আমার হিয়ার মাঝে পর্ব-১৮+১৯

0
349

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৮

গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে অধরা আশ্বিন। তাদের পেছনে বসেছে আরশি আর টুসি। মধ্যরাতে অধরাকে নিয়ে ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে ফিরে যাচ্ছে সবাই। অধরা সহ আরশি আর টুসি নিশ্চুপ। কেননা আশ্বিন সেই কখন থেকে গম্ভীর হয়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ না করে আপনমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে সে।
আড়চোখে একবার আশ্বিনের মুখ পানে ফিরে তাকায় অধরা। কোথায় ভেবেছিলো আশ্বিনকে সারপ্রাইজ দিবে, কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল? এখন তারই নিজের কাজে এতোবড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেলো সবাই।
কিন্তু অধরার প্রশ্ন হলো, গাড়ি হঠাত নষ্ট হলো কবে? আর কিভাবে? সে তো ভালো ভাবেই ড্রাইভ করছিলো!

‘এখানেই কি বসে থাকবে? নাকি উপরে যাবে?’
আশ্বিনের কথায় হুশ ফিরে অধরার। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাদের ফ্ল্যাটের সামনে। আরশি আর টুসি ইতিমধ্যে গেইট দিয়ে প্রবেশ করে চলে গিয়েছে। একনজর আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত নেমে চলে আসে অধরা। এই মুহূর্তে আর কথা বাড়িয়ে বকা খাওয়ার ইচ্ছে নেই তার।

‘এহন যদি বড় কোন ক্ষতি হইয়া যাইতো? তুমি ওই নষ্ট গাড়ি নিয়া কেন গেছিলা বউমণী?’
‘সেই গাড়িটা যে নষ্ট ছিলো সেটাই তো আমি জানতাম না খালা।’
অসহায়ভাবে কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে ফেলে অধরা।
গাড়িটা আগে থেকেই নষ্ট ছিলো। অথচ সে জানতোই না। আজ তার ভুলের জন্যই টুসি আর আরশির বড় কোন ক্ষতি হতে পারতো। না জেনে না বুঝে সে কিভাবে এই বোকামি করলো ভাবতেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে তার।
‘আইচ্ছা বাদ দেও, যা হওয়ার হইছে। ভাগ্য ভালা যে বড় কিছু হয় নাই। বউমণী তুমি যাইয়া এহন ঘুমাও। ঘরে যাও।’
অধরা মাথা নেড়ে চলে আসে রুমে। আশ্বিন তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে, হয়তো রোদ্দুর। অধরা আর দেরি না করে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ে খাটের এক পাশে। এই মুহূর্তে তার বকা শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। আর সারাদিনের পরিশ্রম মুহূর্তেই তাকে ঘুমের দেশে তলিয়ে নেয়।

‘ভাবি উঠে পড়ো। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। উঠো।’

আরশির ডাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে অধরা। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে ঘড়ির কাঁটায় দশটা ত্রিশ বাজতে দেখে চমকে উঠে সে।
‘এতো দেরি হয়ে গিয়েছে? অথচ আমি ঘুমিয়েই ছিলাম? আমার তো ক্লাস মিস হলো আজ।’
‘আরে চিন্তার কিছু নেই ভাবি। কাল রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলে তাই উঠতে দেরি হয়েছে, ব্যাপার না। আর কলেজ নিয়ে তুমি একদম ভাববে না। ভাইয়া সকালে উঠেই তোমার কলেজ গিয়ে সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।’
থতমত খেয়ে যায় অধরা। সাতদিনের ছুটি মানে? হঠাত করেই আশ্বিন তার ছুটি নিয়ে আসলো কেনো?
‘মানে? ছুটি কিসের?’
‘কিসের আবার? আমরা সবাই তো একটু পর ময়মনসিংহ রওনা দিচ্ছি। মা খুব রেগে আছে ভাইয়ার উপর। এক্ষুনি যেতে বলেছে সবাইকে। সকালে ফোন করে ভাইয়াকে অনেক বকেছে মা। কেনো ভাইয়া নষ্ট গাড়ি ঠিক না করে রেখে দিলো, তাই তোমার এই দূর্ঘটনা হয়েছে।’
‘কিন্তু, এখানে উনার কি দোষ ছিলো? আমারই জানা উচিত ছিল যে..।’
‘আরে ভাবি বাদ দাও না। জলদি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। ভাইয়া হাসপাতাল থেকে চলে আসলেই সবাই রওনা দিবো।’
চলে যায় আরশি। মুখটা ভাড় করে বসে থাকে অধরা। বেচারা আশ্বিন মহাশয়, তার জন্য জন্মদিনের শুভেচ্ছা শোনার পরিবর্তে এখন বকা শুনে যাচ্ছেন।
অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে আসে।
—————-

