শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
320

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১৭

বাড়ির উঠোনে প্রতিবেশী দুই ভাবী শিলনোড়া বিছিয়ে হলুদ আর মেহেদি বাটার আয়োজন করছে। তাদের আবার চারপাশে বসে আছে কিছু নানী দাদী, চাচী বয়সী মহিলারা। অনেকের গলায় সুর উঠেছে গ্রাম্য বিয়ের গীতের। নতুন এক কুলোর ওপর সাজিয়ে রাখা ধান, দূর্বা। হলুদ শুরু হবে সন্ধ্যায় আর এখন বিকেল শেষে সন্ধ্যে নামার জো। নিজের ঘরের দরজার সামনে বসে আছে জয়তুন। চোখ তার জলে টলমল করছে আর তাকেই এক হাতে জড়িয়ে বসে আছে নকশি। বাড়িতে হাজারটা কাজ তা করার লোকের কমতি নেই কিন্তু দ্বায়িত্ব নিয়ে সব দিকে নজর নিজেদেরই রাখতে হয়। সেই নজরে রাখার কাজগুলো করছে শিফাই৷ বাড়ির মেয়ে আলতা, শিউলি দুজন হলেও রক্তের দিক থেকে শিউলি বাড়ির একমাত্র মেয়ে। না চাইতেও সবার মনে কথাটা একবার হলেও উঁকি দেয়। বিয়েটা যতোটা সম্ভব ধুমধামেই করা হচ্ছে। নকশিও অনেক কাজে কর্মে হাত লাগাচ্ছে কিন্তু এই মুহুর্তে জয়তুনের মনের অবস্থা ভেবে একটু পাশে বসলো৷ বাড়ির সবার সব কাজের চেয়ে বেশি কাজে ব্যস্ত দেখাচ্ছে আলতাকে। সে আজ দু দুটো শাড়ি পরবে বলে ঠিক করেছে৷ এখনই একটা পরে আছে এটা তার মায়ের শাড়ি। এই শাড়ি পরে সে মেহেদি তুলতে গিয়েছিলো এলাকার বান্ধবীদের সাথে। শিউলির বিয়েতে অলি আর অতশীও আসবে। বাড়ির সবাই জানে অলি শিশিরের সাথে পড়াশোনা করেছে আর আলতার সাথে তার খাতির। শরত দাওয়াত করেনি তাদের বরং আলতা আবদার করেছিলো মামার কাছে সে দুজনকে দাওয়াত করবে। জয়তুন, শিফা, নকশি, শরতও উপস্থিত ছিলো সেখানে৷ নকশি ধমকে উঠেছিলো শুনে কিন্তু আহসানুল্লাহ বলেছিলো, “অবশ্যই দিবি। তোর আপার বিয়ে তুই তোর বান্ধবীদের দাওয়াত দিবি না এটা কি করে হয়! তা কয়জন বান্ধবী তোর আর কে কে? পাড়ায় তো সবাই কমবেশি দাওয়াত পেয়েছে।”

“এই পাড়ায় না তারা। স্কুলের সামনেই তাদের বাড়ি। অতশী আর অলি আপারে দাওয়াত দিব।”

আলতার কথা শুনতেই শরত খক খক করে খালি গলায়ই কেশে উঠলো। বিষম খেলো বুঝি সে অলির নাম শুনে৷ আঁড়চোখে তবে রাগী চোখে তাকালো আলতার দিকে। আলতা তা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হেসে বলল, “দাওয়াত দেই মামা তাদের?”

আনন্দের অনুষ্ঠানে বাচ্চারাই আনন্দ করবে বেশি। এর চেয়ে আনন্দের আর কি আছে। আহসানুল্লাহর দিকে তাকিয়ে জয়তুন বলল, “কি কও আহসান দুইজনই তো দেক দাওয়াত।”

আহসানুল্লাহ লিস্টে নাম দুটো বসিয়ে বলল, “অলি তো আসাদ ভাইয়ের মেয়ে তাই না?”

আলতা মাথা নাড়লো “হ্যাঁ।” দাওয়াতের লিস্ট শেষ করে সবাই যখন ঘর ছেড়ে বের হলো তখন আলতাও বেরুচ্ছিলো। তার পেছনে ছিলো শরত সে আলতার চুলে করা বেণীটা টেনে ধরলো।

“আহ্, শরত ভাই ছাড়ো ব্যথা লাগে।”

কঁকিয়ে উঠতেই শরত তার বেণী ছেড়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল আবার ঘরে।

“তুই সবার সামনে অলিরে দাওয়াতের কথা বললি কেন?”

“ত কি সবার পিছনে বলবো! দাওয়াত দিবো তাদের তাই বলছি৷”

“ওদের দাওয়াত দিতে হবে কেন?”

“কারণ অলি আপা বলছে এই বিয়েতে তাকে দাওয়াত দিতে। সে নাকি নজরে রাখবো তোম….”

আলতার কথা শেষ হওয়ার আগেই থেমে যায়। খেয়াল করে পেছনে বড় মামী দাঁড়িয়ে আছে। আলতার থমকানো দৃষ্টি দেখে শরত পেছনে তাকিয়ে সেও ভূত দেখার মত চমকে যায়। মা কি কিছু শুনলো!

“তোরা দুইটা কি ফুসুর ফুসুর করোছ? আর শরত তুই ওরে চুল ধইরা টানলি ক্যা? শিশিরের রোগে ধরছে? আর কোনদিন চুল টানবি না কইয়া দিলাম। মাইয়া মানুষ কোনরকম দুকটুক(ব্যথা) পাইলে আরেক বিপদ হইবো।”
জয়তুন কথাগুলো শেষ করেই ঘর থেকে পানের বাটা নিয়েছিল।

