গল্প #শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১ (১৮+ এলার্ট )
‘ছি ছি শ্যাষপর্যন্ত ভাসুরের পুতের লগে আকাম! লজ্জা শরমের মাথা খাইলো বেশ্যামা*। জামাই বিদেশ গেছে এক মাসও হয় নাই আর হেয় বাড়ির পোলপান লইয়া বিছানায় যায়! বারেভাতা* চুলের মুঠি ধইরা বাইর কর এই অলক্ষীরে।’
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে উঠোনে বসে নকশির শ্বাশুড়ি আলেয়া। রাত বিরাতে পাড়ার মানুষ এক করে ফেলেছে সে চেঁচিয়ে। শ্বাশুড়ির চেঁচানো শেষ হওয়ার আগেই নকশির বড় জা তার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করলো তাকে ঘর থেকে। শ্বাশুড়ির মত নিজেও গালি দিচ্ছে, ‘খান* আর পোলা পাস নাই? আমার দুধের পোলাডার উপরেই নজর দিলি! আইজ তোরে আমি খু*ন করমু।’
টেনে হিঁচড়ে উঠোনে ফেলল নকশিকে। তারপরই বড় জা ফোন দিলেন নকশির স্বামী আওলাদকে। ফোন ব্যালেন্স দুই টাকা থাকায় কল ঢুকলো না বিদেশি নাম্বারে । নকশির ভাসুর আজমলও বাড়িতে ছিলো না কিন্তু আলেয়া বেগম চুপ রইলেন না তিনি বড় ছেলের বউকে আদেশ দিলেন নকশিকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা বন্ধ করতে। তিনি এক্ষুনি পাড়ার মাতবর ডাকবেন, নকশির বাপের বাড়ির লোক আনাবেন। এমন কুলক্ষী, অসতী মেয়েকে আজই বাড়ি ছাড়া করবেন বলেই মাতবরের বাড়ির দিকে গেলেন। বড় জা রহিমাও চড়, থাপ্পড় কিল যা পারলো এলোপাতাড়ি মেরে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো বাইরে থেকে।
মধ্যরাতে ভাসুরের ছেলের ঘর থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছিলো নকশি। গায়ের আঁচল টেনে শরীর ঢেকে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করার জন্য হাত বাড়িয়েছিলো। আর এইটুকুই নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছে তার শ্বাশুড়ি। নকশির স্বামী আওলাদ এক মাস আগেই দুবাই পাড়ি জমিয়েছে ড্রাইভিং ভিসায়। বিয়ে করার পরই তার খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। আগে সে তার বড় ভাই আজমলের সাথে কাঁচা তরকারির ব্যবসা করতো। সংসারে খরচ বেশি, সদস্য বেশি আর ইনকাম কম তাই আওলাদ বিদেশে গেছে। বিদেশ যাওয়ার টাকা অবশ্য তার শ্বশুরই দিয়েছেন জমি বিক্রি করে। আওলাদ বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই শ্বাশুড়ি একটু বিষ চোখেই দেখে নকশিকে। কারণটা হলো নকশি বাপের বাড়িতে পড়াশোনা করেছে। বিয়ের আগেই সে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলো আর দু সপ্তাহ আগে তার পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। ভালো রেজাল্ট করেছে বলে সে আওলাদকে ফোনে বলেছিলো কলেজে ভর্তি হতে চায়। আওলাদের মা সবসময় ছেলের বউয়ের আশেপাশেই থাকেন যখন আওলাদ ফোন করে। আর তাই তিনি শুনেছেন ছেলের বউয়ের মনোবাসনা। তিনি প্রথমদিনই সাফ বলেছিলেন, ‘বিয়া হইছে অহন আবার কিয়ের পড়ালেহা! পোলা আমার বিদেশ গেছে খাইট্টা মরবো আর বউ সংসার ফালাইয়া পড়ার নাম কইরা বাড়ির বাইরে যাইবো! মতলবখান কি আমি বুঝি না বুঝছো? ও বাজান আমি কইয়া রাখলাম তোর বউয়ের কতা হুনবি না।’
