#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৩]
–“এইযে, নিকাব রাণী। গতকাল কী তুমি-ই আমাকে হামলার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে?”
তরী হঠাৎ থমকে যায়। পিছে ফিরে একপলক তাকায় সিদাতের দিকে। সিদাত নীরবে চেয়ে রইলো সেই চোখ জোড়ার দিকে। কাজলে আঁকা অদ্ভুত সুন্দর চোখ জোড়া। মায়াবী, অনবদ্য। এই চোখ জোড়ার উপমা দিতে আপাতত সে ব্যর্থ। সিদাত নিজের অজান্তেই সেই চোখের গভীরে প্রবেশ করতে চাইলো যেন। তবে সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। সিদাতকে অগ্রাহ্য করে তরী হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। ঠিক অনয়ের পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েই দাঁড়ায়। সিদাত তার উত্তর পেয়ে গেছে। অধর বাঁকিয়ে হাসলো সিদাত। হয়তো-বা মেয়েটি স্বল্পভাষী অথবা অন্য স্বভাবের। তবে সিদাতের ভীষণ ভালো লাগলো।
——————-
–“আজ মনে হলো ওই মেয়েটাকে দেখেছি!”
অনয় চুইংগাম চিবুতে চিবুতে সিদাতের দিকে চাইলো। সিদাত তখন মাথা নিচু করে ফোন স্ক্রল করছে। অনয় ভ্রু কিছুটা কুচকে বললো,
–“কোন মেয়ে?”
–“যার বিবরণ সকালে দিলি। তবে নিকাব পরা ছিলো!”
অনয় হাসতে শুরু করে সিদাতের কথা শুনে। বললো,
–“ভুলেও ওদিকে নজর দিস না বন্ধু। জীবন ছারখাড় হয়ে যাবে, একদম সন্ন্যাসী বানিয়ে ছাড়বে তোকে!”
সিদাত এবার ফোন রেখে ভ্রু কুচকে তাকালো অনয়ের দিকে। অনয় তখনো হাসছে। সিদাত থমথমে সুরে বললো,
–“মানে কী?”
–“মানে হচ্ছে ওটা পুরা হুজুর ফ্যামিলি। ওই মেয়ের বাপ কোনো এক মাদ্রাসার শিক্ষক মনে হয়৷ এখন উমরাহ্ করতে গেছে। মেয়ে দুটোও সারাক্ষণ পর্দার আড়ালে থাকে। তাই পুরো জীবন সাধনা করলেও মনে হয় না এই মেয়ের মুখ দেখতে পারবি!”
সিদাত মহা বিরক্ত হলো অনয়ের কথায়। ভারী কন্ঠে বললো,
–“তাতে আমার কী? আমি এসব জানতে চেয়েছি নাকি? পর্দা করছে, প্র্যাক্টিসিং মুসলিম। আই রেসপেক্ট হার। তুই এভাবে বলছিস যেন আমি সত্যি সত্যি প্রেমে পরেছি?”
–“প্রেম তো আর সময় দেখে না। সে যেকোনো ভাবেই হোক মানুষকে তার ফাঁদে ফেলে। তাই বন্ধু, তুই সাবধান হ। মনে রাখিস, এই প্রেমের বাঁশ আমিও একসময় খেয়ে এসেছি। এই বাঁশ মারাত্মক শক্ত। ব্যথা ভুলাতে কারো বছরখানেক তো কারো পুরো জীবন লেগে যায়।”
সিদাত অনয়ের মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে,
–“ভুল মানুষের প্রেমে পরলে এই অবস্থা হবেই। পার্টনার আবেগের বশে চুজ না করে বিবেক দিয়ে চুজ করতে হয়। এখন থাক। আমি অফিস যাচ্ছি!”
বলেই সিদাত চলে যাচ্ছিলো, হঠাৎ থেমে পিছু ফিরে অনয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমি ওই মেয়ের প্রেমে পরবো না রে অনয়। দেখে নিস!”
অনয় তখন মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–“কিন্তু আমার মন বলছে তুই পরবি। মন তো আর সবসময়ের জন্যে খাচায় বন্দি থাকে না। একদিন না একদিন সে মুক্ত হয়-ই। এখন হয়তো তোরটার মুক্ত হওয়ার সময় হয়ে এসেছে!”
সিদাত গরম চোখে চাইলো অনয়ের দিকে। অনয় চোখ জোড়ায় দুষ্টুমি ফুটিয়ে চোখ টিপ দিলো। সিদাত অনয়ের থেকে চোখ সরিয়ে গ্যারেজের ছেলেটাকে বললো,
–“ভাই, কত টাকা?”
