#চৈত্রিকা (৩০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
৮৫.
আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। কালো মেঘে ছেয়ে আছে পরিবেশ। সূর্য মামার দেখা নেই তবে মেঘেরা জানান দিচ্ছে খানিক বাদেই হয়তো পৃথিবী কাঁপিয়ে তারা বর্ষণ করবে। কালো মেঘ আর বাতাসে পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। বাহিরের এই পরিবেশের মতোই জমিদার বাড়ির পরিবেশও থমথমে। পিয়াস আর সাথী পাশাপাশি বসে আছে হলরুমে। তাদের ভিড় করে বাদ বাকি সবাই বসে আছে নয়তো দাড়িয়ে আছে। চৈত্রিকা আর নীরা একসাথে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চৈত্রিকার অপলক দৃষ্টি সাথীর দিকে। ভেতরটা তার অস্থির হয়ে আছে এই সাথীর সাথে কথা বলার জন্য। সাথীর এমন পদক্ষেপের কারণ জানার জন্য তার মন, মস্তিষ্ক ছুটে বেড়াচ্ছে। নীরা পাশে দাঁড়িয়েই তাকিয়ে আছে পিয়াসের মুখপানে। অদ্ভুত ভাবে এই মানুষটা নতুন বউ আনাতে তার যতটা না কষ্ট হচ্ছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট এটা ভেবে হচ্ছে যে এই নির্দোষ সাথীকে পিয়াস বিয়ে করেছে। চয়ন, সাদিক গম্ভীর হয়ে বসে আছে। পল্লবী, শায়লা, অর্পিতা নির্বাক। অর্থি দুর থেকে বসেই তাকিয়ে আছে চৈত্রিকার দিকে। সকলেই যে কিছু না কিছু ভাবছে তা বুঝতে বাকি নেই৷ সবার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে চয়ন রেনওয়াজ গম্ভীর স্বরে বলে,
‘পিয়াস জমিদার বংশের ছেলে। আরেকটা বিয়ে করেছে এতে তো কিছু বলার নেই।’
নীরা তাচ্ছিল্য করে হাসে। তবে মুখে কিছু বলে না। পাশ থেকে সাদিক রেনওয়াজ বলে, ‘কিন্তু ভাইজান আপনার বড় ছেলের বউকে কিছু বলবেন না! সে যে আমাদের জমিদার বাড়ির মান সম্মান ডুবিয়ে আসলো এতে কি সে কোনো শা’স্তি পাবে না?’
চৈত্রিকা একটুও চমকায় না। তবে শায়লা, নীরা, অর্পিতা, অর্থি আর সাথী চমকে তাকায়। চৈত্রিকার দৃষ্টি তখনো ঠায় সাথীর দিকেই রয়েছে। সাথীর চমকে যাওয়া মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় চৈত্রিকা। নীরা ভয়ে হাত জাপ্টে ধরে চৈত্রিকার। চৈত্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই চয়ন বলে,
‘এই যে বড় বউ! সারা রাত প’র’পু’রু’ষের সাথে থেকে সকাল বেলা কোন মুখ নিয়ে বাড়িতে এসেছো হ্যাঁ? লাজ লজ্জা কি কিছুই নেই? একজনের বউ হয়ে অন্যজনের সাথে এসব কি!’
চৈত্রিকা ছোট্ট করে বলে, ‘আমি কোনো রকম অ’ন্যায় করিনি যে লজ্জা পাবো! আর যার বউ আমি তার সাথে ছিলাম। স্বামীর বাড়িতে মানুষ কোন মুখ নিয়ে আসে আব্বাজান?’
চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। চৈত্রিকার এই তেজ তার পছন্দ নয়। মেয়ে মানুষ হবে নরম কাঁদার মতো কিন্তু এই মেয়ে শক্ত পাথরের মতো। এতোকিছুর পরও গলা উচিয়ে কথা বলছে! চয়ন রাগী স্বরে বলে,
‘একে তো অন্যায় করেছো তারওপর আবার মুখে মুখে কথা বলছো!’
চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। চয়নের চোখে চোখ রেখে কন্ঠস্বর কঠিন করে বলে, ‘আমি মোটেও কোনো অন্যায় করিনি। নিবিড় ভাইয়ের সাথে আমি হসপিটালে আপনার ছেলের কাছেই গেছিলাম এবং সারা রাত সেখানেই ছিলাম। আপনার ছেলেকে খবর পাঠান। আসতে বলুন! সে নিজে মুখেই বলবে কোনটা সত্য!’
পাশ থেকে সাদিক ধমক লাগিয়ে দেয়। কড়া কন্ঠে বলে, ‘বাড়ির বউ হয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলো কোন সাহসে? ভাইজান তোমার গুরুজন।’
চৈত্রিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাদিক নিজের মতো যা তা বলতে থাকে। চৈত্রিকা কোনো উত্তর না দিয়ে সাথীর মুখের দিকে তাকায়। সাথী কাচুমাচু করছে বসে বসে। সাথীকে নতুন বউয়ের বেশে দেখে চৈত্রিকার মনের যে ঝড়, যে ভয়, যে আতঙ্ক কাজ করছিলো তা এখন কমে গেছে। সে জানে সাথীর ভবিষ্যৎ কি হবে! কিন্তু চৈত্রিকা দমে গেলে এ বাড়িতে তাদের দুজনেরই টিকে যাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। পিয়াস তাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো সাথীকে বউ করে এনেছে! সে দমে গেলে যে এবার পিয়াস জিতে যাবে! যে হাতে নীরার হাত ধরা ছিলো সে হাত আরো শক্ত করে ধরে অন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। পিয়াস সাথীকে বিয়ে করেছে এ বিষয়টা মস্তিষ্ক পর্যন্ত যেতেই মাথার শিরা উপশিরা টগবগ করে ওঠে। চোখ তুলে পুরো জমিদার বাড়ি পর্যবেক্ষণ করে। সাদিকের কথার বিপরীতে এতক্ষণ সবাই চুপ থাকলেও পল্লবী মুখ খোলে৷ গম্ভীর স্বরে বলে,
‘সাদিক চুপ থাকো! যত যায় হোক তুমি কিন্তু আমার বাড়ির বউকে নিয়েই যা তা বলতেছো!’
সাদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘সত্যিটাই তো বলতেছি ভাবীজান। আপনার বাড়ির বউয়ের চরিত্র দেখেছেন! ছিঃ ছিঃ। পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গেছে ঘটনাটা। কত লোক তো স্বচক্ষে দেখেছে ওদের দুজনকে ঢ’লাঢ’লি করতে!’
‘ছোট কাকা! কত লোকের কথাগুলো কি নিজেদের নামে বসাচ্ছেন? তাছাড়া তো আপনাদের মতো নিচু মানসিকতার মানুষ ছাড়া এসব ভাবার মতো লোকজন থাকার কথা না।’
চৈত্রিকার শান্ত গলার অ’পমানে সাদিক তেলে বেগুনে জ্ব’লে ওঠে। কয়েকটা অ’কথ্য ভাষা ছুড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘নিজে তো ন*ষ্টামি করে বেড়াও আবার আমাদের মানসিকতার দিকে আঙুল তোলো!’
চৈত্রিকার বা হাতের কাছেই ফুলদানি ছিলো৷ রাগে তা ছুড়ে মা’রে সাদিকের দিকে৷ ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। ফুলদানিটা গিয়ে সরাসরি সাদিকের হাতের লাগে। চোখে মুখে ক্ষো’ভ ফুটিয়ে চৈত্রিকা চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘নিজের ভাষা সংযত রাখুন! আমাকে যা তা বললে আমি সহ্য করবো না। আমি কোনো অ’ন্যায় করিনি মানে করিনি৷ আমার যদি নিবিড় ভাইজানের সাথে চলে যাওয়ার হতো তবে আমি এখানে আবার ফিরে আসতাম না। সবাইকে নিজেদের মতো চ’রিত্র’হীন মনে করেন কেনো?’
এতক্ষণ সবাই নিজেদের মতো বসে থাকলেও এই ঘটনায় সবাই দাড়িয়ে যায়। সাদিককে নাসিমা ধরে। পল্লবী দ্রুত এগিয়ে যায় চৈত্রিকার কাছে৷ পিয়াস এতক্ষণ বসে বসে মজা নিলেও এ পর্যায়ে উঠে দাঁড়িয়ে রেগে বলে,
‘বড় ভাবীজান! কাকা আপনার গুরুজন হয়। আপনি কোন সাহসে উনাকে আ’ঘাত করলেন?’
‘আওয়াজ নিচে! সম্পর্কে আমিও আপনার গুরুজনই হই দেবর ভাই। আমি যদি কাকাকে আ’ঘাত করার সাহস না রাখি তাহলে আপনিও আমার ওপর চেঁচানোর অধিকার রাখেন না।’
পাশ থেকে পল্লবী ধমক দিয়ে বলে, ‘চুপ করো বড় বউ।’
অর্পিতা, অর্থি, শায়লা, সাথী সবাই এসে চৈত্রিকার পাশে দাঁড়ায়। অর্পিতা চৈত্রিকার হাত ধরে টেনে চাপা স্বরে বলে, ‘বড় ভাবীজান কি করছেন এগুলো!’
চৈত্রিকা জবাব দেয় না। সাদিক রেনওয়াজ রাগী স্বরে বলে, ‘যেটা করলে সেইটা ভালো করোনি বড় বউ। আর তুমি যখন এতোই সতী সাবিত্রি তা ডাকো নিবিড়কে। তুমি যে তার সাথে সারারাাত ছিলে না এটা প্রমাণ করো!’
‘আমার নিজেকে প্রমাণ কেনো করতে হবে? কে আপনারা? আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই জানি আমি ক’লঙ্ক’হীনা নারী। আমার গায়ে ক’লঙ্কের ছিটেও নেই৷ বরং ভয় পান! প্রহর রেনওয়াজ এসব কিছু জানলে এতো সহজে আপনাদের ছেড়ে কথা বলবে না।’
‘তুমি এতো বড় বড় কথা না বলে নিবিড়কে আসতে বলো! তুমি যখন কোনো দো’ষই করোনি তাহলে ওকে ডাকতে সমস্যা কোথায়?’
চৈত্রিকা জিদ করে না। একজন মেইডকে ডেকে পাঠিয়ে দেয় নিবিড়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে মনে মনে বেশ অবাকই হয়। এরা নিবিড়কে কেনো ডেকে পাঠালো তা বুঝে আসে না। নিবিড় আসলে তো সব সত্য ঠিকই সামনে এসে যাবে আর পরে নিজেরাই ফেসে যাবে! তাহলে? কি চলছে এদের মনে! এর মাঝেই পিয়াস আর সাথীর বিয়ের খবর পেয়ে ছুটে আসে সনিয়া বেগম আর আজম আলী। সনিয়া বেগম বিচলিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে জমিদার বাড়ির হলরুমে আসে। চোখের সামনে নিজের মেয়েকে বউ সাজে দেখে পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। তিক্ত অনুভূতিতে ভেতরটা তিতকুটে হয়ে আসে। সাথী সনিয়া বেগমকে দেখে ভয় পায়। সনিয়া বেগমকে দেখে বাড়ির সবাই আপাতত চুপ হয়ে যায়। পরিবেশ শান্ত হয়ে যায়। চৈত্রিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের মামীর দিকে। এতো বড় ধাক্কাটা যে তার সহ্য হবে না তা সে খুব ভালো করেই জানে। সনিয়া বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সাথীর সামনে। সাথী ভয়ে চৈত্রিকার পিছনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়ায়। সনিয়া বেগমের চোখে তখনো অশ্রু। সে অশ্রুর দিকে দৃষ্টিপাত করেই চৈত্রিকা শক্ত হাতে সাথীর হাত টেনে সামনে আনে। সাথী কাচুমাচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়। সনিয়া বেগম শক্ত কন্ঠে বলে,
‘তোর গায়ে বিয়ের শাড়ি কেন? যা রটেছে তা কি সত্যিই সাথী?’
