হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-১১+১২

0
427

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১১]

সিদাত অফিসে আসতেই দেখলো এখনকার জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর জারা বসে আছে। যার ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি শর্ট ফিল্ম এবং নাটক বেরিয়েছে। কিছু সপ্তাহ আগে এক টপিকে দারুণ ভাইরালও হয়েছে জারা। সিদাতকে দেখতেই জারা উঠে দাঁড়ালো। মুখে তার অমায়িক হাসি। সিদাত কাঁধে থাকা ব্যাগের হাতল ধরে এগিয়ে এলো জারার কাছে। যেহেতু সিদাতকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে সেহেতু সিদাতের সাথেই জারা কথা বলতে আগ্রহী। সিদাত সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
–“আরেহ, জারা আহসান! কী মনে করে? কোনো শো-এর গেস্ট হয়েছেন নাকি?”

জারা স্মিত হেসে বললো,
–“তা বলতে পারো। মিস রাজিয়ার কুইজ শো-তে গেস্ট হিসেবে এসেছি। তবে তার চাইতেও বড়ো কারণ হচ্ছে তুমি!”

সিদাত কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। তাও হেসে বললো,
–“আমি কী করে কারণ হলাম?”

জারা এবার মুখে একটু অভিমানী ভাব ফুটিয়ে বললো,
–“আমাকে না বলে সেদিন পার্টি ছেড়ে চলে এলে কেন? জানো, কতটা হার্ট হয়েছি? আমার বার্থডে পার্টি ছিলো। তুমি ছিলে স্পেশাল গেস্ট। আপ্যায়ন করার আগেই দেখি তুমি নেই। এটা কী ঠিক হলো?”

সিদাত অত্যন্ত দুঃখিত গলায় বললো,
–“সো স্যরি! সেদিন কিছু ইন্সিডেন্ট ঘটে গিয়েছিলো এজন্যে আপনাকে না বলেই চলে আসতে হয়েছিলো। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”

সিদাতের মুখে “স্যরি” শুনতে পেয়ে জারার মুখ জুড়ে অমায়িক হাসি ফুটে ওঠে। সিদাত জারার দিকে না তাকিয়ে এদিক সেদিক এলোমেলো নজর ফেলছে। জারা সিদাতের সাথে আরও কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে চলে গেলো। সহজে যেত না, কিন্তু শো-এর সময় প্রায় হয়ে আসায় তাকে মেকাপ রুমে যেতে হবে।

জারা যেতেই সিদাত চেপে রাখা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে সিদাত তার ডেস্কে চলে গেলো। সিদাত বসতেই তার কলিগ রাতুল হেসে হেসে বললো,
–“জারা আহসানের দেখছি বেশ ইন্টারেস্ট তোমাকে নিয়ে!”

সিদাত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তাতে চুমুক দিয়ে বললো,
–“আমার তো মনে হয় না!”

রাতুল আজকের স্ক্রিপ্টের ফাইল সিদাতের সামনে রেখে মুচকি হেসে বললো,
–“জারার বার্থডেতে যেতে তোমাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছিলো। নিজে এসে ইনভাইট করেছে। আবার পার্টিতে তুমি কোনো কারণে মিসিং হওয়াতেও কিছুটা অস্থির ছিলো। তাহলে এগুলার মানে কী আর-জে সিদাত?”

সিদাত আড়চোখে রাতুলের দিকে চেয়ে পরমুহূর্তে স্ক্রিপ্টে নজর বুলিয়ে বললো,
–“এজ এ ফ্রেন্ড, এগুলা ন্যাচারাল। তোমার এসব না ভাবলেও চলবে রাতুল। তুমি এডিটিং-এ ফোকাস করো!”
রাতুল এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
–“তা তো দিবোই। তবে সিদাত, পারলে মেয়েদের সাথে একটু চিপকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলিও। আজকালকার মেয়েরা তিন আঙুল দূরে থাকা কোনো ছেলের সাথে ছবি তুলে না।”