নকশির কানের কাছে এসেই চেঁচিয়ে ছেলেকে শুনিয়ে বলতেন আলেয়া বেগম। কিন্তু নকশি হার মানার পাত্রী নয় তার মনোবল কঠিন ছিলো। সে তার বাবার বাড়িতে কিছু টাকা চেয়েছে কলেজে ভর্তি হতে। তার বাবা আর বড় ভাইও রাজী হয়ে দিয়েছিলো টাকা। কিন্তু এখানেও বাঁধা সৃষ্টি করে আলেয়া বেগম। একদিন খুব জরুরি তলব দিয়েই বেয়াইকে বাড়ি ডাকিয়ে খুব করে বলে দিলেন, ‘মাইয়ারে যদি পড়ানের শখ বেশিই অয় তইলে আমার বাড়ি থাইকা একবারে নিয়া যান। আমার পোলার লাগি আমি অন্য মাইয়া দেখমু আবার।’
নকশির বাবা আর সাহস দেখাননি মেয়েকে পড়ানোর। উল্টো ফিরতি পথে মেয়েকে বলে এলেন, ‘যেই ট্যাকা ভর্তির লাইগ্যা দিছি হেগুলা দিয়া শাড়ি-চুড়ি কিনিছ, ভর্তি হওন লাগবো না।’
নকশি আর্তনাদ করে বলেছিলো সে ভর্তি হবেই। এত ভালো একটা রেজাল্ট করছে ঘরে বসে থাকবে কেন? অন্তত ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলে সে একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতে পারবে। আর যদি আরো বেশি পড়তে পারে তবে আরও বড় কিছু! নকশির বাবা শুনলেন না মেয়ের কথা। গ্রাম গঞ্জের মানুষ, মেয়ে বিয়ে দিয়েছে মানে তাকে গুছিয়ে সংসার করতে হবে। বাড়ির ভেতরটা চমৎকারভাবে সামলে নিতে পারলেই তার জীবন ধন্য। খামোখা অত পয়সার জলাঞ্জলি দিয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে দশজন ছেলের সাথে পড়াশোনা করার মানেই হয় না। তারওপর আবার যার বর দেশের বাইরে তার তো ছেলেপেলের আশেপাশে থাকা মানেই চরিত্রের দোষ ধরে নেওয়া হয়। নকশির বাবা তাই জেনেবুঝে মেয়ের সংসার নষ্ট না হয় সেজন্য ধমকের সুরেই বলে গেলেন, ‘তোরে বিয়া দিছি সংসার করবি। পড়ালেহার কোন দরকার নাই।’
বাবা চলে গেছেন শাষণ করে, শ্বাশুড়ি নজরে নজরে রাখছেন আর আওলাদও মায়ের কথা শুনে এখন দোনোমোনো করছে। সে নকশিকে ভালোবেসে ফেলেছে তাই নকশির কথা রাখতে চায় কিন্তু মায়ের মুখের ওপর কিছু বলারও সাহস নেই তাই চুপ থাকে। ফোন করলেই নকশি কান্নাকাটি করে। সে ভাবে কম বয়সী বউ তার একটু কান্নাকাটি করবে পরে ঠিক মেনে নিবে। কিন্তু তেমনটি হয়নি। আওলাদের বড় ভাইয়ের ছেলে আলিম এবার ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। বয়সে সে নকশির চেয়ে বছরের বড় তবুও চাচী হিসেবে সম্মান করে খুব নকশিকে। আর তাই নকশি তার কাছেই বলেছিলো কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতে। আলিম চাচীকে বলেছে সে সব করে দিবে আর চাচাকেও ফোনে সবটা সে নিজেই লুকিয়ে জানিয়ে রাখবে। আজ রাতে আলিম পাড়ায় কোন যাত্রা হচ্ছে বলে সেখানে গিয়েছে। আর যেতে যেতে চাচীকে বলেছিলো তার পড়ার টেবিলে নিজের ভর্তির টাকা সব কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে যেতে। নকশিও রাতের খাওয়া শেষে শ্বাশুড়ি যখন নিজ ঘরে পান সাজাচ্ছিলেন তখনই গিয়েছিলো আলিমের ঘরে। ভর্তির টাকা আর কাগজপত্র সবটা রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বের হয়ে আসছিলো। তখনি চোখে পড়ে আলেয়া বেগমের। সকল অনর্থের শুরু এই একটু দেখার ভুলে। যেই ছেলেকে মিলিয়ে নকশির চরিত্রের দোষ ধরলো সেই ছেলেটা বাড়িতেই নেই এ কথা কেউ জানতোই না। ভাগ্য মন্দ বলেই হয়তো আজ আলিমও