সাথী ভয়ে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করে। নিজের মা’কে সে ভালো করেই চেনে। সাথীর উত্তর না পেয়ে সনিয়া বেগম ফের শুধায়, ‘কি হলো বল! সত্যি এগুলো?’
সাথী এবারও চুপ থাকে। পল্লবী পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বলে, ‘আপা বসেন! বসে কথা বলা যাবে।’
‘বসার জন্য আসিনি জমিদার গিন্নি। আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে এসেছি!’
পল্লবী দমে যায়। সাথীর চুপ থাকায় রেগে যায় সনিয়া বেগম। সাথীর হাতের কব্জি চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কথা বলিস না কেন? বল এগুলো সত্যি? তুই আর পিয়াস রেনওয়াজ বিয়ে করেছিস?’
সাথী কোনো উপায় না পেয়ে ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ায়। সাথে সাথে ক’ষিয়ে থা’প্প’ড় বসায় সনিয়া বেগম। সাথী পড়ে যেতে নিলে চৈত্রিকাকে ধরে নিজের ভার সামলে নেয়। কিন্তু চৈত্রিকা ধরেও না সাথীকে। সনিয়া বেগমের থা’প্প’ড় দেওয়াতেও কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শান্ত চোখে একবার সাথী আর একবার সনিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সনিয়া বেগমের এহেন কান্ডে ছুটে আসে পিয়াস। সাথীর পাশে দাঁড়িয়ে রাগী গলায় বলে,
‘আপনার এতো বড় সাহস হয় কি করে? আপনি আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন কোন সাহসে? ‘ও’ এখন জমিদার বাড়ির বউ।’
সনিয়া বেগম তেতে ওঠে। রাগে এক হাতে পিয়াসের কলার টেনে ধরে বলে, ‘ও এই বাড়ির বউ হওয়ার আগে আমার মেয়ে। আমার মেয়েকে আমি মা’রি, কা’টি সেইটা একমাত্র আমার বিষয়। আপনি নাক গলাবেন না একদম।’
পিয়াসের কলার টেনে ধরায় পিয়াস ক্ষে’পে যায়। চোয়াল শক্ত করে সনিয়া বেগমের হাত থেকে কলারের হাত সরিয়ে বলে, ‘এতো বড় কলিজা তোর! পিয়াস রেনওয়াজের গায়ে হাত দিলি!’
পিয়াস কোনো কিছু না ভেবেই রেগে নিজের কাছে থাকা একটা ছোট্ট ছু’রি সনিয়া বেগমের গলায় চেপে ধরে। সবাই আঁতকে ওঠে। ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটে গেছে যে কি থেকে কি হলো কেউ বুঝতেই পারলো না। পল্লবী ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
‘কি করছিস পিয়াস? ছাড় উনাকে!’
সাথী ভয়ে পিয়াসের পা ধরে বসে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আম্মাকে ছেড়ে দেন প্লিজ। আমার আম্মাকে মা’রবেন না।’
সনিয়া বেগম তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে। মুখের থু পিয়াসের দিকে ছু’ড়ে মে’রে বলে, ‘তোর মতো জা’নো’য়া’রকে মেয়ের জামাই হিসেবে দেখার চেয়ে নিজেই ম’রে যাওয়া ভালো। আমার মেয়েটা না বুঝে নিজের জীবনটা নিজে ন’ষ্ট করেছে! কিন্তু তুই পাপ থেকে বাঁচতে পারবি না।’
পিয়াস রাগে ফুঁসতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বড় বড় শ্বাস নিয়ে ছোট্ট করে বলে, ‘তাহলে ম’র!’
