#চৈত্রিকা (৪২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
১৩.
দিনকাল ভীষণ রকমের খারাপ যাচ্ছে অর্থির। কখনো মন খারাপ তো আবার কখনো শরীর ভীষণ খারাপ। চিত্রর বিয়ে শেষ হয়েছে প্রায় ১৫ দিন আগে। বউভাতের শেষে সেই যে নিবিড়কে দেখেছে তারপর আর ১৫ দিনে নিবিড়ের ছায়াটাও দেখা হয়নি। নিবিড়কে দেখার জন্য দিন দিন অস্থির হয়ে যাচ্ছে অর্থি। অথচ আশ পাশ হাতড়েও নিবিড়ের দেখা পাচ্ছে নাহ। তার মাষ্টারমশাই কি এতোই অবুঝ! সে কি বুঝতেছে না ছোট্ট অর্থির মনের অবস্থা! মানুষটা কি এতোই পা’ষাণ হয়ে গেছে! নিবিড়ের কথা ভাবতেই ভেতরটা বিষাদে ভরে উঠে। জানালার কাছ থেকে সরে এসে বিছানার ওপর পা তুলে বসে৷ কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে বসে থেকেও ভালো লাগে নাহ। কোনো কিছু না ভেবেই ঘর থেকে বের হয়। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখে পল্লবী কাজ করছে। অর্থি ভয়ে ভয়ে নিচু স্বরে ডাকে, ‘আম্মাজান!’
পল্লবী কাজ ছেড়ে তাকায় নিজের মেয়ের দিকে। মেয়ের পাংশুটে মুখ দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। নিজেও নরম স্বরে বলে, ‘কি হয়ছে আম্মা? কিছু বলবা?’
অর্থি মাথা নত করে বলে, ‘অনেক দিন থেকে তো বাহিরে যাই নাহ। আজ একটু যাই আম্মা? হিমানীদের বাড়ি পর্যন্তই যাবো। যাই?’
পল্লবীর মায়া হয়। এগিয়ে এসে মেয়ের কপালের একাংশে চুমু খেয়ে চুল কানের পিঠে গুজে দেয়। ছোট্ট করে বলে, ‘যাও! তাড়াতাড়ি আইসো আম্মা!’
অর্থি মাথা নেড়ে হাসে। নিজেও মায়ের গালে চুমু খেয়ে দৌড় লাগায়। পল্লবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অর্থি বাড়ি থেকে বের হয়ে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে নেয়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁটতে থাকে হিমানীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিবিড়দের বাড়ি পেড়িয়েই হিমানীদের বাড়ি যেতে হয়। অর্থি কি মনে করে উঁকি দেয় বাড়ির মধ্যে৷ পুরো বাড়ি শুনশান দেখে খানিকটা অবাকই হয়। একটা ঘরের দরজা বাদে প্রায় সবগুলো ঘরের দরজা-ই বন্ধ। অর্থি বাড়ির মধ্যে ঢুকে দাঁড়াতেই গোঙানোর শব্দ আসে। অর্থি অবাক হয়। কেউ কি অসুস্থ! অর্থি সাহস নিয়ে উঁকি দেয় ঘরের ভেতর। সেখানে নিবিড়কে শুয়ে গোঙাতে দেখে চমকে ওঠে। কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে নিবিড়ের কাছে যায়। ব্যস্ত স্বরে বলে,
‘কি হয়েছে মাষ্টারমশাই? এমন করছেন কেনো?’
জ্বরের ঘোরে অর্থির কন্ঠ শুনে তড়িঘড়ি করে চোখ মেলে তাকায় নিবিড়। চোখ পিটপিট করে অর্থিকে দেখে। জ্বরে চোখ ঝাপসা হয়। কোনো রকমে চোখ ডলে ভালো করে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি এখানে!’
‘আপনার কি হয়েছে আগে এটা বলুন! এমন লাগে কেন আপনার চোখ মুখ!’
নিবিড় রয়ে সয়ে বললো, ‘জ্বর আসছে।’
অর্থি সাথে সাথেই নিবিড়ের কপালে হাত দেয়। জ্বরের পরিমাণ দেখে ভীষণ রকমের ভয় পায়। অর্থি তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলে নিবিড় হাত টেনে ধরে। কোনো রকমে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘পানি আনি। আপনার মাথায় পানি ঢাললে জ্বর কমবে।’
‘লাগবে নাহ। তুমি বাড়ি চলে যাও!’
অর্থি অবাক হয়ে বলে, ‘কেনো?’
নিবিড় সঠিক জবাব না দিয়ে বলে, ‘যায়তে বলছি যাও!’
অর্থি শোনে নাহ। নাক মুখ কুঁচকে নিবিড়ের হাত শক্ত করে ধরে বলে, ‘আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকেন! চাচা, চাচি কই গেছে? তাদের দেখি না কেন!’
‘আম্মা নানী বাড়ি গেছে আর আব্বা দোকানে গেছে।’
‘আচ্ছা আপনি ছাড়েন আমি পানি নিয়া আসি!’
নিবিড় আরো শক্ত করে চেপে ধরে অর্থির হাত। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘তুমি আমার কথা বুঝো না কেন? চলে যায়তে বলছি কিন্তু আমি!’
