#চৈত্রিকা
#অন্তিম_পর্ব (প্রথম অংশ)
#বোরহানা_আক্তার রেশমী
_________________
নিস্তব্ধ রাত্রী। আশে পাশে মানুষের ছায়াও দেখা যায় নাহ। চারপাশ থেকে ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে অনবরত। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে চিকন একটা চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। চৈত্রিকার পুরো গা থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসছে। একবার নিজের ভেজা গায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকায় চৈত্রিকা। নিজের থেকে কিছুটা দুরে সনিয়া বেগম আর আজম আলীকে বাঁধা অবস্থায় দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে আগে ছুটে যেতে নেয় মামা মামীর কাছে। পেছন থেকে হাতে টান পড়তে আর এগোনো হয় নাহ। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে চয়ন তার হাত ধরে আছে। চৈত্রিকার চোয়াল শক্ত হলো। সামান্যও ভয় ভীতি মনে না রেখে জোড় গলায় বলে,
‘হাত ছাড়ুন!’
চয়ন কু’টিল হাসি হাসে। এক হাতে গাল চুলকে অন্য হাতে শক্ত করে চৈত্রিকার হাত চেপে ধরে বলে, ‘এতো সহজে তো ছাড়বো না বড় বউ। এতো কিছুর পর তোমারে হাতের কাছে পাইছি। এতো সহজে ছেড়ে দিলে হবে?’
চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকায়। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, ‘হাত ছাড়েন! আমার মামা মামীরে এখানে বেঁধে রাখছেন কেন? আপনার শ’ত্রুতা না হয় আমার সাথে। ওদের সাথে তো নাহ। তাহলে আটকে রেখেছেন কেনো ওদের?’
‘ওদের না আটকালে তোমারে আটকাতাম কেমনে? তুমি যে একা সব করতে পারতেছো না এটা তো আমি টের পেয়েই গেছিলাম কিন্তু নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে আমারই বড় পুত্র এসব করতেছে এটা ধরতে পারি নাই। যখন ধরতে পারছি ততক্ষণে তুমি আর প্রহর মিলে আমার ছেলে, ভাইরে মে’রে ফেলছো। এখন তোমার ছাড় নাই। আজ তোমার শিরা উপশিরা থেকে র’ক্ত শু’ষে নিয়ে তবেই ক্ষ্যা’ন্ত হবো।’
রাগে চয়নের চোয়াল শক্ত হয়। চৈত্রিকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাগে উন্মাদ হওয়া চয়ন সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে চৈত্রিকাকে ক’ষে থা’প্প’ড় মা’রে। চৈত্রিকা দু পা পিছিয়ে যায়। ঠোঁটের ফিনকি বেয়ে র’ক্ত গড়াতে থাকে। থা’প্প’ড়টা এতোটাই জোড়ে পড়েছে যে মাথার মধ্যে একটা সুক্ষ্ম ব্যাথা অনুভূত হয়। গালে জ্বা’লা করে রীতিমতো। মিনিট খানেকের মতো লাগে থা’প্প’ড়ের ধা’ক্কাটা সামলাতে। চৈত্রিকা ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে চয়নের দিকে তাকানোর আগেই চয়ন চৈত্রিকার চুলের গোছা টেনে ধরে। এক হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে শক্ত করে ধরে থাকে। চৈত্রিকা ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। আজম আলী আর সনিয়া বেগম চেঁচাতে থাকে। বার বার বলতে থাকে চৈত্রিকাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু পা’ষাণ চয়ন সেদিকে কানই দিলো নাহ। আরো শক্ত করে চৈত্রিকার চুল ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘খুব সাহস তোর তাই না! অনেক বড় কলিজা! এখন তোরে কে বাঁচাবে? তোর প্রহরও আমার সাথে করা বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তার শা’স্তি পাচ্ছে। এতক্ষণে না ম’রলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই ম’রে যাবে। সবগুলোকে আমি পু’ড়িয়ে মা’রবো।’
এতক্ষণে চৈত্রিকা মুখ খোলে। ব্যাথাটুকু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে, ‘পিছন থেকে আ’ঘাত করে নিজেকে বীরপুরুষ ভাবাটা বোকামো চয়ন রেনওয়াজ। কার শা’স্তি কে পাবে আর কে কাকে পু’ড়িয়ে মা’রবে তা তো শুধু সময়ের দেখা।’
এরকম বি’পদের মুহুর্তেও চৈত্রিকার তেজ, সাহস দেখে যেমন অবাক হয় তেমনই রাগে ফেটে পড়ে চয়ন। চৈত্রিকার চুল ছেড়ে দিয়ে ধা’ক্কা দেয়। অনাকাঙ্খিত ভাবে চৈত্রিকা নিজের কোমড়ে রাখা ছোট্ট ছু’ড়ি চেপে ধরে চয়নের গলায়। আকস্মিক ঘটনায় চয়ন চমকালেও একটা টু শব্দও করে নাহ। বরং চৈত্রিকাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য নিজে হাসে। চৈত্রিকা চয়নকে ভয় পেতে না দেখে সত্যিই খানিকটা চমকায়। তার কিছু বুঝে উঠার আগেই কত গুলো লোকজন তাকে ঘিরে ধরে। চৈত্রিকা অবাক হয়। হঠাৎ করে এতো গুলো লোকের মুখোমুখি হয়ে ভেতরে ভেতরে ভয় পেতে শুরু করে। এতোগুলো লোকের সাথে সে কিভাবে পেরে উঠবে! জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সাথে সাথেই চয়ন তার হাত থেকে ছু’ড়ি ফেলে দিয়ে হাত শক্ত করে চেপে ধরে। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে যায় যে চৈত্রিকা বুঝতেই পারে নাহ। চয়ন হাত মু’চড়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তোর কলিজাটা একটু বেশিই বড়! আমারে মা’রার চেষ্টা!’
