পর্ব ৪৩+৪৪
#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_43
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
— রিয়ান!
.
আমি এইবার পিছে ঘুরে দাড়াই। রিয়ানাকে আমার সামনে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি। আমি এইবার সুক্ষ্ম চোখে রিয়ানাকে পর্যবেক্ষন করতে থাকি। রিয়ানার চোখ দুটোতে এখনো রাজ্যের ঘুম ভর করে আছে। হাল্কা হেলছেও সে। মাঝে মধ্যে হাইও তুলছে। কপালটা হাল্কা সংকুচিত করা কিন্তু চেহারায় তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এর থেকে রিয়ান কিছুটা নিশ্চিত হয়ে যায় হয়তো বা রিয়ানা কিছু শুনে নেই। এই ধারণাটি আরও বেশি পরিপক্ব হয়ে গেল যখন রিয়ানা বলে উঠে,
.
— আপনি এত রাতে এইখানে কি করছেন? ঘুম ঘুম চোখে।
.
রিয়ান এইবার স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে ঠোঁটের কিনারাটা প্রসারিত করে বলে,
.
— ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল তাই এইখানে একটু বাতাস খেতে এসেছিল। তুমি কি করছো এইখানে?
.
— ঘুমের ঘোরেই আপনার পাশে হাত চলে যায়। সে জায়গাটা ফাঁকা পেয়ে ঘুমটা ভেঙে যায়। পাশে আপনাকে না পেয়ে খুঁজতে থাকি। বারান্দায় কাউরো কথা বলার শব্দ পেয়ে এইখানে আসি আর আপনাকে পাই। আপনি কি কাউরো সাথে কথা বলছিলেন?
.
— না তো! হাল্কা গুনগুন করছিলাম আরকি হয়তো ওইটাই শুনেছ।
.
— অহহ আচ্ছা। তো আপনি কি এখন ঘুমাবেন নাকি আরও পরে। হাই তুলতে তুলতে।
.
— না না এখনই ঘুমাবো। চল!
.
— হুহ।
.
অতঃপর রিয়ান রিয়ানাকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। আর মনে মনে বলে,
.
— আজ একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছি। পরের বার থেকে আমায় আরও সাবধান হতে হবে। তা না হলে রিয়ানা যদি এইসব সম্পর্কে কিছু জানে তাহলে কেলেঙ্কারি লেগে যাবে। বেশ চিন্তিত হয়ে।
.
.
?
.
ঘড়িতে ৮ টা বেজে ২৭ মিনিট হচ্ছে,
চারদিকে সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে। পাখিরাও এইবার তাল মিলিয়ে সকালের আহবান জানিয়ে শুরু করে দিয়েছে তাদের শুভসকালের ডাক। ব্যস্ত শহরটি ধীরে ধীরে জীবন্ত হতে শুরু করেছে। হাল্কা বাতাসে বারান্দার নীল পর্দাগুলো হাল্কা দোল খাচ্ছে। এক মুঠো রোদ এসে উঁকি দিচ্ছে রুমে। এই নিত্যদিনের সকালটি কেন যেন আজ আমার কাছে বেশ ভিন্ন মনে হচ্ছে। হয়তো রিয়ানের সাথে আমার এই প্রথম সকাল বলে।
আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলগুলো মুচছি। পড়নে আমার গাড় নীল রঙের একটি জামদানী শাড়ি। আয়নার মধ্য দিয়ে একবার রিয়ানের দিকে তাকাই আমি। সে চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে আছে। চুলগুলো কপালে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে। দেখতে একদম বাচ্চাদের মত লাগছে। ঘুমাচ্ছেও বাচ্চাদের মতই। সেই ফরজের নামাজ পড়ে যেই ঘুম দিল আর তার উঠার নাম গন্ধ নেই।
আমি এইবার তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে চুল গুলো ভালো ভাবে মুছে তোয়েলাটা বারান্দায় মেলে আসি। তারপর রুমে এসে দুই মুঠ গাড় নীল রঙের রেশমি চুড়ি দিয়ে নিজের হাত দুটো সাজিয়ে ফেলি। এর উপরে দীদার দেওয়া চুড়িটা পড়ে নেই। গলায় চিকন একটা সোনার চেইন পড়ে নেই। অনামিকা আঙুলে এংগেইজমেন্ট রিংটি পড়ে ফেলি। তারপর চুলগুলো আঁচড়ে নিতে থাকি।
তখনই কেউ এসে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আর আমার কাধে থুতনি রাখে। আমি চট জলদি আয়নায় তাকাই। তাকিয়ে দেখি রিয়ান। আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,
.
