ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৬৩

0
1344

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৬৩)[পর্বটি প্রাপ্তমনস্কদের জন্য]
এমন মোহনীয় রুপে তানভীর ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। ধপ করে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। বাহুবন্ধনে আঁকড়ে নিলো জানু। আবেগে কাঁপছে তার কন্ঠ। কোনভাবে আওড়ালো,
‘ আমার রাণী!’
লাবিবা হাতদুটো তানভীরের কাঁধে রাখলো। ভর দিয়ে সেও বসে ঝুঁকে গেলো তানভীরের সামনে। চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো, ‘ এতো কেনো ভালোবাসেন আমাকে খান সাহেব? ভালোবাসলে বিপরীত মানুষটার প্রতি হেরে যেতে হয় জানেন? ‘ কি উত্তর দিবে তানভীর। প্রবল আবেগে কাঁপছে এখনো তার দেহ। শক্ত পোক্ত পুরুষ মানুষ টা কখনো কারো নিকট হারতে চায়নি। হেরে যাওয়া শব্দটাই ধারণ করতে পারেনি। আর জেনে বুঝে নিজের থেকে অনেক কম বয়সী এক নারীর কাছে ইচ্ছে করেই গো হারা হেরে বসে আছে। এই নারীর কাছে তার স্থান এখানেই, এভাবেই।
‘ তুমি যদি সারাজীবন এভাবেই আমার কাছে থাকো আমাকে ভালোবাসো আমার স্ত্রী ধর্ম পালন করে যাও আমি একবার দুবার নয় বারবার তোমার কাছে হেরে যেতে চাই। সেই হারাই হবে আমার জিত। আমার বেঁচে থাকার প্রয়াস। ‘
চারিপাশে গুমোট একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। লাবিবার চোখ থেকে অনবরত জল ঝড়ছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। তানভীর অপলক তাকিয়ে আছে লাবিবার দিকে। এই দৃষ্টির মানে লাবিবা বুঝে। ছটফট করে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ভুল করে তাকালেও ভুল ভেবে নেয়। চঞ্চল নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজেকে সচল রাখতে কথা ঘুরায়।
‘ খান সাহেব! গান শুনবেন? ‘
‘ শুনাও। ‘
‘ কানে কানে গাই?’
‘ গাও। ‘
লাবিবা মুখটা কানের কাছে নিয়ে যায়। ইসসস! এতোক্ষনে যেনো সেই দৃষ্টির বাইরে চলে আসতে পারলো। চিকন কন্ঠে ফিসফিসিয়ে সুর তুলে,
‘ শোন গো দখিনা হাওয়া.. প্রেম করেছি আমি।
লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি। ‘
কানের মাঝে এই ফিসফিসানি চিকন কন্ঠ ই যেনো তানভীরের কাল হলো। গান তৎক্ষনাৎ অফ হয়ে গেলো। এক ঝটকায় লাবিবাকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো তানভীর। লাবিবা আচমকা ভয় পেয়ে একহাতে গলা আরেকহাতে পিঠ জড়িয়ে ধরলো। বেলকনিতে প্রস্থান করলো মূহুর্তে ই। পা দিয়ে কাচের দরজা টেনে লক করে দিলো। বিছানায় কমফোর্টলি শুইয়ে দিলো লাবিবাকে। সরে দাঁড়াতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। লাবিবা হাতের বেষ্টনী তৈরি করে ফেললো। তানভীরকে সরতে দিতে চাইলো না। লজ্জায় তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এতো কেনো লজ্জা লাগছে তার? তার সাথে কি লজ্জা আদৌ যায়? কনফিউশনে পড়ে নিজেকে নিয়ে বারবার। লাবিবার শরীরের কম্পন টের পেয়ে তানভীর মৃদু হাসলো। ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। শাড়ির আঁচল তখন তার হাতে পেঁচিয়ে গেছে। লাবিবা খামচে ধরে। তানভীর আফসোসের গলায় বলে,
‘ কয়েক বছর থেকে দেখে যাচ্ছি। তোমাকে কখনো আয়োজন করে দেখা হয়নি। আজ মন ভরে দেখতে দাও জান!’
শাড়ির শেষ সুতোটাও ততক্ষণে তানভীরের হাতে উঠে এসেছে। লাবিবা দৃষ্টি মেলাতে পারছেনা তানভীরের দৃষ্টিতে । মায়া, ভালোবাসা, আকাঙ্খা, প্রেম, কামনা মিশ্রিত সর্বগ্ৰাসী সেই দৃষ্টি। নারীকে কাছে টানতে হয়না। ছুঁতে হয়না। এই দৃষ্টিই যথেষ্ট তাকে ঘায়েল করার জন্য। লাবিবা নিরুপায় হয়ে ডাকে,
‘ খান সাহেব! প্লিজ! ‘
তানভীর ঝুড়ি থেকে তুলে আনা গোলাপগুলো ঢেলে দেয় লাবিবার উপর। মন ভরে দেখার পর ঠোঁট চেপে ধরে কপালের মাঝ বরাবর। কিছুক্ষন পর নেমে আসে মুখের উপর। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে, ‘ শত শত গোলাপ আমার রাণীর সৌন্দর্যের নিকট অতি নগন্য। ‘
লাবিবার বন্ধ চোখে চুমু দিয়ে বলে,’ আমার চোখে আমার রাণী পৃথিবীর দ্বিতীয় সুন্দরী। আর প্রথম সুন্দরী তার শ্বাশুড়ি। ‘
গালে হাত রেখে নাকে নাক ঘষে বলে,
‘ চোখ খুলো জান। ‘
‘ না। ‘
‘ দেখো আমাকে। ‘
‘ না। ‘
‘ ইসস তাকাও না জান! ‘
‘ পারবোনা। ‘
‘ আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। ‘ শুয়া থেকে উঠতে ধরে তানভীর। লাবিবা চোখ মেলে ঝট করে কলার টেনে ধরে। চোখে চোখ মেলায়। যেতে দিবে না। কোথাও যেতে দিবে না। মাথা নাড়িয়ে না করে। নিঃশব্দে হাসে তানভীর। গালে গাল ঘসে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি আছে আমার চোখে?’
‘ আমার_ । ‘ লাবিবার কন্ঠ বুজে আসছে ।
‘ তোমার?’
‘ আমার__ আমার সর্বনাশ!’

