নীরবে তুমি রবে পর্ব-১৩

0
253

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১৩.

.
চকিতে’ই মাথা তুলে তাকালো রূপা, সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো দেখতে একটা মেয়েকে। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে বেশ স্মার্ট বলা যায় মেয়েটাকে। নিজ ভাবনায় ভাবলো রূপা, এই মেয়েটা ভার্সিটির’ই টিচার হবে হয়তো। তাকে এই পাশ’টায় টিচারের টেবিলে বসে থাকতে দেখেই হয়তো জিজ্ঞেস করছে –কি করছে? তবে কেন জানি সাজসজ্জা দেখে কিছুতেই রূপার মনে হচ্ছে না তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা এই ভার্সিটির টিচার হবে। পরমুহূর্তেই নিজ ভাবনা ঝেড়ে ফেললো রূপা। কথা না বাড়িয়ে বলতে লাগলো তাসফির কথা,

“আসলে আমি তো তাস….”

কথাটা শেষ করতে পারলো না রূপা, মাঝেই থামিয়ে দিলো। ভেসে আসলো অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠস্বর।

“কিয়ানা! কি হয়েছে?”

এবার অপরিচিত কিছু দৃষ্টি এসে পড়লো রূপার প্রতি। তাকে টেবিলটায় বসে থাকতে দেখে বেশ আশ্চর্য হলো যেন সেই দৃষ্টির মালিক গুলো। সেই আগের কণ্ঠের মালিক আবারও বলে উঠলো,
“আরে, এই মেয়েটা কে? তোর বোন টোন না কি? কই আগে তো বলিস নি, তোর বোন আসবে। দেখতে কিন্তু হেব্বি আছে দোস্ত।”

“আরে চুপ কর, যাকে দেখিস তাকেই তোর ভাল্লাগে। আমিও তো এটাই জিজ্ঞেস করছিলাম, আমি চিনি না-কি?”

এতক্ষণে আরও দু’জন ছেলে ও মেয়ে রূপার সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন ছেলে কিয়ানা নামক মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“চিনিস না তাহলে এখানে বসে আছে কেন? এখানে তো আমাদের বসার কথা, আমরা আসলে তো কর্ণারের এই টেবিল’টায় বসি।”

“আচ্ছা চুপ কর, হয়তো ভুলে বসেছে, আমি দেখছি।”

বলেই সাথের ছেলেটাকে থামিয়ে দিল কিয়ানা। রূপার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাকে দেখে তো স্টুডেন্ট বলে মনে হচ্ছে। এখানে কি করছো? এপাশে টিচার আর তাদের গেস্ট’রা বসে। তুমি ওই পাশ’টায় গিয়ে বসো।”

“কিন্তু আমাকে তো এখানেই বসতে বললো।”

“এখানে? এখানে কে বসতে বললো তোমায়। তাসফি কি বারন করে নি কাউকে?”

রূপার কথায় কিছুটা অবাকই হয়েছিলো সবাই। সেই অবাকের রেশ ধরেই ধীর কণ্ঠে রূপাকে বলে উঠলো কিয়ানা। তারা ফ্রেন্ড’রা একসাথে আসলে এখানেই বসে, আর সেটা সবারই ভালোভাবে জানা। এই ভার্সিটির’ই স্টুডেন্ট কি না তারা। কিন্তু হঠাৎ একটা মেয়ে এসে তাদের জায়গা দখল করে ফেলেছে, এতেই খানিকটা অবাক সবাই। কিয়ানার মুখে তাসফির নামটা শুনে বেশ অবাকই হলো রূপা, অবাকের রেশ নিয়েই ভালোভাবে তাকালো কিয়ানার পানে। বলতে লাগলো,
“আমাকে তো উনি’ই এখানে বসতে বললো। কিন্তু আপনারা কারা?”

“উনি? উনি টা কে এখানে বসতে বললো?”

“উনিই মানে, আমাকে তো তাসফি ভা…..”

সামনে নজর পড়তেই থেমে গেল রূপা। দূর থেকে তাসফি কে দেখেই থেমে গেছে সে, বাকিটা উচ্চারণ করতে পারে নি। একটা ছেলের সাথে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তাসফির সাথের ছেলেটার সাথে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই অপরিচিত। সেই অপরিচিত ছেলের মাঝেই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে উঠলো,
“তাসফি? তুমি বলতে চাইছো তাসফি তোমাকে বসতে বলেছে এখানে।”

“হু! উনিই তো আমাকে…..”

মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো রূপা। তার কথায় আবারও যেন অবাক হলো সবাই। কিয়ানা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তাসফি তোমাকে এখানে বসে বলেছে? চিনো তুমি ওকে?”

মাথা ঝাকালো রূপা, জানালো ‘হ্যাঁ!’ চিনে সে তাসফি কে। এতে যেন সবার বেশ কৌতুহল হলো রূপার প্রতি। জানতে চাইলো, “কিভাবে চিনো তুমি তাসফি কে? কে হয় ও তোমার?”

এতক্ষণে তাসফি এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। রূপা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বাকিরা পিছন ফিরে থাকায় তাসফি ও বাকি একজনের উপস্থিতি বুঝতে পারে নি কেউই। রূপার চুপ করে থাকায় আবারও সবাই জানতে চাইলো —কিভাবে জানে সে তাসফি কে। এদিকে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেছে যেন রূপা। কি বলবে সে তাসফির কথা। ফুপাতো ভাইয়ের পরিচয় দিবে, নাকি তাদের মাঝে তৈরি হওয়া নতুন সম্পর্কের পরিচয় দিবে? তাসফির দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় বলতে চাইলো —কি বলবে? তাসফিও তাকে আশস্ত করে কিছু বলতে বললো। তাসফির ভরসায় কিছুটা হলেও যেন স্বস্তি পেল রূপা। তবে কেন জানি তাসফিকে নিয়ে ফুপাতো ভাইয়ের পরিচয় দিতে মন চাইলো না রূপার, কিন্তু নিজের হাসবেন্ড বলেও পরিচয় দিতে পারলো না। হুট করেই বলে ফেললো,
“ভাইয়া, উনি আমার ফুপাতো ভাইয়া হন।”

রূপার কথায় সবাই একে অপরের দিকে নজর বুলালো একবার। তারপর একজন বলে উঠলো,
“ওও আচ্ছা, তাসফির কাজিন তুমি।”

“আমাকে ভাইয়া ডেকে নিজের বাচ্চা কাচ্চার মামা বানানোর ব্যাবস্থা করছো? গাধী কোথাকার!”

হুট করে তাসফির বলা কথায় সবাই দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো তার পানে, খানিকটা বিষ্ময় খেলে গেল সবার চোখে। রূপাও পিটপিট চোখে তাকালো তাসফির পানে। সে নিজেও তো তাসফি কে ভাইয়া বলে পরিচয় দিতে চায় নি, আবারও তাসফি যে তার স্বামী সেটাও কেন জানি মুখে আনতে পারে নি। তাই বলে তাসফি তাকে সবার সামনে তাকে গাধী বলবে? হু! বজ্জাত লোক একটা। মনে মনে বললো রূপা। এদিকে সবাই অবাকের সুর তুলে তাসফি কে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে? কি বোঝাতে চাইছিস তাসফি?”

“মানেএ এটাই যে, সি ইস্ মাই ওয়াইফ!”

আগের চেয়েও অধিক বিষ্ময় দেখা দিলো সবার চোখে মুখে, আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো তাসফির দিকে। তাসফি যেন খুব একটা পাত্তা দিল না, রূপার পাশে এসে দাঁড়ালো। একজন বলে উঠলো,
“ওয়াইফ? তুই বিয়ে করেছিস তাসফি? কিন্তু কবেএএ?”

হালকা হাসলো তাসফি, এক হাতে আলতো ভাবে রূপার কাঁধ জড়িয়ে নিলো। আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটাই তোদের সারপ্রাইজ! ”

.
“শ্লা! বিয়ে করলি আর আমরা জানতেই পারলাম না। কেমনে বিয়ের টিকিট কাটলি?”

