মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-২+৩

0
858

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
জেরিন আক্তার নিপা
২🌸

ছোট কাকী ফোন হাতে মীরার ঘরে ঢুকে। ছোট কাকীর হাতে ফোন দেখেই মীরা বুঝে গেল কে আছে লাইনে। মীরার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে মানুষটার সাথে কথা বলতে চায় না। তবুও কেন মানুষটা তাকে বিরক্ত করে। একটু কথা বলার জন্য ছোট কাকী অনুনয় করলে মীরা কাটকাট গলায় বলল,

“ছোট কাকী, তুমি উনাকে কেন বলে দাও না উনি যেন এখানে কল না করেন। উনার সাথে তো আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। উনি উনার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো আছেন। আমরা কেমন আছি এটা জেনে তো উনার কাজ নেই।”

ছোট কাকী মীরার মাথায় হাত রেখে নিচু গলায় বলল,

“উনি তোর মা। তোর সাথে কথা বলতে চায়। এটা কি অন্যায়?”

মীরা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল,

“উনি আমার মা নন। আমি উনার মেয়ে না। আমি আমার বাবার মেয়ে। উনি আমার মা হলে আমাকে ফেলে রেখে কীভাবে চলে গেলেন? যাবার আগে আমার কথা ভাবেননি। তখন আমি ছোট ছিলাম। মা ছাড়া থাকতে পারতাম না। এখন আমার জীবনে মা নামের কোন ব্যক্তির প্রয়োজন নেই। তাহলে এখন কেন উনি আমার কথা ভাবছেন? আমি তো উনার একমাত্র সন্তান না। উনার তো আরও ছেলেমেয়ে আছে। তাদের নিয়ে থাকুক উনি। আমাকে নিয়ে যেন উনি চিন্তা না করেন। আমার মা’র প্রয়োজন হলে তুমি আর বড় মা তো আছো। উনাকে প্লিজ বলো রোজ রোজ যেন কল না করেন। আমাকে কি উনি ভালো থাকতে দেখতে পারেন না?”

ছোট কাকী ফোনের মানুষটাকে কিছু বোঝাতে বোঝাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মীরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মা নামের এই মানুষটা তাকে তিন বছরের রেখে তার আগের স্বামীর কাছে ফিরে যায়। সেখানেও তার এক মেয়ে ছিল। স্বামী তাকে নির্যাতন করে এই অপবাদ দিয়ে তিনি ওই মেয়েকে রেখে স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। মীরার বাবা সবকিছু জেনে তাকে বিয়ে করেছিল। তাদের সংসার প্রথম কয়েক বছর ভালোই কাটছিল। কিন্তু মীরা পেটে আসার পর থেকেই তার প্রাক্তন স্বামী আবার তার সাথে যোগাযোগ করতে চায়। মীরার বাবা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ ছিলেন। তিনি হয়তো কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি মারিয়া তাকে, তার সন্তানকে ফেলে চলে যাবে। মীরা হবার এক বছর পরেই বায়েজিদ সাহেব বিজনেসে বড় একটা লস খেলেন। তখন তার অবস্থা এতটাই খারাপ মেয়ের দুধটাও ভাইদের টাকায় কিনতে হয়। সংসারে অভাব অনটন দেখে মীরার মা-ও ঝামেলা করতে লাগল। সাংসারিক জীবনে তাদের কলহ এতই বেড়েছিল স্বামীর সাথে রাগ করে মীরার মা ছোট্ট মেয়েটাকে কষ্ট দিতেও বুক কাঁপত না। মীরা কাঁদলেও দুধ দিত না। কোলে নিত না। একদিন, দু’দিন এই ঘটনা বায়েজিদ সাহেবের চোখ এড়ালো না। তিনি রাগে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে লাগলেন। এর মাঝে মীরার মা তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে। শেষে একদিন মীরাকে ফেলেই চলে যায়। মীরা এই ঘটনাটা আজও মেনে নিতে পারেনি। সবকিছুর জন্য তার নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। মীরা তার ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট গুলো কাউকে বুঝতে দেয়না। তার সামান্য মন খারাপেও যেই মানুষগুলো অস্থির হয়ে পড়ে মীরা তাদের কষ্ট দিতে চায় না। ওই মহিলার নাম শুনলেই মীরার সবকিছু জ্বালিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এত বছর পর ওই মহিলা কেন তার খোঁজ নিতে চায়? মীরা কাঁদতে কাঁদতে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল।