— গুড মর্নিং মি. খারুস।
.
রিয়ান আমার কাঁধে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
.
— গুড মর্নিং রিয়ুপাখি।
.
— তো জনাবের ঘুম এতক্ষণে ভাঙল! তা আরেকটু ঘুমাতেন। এত তারাতারি উঠলেন কেন?
.
— যার এত সুন্দর বউ থাকে সে কি আর এতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে পারে বল? ইনোসেন্ট ফেস করে।
.
— পাম দেওয়া হচ্ছে তাই না। তা মি সকাল সকাল পাম দেওয়ার মানে কি? বলুন বলুন!
.
— কিছু না। বলে আমার চুলে মুখ গুজে।
.
— সকাল সকাল এইসব কি শুরু করেছেন। ছাড়ুন আমায় বলছি।
.
রিয়ান এইবার আমার চুল থেকে মুখ সরিয়ে বলে,
— তাহলে কি তুমি রাতে এইসব করার পারমিশন দিচ্ছো? দুষ্টু হাসি দিয়ে।
.
— রিয়ানন!! লজ্জায় একদম লাল হয়ে।
.
রিয়ান এইবার আমায় ছেড়ে দিয়ে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে আমার গাল দুটো টেনে বলে,
— ইশশ আমার লজ্জাবতী রে! ঠিকই বলেছে কবি, “লজ্জা নারীর ভূষণ।” আজ তা দেখেও নিলাম। তা পারমিশন আছে তো?
.
আমি এইবার রিয়ানের বুকে কিল ঘুষি দিয়ে বলি,
— আপনি না অনেক বাজে।
.
রিয়ান আমার হাত দুটো ধরে বলে,
— হাম তো তুমহারে পেয়ার ম্যায় পেহেলেসে হি ঘায়েল হ্যায়, আব ওর কিতনা ঘায়েল কারনা চাহতি হো হামে?
.
আমি এইবার লজ্জায় রিয়ানের বুকে মুখ লুকাই। রিয়ান এইবার আমায় তার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে আমার চোখ দুটো বন্ধ করে দেয় আর বলে,
.
— আই হ্যাভ সামথিং ফোর ইউ সো ডোন্ট ওপেন ইউর আইস।
.
এই বলে রিয়ান আমার চোখ ছেড়ে একটু দূরে সরে যায়। মনের ভিতরে কেমন যেন উত্তেজনা কাজ করছিল। সাথে কৌতূহলও। যার ফলে চোখ বন্ধ করে রাখার মত ছোট একটি কাজ যেন অসহ্যনীয় লাগছিল। তাই আমি আমার কৌতূহলটি দূর করতে হাল্কাভাবে চোখ খুলার চেষ্টা করি ঠিক তখনই রিয়ান বলে উঠে,
.
— নো চিটিং রিয়ুপাখি! কড়া গলায়।
.
রিয়ানের কণ্ঠ কানে আসতেই আমি চট জলদি চোখ বন্ধ করে ফেলি। রিয়ানের এমন কড়া গলায় আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। কয়েকবার বুকে থু থু দিয়ে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিয়ান এসে আমার সামনে দাড়ায়। তারপর বলে,
.
— এইবার চোখ খুলো।
.
আমি এইবার দ্রুত চোখ খুলে ফেলি। চোখ খুলতেই রিয়ান আমার সামনে একটা ছোট বক্স সামনে তুলে ধরে। বক্সের মধ্যে একটু ছোট প্লাটিনামের নাকফুল। নাকফুলটি ফুলের আকৃতির। আমি এইবার অবাক চোখে রিয়ানের দিকে তাকাই,
.
