান্ত বেরোনোর জন্যে তৈরি হয়ে নিচে এলেন, তখন রান্নাঘরে জলখাবারের পর্ব শুরু হয়ে গেছে। প্রতাপ বাবু খেতে বসেছিলেন, পাশে রতন! রতন কে দেখেই সুকান্তর মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলো, তিনি সোজাসুজি রতনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

কি ব্যাপার? তুমি এখানে?

রতন কিছু জবাব দেবার আগেই সরযূ এগিয়ে এলেন, তাড়াতাড়ি উত্তর দিলেন,

ওই একটু তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে! তা আমি বললুম জলখাবার খেয়ে যেতে, একা থাকে, ভালোমন্দ কিছু তো পেটে পড়েনা!

কেনো! ভালোমন্দ পেটে পড়ে না কেনো? তুমি তো তার জন্যে এবাড়ি থেকেই রান্না করে পাঠাও! প্রতিদিন বামুন দিয়ে আসে!

বিরক্ত গলায় বললেন সুকান্ত, সরযূ একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। তিনি বিপদে পড়লেই প্রতাপ বাবু সব সময় এগিয়ে আসেন স্ত্রী কে বাঁচাতে, এবারও তিনি এগিয়ে এলেন,

আহা! সব সময় নিজের স্বার্থ দেখলে হয় না সুকান্ত, অন্যের দিকটাও একটু ভাবতে হয়! যখন আমরা গ্রামের বাড়িতে যাই, তখন ওকে নিয়ে এসে রাখি, আর অন্য সময় ও একটু এলে কি বিরক্ত হওয়া চলে! এখানে তার মা থাকে, তাকে দেখতেও তো তার ইচ্ছে হয় নাকি!

এতক্ষন ধরে দুপক্ষের কথোপকথন শুনছিল সরযূর ভাই বউ বিমলা, সে অনেকদিন ধরেই এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলো। আজ এই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এর সুযোগে সে তাড়াতাড়ি মুখে আঁচল চাপা দিলো, চোখের জল মুছতে মুছতে প্রতাপ সান্যালের দিকে তাকিয়ে বললো,

জামাই বাবু! নিজেদের বাড়ি ঘর আছে, তবু দিদি হাত ধরে ডেকে নিয়ে এসেছিলো তাই এখানে এসেছিলাম! এতো অপমান সহ্য করে থাকা আর সম্ভবপর নয়! আপনি অনুমতি দিন, আমরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাই!

সরযূ তাড়াতাড়ি স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন, বৌদির হাত ধরে বললেন,

বৌদি! তুমি চলে গেলে আমি বড্ড একা হয়ে যাবো গো! ছেলে, স্বামী সবাই বেরিয়ে যায়, এতবড় বাড়ি হা হা করে! আমি সুকান্তর হয়ে ক্ষমা চাইছি, ওর কথা ধরো না! কি বলতে কি বলে!

বিমলা মাথা নাড়লো, ননদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

তুমি নিজের বাড়িতে স্বামী, ছেলে নিয়ে থাকো, আমার জ্বালা কি বুঝবে! স্বামী নেই, ছেলেটা একা একা বাড়িতে পড়ে থাকে, কখন বামুন গিয়ে দু মুঠো খাবার দিয়ে আসবে সে আশায় তার দিনমান যায়! এ বাড়িতে তার পা দেবার অধিকার নেই! আমরা তো না খেতে পেয়ে তোমার কাছে এসেছি তা নয়, তোমার বাপ ভাই আমাদের জন্যে কম কিছু রেখে যায়নি, তা তুমি জানো! এ বয়সে আমারও তো ছেলে নিয়ে থাকতে একটু সাধ হয়, তাই না! আমাকে আর আটকিয়ে রেখোনা, অনেকদিন হলো, এবার যেতে দাও! যখন মন কেমন করবে, তখন তুমিই না হয় কদিন বাপের বাড়ি ঘুরে যেও! বাপ ভাই না থাকলে কি বাপের বাড়ি আসতে নেই!

সুকান্ত এবার একটু লজ্জিত হলেন, তাঁর কথার জন্যেই মামীমা চলে যেতে চাইছেন বুঝতে পেরে থমকে গেলেন, তাড়াতাড়ি বললেন,

মাইমা! আমি কিন্তু তোমাকে কিছু বলি নি! তুমি কেনো যাবে! তুমি থাকলে আমাদের ভালোই লাগে! আমি শুধুমাত্রই রতন দার কথা বলেছি! সে যা করেছে আমাদের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে তা ভোলা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়! বাবা চান নি বলে আমি তখন থানায় যাই নি ঠিকই, কিন্তু রতন দা কে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না! তার জন্যে আমাদের মেয়ে আজ বাড়ি ছাড়া হয়ে হোস্টেলে দিন কাটাচ্ছে! লোকজন দূর দূর থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসে, এখানের ভালো স্কুল, কলেজে পড়ার চেষ্টা করে, সেখানে তাকে এতো ভালো স্কুল ছাড়িয়ে হোস্টেলে দিয়ে আসতে বাধ্য হলাম যার জন্যে, তাকে অতো সহজে আমি মাফ করতে পারবো না!

