ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২০
মাঝরাতে আলতাকে পাওয়া গেছে শুনেই বাড়িতে থাকা তিনটি নারীই তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর শিফা একটু চোখ বুঁজেছে, জয়তুনও ঝিমিয়ে পড়ে আছে নকশির পাশে। শুধু নকশির দু চোখের পাতা যেন বুঁজতে ভুলে গেছে। শিশিরও ঠায় কনকনে ঠান্ডা রাত দরজায় বসে কাটিয়ে দিল। ভোরের আলো কুয়াশা ভেদ করে তখনো এ ধরনীর বুকে জ্বলে উঠেনি। ফজরের আজান শেষ হতেই নামাজ পড়ে নকশি তাড়া দিল শিশিরকে। শিশিরও তৈরিই ছিল যাওয়ার জন্য৷ শিফা বলল সেও সাথে যাবে। আলতার কি অবস্থা তা কে জানে সেখানে আবার নকশিকেই না সামলানো লাগে। শিশির নিলো না সে সামলে নিবে বলল। শিউলি আর জামাইকেও আজ আনতে যেতে হবে তাই বাড়ির কাজকর্মই গোছাক তারা। কিন্তু এই বিপদে কাজ কি আর হাতে আসে! সবারই তো মন পড়ে আছে আলতার কাছে। কেমন আছে মেয়েটা চোখে না দেখলে শান্তি লাগবে না।
এত ভোরে গাড়ি পাওয়া মুশকিল তবুও এলাকার একটা লোক অটো চালায় তাকেই ডেকে তুলল শিশির তার বাড়ি গিয়ে। অটোতে করে তারা রওনা হতেই বাজার ছেড়ে অটোওয়ালা শিশিরকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাতিজা কই যাইবা তাইতো কইলানা।”
“কাকা অলিপুর হাসপাতাল যাবো।”
‘অলিপুর’ নামটা শুনতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো নকশির।
“অলিপুরে কেন যাব শিশির?”
নকশির হঠাৎ প্রশ্নে চমকে তাকায় শিশির। ফুপুআম্মা খুব সচরাচর নাম ধরে সম্মোধন করে না। তাকে সবসময় আব্বা বলেই ডাকে মাঝেমধ্যে শিশির বলে কিন্তু আজকের প্রশ্নটা কেমন ভয়ার্ত শোনালো ফুপুআম্মার গলায়। তার মনে হলো ফুপুআম্মা আলতাকে নিয়ে খুব বেশি শঙ্কিত আছে তাই সে আলতো করে ফুপুর হাতটা ধরে বলল, “ভয় পাচ্ছেন কেন ফুপুআম্মা! আলতার কিছু হবে না। ভাই তো বলল আমরা গেলেই আলতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো।”
শিশিরের কথাটা ঠিকঠাক কানে পৌঁছুলো না বোধহয় নকশির। সে অটোর বাইরে ঘোলাটে কুয়াশায় অপলক তাকিয়ে ভাবছে আজ থেকে প্রায় ষোলো বছর আগে ছেড়ে যাওয়া গ্রামের পথ দিয়েই তাকে যেতে হবে। সেখানকারই হাসপাতালে ভর্তি তার মেয়ে৷ এ যে প্রকৃতির বড় নির্মম লীলাখেলা। যেখান থেকে অন্তরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল আজ সেখানেই আবার শুকিয়ে আসা ক্ষতটা তাজা হবে। ভাগ্যের সকল ফের কি তার জন্যই বরাদ্দ রেখেছেন উপরওয়ালা! চলন্ত অটোর ভেতরে শীতের হিমেল হাওয়া ডানা জাপটে এসে গাল,মুখ সব অবশ করে দিচ্ছে। ফর্সা মুখটা তার রক্তশূণ্য লাগছে৷ শিশির খেয়াল করল ফুপুআম্মার মুখের পরিবর্তন, কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছে৷ সে নকশির গায়ে জড়ানো চাদরটাই টেনে মাথা ঢেকে দিতে চেষ্টা করলে বাঁধ সাধল নকশি।
“থাক না আব্বা, আমার শীত লাগছে না।”
এ কথায় শিশির জোর করলো না। সেও সময় গুনতে লাগলো আর কতক্ষণ লাগবে গন্তব্যে পৌঁছুতে! অলিপুর গ্রামের রাস্তায় অটো উঠতেই আবার চোখ ভিজে এলো নকশির। সেই পথ-ঘাট সেই ক্ষেত, খামার। এ পথেই পাকা রাস্তায় উঠার আগেই এক বাড়ি সে বাড়ির পেছনের বাড়িটা আওলাদদের৷ আলতার জন্মদাতার বাড়ি এখানটায়, নকশির কয়েক মাসের সংসারটা ছিল সেখানে। হঠাৎ করেই জানতে ইচ্ছে হলো কেমন আছে সেই মানুষটা যাকে সে ভালো না বেসেও ভরসা করতো? যার সংসারে থাকার জন্য সে তার কিশোরী বয়সের সাজানো স্বপ্নগুলো বুনেছিল! নিশ্চয়ই ভালো আছে সে, তার পরিবার আর তার সেই কাল নাগিনী মা! ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে করিয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশিতে থাকছে। নাতি, নাতনিও নিশ্চয়ই পেয়েছে। ভাবনঘর বিস্তৃত ভাবনায় ডুবে খেয়াল করেনি নকশি তারা হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। অটোওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে সে নকশিকে ডাকলো, “ফুপুআম্মা, চলে এসেছি।”