অর্থি পাত্তা দিলো নাহ। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছু না বলে বালতিতে করে অল্প খানিক পানি টেনে আনে। নিবিড়ের বার বার মানা করা স্বত্বেও কোনো রকম কথা কানে না নিয়ে অর্থি নিবিড়কে টেনে মাথায় পানি দেয়। বেশ অনেকটা সময় মাথায় পানি দেওয়ার পর বালতি সরিয়ে নিবিড়ের মাথা মুছিয়ে দেয়। তারপর সেই তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়েই নিবিড়কে জলপট্টি দেয়। নিবিড় চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘তুমি জিদ করতেছো কেন অর্থি? এভাবে আমার ঘরে কেউ তোমাকে দেখলে ভালো ভাবে নিবে নাহ।’
‘না নিলে না নিক! চুপচাপ শুয়ে থাকেন আপনি।’
নিবিড় ছটফট করতে থাকে। অর্থিকে এই সময়ে ভুল করেও কেউ তার ঘরে দেখলে সেইটা যে ভালো হবে না এটুকু সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেও বোকা অর্থি বুঝতে পারছে নাহ। বেশ অনেকটা সময় জলপট্টি দেওয়ার পর নিবিড়ের জ্বরটা একটু হালকা হয়। নিবিড় জ্বরের ঘোরে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। অর্থি দু বার ডাকলেও নিবিড় জবাব দেয় নাহ। বোকা অর্থি ভেবে নেয় নিবিড় ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আলগোছে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই নিজের ঠোঁট ছুইয়ে দেয় মাষ্টারমশাইয়ের কপালে। নিবিড় কেঁপে ওঠে। সাথে সাথেই বাহির থেকে দুজন লোক হৈ হৈ করে ওঠে। হুট করেই চেচামেচি আর হট্টগোলের শব্দে অর্থি আর নিবিড় চমকায়। চোখের পলকেই ঘটে যায় একের পর এক কান্ড।
১৪.
নিবিড় আর অর্থির কথা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গেছে। যে দুজন লোক নিবিড় আর অর্থিকে একা ঘরে দেখেছিলো তারা যা তা বানিয়ে বানিয়ে বলে বদনাম রটাচ্ছে। জমিদার বাড়ির আঙিনায় সালিশ বসানো হয়েছে। সেখানেই আপাতত সবাই উপস্থিত। অর্থি একপাশে জড়োসড়ো হয়ে কান্না করছে। পাশেই পল্লবী, নাসিমা, শায়লা, নীরা, অর্পিতা, চৈত্রিকা দাঁড়িয়ে আছে। চয়ন, শিমুল, সাদিক, প্রহর, চিত্র সবাই বসে আছে। সামনেই অপরাধী ভঙ্গিতে নিবিড় আর নিবিড়ের বাবা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের আরো বেশ কিছু লোকজন উপস্থিত আছে। দুরে দুরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা সবটাই দেখছে। চয়ন গম্ভীর স্বরে নিবিড়কে বলে,
‘অর্থি তোমাদের বাড়িতে গেছিলো কেনো?’
নিবিড় কি বলবে বুঝতে পারে নাহ। গ্রামের একজন মুরব্বি ঠেস মে’রে বলে, ‘জমিদার সাহেব এই পেশ্নটা নিবিড় বাপজান রে না কইরা নিজের মাইয়ারে করেন তো! হেই কিল্লাইগা একলা একা মাইয়া হইয়া অবিয়াইত্তা পোলাডার ঘরে গেসে! এর উপর নাহি আরো কি আহাম কুহাম করছে! তা আপনের তো নিজের মুখ লুকাইয়া রাহান উচিত।’
চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। গলা ফাটিয়ে ডেকে ওঠে অর্থিকে। অর্থি লাাফিয়ে ওঠে ভয়ে। কান্নার দমক বেড়ে যায়। পল্লবী শক্ত করে মেয়ের হাত চেপে ধরে। অর্থি ভয়ে নিজের মা’কে আঁকড়ে ধরতেই চয়ন বলে,
‘অর্থি এখানে আসো!’
অর্থি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝায়। চয়ন রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই পল্লবী মেয়ের হাত টেনে সামনে এগিয়ে আসে। অর্থির কান্না তখনো বন্ধ হয়নি। বার বার কেমন কেঁপে উঠছে! নিবিড় জ্বর নিয়েও কোনো রকমে নিজের ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেও অর্থির কান্না দেখে নিজের ভারসাম্য হারাতে থাকে। বোকা মেয়েটার এভাবে কান্না যে তার সহ্য হয় না মেয়েটা বোঝে না কেনো! ঝাপসা চোখে অর্থির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চয়ন অর্থির দিকে তাকিয়ে কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘গ্রামের মানুষ যা রটাচ্ছে এসব কি সত্য? তোমার আর নিবিড়ের মধ্যে কোনো রকম প্রণয় ঘটিত সম্পর্ক আছে? হ্যাঁ অথবা না তে জবাব দিবে!’