সিদাত এ-কথায় হাসতে বাধ্য হলো। রাতুলও হাসতে হাসতে তার ডেস্কে চলে গেলো। রাতুল চলে গেলে সিদাত স্ক্রিপ্টের ফাইলে চোখ বুলালো। হঠাৎ মস্তিষ্কে নাড়া দিলো তরীর ব্যাপারটা। সিদাত ফোস করে নিঃশ্বাস ফেললো। পরমুহূর্তে কী ভেবে সিদাত আপনমনে হেসে দিলো। মিনমিন করে বললো,
–“অভদ্র মেয়ের সংকট থাকলে এই দুনিয়া চলতো না রাতুল। এখনো কিছু ভদ্র মেয়ে আছে, যারা বাসে নিজের পাশের সিটেও পরপুরুষ সহ্য করতে পারে না! চেহারা তো কখনোই দেখায় না!”

সিদাত তার শো শেষ করে বেরিয়ে আসতেই দেখলো সাইফ দাঁড়িয়ে। চুল এলোমেলো, মুখটাও কেমন শুকনো! সিদার অপ্রস্তুত হলো। উৎকন্ঠা হয়ে বললো,
–“কী ব্যাপার ভাইয়া? আজ হঠাৎ অফিসে এসে হাজির?”

মুহূর্তে-ই সাইফের মুখখানা লাল হয়ে গেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
–“অনুগ্রহপূর্বক আপনার ফোনটা চেক করুন ছোটো ভাইয়া!”

সিদাত বেশ স্বাভাবিক ভাবেই পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো সাইফের প্রায় তেরোটা মিসড কল। সিদাত ফোন আবার পকেটে পুরে বললো,
–“শো-তে থাকলে আমার ফোন সাইলেন্ট থাকে ভাইয়া। জানো না?”

সাইফ জানলেও আজ একটু আবেগী হয়েছিলো। সিদাতকে কলে না পেয়েই মূলত সিদাতের অফিসে চলে এসেছে। এসে জানতে পারে সিদাতের শো চলছে। সিদাত ভ্রু কুচকে বললো,
–“কী লাগবে বলো?”

–“তোর ছুটি। আয় আমার সাথে। দুঃখবিলাস করবো!”

সাইফ লম্বা লম্বা পা ফেলে যেতে থাকে। সিদাতের ব্যাগটা সাইফের হাতে। এর মানে সাইফ নিজ দায়িত্বেই সিদাতের সব গুছিয়ে দিয়েছে। সিদাত সাইফের পেছনে যেতে যেতে বললো,
–“আমার তো কোনো দুঃখ নেই ভাইয়া। আমি দুঃখবিলাস করে কী করবো?”

সাইফ কোনো উত্তর দিলো না। শুধু ঠোঁট কামড়ে রাখলো। ভাইয়ের রসিকতা সে ঠিকই ধরতে পেরেছে।

সিদাত বাইরে এসে সাইফের হাতে গাড়ির চাবিটা দিতে চাইলো। কিন্তু সাইফ সিদাতকে অগ্রাহ্য করে ফন্ট সিটে গিয়ে বসলো। সিদাত কিছু না বলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। পাশে চাইতেই দেখলো সাইফ চোখ বুজে সিটে মাথা এলিয়ে রেখেছে। সিদাতের একটু খারাপ লাগলো। গত দু’দিন সাইফের গাড়ি সিদাতের কাছেই ছিলো। নির্ঘাত সাইফের চলা-ফেরায় খুব সমশা হয়েছে? সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গত বছরেই সিদাত ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে। এজন্যে বাইক এবং গাড়ি দুটোই নির্ভয়ে চালাতে পারে সে।

সিদাত ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিয়ে বললো,
–“এত অস্থিরতার কারণ কী ভাইয়া?”

সাইফ সরাসরি উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করেই রইলো। সিদাতও সাইফকে সময় দিলো। সাইফ হঠাৎ সটান মেরে বসে বেশ আফসোসের সুরে বললো,
–“দুনিয়াতে এমন কোনো মেয়ে নেই যে আমার মতো ফ্রেশ? কেন বারবার নিরাশ হচ্ছি বল তো?”