শিশিরের ডাকে ঘোর কাটে নকশির৷ সে অটো থেকে নেমে হাসপাতালের দিকে পা বাড়ায়। শিশিরও ফোন করে ভাইকে জিজ্ঞেস করে তারা কোথায়। সরকারি হাসপাতালটা দোতলা আর আলতাকে রাখা হয়েছে দোতলাতেই। হাসপাতালে কেবিন বলতে হাতে গুনে পাঁচটা। আলতার অবস্থা বেগতিক দেখে ডক্টররা তাকে কেবিনটাতেই রেখেছে। নকশি যখন কেবিনটাতে ঢুকলো তখন তার পা অসাড় হয়ে ভেঙে এলো। একদম সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মত কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে ঢলে পড়লো আর পাশেই শিশির থাকায় সে কোনমতে ধরে রইলো নকশিকে। নকশির অবস্থা দেখে শরতও এগিয়ে এসে ধরলো। পাশেই একটা চেয়ার ছিলো তাতে বসিয়ে মাথা ধরে রাখলো। আহসানুল্লাহ স্তব্ধ হয়ে আছেন৷ এত বছরের জ্ঞান বুদ্ধি সব যেন এক রাতেই লোপ পেয়েছে তার। সে নিষ্পলক চেয়ে দেখছে সবটা। শিশিরকে বলতে হয়নি সে নিজেই দৌঁড়ে গেল ডাক্তার ডাকতে। এত সকালে কোন ডাক্তার সরকারি হাসপাতালে থাকাটা এই গ্রামে অসম্ভব প্রায়। তবে নার্স একজন এগিয়ে এসেছে। দাঁতে দাঁত লেগেছে নকশির বুঝতে পেরে সে তার জানা কায়দায় জ্ঞান ফেরালো। ঘোলা আর ঝাপসা চোখে নকশি তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে৷ ফর্সা হাত,পা আর মুখটা একদম সবুজাভ বর্ণ ধারণ করেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে হয়ত মেয়েটা মৃত। অনেকে বলে সাপে কামড়ালে এমন গায়ের রঙ হয়ে যায়। নকশির দম ফুরিয়ে আসছে মেয়েকে দেখে। কোন কিছু জিজ্ঞেস করার মত সে খুঁজেই পেল না। অনেকটা সময় পার হলো তার নিজেকে ধাতস্থ করতে। জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় সে একা, নরক যন্ত্রণা সয়ে জীবনটাকে এ পর্যন্ত এনেছে। কখনো ভেঙে পড়েছে, আবার কখনো সামলে গিয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে পাওয়া চরিত্র নিযে যে কুৎসা তাকে ঘরছাড়া, স্বামীহারা করেছিল তাতেও সে নিজেকে সামলে গড়ে নিয়েছিল একরকম৷ গর্ভে আসা সন্তানটাকে তার পিতৃপরিচয়হীন বড় করতে হবে জেনেও নিজেকে সামলে নিয়েছে নিয়তি ভেবে। অথচ আজ এই মেয়েটাকে এমন মৃতের মত দেখার পর আর তার নিজেকে সামলানোর শক্তি পাচ্ছে না। ঠিক পনেরোটা বছরেরও বেশি সময় সে আহসানুল্লাহ ভাইয়ের ছায়ায় ঠাঁই নিয়েছে। সেজন্য যতোই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক কম হবে। আজও তার সবচেয়ে বেশি ভরসার জায়গা ওই মানুষ আর তার পরিবার। কিন্তু তবুও আজ আর সামলানোর শক্তি আর খুঁজে পাচ্ছে না। মন বলছে যে করেই হোক মরণ চাই তার।
কুয়াশা কাটতেই সূর্যকিরণের দেখা মিলল বাড়ির আঙিনায়। শিউলির শ্বশুর বাড়িতে ধুমধামে বৌভাতের আয়োজন চলছে। জামিলও ভোরবেলা থেকে বাবুর্চিদের কাজে তদারকি করছে তার বড় ভাইয়ের সাথে। কনেপক্ষের আত্মীয়রা হয়ত আসবে না তেমন কেউ আলতার দূর্ঘটনার পর কিন্তু জামিলদের আত্মীয়স্বজন তো আর বাদ যাবে না। তাই আয়োজন ঠিকই হচ্ছে। আলতার খবর পাওয়ার পর ভোরের আগেই শিউলি ঘুমিয়েছে তাই জামিল আর ডাকেনি। শিউলি জেগে গেলেই তাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি রওনা হবে ভেবেছিল কিন্তু সকালে আবার শরতকে ফোন করলে সে জানালো আলতার অবস্থা ভালো না। জ্ঞান ফিরলেও তার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। হয়ত প্রয়োজনে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে হতে পারে৷ সব শুনে জামিল ঠিক করেছে সে শিউলিকে নিয়ে হাসপাতালেই যাবে আলতাকে দেখতে।
পদ্মদিঘি গ্রামে সকাল হতেই এক গুমোট হাওয়া বইলো। এ হাওয়া প্রকৃতির নয় মানুষের চাপা গুঞ্জনের। শাওন মাস্টারের ভাগ্নিকে তুলে নিয়ে গেছে আর পথেই এক্সিডেন্টে সে মারা গেছে। শাওনের মৃত্যুতে তার পরিবার শোকাহত হলেও গ্রামের মানুষজনের শোক মাস্টারের ভাগ্নির জন্য। তাঁরা মাস্টারকে খুব সম্মান করে নকশিকে খুব ভালোবাসে আর তাদের বাড়ির মেয়ে হিসেবেই আলতার জন্য সবাই আফসোস করছে। তবে সকল ভালোর মাঝে একদল নিন্দুক থাকবে না তা কি করে হয়! গ্রামেও আছে কয়েকজন যারা শাওনের বাবার টাকা খেয়ে তার আগেপিছে ঘুরাঘুরি করতো৷ ইলেকশন ছিল বলে পা চাটা কুকুরের মতোই দিনরাত তার পাশে থেকে পকেট গরম করেছিল। সেই মানুষগুলো আবার বলে বসেছে আলতার একটা গোপন সম্পর্ক ছিল শাওনের সাথে। দুজন পালিয়ে যাচ্ছিল আর সেই যাওয়ার পথেই দূর্ঘটনায় শাওন মারা গেছে। আলতা বেঁচে আছে বলেই হয়ত আলতার পরিবার সকল দোষ মৃত শাওনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এই কথাগুলো গ্রামের অন্যরা বিশ্বাস করছে না তবুও নিন্দুকের কাজ নিন্দা করা তাই করছে। শাওনের পরিবার অবশ্য এখন ছেলে হারানোর শোকে কাতর। তারা আপাতত কোন বিষয়েই মুখ খুলছে না। পুলিশ এসেছে বাড়িতে লাশের সাথেই। কোন প্রকার কথাবার্তা তারা বলছে না। মৃতের ওপর কেস কি করা! ভেবেই আহসানুল্লাহ আর পুলিশি কোন মামলায় জড়াতে চাইছে না বলে জানিয়েছে।
“কাশেম বাড়িতে আছোছ?”