অর্থি কাঁদতে কাঁদতেই দুদিকে মাথা নাড়ায়। এর মাঝেই একজন বলে ওঠে, ‘মিছা কথা কইতেছে! আমরা নিজের চোক্ষে দেখছি ওরায় এক ঘরে! ছিঃ ছিঃ আমার কইতেই শরম করতাছে।’
নিবিড় প্রতিবাদ করে। কড়া কন্ঠে বলে, ‘মিথ্যা কথা বলতেছেন কেন? ও আর আমি কি এমন করছি যে আপনার লজ্জা লাগতেছে বলতে! আমাদের মাঝে তেমন কিছুই হয়নি। আমার আব্বা, আম্মা বাড়িতে ছিলো নাহ কিন্তু জ্বরে আমার অবস্থা খারাপ দেখে অর্থি আমার মাথায় পানি দিয়ে জলপট্টি দিয়েছে। আপনারা সব না দেখে না জেনেই অযথা দোষ দিচ্ছেন কেনো?’
নিবিড়ের বাবা নয়ন আহমেদ ছেলেকে ধমক দেন। নিচু স্বরে বলে, ‘চুপ কর নিবিড়!’
‘চুপ কেনো করবো আব্বা? উনারা অযথা ওই ছোট্ট মেয়েটার ওপর দোষ কেনো চাপাচ্ছে?’
এর মাঝেই ঠা’স করে শব্দ হয়। নিবিড় চমকে তাকিয়ে দেখে চয়ন অর্থিকে থা’প্পড় দিয়েছে। অর্থি ভয়ে জোড়ে কান্না করে ফেলে। চৈত্রিকা ছুটে আসে নিজ জায়গা থেকে। অর্থিকে জড়িয়ে ধরে। চয়ন রেগে চিল্লিয়ে বলে,
‘বেশি বড় হয়ে গেছো? জমিদারের মেয়ে হওয়া স্বত্বেও তোমাকে এসব করতে কে বলছে?’
প্রহর এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খোলে। গম্ভীর স্বরে বলে, ‘আব্বাজান ‘ও’ ছোট মানুষ। ওকে অযথা মা’রতেছেন কেন? আর কে কি বললো তা ধরতেছেনই কেন?’
চয়ন কিছু বলার আগেই আগের মুরুব্বিটা রাগী কন্ঠে বললেন, ‘মানতাছি আপনেরা জমিদার বংশের তাই বইলা কি নিয়ম মানতেন না? আপনাগো বাড়ির মাইয়া আর ওই পোলায় যখন এক লগে ধ*রা পড়ছে তহন ওগো বিয়া পড়ায় দেন!’
অর্থি আর নিবিড় দুজনেই চমকায়। চৈত্রিকা প্রহরের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ মানুষটা অর্থিকে নিয়ে ভীষণ সেনসিটিভ। সেখানে এতো কিছু কি হজম করে নিবে নাকি কথা বাড়াবে বুঝে আসলো নাহ। নিবিড় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। চয়ন গম্ভীর স্বরে বলে,
‘আমার মেয়ের জীবন আমি ঠিক করবো ওর কার সাথে বিয়ে দেবো না দেবো! জমিদার বংশের মেয়ে হয়ে কখনোই একটা নিম্নবিত্ত পরিবারে আমি আমার মেয়ে দেবো নাহ। আর এই দুই লোক তোমার ঠিক করা তাই না নিবিড়! আমার মেয়েকে তুমিই উ’স্কিয়ে, ভুলভাল বুঝিয়েছো!’
নিবিড় চমকায়িত কন্ঠে বলে, ‘আমি ওকে উ’স্কাবো কেনো?’
‘এখন কিছু বুঝতেছো না তাই নাহ!’
চয়ন মুহুর্তেই দুজন মেইডকে ডাকে। তারা এসে চা’বুক দিয়ে যায় চয়নের হাতে। পুরো গ্রামবাসী হৈ হৈ করে ওঠে। চিত্র আর প্রহরও নিজ জায়গা ছেড়ে ওঠে। প্রহর ব্যস্ত গলায় বলে,
‘কি করছেন আব্বাজান! এগুলো কিন্তু অনুচিত। এখানে কথা বলার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছে আর আপনি এটা কি করছেন!’
‘আমার মেয়ের জন্য যা ভালো হয় আমি তাই করছি। তোমরা চুপ করে থাকো!’
নয়ন আহমেদ রীতিমতো চয়নের পায়ে পড়ে যায়। ছেলের জান ভিক্ষা চেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। নিবিড় দ্রুত নিজের বাবার হাত চেপে ধরে। হাটু মুড়িয়ে নিচে বসে নিজের বাবাকে বলে, ‘কারোর সামনে নত হওয়ার দরকার নেই আব্বা। আমি জানি আমি কিছু করিনি।’
সাথে সাথেই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিবিড়ের গায়ে চা’বুক ছুড়ে মা’রে চয়ন। নিবিড় ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে থাকে। অর্থি চৈত্রিকার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে আসে। নিবিড়কে আগলে বসেই কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আব্বাজান মাষ্টারমশাইয়ের কোনো দোষ নাই। উনারে ছাইড়া দেন আব্বাজান! উনি কিছু করে নাই। উনার শরীর ভালো না। উনারে এভাবে মা’রলে উনি ম’রে যাবে!’
চয়ন পল্লবীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ওরে এক্ষুনি সরাও!’