চৈত্রিকার হাত এমন ভাবে ধরে যেনো হাতটা এখনই ভে’ঙে যাবে। ব্যাথায় চোখ মুখ নীল বর্ণ ধারণ করে। তবুও চৈত্রিকা মুখ দিয়ে কোনো রকম শব্দ বের না করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। এর মাঝেই একটা ছু’ড়ি এসে লাগে একজনের বুক বরাবর। চয়নসহ সবাই চমকায়। লোকটির চোখ মুখ উল্টে যায়। ক্ষ’ত স্থান থেকে অনবরত রক্ত বের হতে থাকে। চয়ন আঁতকে ওঠে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলিয়েও কাউকে চোখে পড়ে নাহ। একবার চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকায় দরজার দিকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘কে? কে মা’রলো ওকে? প্রহর তো এতক্ষণ বাঁচার কথা না। তাহলে কে? কোনোভাবে প্রহর!’
ভাবতেই গায়ের শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে। লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ছু’ড়ি ছুড়ে মা’রা সেই লোকটাকে খোঁজার জন্য। চৈত্রিকা এই সুযোগে লা’থি বসিয়ে দেয় চয়নের পেট বরাবর। আকস্মিক আঘাতে চয়ন হাত ছেড়ে দেয়। চৈত্রিকা নিচ থেকে ছু’ড়ি তুলে কোনো কিছু না ভেবেই আ’ঘাত করে চয়নকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা চয়নের বুক বরাবর না পড়ে চয়ন সরে যাওয়ায় বাহুতে পড়ে। ব্যাথায় গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে চয়ন। চৈত্রিকা মুখ হাত দিয়ে চয়নের থেকে খানিকটা সরে যায়। সনিয়া বেগম আর আজম আলী চেঁচিয়ে তাদের বাঁধন খুলতে বলে। চৈত্রিকা চয়নকে র’ক্তাক্ত অবস্থাতে ফেলেই আগে সনিয়া বেগম আর আজম আলীর হাতের, পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। তারা উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই চৈত্রিকার আঁচলে আ’গুন জ্ব’লে ওঠে। সনিয়া বেগম হায় হায় করে ওঠে। চৈত্রিকা নিজের শাড়ির আঁচলে আগুন দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়। গায়ে কেরোসিন থাকায় সহজেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আজম আলী আর সনিয়া বেগম হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়েই আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। চৈত্রিকার গায়ে ততক্ষণে আ’গুন লেগে গেছে। চোখের সামনে ঝাপসা ভাবে নিজের বাবার মুখটা ভেসে ওঠে। সেই মুহুর্তেই সেখানে প্রহর আসে। উন্মাদের মতো ছুটে এসে জ্ব’লন্ত আগুনেই হাত দিতে যায়। আজম আলী ছুটতে শুরু করে পানির খোঁজে । সনিয়া বেগম আর প্রহর মিলে পাশে পড়ে থাকা বস্তাসহ যা পায় তা দিয়েইআগুন নেভানোর চেষ্টায় মত্ত থাকে। কঠিন সত্তার প্রহর চৈত্রিকার এই অবস্থায় যেনো এখনই কেঁদে ফেলবে। চোখের জ্বলন, হৃদয়ের চিনচিনে ব্যাথায় যেনো শরীর ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম। নিজের সাথে লড়াই করেই প্রহর আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকে। চয়ন প্রহরকে দেখেই হা হয়ে যায়। পাশে পড়ে থাকা তার তলোয়ার হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের ব্যাাথা উপেক্ষা করে এগোতে নিলে অন্য আরেকটি তলোয়ার তার ভে’তর এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়। হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায় চয়নের। স্তব্ধ হয়ে শরীর ছেড়ে দেয়। উল্টে পড়ে যায়। তাকিয়ে দেখে পল্লবী দাঁড়িয়ে আছে। চয়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পল্লবী দৌড়ে আসে চৈত্রিকার কাছে। প্রহর