সিদাত সাইফের কথা শুনে বললো,
–“সবেমাত্র মেয়ে দেখা হলো তিনটা। তুমিএত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? বিয়ে করার জন্যে এত উতলা?”

সিদাতের শেষ কথা শুনে সাইফ কিছুক্ষণ থমকে বললো,
–“ক..কই? না-তো! একদমই তাড়া নেই বিয়ের!”

–“তাহলে ব্যস্ত হওয়ারও দরকার নেই। উপরওয়ালা যাকে তোমার জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছে তাকেই পাবা!”

সাইফ গালে হাত দিয়ে বললো,
–“সেই নির্ধারিত নারী যে কবে আসবে জীবনে।”

সিদাত একগাল হাসলো। সাইফ দুই মিনিট নীরবতা পালন করে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে আলাপ শুরু করে দিলো। সাইফ তার পরিবারের কাছে যতই বাচ্চামো করুক না কেন বাহিরের জগতে সে অত্যন্ত কঠোর থাকার চেষ্টা করে। ভালোবাসা একমাত্র তার পরিবারের জন্যেই নির্ধারিত। বাহিরের মানুষ এই নরম ভালোবাসার মূল্য কখনোই দিবে না। কারণ, নরম মানুষের ওপরই শক্ত আঘাত বেশি হয়!

তরী পরেরদিন-ই ভার্সিটি যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগলো। ফুপি এবং সাবিয়া অসংখ্যবার তাকে বারণ করেছে। কিন্তু তরীর যাওয়াটা জরুরি। ফুপি কেঁদে দিবে ভাব। একা মেয়ে মানুষ, জ্বর এখনো সারেনি। তার ওপর এই জ্বরে মেয়েটার শরীর ভেঙে গিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করে না। একদিনেই কী সুস্থ হওয়া যায়? ফুপি পরেছে মহা মুশকিলে।

ফুপির মুখ-জুড়ে কাঁদো কাঁদো ভাব থাকলেও সাবিয়ার চোখের কোণ চিকচিক করছে অশ্রুতে। তরী মুখ গোমড়া করে তাদের অবস্থা দেখেও না দেখার ভান করছে। তরীর ভাষ্যমতে, রোগমুক্ত হতে হলে পরিশ্রম করতে হবে, বাহিরের আলো-বাতাস না পেলে শরীর সুস্থ হবে কী করে? কিন্তু এসব কেউ কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না।

তরীও নিরুপায়। আজ চারুকলা বিভাগে সুন্দর প্রতিযোগিতা আছে। তরী তাদের রঙিন, সুন্দর ছবি দেখার জন্যে ব্যাকুল, তৃষ্ণার্ত। গত দুই বছরে একবারও এই প্রতিযোগিতা মিস করেনি। এবার জ্বরের কাছে হার মেনে কিছুতেই প্রতিযোগিতা মিস দিতে চায় না। তাই শত কষ্ট হলেও চোখ এবং মনের শান্তির জন্যে হলেও তাকে যেতেই হবে।

তরী আসল সত্যটা সাবিয়া বা ফুপিকে খোলাশা করে বলেনি। শুধু এটুকুই বলেছে যাওয়াটা অত্যন্তি জরুরি। তরী তৈরি হয়ে সদর দরজা খুলে বেরুলো। তরীর পিছু পিছু সাবিয়া এবং ফুপিও এসেছে। তরী কোনো দিকে না তাকিয়ে দুই সিঁড়ি নামতেই মনে হলো তার পাশ কাটিয়ে কেউ একজন উঠছে। হঠাৎ পুরুষালি নরম কন্ঠ কানে আসতেই তরী থমকে দাঁড়ালো। কেউ যেন চাপা স্বরে ডাকলো,
–“নিকাব রাণী!”

তরী চট করে পিছে ফিরে তাকালো। পুরুষ অবয়বের মুখপানে চাইতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। ফুপি সিদাতকে দেখে বেশ আকুল গলায় বললো,
–“অবস্থা দেখো বাবা। মেয়েটার জ্বর এখনো সারেনি। তাও কী না এই অবস্থায় দেড় ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে ভার্সিটি যাবে। এসবের কোনো মানে হয় বলো তো? কত করে বললাম শুনলোই না!”