গাড়ি থেকে নেমে অধরা বাদে সবাই চলে গিয়েছে বাসার ভেতর। আশ্বিন গাড়ি থেকে ব্যাগ পত্র বের করছে। অধরা চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার।
মহাশয় গতকাল রাত থেকে একটি কথাও বলছেন না। অনেক রেগে আছে হয়তো।
সে যে মহাশয়ের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে খেয়াল নেই আশ্বিনের। ব্যাগ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাসার দিকে এগিয়ে যায় সে। পিছু নেয় অধরা, সেও আগ বাড়িয়ে কথা বলছে না। না জানি কখন আবার ধমক দিয়ে উঠে।

‘এইতো চলে এসেছে আমার মেয়েটা। দেখি তো মাথায় কতটা ব্যথা পেয়েছো?’
আশ্বিনের মা দৌড়ে এসে অধরাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালের আঘাত দেখতে থাকে।
‘মামুনি, আমি ঠিক আছি।’
‘একদম কথা বলবি না। আমি দেখতেই পাচ্ছি কেমন ঠিক আছিস। তোর মা বাবা এখন কি বলবে বল তো?’
‘মামুনি, এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি একদম ঠিক আছি। এটা তো সামান্য ব্যাপার। চলো বাবার সাথে দেখা করি।’
মামুনির হাত ধরে অধরা প্রবেশ করে ভেতরে। পুরো বাড়ি জুড়ে আশ্বিনের প্রিয় সব খাবারের সুগন্ধ! বুঝতে আর বাকি নেই, মামুনি উনার ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে বড় সড় আয়োজন করে রেখেছেন।

‘বুঝলি মা? ভেবেছিলাম আরশি তোদের আজ এখানে নিয়ে আসলে আশ্বিনের জন্মদিন উপলক্ষে একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার করবো। অনেক দিন বাসায় কোন আয়োজন হয়নি। তাছাড়া তোদের বিয়ে যেভাবে হুট করে হলো কেউ তো তোকে এখনও দেখতেই পায়নি। তাই আমি আর তোর মা মিলে কত সব ভেবে রেখেছিলাম।’
অধরা নিশ্চুপ। মামুনির সাথে রান্নাঘরে এসে খাবারের আয়োজন দেখছিলো সে। তখন ড্রইং রুম থেকে আশ্বিন আর বাবার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। হেসে গল্প করছে দুজন।
প্রথম দিন থেকে দেখে এসেছে এই বাবা ছেলের মাঝে অনেক মিল। দুজন যেন একে অপরের বন্ধু!
‘কি ভাবছিস?’
‘কিছু না মামুনি। তো কখন আসবে সব মেহমান?’
‘বিকেলে আসার কথা ছিল। কিন্তু আশ্বিনের বাবা চাইছে না এই আয়োজন করতে। তোর এই অবস্থা…!’
‘মামুনি আমি সত্যিই ঠিক আছি তো। আমাকে নিয়ে এতো অস্থির হয়ো না। আশ্বিনের জন্মদিন বারবার আসবে না, তাছাড়া উনার গতকাল থেকে মন ভালো নেই। সবার মাঝে থাকলে হয়তো উনারও ভালো লাগবে।’
মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আশ্বিনের মা। অধরাকে ফ্রেশ হতে বলে হাতের কাজগুলো গোছাতে শুরু করেন উনি।
————–

অতিথিদের ভীড়ে পুরো বাড়ি টইটম্বুর। সবাই মূলত এসেছে নতুন বউ দেখার উদ্দেশ্যে। অধরা বিকেল থেকেই ব্যাস্ত, প্রতিটি সদস্যের সাথে পরিচয় হয়ে কুশল বিনিময় করতে হচ্ছে তাকে। অথচ শত ব্যস্ততার মাঝেও বারবার চোখ ঘুরিয়ে খুঁজে চলেছে সে আশ্বিনকে।
মহাশয় সেই যে সমবয়সী কিছু ভাইদের পেয়ে গল্পে মেতে উঠে ছাদে চলে গিয়েছে, ফিরে আসার আর খবর নেই।