পল্লবী দ্রুত এগোতে নেয়। সবার আতঙ্কের মাঝেই ঘটে যায় আরেক কান্ড। পিয়াস সনিয়া বেগমের গলায় আ’ঘাত করার আগেই চৈত্রিকা তার গলায় তলোয়ার চেপে ধরে। একদিনে পর পর এতোগুলো ঘটনাার সম্মুখীন হয়ে জমিদার বাড়ির লোকজন আতঙ্কিত। অর্থি ভয়ে জাপ্টে ধরে আছে অর্পিতাকে। চৈত্রিকার হঠাৎ এমন কান্ডে সবাই অবাক হয়। পিয়াস চমকায়। চৈত্রিকা শান্ত গলায় বলে,
‘আমার মামীর গলা থেকে ছু’রিটা সরান! নয়তো এই তলোয়ার আপনার গলার ভেতর এফোঁড়ওফোঁড় করতে দেড়ি হবে না।’
হলরুমে জট পেকে যায়। চারপাশ থেকে একবার পিয়াসকে তো একবার চৈত্রিকাকে ছু’রি নয়তো তলোয়ার সরাতে বলছে। কিন্তু দুজনের কেউই কিছু না করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মন যখন পিয়াস আর সনিয়া বেগমের দিকে ছিলো তখন চৈত্রিকা সরে যায়। কেউ খেয়ালই করেনি বিষয়টা। আর এটাই পিয়াসের কাল হলো। পিয়াস সনিয়া বেগমের গলাা থেকে ছু’রি না সরালে চৈত্রিকা নিজের হাতের তলোয়ার আরো জোড়ে চেপে ধরে। চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলে,
‘চৈত্রিকা যে শুধু মুখে নয় করেও দেখাতে পারে তার ছোট্ট একটা উদাহরণ আপনি পেয়েছেন দেবর ভাই। তাই ভালো মতো আমার মামীর গলা থেকে ছু’রি সরান নয়তো আমার হাত কাঁপবে না তলোয়ার আপনার গলার ভেতর ঢু’কিয়ে দিতে! আমার মামীর শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্তবিন্দু বের হলেও তা আপনার জন্য চরম শা’স্তিযোগ্য হবে।’
পিয়াস হুট করেই চমকে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেদিন রাতের কথা যেদিন রাতে চৈত্রিকা তার হাতে সত্যি সত্যিই ব’টির কো’প দিয়েছিলো! অজান্তেই হাত আলগা হয়ে যায় পিয়াসের। চৈত্রিকা বুঝতে পেরে সনিয়া বেগমকে সরিয়ে দিয়ে ছু’রিটা কেড়ে নেয়। পিয়াস কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনষ্ক হয়ে গেছিলো বলেই চৈত্রিকা কাজটা করতে পেরেছে। নিজের তলোয়ার পিয়াসের গলা থেকে সরিয়ে বলে,
‘একটু আগেই না বলছিলেন কাকা আমার গুরুজন! তাকে আ’ঘাত করতে পারি না আমি! তাহলে আমার মামীও তো আপনার গুরুজন। আপনার শ্বাশুড়ি। তাহলে আপনি তাকে আ’ঘাত করার অধিকার রাখেন কেমন করে? আপনি যদি পুরুষ হয়ে গুরুজনকে আ’ঘাত করতে পারেন তবে আমি নারী হয়েও তা পারি। আপনি সাথীকে বিয়ে করেছেন খুবই ভালো কথা কিন্তু এর মানে এই না যে আপনি ওকে সামান্যও কষ্ট দিলে আমি চুপচাপ দেখে যাবো! চৈত্রিকা কাউকে ভয় করে না৷ না পাপকে আর না পাপের বাপকে!’
শেষের লাইনটুকু বলার সময় ঘাড় বাকিয়ে চয়নের দিকে তাকায়। তার শান্ত গলার বাক্যের মানে সবাই ঠিকই বুঝেছে। চয়ন, পিয়াস, সাদিক, নাসিমা সবাই ক্ষে’পে ওঠে। চৈত্রিকা নিজের হাতে তলোয়ার ধরে রেখেই সনিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘বাড়ি যাও মামী। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখানে আর আসবে না। তোমার ছোট মেয়েকে তোমার বড় মেয়ে আগলে রাখবে।’
সনিয়া বেগম কিছু বলার মতো পায় না৷ এর মাঝেই সেই মেইড আসে যাকে নিবিড়কে ডাকার জন্য পাঠানো হয়েছিলো। সে আসতেই চয়ন জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি একা কেনো? নিবিড় কোথায়?’
‘তার বাড়িতে তালা দেওয়া হুজুর। আশে পাশের কেউ তার খোঁজ জানে না।’
কথাটা যেনো বিস্ফোরণের মতো ফুটলো চৈত্রিকার কানে। নিবিড় তো তার সাথেই এসেছিলো তাহলে হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলো! ছোট্ট অর্থি ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার দিকে। বড় ভাবীজানকে সে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু তার বড় ভাবীজানই তার মাষ্টারমশাইয়ের সাথে এমন করলো! মাথার মধ্যে চিনচিন করে ওঠে। ব্যাথায় মাথাটা খুলে যেতে চায় যেনো। এতক্ষণ চৈত্রিকার ওপর বিশ্বাস রাখলেও এ খবরের পর আর অর্থি পারে না বিশ্বাস রাখতে। মুখে হাত চেপে দু পা পিছিয়ে গিয়ে ডুকরে ওঠে। মুখে হাত থাকায় শব্দ বোঝা যায় না। তার ভাবনার মাঝেই সাদিক রেগে বলে,
‘এখন বলো কিছু! ভাইজান এইরকম চ’রি’ত্র’হী’ন মেয়েকে আমরা বাড়িতে রাখতে পারি না। এক্ষুণি বের করে দিন ওকে!’
চলবে..
#চৈত্রিকা (৩১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
চৈত্রিকার মাথায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কোথা থেকে কি হলো তা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো। ঝিম মে’রে অনেকক্ষণ ভাবার পর বুঝে যায় যে এখানে কোনো না কোনো ষ’ড়’য’ন্ত্র আছে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়লেও ওপরে ওপরে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। চয়ন শান্ত গলায় তার উদ্দেশ্যে বলে,
‘নিবিড়ের এই নিখোঁজ হওয়াটাই প্রমাণ তোমাদের অ’প’ক’র্মের। তাই কোনো কথা ছাড়াই এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও নয়তো এমন শা’স্তি দেবো যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
চয়ন যেমন শান্তভাবে কথা গুলো বলে পরিবেশটা অশান্ত করে তোলে তেমনই সেই পরিবেশকে আরো কয়েকগুণ অশান্ত করতে চৈত্রিকা জবাব দেয়,
‘আমাকে তাড়ানোর জন্যই এতোসব প্ল্যান? আব্বাজান! চৈত্রিকা এ বাড়ি থেকে যাবেও না আর আপনাদের পাপ আপনাদের পিছুও ছাড়বে না।’
পরিবেশ এতোটাই বিগ্রে গেছে যে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা কেউই বুঝতে পারছে না। তবে এতোগুলো নারীর মধ্যে তিনজন নারী জানে চৈত্রিকা মিথ্যা নয় সত্যিই বলছে। চৈত্রিকা এতো সহজে হার মেনে অন্যের সাথে পালিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। চয়ন রেনওয়াজ চৈত্রিকাকে কিছু না বলে আজম আলীর দিকে তাকান। কড়া কন্ঠে বলেন,
‘আজম আলী! তোমার বউ আর ভাগ্নীকে নিয়ে এখান থেকে এক্ষুণি
বিদায় হও। আজ প্রথমবার বলে তোমার বউ আর ভাগ্নী ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। তোমরা নেহাৎই আমাদের আত্মীয় হয়ে গেছো নয়তো তোমাদের কি হাল করতে পারি এটা নিশ্চয় তোমার অাজানা নয়?’