🌸

মীরা বড্ড ঘুমকাতুরে। সবকিছুর আগে তার ঘুম। মীরা কেমন ঘুমকাতুরে বলা যাক। কাজিন মহলের আড্ডা যেদিন দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, মীরা চুপটি করে কাউকে কিছু না বলে উঠে চলে আসে। রুমে এসে আরামসে ঘুম দেয়। যেদিন তার রুমেই আড্ডা বসে সেদিন সে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকতে পারে না এটা কি তার দোষ? এজন্যও তনি আপুর কাছে একচোট বকা খায়।

“তুই ভদ্র মেয়ের মতো টাইমলি ঘুমিয়ে পড়িস। তোর ঘুমে ডিস্টার্ব করে আমরা আড্ডা দিই বলে মা একচোট বকে। আলাপ আলোচনা বাকি থাকলেও আড্ডা ভেঙে যার যার রুমে চলে যেতে হয়। এরজন্য সব দোষ তোর। কাল থেকে দেখি তুই কীভাবে ঘুমাস। চোখের পাতা টেনে খুলে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখব। তোর ঘুম আমাদের সবার শত্রু।”

ছোট কাকী এই নিয়ে তৃতীয় বার মীরাকে ডাকতে এসেছে। মেয়েটাকে যতই ডাকে সে একটু নড়ে আবার শুয়ে থাকে। ছোট কাকী মীরার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ডাকছে,

“মীরা। মীরা উঠবি না। পরীক্ষাটা শেষ হলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাস। সমস্যা নেই। কিন্তু এখন তো কোচিং এ যেতে হবে মা। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে তোর স্বপ্ন কীভাবে পূরণ করবি বল তো।”

মীরার ঘুম একটু আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তবুও আলস্য করে না উঠে বিছানায় পড়েছিল। জানত পাঁচ মিনিটের ভেতর ছোট কাকী ডাকতে আসবে। হলোও তাই। মীরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

“স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি ঠিকই একদিন আকাশে উড়ব।”

“আমরাও তো এটাই চাই রে মা। তোর স্বপ্নই আমাদের স্বপ্ন।”

আদুরে সকাল টায় ছোট কাকীর ভালোবাসায় রাতের মন খারাপ ভাবটা একেবারে কেটে গেল। মীরাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে কে তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে? মীরা এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বলবে, ছোট কাকী। তাকেও যদি এই প্রশ্ন করা হয়, তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো? মীরা জবাব দিবে, ছোট কাকীকে।
এর আগেও ছোট কাকীর দুটো বাবু মারা গেছে। একজন পেটেই মারা গিয়েছিল। আরেকজন দুনিয়ায় আসার কয়েক মিনিট পর। মীরা মনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহর কাছে একটা জিনিসই চায়। এবার যেন ছোট কাকীর বাবুটা সুস্থ ভাবে দুনিয়ায় আসে। আল্লাহ যেন ছোট কাকীর পরীক্ষা নেওয়া এখানেই শেষ করেন। ভালো মানুষ গুলো এত কষ্ট কেন পাবে?
পরীক্ষার আর মাত্র একমাস আছে। পড়ার প্রচন্ড চাপে মীরার ওজন কয়েক কেজি কমে গেছে। সে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নাকেমুখে ব্রেকফাস্ট করে নিল। মাহিমার আজ এখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ছোট ফুপুর মেয়ে মাহিমা। ওরা একই ক্লাসে পড়ে। মীরা গেটে আসতেই মাহিমার দেখা পেল। মাহিমা দূর থেকেই বলল,