বিমলা চোখ মুছলো,

ঠিক বলেছো বাবা, একদম সত্যি কথা বলেছো! এই বাড়িতে তো সত্যিই রতনের ঠাঁই হওয়া উচিত নয়, সে যা করেছে, তাকে আমিও কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না! তবে শুধু রতনের ঘাড়েই দোষ চাপালে বাবা! তোমার নিজের দাদার কথা টা একবারও বললে না! সেই বা কম কিসে! মদের আসর বসানোর মুলে তো সেই! আর তোমরাও কি কোনোদিনও তাকে বাড়ির নিচে আসর বসাতে বারণ করেছিলে? বাড়িতে যাদের অতো বড় মেয়ে থাকে, তাদের বাড়ির তলায় মদের ফোয়ারা ছুটলে তো এসব হবেই বাবা! রতন না হলেও ওরকম আরও কতো রতন জুটে যেত! তোমার মা, বাবা, তুমি, কেউই তো এসব বন্ধের চেষ্টা করো নি কখনো! যেটুকু চেষ্টা ছিলো তা ওই বউয়ের! যাইহোক, অতো কথার মধ্যে আমি যেতে চাইনা বাবা, অনেকদিন হলো এবার নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চাই। এ বয়সে আর ছেলের কাছ ছাড়া হয়ে থাকতে মন চাইছে না!

সুকান্ত চুপ করে গেলেন, মামীমার বলা কথাগুলো যে অনেকাংশেই সত্যি সেটা তিনি মনে মনে জানতেন। এবার প্রতাপ সান্যাল হাত তুললেন,

একটা সাধারণ বিষয় নিয়ে বড্ড বেশি কথা বলছো তোমরা! সুকান্ত! তুমি নিজের কাজে যাও! বৌদি! আপনি এখানেই থাকবেন, একা ছেলে কে ছেড়ে থাকতে হবে না আপনাকে! রতনও এখানেই থাকবে! এটা আমার বাড়ি, আমি যা বলবো তাই হবে! কেউ আপনাকে কোনো অপমান করবে না ভবিষ্যতে! আমি আপনাকে কথা দিলাম!

বিমলা হতাশ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালো, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। রতন এতক্ষন চুপ করে ছিলো, এবার মা কে তার দিকে তাকাতে দেখে সে পরিস্থিতি সামলাতে তাড়াতাড়ি বললো,

ঠিক আছে পিসেমশাই, আমরা কোথাও যাবো না! এখানেই থাকবো! সুকান্ত আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইছি! পারলে আমাকে মাফ করে দিস!

সুকান্ত কোনো কথা বললেন না, আধ খাওয়া খাবারের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ালেন, কড়া চোখে সরযূর দিকে তাকিয়ে পাশে রাখা কালো কোট হাতে তুলে নিয়ে গাড়ির চাবি হাতে বেরিয়ে গেলেন।

তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে আর কেউ এই বিষয়ে কোনো কথা বললো না, রতনের মা অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রান্নাঘর থেকে উঠে ছাদে চলে গেলো। এ বাড়ি থেকে তার যে আর কোনোদিনও চলে যাওয়া সম্ভব হবে না সেটা সে মনে মনেই বুঝতে পারলো। প্রতাপ সান্যাল কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন, তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে সরযূ ওপরে উঠে গেলেন। সরযূ কে দোতলায় উঠে যেতে দেখে রতন ধীরে ধীরে ছাদে উঠে এলো, মায়ের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো,

কেনো যাওয়ার জন্যে জেদ করছো মা! মিছিমিছি তাদের সন্দেহ বাড়িয়ে তুলছো! এখানে থাকা অনেক সুবিধের, সেটা তুমি বুঝছো না! অন্তত তারা কি করতে চায় সে খবর টুকু তো তুমি শুনতে পাবে কান পেতে রাখলে! বাড়ি চলে গেলে, কে এখানে আসছে যাচ্ছে, কি শলা পরামর্শ হচ্ছে সেসবের কিছুই টেরটিও পাবে না! আমি রতিকান্ত কে জানিয়ে রেখেছি, সেরকম হলে সুকান্তর সঙ্গেও কথা বলবো!

বিমলা কাঁদতে লাগল, ছেলের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললো,

বলেছিলুম তোকে! এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াস না! শুনলি না আমার কথা! এখন যে কি করি!

রতন মাথা নাড়লো, আফসোসের গলায় বললো,

পিসি তখন এমন করে বললো! বললো ওর গায়ে বেশ্যার রক্ত আছে, ও বেঁচে থাকলে সান্যাল বাড়ির নাম ডুববে! আশা অনেক চেষ্টা করেও পারেনি, খুব বড়ো কাজ তো নয়, ওই টুকু মেয়ে! তাই রাজি হয়ে গেলাম! ভাবিনি বৌদি এসে যাবে!

তা ভাববে কেনো! তোমার তো তখন অন্য বাই মাথায় চড়ে ছিলো! এসব কাজ করতে গেলে মাতাল হতে নেই! এখন দ্যাখো! শ্যামও গেলো, কূলও গেলো! না কাজ উদ্ধার করতে পারলে, না এখন এ বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি! তোমার আর কি! খাচ্ছদাচ্ছ, ঘুরে বেড়াচ্ছ! আমি লোকের বাড়ি ব্যাগার খেটে মরছি! বউ কে তাড়িয়ে ছেড়েছে! এখন যতো রোয়াব সব আমার ওপর! সারা জীবন নিজের ভিটে থাকতে লোকের বাড়ি পড়ে থাকতে হবে!