তরীর চিন্তায় অস্থির হয়ে ফুপি কাকে কী বললো বুঝতে-ই পারলো না। যেন সে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছে। অথবা সিদাতকে বেশি আপন ভেবে ফেলেছে। সিদাতের সামনে ফুপির মুখে এসব কথা শুনে তরী লজ্জায় জর্জরিত হয়ে পরলো। জড়তায় মাথা নিচু হয়ে গেলো তার। পরপুরুষের সামনে ফুপি তাকে নিয়ে এভাবে অভিযোগ করছে। তরীর ভেতরটা কেমন গুলিয়ে আসছে। এই কারণে তরী আর ভার্সিটিতে যাওয়ার সাহস করলো না। ফুপির এই ধরণের কথাবার্তায় সিদাতের পালটা কোনো কথা তরী হজম করতে পারবে না। অথচ সিদাত কিছুই বললো না। নীরবে চেয়ে রইলো তরীর দিকে। আপাতত তার মন জানতে চাইছে তরীর সুস্থতার ব্যাপারে। তরীর শরীর কেমন জানার জন্যে সিদাতের রাতে ঠিকমতো ঘুমও হয়নি। এজন্যে তরীর উপস্থিতির মাধ্যমেই সে তরীর সুস্থতা/অসুস্থতা পরিমাপ করতে ব্যাকুল হয়ে পরেছিলো।

তরী বিনা-বাক্যে ধপাধপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। খুব দ্রুত। যেন সিদাতের সামনে দাঁড়ানোটাই অসম্ভব ব্যাপার।

তরীকে ভেতরে আসতে দেখে ফুপি এবং সাবিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, মত বদলিয়েছে তাহলে। ফুপি মুচকি হেসে সিদাতকে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। সিদাত সেখানেই কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা ভ্রু কুচকালো। এতক্ষণে মস্তিষ্কে নাড়া দেয় ফুপির বলা কথাগুলো। এই অসুস্থতা দিয়ে ভার্সিটি যাওয়ার তো এত তাড়া থাকার তো কথা না। এছাড়াও সিদাতের যতটুকু মনে পরে, আজ সরকারি ছুটি। তাহলে তরীর তাড়া কিসে বুঝলো না। যাওয়ার জন্যে জেদ করলো আবার মিনিটের মধ্যে মতও পালটে গেলো? অদ্ভুত তো!

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১২]

–“ফুপির এভাবে ওই ভাইয়াটার সামনে এগুলো বলা উচিত হয়নি!” নিচু গলায় বললো সাবিয়া।
চোখ-মুখ তার ভার।
তরী বিছানার এক কোণে চোখ বুজে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে বসে। একমনে। সাবিয়া টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার এখন অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু বোনের চুপসে যাওয়া দেখে কিছুই বললো না। শুধুমাত্র সান্ত্বনাস্বরূপ ওই বাক্যটাই বললো। সাবিয়াও তরীর মতো কথা বলায় অপটু। কোন মুহূর্তে কী বলা উচিত তা ঠিকভাবে ঠাওর করতে পারে না। এইতো, বোন তাকে চাপা অভিযোগের স্বরে বললো,

–“পরপুরুষের সামনে ফুপি আমার নামে অভিযোগ কেন করলো রে সাবিয়া? আমার খুব বিব্রত অনুভব হচ্ছে!”

অথচ তার চাইতেও বড়ো কথা হচ্ছে তরীর চোখ জোড়া কিছুটা লাল হয়ে ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখ জোড়া রঙিন ছবি দেখতে পারবে না, অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে না। আজকের দিনেই কেন সে অসুস্থ হতে গেলো? কেন-ই বা আজই সিদাতের সম্মুখে পরতে হলো? তরীর মন আকাশে লজ্জার সাথে একরাশ দুঃখও মেঘ হয়ে জমেছে। এই দুঃখ সে মাটিচাপা দিয়ে বসে আছে। কাউকে বলছে না, বুঝতেও দিচ্ছে না। চিনচিন করছে তার মাথা। জ্বর আসছে নাকি?