আর সনিয়া বেগম ততক্ষণে আগুন প্রায় নিভিয়ে ফেলেছে। আজম আলীও কোথা থেকে এক বালতি মতো পানি নিয়ে আসে। সরাসরি ঢেলে দেয় চৈত্রিকার গায়ে। আগুন যেহেতু অনেকটাই নিভে গেছিলো তাই পানিতেও কাজ হয়। চৈত্রিকা অনেকক্ষণ আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। প্রহর কোনো কিছু ভাবে না কিচ্ছু দেখে নাহ। চট করে চৈত্রিকাকে আগলে নেয়। বুকের মাঝে শক্ত করে আগলে ধরে। সনিয়া বেগম হাউমাউ করে কাঁদছে। চৈত্রিকা নিস্তেজ হয়ে গেছে। শরীরের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই একটু একটু করে পু’ড়েছে। গলা থেকে শুরু করে মুখের একাংশ আর কানের দিক দিয়েও পু’ড়ে গেছে। চয়ন তখনো মা’রা যায়নি। জানটা ছটফট করছে। প্রহর এক পলক দেখে সেদিকে। সনিয়া বেগম আর পল্লবী দ্রুত হাসপাতালে নিতে বলে। প্রহর শোনেও। এক ফোঁটাও দেড়ি করে নাহ। শরীরে, মাথায় ক্ষ’ত থাকা স্বত্তেও কোলে তুলে নেয় চৈত্রিকাকে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের সমস্ত ব্যাথা সহ্য করে চৈত্রিকার পো’ড়া মুখের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘তোমার সমস্ত পু’ড়ে যাক! শুধু তোমার প্রাণটুকু আমার জন্য থেকে যাক বউজান।’
চয়নের প্রাণ যায় যায় অবস্থা তবুও সে প্রহর আর চৈত্রিকাকে মা’রা নিয়ে ব্যস্ত। এক হাতে আবার তলোয়ার তুলে নিলে এবার আজম আলী তার বুকে একবার, দুবার করে বহুবার আঘাত করে। চয়ন মুখ থেকে অস্পষ্ট কিছু আওয়াজ করে। মুখ থেকে টপটপ করে র’ক্ত পড়তে থাকে। আজম আলী হিং’স্রতা নিয়ে বলে,
‘তোরে মা’ইরা জীবনে সব থেকে ভালো একটা কাম করলাম। আজীবন তোর গোলামি করা সত্বেও তুই আর তোর মেজো পুত্র আমার মাইয়ারে বাঁচতে দিস নাই। চৈত্রিকার গায়ে আ’গুন লাগাইয়া দিলি! তোর মতো প’শুরে মা’ইরা আমি স্বার্থক।’
সনিয়া বেগম আজ আর অভিযোগ করলেন নাহ। পল্লবী তাকায় চয়নের দিকে। এতোগুলো বছরের পর তার সেই প্র’তি’শো’ধ পূর্ণ। মনের ক্ষো’ভ যেনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। চয়নের মৃ’ত দেহটা ওখানে ওভাবে ফেলেই সবাই ছুটে চললো প্রহর আর চৈত্রিকার উদ্দেশ্যে।
৪৩.
চৈত্রিকাকে নিয়ে প্রহর, পল্লবী, সনিয়া বেগম আর আজম আলী যখন শহরের হসপিটালে পৌঁছায় সময় তখন রাত ১ টার কোঠায়। প্রহর উন্মাদের মতো হসপিটালে ঢুকে ডাক্তারকে ডাকতে থাকে৷ এতো রাতে কোন ডাক্তারই বা ডাকার সাথে সাথে চলে আসে! প্রহরের ডাকাডাকিতে কমবেশি হাসপাতালে থাকা সবাই সজাগ হয়ে যায়। চৈত্রিকার পু’ড়ে যাওয়া ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত শরীরটা ততক্ষণে পুরোপুরি এলিয়ে গেছে। হাসপাতালের সবাই দেখছে আর বলাবলি করছে নিজেদের মাঝে। প্রহরের চেচামেচিতে একজন ডাক্তার আর নার্সও আসে। প্রহর শুধু পাগলের মতো একটাই কথা বলতে থাকে, ‘চৈত্রকে বাঁচিয়ে দিন ডাক্তার!’ ডাক্তার অনেক চেয়েও শান্ত করতে পারে নাহ প্রহরকে। সনিয়া বেগম আর পল্লবীও কান্না শুরু করেছে। আজম আলী রীতিমতো পা ধরতে বসে ডাক্তারের। সবার এমন অবস্থা দেখে কোনো কথা ছাড়াই ডাক্তার ভর্তি করে নেয় চৈত্রিকার। চৈত্রিকার এই অবস্থা দেখে হয়তো মায়া লাগে লোকটার! চিকিৎসা ব্যবস্থা তখনো এতোটাা উন্নত হয়নি। চৈত্রিকাকে জরুরী বিভাগে রাখা হয়। প্রয়োজনীয় সকল রকমের চিকিৎসা তখনই শুরু হয়। প্রহর হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়ে। দিক বেদিক পুরোটাই তার শূণ্য মনে হলো। বার বার মাথায় একটা কথা-ই বাজছে,
‘চৈত্র বাঁচবে তো! ওর কিছু হবে না তো?’