কাউকে না জানিয়েই যাত্রাপালা দেখতে গেছে। আলিমের মা মানে নকশির বড় জা’ও বোকা বনে গেছেন যেন। শ্বাশুড়ির কথায় সবাইকে ডেকে জড়ো করতে গিয়ে ভুলে গেল তারই ছেলের নাম জড়াচ্ছে নকশির সাথে। যতক্ষণে তার মনে পড়লো কথাটা ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ উঠোন জুড়ে ভিড় জমেছে, মাতবর, মুরুব্বিরা সব এসেছে। নকশি ঘরে বন্দী চিৎকার করে অনেকবার বলল সে এমন কিছুই করেনি৷ কিন্তু এ কথা কারো কর্ণপাত হওয়ার নয়। বাড়িতে কারেন্ট নেই চারপাশ অন্ধকার আর উঠোনের দু কোণায় দুটো হারিকেন জ্বলছে টিমটিমে আলো নিয়ে। পাড়ায় রটে গেছে ঘটনাটা আর আলিমও শুনতে পেয়ে বাড়ি এসেছে৷ বাড়িতে ঢোকার পথেই সে শুনতে পেল তার দাদীর গলা, ‘যাই কন মাতবর সা’ব এই বউ আমি ঘরে রাখমু না। যেমনে পারেন তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা করান। আইজ আমার নাতির লগে কাইল গেরামের অন্য পোলাগো লগে আকামে জড়াইবো। এ আমি কিছুতেই সইহ্য করমু না।’
আলিম তার দাদীর মুখে এমন কথা শুনে বুঝলো সে যা শুনে এসেছে সেই ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট ঘটনা। সে তো বাড়িই ছিলো না আর চাচীও খারাপ মাইয়্যা না। আলিম এগিয়ে এসে দাদীর কথা মিথ্যা প্রমাণ করলো। তার সাথের বন্ধুরাও সত্যিটা জানালো আলিম তাদের সাথে ছিলো। কিন্তু আলেয়া বেগম নকশিকে তাড়ানোর এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইলেন না৷ হুট করেই বললেন, ‘মিথ্যা কইস না আলিম তোরে আমি দেখছি সবুজ শার্টখান আর লাল তাতের গামছার লাহান লুঙ্গিটা পিন্দোনে (পরনে) আছিলো তোর। এই ঘর তে বাহির হইয়া কলপাড় দিয়া ওই পাশে গেলি গা। আর শরীলের কাপড় ঠিক করতে করতে হেই মা* নিজের ঘরে গেল।’
আলেয়া বেগমের বর্ণনা শুনতেই পাড়ার অনেকেই ঘাড় বাঁকিয়ে কলপাড়ের পাশের বাড়িটার দিকে তাকালো। আলিম নিজেও সন্দেহে পড়ে গেল এক মুহুর্তের জন্য। কলপাড়ের পাশের বাড়িটা কুদ্দুসদের।আর পোশাকের যে বর্ণনা দিলেন আলেয়া বেগম তা কুদ্দুস পড়ে আছে আজ। বোকাহাদা পুরুষ কুদ্দুস বয়সে আওলাদের থেকে ছোট। আলেয়া বেগমের সাজানো নাটক সুন্দরভাবে প্রচারিত হয়ে গেছে। নকশির বাড়ির মানুষ এলেই বিচার সম্পূর্ণ করা হবে আওলাদের সাথে নকশির তালাক সেই সাথে পরকিয়ায় ধরা পড়ায় তার শাস্তি হিসেবে চুল চেছে একশো বেত মারা হবে। ঘরের ভেতর নকশি কান্নাকাটি করে বলতে লাগলো এসব মিথ্যে। তার চিৎকার আর কান্নাকাটির ধার কারো কর্ণকুহরে দাগ কাটলো না। জায়ের হাতে মার খেয়ে তার কিশোরী মুখটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে অনেক আগেই তারওপর হাতের চুড়ি ভেঙে চামড়ায় গেঁথে আছে৷ খুব শখ করেই সে কাঁচের চুড়ি পরতো বিয়ের পর থেকে আজ সে শখ তার চামড়া ভেদ করেছে। আলিম ভীড় ঠেলেই তার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দু চার কথায় মায়ের ওপর ক্ষেপে যেতেই তার মা খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘বুঝতাম পারি নাই আব্বা তোর দাদী নকশিরে তাড়ানের লাইগ্যা তোর নাম খারাপ করবো। চিন্তা করিস ন তোর দাদী অনেক চালাক বেডি পল্টি খাইছে দেখলি না তোর বদনাম হইবো না।’
‘আর কাকীর?’
