#তোমাতে_আমাতে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১১
দুপুরের সোনা রঙা রোদটা সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছে এক অদ্ভুত ভালোলাগা শুরু হয়েছে। যদিও মনটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালো নয়।
অবশ্য ভালো থাকার কোন কারনই নেই। ইমন আজকাল বড্ড বেশী রকমের বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বাড়াবাড়িইতো আমি আজকে সাতটা দিন ওদের বাসা থেকে আসলাম! অদ্ভুত একটা ফোন পর্যন্ত করলোনা। অদ্ভুত কেন এইটাইতো স্বাভাবিক। ইমন নামের অদ্ভুত মানুষের স্বভাবটাই এমন। জানিনা কোন কুক্ষনে এই মানুষটা আমার কপালে এসো জুটলো। নাহ! কপালটা যে মন্দ এইটা এইবার স্বীকার করতেই হয়। কত কি ভেবেছিলাম। ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে। কত বিনিদ্র রজনী যে নির্ঘুম কাটিয়েছি স্বপ্নের জাল বুনে সেই সব মিছে! মিছেরে সব আদি!
এইবার তুই কি করবি?
জানিনা…
হাওয়া যেদিকে বইছে বইতে দাও….
— আদৃতা এই কাঠখোট্টা রোদে দাঁড়িয়ে রঙ নষ্ট করছিস কেন ?
ঘরে যা..??
ভাবনার জগতে হানা পড়লো। খুবি হতাশ…
নাহ এরা আমায় শান্তি দিবেনা। মন চায় দূরে কোথায় পালিয়ে যাই।
আমার হাত ধরে মা জননী সিড়ি দিয়ে সুরসুর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
— এইভাবে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসার কি খুব দরকার ছিল।
মা কোন কথা আর কারণ ছাড়াই গরুর মত আমাকে টেনে হিচড়ে নিয়াসলো।
হ্যা আসলেই আমি একটা গরু।
নইতো কি এতদিনেও ইমনের মুখে ভালবাসি কথাটা শোনতে পেলাম না। আমার বান্ধবী পিউ হলে এতক্ষনে ইমনকে কান ধরে নাচাতো। আর আমি আস্ত গরু।
আমি তখন ক্লাস সিক্স অঙ্ক ভুল করায় স্যার সেদিন আমাকে গরু বলেছিল। সবাই মুখ টিপে হাসছিল। আমার দুচোখ ফেটে জল এসেছিল। কিন্তু না স্যার আমাকে ঠিকি বলেছিল…
এবসোলেটলি রাইট স্যার..
রুমের সামনে এনে হাতটা ছেড়ে দিলো।
— যাহ দেখগে কে এসেছে। কতক্ষন ধরে বসে আছে।
— কে এসেছে?
আমার চিবুক আলতো করে ছুয়ে মা বললো,
— যার জন্য আপনি ব্যাকুল আছেন। আর ছাদে গিয়ে একঘণ্টা যাবৎ ন্যাকামো গুলা করছেন। আর গত কয়েকদিন যাবৎ এমন থুম মেরে আছেন যে আপনার জামাই আরেকটা বিয়ে করে এনেছে। যান আমার একমাত্র মেয়ের জামাই এসেছে। এইবার দেখা করে আমাকে উদ্ধার করো মা।
আচ্ছা মা বুঝে গেছে আমি ইমনের জন্য এমন করছি। আচ্ছা সবাই কি বুঝে গেছে। কি সাংঘাতিক!!
আমি বেকুবের মত মায়ের দিকে তাকালাম।
— আমার দিকে হা করে না তাকিয়ে ওইদিকে যাও।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
রুমে ঢুকতেই কলিজাটা ঢক করে উঠলো। বিছানার এক কোনে স্কাই কালার টি শার্ট পরা, চুলগুলো উস্কুখুস্কু গালে হাত দিয়ে বসে আছে মানুষটা।
চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম পুরা লালটকটকে চোখ। এইটা মনে হয় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস। কি জানি কি আছে কপালে!
আমার পায়ের শব্দেই ও আমার দিকে তাকালো। তাকালোতো তাকালোই পলক ফেলার নাম গন্ধও নেই..
আচ্ছা আমি কি ঠিক আছিতো..
নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। নাহ ঠিকিতো আছি।
আগে আমার কথা বলা
উচিৎ ।
— কখন এসেছো?