পল্লবী, শায়লা, নাসিমা মিলে অর্থিকে সরাতে নেয়। অর্থি বার বার কান্না করতে করতে নিবিড়কে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। তাতে চয়ন বিশেষ পাত্তা না দিলেও নিবিড় ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার জন্য অর্থির এই অস্থিরতা তার মনে শান্তি এনে দেয়। অর্থি চোখের আড়াল হতেই চৈত্রিকা এগিয়ে আসে। সরাসরি প্রহরকে বলে,
‘আপনি কিছু বলবেন নাকি আমি বলবো?’
প্রহর হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়। যেনো চৈত্রিকাকেই বলার অনুমতি দিলো। চৈত্রিকার কথায় চয়ন তার দিকে তাকায়। চৈত্রিকা কোনো কথা ছাড়াই আগে চয়নের হাতের চা’বুক টেনে ধরে। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘উনাকে মা’রছেন কেনো? উনি কি করছে? গ্রামের কোন দুইজন কি দেখছে এতে যদি নিজের মেয়ের জন্য বিশেষ গুরুত্ব না দেন তাহলে নিবিড় ভাইয়ের বেলা গুরুত্ব দিচ্ছেন কেনো? আপনি জমিদার আর সে গ্রামের একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বলে!’
চয়ন ফুঁসে উঠে বলে, ‘বাড়ির বউ বাড়ির বউয়ের মতো থাকো! আমার কাজে বাধা দিলে এটা তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে নাহ। চা’বুক ছাড়ো!’
চৈত্রিকা উত্তর দেওয়ার আগেই গ্রামের লোকজন হৈ চৈ শুরু করে। কয়েকজন মুরুব্বি বিতর্ক করতে থাকে। চয়নকে সরাসরি বলে, ‘বড় বউ তো হক কতা-ই কয়ছে! আপনে তো নিবিড়রে মা’রতো পারেন না জমিদার সাহেব। আর সব থেইকা বড় কথা হইলো আপনি নিবিড়রে মা’রেন, কা’টেন যাই করেন না ক্যারে! আপনার মাইয়ার বিয়া এই নিবিড়ের লগেই দেওন লাগবো। দু’র্নাম কিন্তু আপনার মাইয়ারই হয়ছে। মনে রাইখেন পোলা মাইনষের দু’র্নাম হয়ও না থাহেও নাহ। তাই আগে ভাগেই নিজের মাইয়ার বিয়াডা আগে দিয়া দেন! আর নাইলে আমরা আপনের ওই ক’লঙ্কিনি মাইয়ারে এই গেরামে থাকতো দিমু না। চুন, কালি মাখাইয়া গেরাম ছাড়া করুম।’
চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। কিন্তু সকলের একই কথার পিঠে দমে যায়। চৈত্রিকা প্রহরের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলে, ‘বিয়েটা হলে কি খুব ক্ষ’তি হবে জমিদার সাহেব? নিবিড় ভাইজান আর অর্থি কিন্তু একে অপরকে ভালোবাসে। যা-ই করবেন একটু ভেবে কইরেন!’
প্রহর ভেতরে ভেতরে চমকালেও বাহিরে প্রকাশ করে নাহ। চয়ন, সাদিক আর গ্রামবাসীর মধ্যে একটা ঝামেলা বাধতে খুব একটা দেড়ি হয় না। প্রহর সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘আমার বোনরে নিয়ে একটাও বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছি’ড়ে নিবো। এতক্ষণ যাবত চুপচাপ সব দেখছি মানে কি প্রহর রেনওয়াজের সম্পর্কে সব ভুলে গেছেন! আপনারা চাইছেন নিবিড় আর অর্থির বিয়েটা যেনো দিয়ে দেই! ঠিক আছে। তাই হবে।’
চয়ন হুং’কার ছেড়ে বলে, ‘তুমি কি পা’গল হয়ে গেছো? কি যা তা বলতেছো?’
‘যা তা বলছি নাহ। আপনি নিজেই পরিস্থিতিটা আরো বিগড়ে দিয়েছেন আব্বাজান। আগে যা-ও কথা বলে সব সমাধান করা যেতো আপনি নিবিড়কে আ’ঘাত করে সেই পথও বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই আপনি চুপ থাকুন। আমি আমার বোনের খা’রাপ চাইবো নাহ। অন্তত নিজের স্বা’র্থের জন্য ওকে ব্যবহারও করবো নাহ। নিবিড় ভালো ছেলে। পড়ালেখা জানা ছেলে। তাছাড়া আমাদের অর্থিও যথেষ্ট পছন্দ করে ওকে। তাই বিয়েটাতে কোনো সমস্যা নেই।’
চয়ন এক পার্ট চেচামেচি করে রেগে চলে যায়। প্রহর সবার সাথে কথা বলে শান্তমতো। কিন্তু সবার একটাই কথা বিয়ে এক্ষুণি দিতে হবে নয়তো এক্ষুণি গ্রাম ছাড়তে হবে। প্রহর ঝামেলা বাড়ায় নাহ। নয়ন আহমেদের থেকে অনুমতি নিয়েই মসজিদের ঈমাম ডাকায়। ওই আঙিনায় বসেই কয়েক মিনিটের মাঝেই নিবিড় আর অর্থি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। কি থেকে কি হয়ে গেলো তা যেনো দুজনেরই মাথার ওপর দিয়ে যায়। বুঝতেই পারে না কিছু। দুজনেই ভাষাহীন। ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ হতেই যে যার মতো চলে যায়। প্রহর গম্ভীর ভাবে নিবিড়কে বলে,
‘তোমার ভরসায় নিজের বোনকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। এমন কিছু করবে না যাতে আমার বোনকে কখনো কাঁদতে হয়! তাহলে যেভাবে তোমার ভালোবাসা পেলে ওভাবেই আমি কেড়ে নিতে দুবারও ভাববো নাহ। আপাতত বাড়ির ভেতর চলো! আযান দিয়ে দিবে এখনই।’
সবাই ধীরে ধীরে বাড়িতে প্রবেশ করে। চৈত্রিকা আশে পাশে কোথাও সাথীকে না দেখে নীরাকে জিজ্ঞেস করে, ‘সাথী কোথায় বুবু?’