গতকাল রাতে তাড়াহুড়ো করায় বাইকের বেশ কিছু ক্ষতি হয়েছে। টায়ারটাও লিক৷ যেন কেউ ইচ্ছাকৃত করে রেখেছে। এজন্যে আশেপাশের এক গ্যারেজে এনে বাইকটাকে আবার রিকোভার করলো। সিদাতের বড্ড সখের এই বাইক। এই বাইকের জন্যে তার মন যে কত কাঁদতো। কিন্তু সিদাত কখনো বাবার কাছে চাইতে পারেনি। জড়তা কাজ করতো। বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে সে। বাবার মুখের ওপর কখনো কিছু বলেনি। বাবাও তাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু কোথাও না কোথাও ভয়, আড়ষ্ট কাজ করে। সেটা একমাত্র বাবার জন্যেই। বাবা যেমন ভালোবাসার তেমনই হালকা-পাতলা ভয়েরও।
সিদাত বেশ কয়েকবার ফোন দেখলো। বাবাকে কল দিতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে,
–“বাবা, আমি একদম সুস্থ আছি। এখন অফিসে যাচ্ছি। আমার শো শুনবে তো? তুমি ফ্রী থাকলে শুনে নিও তো বাবা। যদি কোথাও ভুল হয় ধরিয়ে দিও।”
সিদাত ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল পকেটে পুরলো। আজ সারাদিন বাড়ী যাওয়া হয়নি। অনয়ের সাথেই ছিলো। বাবাকে না সিদাত ফোন করেছে আর না বাবা সিদাতকে। এক অদৃশ্য দেয়াল দুজনের মাঝে সবসময় গলায় কাটার মতো আটকে আছে। তবে সিদাত নিশ্চিত, তার প্রতিটি মুহূর্তের খবর কোনো না কোনো উপায়ে বাবার কাছে ঠিকই পৌঁছাচ্ছে। নয়তো বাবা তো একবার হলেও কল দিতো।
এসব আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে সিদাত বাইকে উঠে বসলো। তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। সিদাত সবেই ফোনটা পকেটে পুরতে নিচ্ছিলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই সিদাতের চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। চটজলদি কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরলো। মৃদু কন্ঠে বাবাকে সালাম দিলে সাঈদ সাহেব সালামের উত্তর নিলো৷ অতঃপর খুব শান্ত, শীতল গলায় বললো,
–“অফিস থেকে তাড়াতাড়ি এসো। একসাথে ডিনার করবো আব্বু। আমি অপেক্ষা করছি।”
তৃপ্তি, ভালো লাগায় সিদাতের মন-প্রাণ শীতল পানির ন্যায় হয়ে গেলো। সিদাত কোনো রকমে আওড়ালো,
–“আচ্ছা বাবা।”
শুধুমাত্র এইটুকু কথপোকথন। তাও এই অল্প-স্বল্পতে কতশত অনুভূতি, শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসা মিশে আছে।
অফিস পৌঁছাতেই সিদাতের আরেকটা কল এলো। কলটি ছিলো সাইফের। সিদাতের বড়ো ভাই। সিদাত কল রিসিভ করতেই সাইফ ব্যস্ত সুরে বললো,
–“ভাই আমার। তুই ঠিকাছিস তো? তোর লাগেনি তো? কোথায় আছিস?”
সিদাত চারপাশে একনজর চেয়ে বললো,
–“অফিসে। আর আমি একদম ঠিকাছি ভাইয়া। চিন্তা করো না!”
–“চিন্তার কী শেষ আছে রে? রাজনীতি ঢুকে মনে হচ্ছে সারা গায়ে বিষ নিয়ে চলাফেরা করছি। একদম দম বন্ধকর অবস্থা। আবার নাকি বাবাও আমায় এখনই বিয়ে দিবে। কোনো মানে হয়?”
একসঙ্গে সব বলে সাইফ থামলো। সিদাত সব মনোযোগ দিয়ে শুনে হেসে দিলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“রাজনীতি তুমি নিজে পছন্দ করেছো। তাই বিষ বহন করতে হবেই। আর রইলো বিয়ের কথা। দ্রুত বিয়েটা করো তো। তোমার কারণে আমার সিরিয়াল আসছে না।”
ওপাশ থেকে সাইফ অবাক সুরে বললো,
–“নিজের স্বার্থে আমাকে বলির পাঠা বানাবি? ছিঃ সিদাত। তোকে ভালোবাসার এই ফল দিলি?”