মায়ের রাগ দেখে একটু চুপ করে থাকলো রতন, তারপরে নিচু গলায় বললো,

বছর দুয়েক কষ্ট করো মা, প্রতাপ সান্যাল কি সারাজীবন এতো দাপট নিয়ে থাকতে পারবেন! বয়স তো বাড়ছে! ছেলেরা সব দূরে সরে যাচ্ছে! রতি এখন বউয়ের ধামাধরা! সুকান্তর কি বাপের ওপরে রাগ কম ভেবেছো! সেই মেয়ে এখনো তার পিছু ছাড়েনি! তার রাগও সান্যাল বাড়ির ওপরে একটুও কম নেই! আমিও ঘুঁটি সাজাচ্ছি! বউ আমার মাথায় বাড়ি মারলো, তার কোনো শাস্তি তো হলোই না, উল্টে আমি হাসপাতালে পড়ে রইলাম! যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর! পিসি নিজে দরজা খোলা রেখে হরি সভায় গেলো, আর ধরা পড়ার পরে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি কিছু ভুলি নি, তক্কে তক্কে আছি, রতিকান্ত কে তার বাপের কান্ড সব জানিয়েছি!

বিমলা চোখ মুছলেন,

ওকে জানিয়ে কি হবে! বাপের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা আছে তার! বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এলো, তা সে ধরে রাখতে পারলো! বাপ তো তাকে বিদেয় করে ছাড়লো! কে জানে বেঁচে আছে না মেরে দিয়েছে! রতি একটা ভেড়া! কিছু কাজ ওকে দিয়ে হয়নি কখনো! ওই তো পরের বউটা তো বাঁজা! তোর বউ বাঁজা ছিলো, বাড়ি থেকে দূর করে ছেড়েছি! আর ওকে দ্যাখ সেই বউয়ের ভেড়া হয়ে গেলো! কোথায় বাপের বাড়ি গিয়ে ফেলে রেখে আসবি তা না, তাকে নিয়েই ভেন্ন হয়ে গেলো!

রতন বিরক্ত হলো,

আহ! ওসব ওদের নিজেদের ব্যাপার! তোমার আমার কি! ছাড়ো না এসব! রাখার না হলে পিসি নিজেই ফেরত দিয়ে আসতো! রতির কথা শুনতো না! আসলে বিনা মাইনের ঝি পেয়েছিলো তো! তখন তো আর ভাবে নি সে কদিন পরেই ঝি থেকে গিন্নী হয়ে বসবে, তাই রেখে দিয়েছিলো! এখন টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে! আমি একটা অন্য রাস্তা ভেবেছি, একটু সময় লাগবে, আমাকে বছর দেড়েক সময় দাও, তার মধ্যেই প্রতাপ সান্যালের অবস্থা কি করি দ্যাখো! আপাতত মুখ বন্ধ করে নিজের মতো থাকো, ওদের বেশি ঘাঁটাতে যেও না!

সুকান্ত হন্তদন্ত হয়ে কোর্টে ঢুকলেন, সকালের বাকবিতণ্ডায় তাঁর অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাঁকে নিজের জায়গায় বসতে দেখে মক্কেলরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে এগিয়ে এলো, তাদের মধ্যেই একজনকে দেখে সুকান্ত আলাদা করে ডাকলেন, এগিয়ে গিয়ে বললেন,

আপনি যে বাড়িটার ব্যাপারে বলেছিলেন, সেটার খবর কদ্দুর? আমার কিন্তু একটু তাড়া আছে।

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন,

সেতো রেডি আছে স্যার! আপনি কিছু জানান নি, তাই আমিও আর এগোইনি তখন! তাহলে কথা পাকা করে ফেলি!

সুকান্ত সম্মতি দিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁদের কথপোকথন কিছুক্ষনের মধ্যেই নবীনের কানে পৌঁছে গেলো, একটু পরে প্রতাপ সান্যাল নিজের জায়গায় বসার সঙ্গে সঙ্গে সে ঘরের পর্দা তুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো, এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু নিচু গলায় সান্যাল মশাই কে বললো,

ছোড়দা তো বাড়ি কিনছেন শুনলাম!! দরদামও হয়ে গেছে, আজ পাকা কথা হয়ে গেলো!!

প্রতাপ সান্যাল মনে মনে একটু চমকে উঠলেও ছেলের সম্পর্কে নবীন কে তাঁর মনোভাব বুঝতে দিলেন না, গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন,

কিনুক তাতে ক্ষতি কি! ভালোই তো! সম্পত্তি যতো বাড়ে ততোই তো ভালো! কোথায় কিনছে সে খবর টুকু পেলে আমায় জানাতে ভুলে যেওনা যেনো!

নবীন মুচকি হাসলো, সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল ফোন তুলে স্ত্রী কে খবর দিলেন,

তোমার ছোটো ছেলে বাড়ি কিনছে গিন্নী! বাড়ি আসি, এসে সব কথা হবে!