— শুনেছিলাম বিয়ের প্রথম রাতে নাকি বউকে কিছু উপহার দিতে হয়। তাই এইটা তোমার জন্য এনেছিলাম। কিন্তু কালকে এইটা দিতে মনেছিল না তাই এখন দিচ্ছি৷ পছন্দ হয়েছে?
.
— অনেক বেশি। মিষ্টি একটি হাসি উপহার দিয়ে।
.
— আমি পড়িয়ে দেই?
.
— জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি? দেন!
.
রিয়ান এইবার আমার নাকে সেই নাকফুলটি নাকে গেথে দেয়। অতঃপর আমি বাকিটা পড়ে নেই। আয়নায় তাকিয়ে দেখি নাকফুলটি বেশ মানিয়েছে আমায়। আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,
.
— কেমন লাগছে?
.
— সামথিং ইজ মিসিং!
.
— কি?
.
রিয়ান পিছন থেকে আমার আচলটা টেনে নিয়ে এসে আমার মাথা ঘুমটা দিয়ে বলে,
— নাও পার্ফেক্ট। তোমাকে এখন একদম বউ বউ লাগছে।
.
আমি কিছু না বলে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে এইবার মিষ্টি একটি হাসি উপহার দেই। তখনই দরজায় ডাক পড়ে। দোলন ভাবি ডাকছে। আমি মাথায় ঘুমটা ভালোভাবে টেনে দরজা খুলতে চলে যায় আর রিয়ান তোয়েলা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
.
.
?
.
সোফার রুমে বসে আছি। আশে পাশের বিল্ডিং এর সকল আন্টিরা এসেছে আমাকে দেখতে। তারা সকলেই আমার প্রশংসা করে চলেছে। দেখার পর্ব শেষে অনেকেই হাতে কিছু বকশিস স্বরুপ ধরিয়ে দিচ্ছে। কয়েকজন আন্টিরা পাশে বসেই দীদা ও ছোট ফুপুর সাথে কথা বলছে। বড় খালা আর ছোট খালা মিলে দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দোলন ভাবিও রাইশাকে খাওয়াতে ব্যস্ত। আর বাদ বাকি ছেলেরা এখনো ঘুমাচ্ছে। নিলা, রিনা আর মাইশা মিলে রুমে বসে গল্প করছে। কিছুক্ষণ আগেই রিয়ান নাস্তা করেই হসপিটালের কিছু কাজে বেরিয়ে যায়।
আমি সেই আগের ন্যায় সকলের মাঝে চুপচাপ বসে থাকি। দীদার সেই দিকে খেয়াল হয়ে নিলা ডাক দেয় আর আমায় নিয়ে যেতে বলে।
অতঃপর নিলা এসে আমায় রুমে নিয়ে যায়। নিলার পিছু পিছু রিনা আর মাইশাও রুমে আসে।
তারপর নিলা আর মাইশা দুইজনে মিলে আমার সাথে গল্প করা শুরু করে। মাঝে মধ্যে রিনাও কথা বলতে থাকে। এর মধ্যে মাইশা বলে,
.
— ভাবি চল না তোমার বিয়ের গিফট গুলো খুলে দেখি কে কি গিফট দিয়েছে। আমার না গিফট এর রেপিং খুলতে অনেক বেশি ভালো লাগে।
.
তখনই রিনা ধমকের সুরে বলে,
— এইসব কি মাইশা! ভাবিকে দেওয়া গিফট গুলো তুই কেন খুলে দেখবি? এইটা বাজে স্বভাব তুই জানিস না?
.
আমি এইবার রিনাকে বলি,
— রিনা তুমি ভুলে যাচ্ছো মাইশা তো এখন সবে মাত্র কিশোরী। তাই ওর মধ্যে কৌতূহলতা আমাদের থেকে বেশি কাজ করবে এইটাই স্বাভাবিক। ওকে এইভাবে বকাটা একদমই ঠিক নয়।
.
