#চৈত্রিকা (২৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
৮২.
চিত্রকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। জমিদার বাড়ি যেনো মৃ’ত্যুসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে। পুরো বাড়িতে পল্লবীর হাহাকার করা কান্না যেনো দেওয়ালে দেওয়ালে আ’ঘাত হানছে। অর্পিতা মায়ের বুকে মুখ গুজে কেঁদে চলেছে হাউমাউ করে। শায়লা নিজেও নিঃশব্দে কাঁদছে। নাসিমা পল্লবীর পাশে বসে আছে তবে তার মুখভঙ্গী দেখে মনে হয় না খুব একটা কষ্ট পেয়েছে! নীরা পল্লবীকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। চৈত্রিকার বুকে মুখ গুজে অর্থি কেঁদে যাচ্ছে। বাড়িতে কোথাও কোনোরকম আনন্দের ছোঁয়া নেই৷ কষ্ট, হাহাকার, মায়ের আর্তনাদ, প্রেমিকার এক আকাশ সমান বেদনা, ছোট বোনের আহাজারিতে পুরো জমিদার বাড়ি নিঃস্তব্ধ। চৈত্রিকার বৃষ্টিতে ভিজা শাড়ি এখনো গায়েই আছে। এতোকিছুর মাঝে পরিবর্তন করার সুযোগ পায়নি। ভেজা শাড়ি গায়েই শুকিয়ে গেছে। চিত্রকে নিয়ে প্রহর, নিবিড়, শিমুল গেছে হাসপাতালে। চয়ন, সাদিক যায়নি। পিয়াসের কোনো খোঁজ খবর নেই। চয়ন বাড়িতে বসেই পুরো বাড়ির কান্না দেখছে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য আর ভেজা কাপড়ে থাকার জন্য অর্থির গা জ্বরে পু’ড়ে ওঠে। কেঁপে কেঁপে উঠে হুট করেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে চৈত্রিকার বুকে। চৈত্রিকা চমকে ওঠে। জোড়ে জোড়ে ডাকতে থাকে অর্থিকে৷ পুরো বাড়ির এমমন অবস্থা যে কে কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে কিছুই বুঝে আসছিলো না। পল্লবী নিজের কান্না কোনো রকম আটকে ছুটে আসে অর্থির কাছে। একমাত্র মেয়েকে হঠাৎ অজ্ঞান হতে দেখে চয়ন রেনওয়াজও দৌড়ে আসে। পল্লবী অর্থির মুখে কয়েকটা চাপড় দেয়। কাঁদতে কাঁদতেই ডাকতে থাকে মেয়েকে। কিন্তু অর্থি ওঠে না। চয়ন পল্লবীকে সরিয়ে ব্যস্ত গলায় অর্থিকে ডাকতে থাকে,
‘ছোট আম্মা! কি হয়ছে তোমার? ওঠো আম্মা! এই ছোট আম্মা!’
পল্লবী রেগে চয়নের হাত ধরে সরিয়ে দেয়। কান্না বন্ধ করে আঙুল তুলে বলে, ‘আমার মেয়ের থেকে দুরে থাকেন চয়ন রেনওয়াজ! আমার ছেলের আজ এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী। তাই ভুল করেও আমার মেয়েকে ছুঁয়েও দেখবেন না। একদম ভালো হবে না। আপনি যা যা করেছেন আর করে যাচ্ছেন তার শা’স্তি আপনি পাবেনই৷ হয় আমি দেবো নয়তো আমার মতোই অন্য এক নারী দেবে। মনে রাখবেন!’
চয়ন রেনওয়াজ তখন মেয়ের জন্য পাগল। হলরুমের সবার উপস্থিতিতেই রাগ সামলাতে না পেরে চে’পে ধরে পল্লবীর গলা। লাল চোখ তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘মেয়ে মানুষের এতো বড় গলা আমার পছন্দ না পল্লবী। তোমারে ভালোবেসে বিয়ে করছি মানে তোমার সব কথা হজম করে নিবো অমন মানুষ আমি না। তুমি আমার ৪ সন্তানের মা না হইলে এতোদিনে তোমার জায়গা হইতো সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে। তাই চুপচাপ থাকো!’