বেলা গড়িয়ে রোদ উঠেছে একটু আগেই। কুয়াশার চাদর সরতেই মাঠ ঘাটে সোনালি রোদ টুনটুনি আর চড়ুইয়ের মতন প্রকৃতিতে নেচে বেড়াচ্ছে। ঝকঝকে দিনটার শুরু আওলাদের প্রচণ্ড কাঁপুনি দেওয়া জ্বরেই শুরু হয়েছিল৷ তবুও সে জ্বরকে পাত্তা না দিয়ে আগে ছেলের ঘরে ঢুকে দেখল জ্বর কমেছে কিনা। ছেলের জ্বর সেরে গেছে এক রাতেই। ঔষধটা বড় ভালো ছিল জব্বর ডাক্তারের তা দেখে সে নিজেও একটা ঔষধ খেয়ে নিয়েছে নাশতা শেষে৷ আশা করছে তার জ্বরটাও শিগগিরই নামবে৷ কিন্তু চোখ দুটোতে ভীষণ জ্বালা আর মনটাতেও বড় অস্থিরতা। হাসফাস করছে বড় বুকের ভেতরটাতে। কাল রাতে কে জানে কার কলিজার টুকরোকে সে বাঁচাতে নেমেছিল পানিতে কিন্তু রাতভর তার ঘুম হয়নি। ছটফট করেছে বিছানায় আর একটু পরপরই নকশির কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে নকশির সাথে হওয়া শেষবারের ফোনালাপ। তার মা নকশির নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে আর সেই অপবাদে শালিসি বসিয়েছিল। নকশি পালিয়ে গিয়েছিল গ্রাম থেকে আর তাকে সাহায্য করেছিল তারই ভাতিজা সবুজ। দেশে ফিরেছিল আওলাদ বড় তিক্ত মন নিয়ে কিন্তু গ্রামে আসার পরই সকল সত্য তার সামনে এসেছে। মৃত্যুর আগে তার মা সব স্বীকারও করে গেছেন কিন্তু ততদিনে নকশির কোন খোঁজ সে আর বের করতে পারেনি। খোঁজ করেছে নকশির বাবার বাড়িতেও সেখানেও সে আর কখনো ফিরে আসেনি৷ মা তো তার মরার আগে আরো একটা কথা বলেছিল, “তোর বউয়ের গতরখান দেইখা মনে হইছিল বালা না বেশি। পোয়াতি পোয়াতি মনে হইছিল দুই একবার পরে দেহি বেটি খায়দায় বালোই।”
ব্যথাভরা মনে আওলাদের বারবার মনে হয়েছিল নকশি হয়তো সত্যিই গর্ভবতী আবার মনে হতো কি করে সম্ভব! তাদের বিয়ের তো কয়েক মাস হয়ে গিয়েছিল। সে বিদেশে যাওয়ার পরও দু মাস পার হলো কিন্তু নকশি তো কোনদিনো কিছু বলেনি। নাকি মা সবসময় তার পাশে বসে থাকত বলেই বলতে পারেনি! অর্ধেকটা রাত আওলাদের নানা দূর্ভাবনায় ছটফটিয়ে কেটে গিয়েছিল। সকাল হতেই তার মনে পড়লো কালকে পানি থেকে তোলা মেয়েটার কথা। আল্লাহ জানে কার কলিজার টুকরা অমন মরার পথে ছিল। মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা তাও জানে না তাই এই জ্বর শরীরকে ঔষধের ঘুষ দিয়ে বেরিয়ে এসছে বাড়ি থেকে৷ কাশেম বাড়িতে নেই তার বউ বলল। বাজারেই আছে কোথাও ভেবে আওলাদ আবার এগোলো বাজারের দিকে। কসাইয়ের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসা কাশেম আর গ্রামের আরো কিছু লোক বসে রাতের ঘটনাই আলোচনা করছিল। গ্রামের সবার মুখেই আওলাদ এখন আলোচ্য। কাশেমকে দেখে সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, “মাইয়াটা কি বাঁইচা আছে রে কাশেম?”
“শুনলাম তো বাঁইচা আছে। আমাগো এইখানকার হাসপাতালেই ভর্তি।” কাশেম জবাব দিল। অন্যরাও সাথে বলল, “মাইয়ার বাড়ি পদ্মদিঘি সেখানকার মাস্টারের ভাগ্নি।”
মাস্টার বাড়ির মাস্টারকে মোটামুটি আশেপাশের এলাকার অনেকেই চেনে। আওলাদ নিজেও পরিচিত আহসানুল্লাহ মাস্টারের সাথে। আওলাদের বড় ভাই আউয়াল আর আহসানুল্লাহ কোনভাবে পূর্ব পরিচিত সেই সুবাদেই আহসানুল্লাহ এই গ্রামে অনেকবার এসেছিল৷ আওলাদ চেনে তাকে তার পরিবারের কথাও জানে একটু আধটু কিন্তু বোন আছে এমন শোনেনি কখনও৷ মাস্টার বাড়িতে দুই ভাই ছিল মাস্টাররা তাও জানে। কিন্তু তার জানার বিষয় না মাস্টারের বোন আছে কি নেই। তার শুধু মনে হলো যাকে কাল মরণপথ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করেছে তাকে একবার দেখে এলে মন শান্ত হবে৷ বিধাতারই কোন ইচ্ছে হবে হয়ত এটা নইলে কেন তার অন্তর এত বছর পর অতীতের মানুষটাকে ভেবে অস্থির হচ্ছে। কিসের সাথে কিসের যোগসাজশ তার জানা নেই৷ তবুও বন্ধুকে বলল, “চল একবার মাইয়াটারে দেইখা আসি৷”
কাশেমও বোধহয় একবার যাবে বলে ভেবে রেখেছিল৷ তাই আওলাদের একবার বলাতেই সে উঠে দাঁড়ালো। বাজার থেকে হাসপাতালের দূরত্ব খুব বেশি নয়৷ তাই হেঁটেই দুজন রওনা হলো। মিনিট পাঁচেক পর হাসপাতালে এসে নিচতলায় এক নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, “কাল রাতের পানিতে পড়া রোগী দোতলায় আছে।”
আওলাদ হঠাৎ বলল, “তুই যা গিয়া খোঁজ উপরে কোন ঘরটাতে আছে আমি এক প্যাকেট রুটি আর কলা নিয়া আসি।”
কাশেম সম্মতি জানিয়ে উপরে গেল। আওলাদ আবার বের হয়ে গেল রুটি কলা কিনতে। দোতলায় উঠতেই একজনকে দেখে জিজ্ঞেস করতেই লোকটা দেখিয়ে দিল একদম শেষের রুমে আছে সেই রুগী। কয়েক কদম এগিয়ে সে দরজায় এসে দাঁড়াতেই কাশেম থমকে গেল। তার চোখ আটকে রইলো বেডের পাশে চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসা নকশির মুখের দিকে। কতগুলো বছর আগে দেখা সেই মুখ চিনতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আগের মতোই পাতলা ছিপছিপে দেহের মেয়েটি শুধু চেহারায় ভারী একটা ছাপ। কাশেম যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কি করে সম্ভব!