‘অধরা মা, সব ঠিকঠাক আছে তো?’
‘হুম। তুমি কোথায় ছিলে আম্মু? তোমার তো এখানে এসে সবার আগে আমার সাথে দেখা করার দরকার ছিলো।’
‘আমি তো দেখা করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার শাশুড়ি আশাকে চেনো না? আসার পর থেকেই যেভাবে গল্প শুরু করলো!
যাই হোক, কলেজে সব ঠিক আছে তো? আশ্বিনের সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে না তো? আসলে এভাবে হুট করেই বিয়ে হলো তাই..।’
কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকে অধরার মা। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় অধরা।
‘এখন এসব কথা বলা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন আম্মু। বিয়ের আগে তো একবারও আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না তোমরা। এখন বিয়ে হয়েছে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়, আমার ভাগ্যে যেভাবে লেখা ছিলো সেভাবেই। তাই সবটা মেনে নিয়ে তো এগিয়ে যেতে হবে। তাই না?’
‘এর মানে? তবে কি, তুমি আশ্বিনের সাথে ভালো নেই মা?’
অধরা প্রতিউত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখে আশ্বিনের বাবা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। থমকে যায় অধরা। বাবা কি তবে সব শুনে ফেললেন? এখন উনি কি ভুল বুঝবেন তাকে!
চিন্তায় পড়ে যায় অধরা। মায়ের দিকে একনজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় সে।

ছাদের এক কোণে বসে আছে অধরা। রাতের খাওয়া শেষে অনেকেই চলে গিয়েছেন। এখন শুধু মামুনির কিছু বান্ধুবী মিলে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এতোক্ষণ ধরে সবার মাঝে থেকে মাথা ধরে আসছে তার। তাই ছাদে এসেছে খোলা আকাশের নিচে বাতাস উপভোগ করতে।
আকাশে চাঁদের দেখা নেই, কালো মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। একটা বেঞ্চে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে। হঠাত পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে অধরা পাশ ফিরে দেখে আশ্বিনের বাবা।
‘একা বসে আছিস কেনো মা? খারাপ লাগছে?’
‘না বাবা। এমনি বসে আছি।’
‘বুঝেছি। আমার মেয়েটাও আশ্বিনের মতোই কোলাহল মুক্ত! ঠিকই আছে, সবাই যদি তোমার মামুনির মতো বাচাল হয় তবে কারো মাথা ঠিক থাকবে নাকি?’

হেসে উঠে দুজন। পাশাপাশি বসে নিরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বাবা। অধরা নির্বিকার। অনেক কথাই সে বলতে চাইছে বাবাকে।
‘বাবা আসলে..।’
কথাটা আর শেষ করা হয়নি অধরার। বাবার কথার প্রতিউত্তরে থমকে যায় অধরা।
‘আমি জানি মা তুমি কি বলতে চাইছো। আশ্বিনের সাথে তোমার সম্পর্কটা যে এখনও স্বাভাবিক না, সেটা আমি জানি। একটা ভুল বোঝাবুঝি কিভাবে দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরি করেছে…!’
কথাগুলো বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা। অধরা হতভম্ব! তারমানে বাবা সব জানেন? কিভাবে জানলেন এইসব কথা?
‘বাবা, আপনি…?’
অধরার প্রশ্নে হালকা হেসে উঠে বাবা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে..

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৯

অধরার প্রশ্নে হালকা হেসে উঠে বাবা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে..