“একটু লেট হয়ে গেছে রে। কী করব তোর ঘুমের জ্বীন আমার উপর ভর করেছে।”

মীরা মাহিমাকে ভেতরে যেতে বললে মাহিমা বলল,

“পরীক্ষার পর মামুর বাড়ি চিনব। এখন আপাতত ভুলে গেছি আমার কোন মামার বাড়ি আছে। চল চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মীরাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই মুবিন ভাইদের বাড়ি। প্রতিদিন মুবিন ভাইদের বাড়ি পেরিয়েই যেতে হয়। মাঝে মধ্যে এক-দুই দিন মুবিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়।
ওরা রিকশায় উঠে দুই দিনের জমে থাকা কথা গুলো একে অপরকে বলতে লাগল।
মাহিমা বলল,

“তনি আপুরা নানুর বাড়ি গেছে এটা পুরোনো খবর। নতুন খবর থাকলে বল।”

মীরা ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“আমাদের বাড়ির খবর তুই আমি বলার আগেই জেনে যাস। এই রহস্য আমি আজও সমাধান করতে পারলাম না।”

মাহিমা রহস্য করে হেসে বলল,

“তোর মতো গাধী পারবিও না। আমি কি তোর মতো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? চোখ কান খোলা রাখলেই আশেপাশে কী ঘটছে জানা যায় বস।”

“আমি চোখ কান বন্ধ রেখে চলি তোর মনে হয়? ”

“এক হাজার বার। নইলে এক বাড়িতে থেকেও তুই আজ পর্যন্ত জানতে পারলি না আমার ভাইয়ের সাথে তনি আপুর ইটিস পিটিস চলছে।”

এই কথাটা সত্যিই মীরা জানত না। সে অবিশ্বাস্যে প্রায় চিল্লিয়ে উঠেই বলল,

“সত্যি! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? ওরা তো ভাই বোন।”

“আরে দূর! মা’র পেটের ভাইবোন ছাড়া সব ফাউ। আর ইসলাম ধর্মে চাচাতো, মামাতো ভাইবোনের বিয়ে জায়েজ আছে।”

“তা আছে। কিন্তু ভাইবোনের মাঝে ওসব ফিল আসে কীভাবে? আমার সব আবির ভাই, ইভান ভাই ওদের আপন ভাই-ই মনে হয়।”

“যার লগে যার মনে ভাব। তুই আমি বললেও তো কিছু হবে না।”

“এজন্যই তুই আমাদের বাড়ির সব খবর আগে আগেই পেয়ে যাস। তুই আবির ভাই, তনি আপুর রিলেশনের কথা জানতি আমাকে বলিস নি তো।”

“নিজেই শিওর ছিলাম না। সন্দেহের কথা জানিয়ে লাভ কি?”

“এখন যে তুই জানিস এটা আবির ভাই জানে?”

“কচু জানে। আমার ভাইয়ের আমাকে শিশু মনে হয়। প্রেম ভালোবাসা জিনিসটা যে আমিও বুঝি এটা আমার ভাইয়ের মগজে আসে না। সে আমাকে তোকে এখনও লজেন্স খাওয়া বাচ্চা ভেবে আমাদের চোখের সামনে চুটিয়ে প্রেম করে। আমিও ভাইয়ের বিশ্বাস ভাঙি না। সব জেনেও ভাইয়ের সামনে গাধা সেজে থাকি। ইচ্ছে করেই এমন এমন সব প্রশ্ন করি ভাইয়া হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। তুইও তনি আপুর সামনে গাধা সেজে থাকবি বুঝেছিস।”

“তনি আপুকে আমিও সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু সেটা আবির ভাইয়ের সঙ্গে কল্পনা করিনি।”