আর সেদিনই আলতা অলি আর অতশীকে দাওয়াত করে এসেছিল তাই আজ সন্ধ্যায় হলুদে তারাও আসবে। আলতা বসে একবার আয়নায় নিজেকে দেখলো। শীত শীত আবহাওয়ায়ও তার কেমন নাক আর কপাল ঘেমে পাউডার ভেসে উঠছে মুখের। একটু আগেই তো সে ভালো করে স্নো’র ওপরে পাউডার লাগিয়েছে আর ঠোঁটে আলতারঙা লিপস্টিক৷ কাজল এখন লাগায়নি চোখ লেপ্টে যাবে ভেবে। শিউলি আপাকে যখন হলুদ দেওয়ার জন্য প্যান্ডেলে বসাবে তখন সে কাজল দিবে এতে তার চোখ কালো কালো হবে না। আজকে খুব শখ ছিলো চুল খোলা রাখবে৷ শিশির ভাইয়ের মামাতো বোনদের দেখেছিলো পার্লারে সেজে তারা চুল অর্ধেক কেমন করে যেন বেঁধে বাকিটা খোলা রেখেছিল। সে আজ তেমন না পারলেও পুরোপুরি খোলা রাখবে ভেবে রেখেছে কিন্তু ছোট মামি আর মা তার এত বড় কোঁকড়া চুলগুলো খোলা দেখেই বকাবকি করলো। আর ভাল্লাগছে না। সে অতশীর সাথে স্কুলে বসে বসে নানারকম পরিকল্পনা করেছে সাজপোশাক নিয়ে কিন্তু তার কোনটাই পূরণ হয়নি। মাকে কত করে একটা নতুন ডিজাইনের জামা আনতে বলেছিলো মা সেটাও কিনে দেয়নি। এ নিয়ে কাল যখন মা, শরত ভাই শিউলি আপা বাড়ি ফিরলো সে রাগে দুঃখে মায়ের সাথে কোন কথাই বলেনি৷ ঈদের জামাটাই কাল পরতে হবে তাকে। সাজ নিয়ে দুঃখী হওয়া মনটা এবার দ্বিগুণ দুঃখী হয়ে গেল। এত অভাব কেন তাদের! আব্বা থাকলে নিশ্চয়ই এত অভাব থাকতো না। ইশ, মা কেন জাহিদ কাকার প্রস্তাবে রাজী হলো না! আলতার এখন চরম রাগ হচ্ছে মায়ের ওপর। জাহিদ কাকার টাকা পয়সা অনেক। মা বিয়েটা করলেই তো সে জাহিদ কাকাকে আব্বা বলতো আর নিজের আবদার গুলো প্রকাশ করতো৷ তার কিশোরী মনে হঠাৎ নিজের আবদার পূরণের লোভ জাঁকিয়ে বসলো। যেন মায়ের বিয়ে হলেই সে সব চাইতে পারতো জাহিদ কাকার কাছে।

“আলতা!”

শিশিরের ডাকে নিজের কল্পনার রাজ্য থেকে ছিটকে এলো আলতা। আবারও গা থরথরানি শুরু। এ কেমন অশান্তি কাল থেকে! শিশির ভাইয়ের আওয়াজ শুনলেই তার গা কেঁপে ওঠে। সকালে মামা যখন বিয়ে নিয়ে কথা তুলল তখন সে মামীর কথা স্পষ্ট শুনেছে। মামী বলছিলো তাকে বাড়িতেই রাখবে মানে তো শিশির ভাই আর তার বিয়ে। কিন্তু মামা বোঝেনি বোধহয় কথাটা। বোকার মত মামীর দিকে চেয়ে বলেছিলো, ” কি বলো বাড়িতে কি করে রাখবে মেয়ে বিয়ে দিতে হবে না?”

“সময় হলেই বুঝবে কি করবো।” মামী মিটিমিটি হেসে তাকিয়েছিল তার দিকে৷ তখনও সে লজ্জায় এমন করে কেঁপে উঠেছিল।

“ঘরে থেকেও জবাব দিলি না কেন?”

শিশির ঘরে ঢুকেই বলল কথাটা। আলতা বিছানায় বসা ছিলো হাতে তার ছোট্ট আয়না। শিশিরের কথায় কোন জবাব না দিয়ে হাসফাস করতে লাগলো। তার মুখ দেখেই শিশির আবার দমে গেল। যতখানি স্বাভাবিক হয়ে সে আলতার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো ততখানিই এখন সংকুচিত হলো। আবারও ধীর স্বরে বলল, ” তুই নাকি কাল নতুন জামার জন্য রাগ করেছিলি ফুপুআম্মার সাথে তাই আজ শরত ভাই এটা কিনে এনেছে। দলামুচড়া না করে সুন্দর ভাবে পরে দেখ ঠিকঠাক লাগে কিনা। না লাগলে আবার বদলাতে নিতে হবে।”
হাতে থাকা ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে শিশির বেরিয়ে গেল ঘর থেকে আর আলতা থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। শিশির ভাই সামনে এলেই তার ঘাড় নুয়ে যায়। চোখ তুলে তাকানো দায় হয়ে পড়ে। এ কেমন পরিবর্তন তার সে নিজেও বোঝে না। এমনটা কি সবারই হয় না শুধু তার সাথেই হচ্ছে! যার চোখের সামনে তার ছোট থেকে বড় হওয়া আজ তার সামনে দাঁড়াতেই শরীর অবশ হয়ে আসে। অথচ সে সামনে না থাকলেই তাকে নিয়ে কত কত কল্পনা।

