#চৈত্রিকা (৩৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________
৯১.
ঝড় বাদলের দিন। চারদিকে অন্ধকার হয়ে আছে। বাতাসে পুরো গ্রামকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। গোটা জমিদার বাড়ি খা খা করছে। কোথাও কোনো জনমানব নেই। নাসিমা ঘরের দরজা আটকে দরজার পাশ ঘেষেই বসে ফুপাচ্ছে। বাহির থেকে চৈত্রিকার আওয়াজ আসছে,
‘আর কতক্ষণ ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকবে মা? বের হয়ে আসো! তোমার সব পা’পের শা’স্তি তোমার কাছে আসার জন্য ছটফট করছে। তাড়াতাড়ি আসো মা!’
নাসিমা দুদিকে মাথা নাড়াতে থাকে বারংবার। কান্নারত গলায় বলে, ‘তুই এরকমটা করতে পারিস না চৈত্র। আমি তো তোর মা হই। তোকে জন্ম দিয়েছি! তুই আমাকে মা”রতে পারিস না। আমাকে ছেড়ে দে মা!’
চৈত্রিকা হেঁসে ওঠে। ফাঁকা বাড়িতে চৈত্রিকার হাসি ভুতুড়ে লাগে। গায়ের লোপকূপ দাঁড়িয়ে যায়। চৈত্রিকা তলোয়ার দিয়ে ঘরের দরজায় আ’ঘাত করে চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘হ্যাঁ তুমি তো সেই মা যে নিজের সন্তানকে অন্য পুরুষের জন্য মে’রে ফেলতে চাইছিলে! তুমি তো সেই নি’কৃষ্ট মহিলা যে প’র’কী’য়ায় পড়ে আমাদের নিঃস্ব করে দিতে চেয়েছিলে! তোমাকে এতো সহজে ছেড়ে দিলে আমার বাবা শান্তি পাবে না তো। তাই তোমার শা’স্তি তোমার পেতেই হবে।’
পর পর দু বার আঘাত করে দরজায়। তলোয়ারটা এতো বেশি ধারালো ছিলো যে দরজার এপাশ ওপাশ হয়ে যায়। কিছুটা জায়গা ভেঙে যায়। চৈত্রিকা সেই ফুটোতে চোখ রেখে অদ্ভুত কন্ঠে বলে,
‘মা! এবার কোথায় যাবে?’
নাসিমা পেছনে তাকিয়ে শুধুমাত্র চোখ দুটো দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। চৈত্রিকা হাসতে শুরু করে। মিনিট খানেকের মাঝেই কেমন করে যেনো দরজাটা খুলে যায়। নাসিমা চৈত্রিকার সামনে পড়ে বার বার মিনতি করতে থাকে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু চৈত্রিকা সে কান্নায় গলে না। তলোয়ার দিয়ে আ’ঘাত করে একদম বু’ক বরাবর। নাসিমার আ’ত্মা ছটফট করতে থাকে। মুখ দিয়ে র’ক্ত উঠে যায় তবুও চৈত্রিকা থামে না। পরপর আরো দু বার তলোয়ার চা’লিয়ে দেয়। বিকট শব্দে ক্রো’ধ নিয়ে বলে,
“তুমি মা নামের ক’লঙ্ক। তুমি আমার সুন্দর, গোছালো জীবনটা একদম এলোমেলো করে দিয়েছো। তোমার মৃ’ত্যুতে তোমার সকল পা’প, লো’ভ ধুয়ে মুছে ছাফ হয়ে যাবে।’
এ পর্যায়ে লাফিয়ে ওঠে নাসিমা। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বার বার বলতে থাকে ‘আমাকে মা’রিস না চৈত্র। আমি তোর মা হই। আমাকে মা’রিস না।’ ঘুমের ঘোর তখনও তার যায়নি। নাসিমার চিৎকারে সাদিকেরও ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে আগলে নেয় নাসিমাকে। দু বাহুতে হাত রেখে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে,
‘কি পাগলের প্রলাপ বকছো নাসিমা? কি হয়েছে? এমন করছো কেনো? নাসিমা!’
সাদিকের ধাক্কায় নাসিমা আরো জোড়ে কাঁদতে থাকে৷ সাদিকের হাতে আকড়ে ধরে বলে, ‘আমাকে বাঁচাও সাদিক! আমাকে বাঁচাও! চৈত্রিকা আমাকে মে’রে ফেলবে। দেখো ‘ও’ কেমনে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসছে!’