‘হেরে লইয়া তোর চিন্তা করোন লাগতো না। হেরে আজকা জন্মের সাজা দিয়া বাইর করবো।’
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২
একজোড়া নগ্ন পা দৌঁড়ে চলছে আঁধার ভেদ করে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসে শো শো আওয়াজ। নকশি ছুটছে মাটির রাস্তা ধরে। গাঢ় অন্ধকারে ঠিকঠাক ঠাওর করা মুশকিল সামনে কিছু আছে কি নেই। এ রাস্তায় দু কিনারায় সারি বেঁধে গাছ বড় বড় তাই অন্ধকার চোখ সইছে না। এ পথ পেরুলেই গাড়ির রাস্তা সেখানে উঠলেই আর এত কষ্ট হবে না পথ চলতে৷ গ্রামের মাতবররা যখন নকশিকে ঘর থেকে বের করতে বলল তখন আলিমের মনে হলো বিরাট কোন অন্যায় হবে এখন। তার বিশ্বাস হয়নি কাকীকে নিয়ে কুৎসাটা। তার ধারণা দাদী লোভে পড়ে এমন এক নাটক সাজিয়েছে। কাকী দেখতে মহাসুন্দরী, বয়স অল্প আর কাকা যে বিয়ে করতেই কাকীকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে তা দাদী ঠিকই টের পেয়েছে অন্যদের মত। ছেলে হাতছাড়া না হয়ে যায় বউয়ের পাল্লায় পড়ে তাই চাচাকে খুব ধরেবেঁধে রাখার চেষ্টা করেন দূর থেকেই তা আলিম জানে। কিন্তু দাদী আজ যে ভুল করেছে সেটা অনেক বড় আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে দাদীর বড় বোন। সে মহা শয়তান বুড়ি আলিম জানে৷ নিজের এক পাও ল্যাংড়া মাইয়া কাকার গলায় ঝুলাইতে না পাইরা দাদীকে বলদ বানাচ্ছে। কিন্তু কথা হলো আলিম চায় কাকী আজ সালিসে সবার সামনে না যাক। গেলেই কথার মারপ্যাচে ঝামেলা বড় হবে আর কাকীর বাপ, ভাই আসলে অসম্মান করে মেয়ে ফেরত পাঠাবে। কাকাকে ফোনে যা বলবে সে তাই বিশ্বাস করবে এর চেয়ে ভালো কাকী না থাকুক। এই ভেবেই আলিম তার বন্ধুর সাহায্য নিয়ে অন্ধকার ঘরের দরজা খুলে কাকীকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কাকী ভালা চান তো পলাইয়া যান। আমার বন্ধুরা দরজার সামনে আছে আপনি যে কোন একজনের পিছে গিয়ে খাড়ান। তারপর সে যে দিকে যায় আপনে আওয়াজ না কইরা বাইর হন। গ্রামের রাস্তায় উঠাইয়া দিতেই আপনে আপনাগো বাড়ি যান। আজকার বিচার পন্ড হইলেই সব ঠান্ডা হইয়া যাইবো আপনে বাপের বাড়ি থাইকা কাকার লগে যোগাযোগ কইরা সত্যটা বোঝাইয়েন।’
নকশির মাথা কাজ করছিলো না কিছুতেই। কি থেকে কি হয়ে গেল! মাত্র দু ঘন্টা আগেও তার জানা ছিলো না এমন কিছু হতে পারে। সে সত্যিই আঁধার এই রাতে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে খালি পায়ে। পরনে তার সুতির শাড়িটাই সম্বল। রাত কত হলো জানে না তবে আন্দাজ করতে পারে এগারোটা কিংবা তার একটু বেশি৷ তার বাবা, ভাইরা কি চলে এসেছে এই গ্রামে! তাদের যদি অপমান করে