জেদ নিয়ে চোখে চোখ রাখে তানভীর। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ তোমার সকল সংকোচ লজ্জার বিনাশ ঘটুক আমার হাতে। ‘
রাত যত গভীর হতে থাকে ততো গভীর হতে গভীরতম স্থান করে নেয় তানভীর লাবিবার মাঝে। বিন্দু মাত্র ছাড় নেই। তৃষ্ণার্ত কোপত কপোতী উগ্ৰ হলো দুটি মন দুটি দেহ একাকার করে নিতে। এই প্রেমের নেই শেষ। মৃত্যু অব্দি দুজন দুজনকে এভাবেই ভালোবেসে যাবে প্রতিজ্ঞা করে।

সম্পর্কে সময় নেওয়া যায়। তবে বেশী সময় নেওয়া বোকামি। রোজীর কাছে হেল্প চেয়ে তামিম নিজেই রোজীকে হেল্প করছে তাকে কাছে টানতে। সময়টা তামিম বাসাতেই দিচ্ছে। তামিম রোজীর সম্পর্ক নিয়ে খুব চিন্তিত সোহানা ইসলাম। যদিও ছেলে বাসায় থাকে। তবুও সম্পর্কটা গভীর হোক। রোজীকে কোন কাজেই হাত দিতে দেয়না সোহানা ইসলাম। ওসব কাজের লোক আছে তারা করে নিবে। সোহানা যখন রান্না করে রোজী পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। বার বার বলে, ‘ মামুনি দিন তরকারীটা আমি করে নিচ্ছি। আমি রান্না মোটামুটি সবই পারি।সোহানা বলে, ‘ আমার ছেলেরা ছেলেদের পাপা আমার হাতের রান্নাই ভালোবাসে। আমি যতদিন আছি তুমি রেষ্ট নাও মা। আমার পরে তো তোমাকেই রান্নাঘর সামলাতে হবে। ছোট বউকে এতে ডেকোনা। ওর গায়ে ফোস্কা ওঠে যায়। প্রাকটিস থাকার জন্য মাঝে মাঝে রান্না করো যখন আমি আমার কাজে ব্যস্ত থাকবো। আমার উপকার ই হবে। ‘
রোজী অবাক হয়ে যায়। মুখ ফসকেই বলে ফেলে,
‘ তাহলে কি আমি বসে বসে শুধু খাবো?’
সোহানা একপলক রোজীর দিকে তাকায়। শ্বাশুড়ি হলেও তাকে টুক টাক কিছু কথা বাধ্য হয়েই বলতে হবে। আশেপাশে সবাইকে পর্যাপ্ত ডিসটেন্সে দেখে নিয়ে নিচু স্বরে বলে, ‘ মা তুমি শুধু আমার ছেলের যত্ন নিবে। তোমার জায়গাটা ভীষন নড়বড়ে। আর আমার ছেলটাও প্রাণহীন। তাকে আগের মতো করে তুলো। তার মনে জায়গা করে নাও। যেদিন দেখবো আমার ছেলে তোমার জন্য পাগলামী করছে সেদিন আমি তোমাকে এই কিচেনে অবাধ স্বাধীনতা দিবো। ‘
সোহানার নিরব শাষানোতে রোজী বেরিয়ে এসে ভয়ে বুকে হাত চেপে ধরে। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। অনেকক্ষন বসে উপলব্ধি করে তার জায়গাটা সত্যিই ভীষন নড়বড়ে। যেখানে স্বামীর ছায়া নেই সেখানে কিচ্ছু নেই। অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাকে আদায় করে তারপর অধিকার খাটাতে হবে। নিজের অতীত চিন্তা করে। কি ভয়াবহ! কি মানসিক অত্যাচার! শারীরিক অত্যাচার ও কি কম? আর সেই লম্পট লোকটা! রোজী গায়ে হাত