উত্তর নেই। পল্লবী ছেলেকে আগলে ধরে বসে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে, ‘আব্বাজান এমন কইরো না। দোয়া করো চৈত্রিকার জন্য। এই মুহূর্তে তুমি শক্ত না হলে তো চলবে নাহ।’
প্রহর জবাব দিলো নাহ। এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের বুকেই ঠায় করে নেয়৷ ফাঁকা মস্তিষ্কে তার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে। ছোট বাচ্চারা যেভাবে হাউমাউ করে কাঁদে তারও ভীষণ ইচ্ছে করে ঠিক সেভাবেই কাঁদতে। কিন্তু কান্না আসে নাহ। চোখের ভেতরটা জ্ব’লে ওঠে তবুও তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জলও গড়ায় নাহ। ভেতর থেকে হাজারটা কষ্ট উপচে আসে অথচ মুখ থেকে একটা আওয়াজও বের হয় নাহ। সারা রাত মায়ের বুকে লেপ্টে থাকে ওভাবেই যেনো কোনো ছোট বাচ্চা তার মায়ের কোল ছেড়ে যাবে নাহ।
কখন ওভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। ঘুম ভাঙে সকলের চেচামেচিতে। ঝাপসা চোখ ভালো মতো পরিষ্কার করে নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কিছুক্ষণের জন্য মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। যখন গত রাতের সবটা এলোমেলো ভাবে মনে পড়ে তখনই নিজ জায়গা থেকে উঠে ছুট লাগায়। পল্লবী পেছন থেকে ডাকে। সে ডাকে সাড়া দেয় না প্রহর। জরুরী বিভাগের সামনে এসে দাঁড়ায়। দুর থেকে দেখে শুভ্র রঙা চাদরের ওপর নিস্তেজ চৈত্রকে। মুখের একাংশের সেই পো’ড়াটুকু ভ’য়ং’কর লাগছে অথচ প্রহর মন ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের চৈত্রকে দেখছে। একটু খানিও বিরক্তি নেই, ঘৃণা নেই। কুঁচকানো চোখ মুখ নেই। প্রহর যখন নিজ ভাবনায় ব্যস্ত তখন গত রাতের ডাক্তারটি আলগোছে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। কাধে হাত রেখে বলে,
‘এই পোড়া মুখ, শরীরের একটা মেয়ের সাথে কি আজীবন কাটাতে পারবেন? ঘৃ’ণা লাগবে না পো’ড়া অংশ দেখলে!’
প্রহর অদ্ভুত ভাবে তাকায়। ঠোঁট নাড়িয়ে ক্লান্ত গলায় বলে, ‘নিজের প্রাণকে কি কেউ ঘৃ’ণা করে ডাক্তার সাহেব? নিজের প্রাণ ছাড়া কি কেউ বাঁচার কথা ভাবে?’
চলবে..
#চৈত্রিকা
#অন্তিম_পর্ব (শেষাংশ)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
৪৪.
এক টানা ১৫ দিন লেগে যায় চৈত্রিকার খানিকটা সুস্থ হতে। সারা দেহ প্রায় পু’ড়ে যাওয়ায় অসহ্য য’ন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাকে। প্রহর এই ১৫ দিনের হয়তো ১৫ মিনিটও চৈত্রিকাকে একা ছাড়তো নাহ। কিন্তু তারও তো গোসল, নামাজ, নাওয়া খাওয়া আছে! তাই বাধ্য হয়েই যখন সরতে হতো তখন সনিয়া বেগম, অর্থি, অর্পিতা কাউকে না কাউকে বার বার চৈত্রিকার কাছে থাকতে বলতো। বাড়ির সবাই চৈত্রিকার এই অবস্থায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। চয়নের শেষ সকল কাজ যদিও চিত্র আর নিবিড় মিলেই করেছে কারণ প্রহরকে তার জায়গা থেকে টলানো যায়নি। প্রহর চোখ মুখ শক্ত করে একটাই কথা বলেছে, ‘যে পিতা তার স্বা’র্থে নিজের পুত্রকেই মে’রে ফেলতে চায় সেই পিতার মুখও আমি শেষ বারের মতো দেখতে চাই নাহ।’ চয়নের মৃ’ত্যুতে গোটা গ্রামের কোথাও শোক পড়েনি। চৈত্রিকার বেডের পাশেই বসেছিলো প্রহর। চৈত্রিকাকে চোখ মেলতে দেখে দ্রুত নড়েচড়ে বসে বলে,
‘উঠে পড়েছো! কষ্ট হচ্ছে কোথাও? ব্যাথা আছে?’
চৈত্রিকা জবাব দেয় নাহ। শুধু তাকিয়ে থাকে। প্রহর একই প্রশ্ন ফের করে। চৈত্রিকা দুদিকে আলগোছে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় তার ব্যাথা নেই। কষ্ট হচ্ছে না। অতঃপর কোনো রকমে বলে,
‘পানি খাবো জমিদার সাহেব।’
প্রহরের যেনো আত্মায় অন্যরকম প্রশান্তি ছেয়ে গেলো। কতগুলো দিন, কতটা সময় পর সে তার বউজানের মুখে ‘জমিদার সাহেব’ ডাকটা শুনলো! এই ডাকটার মাঝে কিছু আছে নয়তো তাকে টানে কেনো এতো! নিজের ভাবনা বন্ধ রেখে আগে চৈত্রিকাকে পানি খাইয়ে দেয়। চৈত্রিকা উঠতে চাইলে প্রহর নিষেধ করে। কিন্তু চৈত্রিকা শোনে নাহ। তাই বাধ্য হয়ে প্রহর নিজেই চৈত্রিকাকে তুলে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়। চৈত্রিকা কতক্ষণ চোখ মুখ খিঁচে থাকে। প্রহর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ব্যাথা পেলে তো! নিষেধ করলাম শুনলে তো নাহ।’
চৈত্রিকা এবারও জবাব দেয় না। চোখে মুখে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আপনার আমাকে ঘৃ’ণা লাগে না জমিদার সাহেব? মুখের একাংশেও তো পু’ড়ে গেছে। সর্বাঙ্গ পু’ড়ে শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে। আমার মুখের দিকে তাকান কেমন করে? আমাকে ছুঁয়ে দেন কেমন করে?’