আজম আলী ফাঁকা ঢোক গিলে৷ আমতা আমতা করে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘জ্বি জ্বি জমিদার সাহেব। আর এমনটা হবে না। সনিয়া, চৈত্রিকা বাড়ি চল!’
সনিয়া বেগম ঘাড় ফিরিয়ে আজম আলীর দিকে তাকিয়ে ঘৃ’ণ্য সুরে বলে, ‘আপনি এখনো এদের চা’মচা’মি করতেছেন! আপনার নিজের মেয়েকে এরা মে’রে ফেলবে তাও আপনি বুঝতেছেন না! অবশ্য আপনি আর মেয়ের মর্ম কি বুঝবেন! আপনি নিজেই তো পিতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। অ’মানুষদের সাথে থেকে থেকে নিজেও একটা অ’মানুষ তৈরী হয়েছেন।’
আজম আলী ছুটে এসে সনিয়া বেগমের হাত ধরে টানতে টানতে বলে, ‘আর একটাও কথা বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে সনিয়া! বাড়ি চলো তাড়াতাড়ি। আর এই মেয়ে তুই গেলে চল না গেলে এখানে পঁ’চে ম’র!’
চৈত্রিকা হাসে। বিড়বিড় করে বলে, ‘ম’রতে নয় মা’রতে আসছি মামা। আর আমি মে’রে তবেই এখান থেকে যাবো।’
মনের কথা মনে গিলেই হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে মুখে বলে, ‘আব্বাজান! আমি তো চলেই যাবো। তার আগে প্রমাণ করেন আমি যে আসলেই কোনো অ’ন্যায় করছি!’
নাসিমা বলে, ‘এরপরও তোমার প্রমাণ লাগবে? গ্রামবাসী তোমাদের ঢ’লা’ঢ’লি করতে দেখছে, একসাথে যায়তে দেখছে! এখন তো নিবিড়রেও পাওয়া যাচ্ছে না। এসবের থেকে আরো বড় প্রমাণ কি হতে পারে?’
‘অবশ্যই আরো বড় প্রমাণ হতে পারে নিবিড় ভাই নিজ মুখে বলুক আমি তার সাথে অ*বৈধ কোনো রকম বা’জে সম্পর্কে লি’প্ত আছি। আর আপনার গ্রামবাসীরা প্রমাণ হইলে আমার মামি আর নীরা বুবুও তো প্রমাণ আছে। নীরা বুবুকে বলেই গেছিলাম হসপিটাল যাচ্ছি আর মামি আমার সাথে হসপিটাল পর্যন্ত গেছিলোই তো! কি মামি কিছু বলো!’
সনিয়া বেগম চৈত্রিকার কথায় তাল মেলায়। সাদিক ক্ষে’পে উঠে বলে, ‘নিজের মামীরে সাক্ষী বানাইতেছো! তুমি যা শিখায় দিবা তাই তো তোমার মামি বলবে! এটা তো মিথ্যা কথা হইতেই পারে!’
‘পুরো গ্রামবাসী ছেড়ে যাদেরকে আপনি প্রমাণ বানাইছেন তারা যে আপনার শিখানো বুলি আওড়াচ্ছে না এটার গ্যারান্টি কি? যদি আমার মামী সাক্ষী না হইতে পারে তাইলে আপনার ওইসব কেনা প্রমাণও হবে না কাকা।’
চৈত্রিকার কথার প্যাচ ধরতে পেরে চয়ন, সাদিক, পিয়াস, নাসিমা রীতিমতো ফুঁসে ওঠে। কিন্তু সরাসরি চৈত্রিকাকে কিছু না বলে চয়ন গর্জন করে ওঠে আজম আলীর নামে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘একবার ভালো করে বলছি তোর বউ আর ভাগ্নীরে সরাইয়া নিয়া যা এখান থেকে! এরপর কিন্তু আর আমি তোদের সাথে ভালো ভাবে কথা বলবো না। একদম এই জমিদার বাড়ির মাটিতেই পু’তে দেবো।’
আজম আলী ভয়ে সনিয়া বেগমের হাত ধরে চৈত্রিকার হাত ধরে। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘বেঁচে থাকলে অনেক প্রমাণ পাবি তার আগে এখান থেকে চল!’
পেছন থেকে পল্লবী বলে, ‘আজম আলী আমার বাড়ির বউয়ের হাত ছাড়ো!’
চৈত্রিকা গম্ভীরতার মাঝেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। আজম আলী না পারে জমিদারের কথা শুনতে আর না পারে জমিদার গিন্নির কথার বাহিরে যেতে! ভীতু ভীতু দৃষ্টিতে পিছু তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বলে,
‘জমিদার গিন্নি এমন কথা বলবেন না। আমি এখন চৈত্রিকার হাত ছেড়ে দিলে জমিদার সাহেব আমার জান কে’ড়ে নেবে।’
‘হাতটা ছাড়েন মামা!’