শীতের মাস ; গ্রামে কুয়াশা অন্ধকারকে ঘোলাটে চাদরে আরো ঘন করে তোলে। সন্ধ্যের আজান শেষ হতেই মুরুব্বিরা বলতে লাগলো হলুদ শুরু করো। পাড়ার সবাই আর কয়েকজন দূরের আত্মীয় সবাই সন্ধ্যের মধ্যে তৈরি হয়ে হাজির হয়েছে প্যান্ডেলে। বাড়ির উঠোনে বড়সড় প্যান্ডেল করা সম্ভব নয় বলেই আহসানুল্লাহ বাড়ির সামনে খোলা মাঠে প্যান্ডেল করিয়েছে। পুরোপুরি শীত না নামলেও খোলা যায়গায় শীত বেশিই লাগে। সবাই খুব সেজে গুঁজেও চাদরে লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে। আলতারও একই অবস্থা। সে আবার শাড়ি বদলে শিফা মামীর এক শাড়ি পরেছে। আজও শিফা তাকে খোঁপা করে ফুল লাগিয়ে দিয়েছে। বাড়ির পাশেই হলুূদ আর লালচে মিশ্রিত কলাবতী ফুল ছিঁড়ে এনে তাই কালো ক্লিপে আটকে দিয়েছে শিফা। আলতা মুগ্ধ হয়ে তাকায় একবার আয়নায় আর একবার মামীর দিকে। এই মানুষটার সাজপোশাকে এত আধুনিকতা! আলতার মনে হয় শিফা মামী অনেক শিক্ষিত কিন্তু মামী বলেছে নাইন পাস করতেই মামীর বাবা বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন মামার সাথে। মামা গ্রামের হলেও শহরে পড়ালেখা করা মানুষ আর দারুণ জ্ঞান সম্পন্ন হওয়ায় মামা বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করতে রাজী হয়নি। অনেকটা চাপের মুখে পড়ে পিচ্চি মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। তারপর তো মামী বাপের বাড়ি পড়ে রইলো বছর তিনেক মামা আনেনি। মাসে মাসে সাধ্যমত খরচ পাঠাতেন মামীর জন্য । একবার কি কারণে যেন নানা জোর করে মামাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠালো তিন বছর পর। ততদিনে মামী শিউলি আপার বয়সী হয়ে গেছে। মামা তো সেবার গিয়ে বউকে দেখে আর নিজেকে বুঝ মানাতে পারেননি আর মামীর বড় ভাই আবার মামাকে পছন্দও করতেন না। তাই কিছুটা মিথ্যে অজুহাতেই সেবার মামীকে ঘরে তুললেন। এরপর তো আরও দু বছর মামা মামীর সংসার নিরব নিস্তব্ধ রইলো। তারপরই না ঘর আলো করে এলো শিশির ভাই। আলতা সবই শুনেছে বড় মামীর মুখে। আজ শিফা মামী যখন আলতাকে শাড়ি পরাচ্ছিল তখন মামা একবার ঘরে এসেছিল প্রয়োজনে। আলতার মনে হলো মামীকে দেখে মামা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। মামী আজ সেজেছে খুব বেগুনি রঙের শাড়ি পরে। শিশির ভাই এটা তার প্রথম টিউশনির টাকা দিয়ে কিনেছিল। খুব মানিয়েছে মামীকে এই শাড়িটাতে। আলতা যখন অপলক তাকিয়েছিল মামীর দিকে মামী তখন বলেছিল, “আমার পরে তুই পরবি এই শাড়িটা। আজই শেষ আমি আর পরবো না এই শাড়ি।”

পুলকিত হয়েছিলো কথাটা শুনে তবুও কপট রাগের স্বরে বলল, “এই শাড়ি আমি পরবো ক্যান? শিশির ভাই এইটা তোমার জন্য পছন্দ করে আনছে।”

“ভীতু রাজকুমার কি আজও এই ঢিলেঢালা শার্ট পরেই থাকবে?”

অলি একটা কাঁঠাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বলল কথাটা। তার সামনের দিকে অনেকটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে শরত। হাতে তার টাকার বান্ডেল। মুরগিওয়ালার টাকা দিতেই মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্যান্ডেলের কাছাকাছি এসেছিল। অলিকে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে সে একপলক দেখে কিছু বলতে চাইল। তার আগেই অলি মুখ খুলল। শরত জবাব না দিয়ে আরও গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো অলিকে। মেয়েটা আজ সরষে ফুলের মত হলদে সেজে এসেছে৷ তার মোটামুটি ফর্সা গায়ের রঙটা বুঝি মেকাপের আচরে আরো ফর্সা লাগছে! শরত আরো অনেক গভীর ভাবে দেখতে গিয়ে বুঝলো মেয়েটার এই সজ্জা তার দমবন্ধের কারণ হবে। সে টাকাগুলো প্যান্টের পকেটে গুঁজে একহাতে তার কটিদেশ টেনে অন্ধকারে নিয়ে এলো। অসভ্য প্রেমিক না হতে পারলেও সাধু সন্ন্যাসী সে হতে পারলো না। আলতো করে অলির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “এত সাজ কার জন্য?”

“যে দেখছে তার জন্যই।”

“তার জন্যই যদি হবে তাহলে এই ভরা মজলিশে এত কেন সাজতে হলো? আর তো ক’টা দিন তারপরই না হয় সাজতে তার ঘরে এসে।”

অলি এতক্ষণে জড়িয়ে ধরলো শরতকে। ফিসফিসিয়ে বলল, “এই সাজটুকুর জন্যই আমার বোকা মানব এতোটা সাহসী হলো৷ গাঢ় অন্ধকারে বুকের কাছে নিঃশ্বাস ফেলার এই সুযোগটা দিলো। তা নয়ত কি দিতো?”

অলির সেই ফিসফিসানোর সুর শরতকে আরো গভীর অনুভূতির সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু সে তো প্রেমিকার সাথে ভুল করার মানুষ নয়। তার নিয়ম নীতির খাতায় প্রেম ভালোবাসা ভুল কিছু নয় তাই সে জোর করেই নিজেকে সামলে রাখলো। অলিকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “এত সেজেছো সমস্যা নেই। কারো নজরে এসো না নইলে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতো আমি কার্পণ্য করবো না।”

কথাটা শেষ করেই শরত চলে গেল সেখান থেকে। অন্ধকারেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো অলি আর তার থেকে একটু দূরে আরো গভীর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো শিশির। ভাইয়ের মুখের শেষ কথাটাতে যেন কিছু ছিলো। এমন কিছু ছিলো যা তাকে উত্তেজিত করল। তার চোখের পাতায় ভেসে উঠলো আলতার মুখ। সেও কি তবে ভাইয়ের মতই ভাবে তার আলতাকে নিয়ে! আলতার পাশে অন্য কাউকে দেখলে সেও কি এমন বলবে! যু/দ্ধ, বিগ্রহ আর খু/ন সবটাই সেও করতে পারবে আলতার ওপর অন্য কারো দৃষ্টি পড়লে! হঠাৎ মনে পড়লো আলতা প্যান্ডেলে আছে। সেও আর অপেক্ষা না করে পা বাড়ালো সেদিকে।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১৮