বলতে বলতেই হাঁপিয়ে ওঠে চৈত্রিকা। প্রহর এতক্ষণ কিছু না বললেও শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর নিজের হাত চৈত্রিকার মাথা থেকে সরিয়ে ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে,
‘সবাই শুধু এই একটাই কথা কেনো জিজ্ঞেস করে চৈত্র? সবাই তোমার বাহিরের পো’ড়া মুখ, অঙ্গ দেখেছে! আমার ভেতরের পো’ড়া কি কেউ দেখেছো? আমি তো তোমার থেকে এটা আশা করিনি চৈত্র। আমি ভেবেছিলাম তুমি বোঝো আমাকে। আমার ভেতরটা বোঝো। অনুভব করো আমার ভালোবাসা। তোমার এই বাহিরের পু’ড়ে যাওয়া সামান্য কিছুও আমাকে ছুঁতে পারেনি তাহলে ঘৃ’ণা করি কেমন করে? এতোগুলো দিনেও কি নিজের জমিদার সাহেবকে শুধু এতোটুকুই চিনেছো? তোমার জমিদার সাহেবের ভালোবাসা এটুকুই অনুভব করেছো?’
চৈত্রিকা মাথা নিচু করে বসে রয়। মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের করে নাহ। প্রহর নিঃশব্দে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে যায়। প্রহর চলে যেতেই চৈত্রিকা মুখে হাত চেপে ডুকরে ওঠে। চাপা স্বরে আওড়ায়,
‘আমার নিজেরই নিজেকে দেখতে ভীষণ ভয় লাগে জমিদার সাহেব। সেখানে আপনি আমাকে এতো সহজ ভাবে কেমন করে নেন? এতো ভালো কেনো বাসেন?’
কেবিনের বাইরে থেকে অর্থি আর নিবিড় সবটাই দেখে। অর্থি চৈত্রিকার কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে নিবিড়কে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘মাষ্টারমশাই! সত্যিই কি মানুষ এতো ভালোবাসতে পারে?’
নিবিড় নিঃশব্দে হাসে। চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে আরেক পলক তাকায় প্রহরের যাওয়ার দিকে। তারপর চমৎকার কন্ঠে বলে, ‘পুরুষ তার শখের নারীকে সবটা দিয়েই ভালোবাসে অর্থি। সামান্য আগুনে পু’ড়ে যাওয়া বাহিরটা তারা দেখে নাহ। যারা ভালোবাসতে জানে তারা দুনিয়ার কিছুই দেখে নাহ কেবল অপর মানুষের ভালোবাসাটা ছাড়া।’
অর্থিও হাসে। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভালোবাসা বোধহয় চৈত্রিকা-প্রহরের থেকে জানা উচিত। শিখা উচিত। বাহিরের সৌন্দর্য কেবলই একটা মোহ। যারা ভেতরটা ভালোবাসতে জানে তাদের কাছে বাহিরটা কিচ্ছুই নাহ।’
দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। তারাও তো বোঝে, উপলব্ধি করতে পারে ভালোবাসাটুকু।
৪৫.
চৈত্রিকাকে বাড়িতে আনা হয়েছে তারও প্রায় ১০ দিন পর। চৈত্রিকা মোটামুটি সুস্থই আছে। এখন উঠতে পারে, বসতে পারে, হাঁটতেও পারে তেমন একটা কষ্ট হয় নাহ। তাছাড়া তো সবসময় প্রহর ছায়ার মতো আছেই৷ অর্থি, নিবিড়, অর্পিতা, চিত্র ওরাও আপাতত গ্রামেই এসেছে। নীরার প্রেগ্ন্যাসির জন্য এতোদিন ঢাকায় যেতে পারেনি। তাই চৈত্রিকা ফিরার পর সে পাশ থেকে উঠেইনি। চৈত্রিকা মাঝে মাঝে ভীষণ অবাক হয়। এদের এতো ভালোবাসা দেখলে তার অবাক না হয়ে পারা যায় নাহ। এই যে তার মুখের এই অবস্থা! পুরো শরীরের এই অবস্থা অথচ এই বাড়ির মানুষগুলো তাকে এখন পর্যন্ত একটাও ক’টু কথা বলেনি। চৈত্রিকা নীরার দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ অনেকক্ষণ। নীরা চৈত্রিকার তাকানো দেখে বলে,
‘কি দেখেন ভাবিজান?’
চৈত্রিকা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘কিছু নাহ। আপনি ঘুমাবেন না বুবু?’