‘আমি তো জানি না ভাবিজান। সাথী মনে হয় নিচেই নামেনি।’
চৈত্রিকা চমকে ওঠে। এতো ঝামেলার মাঝে তার একটু খেয়াল ছিলো নাহ। দ্রুত সবকিছু পেড়িয়ে সাথীর ঘরের সামনে যেতেই দেখে দরজা হালকা ভেজানো। চৈত্রিকা ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। সাথে সাথেই আযান শুরু হয়। চৈত্রিকার চোখের সামনে সিলিং এ থাকা সাথীর লা’শ ঝুলতে থাকে।
চলবে..
#চৈত্রিকা (৪৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
১৫.
সিলিং এ সাথীকে ঝু’লতে দেখে চৈত্রিকা ‘সাথী’ বলে চিৎকার করেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। চৈত্রিকার চিৎকার শুনে প্রহরসহ বাড়ির কমবেশি সবাই ছুটে আসে। চৈত্রিকাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে কেউ কোনো দিকে না তাকিয়েই আগে চৈত্রিকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চৈত্রিকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মাঝেই অর্থির নজর পড়ে খোলার দরজার ভেতরে। সাথীকে ঝু’লতে দেখে ভয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। নিবিড় ভ্রু কুঁচকে অর্থিকে আগলে নিতেই অর্থি ভয়ে ভয়ে আঙুল তুলে ঘরের ভেতর ঈশারা করে। নিবিড় সেদিকে তাকিয়ে নিজেও থমকে যায়। ছোট্ট করে প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘প্রহর ভাইজান সাথী!’
প্রহর নিবিড়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। চৈত্রিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ পিটপিট করতে থাকে। একে একে সবাই খেয়াল করে সাথী সিলিং এ ঝু’লছে। নীরা, অর্পিতা আর অর্থি মুহুর্তেই শব্দ করে কেঁদে ওঠে। প্রহর ফাঁকা ঢোক গিলে একবার সাথীর ঝু’লন্ত লা’শের দিকে তো আরেকবার তাকায় চৈত্রিকার অবচেতন মুখের দিকে। এর মাঝেই চয়ন, সাদিক, শিমুল, পিয়াসও চলে আসে। সাথীকে ঝু’লতে দেখে পিয়াস হায় হায় করে ওঠে। প্রহর, চিত্র আর নিবিড় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কারো মৃ’ত্যুতে যে পিয়াস হায় হায় করার মতো মানুষ না তা বোধহয় তাদের থেকে কেউ ভালো জানে নাহ। প্রহর কাউকে কিছু না বলেই চৈত্রিকাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে যায়। সাথে ডাকে শায়লাকে। পল্লবী কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে বুঝতে পারে নাহ। নাসিমার মতো কঠিন, পা’ষাণ মহিলাও সাথীর লা’শ দেখে কেঁপে উঠেছে। চিত্র পুলিশকে খবর দেয়। নিজেরা আগেই সাথীকে নামায় না। পিয়াস আচমকাই পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। উপস্থিত সবাই অবাক। পিয়াস কেনো কাঁদছে কেউ বুঝে ওঠে নাহ। নিবিড় অর্থিকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। বোকা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে প্রায় নেতিয়ে পড়ছে। জ্বর শরীরে নিবিড়ের মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্নই দেখছে! হুট করেই তাদের বিয়ে আর এখন সাথীর লা’শ! এগুলো তো স্বপ্ন ছাড়া সম্ভব নয়। পরপর কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে চোখ পিটপিট করে ঝাপসা চোখ পরিষ্কার করে নেয়। মিনিটের মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে সাথীর মৃ’ত্যুর খবর। এই সাঝের বেলাতেই গ্রামের লোকজন একরকম ছুটে আসে প্রায়। জমিদার বাড়ি থেকে খবর দেওয়ার আগেই কথায় কথায় আজম আলী আর সনিয়া বেগম খবর পেয়ে যায়। হুট করেই এমন একটা খবর দুজনের কেউ বিশ্বাস করে উঠতে পারে নাহ। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ছুট লাগায় জমিদার বাড়ির দিকে। বুকের ভেতরটা দুজনের চিনচিনে ব্যাথায় ছেয়ে গেছে। এর মাঝেই পুলিশও চলে আসে। সাথীর লা’শ তারাই নামায়। সাথীকে হলরুমে শুইয়ে রেখেছে। আশে পাশে জমিদার বাড়ির সবাই বসে কাঁদছে। সনিয়া বেগম জমিদার বাড়ির হলরুমে পা রাখতেই সবার কান্নার সুর ভেসে আসে। ফাঁকা ঢোক গিলে ভীতু চোখে আশে পাশে চোখ বুলায়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে সাথীর ফ্যাকাশে মুখ। মেয়েকে মেঝেতে শুইয়ে রেখে আশে পাশের লোকজন কাঁদছে! এই দৃশ্য একজন মায়ের কাছে কতোটা কষ্টের তা একজন প্রকৃত মা-ই বুঝতে পারেন। আজম আলী মেয়ের মুখ দেখেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন। সনিয়া বেগম এগিয়ে মেয়ের কাছে পৌঁছাতে পারে নাহ। জ্ঞান হারিয়ে তিনিও মেঝেতেই লুটিয়ে পড়েন। পল্লবী আর নীরা ছুটে আসে। দ্রুত সনিয়া বেগমকে ধরে সোফায় শুইয়ে দেন। মেইডকে ডেকে পানি এনে ছিটিয়ে দিতে থাকে মুখে। বাড়ির অবস্থা আরো খারাপ হয়। আশে পাশের লোকজন কা’না’ঘু’ষা শুরু করেছে। এতো ভালো একটা মেয়ে হুট করে আ’ত্মহ’ত্যা কেনো করলো এইটাই কেউ ভেবে পাচ্ছে নাহ। সনিয়ার বেগমের জ্ঞান ফিরানোর মাঝেই প্রহর নিচে নামে। এতক্ষণ সে চৈত্রিকার কাছে ছিলো। এতোটা সময় চলে যাওয়ার পরও চৈত্রিকার জ্ঞান ফিরেনি। শায়লা আছে এখনো ওখানেই। বাড়ির পরিবেশ খারাপ হওয়ায় সে নিজেই চলে এসেছে। পুরো বাড়িতে মৃ’ত্যুর কান্না যেনো প্রহরের গায়ের লোমকূপ দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই নির্দোষ মেয়েটা কেনো এমন একটা কাজ করলো এটা ভেবেই বুক ভারী হয়ে আসে। প্রহর রেনওয়াজ তো পা’ষান অথচ সাথীর মৃ’ত্যুতে সে নিজেকেই সামলাতে পারছে নাহ। প্রহর চুপচাপ এসে সাথীর লা’শের সামনে বসে থাকে। চয়ন আর সাদিক পুলিশের সাথে কথা বলেছে। তারা চায় লা’শকে পোস্টমর্টেম করতে। এটা শুনেই আজম আলী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আমার মাইয়ারে আর কষ্ট দিয়েন না আপনারা। আমার মাইয়াটা এমনিতেই অনেক কষ্ট নিয়া দুনিয়া ছাড়ছে। ওরে কা’টা ছে’ড়া কইরেন না। দুনিয়াতে থাকতে মাইয়ার কদর করি নাই অথচ এখন আমার বুকটা ফা’ইটা যাইতেছে। আল্লাহ গো!’
প্রহর যথেষ্ট অপছন্দ করা স্বত্বেও আজম আলীর একেকটা আহাজারী অনুভব করতে পারলো। বেশি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো নাহ। আশ পাশ হাতড়েও বলার মতো দুটো শব্দও সে পেলো না। কথা বলার সময় বুঝতে পারে তার গলা কাঁপছে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে একদম নিচু স্বরে বলে,
‘কোনো পোস্টমর্টেম হবে নাহ।’
পুলিশের এসআই বিনয়ের স্বরে বলতে চায়, ‘কিন্তু স্যার! এটা তো সুই’সা’ইড কেইস! আমাদের তো পোস্টমর্টেম করতেই হবে।’
‘করতে হবে নাহ। হবে না যখন বলেছি তখন হবে নাহ। তাছাড়া ওর বাবাও তো চাচ্ছে নাহ। সাথীর মা, চৈত্রিকা উনারা দুজনই অবচেতন। এখন তো আরোই কোনো রকম সিদ্ধান্ত নিতে চাই নাহ।’
এসআই চুপ করে যায়। এর মাঝেই সনিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরে আসে। লাফিয়ে উঠে পল্লবীর হাত ধরে বলে, ‘জমিদার গিন্নি আমার সাথী কই? আমার মেয়েটা কই? আমার বুক খালি করে আমার মেয়ে কোথাও যায়তে পারে নাহ। কই আমার মেয়ে? দেখি সরেন!’
পল্লবী সনিয়া বেগমকে শান্ত করতে চাইলেও কোনো কাজ হয় নাহ। সনিয়া বেগম সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে পাগলের মতো নিজের মেয়ের কাছে যেতে চাইতে থাকে। ছুটে আসে নিজের মেয়ের লা’শের কাছে। মেয়ের মাথার কাছে বসে দু গাল আগলে নিয়ে পাগলের মতো বলতে থাকে,
‘মা! এই মা! তুই উঠবি না? দেখ আমি সব রাগ, অভিমান ভুলে তোর কাছে চলে আসছি। এই মা দেখ তোর মা আর কিছু মনে রাখে নাই। তাকাবি না মায়ের দিকে? মায়ের সাথে অভিমান হয়ছে মা? আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো তোর সাথে রাগ করবো নাহ। তাকা আমার দিকে! আর কতক্ষণ ঘুমাবি! তাকা না মা!’