সরযূ চমকে গেলেন, ভীত গলায় বললেন,

এই বয়সে বাড়ি কিনছে! কেনো গো! হ্যাঁ গো! ওই মেয়েটা কে আবার ঘরে এনে তুলবে না তো!

সান্যাল মশাই মুচকি হাসলেন,

সব ব্যাপারে এতো ভয় পাও কেনো! সেসব কিছু নয়! এসব আজকের সকালের রাগের প্রকাশ! ভালোই হলো, সে তো পয়সা কড়ি সব ওই আশ্রমের পেছনেই ঢেলে দেয়, নিজের কিছুই রাখেনা, বাড়ি টুকু অন্তত থাকুক!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২০
সুকান্তর নতুন বাড়ি কেনা হয়ে গিয়েছিলো, নবীনের মাধ্যমে সে খবরও প্রতাপ সান্যালের কানে যথাসময়েই পৌঁছে গেলো, কিন্তু তিনি ছেলে কে একটা কথাও বললেন না। সরযূ ভয় পাচ্ছিলেন পাছে ছেলে নতুন বাড়িতে এই বয়সে বিয়ে করে রমা কে এনে তোলে। কিন্তু প্রতাপ বাবু একটুও চিন্তিত হলেন না, তিনি তাঁর বাস্তব বুদ্ধি তে জানতেন যে এই বয়সে আর তাঁর ছেলে বিয়ে করবে না, তার বাবার কথার অবাধ্য হবার হলে সে অনেক আগেই হতো।

সুকান্তর তাড়ার কারণ ছিলো অন্য, রমার অবসরের সময় ঘনিয়ে আসছিল। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে ওখানে থেকে ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদে যাওয়া সুকান্তর পছন্দ ছিলো না, তিনি দ্রুত ওদিকের সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে কলকাতায় চলে আসার জন্যে ব্যস্ত হচ্ছিলেন। অদ্বিতীয়ার পরীক্ষার মাস খানেক আগেই রমা অবসর নিলেন, তাঁর অবসর নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সুকান্ত রমা সহ তাঁর আশ্রম কে কলকাতার নতুন বাড়িতে নিয়ে এলেন।

প্রতাপ বাবুর কাছে বাড়ি কেনার খবর ছিলো ঠিকই তবে সেটা কোথায় তাঁর জানা ছিলো না, নবীন তাঁকে সে খবর এনে দিতে পারে নি। দেখতে দেখতে অদ্বিতীয়ার হোস্টেল জীবন শেষ হয়ে গেলো, উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ওখানে পড়ার কোনো সুযোগ ছিলো না। তাছাড়া রমা ওখান থেকে চলে আসায় ওখানে তার দায়িত্ব নেওয়ার মতোও কেউ ছিলো না। সুকান্ত তাকে কলকাতার কলেজেই ফিরিয়ে আনবেন বলে মনস্থ করলেন, প্রতাপ সান্যাল নিজেও তাই চাইছিলেন ফলে ছেলের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর কোনো দ্বিমত ছিলো না।

দ্বিমত হলো অন্য জায়গায়, সুকান্ত সরাসরি বাবা কে জানালেন, যে ভাই ঝি কে তিনি তখনই এই বাড়িতে রাখবেন যখন এ বাড়িতে রতন থাকবে না। প্রতাপ বাবু ক্ষুব্ধ হলেন, রাগের গলায় বললেন,

এটা তুমি কি বললে? কেউ একবার ভুল করেছে মানেই সে আজীবন শাস্তি পাবে? সে যথেষ্টই অনুতপ্ত, তোমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে, তার পরেও তুমি জেদ ধরে বসে আছো!

সুকান্ত মাথা নাড়লেন, নিজের জেদে অটল থেকে বললেন,

যা বলার আমি বলে দিয়েছি! হয় ও থাকবে নয় পিয়া! তোমার কথা অনেক মেনেছি, ভেবোনা সেটা আমি তোমাকে ভয় পাই বলে! সেটা শুধু মাত্রই তোমার সম্মান রাখার জন্যে, কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা আর হবে না! তোমাকে বেছে নিতে হবে যে কোনো একটা! ভেবে দ্যাখো কে তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তোমার নাতনি না রতন! ভেবে আমায় জানিও, তারপরে আমি ওর অন্য ব্যবস্থা করবো!

সরযূ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, রাগের গলায় বললেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ! কি ব্যবস্থা তুই করবি সে আমরা জানি! সেই জন্যেই তো বাড়ি কিনেছিস! এবার ওই শয়তান মেয়ে এসে ওখানে ঢুকবে, আর আমার নাতনির মাথাটা আরো বেশি করে খাবে! সে যাতে মাথা একদম খেয়ে নিতে পারে, আর আমাদের নামে বলে বলে তার মনে বিষ ঢোকাতে পারে সেই জন্যেই তো ওখানে এতদিন ধরে রেখে দিয়েছিস! আমি কিছু বুঝিনা ভাবিস নাকি! মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি! তার বাবা, মা ফিরে তাকায় না, আর ওই মেয়ের দরদ উথলে উঠছে এক্কেরে! উনি দায়িত্ব নিয়েছেন পড়াশোনার! কিসের জন্যে এতো লোক দেখানো দরদ, সে আমরা সবাই বুঝি! কি যে করেছে তোকে, ওই মেয়ের জন্যে বিয়েও করলি না! যা এবার গিয়ে ওখানেই থাক!