রিনা বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে,
— আচ্ছা ভাবি।
.
— মাইশা যাও গিফট গুলো নিয়ে আসো আমরা সবাই একসাথে মিলেই গিফট গুলো খুলবো কেমন!
.
মাইশা এইবার উত্তেজিত হয়ে বলে,
— ইয়েএ! ইউ আর দ্যা বেস্ট ভাবি ইন দ্যা ওয়াল্ড। লাভ ইউ!
.
এই বলে দৌড় দেয় গিফট গুলো আনতে। সাথে নিলাকেও নিয়ে যায়। অতঃপর গিফট গুলো এনে চারজনে মিলে খুলতে শুরু করি। আমি আসলে একটা গিফট হাতে নিয়েই নেড়ে চেড়ে দেখছি আর বাদ বাকি গুলো নিলা আর মাইশা খুলছে। রিনা শুধু বসে বসে দেখছে।
আমি গিফটটা খুলছিলামই তখনই নজর যায় পাশে পরে থাকা ছোট গিফটির দিকে। তার রেপিং পেপারটি সবগুলো থেকে বেশ ভিন্ন। রেপিং পেপারের গায়ে কঙ্কালের প্রিন্ট বসানো। যার জন্য সহজে নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয় এইটি। আমি সেটি হাতে নিয়ে দেখি উপর একটা চিঠি ভাজ করে দেওয়া। আমি সেটি খুলে পড়তে শুরু করি। তাতে লিখা,
.
” প্রতিটা মেয়ের স্বপ্ন বধু সাজা। আর সেই সাজেই যখন তাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয় তখন সে হয় সবচেয়ে দুর্ভাগা। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত যখন জীবনের শেষ মূহুর্তে পরিনত হয় ঠিক তখনই বুঝা যায় জীবনের মর্ম। ”
.
কথাটি পড়ার সাথে সাথে আমার বিয়ের দিন হওয়া ঘটনাটির কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ার সাথে সাথেই আমার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠে। এইবার আমার এই রেপিং পেপারে নিচে থাকা জিনিসটির প্রতি কৌতূহল কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমি এইবার দ্রুত হাতে রেপিং পেপারটা খুলতে শুরু করি। এরপর আমি যা দেখি তাতে আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি,
.
— আয়ায়ায়ায়া!!!
#Part_44
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
.
আমি এইবার দ্রুত হাতে রেপিং পেপারটা খুলতে শুরু করি। এরপর আমি যা দেখি তাতে আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি,
.
— আয়ায়ায়ায়া!!!
.
আমার চিৎকার শুনে নিলা, মাইশা আর রিনা চমকে উঠে। আর উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে, “কি হয়েছে? কি হয়েছে?”
আমি কিছু না বলেই আমার হাতে থাকা জিনিসটা দূরে ছুড়ে মারি। মাইশা তা দেখে কৌতূহলের বসে সে নিচে নেমে সেই জিনিসটা হাতে নেয়। তারপর মাইশাও ভয়ে পেয়ে চিৎকার করে উঠে।
আমার চিৎকার শুনে ইতি মধ্যে দীদা, ছোট ফুপু, বড় আর ছোট খালা রুমে এসে পড়ে।দরজায় থাকতেই মাইশার চিৎকার শুনে তারা আরও ভয় পেয়ে যায়। তারা দ্রুত রুমে এসেই জিজ্ঞেস করতে থাকে, ” কি হয়েছে? চিৎকার কেন করলি তোরা?”