‘আমি ছোট থেকেই আশ্বিনকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি অধরা। যে বয়সে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা, দৌড়-ঝাঁপ নিয়ে ব্যস্ত! আমার আশ্বিন তখন থেকেই নিশ্চুপ, নিরীহ। বই পড়া, টিভি দেখা আর নিজের রুমে বসে একাই খেলনা দিয়ে খেলতে পছন্দ করতো সে। কোন প্রকার চাওয়া পাওয়া নেই। বাবা এটা আমাকে কিনে দিতেই হবে, এমন কোন জেদ তার নেই। সে তার দিক দিয়ে ছিল সন্তুষ্ট।
মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হতো। আমি চাইতাম আশ্বিন আর দুটো স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো একটু চঞ্চল হোক। তাই অনেক চেষ্টা করেছি তাকে চঞ্চল প্রকৃতির বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়ার। লাভ হয়নি, সে তাদের সাথে মিশতে নারাজ। ওর মা-ও এতে ঘোর আপত্তি জানায়, ছেলে যেমন ভাবে থাকতে চাইছে থাক না। বাধা দিচ্ছি কেনো?
কিন্তু আমিও নাছরবান্দা। আমার বন্ধুর ছেলে রোদ্দুরের সাথে আশ্বিনের পরিচয় করিয়ে দেই। রোদ্দুর ছোট বেলায় ভারি দু/ষ্টু ছিলো। খেলার ছলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো। ভাবলাম একে দিয়েই কাজ হবে। কথায় আছে না, সঙ্গ দোষ? আমিও তাই ভেবে আশ্বিনকে দিনে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই রোদ্দুরের সান্নিধ্যে রাখলাম। কিন্তু আমার আশাকে সম্পূর্ণ ব্যার্থ করে দিয়ে, আশ্বিন রোদ্দুরের মতো না হলেও, রোদ্দুর ঠিকই আশ্বিনের মতো শান্তশিষ্ট বাচ্চা হয়ে গেল।’

কথাগুলো বলে থেমে যায় বাবা। মুহূর্তেই অধরা আর বাবা একসাথে হেসে উঠে। আশ্বিনের বাবার চোখ মুখে আগ্রহ। যেন অনেকদিন পর মনের কথাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন উনি।
‘সেদিন আমার আর বুঝতে বাকি ছিল না যে আশ্বিনকে ঠিক করতে অন্য কেউ নয় বরং আমারই চেষ্টা করতে হবে। তাই তখন থেকেই আমার চেষ্টা ছিলো আশ্বিনের বাবা হওয়ার পাশাপাশি তার ভালো বন্ধু হওয়া। যাকে সে মন খুলে সব কথা বলতে পারবে।
আমার চেষ্টার কোন কমতি ছিল না, তাই দেখো আজ বাবা ছেলের সম্পর্ক অন্যরকম, সুন্দর।’

অধরা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বাবাও মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। নীরবে তাকিয়ে থাকে সিঁড়িঘরে অতি যত্ন করে রাখা ছোট্ট সাইকেলের দিকে।
‘ওই সাইকেলটা দেখছিস মা?’
‘জি বাবা। প্রথম দিন এসেই দেখেছিলাম।’

‘আশ্বিন যখন ক্লাস ফাইভে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিলো, সবাই তার রেজাল্ট দেখে খুশি হয়ে এটা সেটা উপহার দিচ্ছিলো। সেদিন আশ্বিন প্রথম আমার কাছে এই সাইকেল পাওয়ার জেদ করেছিলো। অনেক শখের ছিলো সাইকেলটা তার কাছে। প্রতিদিন বাহির থেকে এসেই রুমাল দিয়ে মুছে পরিষ্কার করতো, ছুটির দিনে আরশিকে সাইকেলে বসিয়ে বাগান ঘুরে আসতো।
হঠাত একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পথে গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙে যায় তার সাইকেল। আশা অনেক রাগ করেছিলো ছেলের উপর। আর আশ্বিন সারাদিন চুপচাপ তার রুমেই ছিলো। একবারও বলেনি যে গাড়ির সাথে লেগে শুধু তার সাইকেল ভাঙেনি, সেও আঘাত পেয়েছে। তার ছোট্ট মন ভেঙেছে। শখের বস্তু হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট সেই বুঝতে পারে যার হারায়।’
এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ বাবার কথাগুলো শুনছিলো অধরা। অতঃপর একনজর ফিরে তাকায় পুরনো সাইকেলটার দিকে।
‘শখের বস্তু অমূল্য হয় বাবা। শখের বস্তুকে মানুষ তার মনের গহীনে, হিয়ার মাঝে লুকিয়ে রাখে।’
মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় বাবা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে,
‘তুইও আশ্বিনের অনেক শখের, অধরা।’