পড়েছে তার কতবার! ভাবলেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। রোজীতো চেয়েছিলো এই তামিমের মতো মানুষকে। এতো বুঝদার। এতো সুন্দর ব্যাক্তিত্ব। এতো ভালো একটা মানুষ। যে মন থেকে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার মানুষের জন্য কষ্ট পেতে জানে। সেই মানুষটার কষ্ট ভুলাতেই তো তাকে আনা হয়েছে। ওরে বোন! লাবিবা, যার কষ্টের সীমা নেই তাকেই আনতে হলো আরেক কষ্টের কাছে? নয়তো কোথায় যেতো রোজী? দ্বিতীয় বিয়ের সমন্ধ কি তার হয়নি? সেইতো এক বৌ আছে। বৌয়ের বাচ্চা হয়না জন্য। বৌ মরেছে বাচ্চা পালার জন্য। বুড়ো। দিন আনে দিন খায়। হা ভাতে অবস্থা! তামিমের মতো একজন ভেজাল বিহীন ডিভোর্সী বড়লোক ডাক্তার সে কোথায় পেতো? পেলো তো পেলো তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো। কি করবে সে? কিভাবে জায়গা নিবে তামিমের মনে,খুব নিকটে? প্রচুর হেল্পলেস লাগছে তার। এই বাড়িতে তার শক্তি লাবিবার বড্ড অভাববোধ করলো। মেয়েটা তাকে একা ফেলে চলে গেলো। রোজী ভীষনভাবে একটা হাগ পাবার অভাব বোধ করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই তামিমের ডাক পড়লো। কফি দেবার জন্য। রোজী কফি নেওয়া বাদ দিয়ে ছুটলো। একছুটে তামিমের বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। তামিম পুরো ভড়কে গেলো। রোজীর কাধ ধরে ঝাকালো।
‘ রোজ! হুয়াটস হ্যাপেন? রোজ!’
রোজী নিজেকে ধীরে ধীরে সামলে নিলো।
‘ কান্না থামাও। কান্না থামাও। হুম। বলোতো কি হয়েছে?’
রোজী চুপ থাকলো। মুখ ফুটে বলতে পারলো না তার তামিমকে প্রয়োজন। তামিমের দেহ মন দুটোই তার প্রয়োজন। কবুল বলে সে নিজেকে তামিমের নামে করে দিয়েছে। আচ্ছা কবুল করার পর তো আল্লাহর তরফ থেকে মায়া চলে আসে। টান সৃষ্টি হয়। তামিমের হয়নি? তার বুকের পাঁজরে কে তৈরী? রোজী তো?
তামিম যত্ন নিয়ে উড়নার পাড় দিয়ে চোখ মুছে দিলো। জিজ্ঞেস করল, ‘ মন খারাপ? বাসার জন্য মন কেমন করছে?’
রোজী টলমলে চোখে তাকালো। তামিম খেয়াল করলো রোজীকে আগের থেকে এখন আরো অসুস্থ লাগছে। তার মুখ দেখে যে কেউ বলে দিবে সে অসুস্থ। তামিম নিজে থেকেই বললো, ‘ রেডি হও। লাঞ্চের পর আমরা তোমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো। থাকা যাবেনা কিন্তু। খুশি?’
রোজীর চোখ চকচক করে উঠলো। আনন্দে ভরে উঠলো। সে যেনো আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলো। মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘ হ্যা। খুশি। ‘

টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। তামিম রোজী একেবারে রেড়ি হয়েই বেরিয়েছে। খেয়ে তারপরেই রওনা দিবে। ফিরে এসে আবার আটটা থেকে তার চেম্বারে বসতে হবে। সোহানা ইসলাম জিজ্ঞেস করলো, ‘ তোমরা বেরোচ্ছ? ‘
‘ হ্যা মম। রোজ কান্নাকাটি করছে। ওকে একটু ওর মামা পাপার সাথে মিট করিয়ে নিয়ে আসি। ‘
‘ খারাপ লাগছে মা? ‘
রোজী মাথা নীচু করে নেয়।
‘ ফাস্ট টাইম একটু খারাপ লাগবেই। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ‘
রোজী মনে মনে বললো, ফাস্ট টাইম না মামুনী। আমার বছরের পর বছর বাবা মার মুখ না দেখে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। সোহানা ইসলাম তামিমকে যাবার সময় বললো, ‘ রাত হলেও চলে এসো। শ্বশুড়বাড়িতে আবার থেকো না যেনো। ‘
‘ চলে আসবো মম। ‘

ওরা যাবার পর ফিরোজ খান জিজ্ঞেস করলো, ‘ এক ছেলে বেয়াদবি করলো আরেকছেলেকে শ্বশুড়বাড়িতে থাকতে নিষেধ করা হয়। এমন আইন কেনো?’
‘ কে বেয়াদবি করলো?’
‘ কেনো তোমার ছোট ছেলে। ‘
‘ বেয়াদবি কোথায়? আমার ছেলে তো হানিমুনে গেছে। ‘
ফিরোজ খান কটমট করে তাকালো। ‘ আমার সম্মান টানাটানি করে হানিমুন করা হচ্ছে! তুমিও সায় দিচ্ছো তাতে। ‘
‘ সায় না দেবার কি আছে? নিরিবিলি তে একটু ছেলে মেয়েরা সময় কাটাতে চেয়েছে তো সায় দেবো না? ফিরে এসে তো ছুটবে তোমার কাজে। রিসোর্ট তো আমিই বুক করে দিলাম। বোকা নেতা! পাশে থেকেও কিচ্ছু দেখেনা। ‘
ফিরোজ খান যেনো শক খেলো। ‘ কি? তুমি জানতে! তাহলে আগে কেনো বলোনি?’

চলবে ___