#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০২
#আনিশা_নিঝুম
আশফি নিজের পোশাক খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেললো। উন্মুক্ত শরীরে পিঠ এলিয়ে দিলো সোফায়। মেঝেতে তার পোশাকটি অবিন্যস্ত রূপে পরে আছে তখন। ঘরের দরজা খুলে প্রবেশ করলো এক মাঝবয়সী নারী। মেঝেতে অবিন্যস্ত রূপে পড়ে থাকা পোশাক নিজের হাতে গুটিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল,’বাড়িতে বউ আছে তা মনেহয় ভুলতেই বসেছো!’
আশফি পিটপিট করে চোখ খুললো। চোখ খুলতেই নিজের স্ত্রীর রাগী দৃষ্টি দৃশ্যমান হলো। আশফির অন্তরে বিরক্তি কাজ করলো! মেয়েটা বুঝি তাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবে না! আশফি সোফায় পা এলিয়ে বলল,’আজ পনেরো দিন পর ট্রেনিং থেকে বাড়ি ফিরেছি। ফিরার সাথে সাথেই তোমার কাকের মতো ক্যা ক্যা শুরু হয়ে গেলো? আমি চাকরী না করলে খাবে কি?’
পূর্ণা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো নিজের স্বামী আশফির দিকে। তাদের প্রেমের বিয়ে। বিয়ের পূর্বে আশফি তাকে বলতো,’চাকরী একদিকে আমার পূর্ণতা একদিকে! চাকরীর সাথে আমি কোনোদিন আমার প্রাণকে কষ্ট দিবো না। সে যে আমার প্রাণ! প্রাণকে কষ্ট দিয়ে থাকা যায়নি?’
পূর্ণা তখন জবাব দিতো না মৃদু হাসতো। বিয়ের শুরুতে এই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও এখন আশফিকে সে দু মিনিটের জন্যও কাছে পায় না। রাত হলে ঘুমানোর সময় আশফিকে একটু জড়িয়ে ধরতে গেলেই এ ওর ফোন এসে আশফিকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ফোন পেতেই আশফি কোনোরকম তার স্ত্রী পূর্ণাকে একা রেখে ছুট লাগায় কাজে। মানুষটার মধ্যকার এতো পরিবর্তন বুঝে উঠতে পারছে না পূর্ণা। আশফির আড়ালে অশ্রু মুছে বলল,’হুম। ফ্রেশ হয়ে আসো, খেতে দেই।’
‘কী রেঁধেছো?’
পূর্ণা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,’চিন্তা করো না তোমার পছন্দের খাবারই বানিয়েছি। তুমি আমার খেয়াল না রাখলেও আমি রাখি কারণ তিনকবুল বলে তোমার অর্ধাঙ্গিনী হয়েছি তো! সেই হিসেবে আমারও কিছু কর্তব্য আছে।’
পূর্ণার তাচ্ছিল্য মিশ্রিত কথায় যেনো আশফির মনে কোনোরকম অনুশোচনার জন্ম নিলো না। উলটো বিরক্তি প্রকাশ করতে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করলো।
৩.
কাঁচ ভেদ করে হাতের ভিতর প্রবেশ করতেই ব্যাথায় শব্দ করে উঠলাম আমি। চোখ থেকে মুক্তার ন্যায় পানি ঝরছে। ব্যাথা কি তা অনুভব করছি বলেই চোখ থেকে পানি পড়ছে। চোখের পানি হাতের কাটা জায়গায় পড়তেই চোখ খিচে বন্ধ করলাম। এ ব্যাথা সহ্য করার মতো না। সেই একই অনুভূতি আজও হচ্ছে! পার্থক্যটা হলো তখন কাঁচ প্রবেশ করেছিলো গ লায় আর আজ প্রবেশ করেছে হাতে।
বোবার মতো ব্যাথা সহ্য করতে থাকলাম। চাইলেও পারছিলাম না কাউকে ডাকতে যেনো কেউ আমার গলা চেপে ধরে রেখেছে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসতে শুরু হলো আমার। জোরে জোরে কয়েকদফা শ্বাস নিলাম।
চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম। সফেদ রঙা বিছানার চাদরটি আঙ্গুল দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম। হাতে লাগোয়া ক্যানোলা এক টানে খুলে ফেললাম, ব্যাথা হলো সহ্য করে নিলাম। হাঁটুর মাঝে মুখ গুজে বসে রইলাম। ভয়ে আমার সারা শরীর ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে।
তখনই কেবিনের দরজা খুলে হন্তদন্ত করে প্রবেশ করলো কেউ। আমার কাছে এসে বলে,’স্নিগ্ধতা, ঠিক আছো?’