“আওলাদের বউ নকশি না তুমি?” কন্ঠস্বরটা কানে আসতেই কেবিনে উপস্থিত থাকা শিশির, নকশি আর শরত তিনজনেই চমকে তাকাল। শরত আর শিশির কিছু বুঝতে না পারলেও নকশির চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে মনে মনে চাইছিল ওই মানুষটা তো দূর মানুষটার পরিচতরাও যেন তার খোঁজ না পায়। আর তারই বন্ধুই কিনা দেখে ফেলল! নকশি তবুও চাইল এ পর্যন্তই থাক আর কেউ না জানুক। নিস্তেজ গলাটাতে জোর করেই স্বর টেনে বলল, “কাশেম ভাই কাউরে বইলেন ন…”
কাশেমের পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির মুখ দেখতেই কথা অসম্পূর্ণ থেকে গেল নকশির।
চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)
ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২১
রোগীর অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হওয়ায় ডাক্তাররা তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলল। ছোটখাটো হাসপাতাল এখানে এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা নেই৷ উপজেলা হাসপাতাল থেকে জরুরি ভিত্তিতে এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করিয়ে দুপুরের আগেই ঢাকায় রওনা দিতে হবে আলতাকে নিয়ে। শিউলি আর জামিল এসে সকালে আলতাকে দেখে চলে গেছে। ঢাকায় সবাইকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু এই মুহুর্তে ছুটোছুটির একটা ব্যপার আছে বলেই শরত আর শিশির আহসানুল্লাহকে বাড়িতেই থাকতে বলল। এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার সময়ই শরত একবার বাড়ি গেল। টাকা পয়সা কিছু নিজেও নিলো সাথে আহসানুল্লাহও কিছু জোগাড় করে দিল। মাত্রই বাড়িতে বিয়ে গেল এতে সবারই পকেট ফাঁকা। ধার করেই সে শরতের হাতে দিল। শিফাও দ্রুত হাতে কয়েকটা কাপড় একটা ব্যাগে ভরে দিল নকশি আর আলতার। জয়তুন একটু বেশিই ভেঙে পড়েছে। সে কখনো মুখে প্রকাশ করেনি আলতাকে সে কতোটা স্নেহ করে কিন্তু আলতার এমন পরিণতি তাকে খুব দুঃখ দিল। শিউলি আর নতুন জামাই আসবে এতেও হেলাফেলা করা যায় না ভেবেই শরত মাকে জিজ্ঞেস করলো প্রয়োজনীয় কিছু আনা বাকি থাকলে কাকাকে দিয়ে যেন আনিয়ে নেয়। সে আর শিশির দুজনেই ঢাকায় যাচ্ছে আলতার সাথে। জয়তুনের সমস্যা নেই ছেলে সহযোগিতা করুক যেভাবে পারে। নকশি বিধবা না হলেও তার মতই বিধবা জীবনই পার করছে। সে বোঝে স্বামীহারা নারীর দুঃখ। দুঃসময়ে কি করে যে নিজেকে সামলাতে হয় তার চেয়ে ভালো আর কে জানে! এই ভেবেই সে নকশিকে স্নেহ করে এসেছে এত বছর। সাধ্যমত সাহায্যও করে গেছে তাই শরতকেও কখনো বাঁধা দেয়নি নকশির সাহায্য করতে৷ কিন্তু শরতের মামী হঠাৎ বাঁধ সাধলো। সে জয়তুনকে একটু বাজে ইঙ্গিতই দিতে চাইল বোধহয়।
“আপা দরকার কি অত যার তার লগে পোলারে পাঠানের?”
জয়তুন বুঝলো না তার ভাইয়ের বউয়ের কথা। রান্নাঘরে বসে তরকারি কাটছিলো জয়তুন রাতের জন্য। বাড়িতে যত বিপদই থাক নতুন জামাইর জন্য রান্না তো ঠিকঠাক করতেই হবে৷ আর দু দিন ধরে মাংস, পোলাও তো চলছেই তাই সে ভাবছিল রাতে ভাত আর সবজিও রাখবে দু পদের। পাশে বসেই তার ভাইয়ের বউ চালের কণা বাছতে বাছতে কথাটা বলেছে। জয়তুন সাদাসিধা চিন্তাধারা পোষণ করে। সে সরাসরিই বলল, ” যার তার লগে হইবো ক্যা গো নকশি আর আলতা তো পর না।”
“আপনও না আপা। দুলাভাইয়ের কেমন বইন জানি। আশ্রয় দিছেন তাই অনেক বেশি। ওই মাইয়া তো বয়স বেশি না আবার তারও একটা মাইয়া আছে। জামাইছাড়া মাইয়া লোকের চরিত্র ভালা থাকে না। আর আমগো শরত তো মাশাআল্লাহ বড় হইয়া গেছে।”
“জামাইছাড়া কইতে কি বুঝাইলা ময়না? আমিও বিধবা হইছি, জামাইছাড়া এত্ত জীবন কাটাইলাম৷ ”
ময়না বরাবরই বেফাঁস কথা বলে আর এ কারণে সে মারও খায় তার স্বামীর হাতে। আজ ভাগ্য ভালো সামনে জয়তুনের ভাই নেই কিন্তু জয়তুনের রক্তচক্ষু দেখেই ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেল ময়না। শরত চলে গেছে হাসপাতালের উদ্দশ্যে।
“এই অবস্থায় আর বাঁধা দিও না নকশি বইন৷ আওলাদ তো নিজেও অনেক কষ্ট পাইছে তোমারে হারাইয়া। আর এত বছর পর সন্তানের কথা জানার পর তার কেমন কষ্ট হইতাছে তুমি বুঝবা না।” কাশেম খুব করে বোঝাতে চাইছে নকশিকে যেন আওলাদকে সাথে নিয়ে যায়। সকালে যখন কাশেমের পেছনে আওলাদকে দেখলো নকশি তখনই আতকে উঠেছিল। কেন আঁতকে উঠেছে তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু আওলাদের মুখটা দেখার মত হয়েছিল। নিজের পছন্দ করা মেয়ে ছিল নকশি তার জীবনে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও সে নকশিকে প্রথম দেখাতেই ভালো বেসেছিল। বিয়ে করে বাড়ি এনেও ছোট্ট নকশিকে পুতুলের মত করে রাখার শখ ছিল তার কিন্তু অভাব ঘুচিয়ে সংসার সাজানোর ইচ্ছেটা তাকে পরদেশী করলো। এরপরই মায়ের প্ররচোনায় হয়ত নিজের মনেরও দূর্বল শংকা তার থেকে নকশিকে দূর করলো। সে হয়ত চাইলেই একটু জোর খাটিয়ে মাকে সাবধান করতে পারত। কিন্তু ভিনদেশে থেকে মনে হাজারটা ভয় ছিল এই বুঝি মা ঠিক বলছে। আবার মনে হতো বউয়ের ইচ্ছেটাও সৎ। কিন্তু তার প্রথম সমস্যাই ছিল সুন্দরী বউ বাড়ি রেখে এসেছে। নকশির প্রতি তার বিশ্বাসের কমতিই ছিল তাদের জীবনে দূর্যোগ নেমে আসার প্রধান কারণ। আওলাদ নকশিকে দেখে ভেবেছিল হয়ত নকশি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে আর আলতা সেই সংসারেরই মেয়ে। না চাইতেও তার মন বাঁধা দিচ্ছিল আলতার দিকে তাকাতে কিন্তু কাশেমের একটা কথা তাকে মর্মাহত করে দিল।