সুকান্ত আরো রেগে গেলেন, বাবার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের গলায় বললেন,

ওকালতি ছেড়ে গোয়েন্দাগিরি করছো নাকি! তবে তো আর নতুন করে তোমাকে জানানোর কিছু থাকলো না! তুমি আগেই বলেছো, এ বাড়ি তোমার, এখানে কে থাকবে আর কে থাকবে না তা তোমার ইচ্ছের ওপরেই নির্ভর করবে। তাই তুমি রতন দা কে চলে যেতে না বললে সত্যিই আমার কিছুই করার নেই। তবে পিয়া এখানে সেক্ষেত্রে থাকবে কিনা সেটা তোমার ইচ্ছের ওপরে নির্ভর করবে না। মা ঠিকই বলেছে রমা কে আমি ওখানেই এনে রেখেছি, আর হ্যাঁ, আমি একদমই তাই ভেবেছি, পিয়া কে আমি ওখানেই নিয়ে গিয়ে রমার আশ্রমে রাখবো! আর মা কে বলে দিও মায়ের চিন্তার কিছু নেই, আমি সেখানে গিয়ে থাকতে যাবো না!!

সুকান্ত চলে গেলেন, বাবা, মায়ের সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটির আওয়াজ বিমলার কানেও পৌঁছালো, এরপরের আলোচনা কোন দিকে গড়ায় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে বসে থাকলো বিমলা। সারাদিন চুপ করে থাকার পরে রাতে ঘরে গিয়ে আলোচনায় বসলেন কর্তা গিন্নী, প্রতাপ বাবু নাতনি কে আশ্রমে ফেলে রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় স্ত্রী কে বললেন,

আমি একটা কথা ভেবেছি গিন্নী, ওই অনাথ বাচ্চাদের সঙ্গে আমি আমার বংশের মেয়ে কে ফেলে রাখতে পারবো না! তাছাড়া আমার একটা সম্মান আছে, পরিচিতি আছে! লোকে কি বলবে! বনেদী সান্যাল বংশের মেয়ে শেষে অনাথ আশ্রমে পড়ে আছে! আমি আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।

সরযূ সহমত হলেন,

সে যা বলেছো! তোমার যা গুষ্টি! তিল কে তাল করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার! ওই তোমার বড়দি, আর রথীন এর বউটা! ও দুটো তো আরো শয়তান! মুখেভাতে এসে কতো কথা শুনিয়ে গিয়েছিলো!!

প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত হলেন,

তোমার এই এক রোগ! সব ব্যাপারে গুষ্টি টেনে আনা কেনো! বড়দির বয়স হয়েছে, সেই মুখেভাতের পর থেকেই তো হাঁটুর ব্যথায় আর আসতেই পারে নি, যেটুকু ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে, আর রথীন আমার ভাই পো! তাকে তো আর অস্বীকার করতে পারি না! কোর্টে দেখা হলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে!

সরযূ তেড়ে উঠলেন,

ছাড়ো তো! পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে! ও আরো শয়তান! শুধু নিজের ধান্দা! ছেলের নামে সম্পত্তি পাবার চেষ্টা!! তোমার বড়দি কি কম কিছু! ফোন করে কেনো সেকি বুঝি না! ইনিয়ে বিনিয়ে শুধু এক কথা! কি করবি এতো সম্পত্তি, তোর তো বংশধরই নেই! আরে বাবা! নেই তো নেই! তাবলে কি সব গুষ্টির ভোগে যাবে নাকি! কারোর তো কম নেই! তবু অন্যের টা চেয়ে খাবার ফন্দি আঁটে শুধু! সারাজীবন শুনে এলুম সান্যাল বংশে নাকি বউরা পোয়াতি হলেই ছেলে হয়! তা আমার কপাল দেখো! যাও বা একটা হলো তাও মেয়ে! এতো সম্পত্তি সব ওই গুষ্টির ভোগেই যাবে গো!

প্রতাপ বাবু নিজেও একটু দুঃখিত হলেন এবার, এ চিন্তা তাঁর নিজেরও মাঝে মাঝেই হয়, বললেন,

যা হয়নি তাই ভেবে আর আফসোস করো না গিন্নী! এর জন্যে তোমার ছেলেরাই দায়ী! রতি কে তো আমি বরাবরই খরচের খাতায়ই রেখেছিলাম, কিন্তু তোমার ছোটো ছেলেই বা কম কিসে! এতো লেখা পড়া শিখে কি উপকারে লাগলো তোর! শেষে কিনা কোথাকার কোন অজাত কুজাতের মেয়ে কে মনে ধরলো! এরা আবার বেশি শিক্ষিত হয়েছে তো, তাই এসব বনেদীয়ানায় বিশ্বাস রাখে না। কিন্তু যতোই বলো জাতের একটা আলাদাই মাহাত্ম্য আছে! আমার নাতনি কে দেখো! ভাগ্যিস সে মায়ের কিছুই পায় নি! রঙ, রূপ, ব্যবহার সব আমাদের মতো! সান্যাল বাড়ির মেয়ে বলে তাকে আলাদা করে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না! দেখলেই বোঝা যায়, মুখে চোখে তার বনেদী বংশের ছাপ ফুটে ওঠে!