— জানিনা।
বড্ড কাটাকাটা শোনালো।
— ওকে ফাইন! আপনি জানেনা না আপনি কখন আসছেন? নাহ ভাবছি আপনার ভবিষ্যৎ পেশেন্ট দের কপালে কি দুর্গতি অপেক্ষা করছে আল্লাহ মালুম!
তা খেয়ে আসছেন? নাকী সেটাও জানেন না বা ভুলে গেছেন।
— খেয়ে আসছি।
নির্লিপ্ত গলায় বললো।
— আচ্ছা এমন ভর দুপুরবেলা এসে কিছু না খেলে কেমন দেখায়। নাহ মানে বলছিলাম একটা ফর্মালিটি বলেওতো কথা আছে। তা কি নেবেন চা না কফি চট করে বলে ফেলুনতো।
— কেন খুব তাড়া আছে নাকি?
বলতে বলতেই বসা থেকে উঠে পড়লো।
আকস্মিক আমার একদম খুব কাছে চলে এলো। যতটা কাছে এলে একজন আরেকজনের হার্টবিট শোনতে পায়। খপ করে আমার কনুইএর একটু উপরে ধরে ফেললো।
— আমার বাসায় কি খবার এর অভাব পড়ছে?
তোমার কি মনে হয় আমি দুপুরবেলা আসছি বলে খেতেই আসছি।
— উঁহু ছাড়। লাগছে আমার।
— লাগুক। লাগবে বলেইতো এইভাবে চেপে ধরেছি বুঝোনা তুমি?
আমি অন্য হাত দিয়ে ওর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না।
অসহায়ের মত ওর দিকে তাকালাম। চোখে জল এসে গেল ব্যাথায় কুঁকড়াতে লাগলাম।
— খুব লাগছে নাহ। আমারো লেগেছে। খুব লেগেছে..।
আমার হাতটা এইবার ছেড়ে দিলও। তারপর কি মনে করে যেন বিছানায় বসলো।
আমি আমার হাতের উপরের দিকে হাতাতে লাগলাম। ফরসা হাতে কেমন পাঁচ আংগুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে। কোন ছেলের হাত এতো শক্ত হতে পারে ইতিপূর্বে আমার জানা ছিলোনা।
রাগে আমার শরীর জলছিলো।
ইমন আমার দিকে ইশারা করলো ওর পাশে বসার জন্য।
আমি বসছিলাম না দেখে চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমি চুপটি করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
কোন কথা বলছিলাম না।
কি বলবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।
নিরিবতা ভেংগে সেই বললো,
— চেহারার এই হাল বানিয়েছো কেন?
খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করোনা?
আর ভরদুপুর বেলা ছাদে গিয়েছিলে কেন?
— চেহারা যখন আমার তখন যা খুশি তাই করতে পারি । আর ছাদে গিয়েছিলাম টাংকি মারতে।
গমগম করে কথাগুলো বলে দিলাম। বেশ হয়েছে।
অগ্নিচোখে আমার দিকে আবার তাকালো ও। এইবার আমার ভয় হতে লাগলো।
— এই শোন মেজাজ একদম খারাপ করাবা না।
এমনিতেও তোমার প্রতি অভিযোগের পাল্লাটা ভারী হয়ে আছে। প্লিজ আর বারিয়ো না।
চুপ করে থাকাটাই মনে হয় উত্তম। ধুর এর সাথে কথা বলতে গেলেই ঝামেলায় পড়তে হয়।
— কি হলো কথা বলছো না কেন? এখন চুপ করে আছো কেন? ঝগড়া করার সময়তো আর বলে দিতে হয়না। মাশ আল্লাহ একাশো।
— আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ চুপ করো।
আর তুমি আমার উপর স্বামিত্ব ফলাতে আসবা না।
— এই তুমি এত সাহস কোত্থেকে পাও?
সেদিন তুমি আমাকে ঘুমে রেখে কোন সাহসে বাসা থেকে চলে আসলা?
আমি কি তোমাকে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছি?
— আমি কারো পারমিশনে চলি না। আমার ইচ্ছের উপর এখনো সম্পূর্ন কিছু নির্ভর করে। ইনশাল্লাহ ভবিষ্যৎ এও নির্ভর করবে।
— সেট আপ! জাস্ট সেট আপ! কালকে থেকে তুমি আমার পারমিশন ছাড়া বাসা থেকে এক পাও বের হবানা।
আর একটা কথাও বলবা না।
আমি বিছানা থেকে উঠে পড়লাম।
চিৎকার করে বললাম,
— হুয়াট??