স্তব্ধতায় মাখা এক নিগূঢ় অন্ধকারকে দু’হাতে পাশ কাটিয়ে যেন এগিয়ে চলছে শিশির। বাড়ির প্রায় প্রতিটা মানুষই এখন প্যান্ডেলে অবস্থান করছিল শুধু শিশিরই ব্যতিক্রম৷ সে আলতাকে খুঁজতে প্যান্ডেলে গিয়ে পেলো না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও নিজের মনের দ্বিধায় আর সম্ভব হলো না। সে নিজেই কিছুক্ষণ খুঁজে যখন প্যান্ডেলে না পেল তখন বাড়ির দিকে গেল। তাদের বাড়ির চারপাশে টিনের বেড়া ভেতরে আলাদা আলাদা দুটো ঘর বড় বড়৷ একটা শিশিরদের অন্যটা শরতদের৷ দুটো ঘরেই দেয়াল পাকা আর ভেতরে বাথরুম সাথে রান্নাঘর। শুধু নিজেদের ঘরের বাইরে আহসানুল্লাহ টিনের যে পড়ার ঘর তুলেছিল, অনেক বছর আগেই সেটাই নকশিকে দেওয়া হয়েছিল। নকশি নিজ খরচে সেই ঘরের সামনে আরেকটু বাড়িয়ে রান্না খাওয়ার ঘর বানিয়েছে। আর তার সাধ্য নেই ঘরদোর সারাবার৷ অনেক পুরনো ঘর, জানালার পাশটা একটু ভাঙা। শিশির বাড়ি ঢুকেই নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। চোখের কোণে ঝাপসা হয়ে আবছা একটা মানব ছায়া দেখতে পেল নকশির ঘরের জানালার বাইরে৷ আর দেরি না করে সরাসরি সেদিকে তাকাতেই দেখলো শার্ট পরা কেউ একজন জানালার সেই ভাঙা অংশ দিয়ে ভেতরে কিছু দেখছে। শিশির হাঁক ছাড়লো, “কে ওখানে? কে!”

তার গলার স্বর কণ্ঠদেশ ছেড়ে বের হওয়ার কয়েক সেকেন্ডেই জানালার পাশে থাকা ব্যক্তিটি দৌঁড়ে পালাল গেইট দিয়ে৷ শিশিরও পেছনে দৌঁড়ালো কিন্তু লাভ হলো না কিছুতেই। ততক্ষণে সেই ব্যক্তিটি ঝুপসি আঁধার ডিঙিয়ে কোন পথে গিয়েছে তা আর বোধগম্য নয়। বড় বড় শ্বাস ফেলে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো। সম্ভব হলো না কিছুক্ষণ তারপর ধাতস্ত হতেই সে দৌঁড়ে বাড়ি ঢুকলো। আলতাদের ঘরের সামনে এসে ভেতরে তাকাতেই থমকে গেল তার পা৷ ঘরের দরজা ভেজিয়ে রাখা একেবারে লাগানো নয়। আলতা শাড়ি খুলে চৌকির ওপরে রেখেছে পরনে তার শুধুই ব্লাউজ, পেটিকোট। চোখ বুঁজে তৎক্ষনাৎ উল্টো ফিরে গেল শিশির উঠোনের মাঝে। কিছু সময় অপেক্ষার পরও যখন আলতা বের হলো না তখন বাধ্য হয়েই ডাকলো, “আলতা!”

শিশিরের গলা শুনে ভয় পেল বুঝি আলতা। মাত্রই সে কামিজ পরে ওড়না গায়ে জড়াচ্ছিলো। শিশিরের ডাকে হাত থেকে ওড়নাটা নিচে পড়লো। আবার ওড়নাটা তুলে গায়ে জড়ালো। মায়ের চাদরটাই সে গায়ে দিয়েছিল প্রথমে সেটাই আবার জড়িয়ে নিলো। ধীর পায়ে দরজার কাছে আসতেই শিশির খুব শীতল আর ভরাট গলায় বলল, ” একা কেন বাড়ি এসেছিস? ফুপুআম্মা, মা, কাকি সবাই প্যান্ডেলে তুই কেন সেখানে নেই?”

“শাড়ি পরে হাটতে পারছিলাম না তাই আম্মা বাড়ি পাঠিয়েছে শাড়ি বদলাতে।”

এইটুকু কথা বলতেই গলা কাঁপছে আলতার। শিশির আর কিছু না বলে গেইটের তালা চাবি খোঁজ করলো। আলতা দেখিয়ে দিতেই শিশির তাকে বের হতে বলে নিজেও বেরুলো। বাড়ির গেইটে তালা ঝুলিয়ে আলতার পেছনে পেছনে এসে প্যান্ডেলে উপস্থিত হলো। হলুদ শেষ হতে বেশি সময় লাগেনি। গ্রামের রাত দশটা মানেই অনেক রাত, তার ওপর শীতের বাতাসে কুয়াশার চাদর সবাইকে এমনিতেই কাবু রাখে৷ রাত এগারোটা বাজতেই সবাই বাড়ি ফিরল প্যান্ডেল ছেড়ে। বিছানায় শুয়েও যখন আরো থাকার জায়গা দরকার মনে হলো, শরত আর শিশির মিলে খড়ের গাদা থেকে অনেক অনেক খড় এনে বিছিয়ে দিলো মেঝেতে। খড়ের ওপর পাতলা কাঁথা বিছিয়ে বিছানা তৈরি। ঘরে লেপ আর বাড়তি কাঁথা গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করলো৷ হলুদের রাতটা কারোই খারাপ কাটেনি। ভোরের আলো ফুটতেই আবার বিয়ের আয়োজনে ছুটোছুটি শুরু হলো। আজকের দিনে আলতা সাজলো নতুন পোশাকে। শিউলির বুঝি একটু মায়া হলো আলতার প্রতি এই শেষ মুহূর্তে তাই সে বাজারে নতুন হওয়া পার্লারে নিয়ে গেল সাজতে। শিউলি বউ সাজলো সাথে আলতা দুজনেই যখন বাড়ি ফিরলো তখন বরযাত্রী বাড়ি এসে গেছে। আফসোস হলো খুব আলতার সে গেইটে বরকে আটকাবে, জুতো চুরি করবে কত শখ ছিলো। এ জীবনে সে কখনোই এগুলো করার সুযোগ পায়নি। এই প্রথম সুযোগ এলো তাও কিনা সাজতে গিয়ে মিস হয়ে গেল! মন খারাপ হলো তার এই ভেবে। তবুও আনন্দ শিউলি আপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তার বেড়াতে যাওয়ার একটা জায়গা তো হলো!