নীরা দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। রাত বেজে গেছে ১১ টা। প্রহর এখনো ফিরেনি! চৈত্রিকাকে রেখে সে তো কখনো দেড়ি করে না। নীরা কিছু বলবে তার আগেই ঘরে আসে প্রহর। নীরা হেঁসে মাথার আঁচল ভাালো ভাবে টেনে নিয়ে বলে,
‘আমি যাই। রাতে কোনো দরকার পড়লে আমাকে ডাকবেন ভাবীজান!’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। নীরা উঁচু পেটটা নিয়ে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। প্রহর দরজা আটকে এসে নিঃশব্দে চৈত্রিকার পাশের ফাঁকা জায়গাটায় শুয়ে পড়ে। টান টান হয়ে শুয়ে চোখের ওপর হাত রাখে। ওই দিনের পর প্রহর খুব একটা কথা বলে না চৈত্রিকার সাথে কিন্তু নিজের দায়িত্বে একটুও কমতি রাখে নাহ। সবসময় আগলে রাখে। চৈত্রিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ। তারপর নরম সুরে ডাকে,
‘জমিদার সাহেব!’
প্রহর চোখ মুখ খিঁচে পড়ে রয়। জবাব দেয় নাহ। সে ভীষন অভিমান করেছে। কথা বলবে নাহ আর এই পা’ষাণ মেয়েটির সাথে৷ তাকে কষ্ট দিয়ে কি সুখ পায় মেয়েটা! চৈত্রিকা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ প্রহরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় প্রহরের বুকে। প্রহর চোখ থেকে হাত সরিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। চৈত্রিকা বাচ্চাদের মতো আবদারের সুরে বলে,
‘উঠে বসুন না!’
প্রহর বিনা বাক্য ব্যায়ে উঠে বসে। চৈত্রিকার মতো করে খাটে হেলান দিয়ে বসে। চৈত্রিকা সাথে সাথেই প্রহরের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। প্রহর একটু চমকায়। চৈত্রিকা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে প্রহরকে। অভিযোগের সুরে বলে,
‘আপনি এমন কেনো হু! আমি না হয় করেইছি একটা ভুল তাই বলে কি এখন এভাবে দুরে সরে থাকবেন! আমার কষ্ট হয় না বুঝি! আমি আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পেয়েছিলাম তাই উল্টো পাল্টা চিন্তা করে ফেলেছি। ভুল হয়ে গেছে। মেনে নিয়েছি। এবার গাল ফুলিয়ে না থেকে নিজের বউজানকে মিষ্টি করে ডাকুন তো!’
প্রহর শুনলো। এবারও জবাব দিলো নাহ। চৈত্রিকা মাথা উচু করে প্রহরের দিকে তাকায়। কাঁদো কাঁদো মুখ করে প্রহরের দিকে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকাকে তাকাতে দেখে প্রহর বলে,
‘কথা বলছি না বলে কষ্ট হচ্ছে! জমিদার সাহেবকে পু’ড়ালে তো বউজানেরও পু’ড়তে হবে।’
চৈত্রিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। প্রহর চৈত্রিকার দৃষ্টি দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে। ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শক্ত কন্ঠে বলে, ‘শোনো মেয়ে! দ্বিতীয়বার কখনো তোমার মুখে ওই ধরনের কথা শুনলে আমি তোমাকে বাহিরে ফে’লে দিয়ে আসবো। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। আমার থেকে তোমার চেয়ে বড় কোনো সৌন্দর্য নেই৷ আমি পূর্বেও তোমাতে মুগ্ধ হতাম এখনও হই ভবিষ্যতেও হবো। এই মুগ্ধতাতে কোনো খাত নেই, কোনো চাহিদা নেই। শুধু রয়েছে এক আকাশ সমপরিমাণ ভালোবাসা।’
—
অর্থি আর নিবিড় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই বাতাস অনুভব করছে। অর্থি আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর নিবিড় তার বোকা চাঁদ কে দেখছে। দৃষ্টি এদিক ওদিক কোথাও নাহ। সরাসরি তার বোকা চাঁদের চোখ আর মুখের দিকে। অর্থি টের পায়। লজ্জায় নুইয়ে যায়। কন্ঠস্বর ধীর করে বলে,
‘চোখ ফিরিয়ে নিন মাষ্টারমশাই। আমার দমবন্ধ লাগে এই দৃষ্টিতে।’
নিবিড় ঠোঁট কামড়ে হাসে। অর্থির সাথে নিজের দূরত্ব মিটিয়ে নিয়ে অর্থির চুল গুলো কপাল থেকে সরিয়ে দেয়। ঠোঁট ছোঁয়ায় কপালে। অর্থি অনুভব করে। নিবিড় ওভাবে থেকেই বলে,
‘তোমাকে দেখলে আমার মন ভরে না কেন অর্থি? ইচ্ছে করে তোমাকে বুকের মাঝে ঢুকিয়ে রাখি। তোমাকে কেউ না দেখুক! আমি আজীবন দেখে যাই৷ এভাবেই!’
অর্থি লজ্জা পায়। মাষ্টারমশাইটা অদ্ভুত! এভাবে কেউ মুখের ওপর এসব বলে! তার বুঝি লজ্জা করে না! অর্থিকে লজ্জা পেতে দেখে নিবিড় শব্দ করে হেঁসে ফেলে৷ অর্থি নাক ফুলিয়ে তার দিকে তাকায়। নিবিড়ের পেটে গুতো দিয়ে বলে,
‘আপনি ভীষণ পঁচা মাষ্টারমশাই। সবসময় আমাকে লজ্জা কেনো দেন?’