সাদিক নাসিমার কথার আগা মাথা বোঝে নাহ। কোনো রকম বলে, ‘কোথায় চৈত্রিকা? সামনে দেখো কেউ নাই।’
‘আরেহ ‘ও’ ওইখানে দাড়িয়ে… ‘
নাসিমা সামনে তাকিয়ে চুপ করে যায়৷ খানিকটা সময় নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সাদিক বুঝতে পারে নাসিমা স্বপ্ন দেখেছে। তাই নাসিমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘চৈত্রিকা তোমাকে মা’রবে কেনো নাসিমা? ‘ও’ তো তোমার মেয়ে। তুমি খা’রাপ স্বপ্ন দেখেছো! শান্ত হও। শুয়ে পড়ো! সকাল হওয়ার আরো অনেকটা বাকি।’
‘তুমি ওকে এখনো চেনো নি সাদিক? চৈত্র ওর বাবাকে যতটা ভালোবাসে আমাকেও ততটা বাসতো কিন্তু আমি যা করেছি তাতে ‘ও’ আমাকে প্রচন্ড ঘৃ’ণা করে। আগে ‘ও’ এমন ছিলো নাহ। কিন্তু এখন ওর কঠোরতার মাপ অনেক বেড়েছে। আমাকে ছাড়বে না ‘ও’।’
সাদিক সব কথা ঘুরিয়ে দেয়। নাসিমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শুইয়ে দেয়। নিজেও লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে৷ নাসিমা চোখ বন্ধ করতেই আযানের ধ্বনি কানে আসে। ভয়ে চোখ খুলে ফেলে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! তবে কি এই স্বপ্নটাও সত্যি হবে? ভয়ে, আতঙ্কে নাসিমা জড়োসড়ো হয়ে যায়। ভেতরে মৃ’ত্যু ভয় ঢুকে যায়।
৯২.
সকাল সকাল অর্থিকে পড়তে বসাতে নিয়ে পল্লবী পুরো বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে। অর্থিকে পড়তে বসতে বলায় সে ফাঁকি দিয়ে পুরো বাড়িতে চক্কর দিচ্ছে। কেউ বলবে এই মেয়ের আর দুদিন বাদেই মাধ্যমিক! পল্লবী অর্থির পেছনে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গেলেও অর্থি হাপায় না। সুন্দর করে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ ঘর, ও ঘরে চক্কর কাটতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ঢুকে পড়ে অনিমের ঘরে। অনিম তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে আর হিবিজিবি গান গাচ্ছে। অর্থি নিজেদের বাড়িতে হুট করেই অপরিচিত এমন কাউকে দেখে ‘চো’র’ বলে চিৎকার করে ওঠে। অর্থির চিৎকারে অনিমের হাত থেকে চিড়ুনি পড়ে যায়। অনিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ছুটে এসে অর্থির মুখ চেপে ধরে। অর্থি মুখ থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করতে করতে ওভাবেই অস্পষ্ট শব্দ করতে থাকে। অনিম ধমক লাগায়,
‘এই মেয়ে চুপ! এমন বো’বার মতো করতেছো কেন? ভালো ভাবে কথা বলতে পারো না?’
অর্থি ভ্রু কুঁচকে চুপ করে যায়। অনিম ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কি?’ অর্থি কোনো কথা না বলেই কা’মড় বসিয়ে দেয় অনিমের হাতে। অনিম হাত সরিয়ে নিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। অর্থি অনিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলে,
‘একে তো আমাদের বাড়িতে চু’রি করতে এসেছেন আবার আমাকে বো’বা বললেন! একদম বড় ভাইজানকে ডেকে এনে আপনাকে ছাঁদ থেকে ফে’লে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।’
অনিম ভ্রু কুঁচকে থাকে। অর্থির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এটা কে! আগে দেখেছে কি না! কিন্তু মনে পড়ে নাহ। তাই ঝাঁঝালো স্বরে বলে, “এই মেয়ে! এটা তোমাদের বাড়ি মানে কি? এটা আমার ছোট বোনের শ্বশুড়বাড়ি। আর আমাকে দেখতে কি চো’রের মতো লাগে? আমি ভদ্র বাড়ির পড়ালেখা জানা ছেলে। চো’র নই। বুঝছো!’