থেমে যায় অধরা। বিস্মিত নয়নে ফিরে তাকায় সে বাবার দিকে। কি বুঝতে চাইছেন বাবা?
‘বুঝলাম না, বাবা।’
‘আশ্বিন আমার সাথে সব কথাই শেয়ার করে অধরা। কলেজে তোমাদের পরিচয়ের পর আশ্বিন প্রায়ই ফোনে তোমার গল্প আমায় বলতো। আমিও সেই সব গল্প শুনতে শুনতে একপ্রকার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর এমনও হয়েছে যে আশ্বিন ফোন করলে আমি প্রথমেই তোমার খবর জানতে চেয়েছি। আশ্বিনও খুশি মনে তোমার কথা বলতো।
হঠাত সব পাল্টে যায়। আশ্বিনকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলতো, এখন তোমাদের মাঝে আর আগের মতো কথা হয়না। বুঝলাম তোমাদের সম্পর্কে কোন ঝামেলা এসেছে। আমি আশ্বিনের কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি, কিন্তু সে কিছু বলেনি।
তারপর একদিন খবর আসে রোদ্দুরের সেই এক্সিডেন্টের কথা। আমরা সবাই ছুটে যাই ঢাকা, এতো সব ঝামেলা আর ব্যস্ততার মাঝে আশ্বিনকে তোমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কিছুদিন পর শুনেছি তোমাদের মাঝে অনেক বড় ধরনের ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, আর সেই দোষটা ছিলো আশ্বিনের।’

মুখটা কালো হয়ে আসে অধরার। এই প্রসঙ্গে কথা বলে অতীত মনে করতে চাইছে না সে। তার মনে আছে কিভাবে তার খামখেয়ালীর জন্য রাফিন আর রোদ্দুরের মাঝে ঝামেলা হয়েছিলো। তার ভুলের জন্যই তো রোদ্দুরের জীবন ম/র/ণ নিয়ে টানাটানি চলছিলো।
‘সবটা হয়েছে সেই সময়ের পরিস্থিতির জন্য। এখানে নির্দিষ্ট কারো দোষ ছিল না বাবা।’
‘জানি না আমি। তোমাদের মাঝে কি নিয়ে এই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, কেনো দুজন পুরোপুরি আলাদা হয়ে গিয়েছিলে সেসব আমি জানি না। তবে আমি এটা জানি, এখানে, এই বেঞ্চে বসেই আশ্বিন আমার সামনে তোমাকে পাওয়ার জন্য কান্না আহাজারি করেছিল। শুধু একটি কথাই বলেছিলো সে, বাবা প্লিজ অধরাকে এনে দাও।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি আশ্বিন যেন তোমাকে ভুলে যায়, কিন্তু লাভ হয়নি। আশ্বিনের শুধু তোমাকেই চাই, তুমি তার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা একমাত্র ব্যক্তি।
ছেলের পাগলামো আমার আর সহ্য হয়নি। তাই রোদ্দুরের থেকে খোঁজ খবর নিয়ে তোমার পরিচয় সংগ্রহ করতেই জেনেছি তুমি আশার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর মেয়ে। তোমার মায়ের সাথে আমাদের অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না, তাই একদিন আমি পরিকল্পনা করেই আশাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাই। যোগাযোগ আর সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর কথায় কথায় তোমার সাথে আশ্বিনের বিয়ের ব্যাপার আসে। আশা তো অনেকটা ইমোশনাল ব্লেকমেইল করেই তোমার মাকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করিয়েছে। যদিও আশা তোমার আর আশ্বিনের ব্যাপারে কিছু জানে না।’

থমকে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে অধরা। কোন কথা বলার শক্তি তার নেই। তার অজান্তেই এতো কিছু হয়ে গিয়েছে। তাদের বিয়ে! সবটাই ছিল বাবার পরিকল্পিত?
‘তাহলে হুট করে এই বিয়ের কারণ?’
‘আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো আশ্বিনকে দেখলে এই বিয়ে ভেঙে দিবি। তাই আমার অসুস্থতার বাহানা দেখিয়ে হুট করে একদিন তোদের ডেকে এনে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করি।’