“নাক আর থুতনা তো পুরাই আওলাদের মত হইছে মাইয়ার। এত মিল বাপের লগে৷ মাশাআল্লাহ! ” কাশেম কথাটা বলতেই আওলাদ চমকে তাকায় নকশির দিকে। এটা তার মেয়ে! ভাবতেই গায়ে কাটা দেয় তার সন্তান এটা আর সে জানেই না! কাশেম আওলাদের হাত ধরে বলে, “আওলাদরে চাচী এতবছর যা কইয়া বেড়াইছে সব মিছা দ্যাখ মাইয়ার মুখটা।”
আওলাদ মাথা নিচু করে ফেলল। তার মা সারা পাড়ায় রটিয়েছে আওলাদ বিদেশ যাওয়ার পরই নকশি পরপুরুষের সাথে উঠছে, বসছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে রাত বিরাতে এলাকার অনেক পোলার লগে রাত কাটিয়েছে এমন অনেক অশ্লীল কথাই কানে তুলেছে। তবুও আওলাদের মন তার বিরোধ করেনি। সে নকশিকে আজও ভালোবাসে আর সে কারণেই মায়ের কথায় সে তালাকনামাও সই করেনি আজও৷ দেশের আসার পরও সে খুঁজেছে নকশিকে কিন্তু একটা মানুষ যখন নিজে থেকে লুকায় তখন তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। সবার ধারণা ছিল নকশি কোন একদিন ফিরে আসবে তার বাড়ি না হোক অন্তত নিজের বাপের বাড়ি যোগাযোগ করবে৷ সেই আশাতেই আওলাদ আজও নকশির বাপের বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে খোঁজ নেয়। নকশি তো সেখানেও কোন সম্পর্ক রাখেনি৷ নকশির বাবাও মরার আগে অনুতাপে জ্বলেছেন। মেয়েটার কথা কেন সেদিন শোনেনি! শুনলে হয়ত মেয়েটাকে মৃত্যুর আগে দেখার সাধ পূরণ করতে পারতেন। আজ নকশিকে দেখে নিজেকে যতটা সামলে রাখতে চেয়েছিল আওলাদ ঠিক ততোটাই ভেঙে পড়েছে আলতাকে দেখে। আলতা তার মেয়ে তাতো যে কেউ এক দেখাতেই বলতে পারবে। গায়ের রঙটা বাদ দিলে মুখশ্রী তো মেয়েটা তার বাবারই পেয়েছে। আওলাদের মত লম্বা চওড়া দেহের গড়ন এটাও মেয়েটা তার বাবার পেয়েছে। মেয়েটার মুখ দেখার পর অঝোরে কেঁদেছে আওলাদ। পাশেই দাঁড়ানো শিশির অবাক হয়ে দেখেছে সে কান্না আর মনে মনে বলেছিল, “সুস্থ হয়ে ওঠ আলতা। তোর বাবাকে দেখ কত কাঁদছে তোর জন্য। ওঠে দ্যাখ তোর সুন্দর একটা পরিবার হবে৷ তুই না থাকলে কি করে হবে বলতো পাখি! তোর কিছু হলে আমরা সবাই পাগল হয়ে যাবো রে।” সকল দুঃখ শিশির মনে চেপে অপলক দেখেছে একজন পুরুষের সব থাকার পরও হারানোর কান্না। ডাক্তার যখন বলল, এ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে পেশেন্টকে নিতে হবে তখন আওলাদ নকশির দিকে তাকিয়ে আকুতিভরা গলায় বলেছিল সেও যাবে। তৎক্ষনাৎ নকশি কোন জবাব দিতে পারেনি। কিছুটা সময় নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, ” দরকার নেই আপনার আসার। আমাকে সাহায্য করার জন্য মানুষ আছে আপনি চলে যান। আপনার স্ত্রী -সন্তানরা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে আপনার।”
আওলাদ কান্নামাখা গলায় খুব করে অনুরোধ করলো নকশিকে কিন্তু সে মানছে না বলেই কাশেমও অনুরোধ করছে। তাদের কথার মাঝেই দুজন লোক স্ট্রেচারে করে আলতাকে নিয়ে গেল। শিশিরও সেখানে না থেকে নিচে গেল তাদের সাথে। শরত আসতেই হাসপাতালের সামনে পেল শিশিরকে । সে নকশির কথা জিজ্ঞেস করতেই শিশির সংক্ষেপে বলল আওলাদ তাদের সাথে যেতে চাইছে কিন্তু নকশি রাজী হচ্ছে না। শরত কি মনে করে হাতে থাকা কাপড়ের ব্যাগটা শিশিরকে দিয়ে বলল, “তুই এখানেই থাক আমি একটু আসছি।”
শরত দোতলায় যাওয়ার পথে দেখলো নকশি নামছে তার পিছু পিছু আওলাদ আর কাশেম৷ আওলাদের চোখ, মুখ তখনও ভেজা অশ্রুজলে। শরত ডাকলো, “ফুপুআম্মা একটা কথা ছিল।”
“বলো শরত।”
শরত খেয়াল করলো সিঁড়ির দিকে কেউ আছে কিনা! কাউকে না দেখে বলল, “কিছু মনে করবেন না ফুপুবম্মা উনি যেতে চাইছেন সঙ্গে অনুমতি দিন। উনি আলতার বাবা সে হিসেবে নিজের মেয়ের এ অবস্থায় পাশে থাকতে না দেওয়াটা অন্যায় হবে। ছোট মুখে বড় কথা বলছি আমি জানি তবুও ফুপুআম্মা এ সময়টা একটু বুঝুন।”
শরতের এইটুকু কথার মাঝেই আরো কিছু কথার ইঙ্গিত ছিল তা যেন নকশি বুঝলো। সত্যিই তো নিজেদের মধ্যে যা আছে তা পরেও ভাবা যাবে। মেয়েটা তো তার একার নয়। পরিস্থিতির কারণেই আওলাদ এত বছর তার সন্তানের খোঁজ জানতে পারেনি। আজ আলতার যা অবস্থা… মনে পরতেই নকশি আর বাড়াবাড়ি করলো না। ধীর স্বরে শুধু বলল, “আসতে বলো শরত।”
নকশি আর দাঁড়ায়নি। সে নিচে চলে যেতে শরতও আওলাদের উদ্দেশ্যে বলল, আসুন আপনি।”
আওলাদের অশ্রুসিক্ত মেঘাচ্ছন্ন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল অনুমতি পেয়ে। সে হাসি হাসি মুখে কাশেমকে বলল, “ভাই আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবি? আছে তোর কাছে?”