সাবিয়া যখন নানা ভাবনায় মত্ত তখন হঠাৎ তরী ক্লান্তিভরা কন্ঠে বললো,
–“সিলিং ফ্যানটা বন্ধ করে দে সাবিয়া। ঠান্ডা লাগছে!”

সাবিয়ার টনক নড়তেই সে দ্রুত গিয়ে মাথার ওপরে শব্দ করে ঘোরা সিলিং ফ্যানটা বন্ধ করে দিলো। তরী ততক্ষণে পাশ থেকে উষ্ণ কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে নিলো।


সিদাতের অবসর সময় ছিলো। এজন্য ঘুরতে ঘুরতে তরীদের ভার্সিটিতে চলে আসলো। দেখলো বেশ চকচকে পরিবেশ৷ যেন কোনো প্রোগ্রাম চলছে। সিদাত কয়েকটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো। জানতে পারলো আজ চারুকলা বিভাগে প্রতিযোগিতা আছে। সিদাত চমকালো। সে যতদূর জানে তরীর মতো মেয়ে অন্তত চারুকলাতে পড়বে না।

এজন্যে সিদাত আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে কিছু হচ্ছে নাকি? ছেলে গুলো বারণ করে বললো,”শুধু চারুকলা বিভাগেই।”

সিদাত চিন্তায় পরে গেলো। পরমুহূর্তে হাসি-মুখে ছেলেগুলো কে বিদায় জানিয়ে চলে এলো!

তার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তরী তাহলে কেন অসুস্থ শরীরে ভার্সিটি আসতে চেয়েছিলো? যদি তার ক্লাস না-ই থাকে। আজ তো চারুকলার প্রোগ্রাম শুধু। আর কিছুই না। তাহলে কী তরী এই প্রতিযোগিতাতেই আসতে চেয়েছিলো? কিন্তু এটা কেন করতে যাবে? সিদাত আকাশ পাতাল ভাবলো। নীরব বন্ধু সম্পর্কে কিছুই জানে না সে। শুধু জানে নীরব বন্ধুর দুই অক্ষরের নামটি। এছাড়া কোন বর্ষ, কোন বিভাগ, কী পছন্দ, ভালো লাগা- মন্দ লাগা কিছুই জানে না। তরী-ই যে কিছুই জানতে দেয়নি।

অবশ্য সিদাতের এবার একটু শান্তি লাগছে। কার জীবনে এরকম একটা নীরব বন্ধু থাকে? তাও তরীর স্বভাবের। হোক একটু ভিন্ন, ভিন্ন অভিজ্ঞতাও নাহয় সিদাত পেলো।

সিদাত আর দেরী না করে বাইক ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। মায়ের সাথে কতদিন গল্প হয়নি।

সিদাত বাড়ী ফিরতেই দেখলো বাগানে সাঈদ সাহেব এবং বেশ কিছু কমিটির লোকেরা ছোটো-খাটো মিটিং বসিয়েছে। সাঈদের পাশে সাইফও আছে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় সাইফের মুখ জুড়ে শক্ত-পোক্ত একটা ভাব আছে। সিদাত চাপা হাসি দিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। মিনমিন করে বললো,
–“থ্যাঙ্ক গড, আমি এসব ঝামেলার মাঝে নেই!”

সিদাত সর্বপ্রথম রান্নাঘরে গিয়ে ফিরোজা খাতুনকে সালাম দিলো। ফিরোজা তখন তরকারিতে খুন্তি নাড়ছিলো। সিদাতের আকস্মিক উপস্থিতিতে কিছুটা চমকে যায়। পরমুহূর্তে আলতো হেসে সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
–“এসেছো আব্বু?”

সিদাত ফিরোজা খাতুনের শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ হাতে নিয়ে ফিরোজা খাতুনের ঘর্মাক্ত কপাল মুছে দিতে দিতে বললো,
–“হ্যাঁ। এইতো এসেছি। আজ কিন্তু বাড়িতেই লাঞ্চ করবো ছোটো মা। তোমার বেশি কিছু রান্না করার দরকার নেই!”

