#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |২১|
সাদিয়া মেহরুজ
সীতাকুণ্ডে ভোর ছাপিয়ে সূর্যালোকের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছে কেবল। বাতাবরণে মৃদুমন্দ হাওয়ার তোড়। সমীরে পুষ্পের সুঘ্রাণ, দূর আকাশে নাম না জানা পাখিদের অবিরত উড়াউড়ি।ব্যাস্ত হয়ে উঠছে নভোমণ্ডল। শরৎকালের রাজত্ব শুরু হয়েছে। অম্বর জুড়ে শুভ্র মেঘেদের ছোটাছুটি। কাশফুলের বাগানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে মেহতিশা। একদৃষ্টে তাকিয়ে সে ঝর্ণার পানে। পাহাড়ি ঝর্ণা। ঝমঝম শব্দে মুখোরিত আশপাশ। মেহতিশার মনে হলো সে গান শুনছে, ঝর্ণার গান। যে গানের স্রষ্টা ঝর্ণা নিজেই। সুর দাতা ঝর্ণার পানি। দুই আঁখি মুদে নিরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন মেহতিশা আবিস্কার করল, তার পিছন কেও দাঁড়িয়ে। পা টিপে টিপে এদিকেই আসছে কেও।
-” আপনি এখানে? ” মাথা পিছন দিকে বাঁকিয়ে চেঁচাল মেহতিশা উচ্চস্বরে!
নিজের দেহ হতে লতাপাতা ছাড়াচ্ছিল সারতাজ। চিৎকার শুনে মুখে কুলুপ এঁটে রইল। প্রতি উত্তর করল না। মেহতিশার চেঁচানোর শব্দে ছুটে এসেছে আয়েশা। সারতাজকে দেখে তার আঁখি জুড়ে দেখা দিল বিষ্ময়!
-” চারটে মাস কোথায় গায়েভ হয়েছিলেন? আপনি বাসা ছেড়েছেন বলেননি তো। ” সারতাজ শীতল গলায় শুধাল।
মেহতিশার হতবাকের রেশ কাটেনি তখনো। তার সম্মুখে স্বয়ং সারতাজ দাঁড়িয়ে এই ব্যাপারটা তার এখনও বিশ্বাস হয়নি। ও দু’কদম এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,
-” আপনি এখানে কেন? কিভাবে এলেন বলুন তো? আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন নাকি কোনো কাজে? ”
সারতাজ মেহতিশার পেছন আয়েশাকে দেখল। পা ফেলে সামনে এগোল। খানিকটা চেঁচাল ও,
-” আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই মেহতিশা। প্লিজ কিছুক্ষণের জন্য আপনার মূল্যবান সময় আমাকে দেবেন? ”
সারতাজের চেঁচিয়ে বলার কারণটা আয়েশা বোধহয় বুঝতে পারল। জায়াগাটা ছেড়ে সে পুনরায় নিজের স্থানে ফিরে গেল। আয়েশার প্রস্থান মাত্র সারতাজ চটপট বলল,
-” আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন মেহতিশা তারপর সব বলছি। ”
মেহতিশার এ মূর্হতে ত্যাড়া হতে ইচ্ছে করল! তবে সে নিজেকে দমন করে নিয়ে বলে উঠলো,
-” চাকরি চলে গিয়েছিল আমার। ওখানে থেকে লাভ কি? বাসা ভাড়া দেয়ার মতো পয়সা আমার ছিল না। তাই বাসা ছেড়ে দিয়ে এখানে এসেছি। এই জায়গায় আমার বাবার ছোট্ট একটা ঘর ছিল যেটা আমার বাবা আমার আর মেহজার নামে করে গিয়েছিল। ঐটা আমি জানতাম না। ফুপি বলল! তখন এখানে এসে পড়ি মেহজাকে সঙ্গে করে। ”
-” এখানে এসে চলছেন কি করে? ঢাকায় অন্য কোথাও কাজ দেখলেই তো হতো। ” দ্বিতীয় প্রশ্ন সারতাজের।
মেহতিশা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসিঁ দিল। বলল,