অর্থি ভেংচি কাটে। বিছানার ওপর পা তু্লে বসে বলে, ‘এটা আমাদের বাড়িই বুঝছেন! আপনার কোন বোনের শ্বশুড়বাড়ি এটা? বড় ভাবীজানেরও কোনো ভাই নাই, মেজো ভাবীজানদেরও তো কোনো ভাই নাই। তাহলে আপনি কোন ভাবীজানের ভাই? চু’রি করতে এসে মিথ্যা বলা হচ্ছে!’
‘চৈত্রিকার ভাই হই আমি।’
অর্থি সটান করে লাফিয়ে ওঠে। এক লাফে সরাসরি অনিমের সামনে দাড়িয়ে আঙুল তার দিকে করে বলে, ‘বড় ভাবীজানের ভাই আপনি? বড় ভাবীজানের ভাইও আছে!’
অনিম উত্তর দেয় না। অর্থি এক আঙুল দিয়ে অনিমের পেটে গুতো দিয়ে বলে, ‘পেট মোটা!’
বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকে। অনিম কটমট করে ওঠে। অর্থি মুখে হাত চেপে হাসে। অনিম ফের ধমক দেয়। অর্থি চমকে উঠে হাসি থামিয়ে দেয়। তারপর চোখ ছোট ছোট করে বলে,
‘আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেনো? আমি কিন্তু বড় ভাইজানকে বলে দিবো!’
এর মাঝেই অনিমের ঘরে চৈত্রিকা আসে। অর্থিকে এই ঘরে এই সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাকই হয়। অর্থির কাছে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে,
‘এই সময় তুমি এখানে! তোমাকে না আম্মাজান খুঁজছে অর্থি! পড়তে বসবা কখন?’
অর্থি এসে চৈত্রিকার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তারপর চোখ নামিয়ে অনিমের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘এটা আপনার ভাই হয় বড় ভাবীজান?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়ায়। অর্থি গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আপনার ভাই আমাকে বকা দিয়েছে। আপনি উনার কান মুলে দিন!’
অনিম হা করে তাকায়। ফোঁস করে উঠে বলে, ‘এই মেয়ে! তুমি যে আমাকে চো’র বললে তার বেলায়!’
‘তো দেখতে পেট মোটা চো’রের মতো হলে চো’র বলবো না?’
অবস্থা বেগতিক দেখে চৈত্রিকা দুজনকেই থামিয়ে দেয়। তারপর অর্থিকে বলে, ‘আচ্ছা আমি ভাইয়াকে বকে দিবো। তুমি যাও পড়তে বসো! আম্মাজান কিন্তু খুজতেছে তোমাকে। সামনে তোমার মাধ্যমিক না!’
‘ভালো লাগে না পড়তে। এরওপর মাষ্টারমশাইটাও নেই। উনি না থাকলে আমার আরো পড়তে ইচ্ছে করে না বড় ভাবীজান।’
অর্থি মন খারাপ করে বিছানার ওপর বসে। চৈত্রিকা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে নিজের ঘরে পাঠায়। অর্থি চলে যেতেই অনিম তেড়ে এসে বলে, ‘এটা তোর ননদ নাকি অন্যকিছু! ছিঃ ছিঃ। আমার জমিদারের মেয়ে জামাই হওয়ার শখ মিটে গেছে। আমাকে কি না চো’র বলে! শেষ মেশ চো’র!’
চৈত্রিকা হাসতে হাসতে বলে, ‘এতো তাড়াতাড়ি শখ মিটে গেলে হবে অনিম ভাই? জমিদারের মেয়ে জামাই হতে হবে তো নাকি!’
অনিম ভেংচি কাটে। হুট করেই কালকের কথা মনে পড়াতে চেপে ধরে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বাহিরটা একবার দেখে আসে। চৈত্রিকা হঠাৎ অনিমের এমন ব্যবহার ধরতে পারে নাহ। বুঝতেও পারে নাহ৷ অনিম দ্রুত চৈত্রিকার কাছে এসে বলে,
‘তোদের মা মেয়ের কাহিনি বল জলদি! কাল থেকে আমার পেট গুড়গুড় করতেছে সব কিছু শোনার জন্য। এখন বল তাড়াতাড়ি!’
‘এখন!’