“ওদের আর কী? লাইফ সেট৷ আমার মা ভাইজি বলতে অজ্ঞান। এই খবর জানাজানি হলে দুই পরিবারই মেনে নিবে। মামাটা তো মাটির মানুষ। মামী একটু ঝামেলা করতে পাবে অবশ্য।”

“ভালোই হবে না! আমরা সবাই মিলেমিশে থাকব।”

“কীভাবে থাকব বেহেন? তোর আমার তো কেউ নেই। আমাদের তো দূরেই যেতে হবে।”

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
মীরা ব্যাগ কাঁধে তিড়িংতিড়িং করে মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে যাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার্থী একটা মেয়ে কি ভালোবাসার নামক অনুভূতি বুঝে না? অবশ্যই বুঝে। তাদের ক্লাসের এমন কোন মেয়ে নেই যে রিলেশন না করে। মাহিমা আর সে-ই বাকি শুধু। এটা পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার বয়স। প্রেম করার বয়স তো আর চলে যাচ্ছে না। কলেজে গিয়ে না করলেও ভার্সিটি গিয়ে করবে। কিন্তু এখন না। আবির ভাই, তনি আপু ভার্সিটিতে পড়ে তাই বাড়িতে জানাজানি হলে তাদের মেনে নিবে। মীরার এখনই প্রেম করার শখ নেই। তবে মুবিন ভাইকে যে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে এটা ঠিকই বুঝতে পারছে। কিন্তু এই ভালোলাগা কি প্রেম ভালোবাসা টাইপ ভালোলাগা। নাকি সাধারণ ভালোলাগা এটা বুঝতে পারছে না। প্রেম ভালোবাসা টাইপ ভালোলাগা কেমন হয় এটাই তো জানে না। গেট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান চাচার সাথে কতক্ষণ গল্প করল। চাচীর খোঁজ খবর ছেলেমেয়েদের খোঁজ খবর নিয়ে ভেতর পা বাড়াল। সামনে একটা ভাঙা ইট পড়েছিল মীরা সেটা দেখেনি। না দেখে উস্টা খেয়ে নখ উলটে ফেলেছে। কলকল করে রক্ত পড়ছে। ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে কেঁদে উঠল মীরা। দারোয়ান চাচা ছুটে এসেছে।

“আহা হা, এইডা কী করলা মা? কেমনে ব্যথা পাইলা? ইশশিরে, অনেক ব্যথা পাইছো?”

মীরা কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলে নাক টানতে টানতে বলল,

“চাচা আমি বাড়ি যাব।”

“এই অবস্থায় কেমনে যাইবা মা? রক্ত বন্ধ করা লাগব না? চল তোমারে জায়িন বাবার কাছে নিয়া যাই। সে তো ডাক্তার। রক্ত বন্ধ করে দিব।”

ওই বদমেজাজি লোকটার নাম শুনেই মীরার ব্যথা আরও বেড়ে গেল যেন। সে দু’পাশে মাথা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,

“না চাচা। আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন।”

ওরা কথা বলার এপর্যায়ে জায়িনকে আসতে দেখা গেল। মনে হচ্ছে সে কোথাও বেরুচ্ছে। পরনে কালো শার্ট, পরিপাটি চুল দেখতে ভালো লাগলেও মীরার এখন দেখার সময় নেই। জায়িন কাছে এসে মীরাকে মাটিতে বসে কাঁদতে দেখে কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে তাকাল। মীরার পায়ে রক্ত দেখেই হয়তো বুঝে গেল কী হয়েছে। মীরা তখনও কেঁদে যাচ্ছে। জায়িন দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করল,

“কোন সমস্যা চাচা?”