দীদা আমার কাছে এসে আমার চিৎকার করার কারণ জানতে চাইলো কিন্তু আমার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। ভয়ে আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছিল।
দীদা এইবার নিলা আর রিনাকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু ওরা কিছু না জানায় কিছু বলতে পারছিল না। তাই সকলেই এইবার মাইশার কাছে যায়। আর মাইশাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে। মাইশা তখন কাঁপা কাঁপা হাতে মাটিতে পড়ে থাকা জিনিসটির দিকে ইশারা করে। সবাই এইবার সেইদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে।
মেঝেতে একটি পুতুল পড়ে আছে। পুতুলটিকে বধুর মত সাজানো হয়েছে। ঠিক একদম রিয়ানার বধু সাজের মত। সেই পুতুলটির শরীর রক্তে রঞ্জিত। একটা চোখ উবরে ফেলা হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা কাঁচের মত টুকরা বসানো। কতটা না বীভৎস লাগছে এইটিকে দেখতে। যে কেউ দেখলে ভয়ে কাঁপতে থাকবে। তার উপর যখন এইটি নির্দিষ্ট কাউকে নির্দেশ করে আর সে বুঝতে পারে তখন তার ভয়টা ঠিক কত গুন বেরে যায় তা সকলের ভাবনার বাইরে।
দীদা এইবার দ্রুত সার্ভেন্টদের ডাক দিয়ে সেটি সরিয়ে ফেলে তারপর রিয়ানার কাছে গিয়ে বসে আর ওকে মাথা হাত রেখে বলে,
.
— তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন বল? এইটা হয়তো কেউ মজা করে এমনটা করেছে। তুই ভয় পাইস না কেমন! এই রাহেলা যা তো দুই গ্লাস কুসুম গরম পানির মধ্যে লবণ মিশিয়ে আনতো। বাচ্চা দুটো বেশ ভয় পেয়েছে।
.
রাহেলা ফুপু দ্রুত রান্নাঘরে দুইগ্লাস লবণ ভেজা পানি নিয়ে আসে। এক গ্লাস আমাকে ধরিয়ে তিনি মাইশার কাছে যান। মাইশাকে তার মা মানে ছোট খালা আগলে রেখেছেন। মাইশাকে গ্লাসটা দিয়ে সেও মাইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তখন রাহেলা ফুপু দীদাকে বলে,
.
— ভাগিস মা মেহমানরা ৫ মিনিট আগেই চলে গিয়েছিল তা না হলে এইসব দেখলে কি কানা ঘুষাই না শুরু করতো।
.
তখন দীদা এইবার রেগে গিয়ে বলে,
— তুই চুপ করতো! নিজের তো আক্কেল জ্ঞান নাই তার উপর আসছে বাইরের মানুষদের কি বলতো তা ভাবতে।
.
— মা আমি তো..
.
— চুপ থাকতে বলেছি না তোকে! তুই যা তো রুম থেকে। আর নাসরিন (ছোট খালা) শুনো তুমি মাইশাকে নিয়ে রুমে যাও। ওকে ঘুম পারিয়ে দাও। ঘুমালে সবকিছু ভুলে যাবে।
.
— আচ্ছা খালাম্মা।
এই বলে তিনি মাইশাকে নিয়ে যায়। বড় খালা অনেক আগেই নিলা আর রিনাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সে চাই নি তারা দুইজন এমন এক পরিবেশে থাকুক। ছোট ফুপুও আস্তে করে বেরিয়ে যায়। দীদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
.
— এখনো ভয় করছে?
.
আমি কিছু বলতে না পেরে শুধু মাথা দুলিয়ে ” হ্যাঁ” সূচক উত্তর দেই। তা দেখে তিনি বলে,
.
— আচ্ছা আগে পানিটা খা। ভালো লাগবে।
.
আমি চুপচাপ তার কথা শুনে পানিটা খেয়ে নেই। দীদা তা দেখে মুচকি হেসে বলে,
.
— এই তো আমার সোনা বাচ্চাটা। তা এখন একটু ঘুম দে, আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আর এখন ভুলেও ওইসবের কথা ভাববি না। দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যা। কেউ হয়তো বা মজার করার উদ্দেশ্যেই এমনটা করেছে। তাই এইটা নিয়ে এত ভেবে লাভ নেই। যত এইটা নিয়ে ভাববি ততো শুধু দুঃশ্চিন্তা বাড়বে বুঝলি!
.
আমি এইবারও শুধু মাথা দুলাই আর শুয়ে পড়ি। দীদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে আর গল্প করতে থাকে। তার গল্পগুলো বেশ ভালোই লাগছিল। মনের ভিতর থেকে আস্তে আস্তে ভয়ের রেশটা কেটে যাচ্ছিল। একসময় তার গল্পগুলো শুনতে শুনতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যাই।
.