সরযূ সহমত হলেন,

শুধু যদি ছেলে টুকু হতো! তাহলে আমাদের আজ আর কোনো চিন্তা থাকতো না! ভগবানের কি বিচার, কে জানে! তা হ্যাঁগো! তুমি কি ভেবেছিলে বলছিলে? সেটাই তো আর শোনা হলো না।

সান্যাল মশাই গিন্নীর হাত চেপে ধরলেন,

ওই মেয়ে কে আশ্রমে রাখতে যেমন পারবো না গিন্নী তেমনই রতন কে এ বাড়ি থেকে যেতে দিতেও পারবো না, সে একবার বাড়ির বাইরে গেলেই বিপদ! যতদিন তারা এখানে থাকবে ততদিনই মুখ বন্ধ রাখবে। আশার খোঁজ এখনো পাই নি, চেষ্টা চালাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এতো বড়ো শহরে তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তাহলে উপায় একটাই! তুমি রাগ কোরো না, এবার ওই বাড়ির বিলি ব্যবস্থা করে বৌমা কে এখানে নিয়ে আসতে হবে। সে এখানে থাকলে সুকান্তর আপত্তি থাকবে না বলেই আমার ধারণা!

সরযূ ক্ষুব্ধ হলেন,

আবার তুমি তাকে ফেরত আনতে চাইছো! নতুন করে আবার তার মানে অশান্তি! এবার আবার মা, মেয়ে একসঙ্গে! তুমি কি আমার কথাগুলো একটুও ভাববে না!

প্রতাপ বাবু মাথা নাড়লেন, শান্ত গলায় বললেন,

ভেবেই বলছি সরযূ! তোমারও বয়স বাড়ছে, এবার তোমারও একটু বিশ্রাম দরকার। ও বাড়ির বন্দোবস্ত করতে আমি নবীন কে বলে দিচ্ছি। তাছাড়া তোমাকে তো আশার খোঁজ করতে বলেছিলাম, সেও তুমি কি করতে পারলে! অন্তত তার মুখ টুকু বন্ধ করতে পারলেও তো কাজের কাজ কিছুটা হতো!

সরযূ মাথা নাড়লেন, চিন্তার গলায় বললেন,

খোঁজ কম করি নি গো! সে যেনো উবে গেছে একদম! পাড়ায় কারো বাড়িতেই আসে না! ব্যবসা কি সে বন্ধ করলো নাকি কে জানে!

বন্ধ করলেও তার পায়ের ওপরে পা তুলে বাকি জীবনটা চলে যাবে সরযূ, এ বাড়ি থেকে সে কম কিছু পায় নি! এ বরং এক দিক দিয়ে ভালো হলো, সে যদি বাড়িতেই থেকে যায় তাহলে সে বেঁচে গেলো, এগিয়ে এসে মুখ না খুললে তো আমরা এগিয়ে তার ক্ষতি করতে যাবো না! ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ, প্রতাপ সান্যাল করে না!

স্বামীর কথায় সরযূ সহমত হলেন, আপাতত বাকি দিক দিয়ে লাভ ক্ষতির হিসেব করতে গিয়ে লাভের পাল্লা যে সরলা কে ফিরিয়ে নিয়ে আসাতেই ভারী, এটুকু বুঝে আর খুব বেশি আপত্তি জানালেন না। যদিও মনের মধ্যে তাঁর একটা অস্বস্তি রয়েই গেল, তাঁর স্বাধীনতা যে বউয়ের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুন্ন হবে সেটা বুঝে মনে মনে তিনি একটু ভীত হয়ে রইলেন।

নবীনের কাছে পাঠানো চিঠি তে সরলার কাছে খবর পৌঁছে গেলো, পত্রপাঠ সাত দিনের মধ্যে ছেলে বউ কে কলকাতা ফিরে আসার জন্যে বলে দিলেন সান্যাল মশাই। বাড়ি শ্বশুরমশাই এর তাই সরলার এ ব্যাপারে কিছু করণীয় ছিলো না। নিজের সুন্দর করে সাজানো গোছানো সংসার কে তুলে নিয়ে ওই সান্যাল বাড়ির নোংরা পরিবেশে ফিরে আসতে তার মন একেবারেই সায় দিচ্ছিলো না। তার ক্ষোভ অনেকটাই গিয়ে রতিকান্তের ওপরেই পড়লো, যদিও সারাজীবন বাপের পয়সায় ফুর্তি করা রতিকান্তের কাছে এ আদেশ অমান্য করার মতো সাহস ছিলো না।

সরলা এবং রতিকান্ত কলকাতায় ফিরে এলো, বাড়ি ফিরেই রতন কে দেখে সরলার মুখ গম্ভীর হলো, সে রতিকান্ত কে রতনের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলতে বললো। রতিকান্ত চিরকালই এসব ব্যাপারে উদাসীন, মেয়ের ক্ষতি হওয়া না হওয়ায় তার কিছু যায় আসে না কোনো কালেই, সে এ প্রস্তাব সরাসরি উড়িয়ে দিলো,

