অচিত্তাকর্ষক পর্ব-১০

0
257

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১০|

স্মৃতি আঁতকে উঠল যেন। সে লাফিয়ে উঠে বসল। মস্তিষ্কের ভেতর জবাব খুঁজতে লাগল। কিন্তু, শূণ্য মস্তিষ্ক। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঘুরে জুভানের দিকে তাকাল। জুভান তাকে পুনরায় প্রশ্ন করল,

‘কী ব্যাপার, স্মৃতি? কিছু বলছো না কেন?’

স্মৃতি ঢোক গিলল। মাথার ভেতর কথা সাজাতে লাগল, কী বলবে। কিন্তু গুছিয়ে কিছু বলে উঠতে পারছে না। কিছু সময় পর স্মৃতি মৃদু সুরে বলল,

‘আ-আসলে আমি একটা চাবি পেয়েছিলাম। সেটা কিসের চাবি জানার জন্যই আমি সব লকগুলো চেক করছিলাম কিন্ত, একটাও খুলছিল না। অবশেষে আপনার লকারে লাগিয়ে দেখি সেটা খুলছে। কিন্তু পরে আর পরে খুলিনি, চাবি টা আপনার ব্যাগে রেখে দিয়েছি।’

স্মৃতি মন বলছে জুভান তার কথা বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস না করারই কথা। এই সাংঘাতিক মানুষটা কে যা তা বলে বোঝানো কোনো চারটে খানি কথা নয়, অনেক বিশাল ব্যাপার। কিন্তু স্মৃতির ভাবনা কে উল্টে দিয়ে জুভান তাকে কাছে টেনে নিল। ব্যাপার টা স্মৃতির ঠিক হজম হলো না। সে অতি আশ্চর্য। জুভান তার কপালের উপর ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘বাবার কথায় কষ্ট পেয়েছো?’

স্মৃতি জবাব দিল না। জুভান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘তোমার এই ব্যবহার টা তখন আমারও মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে কেন বললে, বলতো? আমাদের কি এত খারাপ মনে হয় তোমার কাছে?’

মনে মনে স্মৃতি বলে, ‘হ্যাঁ, হয়তো। মাঝে মাঝে খুব খারাপ মনে হয়।’

মনের কথাটা মনেই চেপে রাখল সে। মুখে বলল,

‘না, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। মা আমাকে লোভী বলায়, আমার খুব কষ্ট লেগেছিল। তাই হয়তো বলে ফেলেছি। সরি।’

জুভান আলতো হেসে বলল,

‘থাক হয়েছে। এখন এসব বাদ দিয়ে অন্য কথা বলো।’

স্মৃতি মাথা উঠিয়ে প্রশ্ন করল,

‘অন্য কী কথা?’

‘আমাদের বেবি নেওয়ার কথা।’

কথাটা বলে জুভান ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। স্মৃতির মুখ কালো হয়ে গেল। সে না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। স্মৃতির নিরবতা দেখে জুভান তার কাছে এগিয়ে গেল। তার গ্রীবার সন্নিকটের এলোমেলো স্পর্শকাতর লতার ন্যায় কুন্তলগুলো নিজ হস্তে সরিয়ে দিল। সে আরো কিছুটা অগ্রসর হলো। তার উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে স্মৃতি খানিক কেঁপে উঠল। জুভান আরো কিছুটা অগ্রসর হতে নিলেই স্মৃতি এবার সরে গেল। জুভান এতে ভ্রু কুঁচকায়। স্মৃতি কে রূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘এখন আবার কী সমস্যা, ডাক্তারের সাথে তো কথা হয়েছে আমাদের।’

স্মৃতি নিস্তব্ধ। তার এই নিস্তব্ধতা জুভানকে আরো বেশি বিষিয়ে তুলছে। সে বুঝতে পারছে না, মেয়েটা আসলে কী চাইছে।

জুভান বিরক্ত হয়ে তাকে সুধাল,

‘তোমার সমস্যা টা কোথায় আমাকে একটু খুলে বলবে, প্লিজ। এমন কেন করছো তুমি? আসলে কী চাও? তুমি চাও না, আমাদের একটা বেবি হোক? বলেছিলে, আগে ডক্টর দেখাবে; সেটাও হলো। এখন তাহলে প্রবলেম কোথায়? চুপ করে থাকলে কী করে বুঝবো আমি, বলতো?’

স্মৃতি নিজেকে শক্ত করল। সোজা দৃষ্টি জুভানের উপর নিক্ষেপ করে বলল,

‘আমি এখন বাচ্চা নিতে চাই না, জুভান।’

কথাটা শুনে জুভান কিছুক্ষণ বাকশূন্য চোখে স্মৃতির থেকে চেয়ে থেকে বলল,

‘ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড়ো।’