.
?
.
বিকেলে সকলের সাথে মিলে আড্ডা দিচ্ছি। ছোট বড় সবাই আছে এইখানে। হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে সবাই। একেকজন সকলের ছোট বেলার মজার ঘটনাগুলো বলে যাচ্ছে। যার কথাটা বলা হচ্ছে সে তো লজ্জায় শেষ আর বাকিগুলো ইচ্ছে মত তার মজা নিচ্ছে। বলতে গেলে এক প্রকার ঘরোয়া রেগিং চলছে।
এদের সাথে গল্প করতে করতে সকালের কথাটা যেন প্রায় ভুলেই গিয়েছি। দীদা সকলকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যেন কেউ সকালের কথা আর না উঠায়। এইভাবেই আমি আর মাইশা ভয় পেয়ে আছি। তাই আমাদের মন থেকে সে ভয় দূর করতে এদের যত প্রচেষ্টা। আমাদের দুইজনকে ভুলিয়ে হাসি খুশি রাখাটাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আসলেই এমন ফ্যামিলি পাওয়াটা খুবই কঠিন। কেউ ঘরের নতুন বউয়ের জন্য ঠিক এতটা করে না।
এদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা নেমে আসে। হাসি মজার মধ্যে কত দ্রুত যে সময় পার হয়ে গেল তা বুঝাই যাই নি। মাগরিবের আযান কানে আসতেই সকলে যার যার রুমে চলে যাই। আমিও রুমে এসে নামাজটা পড়ে ফেলি। এর কিছুক্ষণ বাদেই রিয়ান চলে আসে। রিয়ান ক্লান্ত হয়ে এসে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আমি রিয়ানের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে আসি। রিয়ান এইবার উঠে সেই পানিটুকু খেয়ে নেয়। আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি,
.
— যান ফ্রেশ হয়ে আসেন। ওয়াশরুমে আপনার তোয়েলা, গেঞ্জি আর টাউজার রেখে এসেছি।
.
— বাহ একদিনেই দেখি একদম পার্ফেক্ট গিন্নি হয়ে গিয়েছ। বেশ ভালোই লাগছে এখন আসলেই মনে হচ্ছে যে আমি বিয়ে করেছি। মুচকি হেসে।
.
— হ্যাঁ তা তো করেছেন এই। একবার নয় দুই দুই বার। বুঝলেন!
.
— তাতে কি করেছি তো একজনকেই। কিন্তু প্রথম বিয়েতে তো আর সংসার করিনি। সংসার করছি তো মাত্র ২০ ঘন্টা ৩৭ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড ৪৯ নেনোসেকেন্ড ধরে। মুখে প্রশান্তির হাসি ঝুলিয়ে।
.
রিয়ানের কথায় আমার চোখগুলো মার্বেলের মত বড় হয়ে যায়। আমি এইবার বলি,
— আল্লাহ! আপনি এত হিসাব করে রেখেছেন? মানে নেনোসেকেন্ডেরও! কিভাবে? বিষ্ময়কর চোখে।
.
রিয়ান এইবার আমার কাছে এসে আমার নাক ধরে টেনে বলে,
— যাকে কেউ নিজের থেকে বেশি ভালবাসে তার কাছে সেই মানুষটির সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মিনিটের হিসাব থাকে। আর সেখানে তো তুমি আমার ভালবাসা না আমার আসক্তি। সেই হিসাবে তো নেনোসেকেন্ড কি এর কমের হিসাবও যদি রাখতে পারতাম তাও রাখতাম।
.
— আপনি যে একটা পাগল তা কি জানেন?
.
— হ্যাঁ জানি। কিন্তু এই পাগলটা শুধু একজনের জন্যই পাগল আর তার নাম হলো রিয়ুপাখি। আমার পাগলামি তোমাতেই শুরু আর তোমাতেই শেষ। আর এই পাগলামি যে ঠিক কোন পর্যায় পর্যন্ত যেতে সেটার তোমার কোন ধারণাই নাই। নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে।
.