পাগল হয়েছো! আমি কথা বলতে যাবো কেনো! তোমাকে সব ব্যাপারেই কি মাথা ঘামাতে হবে! নিজের মতো থাকো! পিয়া এখন বড়ো মেয়ে, ইচ্ছে থাকলেও রতন দা কিছু করতে পারবে না। আর সে নিজেই ভয়ে আছে এখন, সে ওসব কিছু করবেও না।

সরলা বিরক্ত হলো,

সারা জীবন গা বাঁচানো স্বভাব, তাই না? নিজের স্বার্থের বাইরে একটুও ভাবো না কখনো! দোষ তোমার নয়, দোষ আসলে তোমার রক্তের! বাবার সব বদ গুণগুলো পেয়েছো! ছোড়দা কে দেখো! রাক্ষস কূলে প্রহ্লাদ! আর রতন দা ভয়ে আছে বলেই তো আরো বিপদ! তোমার বাপ মা যা করতে বলবে, নিজে বাঁচতে সে তাই করবে! তাকে এখান থেকে বার করতেই হবে যে করেই হোক! তুমি ঘরে বসে থাকো, আমি ছোড়দা র সঙ্গে কথা বলবো!

রতিকান্ত মুখ বিকৃত করলো,

মরতে অতো শখ তো মর! পরে বোলো না, আমি তোমাকে সাবধান করি নি! বিপদে পড়লে এই শর্মার কাছে এসো না যেনো, আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না!

সরলা ম্লান হাসলো,

সে আমি জানি! আলাদা করে মনে না করালেও চলবে! কবে আর কারো বিপদে এগিয়ে এসেছো তুমি! পিয়ার মায়ের সময়ও তো আসো নি! মা থাকলে কি আজ মেয়েটাকে এমন অবস্থায় পড়তে দিতো! তোমার ভরসায় আমি থাকবো না, এজন্য ছোড়দাই যথেষ্ট!

বেশি মা হয়ে উঠতে যেও না, সৎ মা, সৎ মায়ের মতো থাকো। আপনি বাঁচলে বাপের নাম! তোমার ছোড়দা কিন্তু মরবে না! মরবে তুমি! এটুকু মাথায় রেখো!

বিদ্রুপের গলায় বললো রতিকান্ত, সরলা উঠে পড়লো, প্রবল স্বার্থপর রতিকান্ত যে তাকে কোনো সাহায্য করবে না এটা বুঝেই এবার সে সুকান্তর সঙ্গে কথা বলতে উদ্যোগী হলো। সুকান্ত সন্ধ্যে বেলা কোর্ট থেকে ফিরে সরলা কে দেখে অবাক হলেন, তারা যে এখানে চলে আসছে সে খবর তাঁর জানা ছিলো না।

আরে! বৌদি! কখন এলেন? কদিনের জন্য?

সরলা ম্লান হাসলো,

একেবারেই এলাম ছোড়দা! বাবা ওবাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন!

তাই নাকি! হটাৎ এরকম সিদ্ধান্ত? শুনিনি তো কিছু!

একটু অবাক গলায় বললেন সুকান্ত, সরলা কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সরযূ সেখানে উপস্থিত হলেন, একটু বিদ্রুপের গলায় বললেন,

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে এতে আবার শোনার কি আছে! আর তোমার শোনার সময়টা কোথায় শুনি! ওই আশ্রমের কাজ করে ফুরসৎ পেলে তবে তো বাপ, মায়ের সঙ্গে কথা বলবে! আজই তো এলো, রাতে খেতে বসে ঠিকই শুনতে পেতে!

সুকান্ত সরযূর দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলেন, সরলা মনে মনে আফসোস করতে লাগলো, শাশুড়ির সামনে রতন সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভবপর নয় বুঝেই সেও নিজের ঘরে ফিরে গেলো।

অনেকদিন পরে আজ রাতে প্রতাপ বাবু দুই ছেলে কে পাশে নিয়ে খেতে বসেছিলেন, খানিকটা বিতর্ক এড়াতেই সরযূ রতন কে ওখানে খেতে বসান নি। মনে মনে একটু হলেও তিনি সুকান্ত কে ভয় করতেন, তার সঙ্গে আজ সরলাও ছিলো। কিন্তু রতিকান্ত খেতে বসেই জিজ্ঞেস করলো,

রতন দা কোথায়?

সরযূ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সুকান্ত বলে উঠলেন,

বিদায় হয়েছে নাকি! সে কি নিজেই গেলো, নাকি বাবা বিদায় করলো?

প্রতাপ বাবু বিরক্ত হলেন, গম্ভীর গলায় বললেন,

কেনো? সে বিদায় হবে কেনো? সব ব্যাপারেই কি তোমাকে বিতর্ক তৈরি করতে হবে! আর সমস্যার তো সমাধান হয়েই গেছে, তুমি রতন থাকলে পিয়া কে একা এ বাড়িতে রাখতে চাও না বলেই তো রতি আর বৌমা কে এখানে নিয়ে এলাম! তারপরেও তার এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবার প্রশ্ন উঠছে কেনো?