–“নাটক কম করে বলো, বিয়ে কেন করতে চাচ্ছো না? কোনো পছন্দ আছে নাকি?”
–“ছিলো তো স্কুল জীবনে। এরপর মন মতো পাই না আর। এজন্যে একটু ঘাবড়ে আছি, বাবা আবার কোন খালাকে আমার বউ করে আনে!”
–“কোনো খালা আনবে না। বাবার পছন্দে বিশ্বাস রাখো। আর হ্যাঁ, আমার শো শুরু হতে আর মাত্র কিছুক্ষণ বাকি। বাসায় গিয়ে কথা হবে।”
–“হ্যাঁ, তা তো বাবার কানে ব্লুটুথ দেখেই বুঝলাম শো শুরু হতে যাচ্ছে। যেভাবে ঘটা করে বসেছে!”
সাঈদ সাহেব ছোটো ছেলের কোনো শো মিস দেননি। অসম্ভব কাজের চাপেও এক কানে ব্লুটুথ থাকবেই। ছেলের বচন-ভঙ্গি, পটু কথা শুনলে তার ভেতরের ক্ষতটা মিলিয়ে যায়। চোখ বুজে অনুভব করে সে ছেলেকে। ছেলে ভালোবেসে যা করে সাঈদ সাহেব তা ভালোবেসে উপভোগ করে। কী সুন্দর, অমায়িক বাবা-ছেলের সম্পর্ক। নীরবে, অপ্রকাশ্যে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ হয়। সবসময় তো মেয়ে-বাবার ভালো সম্পর্ক-ই দেখা যায়। বাবা-ছেলের ভালোবাসা কতজন-ই বা দেখে এবং প্রসংশা করে?
সাইফের কথায় সিদাত আত্মতৃপ্তি, অনুপ্রেরণা, মনোবল পেলো। এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে অধর জোড়ার কোণে। অনুভূতি কীভাবে ব্যক্ত করতে হয় তা সিদাতের জানা নেই। তবে সে ব্যক্ত নয় অব্যক্ততে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে শো এর প্রস্তুতি নিতে চলে গেলো।
————————————–
সাঈদ সাহেব হাতে ফাইল নিয়ে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। কানে তার ছেলের পটু কথা বাজছে। ছেলে তার শো-তে ব্যস্ত৷ আর সাঈদ সাহেব ব্যস্ত তা উপভোগ করতে। কাজ তো বাহানা মাত্র। এমন সময়ই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এলো ফিরোজ খাতুন। সাঈদ সাহেব তাকে লক্ষ্য করেনি। তিনি সাঈদ সাহেবের সামনে চা রাখতেই সাঈদ সাহেবের বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেলো। তাও তিনি একবারের জন্যেও ফিরোজা খাতুনের দিকে তাকালো না। ফিরোজা এতে তপ্তশ্বাস ফেললো। এগুলো এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনুভূতি গুলো সে কবেই মাটিচাপা দিয়েছে সে।
কিছু না বলেই ফিরোজা খাতুন চলে যেতেন। কিন্তু তার মনটা অশান্ত, উশখুশ করছে। কিছু একটা প্রশ্ন করার জন্যে অস্থির হলেও তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। অনেকটা সংশয়ে। তাও নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে ফিরোজা খাতুন নিচু গলায় বললো,
–“শুনছেন! শুনলাম, সিদাত বাবার ওপর হামলা হয়েছে। ও ঠিকাছে তো? সে বাড়ি আসেনি কেন?”
ফিরোজা খাতুনের কন্ঠস্বর যেন সাঈদ সাহেবের সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে তুললো। তাও নিজেকে সংগত করে বললো,
–“ভালো আছে। অফিস শেষে ফিরবে। আপনি রান্না-বান্না করতে চাইলে করতে পারেন!”
ফিরোজা আহত নজরে চাইলো সাঈদ সাহেবের দিকে। তার কথায় কেমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব। ফিরোজা খাতুন আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। যেতে যেতে ঠিকই দুই ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। সাঈদ সাহেবের ব্যবহার আজও বদলালো না। সে এখনো তার প্রথম স্ত্রীতে মত্ত। এ নিয়ে তো ফিরোজার কোনো অভিযোগ নেই। সে তো একটু সম্মান, ভালো মনোযোগ চায়। আর কিছু তো জীবনে চায়নি। সন্তানের জায়গায় সিদাত, সাইফকে বসিয়েছে। তাদের মায়ের মমতা দিচ্ছে। তাও তার মধ্যে কিসের কমতি? সে সাঈদ সাহেবের প্রথম স্ত্রী নয় বলে?
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]