‘হ্যাঁ। এখনই। তুই এখনই বলবি আমাকে সব! এখন মানে এখন।’
চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস নেয়। তারপর বলে, ‘কি কি জানতে চাও?’
‘ওটা কি সত্যিই মামী ছিলো? মামীই যদি হয় তাহলে বেঁচে আছে কেমন করে? সবাই তো জানতো মামা, মামী সবাই মা’রা গেছে! তোর এতো পরিবর্তন কেনো? কেমন করে? কিসের জন্য? তুই আমাদের না জানিয়েই বিয়ে করে নিলি কেনো?’
‘ওটা মা-ই৷ মায়ের সেদিন কিছুই হয়নি। যেদিন বাবা আগুনে পু’ড়ে মা’রা যায় ওইদিন বাড়িতে আরো অনেক কিছু হয়েছিলো। বাবা সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে সবাই ভেবে নিয়েছিলো কোনো শ’ত্রুপক্ষ আমাদের বাড়িতে আ’গুন লাগিয়ে দিয়েছে কিন্তু সেদিন এমন কিছুই হয়নি। মাধ্যমিক শেষ হয়ে যাওয়ায় কোনো কাজ ছিলো না আমার। সারাদিন বাড়িতে বসে বসে কাটাতাম। সেদিন যখন আমি ঘরে বসে বই পড়ছিলাম তখন বাড়িতে কেউ আসে। আমি সাধারণ ভেবে ঘর থেকে বের হইনি। একটু পরই হুট করে চেঁচামেচির, ভাঙচুরের আওয়াজ পাই। কিন্তু ঘর থেকে বের হতে নিলে আর বের হতে পারি নাহ। বাহির থেকে দরজা আটকে দেওয়া। বাহিরে কি হচ্ছিলো কিচ্ছু বুঝতে পারতেছিলাম না। হুট করেই বাবার আর্তনাদ পাই। আমি অস্থির হয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। এক পর্যায়ে বাড়িতে আগুন লেগে যায়। আগুনের ধোঁয়ায় আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বাড়িতে যখন পুরোপুরি আগুন লাগেইনি তখন বাবা ঘরের দরজা খুলে দেয়। বাবার পুরো শরীর র’ক্তে মাখা।’
চৈত্রিকা আর কিছু বলতে পারে না। গলা ভার হয়ে আসে। অনিম বুঝতে পেরে পানি এগিয়ে দেয়। চৈত্রিকা পানি না খেয়েই নিজেকে শক্ত করে। বাবার র’ক্ত মাখানো শরীরটা এখনো চোখে ভাসে। সেই দৃশ্যের মতো ভ’য়ং’কর কিছু বোধহয় পৃথিবীতে আর একটিও নেই। চৈত্রিকা বড় করে শ্বাস নেয়। অনিম জিজ্ঞেস করে,
‘তুই বের হলি কেমন করে? আর মামী?’
‘বাবার ওই অবস্থা দেখে আমার মাথা ঘুরিয়ে যায়। বাবাকে ধরতে গেলে বাবার প্রথম কথা ছিলো ‘পালিয়ে যা চৈত্র।’ আমি যেতে চাইনি। কিন্তু মৃ’ত্যু মুখী বাবা জোড় করে আমার ঘরের জানালা দিয়ে আমাকে বের করে দিলেন। আর তিনি পড়ে রইলেন সেখানে। আগুন ঝ’লসে দিয়ে যায় আমার বাবাকে। পুরো সময়টাতে আমি মা’কে কোথাও পাইনি৷ আর এখানে আসার পর মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। বিয়েটা দরকার ছিলো বলেই করেছি অনিম ভাই।’
অনিম সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকায়। বলে, ‘সব সত্যি বলছিস নাকি কিছু লুকোচ্ছিস?’
‘কি লুকাবো অনিম ভাই? যা সত্য ছিলো সবই তোমাকে বললাম। এর বেশি কিছুই হয়নি।’
অনিম মেনে নেয়। তারপর নিজে থেকেই কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা শুরু করে। চৈত্রিকা অনিমের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ায়,
‘তোমাকে চাইলেও সব সত্য বলা সম্ভব না অনিম ভাই। যতটুকু তোমার জানার দরকার তুমি ততটুকু জেনেই খুশি থাকো। যতটুকু গোপন আছে ততটুকু আমি গোপন রেখেই না হয় এগোবো!’