তাসফির বন্ধু সাদিক কথাটা বলতেই তাকে ইশারায় রূপার দিকে বোঝালো, নিজের মুখটাকে সামলে কথা বলতে বললো। তাসফির ইশারায় ‘ওও সরি!’ বলে চুপ হয়ে গেল সাদিক। তাসফি বলে উঠলো,

“হঠাৎ খুব কম সময়ের মাঝে ঘরোয়া ভাবেই হয়েছে। তুই তো দেশে ছিলি না, বাকিরাও আলাদা শহরে, চাইলেও কেউ বগুড়া যেতে পারতো না। ভাবলাম রিসিপশন যখন হবে তখনই জানাবো। কিন্তু তার আগেই…..”

“তার আগেই ঝটকা ‘টা দিয়ে দিলি? আমার নাদান ডিল’টা টুট টুট টুট….. ”

বেশ আফসোসের সুরেই তাসফি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো জাহিদ। তারা সবাইও তাসফির কলেজের বন্ধু। নিজ নিজ পেশার তাগিদে তাদের দূরত্ব অনেকটা, তবে সম্পর্ক’টা যেন সেই কলেজ লাইফের মতোই বিরাজমান। তাদের সবাই লেকচারার ও বিভিন্ন কোম্পানি জব করলেও সাদিক ডাক্তারি পেশায়। ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করতে দেশের বাইরে যেতে হয়েছিলো তাকে। হুট করেই আসার পর তাসফি’কে জানিয়েছে। সেই সুযোগেই ছোট খাটো এই প্ল্যান’টা করেছে তাসফি।
জাহিদ তার মতোই পাবলিক ভার্সিটির টিচার হিসেবে যুক্ত হয়েছে। কিয়ানা ও সিহাব ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি তে জব করে। আর তাদের মধ্য পায়েল জব করার ভাবনা না ভেবে সিহাবের সাথে সংসার করতে ব্যস্ত।

ইতিমধ্যে সবার সাথেই পরিচয় করিয়েছে রূপাকে। তারপরই সবাই ধরেছে তাসফি কে, একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে তাসফিকে। কিয়ানা ও পায়েল কিছুটা ভাবও জমিয়ে ফেলেছে রূপার সাথে।
এদিকে জাহিদের কথায় সিহাব বলে উঠলো,
“আমাদেরও একই অবস্থা ভাই। আল্লাহর বান্দা একটা প্রেম তো দূরে থাক, বিয়ে পর্যন্ত করতে চায় নি। আর সেই কি না হঠাৎ একটা বউ নিয়ে আমাগো সামনে হাজির।”

সবাই হু হা করতেই হাসলো তাসফি। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“সারপ্রাইজ!”

“শ্লা! রাখ তোর সারপ্রাইজ! ওও সরি! সরি!”

বলেই রূপার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করলো জাহিদ। তারপর আবারও বলে উঠলো,
“আর কয়েকদিন পর দু’জন বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিয়ে আসতি, তারপর এসে আমাদের বলতি ‘সারপ্রাইইইজ’!”

‘সারপ্রাইজ!’ কথাটা জোরেই বললো জাহিদ। এবার খানিকটা শব্দ করেই হেঁসে উঠলো তাসফি, সেই সাথে বাকিরাও। কিন্তু এভাবে কথাটা বলায় বেশ লজ্জায় পরলো যেন রূপা, মাথা নিচু করে ফেললো। তাসফির বেশ কাছেই বসে ছিলো সে, কথাটা শোনার পর অজান্তেই নিজেকে আরও গুটিয়ে নিলো তাসফির অতি নিকটে। সেটা সবার নজরে এলেই সবাই হালকা করে চেঁচিয়ে উঠলো, রূপাকে উদ্দেশ্য করে খোঁচাতে লাগলো তাসফি কে।

রূপার অপর পাশে ছিলো কিয়ানা, রূপার অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো যেন। তাকেও তো এমন অনেক অনেক খোঁচানো সহ্য করতে হয়েছে এদের। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে কিয়ানা,
“উফ্! থামবি তোরা। তোদের এই স্বভাব’টা কি কখনোই যাবো না? আমাকেও তো কম জ্বালাস নি, এই মেয়েটাকে অন্তত ছেড়ে দে।”

বলতেই তাসফি, সাদিক, জাহিদ ও সিহাব একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এরপর একসঙ্গে সুর তুলে বলে উঠলো,
“আমাদের এই বাজেএ স্বভাব কোনদিনও যাবে নাআআ….!”