আর যদি তিনি সত্যিই তালাক দেয়! শ্বাশুড়ি মা তো এমনটাই বলছিলেন বারবার। শঙ্কিত হলো নকশি তার পরবর্তী অবস্থা ভাবতেই৷ মানুষটা তো একটু মা ভক্ত বেশিই কিন্তু সে বোঝে তাকেও ভালোবাসে খুব৷ কিন্তু তার বাবা ভয়ংকর লোক। তাকে যতোটা ভালোবাসে শাসনও ঠিক ততোটাই করে। আজকে যে কুৎসা রটালো তার শ্বাশুড়ি এতে বাবা তাকে ঠিক কেটে জলে ভাসাবে। গ্রামের পথ শেষ হওয়ার আগেই অন্ধকারে একটা সাইকেল এসে থামলো নকশির সামনে। সাইকেলে বসা মানুষটাকে দেখে চিনতে না পারলেও গলা চিনলো।
‘কাকী!’
‘সবুজ কাকা!’
‘হ আমি, আলিম এই পলিথিনটা দিছে এইটাতে আপনের কাগজপত্র আর ট্যাকা।’
সবুজ তার বাটন ফোনটার টর্চ জ্বেলে সাইকেলে করে এসেছে। টর্চের আলোয় নকশি দেখলো পলিথিনে কাগজ গুলো তার পরীক্ষার এডমিট আর মার্কশীট বোধহয়! সে হাত বাড়িয়ে নিলো। সবুজ ততক্ষণে সাইকেল ঘুরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আবার বলল, ‘আপনের বাপ, ভাই কেউ আয়ে নাই। গ্রামের মানুষ আপনেরে খুঁজতাছে জলদি রাস্তা পার হইয়া ভ্যান পাইলে চইলা যান।’
চলে গেছে সবুজ ; আলিমেরই বন্ধু সে। এই ছেলেগুলো বয়সে বড় নকশির চেয়ে কিন্তু কেউ কখনো তাকে অন্য নজরে দেখেনি৷ আর কুদ্দুস! সেই বোকা হাঁদা ছেলেটা তো ভুল করেও কোনদিন কু দৃষ্টি দেয়নি অথচ আজ কত বড় কলঙ্ক লাগলো তাকে নিয়েই। বাবা আর ভাইয়েরা কেউ আসেনি শুনে কলিজা কেঁপে উঠলো নকশির। তবে তো আজ বাপের বাড়ি গিয়েও তার ঠাঁই হবে না। অল্প বয়সী বুদ্ধি তার ভালো দিকের চেয়ে খারাপ দিকটাই বেশি ভেবে নিলো। ভয়ে পথ বদলে নিলো নিজের। বাপের বাড়ির রাস্তা ছেড়ে উল্টো রাস্তায় দৌঁড়ে গেলো। অনেকটা পথ মিহি অন্ধকারে পাগলের মত দৌঁড়ে কোথায় পৌঁছুলো সে জানে না। শুধু মনে পড়ে দৌঁড়ে যেতে যেতে কোন এক গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।
পূর্বে সূর্য কুসুমরঙা হয়ে যখন আকাশটায় ঝলক দেখাচ্ছে তখনই চোখটা মেলল নকশি। মাথার বা পাশ থেকে কান পর্যন্ত সুক্ষ্ম একটা ব্যথা টের পাচ্ছে। বা হাতটাও একদম অবশ আর ভারী লাগছে যেন, এ হাতের ওজন তার বহন ক্ষমতার বাইরে। মাথার উপর ঝকঝকে নতুন টিনের চাল।
‘চোখ খুলছে দ্যাখো আম্মা।’
বাচ্চা একটা কণ্ঠস্বর কানে আসতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় নকশি। কচি একটা মায়াবী মুখের বাচ্চা ছেলে। অপরিচিত কিন্তু কৌতূহলী ছেলেটা কেমন বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ততক্ষণে একজন মহিলা তার পাশে বসলো। বুঝতে সমস্যা হচ্ছে এরা কারা, সে নিজেই’বা কোথায় আছে! মহিলাটিই সহজ করলো তার ভাবনা।
‘চোখ মেললে ভাই! কি যে চিন্তায় রাত পার হলো আমাদের জানো?’