শীতের দিন বিকেলের পরই কুয়াশা পড়ে অন্ধকার হয়ে যাবে। বরযাত্রী চাচ্ছে দ্রুত বিয়ে মিটিয়ে বউ নিয়ে যাবে। দেনাপাওনার একটা হিসেব বরের বাবা করতে চেয়েছিল কিন্তু বরের কারণে তা সম্ভব হয়নি৷ ছেলে নিজে শিউলিকে পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল৷ শরত রাজী ছিল না বোনকে এখনই বিয়ে দিতে কিন্তু পাত্র খুব করে পেছনে লেগেছিল। অনেকটা সেকারণেই দেনাপাওনা ছাড়াই বিয়েটা হচ্ছে। কিন্তু শরত ভেবে রেখেছে এখন কিছু না দিলেও শিউলির নামে জমা সে টাকাপয়সা রেখেছে কিছু। তা দিয়ে শিউলির মত জেনে কিছু পাঠাবে হোক তা সোনাদানা কিংবা ঘরের আসবাব৷ বিয়ে পড়ানো হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বরযাত্রী কনে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।সন্ধ্যের মধ্যে আত্মীয়স্বজনও প্রায় সবাই চলে গেল। জয়তুন কাঁদছে ঘরের দরজায় বসে। তার পাশে শিফা আর নকশিরও চোখ সিক্ত। শরত বোন বিদেয় করতেই কোথায় গেছে কেউ জানে না আর শিশির নিজেকে কঠিন রাখতে জানে যেকোন পরিস্থিতিতে। আজও বোনের জন্য হওয়া কষ্টটা সামলে সে বাবুর্চি আর ডেকোরেটরের খরচ বাবদ বুঝিয়ে দিচ্ছে৷ সন্ধ্যের পর বাড়ি প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। শরতের এক মামী আর মামা ছাড়া তার নানা বাড়ির সকলেই চলে গেছে। শিশিরের যখন মোটামুটি রকমের সব কাজ শেষ তখন সে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো৷ চোখ বুঁজতেই চোখে ভাসলো শরত ভাইদের দরজার কাছে বসা মা, ফুপুআম্মা আর জেঠিমা। আলতা কোথায়! তারপরই মনে হলো আলতা বোধহয় তার ঘরে হবে৷ আরো কিছু সময় বিছানায় গড়িয়ে যখন উঠলো তখন আব্বার গলা শুনলো। আব্বা আলতাকে ডাকছে চা বানাতে। মাথা ধরেছে খুব আর বড়রা সবাই কমবেশি কান্নাকাটি করছে। তাই আলতাকে দিয়েই ভেবেছিল চা টা করাবে। কিন্তু আট থেকে দশবার ডাকার পরও যখন আলতার কোন সাড়া পাওয়া গেল না তখন শিশিরই প্রথমে ঘর ছেড়ে বের হলো৷ সারা বাড়ি খুঁজে আলতার ছায়াও চোখে পড়লো না কারো। টনক নড়ল নকশিরও সে সন্ধ্যে বেলায় আলতাকে ঘর থেকে না বের হতেই বলেছিল। কিন্তু কোথায় গেল মেয়েটা।

চারিপাশে ঝিঁঝির আর হুতুমের ডাক কানে আসছে৷ রাত বাড়ছে আলতাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু সময়ের মধ্যেই পুরো এলাকায় হৈচৈ পড়ে গেল মাস্টারের ভাগ্নি নিখোঁজ৷ সারা গ্রামে মানুষ খোঁজাখুঁজিতে নামল শুধু শাওনদের বাড়ির মানুষ ছাড়া। শিশিরের কেন জানি মন বলল আলতার সাথে কিছু হয়েছে৷ সে যতোই উড়নচণ্ডী হোল না বলো রাতের বেলায় কোথাও যাবে না৷ শরত যখন ভাবছে থানায় যাবে শিশির তখন বাঁধা দিয়ে বলল আগে সে শাওনকে ধরবে তারপর বাকিসব। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শাওনের টিকিটাও মিলল না গ্রামে অথচ বিকেলেও নাকি তাকে শিশিরদের পাড়ায় দেখা গেছে। বাড়িতে আবার নতুন করে কান্নার রোল পড়ল এবার আলতাকে না পাওয়ার। হন্যে হয়ে ছুটছে শিশির, শরত আর আহসানুল্লাহ সাথে শিশিরের বন্ধুরাও। রাত বাড়ছে, বাড়ছে শীতের তেজ সেই সাথে নিকষ কালো আঁধার। আহসানুল্লাহ অনেকটা সময় খোঁজার পরও যখন আলতার খোঁজ পেল না তখন সে পাড়ার মোড়ে হিজল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। হু হু কেঁদে উঠলো দু হাতে মুখ ঢেকে। যে কান্না সে শিউলির বিদায় বেলায় চেপে রাখতে পেরেছে তা আর এখন সম্ভব হলো না৷ বুকটা আচমকাই খা খা করতে লাগলো তার। আল্লাহ তায়ালা তার কন্যা সন্তানের স্বাদ পূর্ণ না করেও অপূর্ণ রাখেনি৷ শিউলি আর আলতা দুটোকেই সে তার মাথায় করে রেখেছিল। আজও তাদের দুজনের বাবার কমতি পূরণ করে সর্বদা তাদের প্রতিটা আবদার বহন করেছে৷ কোথায় গেল আলতাটা? কোন বিপদ হয়নি তো মেয়েটার সাথে! যতবার এই কথাটা ভেবেছে ঠিক ততবার তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। মাথায় তো আর কিছুই আসছে না আর কোথায়, কেমন করে খুঁজবে আলতাকে সে! কান্না আটকে পান্জাবীর পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করে শরতকে ফোন দিল।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই আহসানুল্লাহ বলল, “থানায় যাব আমি।”

শরত কণ্ঠ শুনেই বুঝলো কাকা কাঁদছে৷ সে বলল, “আপনি কোথায় বলেন আমিও যাবো সাথে।”
আহসানুল্লাহ কোথায় আছে বলার পাঁচ মিনিটের মধ্যে শিশির আর শরত এসে উপস্থিত হয় আহসানুল্লাহর কাছে। আহসানুল্লাহ শিশিরকে দেখে বলল আমরা তিনজনেই থানায় গেলে বাড়ির মহিলাদের খেয়াল কে রাখবে। শিশির যেতে চাচ্ছিল খুব করে কিন্তু শরত বলল থানায় শিশিরের যাওয়া দরকার নেই৷ অনেক নিয়ম কানুন আছে থানায় রিপোর্ট করার আর সাথে সাথে পুলিশ কিছু করবে কিনা তাতে সন্দেহ। শরত জানে শিশির অল্পতেই মাথা গরম করে ফেলবে। পুলিশ যদি কোন হেল্প না করে শিশির যে সেখানেই ঝামেলা বাঁধাবে তাতে সন্দেহ নেই তার। তাই সে বলল, “কাকা আমি আর আপনি থানায় যাব শিশির বাড়ি যাবে।”