পল্লবীর গলা ছেড়ে দেয়। সবকিছু এতো দ্রুত, চোখের পলকে ঘটে গেলো যে কেউই বুঝতে পারলো না কিছু। নীরা তাড়াতাড়ি পল্লবীকে আগলে ধরে। পল্লবী কাশতে থাকে। চৈত্রিকা জ্ঞানশূণ্য হয়ে আছে। কাাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে তা বুঝতেই মাথা আওলিয়ে যাচ্ছে। আপাতত কোনো কিছু না ভেবে আগে অর্থিকে ওভাবেই শুইয়ে রেখে দৌড়ে এক গ্লাস পানি আনে। ছিটিয়ে দেয় অর্থির মুখে। চয়নও ততক্ষণে মেয়ের পাজরে বসে গেছে। পানি ছিটানোর পর পরই অর্থির জ্ঞান ফিরে আসে। চৈত্রিকা কাউকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে নিজেই প্রথমে বলে,
‘নীরা আপু অর্থিকে আগে ঘরে যান। ওর শাড়িটা বদলে ওকে একটা জ্বরের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে আসেন।’
নীরা বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায়। অর্থিও কোনো কথা বলতে পাারে না। চয়ন কিছু বলতে চাইলেও চৈত্রিকা থামিয়ে দেয়। চয়ন অবাক হয়। তবুও মুখে কিচ্ছুটি বলে না। অর্থিকে নিয়ে নীরা সরে গেলে চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। চয়নের উদ্দেশ্যে বলে,
‘আপনাকে দেখলে কেউ বলবে আপনার ছেলে মৃ’ত্যুর মুখে!’
চয়ন কপালে ভাজ ফেলে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘এই মেয়ে! আমি তোমার শ্বশুরআব্বা, গুরুজন হই। আমার সাথে এভাবে গলা উচু করে কথা বলো কোন সাহসে?’
‘এই বাড়ির বড় বউয়ের সাহসে। সবচেয়ে বড় কথা! একজন নারী হিসেবে। এখানে আপনার বড় ছেলে থাকলে যা করতো আমিও তাই করছি।’
চয়ন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। পল্লবী নিজ জায়গায় বসে হাসে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘শুধুমাত্র অর্থির জন্য আজ আপনি পাড় পেয়ে গেলেন। নয়তো পল্লবীর গায়ে হাত তোলার সাহসটা আপনার কত বেশি তাও আপনাকে বুঝিয়ে দিতাম।’
চৈত্রিকা শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্পিতা তখনো সমানে কেঁদে চলেছে। শায়লা কোনো মতেই থামাতে পারে না। চৈত্রিকা আড়চোখে পুরো জমিদার বাড়ি পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
‘পিতা হিসেবে আপনি কেমন তা তো আর বুঝতে বাকি নেই। অন্তত মানুষ হিসেবে এখন শান্ত থাকুন। চিত্র ভাইয়ের কিছু হলে আপনার যায় না আসলেও ওই মহিলার ঠিকই যায় আসবে। উনি জন্ম দিয়েছেন। তাই উনার পাগলামি টা অস্বাভাবিক নয়। পারলে স্বামী এবং জন্মদাতা পিতার দায়িত্ব পালন করেন। কোনো কিছু করতে না পারলেও অন্তত আম্মাজানকে শান্ত্বনা দেন। আপনার ছেলে যদি জানে আপনি তার অনুপস্থিতিতে এসব করেছেন তবে তা বোধহয় কারোর জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।’
চয়ন চমকায় ভেতরে ভেতরে। চৈত্রিকার কথার দাপটে তার বুঝতে বাকি নেই সে কি বোঝাতে চাচ্ছে! প্রহরকে কি এতো বেশিই চিনে চৈত্রিকা? চয়ন কোনো রকম উত্তর দেওয়ার আগেই পল্লবী হেঁসে ওঠে। গায়ের শাড়ি এলোমেলো, চুলগুলো এলোমেলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটোও ফুলিয়ে ফেলেছে। কি ভ’য়ং’কর লাগছে পল্লবীর হাসির শব্দ। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো। চৈত্রিকা অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পল্লবীর হাসির দিকে। অর্পিতা, শায়লা ভয় পেয়ে যায় পল্লবীর হঠাৎ হাসিতে। পল্লবী হাসতে হাসতেই চয়নকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘নিজের ছেলেকে ভয় লাগে নাকি চয়ন রেনওয়াজ? কি অদ্ভুত! আপনারই ছেলে আপনার মতো কেমন পা’ষা’ণ হয়েছে দেখছেন! আপনার তো তাও মায়া দয়া কিছুটা হলেও ছিলো আর আপনার ছেলের পা’ষাণতার মাত্রা এতো বেড়েছে যে সে শুধু ন্যায় আর অন্যায় বোঝে। কে বাপ, কে ভাই! এগুলো দেখার মতো মন তার নেই। আপনি আমার চিত্রর সাথে কিছু করে থাকলে পাড় পেয়ে যাবেন ভাইবেন না। আমার প্রহর ঠিকই জেনে যাবে কে ওর সাথে কি করছে! তখন প্রহর কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। এমনকি আপনাকেও না। আর আপনি নিশ্চয় জানেন প্রহরের কঠিন স্বত্তা কত বেশি কঠিন!’