নকশি কিছু বললো না। সে খেয়াল করেছে তার হাতে ব্যান্ডেজ। বা গালটাও ফুলে আছে বুঝি! মহিলাটি তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কি উঠে বসবে একটু! নকশি মাথা নাড়লো ‘হ্যাঁ’। চৌকিতে থাকা দুটো বালিশ একটার ওপর একটা রেখে নকশির পিঠ ঠেকিয়ে বসালো। আলতো হাতে মহিলাটি তার কপাল ছুঁয়ে দেখলো নাহ, জ্বর আসেনি৷ বাচ্চাটি মহিলার আঁচল টেনে কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আম্মা ডাক্তার কি আবার আসবো ইনজেকশন নিয়া?’
‘না বাবা উনি তো এখন সুস্থই হইছে একটু আর ডাক্তার আসবো না।’ হাসিমাখা মুখেই মহিলা কথা বলছেন। তিনি আবার নকশিকে বলল, ‘কাল তোমার এক্সিডেন্ট দেখে খুব ভয় পাইছিলো আমার ছেলেটা। এই যে দ্যাখো রাতভর ভয়ে জামাকাপড়ও ছাড়া হয়নি আমাগো। দাওয়াত থেকেই ফিরছিলাম আমরা আর তুমি অন্ধকারে গাড়ির সামনে পড়লা। যা ভয় পাইছিলাম গো। বড় ভয় হচ্ছিলো তোমার আঘাতটা কেমন লাগছে ভাইবা। শিশিরের বাবা তো আমাগো বাড়ি রাইখা তোমারে নিয়া আবার শহরে হাসপাতালে গেল। ভোর রাতে ফিরতেই আমরা মা ছেলে আবার তোমার পাশে আইসা বসলাম৷ উনি একটু চোখ বুঁজছেন আবার স্কুলে যাবেন নয়টায়।’ গড়গড় করে মহিলাটি অনেকগুলো কথা বলে গেল। নকশি রা কাড়লো না মুখে। কিন্তু তার ভয় সে বাড়ি ফিরবে কি করে আর ফিরলে তার সাথে কি হবে! মহিলা এবার ছেলেকে তাড়া দিলেন, ‘শিশির যা এবার তুই ঘুমা গিয়ে তোর আব্বার সাথে। আমি যাই রান্না বসাই আজ আর স্কুলে যাইতে হবে না।’
পাঁচ বছরের শিশিরের চোখের কৌতূহলের ঝিলিক। সে নকশি অনেকক্ষণ ধরে দেখছে। শাড়ি পড়া কত্তো বড় মেয়ে অথচ তার পায়ে কাঁদামাটি। সে তার মাকে একবার বলেছিলো, ‘আম্মা এই মহিলার পায়ে কাঁদা বিছানায় আনছেন ক্যান!’