পল্লবীর কথার আগেই চৈত্রিকা হাত ছাড়িয়ে নেয়। চৈত্রিকা কিছু বলতে নিলে সনিয়া বেগম থামিয়ে দেয়। আজম আলীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চৈত্রিকার সামনে দাঁড়ায়। চৈত্রিকার দু বাহুতে হাত রেখে বড় করে শ্বাস নেয়। শুকনো ঢোক গিলে বলে,
‘আমার সাথে বাড়ি চল চৈত্র!’
চৈত্রিকা চমকায়। সাথে চমকায় পল্লবী, শায়লা আর নীরা। পল্লবী ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘কি বলেন আপা! চৈত্রিকা কেনো যাবে!’
‘মনে করেন আমার মেয়েকে আমি মেহমান হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা যে ক’ল’ঙ্ক লেপ্টে দিচ্ছেন ওর গায়ে! এই ক’ল’ঙ্ক নিজেরা মুক্ত করে প্রহর বাবাকে নিয়ে তারপর আমার মেয়েকে নিয়ে আসবেন জমিদার গিন্নি।’
পল্লবী কি বলবে ভেবে পায় না। চৈত্রিকা কিছু বলতে গিয়েও বলে না। সনিয়া বেগমকে সে যথেষ্ট সম্মানের সাথে সাথে যথেষ্ট ভালোওবাসে। গত ১ বছর থেকে রক্তের সম্পর্ক না থাকাকালীনও এই মহিলাটি তাকে মায়ের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা দিয়েছে। তাকে বাঁচতে শিখিয়েছে সুন্দর ভাবে। তাই এই মানুষটির মুখের ওপর কথা সে বলতে চায় না। চুপচাপ সনিয়া বেগমের হাত আঁকড়ে ধরে বলে,
‘চলো মামী!’
সনিয়া বেগম হাসে। পল্লবী, শায়লা, নীরা, অর্পিতা, অর্থি, সাথী সবাই আহত হয়। চৈত্রিকা এভাবে হার মেনে চলে যাবে তা কারোরই চিন্তা ভাবনায় ছিলো না। বোকা অর্থি এসময় মনে কষ্ট পেলেও চৈত্রিকা বাাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এটা মানতে পারে না। কিন্তু নিজের বাবার মুখের ওপর কথা বলার অনুমতিও তার নেই। তাই চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়। মনে মনে শতবার আওড়ায়,
‘মাষ্টারমশাই আপনি কোথায়? আমাকে এভাবে স্বপ্ন দেখিয়ে হারিয়ে যাবেন না মাষ্টারমশাই! আপনি আসুন! এসে সবার মুখের ওপর বলে দিন আপনার আর বড় ভাবীজানের মধ্যে কিচ্ছু খারাপ নেই। আপনি আর বড় ভাবীজান একদম নির্দোষ! আসুন না মাষ্টারমশাই!’
অর্থির আফসোস হয়েই নিবিড় আসে না। অর্থি মুখে হাত চেপে সমানে কাঁদতে থাকে। অর্পিতা খেয়াল করে কোনোরকমে এগিয়ে আসে অর্থির কাছে। অর্থির কান্না দেখে ধরেই নেয় অর্থি তার বড় ভাবীজানের জন্য কাঁদছে। অর্পিতা হতাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার পানে। চৈত্রিকা সনিয়া বেগমের হাত ধরেই সদর দরজা পর্যন্ত যায়। তারপর পেছনে ফিরে বলে,
‘চলে যাচ্ছি মানে আমি হার মেনেছি বিষয়টা এমন না। চৈত্রিকা এতো সহজে হারতে শেখেনি তাও আবার কোনো অ’ন্যায় না করেই। আমি ফিরবো৷ সম্পূর্ণ রুপে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েই ফিরবো। এই তো কেবল দুটোদিন। তারপর প্রহর রেনওয়াজ তো ফিরবেই। আর প্রহর রেনওয়াজ ফিরলে এ বাড়িতে চৈত্রিকার ২য় আগমন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আম্মাজান! ২য় বারের মতো বউ বরণ করার জন্য না হয় আগেই প্রস্তুতি সেড়ে রাখুন!’
চৈত্রিকা উল্টো ঘুরে সদর দরজা পেরিয়ে যায়। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। চৈত্রিকা চোখ মুখ শক্ত করে রাখে। যত কদম এগোয় তত কদম মনে মনে একটাই প্রতিজ্ঞা এঁটে রাখে, ‘জমিদারের পা’পের ধ্বং’স।’
৮৬.