গতরাতের সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে লাল চোখে তাকালাম তার দিকে। আমার চোখ দেখে যেনো সে ভড়কে গেলো। দু হাত দিয়ে আমার মাথা নিজের বক্ষস্থলে চেপে ধরে বলল,’স্নিগ্ধতা, কাম ডাউন। এখানে তোমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ভয় পেও না।’
আমি ত্রিধারের হাত শক্ত বাঁধনে চেপে ধরলাম। আমার নখ তার হাতে লাগলো, ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলেন সে। আমার মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’স্নিগ্ধতা তোমার সাথে কি হয়েছে খুলে বলো আমায়?’
তার কথায় আজ সকালের কথা মনে পড়তেই ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ছেড়ে দিলাম ত্রিধারকে। ত্রিধার আমার ছাড়া পেতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসে বলল,’আমার অনুপস্থিতিতে কি হয়েছে? বলো!’
আমি অল্পস্বল্প কাঁপা কণ্ঠে বললাম,’ ঘুমের মধ্যে আমার হাতে ভীষণ ব্যাথা করছিলো, নিদ্রা কাটতেই দেখলাম আমার ঘরের জানালার কাঁচ ভাঙ্গা যেনো কেউ জানালা ভেঙ্গে ঢুকেছিলো। আশ্চর্যের বিষয় আমি এতোটাই গভীর ঘুমে ছিলাম। কেউ আমার ঘরে এসে জানালা ভেঙ্গে চলে গিয়েছে তার ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।’
আমার কথা শুনে হয়তো অবাক হলেন ত্রিধার। তার চেহেরা দেখে তাই মনে হলো। তিনি রাশভারী সুরে বলেন,’তুমি কি ঘুমের কড়া ডোজের মেডিসিন নিতে?’
আমি দুপাশে নাসূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম,’না! আপনি নিজেই তো কাল আমাকে খাইয়ে দিলেন। তখন তো দেখেছেনই আমি কোনো মেডিসিন নিয়েছি নাকি।’
‘হুম।’ বলেই ত্রিধার হনহন করে বেরিয়ে পড়লো কেবিন থেকে। তার যাওয়ার পানে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম আমি। তাকে বলতে ইচ্ছে করছিলো আরেকটু থাকুন আমার সঙ্গে, এই মূহুর্তে আমার ভীষণ সঙ্গ প্রয়োজন! আমাকে এইভাবে একা ফেলে যাবেন না ত্রিধার। কিন্তু মুখ দিয়ে যেনো আমার একটা শব্দও বের হলো না।
কিছুক্ষণ বাদেই ত্রিধার আবারো এলো আমার কাছে। আমার হাত টেনে বললেন,’স্নিগ্ধতা, আমাদের এখনই এই শহর ছাড়তে হবে।’
আচানক শহর ছাড়ার কথায় আমি পিলেই চমকে গেলাম! শুকনো গলায় বললাম,’হঠাৎ কি এমন প্রয়োজন পড়লো?’