‘লজ্জা পেলে তোমাকে আরো বেশি সুন্দর দেখায় বোকা মেয়ে। তাই তো ইচ্ছে করে তোমায় লজ্জা দেই৷ এই মেয়ে সবসময় মুখটা এমন লজ্জারাঙা করে রাখতে পারো না!’
অর্থির রীতিমতো কান দিয়ে গরম ধোঁয়া উঠতে থাকে৷ দু হাতে নিবিড়কে ধা’ক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে সরে যায়। ঘর থেকে শুনতে পায় নিবিড়ের হাসির শব্দ। ইসস কি ভ’য়ং’কর লোক! তাকে লজ্জায় ফেলে আবার হাসে!
—
চিত্র আর অর্পিতা পাশাপাশি শুয়ে আছে। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই। দুজনেই হয়তো কিছু ভাবছে! একটা সময়ে অর্পিতা চিত্রর দিকে ফিরে শোয়। ঠান্ডা গলায় বলে,
‘বড় ভাবীজানের সাথে যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি তাই নাহ চিত্র ভাই! উনার প্রাপ্তিতে তো এগুলো নেই। উনি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন ভীষণ ভাবে। এতোটা কষ্ট পাওয়ার নয়। বড় আব্বু এতো পা’ষাণ ছিলো কেনো? একটা মেয়েকে পু’ড়িয়ে দিতে উনার হাত কাপে নাই?’
চিত্র ঘাড় ফিরিয়ে অর্পিতার দিকে তাকায়। মুচকি হেঁসে বলে, ‘যে মানুষটা তার নিজের ছেলেদেরও ক্ষ’তি করতে দুবারও ভাবে না তার কি অন্য কাউকে মা’রার সময় হাত কাঁপতে পারে?’
অর্পিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মানে!’
চিত্র হাসে। শোয়া ছেড়ে উঠে বসে অর্পিতার মাথায় দু বার হাত বুলায়। তারপর নিচু হয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘এতো ভাবিস নাহ। যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। সবকিছুর পেছনে একটা বড় কারণ থাকে। এই দেখ না! আজ বড় ভাবীজানের এমন না হলে কি বড় ভাইজানের নিঃস্বার্থে উন্মাদের মতো ভালোবাসা প্রকাশ পেতো?’
অর্পিতা বোকার মতো দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে হাসে। বলে, ‘তা কিন্তু ঠিক চিত্র ভাই। বড় ভাইজান আর বড় ভাবীজানের ভালোবাসা দেখলেও শান্তি লাগে।’
চিত্র হাসে। অর্পিতাকে ঘুমাতে বলে মাথায় হাাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই অর্পিতা ঘুমিয়ে পড়ে। চিত্র অর্পিতার মাথাটা নিজের বুকে গুজে নিয়ে মাথায় একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দেয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘অনেক সত্য তুই জানিস না অর্পি। সেদিন রাতে আমাকে অন্য কেউই না আব্বাজান নিজেই আটকে রেখেছিলেন। সেই অন্ধকারে কাটানো দিনগুলো আমি ভুলতে পারবো না। একজন বাবা কতোটা নি’ষ্ঠুর হতে পারে তা আমি কখনোই ভুলবো নাহ। আমি সেই সব দিনগুলোতেও তোকে চেয়েছি আর পেয়েছিও। আমি তোকে আজীবন এভাবেই আগলে রাখবো। তুই কখনোই জানবি না তুই জমিদার বাড়ির মেয়ে না বলেই আব্বাজান তোর আর আমার বিয়েতে মত দিতে চাননি। তোর মনে আজীবন এটাই থাকবে তুই জমিদার বাড়ির মেয়ে এবং পুত্রবধূ। চিত্র রেনওয়াজের অর্ধাঙ্গিনী।’
—
পরিশিষ্টঃ
দিন, মাস, বছর পেড়িয়েছে। নীরার একটা মেয়ে হয়েছে। বয়স ৪ এর দিকে। চৈত্রিকা আর অর্পিতা দুজনেই প্রেগন্যান্ট। চৈত্রিকার ৮ মাস চলে আর অর্পিতার ৫ মাস। অর্থি আর নিবিড় শহরে থাকে। চিত্র, অর্পিতা গ্রামে। চৈত্রিকা আর অর্পিতার প্রেগ্ন্যাসির খুশিতে সবাই বাড়িতে জড়ো হয়েছে। মাস খানেক থাকবে সবাই। অর্থি তো বায়না করে বসেছে চৈত্রিকার বাবু না হওয়া পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়বেই নাহ। নিবিড় শুধু ক’দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। সেই বোকা অর্থি কিন্তু এখন পাকা গিন্নি হয়ে গেছে। ৪ বছরের মতো হয়ে গেছে চৈত্রিকার পু’ড়ে যাওয়া মুখ, অঙ্গের। তবুও এ বাড়ির মানুষগুলো তাকে কোনো রকম ক’টু কথা না বলে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছে। বিকেল তখন ৪ টা। সূর্য কিছুটা হেলেছে পশ্চিমের দিকে। ভ্যাপসা গরমে বাহিরে থাকার জো নেই। অথচ এই সময় চৈত্রিকা বায়না করছে সে বাহিরে যাবে। গ্রামের মাঝে হাঁটবে। প্রহর নিষেধ করলেও তা মানে নাহ। অগত্যা বাধ্য হয়েই হাতের ভাজে হাত রেখে প্রহর চৈত্রিকাকে নিয়ে আসে গ্রামের মাঝে। চৈত্রিকা মাথায় শাড়ির আঁচল ভালো মতো টেনে নিয়ে মুখের একাংশ ঢেকে রাখে। প্রহর চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘মুখ ঢাকো কেন চৈত্র? আঁচল টা সরাও!’