“দেখ না বাবা, মীরা মা উস্টা খেয়ে নখ উলটে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ও বাড়ি যাওয়ার কথা বলছে। বাড়ি তো অনেক দূরে। উপরে নিয়ে গিয়ে তুমিই তো রক্ত বন্ধ করে দিতে পারবা।”

মীরা পা চেপে ধরে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। লোকটার সামনে মন খুলে কাঁদতেও পারছে না। মীরা উপরে যেতে চাচ্ছে না শুনে লোকটা মনে হলো বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকালো। মীরা সেদিকে না তাকিয়ে আহত পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। জায়িন একনজর মেয়েটাকে দেখে স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলল,

“ওকে উপরে নিয়ে আসুন চাচা।”

মীরা এবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও লোকটার তীক্ষ্ণ চাহনির দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। গতকাল কুকুরের তাড়া খেয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে। সেই লজ্জাই তো এখনও ভুলতে পারছে না। তার পর জায়িন ভাইয়ার সামনে আজকে আবার আরেকটা ঘটনা। লোকটা তাকে কী ভাববে? কুকুর ভয় পায়। যেখানে সেখানে পড়ে যায়। দারোয়ান চাচা তাকে তুলে দাঁড় করিয়েছে। হাঁটতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটা চিগবিগিয়ে পা থেকে উপরে উঠে গেল। মীরা অস্ফুটস্বরে কেঁদে ফেলে বলল,

“হাঁটতে পারছি না চাচা। ব্যথা লাগছে।”

জায়িন শান্ত চোখে কান্নারত মীরাকে দেখল। একটু কেঁদেই চোখ ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। ব্যথা সহ্য করতে ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। জায়িন ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলল। পরক্ষণেই মীরাকে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে শূন্যে তুলে ফেলল। প্রথমটায় মীরা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল,

“ওরে বাবা! পড়ে যাব।”

জায়িন কেমন চোখে যেন তাকে দেখল। মনে মনে হয়তো বকা দিচ্ছে। মীরা জায়িন ভাইয়ের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেও ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে পেরে যতটা না বিস্মিত হলো, তার থেকেও বেশি লজ্জায় গুটিয়ে গেল। যে লোক কোনদিনও তার সাথে ভালো করে কথাও বলেনি। আজ কি-না সে সেই লোকের কোলে উঠে বসে আছে। নিতান্তই বাধ্য হয়ে হয়তো কোলে তুলেছে। ডাক্তার মানুষ তো চোখের সামনে তাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারছে না। যেকারণেই হোক মীরা তার ষোল বছরের জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষের এতটা কাছাকাছি এসেছে। ইচ্ছে না করে হোক তবুও লোকটার স্পর্শে মীরার সর্বশরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। লোকটার হার্টবিট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। গা থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রান আসছে। কী পারফিউম মেখেছে কে জানে। মীরা লজ্জা, সংকোচ, অস্বস্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শক্ত করে চোখ বন্ধ করে, দম বন্ধ রেখে সময়টা পার করছে। মনে মনে আল্লাহকে বলছে, আল্লাহ এত লজ্জায় আমাকে কেন ফেললে? মুবিন ভাই হলেও না একটা কথা ছিল। কিন্তু মুবিন ভাইয়ের বড় ভাইয়ের কোলে উঠে বসে আছি! ছি ছি। আজকের পর থেকে উনার সামনে মুখ দেখাব কীভাবে আমি? উনার সামনে পড়লেই তো আজকের এই ঘটনা মনে পড়ে যাবে।

এই জীবনে এতটা অস্বস্তির মধ্যে মীরা কোনদিনও পড়েনি। সে না পারছে মুখ ফুটে কিছু বলতে না পারছে চুপ থাকতে। মুবিন ভাইদের ফ্ল্যাট তিনতলায়। লিফট না থাকায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মীরা আটার বস্তার মতো মোটা না হলেও বাঁশের মতো চিকনও না। মোটামুটি পর্যায়ে আছে। সঠিক ওজন জানা নেই বিদায় বলতে পারছে না। কালই গিয়ে ওজন মাপবে। লোকটা তাকে নিয়ে এতগুলো সিঁড়ি ভাঙবে? লোকটার উপর তার মায়া হচ্ছে। মীরা সহানুভূতির চোখে লোকটার মুখের দিকে দেখল। কষ্ট হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে না। সবে তো মাত্র একতলা উঠল। আরও দোতলা বাকি। মীরা অনেক ভেবেচিন্তে মিনমিনে গলায় বলল,