দু ভাই বোন স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতে শুরু করে। দুজনের কেউই জানে না তাদের কথাগুলো শুধু তারা একা নয় তৃতীয় আরেকজনও শুনেছে। চৈত্রিকার পুরো ঘটনার বিবরণ শুনে তার ভ্রু কুঁচকেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘চৈত্রিকা যদি কিছু না-ই দেখে থাকে তবে প্রতি’শো’ধের নেশা কেনো? আদৌও কি সত্যি চৈত্রিকা কিছু দেখেনি নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পা রেখেছে এ বাড়িতে!’
৯৩.
বিকেলে চৈত্রিকা নিজের ঘরে বসে বসে আকাশ দেখছিলো। বাহিরে আজ রোদ আছে। সূর্য তীক্ষ্ণ আলো দিচ্ছে। আকাশ একদম পরিষ্কার। চৈত্রিকা আনমনে সেদিকে তাকিয়েই বসে ছিলো। প্রহর ঘরে এসে চৈত্রিকাকে এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে বলে,
‘চোখে তাপ লাগছে না? ওভাবে আকাশের দিকে চেয়ে আছো কেনো?’
চৈত্রিকা চোখ ফিরিয়ে নেয়। টুপ করে চোখ থেকে পানি পড়ে। দ্রুত চোখ মুছে প্রহরের দিকে তাকায়। প্রহর উদোম বুকে ধপাস করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। চৈত্রিকা লাফিয়ে সরে বসে। ব্যস্ত গলায় বলে,
‘এই এই উঠুন! বাহিরে থেকে এসে হাত মুখ না ধুয়েই শুয়ে পড়ছেন কেনো? জলদি উঠুন!’
প্রহর শুয়ে থাকা অবস্থাতেই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চৈত্রিকার কথা পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। চৈত্রিকা ফুঁসে ওঠে। ফের বলে, ‘একদম ত্যাড়ামো করবেন না জমিদার সাহেব। জলদি গিয়ে আগে হাত মুখ ধুয়ে আসেন!’
প্রহর ফোঁস করে শ্বাস করে। তারপর বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে। কোনো কথা ছাড়াই গোসলখানায় চলে যায়। চৈত্রিকা চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘বুঝি না কিছু! জমিদার সাহেব নিজে তো কোনো কাজ করে না তাহলে এমন ঘেমে আসে কোন মহাকার্য করে!’
প্রহর হাত মুখে ধুয়ে এলে চৈত্রিকা তোয়ালে এগিয়ে দেয়। প্রহর কোনো রকমে হাত মুখ মুছেই শুয়ে পড়ে। চৈত্রিকা ছোট করে জিজ্ঞেস করে,
‘আজ এমন হুটহাট শুয়ে পড়ছেন কেনো? কি হয়েছে?’
‘ক্লান্ত লাগছে। একটু এদিকে আসো তো!’
প্রহরের অলস গলা। চৈত্রিকা কোনো কথা ছাড়াই এগিয়ে যায়। বিছানায় বসলে প্রহর মাথা গুজে দেয় চৈত্রিকার কোলে। তারপর এক হাত প্রহরের মাথায় রেখে বলে, ‘হাত বুলিয়ে দাও!’
চৈত্রিকা ফ্রিজড হয়ে বসে থাকে। প্রহর ক্লান্ত ভেবে আর কিছু বলে না। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে প্রহরের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। প্রহর মাথা গুজে দেওয়া অবস্থাতেই বলে,
‘সূর্যের আলো তোমার মুখের ওপর পড়লে তোমাকে আরো বেশি মায়াবী লাগে চৈত্র।’
চৈত্রিকা চমকে প্রহরের দিকে তাকায়। প্রহর তখনো চোখ বন্ধ করেই আছে। চৈত্রিকা আড়চোখে সূর্যের দিকে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রহরের চুল ধরে টান দেয়। প্রহর আচমকা ব্যাথা পাওয়ায় প্রথমে চোখ মুখ কুচকালেও পরে আর কিছু বলে না। উল্টো চৈত্রিকাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ উদরে গুজে রাখে। চৈত্রিকা মনে মনে বকা দেয় প্রহরকে। তারপর প্রহরের চুল নিয়ে খেলতে থাকে। দুজনে অল্পসময়েই একে অপরের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। একে অপরে বুঝতেই পারে না তারা নিজেদের কি ভীষণ কাছে চলে এসেছে!
চলবে..