চুপ হয়ে যায় অধরা। বাবা অপরাধীর ন্যায় মাথা নামিয়ে বসে আছে। হয়তো সেদিন উনি শুধু নিজের ছেলের কথাই ভেবেছেন, অধরার হয়েও একবার ভেবে দেখা উচিত ছিল উনার।
‘অধরা মা, আমি আসলে..।’
‘আপনি কোন ভুল করেননি বাবা। সেদিন যদি আপনি এমন কিছু না করতেন তাহলে আজ আমি আপনার আর মামুনির মতো ভালো মা বাবা পেতাম না, আরশিকে পেতাম না। আর সবচেয়ে বড় হলো, আশ্বিনের মতো কাউকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলতাম। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাবা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
আশ্বিনের বাবা হেসে উঠে। অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে ছাদ থেকে চলে আসেন উনি।
—————–

নিরবে বসে একধ্যানে বাবার কথাগুলো মনে করছে অধরা। মনে হচ্ছে সেই দিনগুলো, যখন আশ্বিন তার ভুল বুঝতে পেরে বারবার ক্ষমা চাইতে এসেছিলো আর সে প্রতিবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। অথচ আশ্বিনের দোষ ছিলো এটাই যে সে সত্য না জেনেই অধরাকে দোষ দিয়েছে।
মানুষ মাত্রই ভুল। আশ্বিন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। শুধু তার উচিত হয়নি এতোদিন ধরে কঠোর হয়ে আশ্বিনের সাথে এভাবে দূর্ব্যবহার করা। সেও তো কষ্ট পেয়েছিল অনেক।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে অধরা। অনেক হয়েছে এই ভুল বোঝাবুঝি। এখন সব রাগ অভিমান ছেড়ে আবারো সে ফিরে যাবে সেই চঞ্চল অধরা রূপে। যে অধরা নীরবে নিভৃতে ভালোবাসে আশ্বিনকে।

হঠাত ফোন বেজে ওঠে অধরার। ফোনের দিকে তাকিয়ে আশ্বিনের নাম দেখে মুচকি হাসি দেয় অধরা।
‘হ্যালো।’
‘হ্যা, অধরা। কি করছো তুমি? রাতের ঔষধ খেয়েছো তো?’
অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অধরার। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে,
‘না, খাইনি।’
‘আমি জানতাম। পৃথিবীর সব জ্ঞান তোমার আছে অথচ সময় জ্ঞানটাই নেই তোমার। এখনি গিয়ে ঔষধ খেয়ে নাও, যাও।’
‘আপনি বাসায় কখন আসবেন? কোথায় আছেন এখন?’
‘পার্কে এসেছি সবার সাথে। আড্ডা দেওয়া শেষ হলেই চলে আসবো।’
‘মানে কি? আপনি কি ভাবছেন রাত করে বন্ধুদের সাথে গল্প করে ফিরে আসবেন আর আমি চুপ থাকবো? আশ্বিন আপনি এখন সিঙ্গেল না, আপনার বাসায় একজন সুন্দরী বউ আছে।’
থতমত খেয়ে যায় আশ্বিন। অধরা কি বললো এটা?
‘আমি আসলে বন্ধুদের সাথে…।’

এদিকে ডায়লগ দিতে গিয়ে নিজের কথায় নিজেই বেকুব বনে গিয়েছে অধরা। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললো সে? তবে এখন নিজের বলা ভুল স্বীকার করা যাবে না, উল্টো আরো দু চারটা লজিক দেখাতে হবে।
‘কি বন্ধুদের সাথে? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন আমি অসুস্থ? তাছাড়া আজ সারাদিনের ব্যস্ততার জন্য এখন মাথা ব্যাথা করছে আমার। কোথায় আপনি জলদি এসে আমার সেবা যত্ন করবেন, তা না করে ফোন দিয়ে আমাকে নিজে ঔষধ খেয়ে নিতে বলছেন। ভালোই!’
‘আরে আমি কখন বললাম..।’
‘আপনি আর কি বলবেন আশ্বিন? মনে করে দেখুন আপনার যখন জ্বর হয়েছিলো এই আমি অধরা, আপনার স্ত্রী, আপনার কতো সেবা যত্ন করেছিলাম। আর আপনি? আজ এই দিন দেখানোর জন্যই কি বিয়ে করেছিলেন আমায়?’
‘হয়েছে থামো এখন। অনেক বড় বড় কথা বলেছো। আসছি আমি, দশ মিনিট।’
ফোন কেটে দেয় আশ্বিন। ফোনের দিকে একনজর তাকিয়ে মুচকি হেসে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায় অধরা।

–চলবে।