“না রে আওলাদ লগে কোনো টেকা নাই। তয় তোর না মোবাইলে বিকাশ আছে৷ আমি তোর নাম্বারে পাঠানোর ব্যবস্থা কইরা দিমু চিন্তা করিস না।” কথাটা বলেই কাশেম তার পকেট হাতড়ে দুশো পঞ্চাশ টাকা পেল। বলল এইটা নগদ রাখ আর আমি এহনই টাকার ব্যবস্থা কইরা আরমানের দোকানে গিয়া পাঠাই দিমু।” কাশেম কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল। আওলাদ কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে বন্ধুটির দিকে একবার তাকিয়ে সেও বের হলো।
এ্যাম্বুলেন্সে সবাই উঠে বসেছে শরত বাকি শুধু। সে হাসপাতালের কিছু টাকা পরিশোধ করার ছিল তাই করছে। শরত আসতেই এ্যাম্বুলেন্স চলল ঢাকার উদ্দেশ্যে।
চলবে
ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব- ২২
ইমারজেন্সি কেবিনে রাখা হয়েছে আলতাকে। গ্রামের হাসপাতাল থেকে একটা ছোট্ট চিঠি দিয়েছিল ডাক্তার শরতের কাছে। সেই চিঠিটা দেখামাত্রই তারা রোগীর ট্রিটমেন্ট শুরু করবে এমনটাই বলেছে ডাক্তার সাহেব। শরতও তাই করেছে কাগজটা এনেই রিসেপশনে দেখানো হয়েছে। কাজ হয়েছে ; রোগীকে ইমারজেন্সি কেবিনে শিফট করে ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে। আলতার সমস্যা ডবল নিউমোনিয়া, ফুসফুসেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূলত পানির নিচে টানা কয়েকমিনিট থাকার ফলেই নাক দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। মুখ আর হাত, পা তো তার বাঁধা অবস্থাতেই ছিল। ডাক্তাররা বিভিন্নরকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানালো রোগীর একবার জ্ঞান ফিরে পুনরায় আবার বেহুশ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। নকশি ভেঙে পড়েছে এবার। যতখানি ভরসা নিয়ে সে নিজেকে কঠিন রাখতে চাইছিল এবার আর তা হলো না। অতিরিক্ত টেনশনে মূর্ছা গেল সে। আওলাদ এসে তাকে ধরতে গিয়েও সংকোচে পড়লো। শিশির এক হাতে নকশিকে ধরে শরতকে ফোন দিল৷ শরত একটা কেবিনের জন্য কথা বলতে গিয়েছে। সরকারি হাসপাতাল এখানে একটা সিট পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার সেখানে কেবিন তো বড় কিছু। তবুও চাইছিলো চেষ্টা করে একটা ব্যবস্থা হয় কিনা। সুপ্রসন্ন ভাগ্য বলা যায় তাদের। এক ওয়ার্ডবয়কে পাঁচশ টাকা দিয়ে কেবিনের ব্যবস্থা করানো গেল। পাঁচশ টাকার বাইরেও আরো পঞ্চাশ টাকা দিল শরত চা খেতে তারপর বলল একটু খেয়াল রেখো৷ যার অর্থ তাতেও তোমাকে কিছু কিছু দেওয়া হবে। ওয়ার্ডবয় এক ঘন্টা পর কেবিনের ব্যবস্থা তো করলো সাথে আরো একজনকে নিয়ে এলো বিনিময়ে তাকেও আরো পাঁচশ দিতে হলো। কত কত মানুষ সিট না পেয়ে ফ্লোরেই বিছানা পেতে রোগী নিয়ে বসে আছে। শরতের খারাপ লাগছে এভাবে টাকা খাইয়ে নিজেদের জন্য জায়গা করতে তবুও বিপদে অত ভেবেও পোষাবে না। শিশিরের ফোন পেয়ে সে দ্রুত এলো আগের জায়গায়। এখানে স্ট্রেচার জোগাড় করা সম্ভব নয় ফুপুআম্মাকে কি করে নিয়ে যাবে কেবিন পর্যন্ত! আওলাদের মুখে প্রায় চলে এলো কথাটা, “আমি কোলে তুলেই নিয়ে যাচ্ছি চলো।” কিন্তু বলার সাহস আর দেখালো না সে। শরত কিছু সময় ভেবে বলল, “আমিই নিচ্ছি ফুপুআম্মাকে তুই ব্যাগ নিয়ে আয়। আপনিও আসুন।”
শরত পাঁজা কোলে নিয়ে নিল নকশিকে। কেবিনে এনে বেডে শুইয়ে দিয়ে শিশিরকে বলল, ” তুই গিয়ে বাইরে থেকে স্যালাইন আর কিছু ফল নিয়ে আয়। সম্ভবত দূর্বলতার কারণে এমন জ্ঞান হারাচ্ছেন। আমি দেখি ডাক্তার ডাকা যায় কিনা!” শরত মনে মনে ভাবছে আলতাকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এখন অর্থে কুলাবে না।
বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। শিশির হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে চারপাশে নজর বুলালো। কতশত মানুষ চারপাশে। কোলাহল পূর্ণ পথঘাট। সবাই কত ব্যস্ত চারপাশে কেউ নিজের জন্য কেউ আপনজনদের জন্য । শিশির নিজেই শুধু ব্যস্ত নয়। তার এই ছুটোছুটি কিছুই গায়ে লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে ওই মেয়েটা বেঁচে যাক সে এমন আরো অসংখ্যবার ছুটোছুটি করবে৷ শুধু আলতা ভালো হয়ে যাক। ভেতরটা ফেঁপে আছে শিশিরের। সে প্রথম যখন আলতার মুখটা দেখলো হাসপাতালে এসে তখন তার অবস্থা ছিল ভেতর থেকে অসাড়। কষ্টটা কারো সামনে প্রকাশ করার অধিকারটুকুও তার ছিল না।কিন্তু এখন যখন বের হলো খাবারের জন্য তখন মন বলল কেঁদে ফেলো এখানেই। দেখুক লোকে তাতে তোমার কি যায় আসে! তোমার প্রিয় মানুষটা মৃত্যুর সাথে লড়ছে তুমি কেন কাঁদবে না! কিন্তু না পুরুষদের কাঁদতে নেই। সে পারলো না কান্না করতে। সকাল থেকেই তারা সবাই না খেয়ে আছে তাই হোটেল থেকে খিচুড়ি, ডিম নিয়ে পাউরুটি আর কলাও নিলো। মনে করে কয়েক প্যাকেট স্যালাইনও কিনে নিল সে।
রাতে আওলাদ শিশিরকে বলল, “বাবা আমি একটু বাইরে যামু ফোনে থাইকা কিছু ট্যাকা তুলমু।তুমি কি কোনো দোকান দেখছো আশেপাশে ট্যাকা তুলন যায় এমন?”
শিশিরে মনে পড়ছে না সে তেমন কোন শপ দেখেছে কিনা। আবার মনে পড়লো একটা ফ্লেক্সিলোড এর শপ দেখেছে। সেখানে ক্যাশআউট করা যাবে কিনা কে জানে!
“আপনি কি বিকাশ, নগদ তেমন কোন একাউন্ট থেকে টাকা তুলবেন?”