জুভান শুয়ে পড়ল। স্মৃতি জানে এই মানুষটার ভীষণ ইগো। হয়তো এখন ইগোতে লেগেছে, তাই আর কথাই বলবে না। আপাতত তাতেই তার লাভ। স্মৃতি আর সাত পাঁচ না ভেবে সেও পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে হঠাৎ স্মৃতির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তিনটা দশ বাজে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল, জুভান পাশে নেই। বারান্দা থেকে কারোর গলার মৃদু সুর আসছে। এত রাতে জুভান কার সাথে কথা বলছে? স্মৃতি আস্তে আস্তে উঠে বসল। বিছানায় বসে কিছু শুনতে পাচ্ছে না দেখে, সে তখন বেড়াল পায়ে বারান্দার কাছে গেল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, জুভান কার সাথে কথা বলছে। কিছু না বুঝলেও এত কথার মাঝেই হঠাৎ একটা নাম এসে তার কর্ণকুহুরে বারি খেল। তার মস্তিষ্ক জেগে উঠল তখন। “জিহাদ”? হ্যাঁ, এই জিহাদকেই তো সে খুঁজছে। জুভান কি তাহলে এখন জিহাদের সাথে কথা বলছে? কিন্তু উনি না বললেন, উনার আর এখন জিহাদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই, তাহলে? মিথ্যে বললেন? কেন?
স্মৃতি এই প্রশ্নের জবাব মেলাতে পারে না। জুভান আসার আগেই সে পুনরায় গিয়ে তার জায়গায় শুয়ে পড়ে। ঘুম তার এখন হাওয়া হয়ে গিয়েছে। জুভান কিছুক্ষণ বাদেই তার পাশে এসে শুয়। সে হয়তো ঘুমিয়েও যায়। কিন্তু স্মৃতি আর দু চোখের পাতা এক করতে পারে না। অন্তস্থলে তখন কেবল তার প্রতিশোধের অনল জ্বলছিল। এখন শুধু একবার এই জাহিদ কে পেলেই তার চলবে…

.

জুভান তখন ওয়াশরুমে ছিল। স্মৃতি বিছানা ঠিক করছিল। জুভান কে ওয়াশরুমে দেখেই সে ছুটে গিয়ে তার ফোনটা হাতে নিল। কিন্তু ফের মুশকিলে পড়ল, পাসওয়ার্ড নিয়ে। ভাবতে লাগল কী হতে পারে। দুবার আন্দাজে ট্রাই মারল। তৃতীয় বার স্মৃতি ভাবল, একবার নিজের নাম টা দিলে কেমন হয়, যদিও তার মন বলছিল এবারও রং দেখাবে। কিন্তু না, স্মৃতিকে হতভম্ব করে দিয়ে লক টা খুলে গেল। স্মৃতি যেন পুরো বেকুব বনে গিয়েছে। জুভান তার নামে লক করেছে, সত্যিই ব্যাপার টা ভীষণ আশ্চর্যের।

লক খুলে চট করেই সে জুভানের কল লিস্টে ঢুকল। একটা আননোন নাম্বার ডায়েল লিস্টের সবার উপরে পেল সে। সাথে সাথেই নিজের ফোনে নাম্বার টা সেইভ করে নিল। তারপর আর দেরি না করে ফোনটা আবার জায়গায় রেখে দিয়ে সে দ্রুত নিচে নেমে গেল, নাস্তা বানাতে।

সকালের নাস্তা খেয়ে জুভান তার বাবার সাথে অফিসে চলে যায়। স্মৃতি নাস্তা খাওয়ার পর আর রেস্ট নেয়নি। সাথে সাথেই দুপুরের রান্নাও বসিয়ে দেয়। তার মন তখন ছটফট করছিল কতক্ষণে সে ঐ নাম্বারে কল করবে, কতক্ষণে সে জিহাদের সাথে কথা বলবে। সে রান্নার কাজ কোনরকমে শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়। দরজা টা পুরোপুরি না লাগালেও হালকা চাপিয়ে রাখে। তারপর সে তার ফোনটা নিয়ে বারান্দায় যায়। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সেই কাঙ্খিত নাম্বারে কল লাগায়। প্রথমবার সেটা রিসিভ হয় না। আরো দুবার দিল, তাও কলটা রিসিভ হয় না। স্মৃতি আশাহত হয়ে ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের উপর এনে রেখে দেয়। তারপর আলমারি খুলে আকাশী রঙের একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে গোসল করতে।

দুপুরের দিকে জুভান আর এলো না। সে আর তার বাবা বাইরেই খেল। তার আসতে আসতে সন্ধ্যা হলো। এর মাঝে স্মৃতি আরো কয়েকবার ঐ নাম্বারে কল দিয়েছে কিন্তু, কোনো রেসপন্স পায়নি। সন্ধ্যার দিকে জুভান বাসায় আসার পর স্মৃতি তার জন্য কফি বানাতে রান্নাঘরে যায়। জুভান মাত্রই ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয় তখন। এসেই দেখে স্মৃতির ফোন টা বাজছে। সে তখন সেটা হাতে নিয়ে নাম্বার টা একবার দেখে। আর সেটা দেখা মাত্রই চোখ মুখ কুঁচকে আসে তার। কপালে চওড়া ভাঁজ পড়ে। যেন সবকিছু হঠাৎই গরমিল লাগতে শুরু করে তার কাছে। সে ভেবে পায় না, জিহান কেন তার স্ত্রী কে কল দিচ্ছে?

চলবে..