পল্লবীর কথা শেষ হতেই চয়ন কেঁপে ওঠে। সে জানে প্রহর কেমন! প্রহরের থেকে কিছু লুকানোও কতটা কষ্টকর তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। কিন্তু কেউ কি নিজের ছেলের সাথে খারাপ কিছু করতে পারে! এটা প্রহর বুঝবে তো নাকি তাকে অ’প’রা’ধী ভেবে শা’স্তি দিয়ে দেবে! নিজের বড় ছেলেকে সে নিজ চোখের সামনে এমন কঠিন হতে দেখেছে। দেখেছে কিভাবে নিজের ভালোবাসাকেও শেষ করতে হয়! বি’শ্বাস’ঘাত’কতার শা’স্তির থেকে প্রহর কাউকে ছাড়ে না। স্বয়ং নিজের পিতাকেও না!
৮৩.
গ্রাম থেকে শহরের পথ কেবল ১ ঘন্টা। চিত্রকে শহরের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। প্রহর নিবিড়কে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। টানা অনেকক্ষণ ভেজা অবস্থায় থাকায় চৈত্রিকার নিজেরও শরীর খারাপ লাগছে। তবুও নিজেকে সামলে শক্ত হাতে সবাইকে সামলে রেখেছে। সন্ধ্যার আগে দিয়ে নিবিড় আসে বাড়িতে। চৈত্রিকা তখন অর্পিতা, অর্থি আর নীরার সাথে অর্থির ঘরেই ছিলো। শায়লা আর নাসিমা পল্লবীর কাছে। নিবিড় একজন মহিলাকে দিয়ে চৈত্রিকাকে ডেকে নেয়। নিবিড় এসেছে শুনে নীরাকে সামলাতে বলে নিজে দ্রুত পায়ে নিচে নামে। নিবিড় চৈত্রিকাকে দেখে মাথা নিচু করে বলে,
‘বড় ভাবীজান আপনি নাকি শহরের হাসপাতালে যাবেন!’
চৈত্রিকা ব্যস্ত গলায় বলে, ‘জ্বি। আপনিও তো যাবেন তাই না?’
‘জ্বি।’
‘আচ্ছা একটু দাঁড়ান আমি এক্ষুণি আসছি।’
নিবিড় মাথা নাড়ায়। চৈত্রিকা আগে থেকেই নতুন একটা শাড়ি পড়েছিলো যাতে নিবিড় আসলেই চলে যেতে পারে। চৈত্রিকা ঘুরে আবার অর্থির ঘরে আসে। নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘নীরা আপু আপনি একটু এদিকে খেয়াল রাখুন। আমি আসছি!’
চৈত্রিকা ঘর থেকে বের হতে নিলে নীরা ব্যস্ত গলায় শুধায়, ‘ভাবীজান আপনি সত্যিই যাচ্ছেন? জমিদার বাড়ির মেয়ে, বউদের কিন্তু এসবে যেতে মানা!’
‘যেতে মানা থাকলে থাকুক! আমি তবুও যাবো। আশে পাশে শ’ত্রুর অভাব নেই। এখন উনার পাশে আমাকে দরকার।’
চৈত্রিকা ‘উনি’ বলতে যে ‘প্রহরকে’ বুঝিয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না নীরার। মুচকি হেঁসে চৈত্রিকাকে বিদায় দিলো। চৈত্রিকা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই নীরা সে পথে তাকিয়ে বলে,
‘আপনাদের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে ভাবীজান। আপনারা কবে বুঝবেন আপনারা আসলেই একে অপরকে ভালোবেসে ফেলছেন!