শিশির আর কিছু বলতে পারলো না ভাইয়ের কথার ওপর। কিন্তু তার তো বাড়ি বসে থাকার মত ধৈর্য্য এই মুহুর্তে নেই। এমনিতেই বারবার মনে পড়ছে কালকে রাতের ঘটনা৷ কাল কেন সে জানালার পাশে থাকা ব্যক্তিটাকে ধরতে পারলো না! কে ছিল কাল ওটা? শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে তার শরীরে যেন৷ হাত, পায়ের তালুতে কিছু একটা যেন খুব করে তাকে উত্তেজিত করছে কোন এক শিরশিরানি যা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। শরতরা চলে যেতেই সে রাস্তায়ই বসে পড়লো। দু হাতে মাথার চুল টেনে খামচে ধরলো। কোথায় গেল মেয়েটা; কোথায় তার সেই চঞ্চল পাখিটা! তার কিছু হলে যে শিশির আর কোন ভোরের আলোয় চমকাবে না হীরের মত। যে শিশিরে আলতা গড়াবে না সেতো সেই শিশির হতে চায় না। তিরতিরিয়ে বয়ে যাওয়া শীতের হাওয়াও শান্ত করতে পারছে না শিশিরের শরীর আর মনকে। সে কি করে বাড়ি ফিরবে আলতাকে ছাড়া! সে যে মাত্রই দেখে এসেছে ফুপুআম্মার নিথর দেহ। মেয়েকে না পেয়ে দু দুবার জ্ঞান হারিয়েছে মানুষটা। না, আলতা ছাড়া সে বাড়ি ফিরবে না কিছুতেই কিন্তু কি করবে তাও জানে না। বসা থেকে উঠে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সে শাওনের বাড়ির দিকে আবারও চলতে লাগলো।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-১৯

“এত রাইত কইরা কই যাও আওলাদ মিয়া?” গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ হাকিম কাকা অথচ তার দৃষ্টিশক্তি এখনও জোয়ানদের মতোই স্পষ্ট। টর্চের আলো ফেলে দ্রুত পায়ে আওলাদ বাজারের দিকে যাচ্ছিল মাটির রাস্তা ধরে। রাস্তার ধারে হাকিম চাচার ছেলের চায়ের দোকান। কাকা সেখানেই বসে হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে ঠক ঠক করছিলেন। আওলাদকে দেখে এই আঁধারেও কি করে যেন বুঝতে পারলেন আর তাতেই প্রশ্ন করলেন৷ আওলাদ তাড়ায় থাকলো মুরুব্বি মানুষের প্রশ্ন উপেক্ষা করে যেতে পারেনি। সে থেমে গিয়ে জবাব দিলো, ” বাজারে যাই কাকা ডাক্তার ডাকতে। বড় পোলাডার জ্বর উঠছে খুব।”

“ও, বউরে কইলানা মাতা(মাথা) ধোয়াইতে। না অহন তো আবার শীত, পানি পট্টি দিতে কইয়ো।” হাকিম কাকা কথাটা শেষ করতেই আওলাদ আশপাশ থেকে হৈ চৈ শুনলো। দোকানে আরও অনেকেই ছিল তারাও সবাই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। আওলাদ চিন্তিত হয়ে বলল, “হৈ চৈ তো বাড়তাছে মনে হয়। চল তো কাশেম দেইখা আসি।”

কাশেম দোকানেই ছিল আওলাদের এলাকার এক বন্ধু। কাশেমও বলল, “চল দেহি। ”

আওলাদ আর কাশেম এগিয়ে যেতেই দেখলো বাজারের রাস্তা থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তার বা দিকে যেখানে বড় পুকুর সেখানে কিছু একটা ডুবছে। টর্চ ফেলে তাকাতে তাকাতেই একটা গাড়ি ডুবলো পানিতে৷সবাই হৈ হৈ করলো কিন্তু তৎক্ষনাৎ কেউ পানিতে নামলো না। আওলাদ কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে হাতের টর্চ কাশেমকে দিয়ে গায়ের চাদর আর শার্টটাও খুলে ফেলল। কাশেম তাকে কিছু বলে আটকাবে তার আগেই সে পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো। এতে হৈ চৈ আরো বেড়ে গেল। আওলাদকে ঝাপাতে দেখেই যেন অন্যদেরও সাহস এলো। সাথে আরো তিন চারজন এলাকার তরুণ ছেলেও ঝাপ দিলো। কনকনে ঠান্ডা পানির তলায় দরজা লকড গাড়ির ভেতরে কেউ আছে কিনা তা খোঁজ করা মুশকিল হলেও অসম্ভব নয়। অতি সাহসী ছেলে গুলো আর আওলাদ অনেকটা হাতড়ে হাতড়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলতে সক্ষম হয়৷ দম ফুরিয়ে আসার উপক্রম ভেতরের মানুষটার সাথে ঝাপিয়ে পড়া মানুষগুলোরও। আওলাদ কেমন অবশ হয়ে আসা শরীর নিয়োও হাল ছাড়লো না। সে গাড়ির ভেতরে হাত বাড়াতেই চমকে গেল। একটা হাত তার হাতে এসেছে। মানে সন্দেহ ঠিক গাড়ির পেছনেও যাত্রী ছিল। কিন্তু চমকানো তার আর বাড়ল যখন টের পেল হাতটা বাঁধা গাড়ির সামনের সিটের সাথে। সে তড়াক করে পানি থেকে ভেসে উঠে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলো। চিৎকার করে বলে উঠল, “গাড়ির ভিত্রে মানুষ বাইন্ধা রাখা।”
কথাটা বলেই আবার সে পানিতে ডুব লাগালো। রাস্তায় থাকা একজন সাথে সাথে গ্রামের ডাক্তারকে আনতে গেল তো আরেকজন থানায় গিয়ে জানালো এলাকার রাস্তার পাশে পুকুরে গাড়ি ডুবেছে।
প্রায় সতেরো মিনিট পর পানির নিচ থেকে টেনে তোলা হলো এক মেয়েকে। আওলাদ পানি ছেড়ে ওঠে আর এক সেকেন্ডও দেরি করেনি। দ্রুত বাড়ি ফিরে গিয়ে কাপড় বদলালো। ঔষধ আনতে যাওয়া লোক ভিজেপুরে বাড়ি ফিরেছে দেখেই জরিনা রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এলো।

“কি গো তুমি এমন ভিজলা কেমনে?”