বলেই হেঁসে উঠলো সবাই। এদিকে হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো কিয়ানা। সে জানে তার বন্ধুগুলো ঠিক কেমন ধারার। সবাই অতি ভদ্র ভাবলেও একজন বন্ধু হয়ে খুব ভালোভাবেই জানে সে। রূপাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“আচ্ছা রূপা তুমি এই ফাজিল’টা বিয়ে করতে রাজি হলে কিভাবে? জেনে বুঝে তো একে কেউ গলায় ঝুলাবে না।”

আশ্চর্যের ন্যায় কিয়ানার দিকে তাকালো রূপা। বোঝার চেষ্টা করলো কাকে ফাজিল বললো কিয়ানা। অবশ্যই তাসফি’কে বলেছে, কিন্তু কেন? কিভাবে তাসফি’কে তার ফাজিল বলে মনে হলো তার? হ্যাঁ! তাদের কাজিন মহলের আড্ডায় সবার দুষ্টুমি, ফাজলামি একাধিক থাকে, তাসফিও করে। কিন্তু মোটেও ফাজিল উপাধি দেওয়া যায় না। রূপার ধারণা তার দেখা ভদ্র, শান্ত ও সবচেয়ে গম্ভীর টাইপ মানুষটাই হলো তাসফি। আর সেই মানুষটার দিকেই যেন সে বারংবার আকর্ষিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত ঝুঁকে যাচ্ছে।

কিছু বলতে গিয়েও গলায় স্বাভাবিকতা আনলো রূপা। কিয়ানা কে বলে উঠলো,
“আমাদের বিয়েটা তো ফ্যামেলির সিদ্ধান্তেই হয়ছে।”

“সে যাই হোক, সবসময় টাইটে রাখবা ওকে, একটু এদিকওদিক হলেই খবর নিবা। আমার’টাকে তো এভাবে হাতে রাখি। ছেলে মানুষ, একটু ছাড়া পেলেই…… ”

কিয়ানাকে থামিয়ে ধমকে উঠলো যেন তাসফি। কটমট চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“এ্যাই! আমার বউকে কি ভুজুংভাজুং বোঝাচ্ছিস?হু! একদম উল্টা কিছু ওর মাথায় ঢুকানোর চেষ্টা করবি না। নিজে তো বেচারা সৌভিক ভাইকে তো জ্বালিয়ে মা’রছিস, আমার বউটাকেও শেখাচ্ছিস? বেয়াদব!”

বলেই রূপার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো তাসফি। বললো,
“এ্যাই! ওর কথায় একদম কান দিবা না, উল্টা পাল্টা কিছু মাথাতেও ঢুকাবা না। মনে থাকে যেন।”

তাসফির কথায় বাঁধা দিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিয়ানা। তবে তাদের থামিয়ে দিলো সাদিক। বলে উঠলো,
“উফ্! থাম তো তোরা। কি শুরু করছিস তখন থেকে।”

বলেই একটু থামলো। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে তাসফি রূপাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“কিন্তু তখন যে রূপ…. মানে আমাদের ভাবি তোকে ভাইয়া কেন বললো? তোরা কি কাজিন?”

“হু!”

তাসফি ‘হু’ বলতেই কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো জাহিদ। আঁতকে ওঠার ভান করে, “আরে দোস্ত কাকে বিয়ে করলি তুই? আমার জন্য বুক করে রাখা তোর কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে পিচ্চি কিউট কাজিন’টাকে তো আবার নয়?”

জাহিদের কথায় ও কান্ডে হাসলো তাসফি। তার আইডি তে কাজিন মহলের অসংখ্য গ্রুপ ছবিতে রূপার ছবি দেখেই বলতো জাহিদ —এই মেয়েটা আমার জন্য বুক। যেভাবেই হোক আমি তোকে শা’লা বানাবোই। রূপাকে যে সে চিনতে পারে নি, শুধু জাহিদ কেন? বাকিরাও তো চিনতে পারে নি মেয়েটাকে। সেটা ভেবেই যেন তাসফির ঠোঁটের হাসিটা প্রসস্থ হলো। রূপার দিকে তাকিয়ে এক হাতে জড়িয়ে নিলো তাকে, আলতো ভাবে কাছে টেনে বলে উঠলো,

“এখন সে তোর ভাবী।”

.
.
চলবে……