ইমন আমার দুই কাধ ধরে ওর একদম গা গেষে জোড় করে বসালো। আমি ওর হাত ছাড়িয়ে দিতে লাগলে ও আবার জোড় করে ফেললো। এইবার আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে ফেললো শক্ত করে।
আমি রাগান্বিত হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
— এই ছাড়ো বলছি। তুমি ছুবেনা আমাকে।
— কেন ছোয়া বারণ বুঝি?
— হ্যা বারন।
— আচ্ছা, আজকে আমি কোন বারণ টারন মানছি না কেমন!
ওর কথা শুনে আমার কান গরমহয়ে যাচ্ছে। কি বলছে এগুলো । কি করতে চাইছে?
— তুমি না ছাড়লে কিন্তু আমি চিৎকার করবো।
ও মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালো,
— ওহ রিয়েলি? ওকে চিল্লাও
যত পারো যদি তোমার আত্নসম্মানবোধ না থাকে।
ইমন একঝটকায় আমাকে ওর বুকের কাছে নিয়ে গেল। একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ওর বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি আমার হার্টবিট মিস করেছি।
আমার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
— কি হলো চিল্লাও। দেখি কে আসে তোমাকে বাঁচাতে।
আমি সাত পাঁচ না ভেবে মা মা বলে চিৎকার করে উঠলাম।
আমার মা মা চিৎকার শুনে মা দৌড়িয়ে আসলো।
আমার এহেন কর্মকান্ডে ইমন আমাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
— আদৃতা কি হয়েছে? ওইভাবে চিল্লাই ডাকলে কেন?
সত্যইতো কি হয়েছে? এইবার কি বলবো মাকে।
আমি ইমনের দিকে বড় বড় চোখে তাকালাম।
— তেলাপোকা!!
ইমনের কথা শুনে আমার চমক ভাংগলো।
— কোথায়? কিসের তেলাপোকা?
ওইতো আংগুল দিয়ে একটা তেলাপোকা দেখালো ইমন। আমি ওর চোখ অনুসরণ করে দেখি টেবিলের কাছটায় একটা ইয়া বড় তেলাপোকা।
— ওইটা ওর পায়ের উপর পড়তেই আদি চিৎকার করে উঠলো।
মা আপনি কিছু মনে করবেন না।
— ওহ এই কথা। তোর ছেলেমানুষি দেখে আমি বলিহারি যাইরে। এই সামান্য কারণে কেউ এইভাবে চিল্লায়।
মা চলে যাচ্ছিলো। আমার মনে হয় মায়ের সাথে যাওয়া উচিৎ নইলে কপালে আবার কি আছে কে জানে।
আমার রান্না করতে কোনদিনো ভালো লাগেনা কিন্তু আজকে কেন যে ভালো লাগছে নিজেও জানি না। রান্না করতে হঠাৎ দেখি ইমন আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।
আমি ভুত দেখার মত চমকে উঠি।
— এইভাবে চমকে উঠলে কেন?
— কই নাতো।
— না থাক আমি মনে হয় ভুল দেখছি। তা রান্না কতদূর?
খিদা লেগেছে ।
আমার ওই দুপুরের কাহিনী মনে পড়ে যাচ্ছে। নাহ খাওয়া নিয়ে এখন আর কিছু বলা যাবেনা। তাহলে দেখা যাবে যে রাতে খেলই না।
— এইতো শেষ। আসছি আমি।
ডিনারে বাবা ভাইয়া খুব খুশি হলেন আমার রান্না খেয়ে ইনফ্যাক্ট খুব প্রশংসা ও করলেন। ইমন বেচারীর মুখ দেখে সুবিধের কিছু মনে হলোনা। সে যাই হোক, আমি আবার যার তার প্রশংসা শোনার জন্য অধীর হয়ে বসে নেই।
আজকে খুব টায়ার্ড লাগছিলো ভাবছিলাম শুয়ে পড়িবো। রুমে ঢুকেই গা এলিয়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা কাজ করছে।
যেই বিছানায় বসতে যাবো,
অমনি সাহেব হাজির।
— এই তোমার সমস্যা কি?
সামনে তোমার ফাইনাল এক্সাম আর তুমি বিছানায় শুতে যাচ্ছো কেন? যাও টেবিলে যাও।
আমি যাচ্ছিনা বলে জোড় করে পড়তে বসালো। তারপর নিজে চেয়ার টেনে পড়াতে লাগলো।
ধুর ভাল্লাগেনা। বসে বসে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
(চলবে)