“পুকুরে নামছিলাম৷ গেরামের রাস্তায় গাড়ি পাক্কায় পুকুরে পড়ছে। তার মধ্যে একটা মাইয়া আছিলো।”

“হায় আল্লাহ, কও কি! মাইয়া বাঁইচা আছে? আর তুমি নামলা ক্যা পানিতে শরীরডা খারাপ হইলে আমি দুই বাপ, পুত লইয়া কই যামু?” গলা ছেড়ে হায় হায় করে উঠলো জরিনা। কাঁপা শরীরে পোশাক বদলে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো আওলাদ। চুলায় আগুন জ্বলছিল তাতেই হাত দুটো পেতে বসলো আওলাদ। কয়েক মিনিট সে চুপচাপ হাত, পা, গাল, মুখে আগুনের তাপ নিয়ে পরে আবার বের হলো বাজারের উদ্দেশ্যে। ছেলেটার জ্বর কমেনি ঔষধ আনাটা জরুরি। আওলাদ ভালো করে মাফলার আর চাদরে শরীর মুড়িয়ে বের হল বাড়ি থেকে। সেই রাস্তার পাশের জটলা এখনো আছে আর একন সেখানে পুলিশও চোখে পড়ল। আওলাদের বন্ধু কাশেম সেখানেই এখনো সে আওলাদকে দেখে ডাকলো, “মাইয়াটা মনে হয় না বাঁচব। তাও ডাক্তারে কি কি কইরা পরে কইল হাসপাতালে নিয়া অক্সিজেন দেওন লাগবো৷ আমার মন কয় ডাক্তারে হুদাই কইছে মরে নাই৷ শরীলডা দেখলে কইতি নীলা(নীলবর্ণ) হইয়া গেছে শ্বাসও পড়ে না। তুই ওইদিকে কই যাস?”

“বাজারে দেখি গিয়া দোকান খোলা আছেনি ডাক্তারের। জ্বরের ওষুধ আনোন লাগব।”

“দশটা বাজে, অহন খোলা পাবি না। তারচে ভালা জব্বর ডাক্তারের বাড়ি যা। চল আমিও লগে আসতাছি।” কাশেম আর আওলাদ গ্রামের ভেতরেই গেল জব্বর ডাক্তারের কাছে। আর পুকুরের পাশে জমাট বাঁধা লোকের ভীড়ে একদল পুলিশও এসে জমা হলো। শুধু উদ্ধার করা মেয়েটাকে নিয়ে গ্রামের কয়েকজন আর দুজন কনস্টেবল হাসপাতালে ছিল।

রাত বাড়ছে, ঝিঁঝি আর হুতুমের ডাক, নিশাচরের ডানা ঝাপটানো আর শিশিরের ছটফটানো সবটার সাক্ষী হয়ে দূর আকাশে মিটিমিটি হাসছে যেন তারারা। আজ চাঁদ নেই, গ্রামের পথে আলো নেই ঘুটঘুটে আঁধারে শিশির নিজেকে বড় অসহায় পায় মাঝ রাস্তায়। একটু আগেই বাবা আর শরত ভাই অলিপুর( কাল্পনিক) হাসপাতালে গিয়েছে। সে বারংবার বলল যাবে কিন্তু ভাই নিয়ে গেল না। তাকে বরং নিয়ে গেলেই তার নিশ্চল শ্বাসটা সচল হতো। বাড়িতে ফুপুআম্মার জ্ঞান ফিরলেও সে যে উঠে বসার অবস্থায়ও নেই তা জানে শিশির। সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার বলেই শরত তাকে রেখে গেছে। দুচোর পাতায় কারোই ঘুম নেই, গায়ে জোরও আর অবশিষ্ট নেই আর না মনে আছে। কিছুক্ষণ আগেই পদ্মাদিঘি থানা থেকে ফোন এসেছে শরতের নাম্বারে। তারা যে সন্ধ্যায় মিসিং ডায়েরি লেখাতে চেয়েছিল তা না নিলেও একটু আগে নাকি অলিপুর থানায় একটা মেয়ে আর একটা ছেলে গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। মেয়েটিকে জীবিত আছে তবে বাঁচবে কিনা এখনও সন্দেহ আর ছেলেটি মৃত। মৃত ছেলেটিকে সেখানকার কিছু তরুণ ছেলে চেনে বলে জানা গেছে সে পদ্মাদিঘির ছেলে। এটা জেনেই সেখানকার পুলিশ এই থানায় ফোন করে জানিয়েছে আর তাতেই পুলিশের ধারণা মেয়েটি তবে তারা যাকে খুঁজছে সেই। আর তাই শরতকে খবর দিতেই এখানকার পুলিশের সাথে শরত আর আহসানুল্লাহ গিয়েছে৷ শিশিরের শুধু চিন্তা ছেলেটার নাম কি শাওন? তাহলে মেয়েটি তার চঞ্চল পাখিই হবে। হাত পা অসাড় হয়ে এলো শিশিরের।