-” আপনার কি মনে হয়? আমি চেষ্টা করিনি বুঝি? করেছিলাম! কিন্তু তখন অবস্থা এতোটা বাজে ছিল যে আমার মতো এতো নিম্ন শ্রেণির চাকরি পাওয়াটা দুষ্কর ছিল। চাকরি পাইনি। এখানে আপাতত মাঠে সবজি লাগিয়ে বিক্রি করি। এতে দিন ভালো চলে যায়। ”
-” আমার ফোন কেন রিসিভ করেননি মেহতিশা? ”
-” ফোন থাকলে তো রিসিভ করব। বিক্রি করে দিয়েছি ওটা। ”
লম্বা কয়েক শ্বাস ফেলল সারতাজ। আশপাশ পরখ করে এগিয়ে এলো মেহতিশার সন্নিকটে। তারপর কেমন কাতর গলায় শুধাল,
-” এতোকিছু হয়ে গেল আর আপনি আমাকে একটুও জানালেন না? ”
ব্যাথিত সারতাজকে আরেকটু পীড়া দিতে মেহতিশার অধর জোড়া দিয়ে বের হলো আরো কিছু নিষ্ঠুর বার্তা,
-” আপনাকে কেন বলতে যাব আমি? কি হোন আপনি আমার? কিছুই না! তাহলে কেন বলতে যাব আশ্চর্য! লাইফটা আমার। লাইফে আসা সব স্ট্রাগল ফেস করা আমার দায়িত্ব। আমি আমার লাইফে কারো হস্তক্ষেপ নিতে পারবোনা। ”
দিনের নতুন আলোয় অসহায়, ব্যাথিত সারতাজ চেয়ে চেয়ে দেখল এক নি ষ্ঠু র রমনীকে। মেয়েটার কি মনে বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই? একটুও ক ষ্ট হয়না মেয়েটার সারতাজের জন্য? মেহতিশা তো অবুঝ নয়! তবুও কেন তৃষ্ণার্থ সারতাজের চোখের ভাষা মেয়েটা পড়তে পারেনা? নাকি বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে থাকে?
দূরে সরল সারতাজ। কপালে লেপ্টে থাকা ঘর্মাক্ত চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে অন্যত্রে তাকাল। সারতাজের প্রতিটি পদক্ষেপ চোখ দিয়ে শুষে নিচ্ছে মেহতিশা। তার হৃদয় অস্থিতিশীল! ইচ্ছে করছে তার সম্মুখে দাঁড়ানো রোগা পাতলা ছেলেটাকে ঝাপটে ধরতে, নিজের সকল ক্লান্তির ইতি টানতে। তবে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলালো ও। এসব চিন্তা করাও পাপ, অন্যায়!
-” নিলি, মেহজা ওর ভালো ভালো আছে? ”
মেহতিশা হুঁশে এলো। সারতাজ তখন উত্তরের আশায় তার পানে তাকিয়ে। ঘন ঘন মাথা নাড়ল মেহতিশা। বলে উঠলো,
-” হু ভালো আছে। দেখা করবেন ওদের সাথে? ”
-“অবশ্যই। ”
চার মাস হলো মেহতিশার সীতাকুণ্ডে আসার। এই চার মাস ধরে গাধার খাটুনি খাটতে হচ্ছে তাকে। ঢাকায় চাকরি না হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে এসে ছোট খাটো কিছু করবে। অতঃপর তার আর আয়েশার নেওয়া সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় সবজির বাগান করা পর্যন্ত। চার মাসে মোটামুটি ভালো আয় হয়েছে ওদের। মেহজা, সাদিক দু’জনকে এখানকার এক স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। সবজি বিক্রির টাকা থেকে তারা কিছু হাস ও মুরগী কিনে তা দেখাশোনা শুরু করেছে। মুরগী গুলো ডিম দেয়া শুরু করার পর তাদের আয়ের মাত্রা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। সবকিছুই পরিপাটি। তবে এর মাঝে কিয়ৎ অবিন্যস্ত ছিলো মেহতিশা। খেয়ালে কিংবা বেখেয়ালে তার অন্তঃকরণে আচানক হাজির হতো সারতাজ। অক্ষিপটে ভেসে উঠত ছেলেটার মুখশ্রী। ভুলে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করত ও। তবে যাকে মস্তিষ্কে খোদাই করে রাখা তাকে ভোলা আদৌও কি সম্ভব?