চৈত্রিকা চলে গেছে জমিদার বাড়ি থেকে ৪৮ ঘন্টা পেরিয়েছে। কিছু কিছু শ’য়’তা’ন আনন্দে মেতে উঠলেও বাকি সবার ভেতরটা তিতকুটে হয়ে আছে৷ চৈত্রিকার সাথে অজান্তেই এই বাড়ির ইট পাথর গুলোও জুড়ে গেছিলো। কাল থেকেই অর্থি কারণে অকারণে হুটহাট কেঁদে উঠছে। বোকা মেয়েটা অনেক সময় সবার সামনেই কেঁদে ওঠে। কেউই বোঝে না মেয়েটা কাঁদছে কার জন্য! নিজের ভাইয়ের জন্য নাকি শখের বড় ভাবীজানের জন্য! অবশ্য সবার কথা তো দুরেই থাকলো! মেয়েটা নিজেই তো জানে না কার জন্য সে কাঁদছে! শুধু জানে তার ভালো লাগছে না। ভেতরটা বি’ষাদে ভরে উঠেছে। নিজের ঘরে বিছানার ওপর বসে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে উঠছে অর্থি। ঘরে আপাতত সে ছাড়া কেউ নেই। পড়বে নাকি কান্না করবে এটাই বুঝতে পারছে না মূলত। নিজের সিদ্ধান্ত ধরতে না পেরে আরো জোড়ে জোড়ে কান্না জুড়ে দেয় অর্থি। সে সময় অর্পিতা ঘরে আসে। অর্থির যে পা’গলের মতো হুটহাট কেঁদে উঠার স্বভাব আছে তা বেশ ভালো মতোই জানে অর্পিতা। তাই দেখতে এসেছিলো অর্থি কি করছে! কিন্তু ঘরে এসে এমন পরিস্থিতি দেখে তার নিজেরই কেঁদে দিতে ইচ্ছা করলো। অর্থি অর্পিতাকে দেখে আরো বেশি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে। অর্পিতা কান চেপে ধরে অর্থির কাছে বসে। তারপর অর্থির মুখ চেপে ধরে বলে,
‘কাঁদছিস কেনো বাচ্চাদের মতো? কান্না বন্ধ কর আগে!’
অর্থি কান্না থামিয়ে দেয়। অর্পিতা মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই অর্থি আবার কেঁদে ফেলে। অর্পিতা দ্রুত মুখ চেপে ধরে দাতে দাঁত চেপে বলে, ‘এক থা’প্প’ড় দিবো! কি হয়ছে বলে তারপর কাঁদ!’
অর্থি কান্নার আওয়াজ কমিয়ে বলে, ‘জানি না তো কেনো কাঁদছি!’
অর্পিতা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারে না। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলে, ‘চিত্র ভাইকে বা বড় ভাবীজানকে মিস করছিস?’
অর্থি ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ায়। অর্পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘মন খারাপ করিস না। একটু বাদেই বড় ভাইজান চিত্র ভাইকে নিয়ে ফিরবে তারপর দেখবি বড় ভাবীজান কেও ভাইজান ফিরিয়ে আনবে।’
অর্থি এক মুহুর্তের জন্য খুশি হয়ে গেলেও মনের ভেতর একটা খুত খুত থেকেই যায়। যতক্ষণ না প্রহর নিজ মুখে বলছে চৈত্রিকা আর নিবিড়ের মাঝে কিচ্ছুটি নেই ততক্ষণ তার মনেও শান্তি নেই। আনমনেই অর্থি বলে বসে,
‘কিন্তু মাষ্টারমশাই! সে কোথায়?’
অর্পিতা ভ্রু কুঁচকে অর্থিকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে। তারপর সন্দেহের সুরে বলে, ‘ব্যাপার কি তোর? হঠাৎ নিবিড় ভাইয়ের খোঁজ করছিস কেনো? পড়ালেখায় তো তোর বরাবর ফাঁকিবাজি। কাহিনি টা কি? অন্যকিছুর গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়!’
অর্থি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে অর্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অন্যকিছু কি আপু?’
অর্পিতা কপাল চাপড়ায়। এর মাঝেই নিচ থেকে ডাক পড়ে। অর্পিতা আর অর্থি দুজনেই ছুটে আসে কি হয়েছেে তা দেখতে! হলরুমে প্রহর আর চিত্রকে দেখে অর্থি ছুটে গেলেও অর্পিতা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক গুলো দিন পর চিত্রকে দেখে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। সিড়ির রেলিং শক্ত করে ধরে তাকিয়ে থাকে চিত্রের দিকে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে, চুলগুলোও আগের চেয়ে বেশ বড় বড়, মুখের দাড়িও বড় হয়ে গেছে। চোখ গুলো একদম গর্তের মাঝে চলে গেছে। চিত্রর এমন করুণ অবস্থা দেখে বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে অর্পিতা। নিজের ওপর প্রবল রাগ হয়। কেনো সে সেদিন রাতে ওভাবে চিত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো! কেনো নিজের অভিমান কাটিয়ে চিত্রকে আপন করতে পারেনি তার অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়। অবশ্য এ অনুশোচনা গত দেড় মাস থেকেই বয়ে বেড়াচ্ছে সে। অর্পিতা যখন চিত্রকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত তখন দুর্বল চোখে চিত্রও তাকায়। চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় থমকায় দুজনই। দ্রুত চোখ সরিয়ে অর্পিতা নিচে নেমে আসে। অর্থি ততক্ষণে এসে চিত্রর কাছ ঘেষে বসে পড়ে। চিত্রের আরেক পাশেই পল্লবী বসে ছেলেকে আগলে রেখেছিলো। অর্থি ওভাবেই দুহাতে ভাইকে জাপ্টে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
‘তুমি কোথায় হারিয়ে গেছিলে ছোট ভাইজান! জানো আমি তোমার জন্য কত কেঁদেছি!’
চিত্র দুর্বল চিত্তে হাসে। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট্ট করে বলে, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে সোনা বোনু! আর হবে না এমনটা।’
‘পাক্কা? কথা দাও?’