“হ বাবা।”
“আচ্ছা আমার সাথে আসেন খুঁজে দেখছি।”
নকশির জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু দূর্বলতার কারণে বেডে শুয়ে আছে। তার চোখের কোণ বেয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছেই। শরত সবচেয়ে বেশি ছুটোছুটি করেছে বলে ক্লান্তিতে এখন আর শরীরে সইছে না। সে চেয়ারে বসে চোখ বুঁজেছে একটু৷ শিশির আর তাকে ডেকে কিছু না বলেই আওলাদকে নিয়ে গেল। একটা শপ পেয়ে সেখানে টাকা ক্যাশআউট করে নিল আওলাদ। কাশেম সত্যিই জোগাড় করে পাঠিয়েছে দশ হাজার টাকা। এরই মাঝে আওলাদের বড় ছেলে ফোন করে দুবার জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায় বাড়ি যাচ্ছে না কেন। কোন এক কাজে ঢাকায় এসেছে বলে কাটিয়ে দিয়েছে। শিশির চুপচাপ সবটা শুনে ভাবছে আলতার জন্য সে ভেবেছিল এবার বাবা পাবে মেয়েটা। কিন্তু না তার পোড়া কপাল তাইতো বাবা পেয়েও পাবে না। থাক আমার আলতার জন্য আমি, আমার পরিবার আর ফুপুআম্মাই যথেষ্ট। এই লোকটা হঠাৎ এসেই আমাদের আপন হয়ে উঠতে পারবেন না আর দরকারও নেই এমনটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আওলাদ টাকাগুলো পকেটে ঢুকিয়ে শিশিরকে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু খাইবা বাবা?”
“না চলুন হাসপাতালে যাই।”
“আমার মাইয়াডা সুস্থ হইবো না বাবা?” আওলাদের গলা কাঁপছে সে কথাটা বলতে গিয়ে কান্নার একটা ঢোক গিলল। শিশির তাকালো লোকটার দিকে৷ মুখটা দেখতেই কেমন যেন লাগে। আলতা হুবহু এমনই হয়েছে। বাপের আদলে মেয়ের মুখশ্রী। ফুপুআম্মার জীবনে কি ঘটেছে সে জানে না তবে খুব বড় কিছুই ঘটেছিল আন্দাজ করা যায় নইলে একটা লোক কেন পনেরো বছর পর জানবে স্ত্রীর গর্ভে তার সন্তান ছিল! ভাগ্য যে নির্মম কোন পরিহাস করেই তাদের আলাদা করেছে তা বুঝতে বাকি নেই কিন্তু হঠাৎ আসা লোকটাকে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায় তাও জানে না শিশির। শুধু বলল, “আল্লাহই ভালো জানে। দোয়া করুন সেটাই কাজে লাগবে। ফিরে গেল দুজন হাসপাতালে। শরত কেবিনের বাইরে হাটাহাটি করছিল। শিশির আর আওলাদকে দেখতেই বলল, ” আলতা চোখ খুলেছে ডাক্তার বলল বিপদ হয়ত কেটেই গেছে বাকিটা আল্লাহর ওপর।”
“আলহামদুলিল্লাহ ” বলেই আওলাদ জানতে চাইলো একবার দেখা যাবে কিনা৷ তার এ কথায় শরত আর শিশির দুজনেই তাকালো আওলাদের দিকে। আলতা তাকে দেখলে প্রশ্ন করতে পারে, কথা বলতে পারে আপাতত এমনটা হয়ত না করাই ভাল। আওলাদ বুঝতে পারলো সে মন খারাপ করে পায়চারী করতে লাগল কেবিনটার সামনেই। নকশি দেখে এলো আলতাকে এসেই আবার কান্না জুড়ে দিল। এইটুকুনি মেয়ে তার যমের সাথে লড়েছে। তার কান্না দেখে শরত বলল, “ফুপুআম্মা শুকরিয়া আদায় করবেন না আল্লাহর? নামাজ পড়েন আমরা বাইরে যাচ্ছি।”
রাতের অর্ধেকটা নকশির নামাজ আর দোয়া দুরুদেই কাটল। তারপরই সে কেবিন থেকে বেরিয়ে শরত, শিশিরকে বলল, “তোমরা দুইজন একটু শুয়ে নেও। কাল থেকে দুজনেই একটু খানি বসার সুযোগও পাওনি। তোমরাই তো আমার শেষ ভরসা তোমরা অসুস্থ হয়ে গেলে আমি কার কাছে হাত ফেলবো?”
“এমন করে বলবেন না ফুপুআম্মা। হাত ফেলবেন কেন আপনি আমাদের ওপর আপনার অধিকার আছে না! আর কখনও এমন কথা বলবেন না।”
শরত একটু রাগী মুখ করেই বলল। আওলাদ শুনলো সব কথা আর মনে মনে সংকুচিত হয়ে গেল। তার স্ত্রী, তার সন্তান অথচ আজ এই বিপদে তার কাছে কিছু বলার মত নেই তার স্ত্রীর। সে যেন সম্পূর্ণ অচেনা এক মানুষ এখানে। রাতটা বড় উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস আর উপরওয়ালার শুকরিয়া করেই কেটে গেল সবার। ভোরের দিকে শিশির একটু বেডে শুয়েছিল তারও কিছু পরে শরত গা এলিয়ে দিয়েছে। নকশি আর আওলাদ বাইরে গিয়ে হেটেছে কিছুক্ষণ আবার আলতাকে রাখা ইমারজেন্সি রুমটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আওলাদ কয়েকবার কথা বলতে চেয়েও পারেনি৷ অপরাধবোধ তার অস্থিমজ্জায় গেঁড়ে বসেছে খুব করে।
গ্রাম থেকে ফোন এসেছিল রাতেই সবাই তখনো খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। সকালে জেগেই শরত আলতার খোঁজ নিয়ে আবার বাড়িতে জানিয়ে দিল আলতা এখন ভালো আছে। হয়ত আরো দুদিন রেখে তবেই ফিরতে হবে বাড়িতে। শরতের দোকানে কর্মচারী হিসেবে এলাকারই বিশ্বস্ত এক ছেলেকে রেখেছিল। দোকানটা তার আগের চেয়েও অনেক বড় হয়েছে, নিরলস পরিশ্রমের ফল হিসেবে তার দোকানে বেঁচাকেনার উন্নতি চৌগুণ। সেকারণেই সম্প্রতি একজনকে রেখেছিল কিন্তু সকালেই আহসানুল্লাহ দোকানে গিয়ে দেখলো দোকানের তালা ঝুলে আছে কিন্তু তা লাগানো না। সন্দেহবশেই সে এগিয়ে দোকানটার কাছে গিয়ে বুঝলো দেকানের ভেতর বাতি জ্বলছে অথচ বিয়ে উপলক্ষে তিনদিন দোকান বন্ধ থাকবে। এমন ভেবে শরত নিজেই শিউলির গায়ে হলুদের আগের রাতে ভালোভাবে সব বাতি, ফ্যান বন্ধ করেছিল আহসানুল্লাহর সামনেই। তালাগুলোও ঠিকঠাক লাগিয়েছিল মনে আছে। সন্দেহের কারণেই সে তালা ধরে যখন চেক করল তখন ভেতর থেকে আওয়াজও শুনতে পেল কেউ খুব ধীরে ধীরে কথা বলছে কেউ । ভোরের সময় বাজারে তেমন কাউকে চোখে পড়েনি শুধু কসাইয়ের দোকানের ছেলেটাকে দেখতে পেল। তাকেই ইশারায় ডাকতে লাগলো। ছেলেটা যখন বুঝতে পারলো সামনে এসে দাঁড়ালো তখন আহসানুল্লাহ বলল, “খোকন ভেতরে কেউ আছে চোরটোর হবে। শরত তো বাড়ি না চোর ধরতে হবে।”