সনিয়া বেগমের এমন উন্মাদনা দেখে উপস্থিত সবাই কেঁদে ফেলে। নীরা এগিয়ে এসে সনিয়া বেগমকে কোনো রকমে বলে, ‘আম্মা এদিকে আসেন! এমন করবেন না আম্মা।’
সনিয়া বেগম এক ঝটকায় নীরার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখ মুখ কুঁচকে নীরাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘কান্না করছো কেনো হ্যাঁ? দুরে যাও আমার থেকে। কাছে আসবে না একদম। আমি আমার সাথীর কাছে থাকবো।’
কথা শেষ করেই মেয়ের গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে বসে থাকে। মেঝেতে প্রায় গা ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে আগলে নিয়ে বসে থাকে। পাগলের মতো বিড়বিড় করে কি সব বলতেই থাকে। কেউ ভেবে পায় না এই মহিলাটিকে ঠিক কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়! এর মাঝেই সিড়ি দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে আসে চৈত্রিকা। চারপাশে কোনো কিছু না দেখেই সাথীর লা’শের পাশে বসে পড়ে৷ প্রহরসহ বাকি সবাই চমকায়। শায়লা পিছু পিছু এসে চৈত্রিকাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু চৈত্রিকা কাউকে ধরতে দেয় নাহ। সাথীর পাশে আলগোছে বসে আস্তে আস্তে ডাকতে থাকে। কিন্তু ছুঁতে গেলেই সনিয়া বেগম হুং’কার ছাড়েন। চৈত্রিকার হাত টান মে’রে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে,
‘সর! দুরে যা আমার মেয়ের থেকে! খবরদার আমার মেয়েকে ছুঁবি না তুই। এই তুই যা! যা এখানে থেকে!’
সনিয়া বেগম রীতিমতো ধাক্কা দেয় চৈত্রিকাকে। অর্পিতা চৈত্রিকাকে ধরে কান্নারত অবস্থাতেই বলে, ‘কি করছেন মামি!’
চৈত্রিকা কোনো শব্দ করে না। সনিয়া বেগম কারোর কথা শোনেন নাহ। মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে ফের গালের সাথে গাল ঘেঁষে পড়ে রয়। চৈত্রিকার চোখ থেকে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ে। প্রহর নিজ জায়গা থেকে উঠে এগিয়ে এসে চৈত্রিকার কাছে বসে। চৈত্রিকাকে আগলে নিয়ে নিজের বুকে ঠায় করে দেয়। চৈত্রিকা প্রহরের শার্ট আঁকড়ে ধরে কান্না করতে থাকে। প্রহর চৈত্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘কান্না করো না। মামির মাথা ঠিক নেই তাই এমন বলছে! নিজেকে সামলাও! তুমি নিজেকে না সামলাতে পারলে মামিকে সামলাবে কে?’
প্রহর যত সহজে কথা গুলো বললো ঠিক ততটাই কঠিন এই কাজগুলো। সে নিজেই নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে এরা নিজেদের সামলাতে পারবে এটা ভাবাই বোধহয় বিলাসিতা! চৈত্রিকা প্রহরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদম ধীরে এগিয়ে যায় সনিয়া বেগমের দিকে। সনিয়া বেগমের দিন দুনিয়ার ধ্যান বোধহয় তখন নেই। চুপচাপ নিজের মেয়েকে নিয়ে পড়ে আছেন তিনি। চৈত্রিকা ফাঁকা কয়েকটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে সনিয়া বেগমের বাহুতে হাত দেয়। কান্নারত, ভাঙা কন্ঠে মিনমিনিয়ে ডাকে,
‘মামি! ও মামি!’
সাথে সাথেই সনিয়া বেগম ভ’য়ং’কর হয়ে ওঠেন। নিজের মেয়েকে ছেড়ে তিনি সহসাই সোজা হয়ে উঠে ঠা’স করে থা’প্পড় বসিয়ে দেয় চৈত্রিকার গালে। চৈত্রিকার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
‘তুই না বলছিলি আমার মেয়েরে আগলাইয়া রাখবি! এই আগলাইয়া রাখছিলি আমার মেয়েরে! এইটাই তোর আগলাইয়া রাখার নমুনা! আমি তোরে নিঃস্বার্থে মেয়ের মতো ভালোবাসছি। আগলাইয়া রাখছি। কখনো তোর ওপর দুইটা ক’টু বাক্যও ছুড়ে মা’রি নাই। সেই তুই আমার মাইয়ারে কাইড়া নিলি! তুই কেমনে পারলি এইটা? কেমনে পারলি? আমার বুক খালি করতে তোর আত্মা কাঁপে নাই? তুই না এই জা’নো’য়া’রদের শা’স্তি দিতে আইছিলি! দেস নাই কেন? নিজের সংসারে মায়ায় পইড়া গেছিস তাই না! মাঝখান দিয়ে আমার মাইয়াডা ব’লি হয়ে গেলো। তুই! তুই আমার মাইয়ারে মা’ইরা ফেলছিস। তোরে কোনো দিন আমি মাফ করমু নাহ। দুর হ সামনে থেকে!’