বলেই সিদাত চলে গেলো। আর ফিরোজা খাতুন মুগ্ধ চোখে সিদস্তের চলে যাওয়া দেখলো। এত সোনায় সোহাগা ছেলে পাওয়া ভাগ্য ক’জনের হয়? ফিরোজা খাতুন অনুভব করলো তার ভেতরে শান্তির বর্ষণ বইছে। ছেলেটাকে দেখলেই মাথায় মমতা চাড়া দিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে মমতায় জড়িয়ে নিতে। সিদাত বাড়ি না ফিরলে অস্থির অনুভব হয়। যেন সিদাতের কাছেই তার মন পরে আছে।

নিত্যদিনকার মতো জয়া ছেলের কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনছেন। সিদাতের কথায় আলাদা স্বস্তি পায় সে। ছেলেটা তার কথা বলায় কতটা পটু। কথা কেউ সিদাতের থেকে শিখুক। সিদাত তরীর বর্ণনা দিয়ে হেসে বললো,
–“শুনেছো সব মা?”

জয়া পলক ফেললো৷ সিদাত শান্তি পেলো মাকে সঙ্গ দিতে পেরে। এমন সময় সাঈদ সাহেব উঁকি দিলো রুমে। সাঈদ সাহেব ঠিকই লক্ষ্য করেছিলেন ছেলেকে ফিরতে দেখে। এজন্যই তো কোনো রকমে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা সেরে ভেতরে চলে আসলেন। বড়ো ছেলে সাইফ গিয়ে জরুই কাজে। ছেলের মুখখানা একটু দেখার জন্যেই এসেছেন। ছেলে এবং স্ত্রীকে একসাথে দেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। করুণ চোখে স্ত্রীর মুখপানে একপলক চেয়ে চলে গেলো। স্ত্রীর প্রতি চাপা অভিমান তাকে স্ত্রীর কাছাকাছি যেতে দেয় না। দূর থেকেই বেশিরভাগ সময় দেখে নেয় তাকে।

দুপুরে সকলে একসাথেই খাবার খেলো। এ যেন অনন্য অনুভূতি। সাঈদ সাহেব নিজ হাতে দুই ছেলের পাতে এটা ওটা তুলে দিয়েছে। দুই ভাই-ই নানান গল্প করতে করতে খেয়েছে। আর সাঈদ সাহেব দুই ছেলেকে একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়েছে। ছেলেরা যে সাঈদ সাহেবের ভীষণ আদরের, ভালোবাসার।

ফিরোজা খাতুন একপলক স্বামীর দিকে তো আরেক পলক ছেলেদের দিকে তাকাচ্ছে। এখানে কোথাও না কোথাও জয়ার শূন্যতা অনুভব করছে সে। মানুষটা একা ঘরে পরে আছে আর এখানে সকলে একসাথে। ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফিরোজা।

—————–
বিকালের দিকে ফুপির ছোটো ছেলে শাওন এসেছে। শাওন এবং সাবিয়া সমবয়সী। শাওনকে হুট করে তরীদের বাড়িতে দেখে ফুপি অবাক হলো। অবাক সুরে বললো,
–“একা একা তুই এখানে এসেছিস?”

শাওন দাঁত কেলিয়ে বলে,
–“বাবার রান্না খেতে আর ভালো লাগছিলো না। এজন্যে চলে এলাম। রাস্তা তো চিনি-ই!”

ফুপি এবার শাওনের কান ধরে বললো,
–“খুব বড়ো হয়ে গেছিস না? ‘বাবার রান্না খেতে ভালো লাগছিলো না!’ আহারে ঢং। এতদিন বলতি আমার রান্না ভালো লাগে না। এখন বাবা। তুই কী ভেবেছিস, তোর এসব চালাকী আমি বুঝি না?”

শাওন চাপা আর্তনাদ করে বললো,
–“লাগছে মা। ছাড়ো! কেউ দেকগে ফেলবে। মান-সম্মান আর থাকবে না আমার। আহ্!”

সৌভাগ্যবশত তরী এবং সাবিয়া নামাজ পড়ছিলো এজন্যে শাওনের এই অবস্থা কেউ-ই দেখতে পেলো না।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।