‘কিন্তু..’
‘সরাও!’
বাধ্য হয়ে চৈত্রিকা আঁচল সরায়। বাগানের ছায়ায় এসে দুজনেই দাঁড়ায়। চৈত্রিকা স্মৃতিচারণ করে। এই গ্রামের মাঝে সে কতবার সাথীর সাথে এসেছে। দু বোন কতো শতো গল্প জমিয়েছে। এখন সবই স্মৃতির পাতায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই আর। চৈত্রিকাকে মন খারাপ করতে দেখে প্রহর শুধায়,
‘সাথীকে মনে পড়ছে?’
চৈত্রিকা চুপ থাকে। প্রহর শক্ত করে চেত্রিকার হাত ধরে নিজের দিকে ফিরায়। চোখ মুখ ছুঁইয়ে দিয়ে বলে, ‘মন খারাপ করো নাহ। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন।’
চৈত্রিকা হাসার চেষ্টা করে। কি মনে করে বলে, ‘একটা প্রশ্ন করি জমিদার সাহেব?’
‘হুম!’
‘আপনার মনে আছে আপনি বলেছিলেন নিবিড় ভাইজান সাদিক কাকাকে মা’রতে সাহায্য করেছিলো!’
‘হুম মনে আছে।’
‘উনি কেনো মা’রতে সাহায্য করেছিলো? উনার কি লাভ? কিভাবেই বা কি হলো?’
প্রহর অদ্ভুতভাবে হাসে। দৃষ্টি সামনে ফিরিয়ে দু হাত পেছনে নিয়ে সিনা টান করে দাঁড়ায়। শান্ত গলায় বলে, ‘নিবিড় প্রথম থেকেই সব জানতো। আমার সাথেই তো থাকতো সবসময়৷ ওইদিন শুধু আমার কথায় সে আর আমার আরো কিছু লোক মিলে কাকাকে মে’রেছে। ব্যাক্তিগত কোনো শ’ত্রুতা নেই৷ কতবার পিয়াসকে পি’টিয়েছে ওরা! পিয়াস কখনো ওদের মুখ দেখতে পায়নি৷ মুখ দেখতে পেলে সবার আর নিস্তার ছিলো নাহ।’
চৈত্রিকা হেঁসে ফেলে। প্রহর চট করে তাকায় তার দিকে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। প্রেগন্যান্সির কারণে হুট করেই মেয়েটা একটু সুন্দর হয়ে গেছে। মুখ চোখ চকচক করে। প্রহরকে এভাবে তাকাতে দেখে চৈত্রিকা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কি?’
প্রহর ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে বলে, ‘তুমি দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছো বউজান!’
চৈত্রিকার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। প্রহর বুঝতে পারে চৈত্রিকার মন খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েটাকে এতো বলার পরও মেয়েটা তার মুখের দাগগুলো নিয়েই ভাবে। তাকে নিয়ে কেনো ভাবে না! ভীষণ রাগ হয় মাঝে মাঝে। তার এতো বুঝদার বউটা নিজের বেলায় এতো অবুঝ কেনো হয়! প্রহর চৈত্রিকার এলোমেলো চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে চমৎকার কন্ঠে বলে,
‘তোমার কি মনে হয় তোমার এই দাগগুলো আমার মনে দাগ কাটে? শোনো বউজান! আমার কাছে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। লোকে বলে না, চাঁদেরও কলঙ্ক আছে! ফুলেও তো কাটা আছে। তবুও তো মানুষ চাঁদ, ফুল মুগ্ধ হয়েই দেখে! তেমনই আমার বউজানেরও না হয় কিছু দাগ আছে তাই বলে কি আমি মুগ্ধ হবো না? আমার বউজানের মতো সুন্দরী নারী কয়টা আছে শুনি!’
চৈত্রিকা প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি এতো ভালোবাসেন কেনো জমিদার সাহেব?’
‘জানলে তো আমি নিজেই ধন্য হয়ে যেতাম। এবার চলো!’
দুজনেই রাস্তায় নামে। হাঁটতে থাকে একসাথে। চৈত্রিকার হাতটা প্রহরের হাতের মুঠোয়। একটু এগোতেই একটা দমকা হাওয়ায় চৈত্রিকার মাথার কাপড় সরে যায়। রোদ এসে সরাসরি লাগে চৈত্রিকার মুখের ওপর। প্রহর তাকায়। মনে পড়ে যায় চৈত্রিকার সাথে তার প্রথমদিনের দেখা। সেদিনও এভাবেই রোদ তার মুখে আড়াআড়ি ভাবে পড়েছিলো। প্রহর মুচকি হেঁসে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘চৈত্র মাসের তীব্র রোদের তেজের মতোই আমার চৈত্রিকা।’
সমাপ্ত..