“কি কন মাস্টার কাকা!” বলেই খোকন কান পাতলো। তারপরই বলল, “তালা মাইরা দেই কাকা এলাকার মানুষ ডাইকা পরে খুলমু।”
“না ভেতরে যে চোর আছে তার গলা আমি শুনেছি। চিনিও তারে তাই আর এলাকার মানুষ জড়ো করবো না আগে তার সাথে কথা বলবো।”
খোকন জানতে চাইলো কি করবে তাহলে?আহসানুল্লাহ বলল, “আমি এক শাটার তুলে ভেতরে ঢুকব। তুই এখানেই থাক। সে যদি ভদ্রভাবে কথা বলে তো বলল আর যদি পালানোর চেষ্টা করে আটকাবি সেজন্য এখানেই দাঁড়াবি।”
খোকনের পছন্দ হলো না কথাটা। চোরের সাথে কিসের ভদ্রতা তবুও মাস্টার কাকার মুখে মুখে কথা বলতে পারবে না বলেই দাঁড়ালো। আহসানুল্লাহ শাটার তুলতেই ভেতরে থাকা মানুষটার হাতের বড় বাজারের ব্যাগটা পড়ে গেল সেই সাথে অন্যহাতে থাকা মোবাইলটা । সে দিকবিদিক খেয়াল না করেই ছুট লাগাতে চাইল। আহসানুল্লাহ ধরার চেষ্টা করে ধরতে পারেনি কিন্তু খোকন প্রস্তুতই ছিল। সে খপ করে চেপে ধরেই চিৎকার জুড়ে দিল। আহসানুল্লাহও কাছে এসে ধরলো ছেলেটাকে। খোকনের চিৎকারে কয়েকজন ছুটে এলো আর মিনিট দশেকের মধ্যে গ্রামের ভেতরেও ছড়িয়ে গেল কথাটা। শরতের দোকানের সামনেটাতে বড়সড় এক ভীড় জমে গেল। চোরকে পুলিশে দেওয়ার কথা উঠলেও শরতকে ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না ভেবে আহসানুল্লাহ তাকে ফোন দিল। শিশির আর নকশি ঘটনা শুনে শরতকে বলল বাড়ি যেতে তারা সামলে নেবে এখানটায়। আওলাদও বলল সে সামলে নেবে। শরত শুনলো কথা সে টাকা পয়সা নকশির হাতে বুঝিয়ে দিল৷ শিশিরকেও ডাক্তারদের সাথে কথা বলার ব্যাপারটা বোঝালো কি কখন জানতে হবে, জিজ্ঞেস করতে হবে এবং প্রতি মুহূর্তে তাকে যেন জানায় সব। শরত চলে যাওয়ার পর পরই ডাক্তার জানালো আলতা এখন মোটামুটি ভালো আর অক্সিজেনও লাগিয়ে রাখা হবে না। দুপুরের মধ্যেই আলতাকে কেবিনে দেওয়া হলো। নকশির কান্না পাচ্ছে না এখন আর সে নিজেকে বুঝিয়ে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আওলাদ খুব কাছ থেকে মেয়েকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার কান্না দেখে শিশিরও অপ্রস্তুতবোধ করলো। আলতা ঔষধের কারণে কিংবা দূর্বল শরীরের জন্যই কিনা কে জানে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নকশি হঠাৎ বলে বসল, “রোগীর সামনে কান্না করছেন দেখলে ডাক্তার আমাদের বের করে দিবে কেবিন থেকে।”
আওলাদ কান্না চাপল তার চোখ ভেজা। নকশি খেয়াল করল শিশিরের চোখ দুটো লালচে। তার মনে হলো শিশিরের নিশ্চয়ই মাথাব্যথা করছে একটু ঘুম দরকার। হাসপাতালের খাবার খাওয়াও অসম্ভব তাদের পক্ষে।
“আব্বা তোমার কি মাথাব্যথা করছে? মাথাব্যথা হলেই তোমার এমন চোখ লাল হয়ে যায় না!”
শিশিরের সত্যিই প্রচণ্ডরকম মাথাব্যথা করছে। আর তার কারণ ঘুম না হওয়া। ইতস্তত করেই বলল, “একটু একটু করছে।”
আওলাদ কথাটা শুনে তৎক্ষনাৎ বলল, “আমি তোমার জন্য একটা অষুধ আনি ব্যথা সারানের।”
আওলাদ বলেই বের হতে যাচ্ছিল তা দেখে নকশি বলল, “আমিও আসি সাথে। কিছু খাবারও আনবো এখন খাওয়ার জন্য । শরতটা তো খিদে পেটেই বাড়ি যাচ্ছে বুদ্ধি করে পথে কিছু খায় কিনা কে জানে!” নকশির কথায় আওলাদও সায় দিয়ে বলল সাথে যাওয়ার জন্য। তারা বেরিয়ে যেতেই শিশির একটা টুল ছিল কেবিনে সেটাই টেনে বসল আলতার পায়ের কাছটাতে। ঘুমে অচেতন প্রায় আলতার মুখটার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গোলাপি ফর্সা মুখটা একদম ফ্যাকাশে আর রক্তশূণ্য হয়ে গেছে দুদিনেই। চোখের কোল দেবে আছে অনেকটা। আর হাতের কব্জিতে কালসিটে দাগ৷ তারপরই আলতার পায়ের দিকে তাকালো শিশির৷ ইশ, পায়ের টাকনু বরাবরও দাগ পড়ে আছে। মুহুর্তেই শিশিরের রক্ত যেন তার দেহের ভেতর ফুটতে লাগল বারবার মনে হতে লাগল শাওন কেন মারা গেল? তাকে তো নিজ হাতে মারতে পারলে শান্তি লাগতো তার। আলতার ফর্সা পা দুটোকে সবসময় আলতার রঙে রঙিন দেখেই অভ্যস্ত ছিল শিশির। সেই ছোট থেকেই আলতা তার পা রাঙাতে ভালোবাসত। হঠাৎ আবেগ নাকি অন্য কিছু শিশির জানে না সে একটু ঝুঁকে আলতো স্পর্শে চুমো খেল আলতার পায়ে। ঘুমন্ত আলতা নড়েচড়ে উঠল সেই স্পর্শে।
চলবে