_
-” বাজার শেষ হয়ে গেছে। ” প্রান্তিকা কোমল কন্ঠে বলে উঠলো।
গায়ে কালো পোশাকটা জড়াতে জড়াতে আরশিতে এক ঝলক প্রান্তিকাতে নজর বুলায় শাকিব।মেয়েটার মাঝে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। চোখের নিচে গাঢ় কালি। ঠোঁট রুক্ষ। অর্থবহুল আঁখিজোড়া কেমন যেন নিষ্প্রাণ, অনুভূতিহীন। প্রান্তিকাকে অস্বাভাবিক দেখেও শাকিব পাল্টা কোনো প্রশ্ন করল না। কেবল ছোট্ট করে গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে শুধাল,
-” নিয়ে আসব। ”
প্রান্তিকাকে হতাশ করে শাকিব চলে গেল। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে শাকিবের প্রস্থান নিবিড় নয়নে পর্যবেক্ষণ করল প্রান্তিকা। শাকিব বদলে গেছে! অনেকটা। আগের মতো প্রান্তিকার সাথে দু দন্ড সময় নিয়ে আর কথা বলেনা। প্রান্তিকার খোঁজখবর নেয়না। একই ছাঁদের নিচে থেকে তাদের মনের মধ্যকার দূরত্ব যোজন – যোজন। শাকিবের পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে শায়লার মৃত্যুর পর হতে। ছেলেটা পুরোদমে যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
বিছানায় বসল প্রান্তিকা। ডান হাত পেটের ওপর আলত করে রেখে শুধাল,
-” তোর বাবা তোর কথা জানলে কি আবার আগের মতো হয়ে যাবে বাবু? ”
_
সারতাজের কোল দখল করে বসে নিলি। মেহজা ঠিক তার পাশে কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। সারতাজ মেহজার প্রত্যেকটা মন দিয়ে শুনছে, ফাঁকে ফাঁকে উত্তর দিচ্ছে তো নিলির গায়ে আদুরে ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেহতিশা অদূরে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখছিল। আয়েশা পাশে এসে দাঁড়াল তার। বলল,
-” তোমার উচিত নিজের অনুভূতি ব্যাক্ত করা তিশা। নয়ত পরে দেখা যেতে পারে আর সুযোগই পেলে না। ”
আয়েশা দাঁড়াল না। চট করে চলে গেল। মেহতিশা হতবিহ্বল! এই মেয়েটাও তার অনুভূতি টের পেয়ে গেল? কি আশ্চর্য! বিষয়টা কতো করে চাপা দিতে চাচ্ছিল অথচ হলোটা কি?
মেহতিশাকে দেখে সারতাজ ছটফট করে ছুটে এসেছে। ছটফটে সারতাজকে দর্শন মাত্র কপালে ভাজ পড়ল মেহতিশার। বলে উঠলো,
-” কি সমস্যা? ”
সারতাজ তৎক্ষনাৎ জবাব দিল, ” একটু কথা বলার ছিল। বাহিরে যাই চলুন? ”
-” কেন? ঘরে বললে কি সমস্যা? ”
-” সমস্যা আছে বলেই বলছি। বাহিরে চলুন। ”
মেহতিশার হাত ধরতে নিয়েও গুটিয়ে নিলো নিজের হাত সারতাজ। তাড়া দিলো ওকে। নির্জন স্থানে এসে থামতেই মুখাবয়ব পরিবর্তন হলো সারতাজের, কিয়ৎ পূর্বের চঞ্চলতার বিলীন হয়ে মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে তার অদ্ভুত কাঠিন্যতা। গলার স্বর খাদে নামিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
-” হেয়ালি পছন্দ নয়। সোজাসাপ্টাই বলি! আমি আপনাকে পছন্দ করি মেহতিশা। আমি জানি আপনি এটা জানতেন। কেনো রেসপন্স করেননি? তখন করেননি ইট’স ওকে। বাট নাউ আপনাকে আমার হতে হবে মেহতিশা। সম্পূর্ণরূপে আমার। উইল ইউ এক্সেপ্ট মি? আপনি কি আমার শেহজাদি হবেন মেহতিশা? ”
চলবে~