চৈত্রিকাকে ছু’ড়ে মা’রে সনিয়া বেগম৷ পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। চৈত্রিকা পা’থরের মতো চুপচাপ শুধু বসে থাকে। প্রহর ফের আগলে নেয়। কিন্তু চৈত্রিকা অনুভূতিশূণ্যের মতো শুধু চেয়ে থাকে। চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়লেও মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সনিয়া বেগম পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে আঁচড় কা’টেন আর বিলাপ করতে থাকেন,
‘ওহ আল্লাহ! জীবনে বুঝে কখনো অ’ন্যায় করিনি। তুমি আমার কোন অ’ন্যায়ের শা’স্তি আমার মেয়েরে দিলা আল্লাহ! একজন মায়ের কোল খালি করলা কেমনে? আমার মৃ’ত্যুটা তুমি আগে দিলা না কেন?’
নিজের বুকেই নিজে থা’প্রাতে থাকে অনবরত। পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তার বুকের জ্বা’লা কেবল তিনিই বুঝছেন। তার নি’র্দোষ মেয়েটা অকারণেই চলে গেলো দুনিয়াবি ছেড়ে। একজন মায়ের কাছে এটার মতো কষ্টজনক বোধহয় আর কিছুই নেই।
১৬.
রাতের অন্ধকার থাকা অবস্থাতেও সাথীর কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। গরমের দিন! সারা রাত লা’শ রাখলে লা’শ ধীরে ধীরে প’চন শুরু করবে৷ একেই তো আ’ত্ম’হ’ত্যা করা লা’শ! তাই কেউ দেড়ি করতে চাইলো নাহ। সাথীর ধোয়ানো থেকে শুরু করে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সনিয়া বেগম আকাশ পাতাল ফাটিয়ে চিৎকার করে কাদছিলেন। ৪/৫ জন মিলে ধরেও তাকে সামলানো দায় হয়ে যাচ্ছিলো। শেষ সময়ে সাথীর কাছে আসেনি চৈত্রিকা। দুর থেকে একবার মুখ দেখেই ঘরে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। প্রথমবারের মতো দুর্বল স্বত্তায় চৈত্রিকাকে দেখে প্রহর কিছুই করতে পারেনি। চুপচাপ নিজের বুকে আগলে রেখেছিলো। কিন্তু কবর দিতে যেতে হবে বলে সে চৈত্রিকাকে নীরা, অর্পিতা, শায়লার কাছে রেখে চলে যায়। চৈত্রিকার কান্নার দমকে তারা ৩ জনও কেঁদেছে। প্রহর, আজম আলী, চিত্র আর নিবিড়ই খাটিয়া তুলেছিলো। অন্যদের ধরতে দেয়নি প্রহর। আজম আলী নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও পারে নাহ। পুরো রাস্তা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে৷ আ’ত্ম’হ’ত্যা করা লা’শ এবং রাতের বেলা হওয়া স্বত্বেও বেশ অনেক মানুষ জানাযায় সামিল হয়। কবর দেওয়া শেষে সবাই চলে আসলেও আজম আলী মেয়ের কবর ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। প্রথমবারের মতো নিজের সমস্ত পা’প মনে পড়ে তার। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। প্রহর, নিবিড়, চিত্র ৩ জনই দাঁড়িয়ে দেখে। সত্যিই বোধহয় পৃথিবীতে হাজারটা খা’রাপ মানুষ থাকলেও কোনো খা’রাপ বাবা নেই। বেশ অনেকটা সময় পর ৩ জন মিলেই আজম আলীকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। বাড়ির তখনো তুলকালাম অবস্থা। সনিয়া বেগম কান্না করতে করতে গলা ভাঙিয়ে ফেলেছে তবুও থামার নাম নেই। বার বার সাথী সাথী করে কান্না করেই যাচ্ছে। প্রহর এক নজরে সবটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে যায়। চৈত্রিকা ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। কান্নাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। অর্পিতা, নীরা প্রহরকে আসতে দেখে নিজেরা বেড়িয়ে যায়। প্রহর দরজা আটকে চৈত্রিকার পাশে নিজেও শুইয়ে পড়ে। চৈত্রিকা টের পেয়েও কিছু বলে নাহ। প্রহর নিজে থেকে চৈত্রিকাকে টেনে নিজের কাছে আনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। চৈত্রিকা মুখ গুজে দেয় প্রহরের বুকে। গা থেকে আতরের সুবাস ভেসে আসে। চোখ থেকে টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। হুট করেই প্রহরের থেকে ছিটকে সরে আসে। বড় বড় শ্বাস নেয়। প্রহর অবাক হয়। চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে বলে,
‘সবাই খু’নী। এরা সবাই খু’নী। কেউ ভালো নাহ। আমিও খু’নী। আমার জন্য সাথী ম’রে গেছে। আমি বাঁচতে চাই নাহ। কিন্তু তার আগে এদেরকে বাঁচতে দিতে চাই নাহ।’
চোখ মেলে তাকায় চৈত্রিকা। কান্নার ফলে চোখ ফুলে আছে। সাথে লাল হয়ে গেছে৷ ঘাড় ফিরিয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সময়ের কাটা যত ঘুরবে তত একজন একজন করে জা’নো’য়া’রহীন হবে দুনিয়া। ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি সাথীর সাথে হওয়া অ’ন্যায়ের শা’স্তি দিতে না পারি তাহলে নিজেই নিজের গলা কে’টে ফেলবো। এটা আমার প্রতিজ্ঞা!’
চলবে..