চৈত্রিকা নিজ ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে আসে। ততক্ষণে হলরুমে নাসিমাও হাজির। নাসিমাকে দেখেও না দেখার ভান করে নিবিড়কে বলে,
‘নিবিড় ভাইজান চলুন!’
নিবিড় মাথা নাড়িয়ে বের হতে নিলে নাসিমা পেছন থেকে ডেকে দাঁড় করিয়ে দেয়। চৈত্রিকা জানে এখন একটা ঝামেলা হবে তাই সে যথেষ্ট বিরক্ত হয়। কোনো কথা না বলে চুপচাপ তাকায় নাসিমার দিকে। নাসিমা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
‘জমিদার বাড়ির বড় বউ একজন প’রপুরুষের সাথে এই সন্ধ্যা বেলা কোথায় যাচ্ছে শুনি!’
‘হাসপাতালে যাচ্ছি।’
‘কেনো? প্রহর কি তোমাকে যেতে বলেছে? আর এই যে ছেলে তুমি! ব্যাপার স্যাপার কি তোমার? জমিদার বাড়ির মানুষজন তো তোমার আত্মীয় লাগে না তাহলে এতো দরদ দেখাচ্ছো কেনো? মতলব টা কি তোমার?’
এ পর্যায়ে নিবিড় চুপ থাকলেও চৈত্রিকা চুপ থাকে না। কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়, ‘নিজে যদি জমিদার বাড়ির বিপদে পাশে না থাকতে পারেন অন্তত যে পাশে আছে তাকে কিছু বলবেন না। বলার কোনো রকম অধিকার আপনার নেই। তাছাড়া সবাই তো আর আপনার মতো উদ্দেশ্য নিয়ে সব কাজ করে না। সবাইকে নিজের মতো ভাববেনও না।’
নাসিমা ফোঁস করে ওঠে। চৈত্রিকা পাত্তা না দিয়ে নিবিড়ের উদ্দেশ্য ‘আসুন’ বলেই হাঁটা লাগায়। নিবিড় চৈত্রিকার তেজ সম্পর্কে শুনেছিলো তবে মুখের ওপর এভাবে জবাব দেওয়াটা প্রথমবারের মতো দেখে হা হয়ে গেছে। রোবটের মতো চৈত্রিকার পিছু পিছু বের হয়। কোনো রকম কথা না বলেই দুজনে মোড় পর্যন্ত আসে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সরাসরি শহরে আসে৷ হাসপাতালের করিডোরে তখন প্রহর বসে আছে মাথা নিচু করে। চৈত্রিকা নিঃশব্দে ছুটে আসে প্রহরের কাছে। প্রহরের সামনা সামনি দাঁড়াতেই প্রহর মাথা উচু করে তাকায়। চৈত্রিকার মুখ দৃশ্যপটে ভেসে উঠতেই চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। চৈত্রিকা এ সময় এখানে কেমন করে থাকবে! মাথায় নানান চিন্তা ভাবনা থাকলেও তা আর এগোতে ইচ্ছে করে না প্রহরের। এমনিতেই চিত্রর জন্য মনটা বি’ষিয়ে আছে। এতোগুলো দিন পর ভাইটাকে চোখের সামনে পেয়েও এ অবস্থা যেনো হৃদয়ে ক্ষ’ত করার মতো ঘটনা। যেভাবে মাথা উচু করেছিলো ঠিক সেভাবেই মাথা নিচু করে নেয়। নিবিড় দুজনকে একা ছেড়ে এগিয়ে যায় শিমুলের দিকে। শিমুল তখন ভাতিজার চিন্তায় এ মাথা থেকে ও মাথা পাইচারি করতে ব্যস্ত। খেয়ালই করেনি চৈত্রিকা আর নিবিড়কে। নিবিড় যখন কাছে গিয়ে থামিয়ে দিয়ে দুয়েকটা কথা বলে তখন শিমুলের নজর পড়ে চৈত্রিকার দিকে। নিবিড়ের সাথে অর্ধেক কথা অর্ধেক রেখেই ছুটে আসে চৈত্রিকার কাছে। অবাক কন্ঠে বলে,
‘তুমি এখানে কি করছো বড় বউ?’