সুকান্ত বিদ্রুপের হাসি হাসলেন,

তাই নাকি! তাই ভাবছি হটাৎ করে তুমি ওই বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে কেনো! আমারই বোঝা উচিত ছিলো যে প্রতাপ সান্যাল কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করেন না। কিন্তু প্রশ্ন একটাই! বাড়ি বিক্রি করে দাদা, বৌদি কে নিয়ে চলে এলে পিয়া কে দেখে রাখার জন্যে, কিন্তু মা এতে রাজি হলো কেনো! মা তো বৌদি এখানে এসে থাকুক, কোনো দিনও চায় না! মা পিয়া কেও এতো কিছু ভালোবাসে না, যে সে এখানে থাকবে বলে মা বৌদির আসার কথায় রাজি হয়ে যাবে!

প্রতাপ বাবু কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই সরযূ মুখ খুললেন, রাগের গলায় বললেন,

কারণ, তুমি আমার বাপ মরা ভাই পোটা কে এখান থেকে তাড়াতে চাইছো! তাই তোমার কথা রাখার জন্যে আমাকে তোমার বাবার সব কথা মেনে নিতে হচ্ছে! বৌমা আর রতি তাদের মেয়ে কে পাহারা দিয়ে রাখবে! যাতে আমার ভাই পো তার আর কোনো ক্ষতি করতে না পারে! রতনের তো আর কোনো কাজ নেই, সে নাকি তোমার আদরের ভাই ঝির ক্ষতি করে দেবে!

সুকান্ত মাথা নাড়লেন, বাবার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন,

তবে এতে তোমার উদ্দেশ্য খুব বেশি সিদ্ধ হবে বলে মনে হয় না বাবা! মিছিমিছি তুমি বাড়ি বিক্রির কথা ভাবলে, আর বৌদিদের এখানে টেনে নিয়ে এলে! দাদা যদি তার মেয়েকে দেখে রাখতে পারতো তবে আজ আমাকে আর এতো সব কথা বলতে হতো না! আর বৌদি তো আগের বারও ছিলো, আটকাতে তো পারে নি। নেহাৎ দেখে ফেলেছিলো তাই! সব বার যে ভাগ্য সহায় হবে তা তো না হতেও পারে! আমি শেষ বারের মতো বলে দিলাম, হয় রতন দা থাকবে নয় পিয়া! এই বাড়িতে কাকে তোমার বেশি প্রয়োজন সেটা তুমি ঠিক করো!

প্রতাপ বাবু চিন্তায় পড়লেন, তাঁর ভাবনা চিন্তায় যে কিছুটা গন্ডগোল হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারলেন, তাঁর ধারণা ছিলো সরলা চলে এলে সুকান্ত আর আপত্তি করবে না। এখন তাকে নিজের মতে অটল থাকতে দেখে তিনি মনে মনে প্রমাদ গুনলেন, বৌমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

বৌমা! তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস আছে! তুমি যেভাবে জমি, বাড়ি উদ্ধার করেছো, সেসব আমার ছেলের দ্বারা কখনোই যে হতো না, সেটা স্বীকার করতে আমার একটুও লজ্জা নেই! তুমি তোমার মেয়ের দায়িত্ব নাও, ওকে রতনের কুদৃষ্টি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিলাম। যদিও ও ওই ভুল আর কখনো করবে না আমি জানি, তবু সুকান্ত কে নিশ্চিন্ত করার জন্যেই আমি আলাদা করে তোমার ওপরে দায়িত্ব দিতে চাই!

সরলা পরিবেশন করছিলো, ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে রেখে, হাত ধুয়ে, মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে শ্বশুরের সামনে এসে মৃদু গলায় বললো,

বাবা! আমি আপনার আদেশ কখনো অমান্য করি নি! আপনি যা যা দায়িত্ব দিয়েছেন আজ পর্যন্ত, সব কিছু ঠিক ভাবে পালন করার চেষ্টা করেছি! আপনি এক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতায় ফিরতে বলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছি! কিন্তু আপনি রাগ করবেন না বাবা, সতীনের মেয়ের দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না! অতো বড় মেয়ে, মানুষের মানসিকতা কে কি বলতে পারে! যদি সত্যিই রতন দা আবার কিছু করে কোনোদিনও, তাহলে তো সব দোষ আমার ঘাড়েই এসে পড়বে! আপনি, মা, ছোড়দা কেউ কি আমাকে ছাড়বেন বলুন? আমি ওসব কিছুতে জড়াতে চাই না!

ব্যাস! তাহলে তো আর কোনো কথাই থাকলো না! এবার দ্যাখো, তুমি কি করবে! নাতনি না রতন! কাকে তোমার চাই! যা ঠিক করবে দিন দুয়েকের মধ্যে আমাকে জানিয়ে দিও, পিয়া কে সামনের সপ্তাহে আমি আনতে যাবো, যদি তোমার উত্তর রতন দাই হয়, তাহলে আমি সোজা ওকে রমার কাছেই তুলবো!

বলতে বলতে এঁটো থালা সরিয়ে রেখে হাত ধুতে উঠে পড়লেন সুকান্ত, প্রতাপ সান্যাল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, ছেলের বউ যে দায়িত্ব নিতে সরাসরি অস্বীকার করবে এটা তাঁর ধারণাতেই ছিলো না, কিন্তু সরযূ খুশি হলেন, বউ যে তার মেয়েকে একটুও পছন্দ করে না এটা বুঝেই তিনি শান্তি পেলেন।
ক্রমশ