ত্রিধার বললেন,’এতো প্রশ্ন করো না। হসপিটালের এই পোশাক পড়েই যাবে। এখন ড্রেস চেঞ্জ করার মতো সময় নেই।’
ত্রিধারের কথায় রাগ হলো আমার! ত্রিধার আমাকে টানতেই আমি নিজের হাত ছাড়িয়ে বললাম,’পলাশী আপুকে না দেখা অব্দি আমি এক পাও নড়বো না।’
ত্রিধার শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। তারপর বললেন,’তোমার জন্য আমি আমার প্রাণ বিসর্জন দিতে পারবো না। তাই ন্যাকামো না করে চলে আসো!’
আমার উত্তর শোনার অপেক্ষা করলেন না ত্রিধার। করবেনই বা কিভাবে? সময় যে নেই! তাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করার মতোও ফুসরত পেলাম না।
ট্রেন ছাড়তে সময় লাগবে আরো পাঁচ মিনিট। ত্রিধার আমাকে নিয়ে ট্রেনের ভেতর বসে আছেন পনেরো মিনিট যাবত! অতিষ্ঠ হয়ে আমি বললাম,’ক্ষিদে পেয়েছে আমার! খাবার এনে দিন।’
ত্রিধার আড়চোখে তাকিয়ে বললেন,’খাওয়া লাগবে না। একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে।’
ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি, গম্ভির কণ্ঠে বললাম,’আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘চট্টগ্রাম!’
‘ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম? ওতো দূর কেনো?’
আমার প্রশ্নে ত্রিধার রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,’এতো প্রশ্ন করো কেনো স্নিগ্ধতা? বিরক্ত লাগছে আমার!’
‘খাবারও এনে দিবেন না আবার কথা শুনে বিরক্ত হবেন। পাষাণ, নির্দয় লোক একটা!’
আমার কথা যেনো ত্রিধার এক কানে নিলেন আরেক কান দিয়ে বের করলেন। মনে মনে ভীষণ রাগ হলো আমার কিন্তু ত্রিধারের উপর না নিজের পরিবারের উপর! তারা ত্রিধার নামক জঞ্জালটাকে কেনো আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন? এতোই বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার গলায় আরেকটা বোঝা ঝুলিয়ে দিয়েছেন? রাগে নতজানু হয়ে বসে রইলাম। ট্রেনে উপস্থিত সকল প্যাসেঞ্জার অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, নাহ আমার পোশাকের দিকে! তাদের দু একটা বাচ্চা হাসছে, অস্বাভাবিক কি? আমি লজ্জায় নুইয়ে গেলাম।
‘পর্দা টেনে দিয়েছি, মাথা এতো নিচু করা লাগবে না।’
রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলেন ত্রিধার। আমি একটু স্বাভাবিকবোধ করলাম। ত্রিধার ফের বললেন,’স্নিগ্ধতা, এখন যতটা পারো ঘুমিয়ে নাও কারণ আজ রাতে ঘুমাতে নাও পারো।’
ত্রিধারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম,’কেনো?’
‘এইসব কঠিন হিসাব তোমার মগজে ঢুকবে না।’
‘তো বলছেন কেনো?’
‘তোমাকে রহস্যের বেড়াজালে ফেলার জন্য!’
এই প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না আমি। নিঃশব্দে বসে রইলাম। মিনিট পাঁচেক এইভাবে থাকতেই ত্রিধারের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। আমি তাকালাম, ত্রিধার আস্তে করে ফোন হাতে নিয়ে কানে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,’সব কিছু তৈরি রেখেছিস?’
ফিসফিস করে বললেও অস্পষ্ট ভাবে কথাটা কানে গেলো আমার। অপরপাশের ব্যক্তি কি বলল শুনলাম না, শুনার কথাও না।
ত্রিধার গম্ভীর স্বরে ফোনে বললেন,’প্রয়োজনীয় সব কিছু রেডি রাখিস কিন্তু। কোনো কিছু হলে একেকটার ব্রেন খুলে হাতে ধরিয়ে দিতে পারি যাতে।’
কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম আমি। ত্রিধার আমাকে লক্ষ্য করতেই ইতস্ততবোধ করে নড়েচড়ে উঠলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছি।
#চলবে?
| ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। |