চৈত্রিকা নিচু স্বরে বলে, ‘চিত্র ভাইয়ের জন্য এসেছি।’
শিমুল রাগী গলায় কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। নিচু স্বরে বলে, ‘কাজটা ঠিক করোনি বড় বউ। তোমার শ্বশুড় জানতে পারলে ভীষণ ক্ষে’পে যাবে।’
এ কথা যদিও পাত্তা দেয় না চৈত্রিকা তবে মুখভঙ্গিতেও কিছু প্রকাশ করে না। শিমুল দুরে সরে যায়। চৈত্রিকা প্রহরের পাশে বসতেই প্রহর শান্ত কন্ঠে বলে,
‘এখানে এসে ঠিক করোনি চৈত্রিকা। বাড়ির নিয়ম ভাঙাটা তোমার উচিত হয়নি।’
চৈত্রিকার ইচ্ছে করে প্রহরকে কিছু বলতে। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে দমিয়ে ছোট করে বলে, ‘বাড়ির নিয়মের চেয়েও আপনার পাশে থাকাটা আমার কাছে বেশি জরুরী জমিদার সাহেব।’
প্রহর শোনে। কিছু না বলে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় চৈত্রিকার দিকে। চৈত্রিকা স্বাভাবিক। প্রহরের লাল হওয়া চোখ দেখে চৈত্রিকার মায়া লাগে। মানুষ কান্না আটকে রাখলে যেমন হয় প্রহরের চোখ দুটো এখন তার কাছে তেমনই মনে হলো৷ চৈত্রিকার হঠাৎ কি হলো জানা নেই! কাঁপা কাঁপা দু হাতে প্রহরের মুখটা হাতের আজলে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
‘চিন্তা করবেন না জমিদার সাহেব। চিত্র ভাইয়ের কিছু হবে না। দেখবেন উনি সুস্থ হয়ে যাবে। আপনি ভেঙে পড়লে চলবে না জমিদার সাহেব। যারা অন্যায় করেছে তাদেরকে শা’স্তিও তো দিতে হবে! আপনি ভয় পাবেন না চিত্র ভাইকে নিয়ে। আমরা একসাথে সুস্থ করে তুলবো উনাকে। আমি আছি তো! থাকবো তো আপনার পাশে।’
চৈত্রিকার আদুরে ভঙ্গিতে বলা কথার পিঠে প্রহর কোনো জবাব দেয় না। হুট করেই জাপ্টে ধরে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা একটু চমকালেও দুরে সরে যায় না। বরং নিজেও দুহাতে প্রহরকে আগলে থাকে। নীরব ভাবেই প্রহরকে বুঝিয়ে দেয় সে আছে প্রহরের পাশে।
৮৪.
সারা রাত প্রহর আর চৈত্রিকা জেগেই ছিলো। সকালে বাহিরে নাস্তা করে প্রহর চৈত্রিকাকে বাড়ি ফিরতে বলে। কিন্তু চৈত্রিকা বাড়ি ফিরতে নারাজ। চিত্রকে আরো দুদিন হাসপাতালে রেখে তারপর বাড়িতে নেওয়া হবে৷ চিত্রকে না নিয়ে প্রহর বাড়িতে ফিরতেও পারবে না। চৈত্রিকারও মন সায় দেয় না প্রহরকে ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে! কিন্তু প্রহরের জিদের কাছে চৈত্রিকা হার মেনে নেয়। জমিদার বাড়িতে তাকে আসলেই এখন দরকার। তাই প্রহরের কথা মেনে নিয়ে সে নিবিড়ের সাথেই বাড়িতে ফেরে। গ্রামে পা দেওয়ার সাথে সাথেই নিবিড় আর চৈত্রিকার দিকে গ্রামের লোকরা বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। চৈত্রিকা ততোটা পাত্তা না দিলেও বুঝতে পারে কিছু হয়েছে! আশে পাশের লোকজনের কা’নাঘু’ষোতেই তা স্পষ্ট। নিবিড় সরাসরি চৈত্রিকাকে জমিদার বাড়ির সামনে রেখে ফিরে যায়। চৈত্রিকা গেট পেড়িয়ে বাড়িতে পা রাখতেই বুঝতে পারে বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম। কপালে ভাজ ফেলে এগিয়ে যেতেই নীরা ছুটে আসে। চৈত্রিকার হাত চেপে ধরে দ্রুত তাকে নিয়ে যায় প্রহরের ঘরে। ঘটনাটা এতো দ্রুত হয়ে যায় যে কি হলো তা বুঝতেই পারে না চৈত্রিকা। নীরা ঘরের দরজা আটকাতেই চৈত্রিকা বলে,
‘কি হয়েছে আপু? ঘরের দরজা আটকাচ্ছেন কেনো?’