কথায় আছে বিপদের রাত সহজে ফুরায় না। নকশি আর বাড়ির প্রত্যেকেরই যেন তেমনটা মনে হচ্ছে ।শরতরা হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছেছে এক ঘন্টা পর। নকশির কান্নাকাটিতে শিশিরকে অনেকবার ফোন করতে হলো শরতকে জানতে তারা পেয়েছে কিনা আলতাকে। তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছুল তখন রাত একটা। আলিপুর হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি খুব একটা না থাকলেও আলতার সৌভাগ্যেই হয়ত আজ বিলেতফেরত এক বড় ডাক্তার ছিল তখন। ডাক্তারটি ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিন্তু হঠাৎ এমন এক রোগী আসায় নিজে থেকে চিকিৎসা করতে চাইলেন। অলৌকিকভাবেই কিনা কে জানে আলতার নিঃশ্বাস ঠিক হলো, দশ থেকে বারো মিনিট পানির নিচে থাকা নিথর দেহটি হঠাৎ করেই যেন প্রাণ ফিরে পেল। বেঁচে আছে মেয়েটি তবে ডাক্তার জানালো শঙ্কা কাটেনি । অন্তত কয়েকঘন্টা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। আর বেঁচে থাকলেও নিউমোনিয়ার সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা খুব আছে৷ ডাক্তারের কথা শুনে শরত, আহসানুল্লাহ নিজেরাই যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। পুলিশের সাথে আরো অনেক কথার মাঝে জানা গেল মৃত ছেলেটির লাশ সনাক্তকারীরা অলিপুর গ্রামের এবং তারাই জানালো ছেলেটি এই মেয়েটিকে খুব উত্যক্ত করতো। গ্রাম ভিন্ন হলেও সঙ্গের সঙ্গী বলে তারা আরও অনেক কিছুই জানে তাই সেই ছেলেদেরকেও পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে আর মেয়েটিকে পানি থেকে উদ্ধার করেছে যারা তারাই জানিয়েছে মেয়েটির হাত পা বাঁধা অবস্থায় ছিল গাড়িতে। শরত লক্ষ্য করেছিল অচেতন আলতার দু হাতের কব্জিতে আর পায়ের গোড়ালিতে রক্তাভ চিহ্ন। সে প্রথমেই বুঝেছিল আলতার হাত পা শক্ত কিছুতে বাঁধা হয়েছিল৷ কিন্তু শাওন তো আলতাকে মারবে বা নিজে মরবে এমন কোন কারণ ছিল না! শরতের এ নিয়ে মনে একটু সন্দেহ হলে সে পুলিশের কাছে জানতে চায় গাড়িটা পানিতে পড়েছিল কি করে কোন ধারণা! পুলিশ জানায় ছেলেটি গাড়িতে নিজেই ড্রাইভ করেছিল এবং মেয়েটিকে পেছনের সিটে বেঁধে রেখেছিল। গ্রামের ভেতরের রাস্তা খুব চওড়া নয় আর মেয়েটিকে যে জোর করে এনেছে তাতো বাঁধন দেখেই স্পষ্ট। হতে পারে মেয়েটি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে হাত পা ছুঁড়েছে আর ড্রাইভিং থেকে মনযোগ সরেছে ছেলেটার পাশেই পুকুর আর অল্পতেই গাড়ি গড়িয়েছে পুকুরে সেরকমভাবেও হতে পারে এক্সিডেন্ট। আন্দাজমাত্র বলা এটা আসলে হয়েছিল কি তা একমাত্র ছেলে আর মেয়ে দুটোই ভালো বলতে পারত যার মধ্যে একজন তো দুনিয়া ছাড়লো।

পুলিশের কথা শুনে শরত আবার বলল শাওনের মৃত্যুটা কি করে হলো? পুলিশ জানালো, “গ্রামবাসী যারা পানিতে নেমেছিল তারা প্রথমে মেয়েটিকেই পায়। এমনিতেই একটা হৈ চৈ ছিল মেয়েটিকে তোলার পর সবার খেয়াল মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা তা দেখায়। তখনো কারো মনে হয়নি গাড়িতে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি আছে৷ যতক্ষণে মনে পড়লো ততক্ষণে গাড়ি তলিয়ে গেছে আর পুলিশ যাওয়ার পর যখন জিজ্ঞাসাবাদের পর আবারও পানিতে নামানো হলো মানুষজন। অতল থেকে টেনে তোলা মুশকিল ছিল আর তাতে সময়ও ব্যয় হয়েছে অনেক যার দরুণ ছেলেটার মৃত্যু। এখানে করার কিছুই ছিল না কারো।”
সমস্ত আলোচনার পর পুলিশ চলে গেলে শরত বাড়িতে ফোন করে জানায় আলতা হাসপাতালে আছে এবং শিশির যেন সকালেই ফুপুআম্মাকে নিয়ে পৌঁছায়। শিশির বলতে চাইলো সে এখনি আসবে কিন্তু বলা হলো না। চুপচাপ ঘরের দরজায় পা মেলে বসে রইলো সে। নকশিকে বলল আলতা ভালো আছে আব্বা আর ভাই সকালে নিয়ে আসবে আলতাকে। নকশি যাওয়ার জন্য উতলা হচ্ছে দেখে শিশির আরো একটা মিথ্যে বলল, “আমরা এখন গেলে আলতা ভয় পাবে। সে এমনিতেই খুব ভয় পেয়েছে আরো ভয় পেলে ক্ষতি হবে তার।”

মেয়ের একটুও ক্ষতি হোক এমনটা তো কোন মা’ই চাইবে না।নকশিও চুপচাপ বসে রইলো ভোরের অপেক্ষায়।

এদিকে সদ্য বিয়ে হওয়া শিউলিরও একই অবস্থা। আজ তো তার জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সুন্দর একটি রাত হওয়ার ছিল। কিন্তু তার আর তার বর জামিলের তেমনটি হলো না৷ বাড়িতে কখনো আদর করে দুটো কথা না বললেও আলতার খোঁজে যখন তার শ্বশুরবারিতে ফোন করা হলো চিন্তায় তখন শিউলিও অস্থির হলো। চোখ দুটো তারও ভীষণ জ্বালা করলো আলতাকে হারানোর ভয়ে। বাড়ির অন্যরাও শুনে তাকে সান্ত্বনা দিলো কিন্তু তাতে কি আর মনের ভয় কাটে৷ সেও জানে গ্রামে এক শাওন আছেই যার কুনজর সর্বদা আলতার ওপর থাকে কিন্তু ইদানীং সে শাওনকে দেখেনি আলতার পিছু নিতে। কিন্তু আজকের ঘটনাতে প্রথমেই মাথায় আসে শাওন কিছু করেছে। জামিল অতি ধৈর্য্যশীল মানুষ তাই সে খুব ঠান্ডায় মাথায় শিউলিকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ভোরের আলো ফুটতেই সে শিউলিকে নিয়ে বাড়ি যাবে। শিউলির অস্থিরতায় জামিলের কষ্ট হলো তাই সে নিজেই রাত তিনটার পর শরতকে ফোন দিল। মাত্রই চোখের পাতা বুঁজে শরত টুলে বসে দেয়ালে হেলান দিয়েছিল। ফোন ভাইব্রেট হতেই সে আহসানুল্লাহর পাশ থেকে সরে গেল। কাকা একটু আগেই চোখ বুজেছেন একটা চেয়ারে বসে। খুব সাবধানে সে একটু দূরে গিয়ে ফোন ধরতেই জামিল সালাম দিয়ে জানতে চাইলো আলতাকে পাওয়া গেছে কিনা? খুব সংক্ষেপে শরত ঘটনাটা বলল এবং কাল কথা হবে বলে ফোন কাটলো। এতে স্বস্তি পেয়ে জামিলও শিউলিকে সবটা জানিয়ে একটু ঘুমানোর জন্য জোর করল।

চলবে