— পাগল একটা। এখন যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।
.
— হুহ!
.
.
?
.
রাতে খাওয়া শেষে যে যার রুমে শুয়ে পড়েছি। কালকে যেহেতু বৌ-ভাত তাই সকালে অনেক কাজ আছে। যার জন্য সকলেই আগে ভাগে শুয়ে পড়েছে। আমিও রুমে এসে ঘুমোবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শাড়িটা বদলিয়ে কামিজ পড়ে নিয়েছি। এখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলগুলো আঁচড়িয়ে বেনুনী করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। রিয়ান তখন পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে আমার কাধে থুতনি রেখে বলে,
.
— কালকের জন্য তোমার সকল কিছু কিন্তু রেডি। কাবার্ডের রাইট সাইটে কিন্তু আমি সব রেখে দিয়েছি। তুমি সবকিছু দেখে বুঝে নিও। আর কালকে সকাল সকালই মেকাপ আর্টিস্টরা এসে পড়বে কিন্তু। তাই এর আগেই নাস্তা করে নিও। আর..
.
আমি রিয়ানকে আর বলতে না দিয়ে বলি,
— ব্যাস রিয়ান! আমি একসাথে কত কিছু কিভাবে মনে রাখবো? অবাক হয়ে।
.
— রাখতে হবে। সকাল থেকে ব্যস্ত থাকবো আমি। তোমার ব্যপারটা ভালো মত দেখতে পারবো না। তাই আগে থেকেই তোমাকে বলে দিচ্ছি। গাল টেনে।
.
— আমাকে নিয়ে আপনার এত চিন্তা? আমি তো আস্তে আস্তে আপনার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি রিয়ান। এখন তো ভয় হচ্ছে, যদি কোন সময় আপনার থেকে দূরে চলে যাই আর তখন আমি….
আর কিছু বলতে পারলাম না। রিয়ান আমার মুখ চেপে ধরে বলে,
.
— আমায় ছেড়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। এমকি তুমি আমায় ছাড়তে চাইলেও আমি তোমায় আমাকে ছাড়তে দিব না। আগেই বলেছি তুমি আমার ভালবাসা না আমার আসক্তি। ভালবাসাও একসময় ছাড়া যায় কিন্তু আসক্তি কখনো ছাড়া যায় না। তাই তুমি কখনোই আমি ছাড়া হবে না। গম্ভীর কন্ঠে।
অতঃপর সে হাতটা সরিয়ে নেয়।
.
— বুঝেছি। আমিও প্রমিস করছি আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। সবসময় আপনার আসক্তি হয়ে পাশে থাকব। মুচকি হেসে।
.
— হুম! এই বলে রিয়ান অভিমান করে সরে যেতে নিলে আমি খপ করে তার বা হাতটা ধরে ফেলি আর জরে টান দেই। সাথে সাথে রিয়ান চমকে উঠে।
আমি হাতে টান দিতেই রিয়ানের হাতের চামড়াটা কিছুটা কুচকিয়ে আসে। তা দেখে আমি বিষ্ময়কর চোখে সেইদিকে তাকিয়ে থাকি। রিয়ান হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলে আমি এইবার টেনে বসি। তারপর জায়গাটা ধরতেই বুঝে যাই এইটা ফেক স্কিন। রিয়ান এইবার চেঁচিয়ে উঠে,
.
— কি করছো কি? হাত ছাড়!
.
— আপনি হাতে ফেক স্কিন পড়ে আছেন কেন? কি লুকাতে চাচ্ছেন?
.
— ককিছু ননা। ততুমি হাতটা ছাড়!
.
আমি এইবার কিছু না বলে একটানে ফেক স্কিনটা খুলে ফেলি আর সাথে সাথে আমার চোখের সামনে সেই ছুড়ি দিয়ে খোঁদাই করে লিখা “রিয়ানা” নামটি ভেসে উঠে।
পরবর্তী পর্ব পড়তে পেইজটি তে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন
.
#চলবে