নীরা কোনো রকমে বড় বড় শ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আপনাকে নিয়ে পুরো গ্রামে যা তা রটে গেছে বড় ভাবীজান। আপনি নাকি নিবিড় ভাইজানের সাথে অ*বৈ*ধ সম্পর্কে গেছেন এবং কাল রাতে তার সাথেই কোথাও চলে গেছেন! এমন ঘটনা দিয়েই পুরো গ্রাম ভরে উঠেছে। জমিদার বাড়ির সবাইকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলেও কেউ কিছু মানতে নারাজ। সবাই আপনার ওপর ক্ষে’পে আছে। আম্মাজানের যদিও এসবে মন নেই কিন্তু আপনাকে সামনে পেলে যা তা শোনাবে না এটাও আমি সম্পূর্ণ পরিষ্কার না! আপনি এখন কি করবেন বড় ভাবীজান?’
চৈত্রিকা নির্বাক, হতভম্ব। কি বলবে তার ভাষাই খুঁজে পেলো না৷ এটাও কোনো কথা! এগুলো মানুষ বিশ্বাস করে কেমন করে! আর কি থেকে কি হলো তাই বা কে জানে! চৈত্রিকার মাথাই যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিলো। নীরা কয়েকবার চৈত্রিকাকে ধাক্কা দিলেও চৈত্রিকা কোনো শব্দই করে না। এর মাঝেই নিচ থেকে হৈ চৈ এর শব্দ আসে। যেনো কোনো ঝা’মেলা বেঁধেছে। ঘরের দরজায় অর্থি কড়া নাড়ে,
‘মেজো ভাবী এই ঘরে আছেন! যদি থাকেন জলদি নিচে আসেন। স’র্বনাশ হয়ে গেছে।’
অর্থির কথার প্রেক্ষিতে চৈত্রিকা আর নীরা দুজনেই চমকে ওঠে। অর্থি ততক্ষণে ছুট লাগিয়েছে। চৈত্রিকা আর নীরা একসাথে ঘর থেকে হয়। নীরা ভয় পেলেও চৈত্রিকা ভয় পাচ্ছে না। তবে মন বলছে ভ’য়ং’কর কিছুর সামনে সে পড়তে চলেছে। গুটি গুটি পায়ে যখন দুজন এগিয়ে আসে তখন চোখ পড়ে দরজায় দাঁড়ানো দুজন নব বিবাহিত দম্পতির দিকে। যাদের গায়ে বিয়ের শাড়ি আর পাঞ্জাবি রয়েছে। চৈত্রিকা আর নীরা দুজনেই চমকায়। দুজনেরই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। চৈত্রিকা ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় সদর দরজায় দাঁড়ানো পিয়াসের পাশে লাল টুকটুকে বউ সাজের সাথীর মুখের দিকে। ভেতরটা অচেনা, অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। প্রথমবারের মতো চৈত্রিকা ভয় পায়। কঠোরতা ছাপিয়ে চৈত্রিকা আতঙ্কে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসে। সামনে যেনো জ্বলজ্বল করে ওঠে সাথীর ভবিষ্যৎ।
চারদিকে চৈত্রিকার নামের দু’র্নাম। সাথীর এই অজানা পদক্ষেপ! প্রহরও নেই পাশে। চৈত্রিকার একার লড়াই এবার একাই লড়তে হবে বরাবরের মতো। চৈত্রিকা কি আদৌও পারবে সব কিছুর সামনে নিজেকে শক্ত রাখতে! নিজের কঠোরতা ধরে রেখে সকল রহস্যের সমাধান করে বাঁচতে পারবে নাকি রহস্যের জালে, কিছু মানুষের ষ’ড়য’ন্ত্রের কাছে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাবে চিরতরে! সকল প্রশ্নের উত্তর পাবেন ‘চৈত্রিকা’র দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে।
চলবে।