“আমাকে নামিয়ে দিন ভাইয়া। আমি যেতে পারব।”

লোকটা তার কথা শুনেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কারণ তিনি মীরাকে নামাবে তো দূর চলার গতিও সামান্য কমালো না। দোতলায় উঠে মীরা লক্ষ করলো লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুটা দ্রুত হয়েছে। সে একা একাই কয়েকটা সিঁড়ি উঠে হাঁপিয়ে যায়। লোকটা তো তাকে নিয়ে উঠছে। হাঁপাবে এটা স্বাভাবিক। তবুও বেটা থামছে না। শক্তি দেখাচ্ছে। দেখাক, মীরার কি? সে তো একবার বলেছেই। তাকে না নামালে সে কি জোর করে নেমে যাবে? সাহায্য করার এত শখ থাকলে করুক। দারোয়ান চাচাও তাদের সাথে আসছিল। ফ্ল্যাটের সামনে এসে জায়িন মীরাকে কোলে নিয়ে কলিংবেল বাজাতে পারল না। দারোয়ান চাচা পেছন থেকে এগিয়ে এসে কলিংবেল চাপল। মীরা আড়চোখে একবার দেখে নিল জায়িন ভাইয়ার কপালের ঘাম দেখা দিয়েছে। আহা বেচারা কত কষ্টই না করল। মুবিন দরজা খুলে দিয়ে ভাইয়ের কোলে মীরাকে দেখে হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। এই দৃশ্য হজম করতে তার সময় লাগছে। মুবিন ভাইয়ের সামনে মীরা তার বড়ো ভাইয়ের কোলে বসে আছে। ভেবেই মীরা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। মুবিন ভাই কী ভাববে? হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে মুবিন প্রশ্ন করল,

“কী হয়েছে ভাই? মীরা, কী হয়েছে তোমার?”

মীরা উত্তর দিতে পারল না। সে লজ্জিত মুখে একবার মুবিন ভাইকে দেখে আরেকবার তার ভাইয়ের দিকে তাকাল। বেশি সময় না নিয়ে চোখ নামিয়েও নিল। মুবিন এখনও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সরে গিয়ে জায়গা দিচ্ছে না। জায়িন ভ্রু কুঁচকে মুবিনকে দেখলে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরে দাঁড়াল। জায়িন মীরাকে ড্রয়িংরুমের সোফায় এনে বসিয়ে দিল। মুবিন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে আবার জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে ভাইয়া? বলবে তো।”

জায়িন মুবিনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে না করে রুমের দিকে হাঁটা ধরল। ভাই তো মাত্রই বেরিয়েছিল। সে আবার ফিরে এলো কেন? আর মীরাকেই বা পেলো কোথায়? ওকে ওভাবে কোলে করে বাড়িতে এনেছে কেন? একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে মুবিন মীরার সামনে এসে দাঁড়াল। দারোয়ান চাচা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছে।

“বুঝছো বাবা, মীরা মা পড়ে গিয়ে নখ উলটে রক্তারক্তি কাণ্ড। জায়িন বাবা না গেলে কি যে হতো! ব্যথা পায়ে হাঁটতে পারছিল না তো।”

জায়িন রুম থেকে ফার্স্টএইড বক্স হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। তাকে দেখে মুবিন সাইড দিয়ে দাঁড়াল। জায়িন মীরার পাশের সোফায় বসেছে। মীরার পা সোফার উপর তুলে হাতে ধরে দেখতে নিলে মীরা এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে উঠল,

“না না। পায়ে হাত দিবেন না।”

চলবে…