চিত্র হেঁসে বলে, ‘পাক্কা। কথা দিলাম।’
অর্থি সন্তুষ্ট মনে হাসে। হল রুমের সোফায় বসে ছিলো চয়ন, সাদিক, শিমুল, পল্লবী, পিয়াস, চিত্র, প্রহর আর অর্থি। শায়লা, নাসিমা, নীরা, সাথী আর অর্পিতা একপাশে দাড়িয়ে আছে। পিয়াস দুভাইবোনের ভালোবাসা দেখে চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘এসব ঢঙ বাদ দিয়ে ঘরে যা দুজন।’
প্রহর আর চিত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তবে উত্তরটা চিত্র দেওয়ার আগেই প্রহর গম্ভীর স্বরে দেয়, ‘তোর যদি ওদের ভালোবাসা দেখতে ঢঙ মনে হয় তাহলে তুই চলে যা এখান থেকে।’
পিয়াস অপমানে মুখ ছোট করে নেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। প্রহর নিজের দৃষ্টি সরিয়ে দুজন মেইডকে ডেকে বলে, ‘চিত্রকে সাবধানে ঘরে নিয়ে যাবে আর ওর ঘরের দরজার সামনেই বসে থাকবে। আমি আর অর্থি ছাড়া যেনো ওই ঘরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে! কেউ না মানে কেউ না। যেই ওই ঘরে প্রবেশ করতে চাক তুমি তাকে সেই ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। মনে থাকবে? আমার কথার যেনো নড়চড় না হয়!’
প্রহরের কন্ঠের গাম্ভীরতা সবাই টের পেলো। মেইড দুজন মাথা নাড়িয়ে চিত্রকে ধরে তার ঘরে নিয়ে যায়। সাথে অর্থিও যায়। প্রহর জানে এরা বে’ই’মা’নি করবে না। এরা প্রহরকে হাড়ে হাড়ে চিনে। চিত্র আর অর্থি চোখের আড়াল হতেই প্রহর নড়েচড়ে বসে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রেখে কন্ঠের গাম্ভীর্যতা ধরে রেখেই শুধায়,
‘চৈত্রিকা কোথায়?’
প্রহরের এই সময় হঠাৎ এই প্রশ্ন চয়ন, সাদিক, নাসিমা, পিয়াস আশা না করলেও বাকিরা ঠিকই আশা করেছিলো। চয়নেরা ভেবেছিলো প্রহর এখনো ততটা জুড়ে যায়নি চৈত্রিকার সাথে। তাই সে এতো সহজেই তার কথা জিজ্ঞেসও করবে না তার পক্ষে কিছু বলবেও না। কিন্তু চয়ন রেনওয়াজ যে নিজের ছেলেকেই এখনো চিনতে পারেনি তা বোধহয় সে নিজেও জানে না। বাকি সবাই প্রহরের প্রশ্নে চুপ থাকলে উত্তরটা পল্লবীই দেয়,
‘মামার বাড়িতে আছে।’
‘কেনো? কি এমন হয়ছে যে চৈত্রিকা এই অসময়ে মামার বাড়িতে গেছে!’
পিয়াস ছ্যাত করে উঠে চট করে বলে, ‘বউয়ের এতো খোঁজ নেওয়ার কি আছে বড় ভাইজান? ন*ষ্টামি করেছে তাই আব্বাজান বড় ভাবীজানকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাছাড়া আপনি নিজেও তো অ’ন্যায় কে প্রশ্রয় দেন না।’
‘বড় ভাইজানের মুখের ওপর এতো বড় গলায় কথা বলার অধিকার তোকে কেউ দেয়নি। আর নিজের জবান ঠিক করে কথা বল! তুই প্রহর রেনওয়াজের বউকে নিয়ে কথা বলতেছিস তাই নিজের ভাষা সংযত রাখ।’
প্রহরের শান্ত গলার বাণীতে পিয়াস উপরে দমে গেলেও ভেতরে জ্বলে ওঠে। বাকিরা সবাই চঞ্চল হয়। প্রহর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে, ‘আমি বাড়িতে বা গ্রামে নেই মানে এই না যে কে কি করছে তার খোঁজ আমার কাছে থাকে না। তুই নিজে কি করে বেড়াচ্ছিস তাও আমি জানি। কখন, কোথায়, কি করছিস সব খবর থাকে আমার কাছে। চৈত্রিকার কথা সাইডে রাখ! তুই যে বিয়ে করেছিস এটা কার অনুমতিতে? ২য় বিয়ে করতে যে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি লাগে তা নিয়েছিলি? আব্বাজান তোকে বলেনি এটা? নীরা! পিয়াস অনুমতি নিয়েছিলো তোমার কাছে?’
নীরা মাথা নিচু করে দুদিকে মাথা নাড়ায়। পিয়াস কটমট করে ওঠে। প্রহর অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় আওড়ায়, ‘নিজের ন*ষ্টামি ঠিক করে তারপর তোর বড় ভাবীজানকে কিছু বলতে আসিস! আমি কিছু বলবো না। আর আব্বাজান! আপনাকে কে বলছে নিবিড় আর চৈত্রিকা ওই রাতে একসাথে ছিলো? আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন একবারও সবটা? চৈত্রিকা সেদিন আমার সাথেই হসপিটালে ছিলো। মেজো কাকা দেখেছে,জানে সবটাই। আমি আসার আগেই আমার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন! কেনো?’
‘তুমি কি এখন তোমার বউয়ের জন্য বাবার সাথে ঝামেলা করবে!’
‘আপনি চেনেন আমাকে ভালো করেই। আমি কোনো সম্পর্ক বুঝি না। আমি শুধু ন্যায় আর অ’ন্যায় বুঝি। আপনারা আমার চোখের সামনে বসে বসে একটা মেয়ের সাথে অ’ন্যায় করবেন আর ওটা আমি দু চোখ ভরে দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো! অতোটা কাপুরুষ এখনো প্রহর রেনওয়াজ হয়নি। আমি যে বউয়ের জন্য তর্ক করতে জানি না তা মহুয়ার সময় নিজ চোখেই দেখেছেন। আমি ন্যায়ের সাথে থাকতে জানি আর অ’ন্যায়ের শা’স্তি দিতে জানি। সে অন্যায় যেই করুক না কেনো!’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)