শিশির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার চোখ এখনো ঘুমে ঢুলুঢুলু। কিন্তু এখন ঘুমালে চলবে না। শরৎ ভাই আর শিউলি উঠলেই আগে তাদের বলতে হবে বাড়িতে আসা অদ্ভুত মহিলার কথা। জুতো পরে না সেই মহিলা আবার দেখতে অনেক সুন্দরও।
নকশি সকালটা বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইলো একভাবেই। কোথায় আছে জানে না শুধু এতটুকু বুঝতে পারলো সে কাল রাতে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলো। গাড়িতে এ বাড়ির মানুষরা ছিলো তারা তাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিজ বাড়িতে এনেছে। গাল আর কানটাতে ঝিমঝিমে ব্যথা অনুভব হচ্ছে খুব তাই চোখ দুটো বুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে রইলো।
শিফা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শিশিরকে দেখলো। ছেলে গাড়িতে বাবার কোলে পড়ে ঘুমিয়েছিলো তাই এখন যে সে ঘুমাবে না ভালোই জানে। তাই ছেলেকে বলল, ‘শিশির যা তো তোর জেঠিরে একটু আসতে বল।’ শিশির সাথে সাথে চলে গেল শরৎ ভাইদের ঘরে। শিফাও আলনা থেকে বাড়িতে পরার শাড়ি নিয়ে নতুন শাড়িটা পাল্টে নিলো। কাল দাওয়াত ছিলো তার বড় আপার শ্বশুর বাড়িতে। বড় দুলাভাইরা শহরের দিকে থাকে আবার তারা বড়লোকও বটে। সেই কারণেই শিফা তার স্বামীর কাছে খুব বায়না করেছিলো যেন কাল ট্যাক্সি করে নিয়ে যায়। বিধিবাম, গ্রামে ট্যাক্সি কোথায় পাবে! কিন্তু শখ তো আর তা বোঝে না। এজন্যই কাল রাতে ফেরার পথে শিশিরের বাবা আহসানুল্লাহ ট্যাক্সি ভাড়া করে তাদের নিয়ে ফিরছিলেন। এর মাঝেই ঘটলো কি এক কান্ড! প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে শিফা তাকালো বিছানায় ঘুমন্ত তার স্বামীর দিকে। মানুষটা বড় ভালো আর সাদা মনের। কাল রাতে তার শখ পূরণ করতে গিয়েই বিপদ হলো। শাড়ি বদলে সে আবার গেল নকশিকে দেখতে। মেয়েটার সাথে কথা বলে তার বাড়ির ঠিকানা জানতে বলেছিলো শিশিরের বাবা। কিন্তু সে তো কত কথা বলে গেল শুধু মেয়েটার ঠিকানা জানাই হলো না।
‘এ্যাই যে, তুমি কি ঘুমাইয়া পড়ছো?’
নকশি চোখ মেলে তাকালো। সেই মহিলা আবারও এসেছে এবার শাড়ি বদলে। সে খেয়াল করলো মহিলাটি তার বড় ভাবীর বয়সী হবে৷ শ্যামলা মুখে বোকা বোকা ভাব আর হাসি যেন ঠোঁটে আঠার মত লাগানো।
শিফা প্রশ্ন করলো, ‘তোমার ঠিকানাটা বলো গো খবর দিতে হবে তোমার বাড়িতে।’
‘বাড়িতে!’ অস্পষ্ট শব্দে উচ্চারণ করলো নকশি। কোন বাড়িতে খবর দিবে তার! আওলাদ কি জেনেছে সবটা? কি জেনেছে তার বউ পরকিয়া করে নাকি সত্যিটাই জেনেছে, তার মা ষড়যন্ত্র করেছে! নকশির মনে পড়লো সবুজের কথা কাল তার বাবা, ভাইরা কেউ আসেনি বলেছিলো। সে কি বাপের বাড়িই ফিরে যাবে! নকশি জানতে চাইলো এটা কোন গ্রাম? শিফা বলল, ‘এটা পদ্মদিঘি (কাল্পনিক) গ্রাম।’
নকশি চিনলো না। সে এই গ্রামের নাম শুনেছে বলে মনে করতে পারলো না। কিন্তু এখন নিজের বাড়ির কথা কি বলবে! সেখানে ফিরে আবার কোন বিপদে পড়বে কিনা বুঝতে পারছে না। আপাতত চুপ করে বসে রইলো সে আর শিফা তো বাঁচাল স্বভাবের। সে নিজের মতোই হাজারো কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছে নকশির ঠিকানা জানার কথা।
সকাল নয়টায় স্কুলে যাওয়ার কথা ছিলো আহসানুল্লাহর। ঘুমটা বেশ ঝাঁকিয়ে আসায় সময় মতো উঠতে পারলো না। এমনিতেও রাতের ধকলে শরীরটা ক্লান্ত। শিশির আর শিউলির মারামারিতে ঘুম ভাঙতেই সে শিফাকে ডাকলো। ছেলে আর ভাতিজি আজ স্কুলে যায়নি কেন জিজ্ঞেস করতেই শিফা বলল, ‘বাড়িতে একটা মেয়ে অসুস্থ তারা দুজন বারবার সেই মেয়েকেই উঁকি মেরে দেখছে আর কিসব গল্পে ব্যস্ত।’
‘একটা মানুষ দূর্ঘটনায় পড়ে এ বাড়িতে আছে তাই বলে বাচ্চারা স্কুলে যাবে না! শিফা তুমি এত অসচেতন কেন বলোতো? আর মেয়েটা কি জেগেছে!’ বলতে বলতেই আহসানুল্লাহ বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাড়িতে নতুন তোলা বাচ্চাদের জন্য পড়ার ঘরটিতে রাখা হয়েছে নকশিকে। আহসানুল্লাহ সে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাশির শব্দ করলো। শিফাও ততক্ষণে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ঘরে প্রবেশ করলো পেছন পেছন শিশিরের জেঠিও এসে ঢুকলো ঘরে। শিফার কাছে আগেই শুনেছেন রাতের ঘটনা। তিনজনেই একসাথে নকশির সাথে কথা বললেন। জানতে চাইলেন তার ঠিকানা, পরিবারে কে কে আছে, কারো মোবাইল আছে কিনা নাম্বার মুখস্ত থাকলে বলুক তারা খবর দেবে৷ অনেকটা সময় নিরব থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নকশি। কাঁদতে কাঁদতেই সে তার সাথে ঘটে যাওয়া সবটা বলল। তার সব কথা শুনে থমকে গেলেন ঘরের উপস্থিত থাকা বাকি তিনজন মানুষ। মেয়েটার বয়স কত সর্বোচ্চ সতেরো, আঠারো হবে! এতটুকু মেয়ের জীবনে এত ষড়যন্ত্র! সে সামলে উঠবে কি করে? আবেগি হয়ে উঠলো মহিলা দুজনই। শিফা তো কাঁদো কাঁদো হয়ে জড়িয়ে ধরলো নকশিকে আর শরতের মা আকণ্ঠ আবেগে গলে বলেই ফেললেন, ‘তুমি আমাগো বাড়িতেই থাকো। যাইতে হইবো না ওইরকম যমের বাড়ি।’
আহসানুল্লাহ জ্ঞানী লোক; তিনি প্রথমেই সবটা বিশ্বাস করলেন না। মেয়েটার বয়স অল্প আর দেখতেও সুন্দরী। সন্দেহ হলো সত্যিই কোন কু’ঘটনা আছে কিনা! আবার হতে পারে সত্যিই বিপদ তার। খোঁজ না নিয়ে আবেগের বশে কাউকে বাড়িতে রাখা বোকামি। নকশির বলা ঠিকানা তার চিনতে অসুবিধে হলো না। বেশি দূর নয় নকশিদের গ্রাম। বাসে যেতে পারলে এক ঘন্টার রাস্তা। নকশি কিছু না জানিয়েই সে দুপুরে তার এক বাল্য বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল খোঁজ নিতে।
রাতে সে বাড়ি ফিরে বিমর্ষ মুখে শিফাকে বলল, ‘মেয়েটা কি জেগে আছে?’
‘হ্যাঁ মাত্রই ভাত খাইয়া একটু বইসা রইছে।’
‘ডেকে আনো তারে৷’
চলবে…..
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)